নেপোলিয়নের ক্ষমতারোহন ও সাফল্যের কারণ


ভূমিকা
অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুরবস্থার কারণে ফ্রান্সের
জনসাধারণের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। ১৭৮৯ সালে সাধারণ মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে
বিপ্লবে রূপ নেয়। তারা রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রথমে একটি গণ পরিষদ গঠন করে। রাজনৈতিক ও
প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার অভাবে এ পরিষদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এদিক ফরাসি রাজতন্ত্রের পুরোধা
রাজা ষোড়শ লুইকেও বিপ্লবীরা হত্যা করায় ফ্রান্সে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বৈদেশিক আক্রমণের আশঙ্কা
দেখা দেয়। এ সময়ে বিপ্লবীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সন্ত্রাসের রাজত্ব
এবং সন্ত্রাসের রাজত্বের সময় ফ্রান্স অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শত্রæমুক্ত হলেও এই শাসকগণের অত্যাচার
ও জুলুমের ফলে সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে। অতঃপর ফ্রান্সের শাসনভার অর্পিত হয় একটি
গোষ্ঠীর ওপর। এই নতুন শাসকদের শাসনই ডাইরেকটরি ব্যবস্থা নামে পরিচিত।
ডাইরেক্টরি
১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হলে রাজতন্ত্রের পতন হয়। এর পর ফ্রান্সে বহুবিধ সমস্য দেখা দেয় এবং
শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। এমতাবস্থায় পুনরায় দেশ গঠন ও একটি শাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্য
১৭৯৫ সালে ২৬ অক্টোবর নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। নতুন শাসনতন্ত্র অনুসারে শাসন ব্যবস্থার
দায়িত্ব প্রদান করা হয় পাঁচজন ডাইরেক্টরের উপর। ডাইরেক্টরগণ পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা ডাইরেক্টরি
নামে অভিহিত।
ডাইরেক্টরির পটভূমি
১৭৮৯ সালের গণপরিষদের উপর ফ্রান্সের সংবিধান রচনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। গণপরিষদের
সদস্যগণ আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অনুকরণে ফ্রান্সের নতুন শাসনতন্ত্রের মূলনীতি নির্ধারণ
করেন যা ১৭৯১ সালে চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। নতুন সংবিধান অনুযায়ী ফ্রান্সে শাসন করার ক্ষমতা অর্পণ
করা হয় রাজা ও আইন পরিষদের উপর। রাজার ক্ষমতা সীমিত করা হলেও রাজার ভেটো প্রদানের
ক্ষমতা ছিল- এক কথায় ফ্রান্সে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
গণপরিষদ ভাঙ্গার পর নতুন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ১৭৯১ সালের ১ অক্টোবর আইন পরিষদের অধিবেশন
অনুষ্ঠিত হয়। গণপরিষদের সদস্যদেরকে আইন পরিষদ থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং শাসনতন্ত্র
রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নতুন একদল লোকের হাতে অর্পিত হয়। ফলে ঔধপড়নরহ ঈষঁন ধহফ ঈড়ৎফবষরবৎ
ঈষঁন এর উদ্ভব হয় এবং ধীরে ধীরে এ ক্লাবগুলো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।


১৭৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি ষোড়শ লুইকে হত্যা করা হলে দেশে বিদেশে ফ্রান্সের শত্রæ বৃদ্ধি পায়।
এমনকি ইউরোপের এক সম্মিলিত শক্তিজোটের আক্রমণের আশংকা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতি
মোকাবিলার জন্য নয় সদস্যের একটি বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন জননিরাপত্তা কমিটি (ঈড়সসরঃঃবব ড়ভ
চঁনষরপ ঝধভবঃু) গঠন করা হয়। এই কমিটির গিরোনডিস্ট ও জ্যাকোবিন সদস্যদের মধ্যে তিক্ততার
সম্পর্ক সৃষ্টি হলে জ্যাকোবিনরা গিরোনডিস্টদের হত্যা করে। রোবসপিয়ার (জড়নবংঢ়রবৎব), ডানটন
(উধহঃড়হ) ও মারাটের (গধৎধঃ) নেতৃত্বে ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। জ্যাকোবিনরা অত্যাচার
ও দমননীতির মাধ্যমে ফ্রান্সকে অভ্যন্তরীণ ও বহি:শত্রæ মুক্ত করার পর সন্ত্রাসের রাজত্বের (জবরমহ ড়ভ
ঞবৎৎড়ৎ) অবসান ঘটে। এ সময়ে (১৭৯৫ সালে) ফ্রান্সে নতুন শাসনতন্ত্র রচনার পাশাপাশি শাসন ব্যবস্থা
ডাইরেক্টরদের হাতে অর্পণ করা হয়।
ডাইরেক্টরির বৈশিষ্ট্য
(ক) ডাইরেক্টরগণ পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন;
(খ) তাঁরা কেবলমাত্র প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন-আইন রচনায় তাদের কোনো হাত ছিলনা;
(গ) আইন সভা কর্তৃক তৈরি আইন ডাইরেক্টরগণ প্রয়োগ করবে;
(ঘ) প্রশাসন ও আইনসভার মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে সাংবিধানিক পথে তার মীমাংসার
কোনো ব্যবস্থা ছিলনা;
(ঙ) সংকট দেখা দিলে ডাইরেক্টরগণ বলপ্রয়োগ দ্বারা আইনসভার বিরোধী সদস্যদের বহিষ্কার
করত।
ডাইরেক্টরি শাসনের বিভিন্ন দিক
ডাইরেক্টরি শাসন ব্যবস্থায় ডাইরেক্টরগণ আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়ে নি¤œলিখিত পদ্ধতি বা নীতি
অনুসরণ করতেন :
অভ্যন্তরীণ নীতি
বামপন্থী ও ডানপন্থীদের মধ্যে শক্তিসাম্য রক্ষা ডাইরেক্টরি শাসন ব্যবস্থায় প্রধান ছিলেন পাঁচজন
ডাইরেক্টর/পরিচালক। বারাস (ইধৎধং) ছিলেন এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী। ডাইরেক্টরগণ
সবসময় বামপন্থী জ্যাকবিন ও ডানপন্থী অভিজাতদের মধ্যে শক্তিসাম্য বজায় রেখে শাসন ব্যবস্থা
পরিচালনার চেষ্টা করতেন। এই দুই বিপরীতপন্থীদের মধ্যে শক্তিসাম্য রক্ষার নীতিকে বলা হত
“বাসকুল” (ইধংপঁষব) নীতি। ডাইরেক্টরগণ ভালভাবেই জানতেন যে এ দু’দলের মধ্যে কোন পক্ষ বেশি
শক্তি অর্জন করলে ডাইরেক্টরি সংবিধান ভেঙ্গে যাবে। অবশ্য ডাইরেক্টরগণ শেষ পর্যন্তএই বাসকুল
নীতি সাফল্যমন্ডিত করতে ব্যর্থ হন।
ঐতিহাসিকগণ ডাইরেক্টরি শাসনকে দুর্নীতিপূর্ণ ধনী বুর্জোয়া শাসন হিসেবে আখ্যায়িত করে এ ব্যবস্থার
তীব্র নিন্দা করেছেন। তাদের মতে রাজতন্ত্রেও ও বুর্জোয়াতন্ত্রের খারাপ অংশ নিয়ে গঠিত ডাইরেক্টরি
শাসন দুর্নীতি পরায়ণ হতে বাধ্য। তাদের নানাবিধ পরিচয় আস্তেআস্তেফুটে উঠতে থাকে। সম্পদের
বড়াই করা তাদের ফ্যাশনে পরিণত হয়। পাঁচজন ডাইরেক্টর কার্যক্ষেত্রে নির্বাচিত সদস্যের ন্যায় আচরণ
করার পরিবর্তে যেন পাঁচ জন রাজার ন্যায় ব্যবহার করতে থাকে।
মুদ্রাস্ফীতি
ডাইরেক্টরি শাসন ব্যবস্থায ডাইরেক্টরগণ শুরু থেকে নিদারুণ অর্থাভাবের সম্মুখীন হন। তথাপি তাঁরা
ব্যয় কমানোর জন্য সামান্য চেষ্টা করেননি। ১৭৯৫ সালে ডাইরেক্টরীগণের দৈনিক ৬-৮ মিলিয়ন ফ্রাঁ
আয় হওয়া সত্তে¡ও ব্যয় করত ৮০-৯০ মিিিলয়ন ফ্রাঁ। ফলে অর্থের মূল্য হ্রাস পায়। সর্বত্র আর্থিক
বিপর্যয় দেখা দেয়। লুটপাট ও ভবঘুরেদের উপদ্রব বেড়ে যায়। শস্য বিক্রি করে মূল্য হিসেবে


অ্যাসাইনাট বাতিল করে ১৭৯৭ সালে ম্যান্ডেট টেরিটারিয়াল নামে একপ্রকার নতুন কাগজি মুদ্রা প্রচলন
করা হয়। এ মুদ্রাও অচল হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে ডাইরেক্টরগণ ধাতব মুদ্রা প্রবর্তন করে। ফ্রান্সে যথেষ্ট
রূপা না থাকায় মুদ্রার সংখ্যা হ্রাস পায়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অচলাবস্থা বিরাজ করে। কৃষক ও
ছোট দোকানদারেরা দারুণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। রুটির দাম যায় বেড়ে। ফলে দরিদ্র জনসাধারণ ও
বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
ব্যাবেয়ুফের সমাজতান্ত্রিক বিদ্রোহ
ডাইরেক্টরি শাসন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরপর বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ শুরু হয়। বিদ্রোহগুলোর মধ্যে
সবচেয়ে বিখ্যাত হল বামপন্থী ব্যাবেয়ুফের (ইধনবঁভ) সমাজতান্ত্রিক বিদ্রোহ। সমগ্র ফরাসি বিপ্লবের
ইতিহাসে ব্যাবেয়ুফ হলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রকৃত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করেন
যে, সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা থাকলে সমাজে ধনী দরিদ্রের পার্থক্য থাকবে। এজন্য তিনি সম্পত্তির
ব্যক্তিগত মালিকানা লোপ করে সরকারি মালিকানা স্থাপনের কথা বলেন। তিনি সমাজে সকলের সমান
অর্থনৈতিক অধিকারের কথাও বলেন। তিনি সর্বসাধারণের ভোট দানের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান
এবং সহিংস সংগ্রামের মাধ্যমে বুর্জোয়া সমাজকে ভাঙ্গার চেষ্টা করেন; কিন্তু ডাইরেক্টরি দমন নীতির দ্বারা
ব্যাবেয়ুফের বিদ্রোহ দমন করে এবং ১৭৯৫ সালে তার মৃত্যু দন্ড দেওয়া হয়।
ব্যাবেয়ুফের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়াও সোসাইটি অব দি কোম্পানি অব জেহ (ঝড়পরবঃু ড়ভ ঃযব
ঈড়সঢ়ধহু ড়ভ ঔবয) নামে এক ধর্মোন্মাদের দল লুটপাটের মাধ্যমে এক বিভীষিকামায় পরিবেশের সৃষ্টি
করে। রাজতন্ত্রী ক্লিশিয়ান দল ও ডাইরেক্টরিকে ধ্বংসের চেষ্টা করে। ডাইরেক্টরির নির্দেশে সেনাপতি
হোসি (ঐড়পযব) এই সকল ষড়যন্ত্র ও দক্ষিণ পন্থি বিদ্রোহগুলি দৃঢ় হস্তেদমন করে।
ডাইরেক্টরির সামরিক শক্তির সাহায্য গ্রহণ
বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীদের দমন করার পর দেশে স্থিতিশীলতা আনার জন্য ডাইরেক্টরি মধ্যপন্থা বা
“বাসকুল” নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু দেশে “বাসকুল” নীতি ব্যর্থ হয়। এই সময় সেনাপতি পিসেগ্রর
(চরপযবমৎ) নেতৃত্বে আবারো দেশে রাজতন্ত্রী বিদ্রোহ মাথাচারা দিয়ে ওঠে। ১৭৯৭ সালে নির্বাচনে বহু
রাজতন্ত্রীপন্থী আইন সভায় সদস্য পদে রাজতন্ত্রের সমর্থন করায় ফ্রুক্তিদরের (ঋৎঁপযঃরফড়ৎ) সন্ত্রাস যা ৪
সেপ্টেম্বর, ১৭৯৭ সালে ডাইরেক্টরির একজন সেনাপতি নেপোলিয়নের সহায়তায় এই রাজতন্ত্রীদের
বহিষ্কার করে। কর্নোৎ (ঈধৎহড়ঃ) ও কর্নেলমি সহ ১১৮ জন নবনির্বাচিত সদস্যকে আইনসভা থেকে
বহিষ্কার করা হয়। এর পর থেকে ডাইরেক্টরি ধীরে ধীরে জনসমর্থন উপেক্ষা করতে থাকে এবং সামরিক
শক্তি বা সেনা দলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এভাবে ডাইরেক্টরি শাসনের পতনের পথ প্রস্তুত হয়।
বৈদেশিক নীতি
ডাইরেক্টরেরা ক্ষমতায় আসার পর তাদের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দেয় যে তারা বিরাজমান যুদ্ধ
অব্যাহত রাখবে কিনা?
(১) প্রথম জোটের কারণ : বিপ্লবী ফ্রান্সের সঙ্গে ইউরোপীয় রাজ শক্তিগুলির যুদ্ধ বাধলে ফ্রান্স বেলজিয়াম
দখল করে। এতে আতঙ্কিক ইংল্যান্ড ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রথম শক্তি জোট গঠন করে। প্রাশিয়া, হল্যান্ড ও
স্পেন এই জোট ত্যাগ করায় জোট স্থায়ী হয়নি। অস্ট্রিয়া ও ইংল্যান্ড এতে না দমে ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ
অব্যাহত রাখে। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার এই বিরোধিতার কারণ ছিল প্রথমত, বেলজিয়ামে ফরাসি সৈন্যের
উপস্থিতি অস্ট্রিয়া সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলনা। দ্বিতীয়ত, বেলজিয়ামে ফরাসি সেনার উপস্থিতি ইংল্যান্ডের
নিরাপত্তার পক্ষে বিঘœ সৃষ্টি করে। তৃতীয়ত, শেল্ট নদীকে অবাধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য ফরাসিরা
খুলে দেওয়ায় হল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বাণিজ্য বিপন্ন হয়। চতুর্থত, ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত দ্রব্যের
উপর ফ্রান্স অত্যাধিক শুল্ক ধার্য করায় ইংল্যান্ড ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে বাধ্য হয়।


নেপোলিয়ানের অভ্যুত্থান
এই সময়ে ফ্রান্সে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের আবির্ভাব ঘটে-যিনি চিরাচরিত যুদ্ধের কায়দা- কৌশল ত্যাগ
করে নিজস্ব কৌশলে যুদ্ধ করে যথেষ্ট সফলতা লাভ করেন। ইতিমধ্যে প্রধান ডাইরেক্টর ব্যারাসের
উপপতœী মাদাম থেরেসা তালিয়নের সুনজরে তিনি পড়েন। প্রতিভার সাথে সৌভাগ্যের সংমিশ্রনে
নেপোলিয়নের উন্নতির পথ প্রশস্তহয় এবং তিনি দ্রæত উন্নতি করেন। অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য
ডাইরেক্টরি সরকার যে নতুন কৌশল গ্রহণ করে তাতে দু’দিক থেকে অস্ট্রিয়াকে আঘাত হানার ব্যবস্থা
করা হয়। আর একটি নেপোলিয়নের নেতৃত্বে আল্পস পর্বতের গিরিপথ ধরে ইতালিতে অবস্থিত অস্ট্রিয়ার
প্রধান সেনাদলকে আক্রমণ করে। ২৭ বছর বয়সে নেপোলিয়ন ইতালি আক্রমণ করে বিরল সাফল্য লাভ
করেন। রণশাস্ত্রের একজন পন্ডিত অভিমত প্রকাশ করেন-নেপোলিয়ন ইতালি যুদ্ধে যে রণ পরিকল্পনা
নেন তা একমাত্র নেপোলিয়নের পক্ষেই বাস্তবায়িত করা সম্ভব ছিল।
লোদি ও রিভোলির যুদ্ধ জয়
নেপেলিয়ন ইতালিতে বা একের পর এক যুদ্ধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল
সার্দেনিয়া মৈত্রী থেকে অস্ট্রিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে উভয়কেই ধ্বংস করা। তিনি অন্যোভির যুদ্ধে
সার্দেনিয়াকে পরাজিত করে স্যাভয় ও নিস দখল করেন। ফলে সার্দেনিয়া যুদ্ধ ত্যাগ করে। অতপর
লোদির যুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়াকে মিলান থেকে তাড়িয়ে দেন। অস্ট্রিয়ার
বাহিনী ম্যাস্টুয়া দুর্গে আশ্রয় নিলে নেপোলিয়ন এই দুর্গ অবরোধ করেন। অবরুদ্ধ সৈন্যদের উদ্ধারের
জন্য অস্ট্রিয়া থেকে নতুন সৈন্যদল পৌছলে নেপোলিয়ন পর পর আরকোন ও রিভোলির যুদ্ধে তাদের
পরাজিত করেন।
১৭৯৭ সালে ম্যাস্টুয়া দুর্গের পতনের পর অস্ট্রিয়া সৈন্যবাহিনী পিছু হটতে থাকলে তাদের পিছু নিয়ে
নেপোলিয়ন ভিয়েনা নগরীকে বিপন্ন করে তোলেন। অন্য দিকে পোপ তলেনতিনোর সন্ধির মাধ্যমে
ত্র্যাভিগননের উপর তাঁর দাবি ছাড়েন। মধ্য ইতালির বলোগনা, রোমান প্রভৃতি অঞ্চলে নেপোলিয়ন
ফরাসি বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন।
ক্যাম্পো ফোর্মিওর সন্ধি
লোদি ও রিভোলির যুদ্ধে পরাজয়ের পর অস্ট্রিয়া বাধ্য হয়ে ১৭৯৭ সালে ক্যাম্পোফোর্মিও (ঈধসঢ়ড়
ঋড়ৎসরড়) এর সন্ধিতে স্বাক্ষর করে। এই সন্ধি ছিল নেপোলিয়নের প্রথম বিজয়। এ বিজয়ের মাধ্যমে
ফ্রান্স বিরাট এলাকার অধিকার লাভ করে।
প্রথম জোটের পতন
ইতালির যুদ্ধে ফ্রান্সের জয় লাভের ফলে প্রথম শক্তি জোটের পতন ঘটে। একমাত্র ইংল্যান্ড নির্ভীকভাবে
যুদ্ধ চালাতে থাকে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কান্ট্রিবের নৌ অভিযান ব্যর্থ হলে এবং সেন্ট ভিনসেন্টের যুদ্ধে
ইংরেজ নৌবহর পরাজিত করা সম্পর্কে ফ্রান্স হতাশ হয়ে পড়ে। এর পরিবর্তে ভূমধ্য সাগর পার হয়ে
মিশরের পথে ভারত অভিযানের পরিকল্পনা ডাইরেক্টরি গ্রহণ করে। ইতালির যুদ্ধে জয়লাভের ফলে
নেপোলিয়নের জনপ্রিয়তায় ডাইরেক্টররা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। ডাইরেক্টরি সভার আশা ছিল যে,
দুরুহ মিশর অভিযানে হয় নেপোলিয়নের পতন ঘটবে, নতুবা ইংল্যান্ডের পরাজয় হবে। ফলে যে
কোনো দিক থেকে তারা লাভবান হবে। এ সময় ফ্রান্সের সীমান্তছিল সুরক্ষিত। প্রতিবেশী অঞ্চলগুলো
ছিল ফ্রান্সের অধীনস্ত। সুতরাং, সুদুর মিশরে অভিযান পাঠানো বাধা ছিল না।
মিশর অভিযান
ভারতবর্ষ থেকে সমুদ্র পথে ইংল্যান্ডে সম্পদ আসত। ভারতবর্ষ ছিল ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বৃহৎ
উপনিবেশ। সুতরাং, ভারত থেকে সম্পদ আনা বন্ধ করার জন্য স্থল পথে মিশর হয়ে ভারত আক্রমণের
পরিকল্পনা ফরাসি সরকার গ্রহণ করে। এ উদ্দেশ্যে ১৭৯৮ সালে তুর্লো বন্দর থেকে ৪০ হাজার সেনা

৪০০ রণতরী সহ নেপোলিয়ন মিশর যাত্রা করেন। একই বছর নেপোলিয়ন পিরামিডের যুদ্ধে মিশরের
ম্যামেলুকদের পরাজিত করেন। কিন্তু ইংরেজ সেনাপতি নীল নদের যুদ্ধে ফরাসি নৌবাহিনী ধ্বংস করলে
নেপোলিয়নের বাহিনীর সংগে ফরাসি দেশের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফ্রান্স থেকে সৈন্য ও রসদ
সরবরাহ বন্ধ হলে নেপোলিয়নের অগ্রগতি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তুরস্ক নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে চলে যায়।
মিশর অভিযান ব্যর্থ হওয়ায় নেপোলিয়ন ফ্রান্সে ফিরে আসেন।
ডাইরেক্টরি শাসনের কৃতিত্ব
অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ডাইরেক্টরির আমলে দুর্নীতি ও কুশাসন ছাড়া আর কিছু ছিলনা।
তবে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বিখ্যাত শাসন সংস্কার গুলির রূপরেখা বা বøুপ্রিন্ট (ইষঁব চৎরহঃ) এই
আমলেই শুরু হয়। তাই অনেকে ডাইরেক্টরিকে নেপোলিয়নের শাসন সংস্কারের সূচনা বলে থাকেন।
এই সময়ের কৃতিত্বগুলো নিচে আলোচনা করা হল-
(১) ডাইরেক্টরি উগ্র অর্থনৈতিক জ্যাকোবিন মতবাদ এবং মডারেট বুর্জোয়া মতবাদের মধ্যে সমন্বয়
সাধন করে। এসময় ফ্রান্স বৈদেশিক আগ্রাসনের আশংকা থেকে মুক্ত হয়;
(২) ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত দ্রব্যের উপর উচ্চ হারে শুল্ক চাপিয়ে ডাইরেক্টরি পরোক্ষভাবে
ইংল্যান্ডকে বয়কট করার চেষ্টা করে;
(৩) ডাইরেক্টরি সরকারি ব্যয় সংকোচন নীতি, ঋণের উপর সুদের হার হ্রাস এবং প্রত্যক্ষ করের হার
কমিয়ে পরোক্ষ করের হার বাড়িয়ে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক স্থিতি আনে;
(৪) সংবিধান সভার সময় থেকে প্রদেশ ও জেলাগুলোর উপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রন বিনষ্ট হয়। ডাইরেক্টরি
গ্রামে কমিউন ও শহরে মিউনিসিপ্যালিটির কর্মচারী নিয়োগের দায়িত্ব নিজ হাতে নেয়।
ডাইরেক্টরির পতন
বিশেষ কয়েকটি ঘটনার ফলস্বরূপ ফ্রান্সে ডাইরেক্টরি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বেশিদিন এ
শাসন স্থায়ী হতে পারেনি। নি¤েœাক্ত কারণ সমূহ ডাইরেক্টরি ব্যবস্থা পতনের জন্য দায়ী বলে মনে করা
হয় :
(১) অর্থসংকটঃ নিদারুণ অর্থ সংকট ও মুদ্রস্ফীতি ডাইরেক্টরি পতনের প্রধান কারণ ছিল বলে ধারণ
করা হয়। অর্থ সংকটের ফলে ডাইরেক্টরির অনেক পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় এবং সংস্কারের প্রতি
জনগণের আস্থা হ্রাস পায়।
(২) ডাইরেক্টরগণ ছিলেন বুর্জোয়া শ্রেণীর। বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেয়ায় দরিদ্র শ্রেণীর
সমর্থন হারায়। অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ডাইরেক্টরি আমলে সর্বসাধারণের ভোটদানের অধিকার
ছিলনা। এ কারণে এর প্রকৃত গণতান্ত্রিক চরিত্রও ছিলনা।
(৩) চারিত্রিক দুর্বলতাঃ ডাইরেক্টদের ব্যক্তিগত চরিত্র ছিল কলংকিত, তাই তারা সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা
অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।
(৪) সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীলতাঃ ডাইরেক্টরগণ বিদ্রোহ দমনের জন্য জনগণের সাহায্য কামনা
না করে সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে তাদের অস্তিত্ব উচ্চাকাক্সক্ষী
সেনাপতিদের হাতে চলে যায়। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থান ও তার বিস্ময়কর সামরিক সাফল্য
ডাইরেক্টরির কৃতিত্বকে ¤øান করে দেয়।
(৫) ডাইরেক্টরিদের ভুল সিদ্ধান্তও ইউরোপীয় সমর্থন লাভে ব্যর্থতাঃ নেপোলিয়নের অনুপস্থিতির সময়
ডাইরেক্টরি তার ইউরোপীয় নীতি পরিচালনায় ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। পোপের প্রতি দুর্ব্যবহার ও
পোপকে নজরবন্দী করায় ক্যাথলিক ইউরোপে ফ্রান্সের প্রতি ঘৃণার সঞ্চার হয়। ডাইরেক্টরি ইতালি
ও সুইজারল্যান্ডে প্রচলিত শাসন ব্যবস্থা লোপ করে প্রজাতান্ত্রিক শাসন স্থাপন করায় ইউরোপীয়
রাজশক্তি গুলো বিরক্ত হয়।
এস এস এইচ এল বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস পৃষ্ঠা - ৭
(৬) ব্রুমিয়ারির অভ্যুত্থানঃ ডাইরেক্টরদের অন্যতম ত্যাবেমিয়েম ডাইরেক্টরকে ধ্বংস করার একটি
পরিকল্পনা তৈরি করেন। তিনি প্রধান ডাইরেক্টর বারাস (ইধৎধং) ও নেপোলিয়নের মধ্যে
যোগসূত্র তৈরি করে দেন এবং চক্রান্তকরে নেপোলিয়নের ভাইকে পাঁচশতের সভার সভাপতি
নিয়োগ করেন। ৯ নভেম্বর, ১৭৯৯ পাঁচশতের পরিষদে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে আক্রমণের চেষ্টা
হলে পরিষদের সভাপতি লুসিয়েন সেনাবাহিনী ডাকেন। সেনা দল পাঁচশত এর পরিষদ ভেঙ্গে
দিলে ডাইরেক্টরির পতন ঘটে। এই ঘটনাকে ব্রুমিয়ারির অভ্যুত্থান বলা হয়।
সারসংক্ষেপ
ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে অরাজকতা শুরু হলে ফ্রান্সে স্থিতিশীলতা আনার জন্য ডাইরেক্টরি শাসন
ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। নানাবিধ প্রতিকূলতা,চারিত্রিক দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ নীতির দুর্বলতার কারণে
ডাইরেক্টরগণ শাসন ব্যবস্থায় যথেষ্ট সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। অবশেষে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের
উত্থানের মাধ্যমে ১৭৯৯ সালে ডাইরেক্টরি শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটে।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যাক্তিক প্রশ্ন
১। ব্রæমিয়ারির উত্থান ঘটে কত সালে?
ক. ১৭৮৯ খ. ১৭৯৬
গ. ১৭৯৮ ঘ. ১৭৯৯
২। ডাইরেক্টরি পতনের জন্য দায়ী ছিল
ক. মুদ্রাস্ফীতি খ. বুর্জোয়া শাসন
গ. বৈদেশিক সাহায্যের অভাব ঘ. নেপোলিয়নের উত্থান
৩। ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের রাজা ছিলেন কে?
ক. রোবস পিয়ার খ.  ষোড়শ লুই
গ. নেপোলিয়ান ঘ. চতুর্থ হেনরি
৪। ম্যান্ডেট টেরিটারিয়ান কি?
ক.  এক প্রকার কাগজি মুদ্রা খ. ফ্রান্সের একটি সন্ত্রাসী ক্লাব
গ. রাজনৈতিক দল ঘ. ষোড়শ লুইয়ের হত্যা ব্যবস্থা
৫। ডাইরেক্টরদের মধ্যে প্রধান ছিলেন কে?
ক.  বারাস খ. নেপোলিয়ন
গ. এ্যাবেমিয়েস ঘ. লুসিয়েন
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ডাইরেক্টরি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পটভুমি লিখুন।
২। ডাইরেক্টরি শাসনের উল্লেখযোগ্য দিক কি কি?
৩। কেন ডাইরেক্টরি শাসনের পতন ঘটে?
৪। নেপোলিয়নের উত্থান ডাইরেক্টরি পতনের জন্য কতটুকু দায়ী বলে আপনি মনে করেন?
৫। নেপোলিয়নের দুইটি অভিযান আলোচনা করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ডাইরেক্টরি শাসন ব্যবস্থা বলিতে কি বুঝেন? ডাইরেক্টরির অভ্যন্তরীণ নীতি ও পতনের কারণ সমূহ
বিশ্লেষণ করুন।
২। ডাইরেক্টরি শাসন ব্যবস্থা ফ্রান্সে কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? আপনি কি মনে করেন ডাইরেক্টরি
শাসন সফল হয়েছিল?
৩। ডাইরেক্টরি বলতে কি বুঝেন? ডাইরেক্টরি শাসনের বৈদেশিক নীতি আলোচন করুন? কেন
ডাইরেক্টরি ব্যবস্থা স্থায়ী হতে পারেনি?

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]