শ্রমিক আন্দোলনের বিস্তারিত বিবরণ দিন।
প্যারিকমিউনের বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করুন।


শ্রমিক আন্দোলন ও প্যারি কমিউন ১৮৭১
এই পাঠ শেষে আপনি -
 শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন;
 শ্রমিক আন্দোলনের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন;
 প্যারি কমিউন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিতে পারবেন;
 প্যারি কমিউনের বিদ্রোহের কারণ বিশ্লেষণ করতে পারবেন;
 প্যারি কমিউন বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
শ্রমিক আন্দোলন
অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজে পুঁজিপতি শ্রেণীর বিকাশ লাভ করে এবং সমাজ ও
রাষ্ট্র অধিকাংশ পুঁজিপতি শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এতে শ্রমিক শ্রেণী হয়ে পড়ে অসহায় এবং তারা
নানাভাবে নিষ্পেষিত হতে থাকে। ফলে তাদের মাঝে অসন্তোষের বীজ দানা বেঁধে ওঠে। তারা তাদের
যথার্থ অধিকার ও দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন শুরু করে যা ইতিহাসে শ্রমিক আন্দোলন নামে
পরিচিত। এই আন্দোলনের পক্ষে অনেক বুদ্ধিজীবীর চিন্তাধারা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা
শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় পুঁজিপতিরা শিল্প ও বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য স্থাপন ও
মুনাফা লাভের যে নীতি গ্রহণ করে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায় ও অধিকার
রক্ষার জন্য ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়। ইউরোপীয সমাজতন্ত্রবাদীরা দীর্ঘকাল ধরে
শ্রমিক সমবায় ও শ্রমিক সংগঠনের তত্ত¡ প্রচার করে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রচার
করে। তৎকালীন সরকারসমূহ ছিল পুঁজিবাদের সমর্থক। সুতরাং সরকারের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে
শ্রমিক সংগঠন তৈরি করা সহজ ছিলনা। শিল্প মালিকদের পক্ষে জোটবদ্ধ হওয়া যেমন অধিকার
শ্রমিকদেরও জোটবদ্ধ হওয়া সেরূপ একটি পবিত্র অধিকার বলে গণ্য করা হয়। এজন্য বুদ্ধিজীবী ও
সমাজতন্ত্রী নেতারা শ্রমিকদের ভোটাধিকার দাবি করেন যাতে গণভোটের প্রবর্তন হলে তার সুযোগ নিয়ে
শ্রমিক প্রতিনিধিরা পার্লামেন্টে নির্বাচিত হতে পারে।
শ্রমিক আন্দোলন দমনের চেষ্টা
সরকারের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো সহজ কাজ ছিলনা। কারণ, পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফলে
পার্লামেন্টের শ্রমিক আন্দোলনের উপর নানা রকমের নিয়ন্ত্রণমূলক শর্ত চাপিয়ে দেয়া হতো। সরকারের
মনোভাব ছিল যে, শ্রমিকরা মালিকের সঙ্গে কারখানায় কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ। সেক্ষেত্রে ধর্মঘট করা
শুধু বেআইনি নয়, চুক্তি ভঙ্গ করার সমতুল্য। এ জন্য ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘটের ওপর বাধা নিষেধ
চাপানো হয়।


আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস - ২ পৃষ্ঠা-৯৬
শ্রমিকদের ভোটাধিকার প্রদান
ইংল্যান্ডে সর্বসাধারণের ভোটাধিকারের দাবিতে চার্টিস্ট আন্দোলন শুরু হলে শ্রমিকরাও তাতে যোগ
দেয়। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে ভোটাধিকার আইনদ্বারা শহরাঞ্চলে ভোটাধিকার স¤প্রসারণ করা
হলেও সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকার চালু থাকায় শ্রমিকরা তাতে উপকৃত হয়নি। ক্রমে ইংল্যান্ডে
উদারপন্থী এবং টোরি দল ভোটাধিকার স¤প্রসারণের নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে
হাইড পার্কেভোটাধিকারের দাবিতে জনসভা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হওয়ায়, ক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা হাইড
পার্কের রেলিং ভেঙ্গেঁ ফেলে। পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের খন্ড যুদ্ধ বাধে। এই ঘটনা গোটা ইউরোপে
দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফরাসি চিত্রকরের আঁকা হাইড পার্কের শ্রমিকদের রেলিং ভাঙ্গার দৃশ্য এই
ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। ইংল্যান্ডে শ্রমিকদের এই বিদ্রোহ ইউরোপের গণতন্ত্রবাদী
শাসকদের কাছে এক অশুভ ইঙ্গিত হিসেবে দেখা দেয়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের শাসকগণ
উপলব্ধি করেন যে, শ্রমিকদের দাবি গুলি অংশত পূরণ না করলে শিল্প সমৃদ্ধ ইউরোপীয় সমাজে নতুন
সমস্যা দেখা দেবে।
ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের স্বীকৃতি
সমাজে শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার সৃষ্টি হয় এবং শিল্পপতিগণ এও বুঝতে পারে যে,
শ্রমিকদের অধিকারকে যথাযথ মর্যাদা না দিলে আইন শৃংঙ্খলার চরম অবনতি ঘটবে এবং শ্রেণী সংগ্রাম
শুরু হতে পারে। এরকম সচেতন থেকে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রমিকরা পার্লামেন্টে ভোটাধিকার লাভ
করে। গদ্বাডস্টোন বলেন যে, “ডব সঁংঃ বফঁপধঃব ড়ঁৎ সধংঃবৎং’’। যেহেতু ভোটাধিকার এখন
শ্রমিকদের হাতে চলে গেছে, সেহেতু তারাই আমাদের প্রভু, আমাদের প্রভুদের শিক্ষার ব্যবস্থা না করলে
গণতন্ত্র প্রহসনে পরিণত হবে’’। এরকম সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ থেকে গদ্বাডস্টোন শ্রমিকদের অধিকার
রক্ষায় সচেষ্ট হন এবং শেষ পর্যন্ত১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে এক আইন দ্বারা ইংল্যান্ডে শ্রমিকদের বৈধ ট্রেড
ইউনিয়ন গঠনের অধিকার স্বীকার করেন। ফলে ইংল্যান্ডে শ্রমিকদল গঠিত হয়।
শ্রমিকদল স্থাপন ও পার্লামেন্টে আসন লাভ
শিল্প যুগ আরম্ভ হওয়ার ফলে শ্রমিকের দাবি অগ্রাহ্য করে সমাজ অগ্রসর হওয়ার ধারণা বাতিল হয়ে যায়।
ফেবিয়ানবাদ ইংল্যান্ডের শ্রমিক আন্দোলনকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করে। সিডনি ওয়েব ও অন্তত ৫০
জন শ্রমিক নেতাকে হাউজ অব কমনসে সদস্য নির্বচিত করলে পার্লামেন্ট শ্রমিদের অবজ্ঞা করার
সাহস হারিয়ে ফেলে। এই সময় জেমস হার্ডি ইংল্যান্ডে শ্রমিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন ট্রেড
ইউনিয়ন শ্রমিকদলের প্রতি আনুগত্য জানায়। শ্রমিক দল ইংল্যান্ডের শিল্প শহরগুলি যথা বার্মিংহাম,
ম্যাঞ্চেস্টার, লিভারপুল প্রভৃতি ও কয়লা খনি অঞ্চলে অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। শ্রমিক দল পার্লামেন্টে
শ্রমিক সদস্যের সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হয়। শ্রমিক সদস্যদের দাবিতে পার্লামেন্ট ইংল্যান্ডে ট্রেড
ইউনিয়ন বৈধতা দিতে আইন পাশ হয়।
শ্রমিক ধর্মঘট ও আন্দোলন
বৃটেনের মত ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন ফরাসি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার দেন।
কিছু কিছু ক্ষেত্রেও তারা ধর্মঘট করতে পারবে, এ অধিকারও তাদের প্রদান করা হয়। ফ্রান্স প্রজাতন্ত্রের
রাষ্ট্রপতি থিয়ার্স কর্তৃক শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দেলনের উপর এই নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও ইউরোপে
বৈধ বা অবৈধভাবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হতে থাকে। অদক্ষ শ্রমিকরা অধিক সংখ্যায় ট্রেড ইউনিয়নের
মাধ্যমে সংগঠিত হয়। শ্রমিক আন্দোলনগুলি ক্রমশ জঙ্গি চরিত্র নিতে থাকে। ১৮৮৬ সালে এবং ১৮৮৯
সালে লন্ডনে শ্রমিকের সঙ্গে পুলিশের সংর্ঘষ হয়। ইংল্যান্ডে সরকার বাধ্য হয়ে ডক শ্রকিদের মজুরী
বাড়ায়। ইংল্যান্ডের দৃষ্টান্তেঅনুপ্রাণিত হয়ে জার্মানির হ্যামবুর্গেও ডক শ্রমিকরা ধর্মঘট ও আন্দোলন
করলে জার্মান মালিক শ্রেণী তা প্রতিহত করে।


৮০ ও ৯০ এর দশকে ইউরোপ মহাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের মার্কসবাদী সংগঠনগুলির প্রভাব পড়ে।
জার্মান সোস্যাল ডেমোক্রাটরা বেশিরভাগ ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে পরিচালিত করতে থাকে। রাশিয়ার
শ্রমিক আন্দোলনকে জার সরকার দৃঢ় হাতে দমন করলেও প্রতি কলকারখানায় বলশেভিক ও স্যোসাল
ডেমোক্রেটরা গুপ্ত সংগঠন গড়ে তোলে। এ সব শ্রমিক সংগঠন ক্রমে ক্রমে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
শ্রমিক আন্দোলনের প্রকৃতি
উনিশ শতকের শ্রমিক আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শ্রমিক নেতৃবৃন্দ জঙ্গি
মনোভাব দেখালেও কার্যক্ষেত্রে তারা ছিল আপোষকামী। শ্রমিকদের দাবি দাওয়া পূরণ হলে তাঁরা সন্তুষ্ট
হতেন। তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থন পান এবং ট্রেড ইউনিয়নের
অধিকার লাভ করেন। তাই তারা সরাসরি সংঘর্ষের পথ পরিহার করে। শ্রমিক সংগঠনগুলি আর্থিক
দিক থেকে পুষ্ট হয়। তাদের নিজস্ব সংবাদপত্র অফিস ও আমলাতন্ত্র গড়ে ওঠে। শ্রমিকদের জীবনযাত্রার
মানোন্নয়ন ও মজুরি বৃদ্ধিই ছিল এই যুগের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। মার্কসবাদীরা ছাড়া কেউই সমাজ
ব্যবস্থা বদলের জন্যে আন্তরিক ছিলনা। তৃতীয়ত সকল শ্রমিককে এই যুগে ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য
পদভুক্ত করা সম্ভব ছিল না। অনেক শ্রমিক ছিল অসংগঠিত।
অন্যদিকে রাশিয়ার শ্রমিকেরা সরকারের সাথে আপোষ করেনি। তারা সংগ্রাম করে গেছে বিজয় লাভ
করা পর্যন্ত। রাশিয়ায় কম বেতন, বেশি খাটুনি এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ শ্রমিকের জীবনকে বিষময় করে
তোলে। যুদ্ধের দরুণ খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কম মজুরিতে খাদ্য কেনা তাদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে
পড়ে। জার সরকার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার স্বীকার করত না। এ জন্য শ্রমিকদের
দাবি আদায় করা ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বলশেভিক দল শ্রমিকদের ভিতর গোপন প্রচার চালিয়ে
তাদের সংঘবদ্ধ করে বিপ্লবীমুখী করে। শ্রমিক ধর্মঘটের ফলে রাশিয়ার অর্থনৈতিক জীবন ঝাঁঝরা হয়ে
যায়। জার সরকারের পুলিশ দ্বারা ধর্মঘট দমনের চেষ্টা করলে শ্রমিকরা জঙ্গি হয়ে ওঠে। শ্রমিক
আন্দোলন এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব সাধিত হয় এবং জার
সরকারের পতন ঘটে।
প্যারি কমিউন (১৮৭১)
১৮৭০ সালের ফ্রাংকো-প্রুশিয়া যুদ্ধে তৃতীয় নেপোলিয়নের পরাজয়ের মাধ্যমে ফ্রান্সের দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের
অবসান ঘটে। ৪ সেপ্টেম্বর (১৮৭০) প্যারিসে একটি রক্তপাতহীন বিপ্লব সংগঠিত হয় এবং ফ্রান্সে একটি
প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘোষিত হয়। এটিকে ফ্রান্সের তৃতীয় প্রজাতন্ত্র বলা হয়। তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের সংবিধান
রচিত হওয়া সাপেক্ষে ফ্রান্সে একটি অস্থায়ী সরকার স্থাপিত হয়। প্রখ্যাত রাজনীতিজ্ঞ থিয়ার্স এই অস্থায়ী
প্রজাতন্ত্রী সরকারের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন।
যুদ্ধ পরবর্তী (১৮৭০) সময়ে ফ্রান্সে সংবিধান রচনা, সরকার গঠন, জার্মান অবরোধ প্রতিহতকরণ,
সামাজিক অসন্তোষ, বিদেশী সাহায্য প্রাপ্তি, বোনাপার্ত বংশীয় স্বৈরাচার, সংসদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত
হওয়া, নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করা ইত্যাদি প্রশ্নে তীব্র মতবিরোধ, দ্ব›দ্ব, অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে
থাকে। ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ প্যারিসের জাতীয় রক্ষীবাহিনী ভ্যার্সাই নগরীতে অবস্থানকারী সরকারের
নিয়মিত সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। প্যারিসে একটি অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। প্যারিসের
এই বিশেষ ব্যবস্থার সরকারকেই প্যারি কমিউন বলা হয়। ৯০ জন নির্বাচিত সদস্যের একটি সাধারণ
পরিষদের উপর কমিনিউনের প্রশাসনিক ক্ষমতা ন্যস্তহয়। ৭২ দিন প্যারিসের কমিউনের বিশেষ সরকার
ব্যবস্থা টিকে ছিল। এই সরকার স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, জনতার সার্বভৌমত্ব, এক ও অখন্ড প্রজাতন্তে
বিশ্বাসী ছিল। তাদের মধ্যে বøাঙ্কের মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন। প্যারি কমিউনারগণ সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র
র‌্যডিকালিজম ইত্যাদি ধারা উপধারায় প্রভাবিত ছিল। তাদের মধ্যে সংহতির অভাব থেকেই থিয়ার্সের
বাহিনী ভের্সাই নগরী থেকে সংঘবদ্ধভাবে প্যারির কমিউন সরকারকে আক্রমণ করে। কমিউন তা


প্রতিহত করতে পারেনি। তবে মাত্র ৭২ দিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও প্যারি কমিউন সাধারণ
মানুষের কল্যাণে কাজ করার মহৎ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে স্মরণীয় হয়ে আছে।
অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রী সরকারের সামনে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল প্যারি কমিউনের বিদ্রোহের কারণ।
প্যারিকিমিউনের বিদ্রোহের কারণ স¤পর্কে মতভেদ আছেক) রাজনৈতিক কারণ
প্যারিস নগরি ছিল বিপ্লরের কেন্দ্রভূমি। এই শহরে প্রজাতান্ত্রিক দলের শক্তি সর্বাধিক ছিল। ফলে প্যারিস
নগরবাসী মনে করত যে, প্রজাতন্ত্রী ফ্রান্সের যোগ্য রাজধানী হল প্যারিস নগরি। কিন্তু প্রজাতন্ত্রী সরকার
প্যারিসের পরিবর্তে ভার্সাই নগরিতে প্রতিনিধি সভা স্থাপন করলে প্যারিসের লোকজনের আত্মমর্যাদায়
আঘাত লাগে। অস্থায়ী সরকারের জাতীয় সভায় নির্বাচনে প্রজাতন্ত্রী দল সংখ্যাাগরিষ্ঠতা পায়নি। জাতীয়
সভায় বহু রাজতন্ত্রী নির্বাচিত হয়। ভ্যার্সাই নগরি ছিল রাজতন্ত্রী ফ্রান্সের ঐতিহাসিক রাজধানী। ভ্যার্সাই
শহরের লোকেরাও ছিল রাজতন্ত্রবাদী। সুতরাং, প্যারিসের প্রজাতন্ত্রীরা আশংকা করে যে, ভ্যার্সাইয়ে
রাজধানী স্থাপিত হলে প্রজাতন্ত্র ধ্বংস হয়ে রাজতন্ত্র ফিরে আসবে। জার্মান আন্দোলনের বিরুদ্ধে
প্যারিসের নাগরিকরা তাদের জীবনপাত করে বাধা দেয়। এই ঐতিহাসিক প্রতিরোধের ও ত্যাগ
স্বীকারের বিনিময়ে প্যারিসকে রাজধানী হিসেবে নির্বচন না করায় এই নগরের জনগণের মধ্যে ঘোর
হতাশা দেখা দেয় যা বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।
খ) অর্থনৈতিক কারণ
ভ্যার্সাই শহরে রাজধানী স্থাপিত হওয়ার ফলে প্যারিসের বণিক ও দোকানদারেরা আশাংকা করে যে,
তাদের ব্যবসায় মন্দা দেখা দেবে। ভ্যার্সাই সরকারি আনুকূল্য উন্নত ব্যবস্থা আর প্যারিসের নাগরিকরা
হতাশায় ও দারিদ্র্যে নিমর্জিত হবে। জার্মান সেনা প্যারিস অবরোধ করলে প্যারিসের সকল কল
কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বেকার শ্রমিকরা প্যারিস রক্ষার জন্য ন্যাশনাল গার্ডে নাম লিখিয়ে নামে মাত্র
ভাতায় প্যারিসকে রক্ষার চেষ্টা করে। নাগরিকদের নিয়ে জাতীয় রক্ষিবাহিনী গঠিত হয়। প্রজাতন্ত্রী
সরকার এই রক্ষিবাহিনীর সদস্যদের ভাতা বন্ধ করে সাধারণ নাগরিকদের বিরাগভাজন হয়। ২)
অপরদিকে অস্থায়ী সরকার প্যারিসের নাগরিকদের বকেয়া কর ও বাড়ির খাজনা অবিলম্বে পরিশোধ
করতে আদেশ দিলে প্যারিসের নাগরিকরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। প্যারিস কমিউনকে স্বাধীন সরকার হিসেবে
ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় প্রজাতন্ত্রী সরকারের অধীনতা অগ্রাহ্য করে।
গ) সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রভাব
প্যারি কমিউনের বিদ্রোহের পেছনে সক্রিয় ছিল বিপ্লবী চিন্তাধারা। ভার্সাইয়ের জাতীয় সভার নেতৃত্বে
প্যারিসের জ্যাকোবিন ও নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীর আস্থা ছিলনা। এরা এই কারণে প্যারিসে একটি
সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। ধনবন্টন, উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ,
জীবিকার অধিকার প্রভৃতি মৌলিক অধিকার অর্জনও ছিল এই বিপ্লবের লক্ষ্য। প্যারিসের বিপ্লবীদের
দাবি ছিল সরকারের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। রাজতন্ত্রী যুগে ফ্রান্সের গ্রাম ও শহর গুলির স্বায়ত্তশাসনের
অধিকার লোপ করে শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। প্যারিসের বিপ্লবীদের মতে, কেন্দ্রীয়
সরকার ছিল স্বৈরাচারী ও স্থানীয় স্বার্থের প্রতি উদাসীন। তারা দাবি করে যে, প্রতি এলাকায় নির্বাচিত
প্রতিনিধি নিয়ে কমিউন গঠন করে এদের হাতে স্থানীয় শাসনের দায়িত্ব দিতে হবে। কমিউনগুলির
প্রতিনিধি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে হবে।


প্যারি কমিউনের বিদ্রোহ দমন
অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থিয়ার্স সর্বপ্রথম জাতিকে বুঝিয়ে দেন যে, তৃতীয় প্রজাতন্ত্র স্থায়ী হয়েছে।
ফ্রান্সে আর রাজতন্ত্র স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্যারিক মিউনের বিদ্রোহ দমন না করা হলে ফ্রান্সের
জাতীয় ঐক্য ভেঙ্গে পড়বে। অতপর তিনি সেনাপতি ম্যাকমেহনকে প্যারিসের বিদ্রোহ দমনে নিয়োগ
করেন। তিন সপ্তাহ ব্যাপী প্রচন্ড যুদ্ধ ও হত্যাকান্ডের পর প্যারিস নগরি ম্যাকমেহনের নিকট আত্মসমর্পণ
করে। এই যুদ্ধে প্রায় ২০ হাজার ফরাসি নাগরিক নিহত হয়। প্যারিস কমিউনের প্রতিরোধ দমনের পর
থিয়ার্স নিষ্ঠুর প্রতিহিংসা নীতি গ্রহণ করেন। জাতীয় রক্ষীদের পোষাক পরা কোনো লোক দেখা গেলে
নির্বিচারে গুলি করা হতো। প্রায় দীর্ঘকাল ধরে প্যারিস যা বলত গোটা ফ্রান্স তা শুনত। প্যারি কমিউনের
পতন হলে ফ্রান্সের উপর প্যারিসের প্রভাব বিনষ্ট হয়।
থিয়ার্স বিদ্রোহ দমন করেই ক্ষান্তহননি। তিনি ফরাসি জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য কিছু সংস্কার প্রবর্তন
করেন যা প্যারি কমিউনের বিদ্রোহ না হলে সম্ভব হত না। তিনি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে ছোট ছোট
শহরের মেয়র ও নগর সভার সদস্যদের নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়োগের প্রথা চালু করেন। বড় শহরগুলির
মেয়রকে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিযুক্ত করার ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়। স্থানীয় নির্বাচিত সভাগুলির ক্ষমতা
বৃদ্ধি করা হয়। গণভোটের মাধ্যমে নর্বাচিত জাতীয় সভাকে ফ্রান্সের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে
ঘোষণা করা হয়। প্রাপ্ত বয়স্ক ফরাসি পুরুষদের বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা গ্রহণের নিয়ম চালু করা
হয়। ফরাসি বাহিনীর সর্বাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করা হয়। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের সংবিধান
গৃহীত হয়। ফ্রান্সে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা এবং গণভোট চালু করা হয়।
প্যারিকমিউন বিদ্রোহের প্রকৃতি
প্যারি কমিউনের বিদ্রোহ কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক উজ্জল উত্থান রূপে পরিচালিত হয়ে থাকে।
কার্লমার্কস তাঁর ‘সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স’ নামক গ্রন্থে প্যারি কমিউনের বিদ্রোহকে প্রলিতারিয়েত বনাম
বুর্জোয়া শ্রেণী যুদ্ধের নিদর্শন রূপে ব্যাখ্যা করায় প্যারিস কমিউনের বিদ্রোহ বহু সমাজতন্ত্রীর কাছে
আবেগপূর্ণ ঘটনা বলে পরিচালিত হয়। প্যারিস কমিউনের বিদ্রোহকে শ্রেণী সংগ্রাম রূপে ব্যাখ্যা করা
কতখানি তাত্তি¡কভাবে গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এমন কি “কমিউনার” অর্থাৎ কমিউনের
সমর্থকদের কমিউনিস্ট বলে মনে করা হয়। টমসনের মতে, প্যারিস কমিউনের বিদ্রোহ ছিল আসলে
প্যারিসের অতীত বিপ্লবী ঐতিহ্যবাহী জনতার শেষতম অভ্যুত্থান। যাঁরা ১৭৮৯ ও ১৮৪৮ সালে
প্যারিসের পথে ব্যারিকেড রচনা করে লড়াই করে ছিল। তাঁদেরই উত্তরাধিকারীরা ১৮৭০ -৭১ সালে
অবশিষ্ট ফ্রান্সের উপর প্যােিসর সিদ্ধান্তচাপিয়ে দিতে শেষতম অভ্যুত্থান ঘটায়।
সারসংক্ষেপ
১৮ শতকে শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হবার ফলে সারা ইউরোপে পুঁজিপতি শ্রেণী গড়ে ওঠে এবং তাদের
নিষ্পেষণে শ্রমিকরা অতিষ্ঠ হয়ে তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য আন্দেলন করে। অন্যদিকে তৃতীয়
ফরাসি প্রজাতন্ত্রের কিছু কিছু সিদ্ধান্তপ্যারিসবাসীকে বিদ্রোহী করে তোলে। তবে এই বিদ্রোহ
কঠোরভাবে দমন করে তৃতীয় ফরাসি প্রজাতন্ত্রকে স্থায়ী করা হয়। শ্রমিক আন্দোলন ও প্যারি কমিউনের
বিদ্রোহ আলোচনা করলে দেখা যায় যে, এদের মধ্যে অন্তত একটি সাদৃশ্য রয়েছে আর তা হল উভয়ই
তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্তপ্যারি কমিউনের বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।


পাঠোত্তর মূল্যায়ন
১। নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
ক) ১৮৬৬ সালে কোথায় শ্রমিক সম্মেলন সরকার নিষিদ্ধ করলে পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু
হয় ?
১. হাইডপার্ক ২. রিজেন্ট পার্ক
৩. বিৃস্টল ৪. লিভারপুল
খ) কত সালে ইংল্যান্ডের শ্রমিকরা ভোটাধিকার লাভ করে?
১. ১৮৬৬ ২. ১৮৬৭
৩. ১৮৯০ ৪. ১৮৭৭
গ) কত সালে ইংল্যান্ডে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন স্বীকৃত হয়?
১. ১৮৭০ ২. ১৮৭২
৩. ১৮৭১ ৪. ১৮৭৩
ঘ) ইংল্যান্ডের শ্রমিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করে।
১.মার্কসবাদ ২.  ফোবিয়ানবাদ
৩. সিন্ডিক্যালিস্ট ৪. পুঁজিবাদ
ঙ) রাশিয়ার শ্রমিকদের সংগঠিত করে কোন দল?
১.লেবার ২. টোরি
৩. বলশেভিক ৪. মেনশোভিক
চ) প্যারিকমিউনের বিদ্রোহ কোথায় সংগঠিত হয় ?
১.ভার্সাই ২. প্যারিস
৩. লন্ডন ৪. মেলবোর্ন
ছ) তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি কে ছিলেন ?
১. থিয়ার্স ২. তৃতীয় নেপোলিয়ন
৩. ম্যাকমেহন ৪. বিসমার্ক
২। সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
ক) শ্রমিক আন্দোলনের কারণ সমূহ আলোচনা করুন ।
খ) রাশিয়ার শ্রমিক আন্দোলনের পরিণতি কি হয়েছিল?
গ) প্যারিকমিউন বিদ্রোহের কারণ কি?
ঘ) প্রশাসনে কখন, কিভাবে প্যারিসের আধিপত্য খর্ব হয়?
ঙ) প্যারিকমিউন বিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা করুন।
৩। রচনমূলক প্রশ্ন
ক) শ্রমিক আন্দোলনের বিস্তারিত বিবরণ দিন।
খ) প্যারিকমিউনের বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]