তৃতীয় নেপোলিয়ন (১৮৪৮ খ্রি)
ফেব্রæয়ারি বিপ্লবের ফলে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি পদে লুই নেপোলিয়ন নির্বাচিত হন। লুই
নেপোলিয়ন ছিলেন সম্্রাট নেপোলিয়নের ভ্রাতুষ্পুত্র। তিনি প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি অনুগত ছিলেন
না। তার লক্ষ্য ছিল তাঁর পিতৃব্যের ন্যায় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তিনি তাঁর জনপ্রিয়তার সুযোগে
সংবিধান সংশোধনীতে গণভোটের মাধ্যমে জনসাধারণের অনুমোদন নেন। পরে তিনি প্রজাতন্ত্র ধবংস
করে নিজেকে দ্বিতীয় সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন (২রা ডিসেম্বর ১৮৫১ খ্রি)। বিরোধী দলগুলিকে
তিনি প্রচন্ড দমন নীতির দ্বারা উৎখাত করেন। সম্্রাট হিসেবে তৃতীয় নেপোলিয়নের শাসনকাল ছিল
উনবিংশ শতকের ইউরোপের ইতিহাসের একটি ঘটনাবহুল যুগ। তাঁর শাসনকালে ফ্রান্স তার পিছিয়ে
থাকার নীতি ত্যাগ করে হঠাৎ প্রবল বিক্রমে ইউরোপীয় শক্তিগুলির প্রথম সারিতে অংশ গ্রহণ করে।
তৃতীয় নেপোলিয়ন বুঝতেন যে, তাঁর যুগে জাতীয়তাবাদ হল ঐতিহাসিক শক্তি। তিনি এই নীতিকে
সমর্থন করে ইতালি, জার্মানিতে জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মূখ্য ভূমিকা নেন। এর ফলে ইউরোপের মানচিত্র
পরিবর্তিত হয়। তার শাসন কালে ভিয়েনা সন্ধির দ্বারা স্থাপিত ইউরোপীয় শক্তি সাম্য ভেঙে পড়ে।
তৃতীয় নেপোলিয়ন ফ্রান্সে তার প্রগতিবাদী শাসন ও অর্থনৈতিক সংস্কার দ্বারা ইউরোপে জনকল্যাণমূলক
শাসন ব্যবস্থার অভুতপূর্ব নজির স্থাপন করেন। এই কারণে বলা হয় যে, যদিও তৃতীয় নেপোলিয়ন নিজে
বিপ্লবী ছিলেন না, তবুও তিনি ইউরোপে বহু বিপ্লব সৃষ্টি করেন”।
তৃতীয় নেপোলিয়নের অভ্যান্তরীণ শাসন ব্যবস্থা
তৃতীয় নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থা
তৃতীয় নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ শাসন নীতি ফরাসি ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন
যে, তৃতীয় নেপোলিয়নের শাসন ব্যবস্থা ছিল তার পিতৃব্য প্রথম নেপোলিয়নের অন্ধ অনুকরণ মাত্র।
তৃতীয় নেপোলিয়ন ওফবধং ড়ভ ঘবঢ়ড়ষবড়হ নামে এক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে তিনি প্রচার করেন
যে, তার পিতৃব্য মহাবীর নেপোলিয়ন ছিলেন আসলে ফরাসি বিপ্লবের সন্তান। তিনি ফরাসি বিপ্লবের
ভাবধাারার আলোকেই শাাসনকার্য পরিচালনার চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি দৃঢ় হাতে শাসন চালিয়ে
বিপ্লবের আদর্শগুলিকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার অকস্মাৎ পতনের ফলে তার কাজ অসমাপ্ত
থেকে যায়। নেপোলিয়নের উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি এ আদর্শ পালন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
বলা হয় ১৮৫২- ১৮৬০ খিৃ. পর্যন্তঅভ্যন্তরীণ শাসনের ক্ষেত্রে তৃতীয় নেপোলিয়ন একনায়কতন্ত্র ও
সংস্কার নীতি অবলম্বন করেন এবং ১৮৬০-১৮৭০ খিৃ. পর্যন্তসংস্কার সফল হলে তিনি উদার শাসন নীতি
প্রবর্তনের চেষ্টা করেন।
শৃংখলার সাথে স্বাধীনতার সমন্বয়
তৃতীয় নেপোলিয়ন মনে করতেন যে, শাসন ব্যবস্থা মজবুত ও দৃঢ় না হলে সংস্কার ধরে রাখা যাবে না।
এজন্য তিনি যে সংবিধান প্রবর্তন করেন তার মূখ্য নীতি ছিল, “শৃঙ্খলা বোধের সঙ্গে গণতান্ত্রিক
অধিকারের সমন্বয় সাধন”। কার্যত এটি ছিল স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। ক্ষমতা তিনি নিজের হাতেই রাখেন।
এই সাথে তিনি সর্বসাধারণের ভোটাধিকার ব্যবস্থাকে বহাল রাখেন। তার সাথে তিনি অঁঃযড়ৎরঃু বা
শৃঙ্খলাকে জুড়ে দেন। ফলে তার স্বৈরতন্ত্র ছিল জনসমর্থন পুষ্ট স্বৈরতন্ত্র।
আইন সভার সংগঠন ও সম্্রাটের অধিকার
তৃতীয় নেপোলিয়ন আইন সভাকে সিনেট এবং লেজিসলেটিভ বডি এই দুই কক্ষে বিভক্ত করেন।
সিনেটের সদস্যগণ সম্্রাট কর্তৃক মনোনীত হতেন। নেপোলিয়ন আইন সভা গঠনে মনোনয়ন প্রথা ও
নির্বচন প্রথার সমন্বয় করেন। তিনি আইন রচনার আিধকার আইন সভার দুটি কক্ষের মাঝে ভাগ করে
দেন। কিন্তু নির্বাচন সভার আইন রচনার বিষয়ে পূর্ণ অধিকার ছিল না। এই সভা বছরে মাত্র তিন মাস
বসতে পারত। কাউন্সিল অব স্টেট যে বিলের খসড়া পেশ করত তা বিনা বিতর্কে আইনসভা গ্রহণ
অথবা বর্জন করতে পারত। ২৬০ জন সদস্যের আইন সভায় সদস্য হতে সাধারণ নির্বাচনের সময়
নেপোলিয়নের প্রিফেক্টরা নানাভাবে নির্বাচন প্রভাবিত করত। তদুপরি আইন সভার কোনো স্বাধীন
ক্ষমতা ছিলনা। মনোনীত সিনেট বা পরিষদ যে কোনো আইনকে নাকচ করতে পারত। সিনেট তৃতীয়
নেপোলিয়নের নির্দেশেই চলত। প্রয়োজন হলে সম্্রাট অর্ডিন্যান্স দ্বারা বিশেষ ক্ষমতা বলে আইন রচনা
করতে পারতেন। আসল ক্ষমতা ছিল কাউন্সিল অব স্টেটের হাতে। সম্রাট তার মন্ত্রীদের নিয়োগ
করতেন। মন্ত্রীগণ আইনসভার কাছে তাদের কাজের জন্য দায়বদ্ধ ছিলনা। আইনসভা ছিল গণতন্ত্রের
একটি মুখোশ মাত্র। আসল ক্ষমতা ছিল সম্রাট ও তাঁর আমলাদের হাতে। তিনি ছিলেন সেনাদলের
সর্বাধিনায়ক। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন ২,৫০,০০০ দায়িত্বশীল কর্মচারীকে তিনিই মনোনীত করতেন
এবং এরা তার নির্দেশ অনুযায়ী চলত। প্রদেশের প্রিফেক্ট বা শাসনকর্তারা নেপোলিয়ন কর্তৃক নিযুক্ত
হত। তিনি বিরোধী দলগুলো ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাধীনতা হরণ করেন। দমন নীতির দ্বারা তিনি
বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন।
নতুন সংবিধানের সমালোচনা
সুতরাং, তৃতীয় নেপোলিয়ন কর্তৃক প্রবর্তিত সংবিধানে গণতন্ত্র ছিলনা। ঐতিহাসিক লিপসনের মতে
নেপোলিয়নের সংবিধান ছিল “জনপ্রিয়তার উপর প্রতিষ্ঠিত সিজারতন্ত্র” (ঈধবংধৎরংস ড়হ ধ ঢ়ড়ঢ়ঁষধৎ
নধংরং)। ডেভিড টমসনের মতে, তৃতীয় নেপলিায়নের প্রতিষ্ঠিত স্বৈরতন্ত্র বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ফ্রান্সের
জনগণ ধীরে ধীরে তার স্বরূপ বুঝতে পারে। আইনসভায় ক্রমে বিরোধীদলীয় সদস্য অধিক সংখ্যায়
নির্বাচিত হতে থাকেন। প্যারিস, মার্সাই, লায়ন্স, বোর্দো প্রভৃতি শহরের নি¤œমধ্যবিত্তরা স্বৈরতন্ত্রের
বিরোধিতা করতে থাকে। এদিকে ১৮৬০ সালের পর বৈদেশিক যুদ্ধে ব্যর্থতার দরুণ তার জনপ্রিয়তা
হ্রাস পেলে তৃতীয় নেপোলিয়ন বাধ্য হয়ে উদার শাসন নীতি গ্রহণ করেন। উদার নীতি চালু করে এবং
সংবিধানের কঠোরতা হ্্রাস করে জনপ্রিয়তা বাড়াতে চেষ্টা করেন। এজন্য ১৮৬০ খ্রি থেকে তার
শাসনব্যবস্থাকে “উদারতন্ত্রের পথে” প্রত্যাবর্তন বলা হয়। ফলে তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কিছুটা
বাড়লেও তার শাসন ব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের আস্থা বাড়েনি। নেপোলিয়নের উদার নীতি অনুসারেঃ১) লেজিসলেটিভ বডির সদস্যরা সম্রাটের প্রস্তাবের উপর বিতর্ক করার অধিকার পায়। ২) আইনসভায়
মন্ত্রীদের আত্মপক্ষ সমর্থনে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়। ৩) পার্লামেন্টের বিতর্কের বিবরণ সংবাদ পত্রে
প্রকাশ করার অধিকার দেওয়া হয়। এক কথায় সংবাদপত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করা হয় এবং
রাজনৈতিক দলগুলিকে সমালোচনার অধিকার দেয়া হয়। তিনি মন্ত্রী সভাকে আইন সভার নিকট এর
কাজের জন্য দায়িত্ববদ্ধ করেন। অন্যতম প্রধান প্রজাতন্ত্রী নেতা এমিল অলিভিয়েরকে মন্ত্রীসভা গঠনের
দায়িত্বদেন। সামরিক বিষয় ছাড়া অন্য সব বিষয়ে তিনি মন্ত্রীসভাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার
দেন। ফলে ফ্রান্সে দায়িত্বশীল মন্ত্রীসভা ও পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হয়। কিন্তু
দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের এই শেষ প্রহরে এই প্রত্যাশিত সংস্কার তাঁর শাসনব্যবস্থাকে রক্ষা করতে পারেনি।
বৈদেশিক যুদ্ধের বিপর্যয় এবং তার অতীতের স্বৈরশাসনের দায় তিনি এড়াতে পারেননি। ১৮৭০ খ্রি তাঁর
দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের পতন হয়।
তথাপি দ্বিতীয় সাম্রাজ্য প্রথম সাম্রাজ্যের অন্ধ অনুকরণ ছিলনা। তৃতীয় নেপোলিয়ন জানতেন যে,১)
যুগের পরিবর্তনের ফলে গঠনমূলক পরিবর্তনগুলি তাকে স্বীকার করতে হবে। তিনি শিল্প বিপ্লবের
প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশেষ সচেতন ছিলেন। তৃতীয় নেপোলিয়নের আমলেই ফ্রান্সে প্রকৃত শিল্প
বিপ্লব শুরু হয়। ২) তৃতীয় নেপোলিয়ন শ্রমিকশ্রেণীর দারিদ্র্য ও অসন্তোষের খবর রাখতেন। তিনি
সিংহাসনে বসার আগেই ঐড়ি ঃড় ফবংঃৎড়ু চড়াবৎঃু বা দারিদ্রতাকে কিভাবে ধবংস করা যায় এ
সম্পর্কে পুস্তক রচনা করেন। ৩) তিনি লক্ষ্য করেন যে, ফ্রান্সে বিপ্লব ও প্রতিক্রিয়াশীলতার আবর্তন
চলছে। সমাজে স্থিতি আসছেনা। এ জন্য তিনি মঙ্গলজনক নীতিগুলিকে আইনের দ্বারা চালু করে স্থিতি
প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন। গ্রেনভিলের মতে নেপোলিয়ন বিশ্বাস করতেন যে, ফ্রান্সকে ক্রম পরিবর্তনের
মাধ্যমে তিনি স্বচ্ছলতা এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা দিতে পারবেন। এই সঙ্গে তিনি ফরাসি
বিপ্লবের মূল্যবান ফলাফলগুলিকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেন।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন
দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ধবংস করে তৃতীয় নেপোলিয়ন ফরাসি জাতির যে স্বাধীনতা হরণ করেন অর্থনৈতিক ও
সামাজিক সংস্কার দ্বারা তিনি তা পূরণের চেষ্টা করেন। ১৮৫২ খ্রি তিনি তার বিখ্যাত বোর্দো বক্তৃতায়
বলেন “ফ্রান্সের চাষের উপযোগী অকর্ষিত বিশাল ভূ-খন্ডকে খাদ্য উৎপাদনের কাজে লাগাতে হবে, রাস্তা
তৈরি ও খাল খনন করতে হবে, নদীগুলিকে নৌ-বহনযোগ্য করতে হবে। এবং রেলপথ নির্মাণ সম্পূর্ণ
করতে হবে। আমার সাম্রাজ্যে এগুলিই হবে প্রধান কর্তব্য...যদি যুদ্ধ জয়ের কথা বলা হয় তবে এই
যুদ্ধগুলিই আমি জয় করতে আগ্রহী”। এই নীতিগুলি কার্যকরি করে তিনি ফ্রান্সের আর্থিক ও সামাজিক
পরিবর্তন করতে চেষ্টা করেন।
ব্যাংক ব্যবস্থা ও শিল্প বিপ্লব
শিল্প স্থাপনের জন্য নেপোলিয়ন শিল্প উদ্যোগীদের বিশেষ উৎসাহ দেন। তিনি ধনীদের সহায়তায়
ক্রেডিট মোবিলিয়ার’ নামে একটি শিল্প ব্যাংক স্থাপন করেন। এই ব্যাংকের শাখা বিভিন্ন শহরেও
স্থাপিত হয়। নতুন শিল্পে অর্থ লগ্নী করতে এবং কারখানা স্থাপনের জন্য এই ব্যাংক থেকে দীর্ঘ মেয়াদী
ঋণ দেওয়া হত। শিল্পের জন্য ঋণ দানের ব্যবস্থা করা হয়। তাছাড়া তিনি ব্যাংক অব ফ্রান্সকে পুনর্গঠন
করে মূদ্রা ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন ব্যাংকগুলির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে পুরাতন
ব্যাংকগুলিও শিল্পে অর্থলগ্নী করতে শুরু করে। এ ভাবে মূলধনের সরবরাহ বৃদ্ধি করে নেপোলিয়ন
শিল্পের দ্রæত প্রসার ঘটান। ফরাসি বিপ্লবের পর কৃষকেরা ভূমির মালিক হলেও মূলধনের অভাবে তারা
উন্নত প্রথায় কৃষির উৎপাদন করতে পারত না। তিনি কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে কৃষকদের হ্রাসকৃত সুদে
কৃষি ঋণ দানের ব্যবস্থা করেন। তিনি আদর্শ কৃষি খামার স্থাপন, উন্নয়ন, বীজের উৎপাদন, কৃষি মেলার
সংগঠন দ্বারা কৃষকদের উৎসাহিত করেন। তিনি উন্নত প্রথায় পশু পালনের উপরেও জোর দেন। তিনি
পতিত জমির পুনরুদ্ধার, জলাজমির জল নিষ্কাষন ব্যবস্থা ও অরণ্য ভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এর
দ্বারা বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয় এবং কৃষির উন্নতি হয়। রেলপথ নির্মিত হলে গ্রামের কৃষকরা
তাদের ফসলের উদ্বৃত্ত শহরে রপ্তানি করে লাভবান হয়।
শ্রমিক কল্যাণমূলক ব্যবস্থা
তৃতীয় নেপোলিয়ন ছিলেন ঘোড়ায় উপবিষ্ট সেন্ট সাইমন (ঝঃ. ঝরসড়হ ড়হ যড়ৎংবনধপশ)। তিনি
সমাজতন্ত্রবাদের সেন্ট সাইমনের আদর্শে প্রভাবিত হন। শ্রমিক কল্যাণের জন্য তিনি বেশ কয়েকটি
আইন প্রণয়ন করেন। তিনি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের স্বীকৃতি প্রদান এবং তাদের ধর্মঘট করার
অধিকার দেন (১৮৬৪ খ্রি)। বৃদ্ধ, অবসর প্রাপ্ত, রূগ্ন এবং দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তশ্রমিকের ত্রাণের জন্য
তিনি বিভিন্ন প্রকার বাধ্যতামূলক বীমা ব্যবস্থা চালু করেন। তিনি খাদ্য দ্রব্যের দাম বেধে দেন এবং
জাতীয় কর্মসংস্থান কেন্দ্র স্থাপন করে বেকার সমস্যা দূর করার চেষ্টা করেন।
অবাধ বাণিজ্য চুক্তি
১৮৬০ সালে তৃতীয় নেপোলিয়ন ব্রিটেনের সাথে কবডন চুক্তি (ঈড়নফড়হ ঞৎবধঃু) নামে এক অবাধ
বাণিজ্য চুক্তি করেন। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল বৃটেন থেকে সস্তা দামের শিল্প দ্রব্য এনে ফরাসি
জনগণের সুবিধা দেয়। কিন্তু এই ব্যবস্থার ফলে সংরক্ষণ নীতি ত্যাগ করা হয়। ফ্রান্সের নতুন শিল্প
সস্তা ব্রিটিশ দ্রব্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মার খেতে থাকে।
প্যারিস নগরীর পুনর্গঠন
তৃতীয় নেপোলিয়ন প্যারিস নগরীকে ভেঙ্গে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন
রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়। উদ্যান ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করে শহরের জীবন যাত্রার
মান উন্নত করা হয়। আদি প্যারিসের উপকন্ঠের বহু গ্রামকে নিয়ে আধুনিক প্যারিস তৈরি হয়।
প্যারিসের পুনর্গঠনের ফলে তার পুরাতন সরু বাঁকা চোরা রাস্তা চওড়া, নতুন ম্যাকাডাম রাস্তা ও ভূ-গর্ভস্থ
পয়ঃ প্রণালী তৈরি করা হয়। কলকারখানা গুলিকে শহরের বাইরে স্থানান্তর করা হয়। বাগান/পার্ক
জনাকীর্ণ শহরের ফুসফুসের কাজ করে। এই নির্মাণ কাজে বহু লোকের রূজি রোজগারের ব্যবস্থা হয়।
প্যারিস নগরীতে এক আšতর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করায় ইউরোপে ফ্রান্সের মর্যাদা বৃদ্ধি করা
হয়।
তৃতীয় নেপোলিয়নের অভ্যন্তরীণ নীতির মাঝে সামঞ্জস্য ছিলনা। তিনি একদিকে শিল্প বিস্তার নীতি গ্রহণ
করেন। এজন্য তাঁর উচিত ছিল শিল্প সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করা, কিন্তু তিনি অবাধ বাণিজ্য নীতি গ্রহণ
করায় শিল্প গুলি ক্ষতিগ্রস্তহয়। তাঁর শাসনের ফলে দেশে স্থিতি ও সমৃদ্ধি স্থাপিত হয় ইহা সত্য, কিন্তু
সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের ব্যবস্থা না করার কারণে ধনীরা আরো ধনী হয় এবং গরিব পরিণত হয় আরো
গরিবে। ঐতিহাসিক বিউরি (ইঁৎু) মনে করেন যে, তৃতীয় নেপোলিয়ন শেষ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ শাসনের
ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকেন। জনপ্রিয়তা বজায় রাখার জন্য তিনি বৈদেশিক যুদ্ধে যোগ দেন। এর
ফলে দেশে কর ভার বাড়ে। শেষ পর্যন্ততাঁর ভ্রান্তবৈদেশিক নীতি তাঁর পতন ত্বরান্বিত করে।
তৃতীয় নেপোলিয়নের বৈদেশিক নীতি
জাতীয়তাবাদী ফরাসি ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, জাতিকে যুদ্ধ জয়ের গৌরব দানের মাধ্যমে তৃতীয়
নেপোলিয়ন নিজ জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কথা ভাবেন। পূর্বের নিষ্ক্রিয় বৈদেশিক নীতির স্থলে কার্যকরি নীতি
গ্রহণ করেন। তাছাড়া তিনি ভাবেন যে, বৈদেশিক ক্ষেত্রে জয় লাভের ফলে ফরাসি জাতির স্বদেশে তাঁর
স্বৈরশাসনের বিফলতা ভুলে যাবে। তৃতীয় নেপোলিয়নের বৈদেশিক নীতির মূল লক্ষ্য ছিল গৌরবময়
বৈদেশিক নীতির দ্বারা ফ্রান্সে তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা। অন্যদিকে কোনো কোনো মধ্যপন্থী
ঐতিহাসিক বলেন যে, তিনি ব্রিটিশের সহায়তায় ভিয়েনা সন্ধির পূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে ইউরোপে
জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠন দ্বারা নতুন শক্তিসাম্য স্থাপন করতে চান। এই শক্তিসাম্যের মধ্যমণি হিসেবে
ফ্রান্সকে তিনি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। ঐতিহাসিক কার্লটন হেইজের মতে, তৃতীয় নেপোলিয়ন
ছিলেন একজন পুরোপুরি জাতীয়তাবাদী (অ ঘধঃরড়হধষরংঃ ঢ়ধৎ-বীপবষষবহপব)। ইতালি জার্মানি,
পোল্যান্ড, রুমানিয়া প্রভৃতি দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে তিনি দৃঢ় সমর্থন জানান। যেহেতু
ভিয়েনা সন্ধি ছিল জাতীয়তাবাদ-বিরোধী সেহেতু তিনি জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে
ভিয়েনা সন্ধি ভাঙ্গার আয়োজন করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে
ইউরোপের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী আদর্শ ছিল জাতীয়তাবাদ। বৃহৎ শক্তির মধ্যে প্রতিদ্ব›িদ্বতা এবং
জাতীয়তাবাদী শক্তি গুলোর অভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে তিনি ইউরোপের উপর চাপিয়ে দেওয়া ভিয়েনার
স্থিতাবস্থা ভাঙ্গতে চান। তুরস্ককে ব্যবচ্ছেদের জন্য তিনি রাশিয়ার জারের কাছে প্রস্তাব পাঠান আবার
সেই তুরস্ককে রক্ষা করার জন্যে তিনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেমে পড়েন। তার অভ্যন্তরীণ
মতের মতই তার বৈদেশিক নীতিতে স্ব-বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পক্ষ অবলম্বন
করে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে যোগ দেন। যদিও তার এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণের উপলক্ষ্য ছিল গ্রোটোর গির্জার পবিত্র
চাবি ক্যাথালিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপের হাতে রাখা। ইংল্যান্ডের সমর্থন লাভ করা ছিল তাঁর
বৈদেশিক নীতির প্রধান লক্ষ্য। যেহেতু তুরস্কের সমর্থনে ইংল্যান্ড রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়,
সেহেতু ইংল্যান্ডের সমর্থনে তিনি যুদ্ধে নামেন। রুশ জার নিকোলাস তাঁকে ‘ভূঁইফোঁড় রাজা’ বলে
তিরস্কার করায় তিনি জারকেও শিক্ষা দিতে চান। ১৮৫৬ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিসের সন্ধির দ্বারা
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান ঘটে। তৃতীয় নেপোলিয়ন প্যারিসের সভায় সভাপতিত্ব করেন। ক্রিমিয়ার
যুদ্ধের পর ফ্রান্স প্রথম সারির রাষ্ট্র হিসেবে ইউরোপে স্বীকৃত হয়। তৃতীয় নেপোলিয়নের রাজনৈতিক
প্রভাব বিশেষভাবে বাড়ে। প্যারিস ইউরোপের কূটনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়। সকল দিক থেকে বিচার
করলে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে নেপোলিয়ান যে পরিকল্পনা নিয়ে যোগ দেন তা পূরণ হয়নি। এই যুদ্ধে ফ্রান্সের
ভয়াবহ অর্থ ও লোক ব্যয় হয়। নেপোলিয়নের বিদেশমন্ত্রী এ জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে, ব্রিটেন তার
শুরু করা যুদ্ধ ফ্রান্সের ঘাড়ে ফেলে দেয়। নেপোলিয়ন ব্রিটেনের মিত্রতা রক্ষার জন্য এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি
বহন করেন। তিনি রাশিয়ার হাত থেকে পোল্যান্ডকে ছিনিয়ে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন পোল্যান্ড গঠন
করতে পারেননি। সুতরাং, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ নেপোলিয়নের ভাবমূর্তিকে বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনো দিক
থেকে লাভজনক ছিলনা।
ইতালি নীতি
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর তৃতীয় নেপোলিয়ন ইতালির দিকে দৃষ্টি দেন। জাতীয়তাবাদী ইতালির জাতীয়
ঐক্য আন্দোলনকে আন্তরিক সমর্থন দেন। তৃতীয় নেপোলিয়ন মনে করতেন যে, ভিয়েনা চুক্তি ভাঙতে
হলে ইতালিই সর্বাপেক্ষা সুবিধাজনক স্থান। জার্মানিও তুলনামূলকভাবে ইতালির ব্যাপারে একমাত্র
অস্ট্রিয়া ছাড়া অন্যান্য বৃহৎ শক্তিগুলো ছিল উদাসীন। ইতালিতে তিনি দ্রæত ও চমকপ্রদ সাফল্য আশা
করেন। ইতালির জাতীয়তাবাদেও প্রধান রূপকারের খ্যাতিও তার কাম্য ছিল। নেপেলিয়ন ইতালির
যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যোগ দিলে ও প্রæশিয়া ফ্রান্সকে আক্রমণ করার জন্য রাইন সীমান্তেসৈন্য সমাবেশ
ঘটায়। নেপোলিয়ন এই বিপদের কথা কল্পনাও করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, ফ্রান্সের দক্ষিণে একটি
ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী ইতালির উত্থান ফ্রান্সের নিজের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক বলে ফ্রান্সের
অধিকাংশ নেতা মনে করেন। এ জন্য তারা নেপোলিয়নের ইতালি অভিযানকে অপ্রয়োজনীয় বিপজ্জনক
সিদ্ধান্তবলে সমালোচনা করেন। একারণে স্বদেশে তিনি নিন্দিত হন। বৃহৎ শক্তিগুলো তাঁর হস্তক্ষেপ
নীতিকে ইউরোপের স্থিতাবস্থা বিঘœকারাী বলে চিহ্নিত করেন এবং তিনি অস্ট্রিয়ার চিরশত্রæতে পরিণত
হন। ১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্কো-জার্মান যুদ্ধের সময় তার ভয়াবহ বিপদের দিনে তিনে অস্ট্রিয়ার সাহায্য লাভে
ব্যর্থ হন।
নেপোলিয়নের ইতালীয় নীতি পরিণামে তার পক্ষে ক্ষতিকর ছিল। জাতীয়তাবাদী ইতালিয়রা স্যাভয় ও
নিস অধিকারের জন্য নেপোলিয়নকে দায়ী করে। অতৃপ্ত ইতালিয় জাতীয়তাবাদ এই দুটি স্থান ফিরে
পাবার দাবি জানায়। নেপোলিয়নের নীতির ফলে রুশ-ফরাসি সমপর্কেও দারূণ অবনতি ঘটে। ইতালির
যুদ্ধে ইংল্যান্ডকে সাথে না নিয়ে একক হস্তক্ষেপের ফলে তিনি ইংলন্ডের বন্ধুত্ব হারান। আবার তাঁর
পোলিশ নীতির জন্য তিনি রুশ জারের মিত্রতা হারান।
সাম্রাজ্যবাদী নীতি
তৃতীয় নেপোলিয়ন ইউরোপে জাতীয়তাবাদের সমর্থক হলেও ইউরোপের বাইরে তাঁর নীতি নগ্ন
সাম্রাজ্যবাদ ভিন্ন আর কিছুই ছিলনা। অথচ, ইউরোপের ভেতরে তিনি জাতীয়তাবাদের পৃষ্ঠপোষকের
ভূমিকা পালন করেন। তিনি আলজেরিয়াকে সম্পূর্ণ ফরাসি উপনিবেশে পরিণত করেন। পশ্চিম
আফ্রিকার সেনেগাল তার অধিকারে নেন। তিনি দূর প্রাচ্যে দ্বিতীয় ইঙ্গ-চীন যুদ্ধে অংশ নিয়ে চিনের
উপর ১৮৬০ সালে পিকিং সন্ধি স্থাপন করেন। ফরাসি মিশনারিদের উপর অত্যাচারের অজুহাতে তিনি
ইন্দোচীন বা ভিয়েতনাম অধিকার করেন। তিনি মিশরের সাথে যোগ দিয়ে ফার্দিনান্দ দ্য লেসেবোর
সাহায্যে সুয়েজ খাল খনন কাজ শুরু করেন।
তৃতীয় নেপোলিয়ন মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো প্রদেশে সাম্রাজ্য বিস্তারে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতিবাদে পিছু হটতে বাধ্য হন। ঐতিহাসিক হ্যাজেনের মতে “মেক্সিকো
অভিযান ছিল নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়,প্রচন্ড মূর্খতা এবং সম্পুর্ণভাবে বিপজ্জনক”।
জার্মান নীতি
তৃতীয় নেপোলিয়নের জার্মান নীতি তাঁর পতনকে ত্বরান্বিত করে। ফ্রান্সের স্থায়ী নীতি ছিল পূর্ব সীমান্তে
অবস্থিত জার্মানিকে বিভক্ত করে দুর্বল রাখা। ১৬৪৮ সাল হতে ১৮৬২ সাল পর্যন্তফ্রান্স এই নীতি
অনুকরণ করে চলে। কিন্তু তৃতীয় নেপেলিয়ন এই সনাতন নীতি অগ্রাহ্য করে জার্মানির ঐক্য প্রচেষ্টাকে
স্বাগত জানন। তিনি মনে করতেন যে জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হলে ভিয়েনা চুক্তি একেবারে ভেঙ্গে পড়বে।
জার্মানি থেকে বহি®কৃত হয়ে অস্ট্রিয়া একটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হবে। নেপোলিয়নের আশা ছিল যে,
জার্মানির পুনর্গঠন তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী হবে। নেপোলিয়নের এই পরিকল্পনা ছিল অবাস্তব। প্রথমত
ও প্রæশিয়ার বিশাল সামরিক শক্তি সম্পর্কে তার ধারণা ছিলনা। ফলে তার কাক্সিক্ষত দীর্ঘায়িত অস্ট্রো- ও
প্রæশিয়া যুদ্ধের স্থলে মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রƒশিয়া অস্ট্রিয়াকে পরাস্তকরে। ফলে তিনি মধ্যস্থের
ভূমিকা অবলম্বন করে জার্মান পুনর্গঠনের সুযোগ আর পাননি।
অস্ট্রো- প্রæশিয়া যুদ্ধের মাধ্যমে উত্তর জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হলে ফ্রান্সে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফ্রান্সের
জাতীয়তাবাদী জনমত ঐক্যবদ্ধ জার্মানির দ্বারা ফ্রান্সের নিরাপত্তা ক্ষুন্ন হওয়ার জন্য নেপোলিয়নকে দায়ী
করে। নেপোলিয়ন এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে জার্মানির নিকট একে একে রাইন প্রদেশ,
বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ -ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কিন্তু বিসমার্ক প্রতিটি দাবি নাকচ করে দেন। এজন্য
ফ্রান্সের সাথে জার্মানির সম্পর্কের দ্রæত অবনতি ঘটে। ইতিমধ্যে বিসমার্ক স্পেনের সিংহাসনে প্রশিয়ার
হোহেনজোলার্ন বংশের এক রাজপুত্রকে বসিয়ে ফ্রান্সকে বেষ্টন করার চেষ্টা করেন। এর ফলে ফ্রাঙ্কো -
প্রƒশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়। সেডানের যুদ্ধে ১৮৭০ সালে মিত্রহীন ফ্রান্সকে জার্মানি পরাস্তকরলে তৃতীয়
নেপোলিয়ন জার্মান সেনার হাতে বন্দি হন। ফরাসি পার্লামেন্ট তৃতীয় নেপোলিয়নকে পদচ্যুত করে
ফ্রান্সে তৃতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে।
তৃতীয় নেপোলিয়নের পতন
তৃতীয় নেপোলিয়ন তাঁর নামের মহিমার জোরে সম্রাট পদ লাভ করেছিলেন। প্রথম নেপোলিয়নের
আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সুশাসন প্রবর্তন করেছিলেন এবং চমকপ্রদ (ফধুুষরহম)
পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে ফরাসি জনমনে আস্থা অর্জন করে করেছিলেন। ফ্রান্সের অগ্রগতির জন্য
তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। অভ্যন্তরীণ ক্ষত্রে বিভিন্ন সংস্কার করে তিনি ফ্রান্সের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন
করেছিলেন। তার চেষ্টায় দেশের শিল্প বাণিজ্যের যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। পররাষ্ট্র ক্ষেত্রেও তিনি
তার অনুসৃত নীতির দ্বারা ফ্রান্সের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু এই সাফল্য সত্তে¡ও একাধিক
কারণে তার সাম্রাজ্যেও পতন ঘটে।
ফ্রান্সের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য তৃতীয় নেপোলিয়ন যে আপোষমূলক
নীতি অবলম্বন করেছিলেন এর ব্যর্থতা তার পতনের অন্যতম কারণ। তাঁর প্রবর্তিত সংস্কারে প্রজাতন্ত্রী
দল সন্তুষ্ট ছিলনা। ইংল্যান্ডের সাথে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করায় ফ্রান্সের শিল্পপতিগণ তাঁর প্রতি
খুশি ছিলেন না। এ ছাড়া ক্যাথলিক স¤প্রদায় তাঁর পররাস্ট্র নীতি সমর্থন করেননি এবং জাতীযতাবাদী
দল পোল্যান্ড ও মেক্সিকো সম্পর্কে নেপোলিয়নের নীতির তীব্র সমালোচনা করেছিল। বিভিন্ন দলের
মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলার মত প্রতিভা তাঁর ছিলনা।
তৃতীয় নেপোলিয়নের পররাষ্ট্র নীতির ব্যর্থতা তাঁর পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। সম্রাট পদ লাভ
করার পর তিনি ফ্রান্সের লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য জনসাধারণের কাছে প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন,
কিন্তু কার্যত তা সম্ভব হয়নি। তাঁর ইতালি নীতি শেষ পর্যন্তফ্রান্সের স্বার্থেই আঘাত হেনেছিল। পোল্যান্ড
নীতির ব্যর্থতা ও মেক্সিকো অভিযানের অকৃতকার্যতার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নেপোলিয়ন ও ফ্রান্সের
মর্যাদা যথেষ্ট ক্ষুন্ন হয়েছিল। অস্ট্রো-প্রাশিয়ান যুদ্ধে নিরপেক্ষতা অবলম্বন নেপোলিয়নের পক্ষে মারাত্মক
ভুল হয়েছিল। ইহা তাঁর অদূরদর্শিতার পরিচায়ক। সেডানের যুদ্ধে ও প্রæশিয়ার হাতে ফ্রান্সের পরাজয়ের
ফলে তাঁর পতন ঘটে।
উনবিংশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আবহাওয়া স্বৈরতন্ত্রের অনুকূল ছিলনা। ১৮৩০ ও ১৮৪৮
খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাঁর রাজত্বের প্রথম কয়েক বছর তৃতীয় নেপোলিয়ন অভ্যন্তরীণ
ক্ষেত্রে এক জাকালো নীতি দ্বারা ফরাসি জনসাধারণকে সন্তুষ্ট করেছিলেন। কিন্তু গণতন্ত্রের পোশাকে
স্বেচ্ছাচারিতা বেশি দিন ঢেকে রাখা সম্ভব হয়নি। ফরাসি জনসাধারণের নিকট ক্রমশ তাঁর স্বেচ্ছচারিতার
আসল রুপ প্রতিভাত হয় এবং জনসাধারণের বিক্ষোভ প্রচন্ড আকার ধারণ করে। ভগ্নস্বাস্থ্য ও বার্ধক্য
হেতু নেপোলিয়নের কর্মদক্ষতা ও মানসিক দৃঢ়তা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে ফলে তিনি জনসাধারণের
আস্থা হারাচ্ছিলেন। অবশেষে সেডানের যুদ্ধ তাঁর ও তাঁর সাম্রাজ্য উভয়েরই পতন ঘটায়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
ক) নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্ন
১। তৃতীয় নেপোলিয়ন কে ছিলেন ?
(ক) প্রথম নেপোলিয়নের ছেলে খ) প্রথম নেপোলিয়নের ভ্রাতুস্পুত্র
(গ) নেপোলিয়নের চাচা ঘ) কোনটিই নয়
২। তৃতীয় নেপোলিয়ন আইন সভাকে কয়ভাগে ভাগ করেন ?
(ক) এক ভাগে খ) দুই ভাগে
গ) তিনভাগে ঘ) কোনটিইনয়
৩। ১৮৬০ সালে তৃতীয় নেপোলিয়ন ব্রিটেনের সাথে কি চুক্তি স্বাক্ষর করেন?
(ক) কবর্ডন চুক্তি খ) প্যারিস চুক্তি
গ) মিউনিক চুক্তি ঘ) ভার্সাই চুক্তি
৪। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে নেপোলিয়ন কোন দেশের পক্ষে যুদ্ধ করেন ?
ক) রাশিয়া খ) তুরস্ক
গ) পোল্যান্ড ঘ) বুলগেরিয়া।
৫। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময় রাশিয়ার জার কে ছিলেন ?
ক) জার নিকোলাস খ) লুট ফিলিপ
গ) লেনিন ঘ) মহামতি পিটার।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। তৃতীয় নেপোলিয়নকে কি জাতীয়তাবাদী বলা যায়?
২। তৃতীয় নেপোলিয়নের সময় ফ্রান্সের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের বিবরণ দিন।
৩। তৃতীয় নেপোলিয়নের সময়ে ফ্রান্সের শিল্পায়নের বর্ণনা দিন।
৪। তৃতীয় নেপোলিয়নের পররাষ্ট্র নীতি কেন ব্যর্থ হয়েছিল?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। তৃতীয় নেপোলিয়নের সাংবিধানিক সংস্কারের বিবরণ দিন।
২। তৃতীয় নেপোলিয়নের স্বরাষ্ট নীতি আলোচনা করুন।
৩। তৃতীয় নেপোলিয়নের পতনের কারণ সমূহ আলোচনা করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত