ফরাসি বিপ্লব ও নেপোলিয়নের যুগের পর বুরবোঁ রাজবংশ পুনরায় ফ্রান্সের সিংহাসন ফিরে পেলেও
পূর্বের সেই শক্তি ও জনসমর্থন তারা কখনই পুরোপুরি ফিরে পায়নি। মাঝে উদ্ভব ঘটে বুর্জোরা শ্রেণীর।
দেখা দেয় শ্রমিক অসন্তোষ। শ্রমিক সংঘাত হয়ে উঠে প্রকট। রাজতন্ত্রীদের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। এই
সুযোগে জাতীয়তাবাদীরা তাদের লক্ষ্য অর্জনের আন্দোলন শুরু করলে জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়। কিন্তু
জুলাই বিপ্লব স্থায়ীত্ব লাভ করতে পারেনি। জুলাই বিপ্লবের নেতারা অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপকে
সাংবিধানিক রাজা হিসেবে নির্বাচন করলে তিনি সংশোধিত চাটার বা সাংবিধান মেনে শাসন চালাতে
সম্মত হন। কিন্তু তার ব্যর্থতা ও দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক দল সমূহের মধ্যে মতভেদ শেষ পর্যন্তজুলাই
বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেয় এবং মাত্র ১৮ বছরের মধ্যে আরেকটি-বিপ্লব -ফেব্রæয়ারি বিপ্লব ঘটে যায়।
ফেব্রæয়ারি বিপ্লব সারা ইউরোপকে আন্দোলিত করলেও শেষ পর্যন্তঅধিকাংশ স্থানে এটি ব্যর্থতায়
পর্যবসিত হয়। ফ্রান্সে সমাজন্ত্রী ও প্রজাতন্ত্রী দলের মধ্যে বিরোধের ফলে ফ্রান্সে বিপ্লবের গতি স্তব্ধ হয়ে
যায়। ফ্রান্সের নতুন সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পর বোনাপার্ট দলের নেতা
লুই নেপোলিয়ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। একই ভাবে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতেও কঠোর হাতে
বিপ্লব দমন করা হয়।
জুলাই বিপ্লব ১৮৩০
এই পাঠ শেষে আপনি -
জুলাই বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে আর্থসামাজিক অবস্থার বিবরণ দিতে পারবেন;
জুলাই বিপ্লবের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন;
দশম চার্লসের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির মূল্যায়ন করতে পারবেন;
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে পারবেন;
জুলাই বিপ্লবের ফলাফল বর্ণনা করতে পারবেন, এবং ইউরোপে জুলাই বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া সমূহ
জানতে পারবেন।
জুলাই বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের আর্থ-সামাজিক অবস্থা
নেপোলিয়নের পতনের পর ভিয়েনা সম্মেলনের মাধ্যামে ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শকে বিসর্জন দেয়া
হয় এর পুরাতন রাজবংশকে পুনপ্রতিষ্ঠা করা হয়। ফরাসি বিপ্লব-উত্তর কালে ফ্রান্সে যে গণতান্ত্রিক বা
উদারনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা একেবারে মুছে দেয়া সম্ভবপর ছিলনা। ফলে অষ্টাদশ লুইকে
পুরাতনতন্ত্রের সাথে বিপ্লবী ব্যবস্থার সামঞ্জস্য করতে হয়।
ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী সময় সামন্তশ্রেণীর অবসান ঘটে। জমিদারি কৃষকদের মধ্যে বন্টিত হয়।
গির্জার সম্পত্তি কৃষকদের হাতে এসে পড়ে। এই সকল জমি পুনরায় সামন্তশ্রেণী ও গির্জা মালিকানায়
ফেরত দেওয়া সম্ভব ছিলনা। গ্রাম্য জীবনের এদের প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিল বেশি, তাই গির্জা আর
সামন্তপ্রভুর ক্ষমতা ছিলনা তাদের উচ্ছেদ করা।
ফ্রান্সের নবকৃষক শ্রেণীর আশংকা ছিল যে বুরবোঁ রাজ এবং অভিজাতরা ক্ষমতায় ফিরে এলে তাদের
জমি হাতছাড়া হতে পারে। এ কারণে বুরবোঁ সরকারকে তারা সন্দেহের চোখে দেখত। অষ্টাদশ লুই
জমির উপর কৃষকদের অধিকার স্বীকার করে নিলেও কৃষকদের ভোটাধিকার না থাকায় যে কোনো
সময় আইন সভায় তাদের অধিকার কেড়ে নেয়া হতে পারে।
ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম ফল স্বরুপ বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। প্রাক-ফরাসি যুগে যে অভিজাততন্ত্র ও
কৌলিণ্য প্রথা বিরাজমান ছিল তার বিলোপ ঘটে। শিল্প বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে কলকারখানা ও ব্যবসা
বিপুল বৃদ্ধি পায়। বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের তারতম্য অনুসারে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়। ধনী বুর্জোয়া
শ্রেণীর মধ্যে ছিল ব্যাংক মালিক, শিল্পপতি, জাহাজ কোম্পানির মালিক- এরা ছিল খুব দাম্ভিক। এরা
সহজেই অভিজাতদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলে। পাতি বুর্জোয়া শ্রেণী ছিল মূলত
দোকানদার, চাকুরে, শিক্ষক, আইনজীবি প্রমুখ- এদের সংখ্যাই ছিল বেশি।
শহরে শ্রমিক ও গ্রামের কৃষক শ্রেণীর অবস্থান ছিল বুর্জোয়া শ্রেণীর নিচে। শ্রমিকদের অবস্থা মোটেও
ভাল ছিলনা। ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের ভাগ্য ফেরাবার কোনো উপায় ছিলনা। ফ্রান্সে
ধর্মঘট ছিল নিষিদ্ধ। বুর্জোয়াদের চাপে সরকার শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন পাশ করতেও বিরত থাকে।
ফলে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ে। শিল্প শহর গুলিতে শ্রমিক ও জনতা বিপ্লবমুখী হতে থাকে। গ্রামের দরিদ্র
কৃষকের অবস্থাও খুব খারাপ ছিল। তারা উচ্চ সুদে মহাজনের নিকট হতে ঋণ নিত। দরিদ্র চাষীকে
রক্ষা করার কোনো আইন না থাকায় তাদেরকে শোষণ অব্যাহত থাকে। ফরাসি বিপ্লবোত্তর কালে
ফ্রান্সের জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। লোক সংখ্যা দ্রæত বাড়ার ফলে শহরগুলিতে বাসগৃহ,স্বাস্থ্য, পানি
প্রভৃতির সংকট দেখা দেয়। শিল্প শহরগুলিতে জনসংখ্যা বাড়ার ফলে বস্তির সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
ফ্রান্সে শিল্পের বিস্তার দ্রত ঘটছিল। বস্ত্র, ধাতু ও কয়লা শিল্পের আগ্রগতি ঘটে। বাস্প চালিত ইঞ্জিন
নির্মিত হয়। ভোগ্য পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে বিদেশ থেকে ভোগ্য পণ্য আমদানি কমিয়ে ফেলা হয়।
শিল্পের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটে। ফ্রান্সে রেল পথ নির্মাণের কাজও পিছিয়ে থাকে
নি। ১৮৪৮ খৃস্টাব্দ পর্যন্তপ্রায় ১১
/২ হাজার মাইল রেলপথ নির্মিত হয়। ফ্রান্সে নতুন বন্দরও স্থাপিত হয়।
এভাবে ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্সে আর্থ সামাজিক পরিবর্তন ঘটে।
জুলাই বিপ্লবের কারণ
১৭৮৯ সালের সমতা উদারনীতি ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ প্রভৃতি বিপ্লবী আদর্শ সাময়িকভাবে ফ্রান্সে সামন্ত
প্রথার বিলোপ ঘটায়। কিন্তু এই ব্যবস্থা দীর্ঘ স্থায়ী না হওয়ার দরুন ১৮৩০ সালের জুলাই বিপ্লব
সংঘটিত হবার পিছনের নানা রকম কারণ বিদ্যমান ছিল, যেমন ---
অষ্টাদশ লুইয়ের মধ্যপন্থা নীতি
নেপোলিয়নের পতনের পর বুরবোঁ বংশের অষ্টাদশ লুই ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি
বুরঁবো বংশের স্বভাবসুলভ স্বর্গীয় অধিকার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ষোড়শ লুইয়ের মৃত্যুর পর যে বিপ্লবী
কর্মধারা ফ্রান্সে পরিচালিত হয়েছিল অষ্টাদশ লুই তা আমলেই আনেননি, কারণ তিনি ১৮১৪ সালে তার
রাজত্বের প্রথম বছরকে তার রাজত্বের ১৯ বছর বলে গণ্য করেন। কারণ ১৯ বছর আগে ষোড়শ
লুইকে হত্যা করা হয়েছিল। তবুও অষ্টাদশ লুই একটি আপোষ মূলক নীতি নিয়ে রাজ্য শাসন শুরু
করেন। বিপ্লবের ফলে ফরাসি সমাজে যে সকল পরিবর্তন ঘটে তার সাথে পুরাতন তন্ত্রের সামঞ্জস্য
বিধান করতে অষ্টাদশ লুই সচেষ্ট হন। এবং এই নীতির ফল স্বরুপ ফ্রান্সে জনগণকে আশ্বস্তকরার জন্য
তিনি ১৮১৪ সালে একটি চার্টার বা সনদ দান করেন।
১। এই সনদে রাজা শাসন ক্ষমতার দায়িত্ব পান, ২। যুদ্ধ, সন্ধি, বৈদেশিক নীতি, কর্মচারী ও মন্ত্রী
নিয়োগের ক্ষমতা পান রাজা, ৩। আইন সভা থাকলেও আইনের চূড়ান্তঅনুমোদন করে রাজা কর্তৃক,
৪। ৩০০ ফ্রাঙ্ক কর প্রদানকারীদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। এর ফলে সারা ফ্রান্সে মাত্র ৯০ হাজার
লোক ভোটাধিকার লাভ করে, ৫। কোর্ড নেপোলিয়নকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, ৬। বিপ্লব কালের ভূমি
সংস্কারকে স্বীকার করে নেওয়া হয়, ৭। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ধর্মীয় অধিকার দেওয়া হয়।
কিন্তু এত কিছুর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় সকল ক্ষমতা রাজার হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায়। আইনসভা
ভেঙ্গে দেওয়া, মন্ত্রী নিয়োগ এবং সীমিত ভোটের অধিকার জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তিন কোটি
লোকের মধ্যে মাত্র ৯০ হাজার ভোটাধিকার লাভ করে অর্থাৎ অভিজাত আর ধনিরাই কেবল ভোটাধিকার
পান। বঞ্চিত হয় সাধারণ প্রজা। সনদের এই ত্রæটি গুলো বুরবোঁ শাসনের সাফল্যকে ব্যহত করে।
শ্রেণী সংঘাত ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উত্থান
অষ্টাদশ লুই এর শাসনামলে কয়েকটি রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে। এই দলগুলির মধ্যে তীব্র বিরোধ
ফ্রান্সকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। রয়ালিস্ট দল দেশত্যাগী অভিজাত শ্রেণী ও ধর্মযাজকদের নিয়ে
গঠিত হয়। এই দলের লক্ষ্য ফ্রান্সে যাজকতন্ত্র, পুরোহিত তন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এরা গুপ্ত
সমিতি গঠন করে বিপ্লব বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের সংঘবদ্ধ করে। অপর পক্ষে সংবিধানপন্থী দল
১৮১৪ সালের সনদ অনুসারে আপোসমূলক শাসনের পক্ষপাতি ছিল। উদারপন্থি অভিজাত ও উচ্চ
বুর্জোয়া শ্রেণী ছিল এদের সমর্থক। আবার উদারপন্থি দল মনে করত যে ১৮১৪ সালের সনদ যথেষ্ট
উদার নয়। তারা সনদ সংশোধন করে আইন সভাকে অধিকতর শক্তিশালী করার পক্ষে ছিল।
সর্বশেষে, চরমপন্থী বা র্যাডিক্যাল নামে একটি দল গড়ে ওঠে। এই দলের সদস্যরা ছিল নি¤œবুর্জোয়া
শ্রেণী। এরা মনে করত ১৮১৪ সালে সনদে ফ্রান্সের জনগণের কোনো উপকার হবেনা। গণভোট
প্রবর্তন ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলে ফ্রান্সে স্থিতি আসবে বলে তারা বিশ্বাস করতো। এদের বলা হত
সমাজতন্ত্রী। এদের সঙ্গে বোনাপোর্টবাদীরা যোগ দেয়। এই সকল দলের মধ্যে বিরোধ ফ্রান্সকে বিপ্লবের
দিকে ঠেলে দেয়।
ফরাসি বিপ্লব ও শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লবের ফলে বুরবোঁ শাসনের অবসানের ফলে সাধারণ মানুষ স্বস্তিপায়।
মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা ও বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা পেলেও ফরাসি বিপ্লবের যে নেতৃত্ব
তাদের ছিল নেপোলিয়নের পতনের পর সেটি আর থাকে নি। আবার ১৭৬০ থেকে ১৭৮০ দশকে
ইংল্যান্ডে যে শিল্প বিপ্লব হয় তার ছোয়া ফ্রান্সেও লাগে। শিল্প ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে
শহরের লোক সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এতে বুর্জোয়া শ্রেণী আরো শক্তিশালী হতে থাকে। শিল্প
বিপ্লবের সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণী শিক্ষা, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে
তাদের কোনো প্রধান্য ছিলনা। নতুন কোনো বিপ্লব ছাড়া অন্যকোনো বিকল্প আর তাদের হাতে
ছিলনা। আবার শিল্পায়ন হলেও ফ্রান্সের শ্রমিকদের অবস্থা ভাল ছিল না। ফলে শ্রমিক জনতা বিপ্লবমুখী
হতে থাকে। তাছাড়া অষ্টাদশ লুইএর মন্ত্রী সভায় প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপে সাধারণ জনগণ বিদ্রোহী
হয়ে ওঠে।
দশম চার্লসের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি
অষ্টাদশ লুইয়ের মৃত্যুর পর তারঁ ভ্রাতা দশম চালর্স উপাধি নিয়ে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। তিনি
ছিলেন উগ্র রাজতন্ত্রী দলের নেতা। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল অষ্টাদশ লুইয়ের মধ্যপন্থা নীতি পরিহার
করে যাজক ও অভিজাত তন্ত্র ফিরিয়ে আনা। ধীরে ধীরে পুরাতনতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার কৌশল
চার্লসের পছন্দ ছিলনা। তাই তিনি মন্ত্রী ভিলিলকে পদচ্যুত করে উগ্ররাজপন্থী পলিন্যাককে মন্ত্রীসভার
দায়িত্ব দেন। পলিন্যাকের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি উদারপন্থী ও প্রজাতন্ত্রী দলগুলির মধ্যে তীব্র অসন্তোষ
সৃষ্টি করে। ইতিমধ্যে ১৮৩০ সালের নির্বাচনে আইন সভায় উদারপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তারা
একটি প্রস্তাব দ্বারা পলিন্যাক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্তকরার জন্য রাজার নিকট আবেদন জানান।
অন্যদিকে প্রজাতন্ত্রী সংবাদপত্র ট্রিবিউন, ন্যাশনাল প্রভৃতি গোঁড়া স্বৈরতন্ত্রী বুরবোঁ রাজবংশের স্থলে
অর্লিয়েন্স বংশের লুই ফিলিপকে সাংবিধানিক রাজা হিসেবে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসানোর প্রস্তাব দেয়।
জুলাই অর্ডিন্যান্স
আইন সভায় উদারপন্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং প্যারিসের প্রজাতন্ত্রীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে
দশম চার্লস পলিন্যাকের পরামর্শে আইনসভা ভেঙ্গে দেন। রাজার বিশেষ অধিকার প্রয়োগ করে দশম
চার্লস জুলাই অর্ডিনান্স জারি করেন। জুলাই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ১) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা
হয়, ২) আইন সভা ভঙ্গ করা হয়, ৩) নির্বাচন আইন পরিবর্তন করে বুর্জোয়া শ্রেণীর ভোটাধিকার হরণ
করা হয়, ৪) নতুন নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হয়, ৫) অষ্টাদশ লুই এর ১৮১৪ সালের সনদ রদ
করা হয়। এ ভাবে দশম চার্লস জুলাই অর্ডিন্যাস দ্বারা পুরাতন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।
জুলাই অর্ডিন্যাসের বিরুদ্ধে উদারপন্থি ও প্রজাতন্ত্রীদলগুলো প্রতিবাদ জানায়। তারা প্যারিসের রাস্তায়
অবরোধ গড়ে রাজকীয় বাহিনীর সাথে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। প্যারিসের মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিদ্রোহীদের পক্ষে
যোগ দেয়। জনগণের উগ্রমূর্তি প্রত্যক্ষ করে দশম চার্লস জুলাই অর্ডিন্যাস প্রত্যাহার করে নিলেও
বিদ্রোহীরা তাঁর পদত্যাগ দাবি করে। শেষ পর্যন্ত৩০ জুলাই দশম চার্লস তাঁর পৌত্র ডিউক অব বের্দোর
অনুকূলে পদত্যাগ করেন। কিন্তু বিপ্লবীরা বুরবোঁ বংশের দাবি উপেক্ষা করে অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই
ফিলিপকে মনোনীত করে। আইন সভা লুই ফিলিপকে সাংবিধানিক রাজা হিসেবে ঘোষণা করে। দশম
চার্লস ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন। এভাবে জুলাই বিপ্লব সম্পন্ন হয়।
জুলাই বিপ্লবের ফলাফল
১৮৩০ সালে জুলাই বিপ্লবের ফলে বুরবোঁ বংশীয় দশম চার্লস সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং
বুরবোঁ বংশের পতন ঘটে। দশম চার্লসকে পদচ্যুত করে ফ্রান্সের আইন সভা অর্লিয়েন্স বংশীয়
ফিলিপকে সাংবিধানিক শাসক হিসেবে নির্বাচন করে। ঐতিহাসিক কোব্বান মন্তব্য করেন যে, জুলাই
বিপ্লব মূলত একটি রক্ষণশীল বিপ্লব ছিল। কারণ এই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের সিংহাসনে এক রাজবংশের
পরিবর্তে আরেকটি রাজবংশ আসীন হয়। এই বিপ্লবের দ্বারা সংবিধান, ভোটাধিকার, সমাজব্যবস্থার
কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি, রাজতন্ত্রের স্থলে প্রজাতন্ত্রও আসেনি।
বুর্জোয়াদের ক্ষমতা লাভ
জুলাই বিপ্লবের ফলে বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের পুরান ভোটাধিকার ফিরে পায় এবং এখন ৩০০ ফ্রাঁর
বদলে ২০০ফ্রাঁ কর প্রদানকারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়। এতে ধনী বুর্জোয়ারাই উপকৃত হয়। নি¤œ
বুর্জোয়া ও সাধারণ জনগণ এর ফলে কোনো ভোটাধিরার পায়নি। জুলাই বিপ্লবের ফলে রাষ্ট্র ক্ষমতা
হাতে পেয়ে বুর্জোয়া শ্রেণী ফ্রান্সে শিল্প সভার কাজে নেমে পড়ে। জুলাই বিপ্লবের ফলে লুই ফিলিপ
সিংহাসনে বসেন। তাকে বুর্জোয়া রাজা বলা হতো। কারণ তিনি বুর্জোয়াদের স্বার্থ দেখতেন। লুই
ফিলিপের সরকার গণভোট বা সাধারণ নির্বাচন দ্বারা গঠিত হয়নি। জুলাই বিপ্লবের এই অসম্পূর্ণতার
জন্য ফ্রান্সে ১৮৪৮সালে আরেকটি বিপ্লব প্রয়োজন হয়।
সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রবর্তন
অনেক ঐতিহাসিক জুলাই বিপ্লবকে প্রকৃত বিপ্লব বলে মনে করেন। এতে কেবল মাত্র পূর্বের অবস্থাই
ফিরে আসেনি। ভোটাধিকারে আসে পরিবর্তন। পরিবর্তন আসে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ও নতুন রাজা লুই
ফিলিপ সংবিধান মেনে শাসন করার শপথ নেন। ফলে সকল ক্ষমতা রাজার পরিবর্তে পার্লামেন্টের হাতে
বর্তায়। রাজার বিশেষ ক্ষমতা বিলোপ করে তাকে সংবিধানের অধীন আনা হয়। উগ্ররাজতন্ত্রপন্থীদের
পতন ঘটে। তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। শিক্ষা ব্যবস্থার উপর গির্জার নিয়ন্ত্রণ দূর হয়। ধর্ম
নিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। মোটকথা অভিজাত যাজক এবং স্বৈরাচার গোষ্ঠীর চিরতরে অবসান
হয়।
বুর্জোয়াদের উদ্ভব ও শিল্প বিপ্লব
জুলাই বিপ্লব হওয়ার ফলে ফ্রান্সে বুর্জোয়া শ্রেণী দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ধনী বুর্জোয়া শ্রেণী
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। এই শ্রেণী ক্ষমতা লাভ করে ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লব
সংগঠিত করে। লুই ফিলিপ নিজে এমন শিল্প নীতি নেন যার ফলে ফ্রান্স শিল্প অর্থনীতির পথে পা
বাড়ায়। ফ্রান্সে রেলপথ সহ যতাযাতের বিস্তার ঘটে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠন গঠিত হয়।
সাধারণ রাজনীতি সচেতনতা
জুলাই বিপ্লবে ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ ক্ষমতা না পেলেও তাদের মধ্যে রাজনৈতিক জাগরণ ঘটে।
রাজনৈতিক ক্লাব বা আড্ডাখানাগুলিতে নি¤œবুর্জোয়া ও শ্রমিকরা জড়ো হয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি আলোচনা
আরম্ভ করে। রাস্তায় শ্রমিক মিছিলগুলিকে জাতীয় রক্ষীদল অস্ত্র নামিয়ে সম্মান দেখায়। জুলাই বিপ্লব
নিশ্চিতভাবে নি¤œবুর্জোয়া শ্রেণী ও শ্রমিক জাগরণের সূচনা করে।
ফ্রান্সের বাইরে জুলাই বিপ্লবের ফল
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস - ২ পৃষ্ঠা-৭৭
জুলাই বিপ্লব কেবলমাত্র ফ্রান্সের ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ থাকেনি। ঐতিহাসিক ফিশারের মতে
“প্যারিসের বিপ্লবী চুল্লিহতে উড়ন্তঅগ্নি স্ফূলিঙ্গ কংগ্রেস বা কনসার্ট শাসিত ইউরোপের সারহীন
কাষ্ঠখন্ডগুলির উপর পড়লে এক দাবানল সৃষ্টি হয়”। জুলাই বিপ্লব সারা ইউরোপেই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি
করেছিল। জুলাই বিপ্লব প্রধানত ভিয়েনা চুক্তির বিরুদ্ধেই আঘাত হানে। ন্যায্য অধিকার ছিল ভিয়েনা
চুক্তির প্রধান স্তম্ভ। জুলাই বিপ্লব বুরবোঁ বংশকে উচ্ছেদ করে এবং সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্তকরে।
ফ্রান্সের বাইরে এই বিপ্লব জাতীয়তাবাদী উদার ভাবধারার প্রসার ঘটায়। বেলজিয়াম হল্যান্ড থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়। বেলজিয়ামের স্বাধীনতা ঘোষণা দ্বারা জাতীয়তাবাদ স্বীকৃত হয়। জুলাই বিপ্লবের ফলে
সুইজারল্যান্ড, স্পেন, হল্যান্ড, ইতালি ও ইংল্যান্ডের সংবিধান অধিক উদারপন্থি হয়। ইংল্যান্ডে চার্টিস্ট
আন্দোলন তীব্রতর হয়। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের নির্বাচনে ভোটাধিকার স¤প্রসারিত হয়। সুইডেনের
রাজা স্বৈরশাসন প্রত্যাহার করে নরওয়েকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। ইতালিতে ইয়ং ইতালি দল সংঘবদ্ধ
হয়। মোট কথা ১৮১৫ সালের ভিয়েনা ব্যবস্থায় এক বিরাট ফাটল সৃষ্টি হয়। ডেভিড টমসনের মতে
ইউরোপ দুই আদর্শগত শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। রাইন নদীর পশ্চিমের দেশগুলি উদারপন্থার প্রতি
আনুগত্য জানায়। এই অঞ্চলে বুর্জোয়া শ্রেণী রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। রাইনের পূর্বদিকের
দেশগুলি উদার পন্থার প্রতি আনুগত্য জানায়। এই অঞ্চলে বুর্জোয়া শ্রেণী রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রের অধীনে
থাকে। এই অঞ্চল অভিজাত শ্রেণীর ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে।
সারসংক্ষেপ
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, ফরাসি বিপ্লব-উত্তর কালের ফ্রান্সে আর্থ সামাজিক অবস্থা ও
দুর্বল রাজতান্ত্রিক শাসন ও প্রগতিশীলদের সঙ্গে সংঘর্ষ ১৮৩০ সালের বিপ্লব ঘটাতে সহায়তা করে।
সর্বোপরি প্রতিক্রিয়শীল রাজা দশম চালর্স এর চরম প্রতিক্রিয়াশীল অর্ডিন্যান্স প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে কাজ
করে। জুলাই বিপ্লব ফ্রান্সে রাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান করে সাংবিধানিক শাসন প্রবর্তন করে এবং
গণতন্ত্রের সূচনা হয়। শুধু ফ্রান্স নয় সারা ইউরোপে জুলাই বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। ইউরোপ
তার রক্ষণশীলতার বৃত্ত ভেঙ্গে জেগে উঠে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
ক) সঠিক উত্তরে টিক () চিহ্ন দিন।
১. অষ্টাদশ লুই কোন নীতি অনুসরন করেন ?
ক) চরমপন্থা খ) পরম পন্থা
গ) রক্ষণশীল নীতি ঘ) মধ্যপন্থা নীতি।
২. ফরাসি বিপ্লবে ফলে ফরাসি সমাজে কোন শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে ?
ক) জমিদার খ) বুর্জোয়া
গ) অভিজাত ঘ) যাজক
৩. জুলাই বিপ্লব কখন সংঘটিত হয় ?
ক) ১৮৩৫ খ) ১৮৪০
গ) ১৮৩০ ঘ)১৮৩৩
৪. ১৮১৪ সালের চার্টার প্রদান করেন কে ?
ক) মেটারনিক খ)দশম চালর্স
গ) অষ্টাদশ লুই ঘ) রিশলু।
৫. শিল্প বিপ্লব কখন সংঘটিত হয়েছিল?
ক) অষ্টাদশ শতকে খ) মহাদশ শতকে
গ) পঞ্চাশ শতকে ঘ) উনবিংশ শতকে।
৬. ১৮৩০ সালের নির্বাচনের কারা সংখ্যাগোরিষ্ঠতা পায়?
ক) রাজতন্ত্রীরা খ) সমাজবাদীরা
গ) র্যাডিক্যাল বা ঘ) উদারপন্থিরা।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. জুলাই বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের আর্থসামাজিক অবস্থার বর্ণনা দিন।
২. অষ্টাদশ লুই এর মধ্যপন্থা নীতি কি?
৩. ১৮৩০সালের সনদের বিবরণ দিন?
৪. ১৮৩০ সালের পূর্বে গঠিত রাজনৈতেক দলের কার্যক্রমের বর্ণনা দিন।
৫. দশম চার্লসের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি বর্ণনা দিন?
৬. ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের ফল কি ছিল?
রচনামূলক প্রশ্ন
১. জুলাই বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল কি ছিল?
২. জুলাই বিপ্লবের কারণ সমূহ আলোচনা করুন, দশম চালসের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি এর জন্য কতটা
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত