মেটারনিক ব্যবস্থা
মেটারনিকের রক্ষণশীল নীতি আলোচনা করুন। কি কারণে এ নীতি ব্যর্থ হয়?


মেটারনিক ব্যবস্থা
১৮১৫ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তইউরোপের ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স
মেটারনিক। কেউ কেউ এই যুগকে ‘মেটারনিকের যুগ’ (ঊৎধ ড়ভ গবঃঃবৎহরপয) বলে আখ্যায়িত করেন।
যদি ব্যক্তির দ্বারা ইতিহাসের গতি প্রভাবিত হয়ে থাকে তবে নিঃসন্দেহে মেটারনিক ছিলেন সেই ব্যক্তি
যিনি তাঁর সময়ে ইউরোপের ইতিহাসের গতিকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। ‘প্রিন্স
মেটারনিক ছিলেন অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বা চ্যান্সেলর। তাঁর প্রভু ছিলেন অস্ট্রিয়ার
সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস এবং প্রথম ফার্দিনান্দ। তিনি রাইনল্যান্ডের অভিজাত বংশীয় লোক ছিলেন। তিনি
বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ছিলেন। আইন ও ভাষাতত্তে¡ তাঁর পারদর্শিতা ছিল। তাঁর বাকধারা ছিল
বুদ্ধিদীপ্ত। তিনি জটিল রাজনৈতিক সমস্যাগুলিকে চমৎকার ভাষায় প্রকাশ করতে পারতেন। ভিয়েনা
সম্মেলনে তিনি ছিলেন সভাপতি।
মেটারনিক খুব মার্জিত রুচির লোক হলেও তাঁর চরিত্রে একটি স্বভাবসিদ্ধ চাতুর্য ছিল। তিনি প্রতিপক্ষকে
জব্দ করতে নীচ কাজ করতে কুন্ঠা বোধ করতেন না। জার প্রথম আলেকজান্ডারের মতে মেটারনিক
ছিলেন ‘মিথ্যাবাদী’। কাসলরি তাঁকে ‘রাজনৈতিক ভাঁড়’ বলে অভিহিত করেন। নেপোলিয়নের মতে
‘মেটারনিক ছিলেন একজন চক্রান্তকারী। তিনি রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন না’ (অহ ওহঃৎরমঁবৎ হড়ঃ ধ
ংঃধঃবংসধহ)। তিনি আসলে ছিলেন একজন ভয়ানক আত্মম্ভরী ও দাম্ভিক প্রকৃতির লোক। ১৮৪৮ খ্রিঃ
ফেব্রæয়ারি বিপ্লবের সময় তিনি স্বদেশ থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন। তবু তিনি নিজ ভুল স্বীকার
না করে বলেন যে, ‘এই পৃথিবীতে হয় আমি অনেক আগে অথবা অনেক পরে এসেছি’ (ও যধাব পড়সব
রহ ঃযরং ড়িৎষফ বরঃযবৎ ঃড়ড় বধৎষু ড়ৎ ঃড়ড় ষধঃব)।
অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিক তাঁর রক্ষণশীল মতবাদের জন্য বিখ্যাত। মেটারনিকের কোনো
ংুংঃবস বা বাধাধরা প্রথা ছিল না বলে অনেক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেন। মেটারনিকের কতকগুলি
বিশেষ রাজনৈতিক বিশ্বাস বা মতামত ছিল। সেই মতামতগুলিকে কার্যকরী করার জন্য তিনি বিভিন্ন
ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাঁর নীতি কার্যকর করতে যে দেশে যেরকম নীতি গ্রহণ করা দরকার তা তিনি
করতেন। কিন্তু তিনি তাঁর এ রাজনৈতিক মতবাদকে এমনভাবে প্রয়োগ করেন যে তার নীতি মেটারনিক
তত্ত¡ হিসেবে আখ্যায়িত হয়।
বিপ্লব দমন নীতি
চরম প্রতিক্রিয়াশীল হবার কারণে মেটারনিক প্রগতিশীল আন্দোলনকে সুনজবে দেখেননি। ফরাসি
বিপ্লবের আদর্শকে তিনি ঘৃণা করতেন। তিনি জানতেন যে, বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হলে
প্রতিক্রিয়াশীলদের পতন অবসম্ভাবী। তিনি এও জানতেন যে, বিপ্লবী আন্দোলন কোনো এক দেশে
একবার ছড়িয়ে পড়লে তা সারা ইউরোপকে গ্রাস করবে। তাই অভিজাত স্বার্থ-সংরক্ষণে মধ্যযুগীয় সামন্ত
প্রথাকে সমর্থন করেছিলেন। তাই তিনি বিপ্লব যাতে না ঘটে এবং বিপ্লব ঘটলে তা কঠোর হাতে দমন


করার নীতি গ্রহণ করেন। ঈড়হপবৎঃ ড়ভ ঊঁৎড়ঢ়ব কে তিনি দারুণভাবে ব্যবহার করেন। বিদ্রোহ দমন
করার জন্য তিনি ট্রাপোর ঘোষণাপত্র প্রচার করেন। এতে বলা হয় -
১। যদি ইউরোপের কোনো দেশে বিপ্লব ঘটে এবং ফলশ্রæতিতে রাজা তার ন্যায্য অধিকার বা সিংহাসন
বঞ্চিত হন তবে, সেই দেশকে ইউরোপীয় শক্তি সমবায় থেকে বহিস্কার করা হবে।
২। যদি বিপ্লবের ফলে প্রতিবেশী দেশের শান্তিবিনষ্ট হবার সম্ভাবনা দেখা দেয় তাহলে শক্তি সমবায়
সেই বিপ্লবকে বলপূর্বক দমন করে শক্তি ও স্থিতি অবস্থা ফিরিয়ে আনবে। অর্থাৎ শক্তি সমবায়ই হবে
সকল রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অবস্থার নিয়šতা। কোনো দেশে বিপ্লব সংঘঠিত হলে তাকে সেই
দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে না দেখে আন্তর্জাতিক বিষয় হিসেবে দেখতে হবে। তিনি মনে করতেন,
যেহেতু বিপ্লব এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে তাই অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়কে আলাদা
করে দেখা সম্ভব নয়। এ ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয় যে, বিপ্লবের দ্বারা সরকার পরিবর্তন এবং সংবিধান
স্থাপন বে-আইনি। মেটারনিক তাঁর এ নীতির দ্বারা নেপলস, পিডমন্ড ও স্পেনের বিপ্লব দমন করেন।
বিদ্রোহ দমনের সাথে সাথে বিদ্রোহ যাতে না ঘটতে পারে সেজন্য তিনি নিজ দেশ অস্ট্রিয়ায় বিপ্লব
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এ ব্যবস্থার মধ্যে ছিল সকল প্রকার সংস্কার ও প্রগতিশীল ভাবধারা
নিষিদ্ধ করা। শিক্ষিত- অর্থাৎ ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে যাতে বিপ্লব অঙ্কুরিত হতে না পারে সেজন্য ছাত্র
এবং অধ্যাপকদের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়। ছাত্রদের বিদেশ গমন
এবং বিদেশী ছাত্রদের অস্ট্রিয়ার আগমন নিষিদ্ধ করা হয়। ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ নিষিদ্ধ করা হয়
যাতে করে ছাত্রদের মাঝে স্বাধীন ও যুক্তিবাদী চিন্তার বিকাশ না ঘটে। এবং সর্বোপরি শিক্ষা ব্যবস্থা
প্রতিক্রিয়াশীল ক্যাথলিক গির্জার অধীনে আানা হয় এবং পুস্তক নিয়ন্ত্রণ পরিষদ গঠিত হয়।
গণতন্ত্রের বিরুদ্ধাচারণ
মেটারনিক রাজতন্ত্রকে যেমন পছন্দ করতেন গণতন্ত্রকে তেমনি ঘৃণা করতেন। কারণ ফরাসি বিপ্লবের
ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হয় যারা রাজার ক্ষমতা বা রাজতন্ত্র, স্বৈরশাসন, অভিজাত ও পুরোহিত
অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র, ব্যক্তি- স্বাধীনতা, যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকুরী, অবাধ বাণিজ্য, জাতীয় রাষ্ট্র
ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করে যা একজন প্রতিক্রিয়াশীল শাসক কোনো ভাবে মেনে নিতে পারেনা।
মেটারনিক মনে করতেন এই ধারা সভ্যতাবিরোধী ও অশুভ এবং মধ্যবিত্তের আকাঙক্ষা হল রাজার
ক্ষমতা দখল করা। এই অশুভ ধারাগুলো যাতে ইউরোপে অশান্তিসৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য তিনি
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাবধারাকে ‘রাজনৈতিক মহামারী’ বলে ঘোষণা করে রাজাকে সকল ক্ষমতার মূল বলে
ঘোষণা করেন।
মেটারনিক মনে করতেন রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তাঁর (ঈশ্বরের) আদেশই রাজা বংশানুক্রমিকভাবে
রাজ্য শাসন করবেন। এ কারণে প্রজা রাজার আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য এবং রাষ্ট্র পরিচালনার
ব্যাপারে ঞযরৎফ ঝঃধঃব এর কোনো ভূমিকা থাকতে পারেনা। রাজা ও অভিজাতরা তার মতে ছিল
সমাজ ব্যবস্থার ধারক। একমাত্র তাদের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব, সাধারণ জনগণ দ্বারা নয়।
তাই জাতি বলতে রাজবংশ এবং রাষ্ট্র বলতে রাজাকেই বুঝাবে। রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য
ট্রাপোর ঘোষণা পত্রে তিনি বলেন-রাজা স্বেচ্ছায় ও বিনা প্ররোচনায় যে সংবিধান দান করবেন, একমাত্র
সেই সংবিধান বৈধ বলে বিবেচিত হবে।
মেটারনিকের এই নীতির উদ্দেশ্য ছিল মূলত উদারপন্থী আন্দোলনকে দমন করে রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী
করা এবং ক্ষমতাচ্যুত রাজবংশকে ক্ষমতায় পুন প্রতিষ্ঠা করা। ভিয়েনা সম্মেলনের মাধ্যমে বুরবোঁ
রাজবংশের পুনপ্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ বংশের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর
প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া ন্যায্য অধিকার নীতির আওতায় হল্যান্ডের অরেঞ্জ রাজবংশ, পোপের রাজ্য,


সার্দিনিয়া পিডমন্ট; স্যাভয় রাজবংশ স্পেন ও ইতলির নেপলস্ ও সিসিলি বুরঁবো বংশের দাবিদারকে
প্রদান করা হয়।
জার্মান নীতি
মেটারনিক জার্মানিতে তাঁর রক্ষণশীল মতবাদ প্রয়োগের জন্য বিশেষ যতœ নেন। জার্মানি ছিল অস্ট্রিয়ার
প্রতিবেশী ও অঙ্গরাজ্য। মেটারনিক তাঁর রক্ষণশীল স্থিতাবস্থা নীতি জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য
বিশেষ ব্যবস্থা নেন। এজন্য ভিয়েনা কংগ্রেসে জার্মান ঐক্যের পরিকল্পনা পেশ করলে মেটারনিক তা
নাকচ করে দেন। তাঁরই উদ্দ্যেগে জার্মানিকে ৩৯টি অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত করে একটি ফেডারেশন গঠন
করা হয়। অস্ট্রিয়া এ ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে জার্মানিতে জাতীয়তাবাদী ও উদারনৈতিক
ভাবধারাকে দমিয়ে রাখেনা। প্রাশিয়ার রাজা তৃতীয় ফেডারিক উইলিয়াম যাতে প্রাশিয়ায় উদারনৈতিক
সংবিধান চালু না করেন এজন্য তিনি প্রাশিয়ার রাজার উপর চাপ সৃষ্টি করেন। ব্যাভারিয়া, উটেমবার্গ
প্রভৃতি রাজ্যকেও তিনি উদারপন্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করেন। জার্মানির ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা জাতীয়তাবাদী ও
উদারপন্থী সংবিধানের জন্য আন্দোলন করে। মেটারনিক এই ভাবধারার প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেন।
তথাকথিত এ নৈরাজ্যবাদী শক্তিকে দমনের জন্য তিনি দমনমূলক কর্লসবাড ডিক্রি জার্মানিতে চালু
করেন। এই ডিক্রির বলে জার্মানির উদারপন্থী ছাত্র, অধ্যাপকদের নিগ্রহ করা হয়। এমনকি উদারপন্থী,
দেশপ্রেমিক ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয় ও সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ করা হয়। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ
করা হয়। জার্মান ছাত্ররা যাতে জার্মান জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত না হয় এজন্য সর্বপ্রকার চেষ্টা করা
হয়। দমননীতি প্রয়োগের জন্য মেইনজ শহরে এক বিশেষ দপ্তর স্থাপিত হয়। ১৮৩০-এর জুলাই
বিপ্লবের পর দমনমূলক কর্লসবাড ডিক্রিতে আরও কয়েকটি ধারা যুক্ত করা হয়।
ইতালি নীতি
ভিয়েনা চুক্তির দ্বারা জার্মানিতে অন্তত একটি শিথিল যুক্তরাষ্ট্র গড়া হয়। ইতালির জাতীয়তাবাদকে অগ্রাহ্য
করে ভিয়েনা চুক্তিতে মেটারনিক ইতালিতে এ রকম কোনো ব্যবস্থা গড়ার সুযোগ দেননি। তিনি
রাজনৈতিকভাবে ইতালির ঐক্য চিন্তার পরিসমাপ্তি ঘটান। প্রধান পাঁচটি ভাগে ও কয়েকটি ক্ষুদ্রভাগে
বিভক্ত ইতালির উপর তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁর রক্ষণশীল নীতি চাপিয়ে দেন। মধ্য ইতালির
হ্যাপসবার্গ শাসকরা ছিল তাঁর ক্রীড়নক। মেটারনিকের গুপ্ত পুলিশ বাহিনী অস্ট্রিয়া শাসিত লম্বার্ডি ও
ভেনিসিয়া এবং হ্যাপসবার্গ শাসিত অঞ্চলে অত্যাচার করতো। অস্ট্রিয়া শাসিত ইতালিতে জার্মান
কর্মকর্তা ইচ্ছাপূর্বক নিয়োগ করা হত। ইতালির জাতীয়তাবাদীদের দমন করার জন্য নেপোলিয়নের
আমলে কোড নেপোলিয়ন ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকুরীতে নিয়োগের ব্যবস্থা মেটারনিক লোপ করেন।
যোগ্য, দক্ষ ইতালিয় বুদ্ধিজীবিরা অবহেলিত হয়। নেপোলিয়নের আমলে যে পৌর ব্যবস্থা চালু হয়,
মেটারনিকের সমর্থনপুস্ট রক্ষণশীল শাসকরা তা বিলোপ করেন। কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঐক্য চিন্তা
দমন করে আঞ্চলিকতাকে উৎসাহ দেয়া হয়।
অস্ট্রিয়া নীতি
অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্য ছিল মেটারনিকের হাতের মুঠোয়। সুতরাং, তাঁর রক্ষণশীল নীতির সম্পূর্ণ প্রকাশ
হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্যে দেখা যায়। অস্ট্রিয়ার সকল প্রকার সংস্কার ও প্রগতিশীল ভাবধারা নিষিদ্ধ করা হয়।
ছাত্রদের ও অধ্যাপকদের গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য গোয়েন্দা নিয়োগ করা হয়। ছাত্রদের
বিদেশে অধ্যয়ন এবং বিদেশী অধ্যাপকদের অস্ট্রিয়ায় অধ্যাপনা নিষিদ্ধ করা হয়। অস্ট্রিয়ার ভেতর
‘স্থিতাবস্থা’ (ঝঃধঃঁং য়ঁড়) বজায় রাখাই ছিল মেটারনিকের একমাত্র লক্ষ্য । ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের
পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ করা হয়।
হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্যে প্রজা বিদ্রোহ দমনের জন্য মেটারনিক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ নীতি
প্রয়োগ করেন। চেক পুলিশ দ্বারা অস্ট্রিয়দের, জার্মান পুলিশ দ্বারা চেকদের, হাঙ্গেরীয় পুলিশ দ্বারা


ইতালিয়দের নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কার্ল মার্কস অস্ট্রিয়ার অবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন “সকল প্রকার কায়েমী
স্বার্থকে মেটারনিক সমর্থন করতেন”। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী দ্বারা গঠিত হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্যে ঐক্য ও
পুরাতন ব্যবস্থা রক্ষা করার জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করতেন। তাছাড়া মেটারনিক অস্ট্রিয়ার সামাজিক
ও অর্থনৈতিক জীবনে যাতে কোনো পরিবর্তন না হয় সেজন্য সচেষ্ট হন। অস্ট্রিয়া যাতে একটি কৃষি
অর্থনীতির অনগ্রসর সামন্ততান্ত্রিক দেশ হিসেবে থাকে, সেজন্য তিনি চেষ্টা চালান। অস্ট্রিয়াতে তিনি শিল্প
বিপ্লবে বাধা দেন। কারণ, তিনি আশঙ্কা করতেন যে, শিল্প বিপ্লব হলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হবে এবং
স্থিতিশীল সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে।
বলকান নীতি
অস্ট্রিয়া গ্রিসের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করে। গ্রিসে অধিকাংশ খ্রিস্টান হওয়াতে রাশিয়া
চেয়েছিল অন্য ধর্মাবলম্বীদের হাত থেকে খ্রিস্টানদের রক্ষা করতে। তাই সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে
চাইলে মেটারনিক রাশিয়াকে নিবৃত করেন। কারণ, তিনি গ্রিসের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ন্যায়সঙ্গত
শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে মনে করতেন। আরো মনে করতেন ঐ এলাকায রাশিয়ার প্রাধান্য
প্রতিষ্ঠিত হলে অস্ট্রিয়ার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
মেটারনিকের ব্যবস্থা ১৮১৫-১৮৪৮ সাল পর্যন্তমোটামুটিভাবে চলে। অবশেষে ১৮৪৮ খ্রিস্ট বিপ্লবের
আঘাতে এর পতন ঘটে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে ১৮৪৮ সালে যে ছাত্র ও শ্রমিক বিদ্রোহ ঘটে
ক্রমে তা প্রদেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। মেটারনিক ইংল্যান্ডে পলায়ন করলে তার রচিত আদর্শের পতন
ঘটে।
মেটারনিকের ব্যবস্থার ব্যর্থতা
মেটারনিক ইতিহাসের বিপরীতে চলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি রাজাদের পরামর্শ দিতেন “রাজত্ব
করুন কিন্তু সংস্কার করবেন না”। মেটারনিকের এই নীতি ছিল অনুপযোগী। ঐতিহাসিক কার্লটন
হেইজের মতে, “মেটারনিক যদিও শেক্সপীয়ারের নাটক, বিটোফোনের সঙ্গীত ও গ্যাটের কাব্যগ্রন্থ
পড়তেন তবুও তিনি তাঁর সমকালীন যুগের ভাবধারাকে স্বীকার করেননি”। দ্বিতীয়ত, তার মতবাদের
কোনো গঠনমূলক দিক ছিলনা। সংস্কার বিমুখতার কারণে নতুন ও পুরাতন আদর্শের সমন্বয় সাধন
করার চেষ্টা করেননি। তৃতীয়ত, সকল রাজার সমর্থন পাননি। ইংল্যান্ড প্রথম থেকেই তাঁর বিরোধিতা
করে। জার্মানিতে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাধতে থাকে। ফ্রান্স ও
বেলজিয়ামে মেটারনিকের ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। ফ্রান্স ইংল্যান্ডের সঙ্গে যোগ দেয়। জুলাই বিপ্লবের ফলে
তাঁর নীতি নড়বড়ে হয়ে পড়ে এবং ১৮৪৮ সালের ফেব্রæয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে তাঁর নীতির অবসান
ঘটে।
সারসংক্ষেপ
ভিয়েনা সম্মেলনের মধ্যমনি, ইউরোপে রক্ষণশীল নীতির ধারক ও বাহক মেটারনিক গণতন্ত্র ও
জাতীয়তাবাদের বিকাশের পথ রুদ্ধ এবং বিপ্লব দমন করে ধর্ম, অভিজাততন্ত্র, রাজবংশ এই তিনের
পুনপ্রতিষ্ঠা করতে যে নীতি গ্রহণ করেন তাই মেটারনিক ব্যবস্থা নামে পরিচিত। রক্ষণশীল ইউরোপ
প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মেটারনিক সফল হয়েছিলেন। ১৮১৫-১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তমেটারনিকের আধিপত্য
কমবেশি বজায় থাকে; কিন্তু তিনি প্রগতিশীল আন্দোলন সাময়িকভাবে দমাতে পারলেও নির্মূল করতে
পারেননি। ফলে প্রজা বিদ্রোহ দেখা দেয় এমনকি তাঁর নিজ দেশেও বিদ্রোহ দেখা দেয়। অবশেষে
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের আঘাতে মেটারনিকের পতন ঘটে। একই সঙ্গে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রক্ষণশীল
ইউরোপও ধ্বসে পড়ে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন


১। সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দাও।
ক. মেটারনিক কে ছিলেন?
(১) ইংল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী (২) রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী
(৩)  অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী (৪) প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী
খ. ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে মেটারনিক কোথায় পালিয়ে যান?
(১) ইংল্যান্ডে (২) ফ্রান্সে
(৩) রাশিয়ায় (৪) প্রাশিয়ায়
গ. ভিয়েনা সম্মেলনের মাধ্যমে ফ্রান্সে কোনো রাজবংশের পুন প্রতিষ্ঠা হয়?
(১) হ্যাপসবার্গ (২) অরেঞ্জ
(৩)  বুরবোঁ (৪) হ্যানোভার
ঘ. কার্লসবার্ড ডিক্রি কি?
(১) উদারপন্থী আন্দোলন দমন আইন (২) প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন দমন আইন
(৩) রক্ষণশীল মতবাদ দমন নীতি (৪) ইংল্যান্ড সরকারকে কোণঠাসা করার নীতি
ঙ. মেটারনিক কোন দেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ করেন?
(১) ফ্রান্সে (২)  অস্ট্রিয়ায়
(৩) প্রæশিয়ায় (৪) রাশিয়ায়
২। ছোট প্রশ্ন
ক. মেটারনিক ব্যবস্থা কি?
খ. মেটারনিকের বলকান নীতি ব্যাখ্যা করুন।
গ. আপনি কি মনে করেন মেটারনিক ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছিল?
ঘ. বিপ্লব দমনের জন্য মেটারনিক কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন?
৩। রচনামূলক প্রশ্ন
ক. মেটারনিক ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করুন। অস্ট্রিয়া ও ইউরোপে এ ব্যবস্থা কতখানি ফলপ্রসূ হয়েছিল?
খ. মেটারনিক ব্যবস্থা কি ইউরোপের ইতিহাসের গতি রুদ্ধ করেছিল?
গ. মেটারনিকের রক্ষণশীল নীতি আলোচনা করুন। কি কারণে এ নীতি ব্যর্থ হয়?
ঘ. ঊনবিংশ শতাব্দীর রক্ষণশীল দলের নেতা হিসেবে মেটারনিকের ভূমিকা পর্যালোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]