কালের বিবর্তনে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সভ্যতা গড়ে উঠে। ইউরোপে দাঁড়িয়ে ছিলো
খ্রিস্টান সভ্যতা বা খ্রিস্টান জগত। উত্তর আফ্রিকা বা পশ্চিম এশিয়ায় ছিল ইসলামি সভ্যতার
লীলাভ‚মি, দূর প্রাচ্যে ছিল চৈনিক সভ্যতা আর সীমাহীন আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর দ্বারা
বিচ্ছিন্ন আমেরিকা বা দূরপ্রতীচ্যে গড়ে উঠেছিলো মায়া, আজটেক এবং ইনকাদের দ্বারা
সুপ্রাচীন সভ্যতা। কিন্তু মজার ব্যাপার ছিল কয়েকটি সভ্যতার সঙ্গে সামান্য পারস্পরিক
যোগাযোগ থাকলেও ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত অধিকাংশ সভ্যতা ছিল আলাদা ও বিচ্ছিন্ন।
আমেরিকা ছিল সবার অলক্ষ্যে, সাহারা মরুভ‚মির দক্ষিণে আফ্রিকা সম্পর্কে ছিল খুবই কম
তথ্য জানা ছিল। দূরপ্রাচ্য থেকে কিছু পণ্য ইউরোপে প্রবেশ করতো, ক্রুসেডের সময় সামান্য
সময়ের জন্য পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের কিছু যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঐ
পর্যন্তই। নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত এই সমস্ত জনগোষ্ঠি ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত নিজেদের ধর্ম,
সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য নিয়ে আলাদাভাবে গড়ে উঠেছে। কিন্তু ইউরোপের নেতৃত্বে প্রায় পঞ্চাশ
বছরের কম সময়ে এই পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা কলম্বাস, ম্যাগগিলান, ভাস্কো-ডা-গামার মতো
কয়েকজন নাবিকের ভৌগোলিক আবিস্কার পৃথিবীটাকে বদলে দিয়েছিল। এই সব ভৌগোলিক
আবিস্কার পৃথিবীর বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী এবং সভ্যতার মধ্যে এক নতুন যোগসূত্রের বন্ধন এনে
ছিলো। ইউরোপের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো সারা পৃথিবীর উপর।
ভৌগোলিক আবিষ্কার শুধুমাত্র পৃথিবীটাকে ছোট করেই আনল না, যুগান্তকারী অর্থনৈতিক সম্পর্কও
স্থাপন করলো দেশে দেশে। ইউরোপের সঙ্গে বহিঃবিশ্বের বিপুল সম্ভারের বাণিজ্য শুরু হলো,
নতুন নতুন পণ্য ইউরোপে আসতে লাগলো, আর ইউরোপীয় পণ্য ক্রমান্বয়ে ঐসব দেশে
রফতানি শুরু হলো। ইউরোপের ব্যবসার কেন্দ্র এতদিন ধরে ছিল ভ‚মধ্যসাগরীয় অঞ্চল, এখন
তা পরিবর্তিত হয়ে উত্তর আটলান্টিকে সরে গেলো। ক্রমেই ইউরোপীয় দেশসমূহের মধ্যে
ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা শুরু হয় এবং ইউরোপীয় দেশসমূহ এশিয়া, আফ্রিকায় এবং ল্যাটিন
আমেরিকার দেশসমূহকে পরাজিত করে সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। দাস ব্যবসা শুরু
হয়। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের কারণে যখন ইউরোপ উত্তর উত্তর সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছিলো
তখন বাণিজ্যিক সংগঠনের কাঠামোর মধ্যেও পরিবর্তন আসে। আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থা,
ইনস্যুরেন্স, জয়েন্ট কোম্পানির আর্বিভাব সূচনা করে, আর এরই পথ ধরে শুরু হয় আধুনিক
পুঁজিবাদের।
ভৌগোলিক আবিস্কারের কারণ সমূহ
এতোদিন পর্যন্ত যা হয় নি অর্থ্যাৎ পৃথিবীটাকে একটি সুতোর মালায় গাঁথার প্রচেষ্টা কেন শুরু
হলো? এ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। একদল ঐতিহাসিক মনে করেন রেনেসাঁই
ভৌগোলিক আবিষ্কারের বড় কারণ। তাদের বক্তব্য হলো- রেনেসাঁর কারণে মানুষের মনে
অনুসন্ধিৎসা এবং ত্মবিশ্বাসের জন্ম হয়। অজানা অদেখাকে জয় করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে।
তাঁরা বলে থাকেন ভৌগোলিক আবিষ্কারক কলম্বাস ছিলেন প্রখ্যাত রেনেসাঁসের চিত্র শিল্পী
লিওনার্দো ভিন্সির সমসাময়িক। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক এমতের বিরোধিতা করেছেন।
সমালোচকদের মতে রেনেসাঁসের মতাদর্শে বিশ্বাসীরা ধরেই নিয়েছেন অনুসন্ধিৎসা, অজানাকে
জানার আগ্রহ মধ্যযুগীদের মধ্যে ছিল না। তাদের মতে মধ্য যুগীয় মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস
এবং অদেখাকে দেখার তীব্র আকর্ষণ ছিল। রেনেসাঁয় পন্থীরা দাবি করেন অনেক নাবিক যারা
পর্তুগাল ও স্পে ¯েনের থেকে বিশ্বজয়ে বের হয়েছিলেন তাদের জন্ম ছিলো ইতালীতে।
কিন্তু তাঁরা একথা লুকিয়ে যান যে কলম্বাসের মতো অনেক ইতালীয় নাবিক আসলে জেনোয়ার
অধিবাসী। কিন্তু ইতালিয় রেনেসাঁ জেনোয়ার অংশ গ্রহণ খুব কমই। ইতালীয় রেনেসাঁর সময়
অর্জিত কিছু ভৌগোলিক জ্ঞান নিঃসন্দেহে ভৌগোলিক অভিযানে সহায়তা করেছিলো,
কিন্তু রেনেসাঁই ভৌগোলিক আবিষ্কারের জন্ম দিয়েছে এটা সমালোচকরা মানতে রাজি নন।
তাঁদের মতে মধ্যযুগের গর্ভে ভৌগোলিক অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
(ক) বাণিজ্যিক কারণ
বেশির ভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন যে ভৌগোলিক আবিষ্কারের সবচাইতে বড় কারণ
বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের জন্য ইউরোপের প্রচেষ্টার মধ্যে নিহিত ছিলো। পৃথিবীর পাঁচটি
মহাদেশের ভিতর ইউরোপ সবচাইতে ছোট, স্বাভাবিকভাবে বহু পণ্যের জন্য ইউরোপকে নির্ভর
করতে হতো অন্য মহাদেশের উপর। ইউরোপে অনেক জিনিস উৎপন্ন হতো যেমন খাদ্য শষ্য ,
ভেড়া, গরু, হাঁসমুরগী, শাকসবজি যা জনগণের খাবার জোগানের জন্য যথেষ্ট ছিল। এছাড়া
নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে প্রচুর কাঠ, পাথর, কয়লা, লোহা, তামা, টিন ইত্যাদিও প্রচুর ইউরোপে
পাওয়া যেতো। এতদসত্তে¡ও ইউরোপকে অনেক প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য অন্য মহাদেশের
ওপর প্রাচীন কাল থেকেই দ্বারস্থ হতে হচ্ছিল। কিন্তু কিছু কিছু সামগ্রী ইউরোপে একদম উৎপন্ন
হতো না, যেমন কিছু প্রকার কাঠ, তুলা, চিনি ইত্যাদি। কিছু কিছু দ্রব্য ইউরোপে উৎপন্ন হলেও
এগুলির পর্যাপ্ত সরবরাহ ছিল না। সিল্ক, স্বর্ণ, রুপা, মূল্যবান পাথর উপরে উল্লেখিত অনেক
গুলি সামগ্রীর জন্য এশিয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে যে জিনিসটির জন্য ইউরোপ
সবচাইতে বেশি এশিয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল তা হলো মশলা। গোলমরিচ, দারুচিনি, আদা,
মরিচ,জয়ফল, লবঙ্গ, শুধুমাত্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ায় জন্মায়। ইউরোপ এগুলো
আমাদের দেশের মতো সুস্বাদু খবার তৈরি জন্য তা কিন্তু নয়। তখন ইউরোপে রিফ্রিজারেটর
আবিষ্কৃত হয় নি, মাংস সংরক্ষণের জন্য মশলার প্রয়োজন ছিল, তখন লবন দিয়ে মাংস
সংরক্ষণ করা হতো, কিন্তু তা অনেকেই পছন্দ করতো না।
পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে মশলা, চীন থেকে সিল্ক, ভারত থেকে তুলা ও
রতেœর চাহিদা এগুলোর সরবরাহের তুলনায় বেড়ে যাচ্ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রাচ্য থেকে
দ্রব্য সামগ্রীর আমদানি সরবরাহে কয়েকটি কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কিছু কিছু দ্রব্য পশুর
পিঠে করে বিরাট পথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছাত, কিছু পণ্য আরবদের ছোট জাহাজে করে
লোহিত সাগরে পৌঁছত, তারপর তা স্থলপথে ভ‚মধ্যসাগরে পৌঁছাত, সেখান থেকে ঐ-সব পণ্য
আবার জাহাজে করে ইউরোপে পাঠানো হতো। চীন থেকে ইউরোপে পণ্য পৌছতে প্রায় তিন
বছরের মতো সময় লাগত। তারপর আরব, ভেনিশীয় এবং জেনোয়ার মধ্যসত্ত¡ ভোগীদের
কারণে দ্রব্যাদির দাম বেশি পড়ত। দ্বিতীয়ত: ভ‚মধ্য সাগরের পূর্বাঞ্চল একাদশ শতাব্দী থেকে
ত‚ির্ক মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে। ইউরোপগামী সমস্ত বাণিজ্য এই সব এলাকা দিয়ে
তাদের গন্তব্যে পৌছাত। ত‚র্কিরা এসব পণ্যের উপর ট্যাক্স আরোপ করাতে পণ্যের দাম বেড়ে
যেতে লাগল। ইউরোপীয় অনেক ব্যবসায়ী ভয় পেতে লাগলেন যে তুর্কীরা চাইলে তাদের
নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় বাণিজ্য পথ একেবারে বন্ধ করে ইউরোপীয় বাণিজ্যে বিপর্যয় ঘটাতে
পারে। ইউরোপীয় বণিকদের আশঙ্কা সত্যে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল যখন ১৪৫৩
সালে তুর্কিদের হাতে কনস্টানটিনোপলের পতন হলো। যেহেতু দূরপ্রাচ্যের দ্রব্যের চাহিদা
বেড়েই চলেছিলো আর সে অনুযায়ী সরবরাহ অনিশ্চিত এবং অপর্যাপ্ত হয়ে পড়ছিলো, তাই
পশ্চিম ইউরোপের দেশ বিশেষ করে পুর্তগিজ এবং স্পেন দেশীয় বণিকরা চাইছিল ইউরোপীয়
চাহিদার উৎস মূলে প্রবেশ করে ইতালীয় ও আরব মধ্যসত্ত¡ভোগী বণিকদের বাদ দিয়ে এবং
তুর্কিদের নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে কিভাবে সরাসরি বাণিজ্য করতে পারে। স্থল পথে চীন ও ভারতে
পৌঁছা বিপদ সঙ্কুল কেননা মধ্য এশিয়ার অস্থিশীল এবং দাঙ্গাহাঙ্গামাপূর্ণ অঞ্চল অতিক্রম করা
সহজসাধ্য ছিলো না। তাছাড়া রেল আবিষ্কারের পূর্বে নৌপথেই মালামাল আনা নেওয়া করা
অপেক্ষাকৃত সস্তা ছিল।
(খ) জাতীয় রাজাদের স্বপ্ন
শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের মনে দূরপ্রাচ্যের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যের কথা মনে হচ্ছিল না, খ্রিষ্টান
জগৎ ভেঙ্গে যে সব জাতীয় রাজারা বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন
তারাও চাচ্ছিলেন উচ্চ মুনাফা প্রদান করতে পারে এমন নতুন নতুন বাণিজ্য পথ আবিষ্কৃত
হউক। এইসব রাজা যাজকদের এবং ভ‚স্বামীদের তুলনায় শক্তিশালী হতে চাচ্ছিলেন, আর এ
জন্য প্রয়োজন ছিল সম্পদের স্বর্ণ ও রোপ্যের প্রচুর মজুদ, যদি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে থাকে তাহলে
রাষ্ট্র সামরিক এবং নৌশক্তিতে বলীয়ান হতে পারে। পর্তুগালের রাজা যেমনটি ভারতবর্ষে
আসার পথ খুঁজছিলেন এবং ভারতে আসার পথ পাওয়ার পর দূর প্রাচ্যের বাণিজ্যিক উপর
একছত্র অধিকার বা মনোপোলি কায়েম করেছিলেন। স্পেনের রাজা আমেরিকা মহাদেশের
উপর বাণিজ্য কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চেয়েছিলেন যেন স্পেনীয় রাজতন্ত্র শক্তিশালী হয়। আবার
ইউরোপের অন্য শক্তিশালী রাজারা বিশেষ করে ডাচ, ফরাসি এবং ইংরেজ সম্রাটরা পর্তুগিজ
এবং স্পেনীয় একছত্র বাণিজ্য অধিকার ভেঙ্গে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাদের
দেশের নাবিক এবং ব্যবসায়ীদেরকে উৎসাহিত করেছিলেন। এইভাবে নতুন নতুন বাণিজ্য পথ
এবং অজানা দেশ ইউরোপের নজরে আসতে থাকে। নতুন দেশ আবিষ্কার এবং তার ওপর
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ইউরোপীয় জাতীয়তার স্মারক চিহ্ন হিসেবে পরিগণিত হতে লাগল।
ধর্মীয় কারণ
বাণিজ্যিক সুবিধা এবং দেশকে শক্তিশালী করার চিন্তায় যখন ব্যবসায়ী এবং রাজারা বিভোর,
তখন আর এক দল লোক ভিন্ন একটি কারণে ইউরোপের বাইরে তাদের প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট
ছিল। এরা হচ্ছেন ধর্মগুরু, পোপ, বিশপ এবং চার্চের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য যাজকরা। খ্রিস্টধর্মের
ছায়াতলে স্থান দেওয়ার জন্য, বাইবেলের বাণী এশিয়া আফ্রিকায় এবং ল্যাটিন আমেরিকায়
ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ইউরোপীয় যাযকরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলো। খ্রিস্টান ধর্ম বরাবরই একটি
মিশনারি বা প্রচারকামী ধর্ম। দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত যাজকরা ক্রুসেডের যোদ্ধাদের
সাথে মিলিত হয়ে ইসলাম থেকে নিকট প্রাচ্যকে ছিনিয়ে আনার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপকে খ্রিস্টান বানিয়ে সমস্ত খ্রিস্টান মিশনারিরা ক্রমে ক্রমে এশিয়া
এবং আফ্রিকার দিকে নজর দিচ্ছিলো। ব্যবসায়ীরা তো এই শতাব্দীতেই এই সব অঞ্চলে
বাণিজ্য দখল করতে চাচ্ছিল। ফলে ব্যবসায়ী এবং মিশনারিরা একত্রিত হয়ে তাদের উদ্দেশ্য
সাধনের জন্য পৃথিবীময় চষে বেড়াতে লাগল। অন্য কথায় ধর্মের প্রয়োজন এবং ব্যবসার দাবি
একত্রিত হয় ষোড়শ শতাব্দীতে বিশ্ব যোগাযোগের বিপ্লবী অধ্যায়ের সূচনা করল। যেসব
স্বৈরশাসকরা ব্যবসায়ী এবং নাবিকদেরকে অভিযানে বের হওয়ার জন্য সাহায্য সহোযোগিতা
করছিলেন তারা ব্যবসা বাণিজ্য দ্বারা সম্পদ লাভের সাথে সাথে ধর্মপ্রচারের আকাংক্ষাও
করছিলেন।
ভৌগোলিক জ্ঞান
ব্যবসা বা ধর্মপ্রচারের আকাংক্ষা হলেও দিগি¦জয় সম্ভব হয় না, ভৌগোলিক জ্ঞান এবং দিক
নির্ণয়ক যন্ত্রপাতির উন্নতি ছাড়া দেশ আবিষ্কারের দুঃসাহসিকতা কার্যকরী হতে পারে না। এ
রকম জ্ঞান মধ্যযুগের শেষ ভাগ থেকে ইউরোপীয়রা নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন জাতি।
বিশেষ করে আরব বণিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করছিলো। ত্রয়োদশ শতকে খ্রিস্টান
কয়েকজন দূতকে পোপ মধ্য এশিয়ার মঙ্গোল খাঁনদের দরবারে প্রেরণ করেছিলেন। ভেনিসের
পোলো পরিবারের তিন ভাই চীন দেশে গিয়েছিলেন। এদের একজন মার্কো পোলো কুবলাই
খাঁর দরবারে দীর্ঘ সতেরো বছর কাটিয়েছিলেন। আরেক জন উৎসাহী ধর্ম যাজক, মন্টি-করবিনো
প্রথমে মঙ্গোলদের সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে পরে ভারতের মাদ্রাজে একটি খিস্টান মিশন প্রতিষ্ঠা
করে সর্বশেষে চীন পাড়ি দিয়ে পিকিং-এ বসবাস শুরু করেন। পোপ ১৩০৭ সালে তাঁকে
চীনের রাজধানীর আর্ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দান করেন। পরে তাঁর পথ ধরে কয়েকজন
ইটালীয় ব্যবসায়ী দূরপ্রাচ্যে চলে আসেন। ফ্লোরেন্সের এক ব্যবসায়ী “অ গবৎপযধহঃং’ যধহফ
নড়ড়শ” নামক এক গ্রন্থে পূর্ব ও পশ্চিমের সকল বাণিজ্যিক রাস্তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। একজন
ভেনিসিয়ান ব্যবসায়ী তাঁর গ্রন্থ “ঝবপৎবঃং ড়ভ ঃযব ঋধরঃযভঁষ ঈৎঁংঁফবৎ”-এ তাঁর দেখা কয়েকটি
এশীয় শহরের বর্ণনা দিয়েছেন। ত্রয়োদশ এবং চর্তুদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের এসব প্রচেষ্টা
ক্ষণস্থায়ী হলে পরবর্তী কালের জন্য এগুলি সূদুর প্রসারী ভ‚মিকা রেখেছিলো। তাদের ভ্রমণ
বৃত্তান্ত গুলোতে চীন ও ভারত সম্পর্কে চিত্তাকর্ষক বর্ণনা রয়েছে। যেমন মার্কো পোলোর ভ্রমণ
নামক গ্রন্থে চীন, বার্মা ও জাপান সম্পর্কে বিবরণ রয়েছে। উল্লেখ্য, কুবলাই খাঁ মার্কো
পোলোকে তাঁর দূত হিসাবে জাপান ও বার্মাসহ বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করেছিলেন । এসব ভ্রমণ
কাহিনীগুলোতে সব সময় সত্যি কথা লিখিত হয়েছে এমনটি নয়। ভ্রমণকারীরা লিখেছেন
এশিয়াতে তারা এমন লোক দেখেছেন যাদের একটি মাত্র পা রয়েছে, কারো মাথার মধ্যে চক্ষু,
আবার কারো মাথা নেই, তাদের মুখটা বুকের মাঝে। এমনও বর্ণনা রয়েছে যেখানে বলা
হয়েছে এশিয়াতে একধরনের লোক বাস করে যাদের মাথা কুকুরের মাথার মতো। তাদের
আনা কাপড় সম্পর্কে ভ্রমণকারীরা লিখেছেন এক ধরণের গাছে ফুলের মতো জন্মানো মেষের
পশম থেকে এগুলো প্রস্তুত। সে যাই হোক, তাদের ভ্রমণ কাহিনী পাঠ করে ইউরোপীয়
নাকিদের মধ্যে প্রাচ্য দেশগুলোতে বিশেষ করে ক্যাথিতে (চীনের অপর নাম) পৌছার আগ্রহ
বাড়তে থাকে। জানা যায় পর্তুগালের যুবরাজ নাবিক হেনরী মার্কো পোলোর ভ্রমণ পাঠ করে
এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের উৎসাহী হয়ে ছিলেন। ভাস্কো-ডা-গামা’র নিকটে ’মার্কো
পোলোর ভ্রমণ-কাহিনী’ টি ছিল। মার্কোপোলোর বর্ণনামতো প্রাচ্যদেশীয় মণিমুক্তার ভান্ডার
ইউরোপীয় নাবিকদের কল্পনা আন্দোলিত করতে থাকে। যদি ইউরোপীয়রা স্থলপথে নিরাপদে
সেখানে না পৌঁছতে না পারে তবে তাদেরকে অবশ্যই জলপথে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বা
ক্যাথিতে পৌঁছুতে হবে।
দিক নির্ণয়ের জ্ঞান ও যন্ত্রপাতি
এককালে বিশ্বাস করা হতো পৃথিবীটা সমতল এবং একটি প্লেটের মতো গোলাকার। পৃথিবীর
উপর যদি কেউ পরিভ্রমণ করে এক সময় সে কিনারা দিয়ে পড়ে যাবে। মধ্যযুগে ভূগোল
সম্পর্কে নতুন নতুন জ্ঞান বাড়ার সাথে সাথে মানুষ আর এসব কল্পকাহিনী বিশ্বাস করছিলো
না। বরং বিশেষজ্ঞরা ক্রমে মনে করতে থাকে যে পৃথিবী বৃত্তাকার এবং অক্ষরেখার উপর
ঘুরছে। এটা বলা হতে লাগলো যে ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ আটলান্টিকের পশ্চিম উপক‚লে অবস্থিত।
সুতরাং ইউরোপ থেকে জাহাজে করে সোজা পশ্চিমে গেলেই পূর্ব এশিয়ায় পৌছানো যাবে।
একই সঙ্গে এও বিশ্বাস করা হতো যে ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং চীনে আসার ক্ষুদ্রতর সমুদ্র পথটা
পাওয়া যাবে ইউরোপের উত্তর পূর্ব অথবা আফিকার দক্ষিণ দিক বরাবর। পঞ্চদশ শতাব্দীতে
ইউরোপের নাবিকের নৌচালনা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন। ইটালির
নাবিকেরা ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে কম্পাসের ব্যবহার শুরু করেন। ধ্রæবতারার উচ্চতা মাপার
জন্য আরবদের আবিষ্কৃত এ্যাষ্ট্রেল্যাব নামক এক প্রকার যন্ত্রের সাহায্যে ইউরোপীয়রা নিরক্ষ
রেখা থেকে কৌণিক দূরত্ব (অক্ষাংশ) মাপতো।
নৌপথের চার্ট ও ম্যাপের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। মহাসমুদ্রে আগের মতো নাবিকরা হারিয়ে
যাওয়ার সম্ভাবনা তখনও ছিল। কিন্তু এ সময়ে তাঁরা সাহসের সঙ্গে অভিযানে বের হতে পারত,
কেননা হারিয়ে গেলেও তাঁরা জানতেন যে মহাউত্তাল সাগরে তাদের অবস্থান কোথায়।
ভৌগোলিক জ্ঞান আর নাবিকের যন্ত্রের উপর সাহসে ভর করে ইউরোপীয় নাবিকরা গৌরব
আর ভাগ্যের লোভে আটলান্টিকের আফ্রিকার উপক‚লে কিম্বা অজানা সমুদ্রের বুকে তরী
ভাসাল। আর এই ভাবেই পৃথিবীটাও আধুনিক জগতে প্রবেশ করল।
সারসংক্ষেপ
ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের নেতৃত্বে ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে পৃথিবীর চেহারাটাই পালটে
গেলো। আগে যেখানে এক সভ্যতা আরেক সভ্যতা বা এক দেশ আরেক দেশ সম্পর্কে খুব একটা
জানতো না তার অবসান হয়ে সভ্যতা ও দেশ সমূহ খুব কাছাকাছি এসে গেলো। এই আবিষ্কারের
ফলে ইউরোপীয় ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের অধীন হয়ে পড়ল সারা পৃথিবী। মূলত: বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের
জন্য বিশেষ করে প্রাচ্য দেশসমূহ থেকে মশলা, সিল্ক, মূল্যবান পাথর, তুলা সহজে ও সস্তায় নেওয়ার
জন্য প্রচেষ্টার মাঝেই ভৌগোলিক আবিষ্কারের শুরু। পরে বাণিজ্য ছাড়া ধর্মীয় কারণ, রাজাদের
অভিলাস ইত্যাদি কারণে ইউরোপীয়রা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ভৌগোলিক জ্ঞান এবং
নাবিকদের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতির আবিস্কার ভৌগোলিক আবিষ্কারকে সহায়তা করেছে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। ভৌগোলিক আবিষ্কারের প্রচেষ্টা শুরু হয় -
(ক) একাদশ শতাব্দীতে (খ) দ্বাদশ শতাব্দীতে
(গ) ত্রয়োদশ শতাব্দীতে (ঘ) ষোড়শ শতাব্দীতে
(২) মশলা পাওয়া যেতো -
(ক) আমেরিকায় (খ) চীনে
(গ) আরবে (ঘ) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়
(৩) ইউরোপীয়দের মশলার প্রয়োজন ছিল -
(ক) মাংস সুস্বাদু করতে (খ) মাংস সংরক্ষণ করতে
(গ) নানা খাবার তৈরি করতে (ঘ) ঔষধ বানাতে
(৪) মার্কো পোলো কোন দেশের নাগরিক ছিলেন -
(ক) চীনের (খ) ভেনিসের
(গ) ভারতের (ঘ) ইংল্যান্ডের
রচনা মূলক প্রশ্ন
১। ইউরোপীয় ভৌগোলিক আবিষ্কার পিছনে যে সব বাণিজ্যিক কারণ ছিল তা আলোচনা
করুন।
২। যে সব ভৌগোলিক জ্ঞান বৃদ্ধি ও সমুদ্র যাত্রার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের কারণে
ভৌগলিক আবিস্কার সহজ হয়েছিলো সে সম্পর্কে আলোচনা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
১। (খ), ২। (ঘ), ৩। (খ), ৪। (খ)
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ভৌগোলিক আবিস্কার সম্পর্কে রেনেসাঁস মতবাদ সঠিক নয় কেন?
২। ধর্মীয় কারণ কীভাবে ভৌগোলিক আবিষ্কারেকে প্রভাবিত করেছে।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত