তার প্রাধান্য হারালো সে সম্পর্কে জানবেন।
একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা মানুষের চিরকালের। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন মতবাদ এই লক্ষ্যে আর্বিভ‚ত
হয়েছে। যে মতবাদটি দীর্ঘ সময় ধরে পাশ্চাত্যের চিন্তাশীল মানুষকে প্রভাবিত করেছে তা হচ্ছে
উদারনৈতিকতাবাদ বা লিবারেলিজম। লিবারেলিজমের বক্তব্য হচ্ছে সমাজের জন্য ব্যক্তি নয় বরং
ব্যক্তির জন্য সমাজ। ব্যক্তি নিজেই নিজের সমস্তবিষয়ে সিদ্ধান্তনিতে সক্ষম এবং তার প্রাচুর্য বা
দারিদ্র্যের জন্যে সে নিজেই দায়ী। ব্যক্তি যেন তার সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে, সে ক্ষেত্রে
রচিত হতে পারে সমাজের বা রাষ্ট্রের আইন কানুন। অনেকের মতে ব্যক্তি স্বাধীনতার এই ধারণাটিকে
আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার ব্যাপক অগ্রগতির কৃতিত্ব দেয়া যেতে পারে।
লিবারেলিজমের উৎস
যদিও লিবারেলিজমের জন্ম হয়েছে আধুনিক কালে। কিন্তু এর উৎস নিহিত ছিল প্রাচীনকালে। প্রাচীন
গ্রিসে ব্যক্তিকে মনে করা হতো সামাজিক প্রয়োজন পূরণের হাতিয়ার হিসেবে, ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তার
আলাদা সত্ত¡া রয়েছে এটা মনে করা হতো না। সমাজের প্রয়োজনে কিছু ব্যক্তির দাস হওয়ার মধ্যে
গ্রিসের বড় বড় দার্শনিকরা অস্বাভাবিক কিছু দেখতেন না। কেবল মাত্র সফিস্টরা (ঝড়ঢ়যরংঃ) দাসত্ব
ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং মানুষে মানুষে সাম্যের কথা বলার মাধ্যমে ব্যক্তি অধিকারের পক্ষে
দার্শনিকগণ অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। রোমান যুগে দার্শনিক সিসেরোর লেখায় ব্যক্তিগত অধিকারের
পক্ষে কিছু যুক্তি প্রদর্শিত হতে দেখা যায়। মধ্যযুগে পাশ্চাত্যের পন্ডিতরা গ্রিক ও মুসলিম দর্শনের সমন্বয়
ঘটিয়ে অর্থনীতির একটি তত্ত¡ উদ্ভাবন করেন যা পরবর্তীকালের স্কটিস লিবারেল চিন্তানায়ক এ্যাডাম
স্মিথকে প্রভাবিত করেছিল। আধুনিক যুগের সূচনাতে রিফরমেশনের সময় প্রটেস্টান্টরা ব্যক্তিকে
যাজকের ভ‚মিকায় অধিষ্ঠিত করেন। ইতিপূর্বে প্রচলিত ক্যাথলিক মত অনুসারে স্রষ্টা ও মানুষের মধ্যে
মধ্যস্ততা করার জন্য যাজকের ভ‚মিকা ছিল অপরিহার্য। ফলে ব্যক্তি মানুষ তার স্বাধীনতা, মর্যাদা ও
দায়িত্ব হারিয়ে ফেলেছিলো। কিন্তু প্রটেস্টান্টরা যাজকের অপরিহার্যতাকে অস্বীকার করে ব্যক্তিকে তার
কর্ম ও কর্মফলের জন্য দায়িত্বশীল করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে বিপ্লবকালীন নিউমডেল আর্মি
অব পার্লামেন্টের সদস্যরা ভোটাধিকার বিস্তার, পার্লামেন্টারি শাসন, সরকারের দায়িত্ব এবং বিবেকের
মত বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেন। এই সময়কার বিতর্ক কবি মিলটনকে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ
অৎবঢ়ধমধঃরপধ (১৬৪৪) রচনা করতে উদ্বুদ্ধ করে। এই গ্রন্থে তিনি মানুষের বিবেক এবং চিন্তার স্বাধীনতার
সপক্ষে বক্তব্য রাখেন।
জন লক (১৬৩২ - ১৭০৪)
উপরোক্ত ধারণাগুলোকে সমন্বিত করে যৌক্তিক কাঠামোতে প্রথিত করে ইংরেজ দার্শনিক জন লক
আধুনিক লিবারেলিজমের জন্মদাতা হিসেবে পরিচিত হন। লকের চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে
পরবর্তীকালের লিবারেল চিন্তাবিদরা ব্যক্তি স্বাতন্ত্রভিত্তিক এই দর্শনকে এগিয়ে নিয়ে যান। লকের প্রথম
বক্তব্য হচ্ছে মানুষের রয়েছে কিছু প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার। কিন্তু সমাজে চলতে গেলে তাকে কিছু আইন
মেনে চলতে হয় যা তার অবাধ স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে এই বিপরীত ধর্মী
অবস্থান লক নিরসন করেন এই ভাবে সেই আইনটিই গ্রহণযোগ্য যা ব্যক্তি অধিকারকে সবচাইতে বেশি
নিশ্চয়তা প্রদান করে। লক আরো বলেন যে, প্রকৃতি প্রদত্ত ব্যক্তি অধিকারের সাথে সাংর্ঘষিক কোনো
রাষ্ট্রীয় আইন মান্য করা অনুচিত। লকের দ্বিতীয় বক্তব্যটি ইংরেজ চিন্তাবিদ থমাস হবসের (১৫৮৮ -
১৬৭৯) সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী। হবসের ধারণা, মানুষ জন্মগতভাবে অপূর্ণ এবং মানবীয় দুর্বলতার
শিকার। তাই গোষ্ঠিবদ্ধভাবে বসবাস করে শান্তিকায়েম করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু লক বলেন
যে, জন্মগতভাবে মানুষ শুভ-প্রকৃতি সম্পন্ন, পূর্ণ স্বাধীনতা পেলে সে একটি আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে
পারে। লকের তৃতীয় বক্তব্য হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নির্ভর করে শাসিতের সম্মতির
ওপর। রাষ্ট্র যদি তার নাগরিকের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে নাগরিক অধিাকার হরণ করে; তবে
নাগরিকদের বিপ্লব করার অধিকার রয়েছে। লকের চতুর্থ বক্তব্য, মানুষের অধিকার নির্ভর করে
ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভোগের অধিকারের ওপর। সামাজিক আইন ব্যক্তি সম্পত্তি ভোগ করার অধিকারকে
অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। তাঁর মতে, ব্যক্তির প্রয়োগের মাধ্যমেই ব্যক্তিগত সম্পদের সৃষ্টি হয়। এই
কারণে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা যেমন তার ব্যক্তি সত্ত¡ার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে
জড়িত ঠিক তেমনিভাবে ব্যক্তিসম্পদও ব্যক্তি সত্ত¡ার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন থাকে।
ফ্রান্সে লকের ধারণাকে আরো অগ্রসর করে নিয়ে যান ফরাসি জ্ঞানদীপ্ত যুগের নেতা ভলতেয়ার (১৬৯৪-
১৭৭৮) ও মন্টেস্কু (১৬৮৯ - ১৭৫৫)। ভলতেয়ার বলেন, রাষ্ট্রগির্জার ওপর কর্তৃত্বের অধিকারী হওয়া
উচিত। তিনি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রদর্শন, সেনসরশিপ তুলে দেওয়া এবং অপরাধীর জন্য হালকা শাস্তির
দাবি করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রকে অবশ্যই শক্তিশালী হতে হবে, তবে রাষ্ট্রকে কতগুলি সাধারণ
নিয়মকানুনের অধীনে কাজ করতে হবে যেন সামাজিক অগ্রগতি এবং ব্যক্তি স্বাধীনতাকে কোনো শক্তিই
নষ্ট করতে না পারে। ভলতেয়ারের মতো ফরাসি নাট্যকার ডিডারটও মনে করেন যে, রাষ্ট্র এমন একটি
যন্ত্রযা হবে মানুষের সন্তুষ্টি ও শান্তিঅর্জনের হাতিয়ার এবং রক্ষণশীলতার বড় দুটি দুর্গ-শক্তিশালী
অভিজাততন্ত্রএবং গির্জার বিরুদ্ধে বড় রক্ষা কবচ। মন্টেস্কু সরকার কর্তৃক স্বৈরচারি ক্ষমতা প্রয়োগের
বিরুদ্ধে নাগরিক অধিকার রক্ষা করার জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ তত্ত¡ উদ্ভাবন করেন। তিনি বলেন,
যদি একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে সরকারের আইন, বিচার ও কার্যনির্বাহী বিভাগ ন্যস্তথাকে তবে
তাতে ব্যক্তি স্বাধীনতা লোপ পাবে।
লিবারেলদের অর্থনৈতিক তত্ত¡
লিবালেররা রাজনীতির গন্ডির বাইরে অর্থনীতি সম্পর্কেও তাদের মতামত প্রকাশ করেন। অর্থনীতি
সম্পর্কে তাদের বক্তব্য হচ্ছে যে, বাজার শাসকের কর্তৃত্বের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে রাষ্ট্রের ন্যায় স্বাভাবিক
ও প্রাকৃতিক আইন দ্বারা পরিচালিত হবে। স্কটিশ অর্থনীতিবিদ এ্যাডাম স্মিথ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ অহ
ওহয়ঁরৎু রহঃড় ঃযব ঘধঃঁৎব ধহফ ঈধঁংবং ড়ভ ঃযব ডবধষঃয ড়ভ ওঃধষরপ ঘধঃরড়হং -এ বলেন, সরকারি
হস্তক্ষেপ ছাড়াই অবাধ বাণিজ্যক পরিবেশের মধ্যে সম্পদের উৎপাদন এবং বন্টনের কাজে পুঁজির
সর্বোত্তম ব্যবহার করা যায। স্মিথের মতে ব্যবসাও ভালভাবে চলবে এবং মানুষের জীবন যাত্রার মানটাও
উন্নত হবে যদি অর্থনীতিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে অত্যন্তসীমিত পরিমাণে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত
তথা লেইজে ফেয়ার (খধরংংবু ঋধরৎব) ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি “অদৃশ্য হাত” বা রহারংরনষব যধহফনামক একটি তত্ত¡ উপস্থাপন করেন। তাঁর এই মত অনুযায়ী প্রত্যেকটি মানুষ তার ব্যক্তিগত মঙ্গল করতে
গিয়ে যেন এক অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিতে সমাজের মঙ্গল সাধন করে যাচ্ছে। এ্যাডাম স্মিথের ভাষায়,
“বেচাকেনা করতে গেলেই একজনকে আরেক জনের প্রয়োজন পূরণ করতে হয়। কসাই,
মদপ্রস্তুতকারি, রুটিওয়ালা কোনো দয়ার বশবর্তী হয়ে আমাদেরকে খাদ্য সরবরাহ করে না বরং তাদের
স্বীয় স্বার্থ পূরণের জন্যই তারা আমাদের টেবিলে খাবার এনে হাজির করে।”
এড্যাডাম স্মিথের মতে এই অবাধ প্রতিযোগিতায় সরকারি হস্তক্ষেপ নিশ্চিতভাবে ক্ষতিকারক।
লিবারেলদের মতে “একটি রাষ্ট্র সেই জাতির উন্নতিতে অবদান তখনই রাখতে পারে যখন সে শুধু
অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত থাকে, আর জাতির অর্থনৈতিক সর্বনাশ ডেকে আনে যখন
মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতায় সে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।”
লিবারেলরা বিশ্বাস করেন যে, মানুষ তার দুভার্গ্য ও দুর্দশার জন্য নিজেরাই দায়ী। তারা আরো বিশ্বাস
করতেন যে, গরিব মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় কারো কিছু করার নেই, রাষ্ট্র যদি দারিদ্র্য দূর করার চেষ্টা
করে তবে তা হবে চাহিদা ও যোগানের মতো প্রাকৃতিক আইনের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ। ইংরেজ
ধর্মযাজক থমাস ম্যালথাস (১৭৬৬-১৮৩৪) তাঁর গ্রন্থঊংংধু ড়হ ঃযব চৎরহপরঢ়ষব ড়ভ চড়ঢ়ঁষধঃরড়হ-এ যুক্তি
দেখান যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উৎপাদন বৃদ্ধির হার থেকে সবসময়ই বেশি। ম্যালথাস মনে করেন যে,
এটাই প্রমাণ করে যে শ্রমিক শ্রেণীর দারিদ্র্য চিরস্থায়ী ব্যাপার। ম্যালথাস বলেন, যদি শ্রমিকের মজুরি
বৃদ্ধি করা হয় তাহলে শ্রমিকের পরিবারের আকার বৃদ্ধি পাবে, এবং বাড়তি মজুরি নবাগত সদস্যদের
ভরণপোষণে ব্যয়িত হবে। ম্যালথাসের এই বক্তব্যকে ম্যালথাসবাদ বলে অভিহিত করা হয়। এই মত
তখনকার সময়ে সরকার কর্তৃক গরিবদের সাহায্য করার বিরুদ্ধে বিজ্ঞান সম্মম যুক্তি বলে অনেকের
কাছে মনে হয়েছে। ম্যালথাসের মতে দারিদ্র্য হচ্ছে প্রকৃতির কঠোর ও অলংঘনীয় নিয়ম (ওৎড়হ খধি ড়ভ
ঘধঃঁৎব). সীমিত সম্পদের উপর জনসংখ্যার চাপের ফলাফলকে সরকারি সংস্কারের দ্বারা দূর করা যায়
না। সমসাময়িক আরেক ইংরেজ অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডো (১৭৭২-১৮২৩) ম্যালথাসের তত্ত¡কে
ব্যবহার করে আরেকটি অর্থনৈতিক তত্তে¡র জন্ম দিলেন। তিনিও বললেন যে, দারিদ্র্য হচ্ছে একটি
স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিধান এবং এটাকে দূর করা যায় না। মজুরি বেড়ে গেলে শ্রমিক তাদের পরিবার বড়
করতে থাকবে। ফলে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাবে, চাকুরির বাজারে প্রতিযোগিতা তীব্র হবে এবং
স্বাভাবিকভাবেই মজুরি কমতে থাকবে। মজুরির অলংঘণীয় আইন (ওৎড়হ খধি ড়ভ ডধমবং) বলে পরিচিত
রিকার্ডোর এই তত্ত¡ গরিব মানুষের জন্য সরকারের কিছু করণীয় নেই, লিবারেলদের ধারণাকে আরো
শক্তিশালী করতে সমর্থ হয়।
লিবারেলিজমের অগ্রগতি
লিবারেলিজম ইউরোপের বুর্জোয়া শ্রেণীকে সবচাইতে বেশি আকৃষ্ট করে। শিল্প বিপ্লবের পর সমগ্র
ইউরোপে বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে সম্পদ জমা হতে থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সামাজিক প্রতিপত্তি
ছিল ভ‚স্বামী ও অভিজাতদের হাতে। শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর ব্যক্তিবর্গ, প্রতিভাবান ও উচ্চাভিলাষী,
ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, পণ্য উৎপাদনকারী এবং বিভিন্ন পেশাজীবী দেখলো রাষ্ট্রের গৌরবে তাদের বিরাট
অবদান থাকলেও ক্ষমতার কাঠামো থেকে তারা বহুদূরে। সমাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে রক্ষণশীলরা যাদের
ক্ষমতার ভিত্তিমূল হচ্ছে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ভ‚মিজ সম্পদ। বুর্জোয়ারা চাইলে সামাজিক মর্যাদা
জন্মসূত্রে নয় - প্রতিভা ও কৃতিত্তে¡র দ্বারাই নির্ধারিত হবে। ব্যবসায়ী ও পণ্যউৎপাদনকারী হিসেবে
বুর্জোয়ারা নিয়ন্ত্রিত বাজার এবং বাণিজ্যিকে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার পথে প্রতিবন্ধকতা মনে করল।
মানুষ হিসেবে মানুষের অধিকার এবং প্রতিভাও যোগ্যতার ভিত্তিতে সামাজিক অবস্থান নির্ধারণলিবারেলিজম এই তত্ত¡কে তারা আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করল। লিবারেলিজমের প্রথম বিজয় সূচিত হয়
১৬৮৮ সালে ইংল্যান্ডে যখন রাজতন্ত্রপার্লামেন্টের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়। দীর্ঘ হুইগ শাসনকালে
ইংল্যান্ডে শান্তিও নিশ্চয়তা এক ধরনের ব্যক্তিস্বাধীনতা ভোগ করতে থাকে। ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু
১৭২৭ থেকে ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তইংল্যান্ড সফর করেন, ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা নিখুঁত না হলেও এর
নিয়ন্ত্রণ, ভারসাম্য ও ক্ষমতার বিভাজনের জন্য তিনি এর প্রশংসা করেন। লিবারেলিজমের বড় বিজয়
ঘটে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের সময়। মার্কিন স্বাধীনতার ঘোষণা
লকের দেওয়া জন্মগত অধিকারের তত্ত¡কে এবং মার্কিন শাসনতন্ত্রেমন্টেস্কুর ক্ষমতা বিভাজন নীতিকে
বাস্তবায়িত করে। মার্কিন বিল অব রাইটস ব্যক্তির অধিকারকে নিশ্চয়তা প্রদান করে। ফরাসি বিপ্লবী
ন্যাশনাল এ্যসেম্বলি আইনের চোখে সকলে সমান এই আদর্শ কায়েম করে, অভিজাতদের বিশেষ সুয়োগ
সুবিধা হরণ করে প্রতিভাবানদের জন্য দরজা উন্মুক্ত করার নীতি গ্রহণ করে। ন্যাশলান এ্যাসেম্বলি ব্যক্তি
ও নাগরিকের অধিকারগুলি ঘোষণা ও পাশ করে, ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং রাজার
ক্ষমতাকে সঙ্কুচিত করে একটি শাসনতন্ত্রজারি করে। আমেরিকা ও ফরাসি বিপ্লব উভয়েই লিবারেল
আদর্শ অনুযায়ী ব্যক্তির সম্পদের অধিকার ভোগ করার উপর সুষ্পষ্ট ঘোষণা দান করে।
লিবারেলিজম ও গণতন্ত্র
কিন্তু নেপোলিয়নের যুদ্ধের পরে ইউরোপে ১৮১৫ সালের পর আবার স্বৈরাচার ও রক্ষণশীলতার
পুনরুজ্জীবন ঘটে, আর উদারনীতির যে বিজয় স‚চিত হয়েছিলো তা বাধাপ্রাপ্ত হয়। লিবারেলরা এখন
স্বৈরাচার ও ভ‚স্বামীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। তারা দাবি করে যে সরকার শাসনতান্ত্রিক নীতির
ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আইনের সামনে সমতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকতে
হবে। ভ‚স্বামীদেরকে সুবিধা দান করছে এমন সব আইনেরও তারা প্রত্যাহার দাবি করে। লিবারেলদের
এই সময় কোনো সামাজিক কর্মসূচি ছিল না বা তারা সামাজিক কোনো পরিবর্তনের দাবি করে নি।
তারা শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো। তবে শীঘ্রই শ্রমিক শ্রেণীর সাথে তাদের বিরোধ
শুরু হয়। ১৮১৫ সাল নাগাদ ইউরোপে শিল্প কলকারখানার ব্যাপক বিকাশ ঘটে, শ্রমিকরা একটি
রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আর্বিভ‚ত হয়। লিবারেলরা শ্রমিকদেরকে রাজনৈতিক অধিকার দিতে অস্বীকার
করে। ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত লিবারেল নীতি সমূহকে তারা স্বাগত জানালেও বিপ্লবকালীন
জেকোবিন, র্যাডিকালিজম বা আমূল সংস্কারবাদী কার্যাবলিকে অপচ্ছন্দ করে। তাদের মতে
জেকোবিনবাদের মানে ছিল উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসন, অর্থনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপ সম্পত্তির উপর
ব্যক্তি অধিকার ক্ষুন্ন করে এবং ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনার তাদের প্রচেষ্টা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের
উপর হস্তক্ষেপ করে। লিবারেলরা মনে করতে থাকে যে, সাধারণ মানুষ মানে অশিক্ষিত, সহায়
সম্পদহীন, অনঅভিজ্ঞ এবং অস্থির লোকের সমন্বয়, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি রক্ষা করার মতো যাদের না
আছে যোগ্যতা, না আছে মানসিকতা। রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ মানে বাজে রকমের
স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠা এবং ব্যক্তির স্বাধীনতার সমাপ্তি ঘটতে পারে বলে তাঁরা আশংকা প্রকাশ করে। বস্তুত
সাধারণ মানুষের অধিকার, মর্যাদা, স্বাবলম্বী হওয়া ইত্যাদি গুরুত্ব পূর্ণ প্রশ্নে লিবারেলরা হয়
রক্ষণশীলতার পরিচয় দিয়েছে, নতুবা দ্বিধান্বিত ছিল।
ফরাসি রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ টুকভিল যুক্তি দেখান যে আসলে সাধারণ মানুষ চায় সাম্য, স্বাধীনতা নয়।
জনতা চায় সামাজি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতির দুয়ার সবাইর জন্য খোলা থাকুক। সম্পদে
বৈষম্য ও সামাজিক মর্যাদার তারতম্য প্রাকৃতিক বিধান এরূপ মতবাদ তারা গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন
না। নিজেদের বস্তুগত উন্নতির জন্য জনগণ রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। রাষ্ট্রই
সাম্যের নিশ্চয়তা দিতে পারে এ ধারণার বশবর্তী হয়ে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রকে আরো বেশি ক্ষমতা দিয়ে
যেতে থাকবে। এইভাবে রাষ্ট্র তার নাগরিকের উপর ক্রমবর্ধমান ভাবে নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে, বিভিন্ন
স্বায়ত্ত¡শাসিত প্রতিষ্ঠান গুলোর ক্ষমতা হ্রাস করে কেন্দ্রীয় সরকারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। সংখ্যাগুরুর
বিশ্বাস সংখ্যালঘুর উপর চাপিয়ে দিতে সমর্থ হবে। স্বৈরাচারী রাজার হাতে নয় সংখ্যাগরিষ্ঠের
স্বৈরাচারের কাছে স্বাধীনতা হারিয়ে যাবে।
যেহেতু গণতন্ত্রপ্রতিষ্ঠা মানে হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতার বিনাশ তাই বুর্জোয়া লিবারেলরা সরকারী চাকরি এবং
ভোটাধিকারের জন্য সম্পত্তির মালিকানার যোগ্যতার উপর জোর দিলেন। তারা চাইলেন রাজনৈতিক
ক্ষমতা শিক্ষিত ও সম্পত্তির অধিকারী মধ্যবিত্তের হাতে থাকাটাই নিরাপদ। এ ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা
হলে নি¤œশ্রেণীর লোকদের দ্বারা বিপ্লবের হুমকি থেকে সমাজকে রক্ষা করা যাবে। উনবিংশ শতাব্দীতে
লিবারেলরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সংগঠিত বিপ্লবে জড়িয়ে পড়ে, কিন্তু সর্বদাই তাদের লক্ষ্য ছিল
সীমিত। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে শাসনতন্ত্র, পার্লামেন্ট অথবা সরকার পরিবর্তন করে লিবারেলরা
বিপ্লবকে সমাপ্ত করে দিতে চেয়েছে। যখন তাদের মনে হয়েছে জনসাধারণের মধ্যে বিপ্লব দ্রæত বিস্তার
লাভ করছে তখন এই লিবারেলরা হয় বিপ্লব থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে অথবা
প্রতিবিপ্লবীতে রুপান্তরিত হয়েছে। জনশাসনকে তারা আতঙ্কের চোখেই দেখত।
উপযোগবাদ বা ইউটিলিটেরিয়ানিজম (টঃরষরঃধৎরধহরংস)
একটু আগেই যেমনটি বলা হয়েছে, গণতন্ত্রজনগণের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে, অপর পক্ষে লিবারেলরা
মানবাধিকারের কথা বললেও সাধারণ মানুষের শাসনকে ভয় করতো। গণতন্ত্র এবং বুর্জোয়া
লিবারেলিজমের এই বিরোধের সমন্বয় করার চেষ্টা করে উপযোগবাদ। জেরেসি বেনথাম তাঁর গ্রন্থ(ঞযব
চৎরহপরঢ়ষবং ড়ভ গড়ৎধষং ধহফ খবমরংষধঃরড়হ)-এ উপযোগবাদ তত্তে¡র বিশ্লেষণ করেন। বেনথামের মতে
মানুষ কার্যত: স্বার্থাপর প্রাণী। কোনো রকম দিক নির্দেশনা ছাড়া এই আন্তকেন্দ্রিক মানুষের সমষ্টির দ্বারা
সুন্দর সমাজ কল্পনা করা অসম্ভব। সমাজ যদি সুন্দর ভাবে পরিচালনা করতে হয় তাহরে এমন একটা
ব্যবস্থা থাকতে হবে যা মানুষের মৌলিক স্বার্থপরতার স্বীকৃতি দিয়ে তাকে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে তার
ব্যক্তি স্বার্থের কিছু অংশ অন্তত: ত্যাগ করতে বাধ্য করতে পারে। এই নীতিই হচ্ছে উপযোগবাদ যার
অর্থ হচ্ছে প্রত্যেকটি আইন ও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা বিচার্য হবে তার সামাজিক কার্যকারিতা বা
উপকারিতার ওপর ভিত্তি করে। সমাজের জন্য সে আইনটি প্রয়োজনীয় যা সবচাইতে বেশি সংখ্যক
মানুষের বেশি প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। যে আইন এই মানদন্ডে উত্তীর্ণ হবে সেই আইনটি
গ্রহণযোগ্য হবে।
বেনথামের এই বক্তব্য একদিকে ব্যক্তি স্বাধীনাতর পক্ষে যেমন জোরালো যুক্তি দেওয়া হয়েছে তেমনি
সরকারি হস্তক্ষেপেরও যৌক্তিক ভিত্তি দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক মানুষ তার স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন ও সজাগ,
তাকে তার স্বার্থপূরণ করার জন্য স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। তবে ব্যক্তির স্বার্থপূরণ করতে গিয়ে তা যদি
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুন্ন হয় তবে তখনই স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করতে হবে। বুর্জোয়া
শিল্পমালিকদের জন্য তার এই তত্ত¡ খুবই গ্রহণযোগ্য ছিল। শিল্পায়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রগতি মানে
হচ্ছে বিশ্বমানুষের কল্যাণ, তাই তারা এই তত্ত¡কে তাদের কাজ কর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবুজ
সংকেত বলে মনে করল। বেনথামের পূর্বে লিবারেলরা যেখানে মানুষের দুঃখ দুর্দশা দূর করার জন্য
রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে অযাচিত মনে করেছে সেখানে বেনথাম দুঃখ দুর্দশা দূর করার জন্য রাষ্ট্রীয় আইনের
প্রয়োজন মনে করেছেন। ব্যক্তিকে রক্ষা এবং ব্যক্তির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের সামাজিক
পুর্ণ গঠনের উপর বেনথাম জোর দিয়েছেন। ব্যক্তি যদি দরিদ্র থাকে তবে তার স্বাধীনতা থাকে না, সে
যাচাই-বাছাই করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। দরিদ্র ও হতাশাগ্রস্থ মানুষ বিদ্রোহ করে বুর্জোয়াদের বৃহত্তর
জনগোষ্ঠীর কল্যাণ করার ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই সরকারের এমন সব আইন প্রণয়ন
করা দরকার যা শ্রমিকদের কাজের পরিবেশকে উন্নত করবে, তাদেরকে শিক্ষিত করে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ও
যাচাই বাচাই করার যোগ্য করবে। অবশ্য অনেক লিবালে চিন্তাবিদ এটাকে ব্যক্তির কল্যাণের নামে
রাষ্ট্রের কর্তৃত্ত¡কে সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা বরে অভিহিত করেন। যাই হউক, বেনথাম ইংল্যান্ডে ভোটাধিকার
বিস্তৃতি, গোপন ব্যালটে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন এবং রাজনৈতিক দুর্নীতি শিক্ষা ব্যবস্থার
ধর্মযাজকদের নিয়ন্ত্রণের সমালোচনা করেন। তাছাড়া নারী ও শিশু শ্রমিকদের রক্ষার জন্য এবং
শহরগুলোকে স্বাস্থ্যসম্মত করার জন্য তিনি সংস্কারের উপর জোর দেন।
জনস্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩)
বেনথামের উপযোগবাদকে আরো অগ্রসর করে নিয়ে যান জনস্টুয়াট মিল। স্টুয়ার্ট মিলের বাবা জনমিল
বেথামের একজন অনুসারী ছিলেন এবং ষ্টুয়ার্ড মিল একজন উপযোগবাদী হিসেবেই বড় হন। প্রথম
দিকের লিবারেলদের অর্থনৈতিক তত্তে¡র মাঝে তিনি কিছু পরিবর্তন আনেন। অর্থনেতিক আইনগুলো যে
সর্বজনীন তা তিনি মানতে অস্বীকার করেন। তিনি স্বীকার করে নেন যে উৎপাদনের আইনগুলো যে
সর্বজনীন ও অলংঘণীয়। কিন্তু লিবারেল অর্থনীতিবিদরা সেখানে অর্থনীতিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণকে বিষবৎ
পরিত্যজ্য ভেবেছেন যেনো মিল সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একটি কল্যাণবৃদ্ধিকারী ভ‚মিকা রয়েছে
বলে দাবি করেন। তিনি পূর্বে যেনো লিবারেলদের লেইসে ফেয়ার রাষ্ট্রের কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করার
নীতির ব্যাপক পরিবর্তন করে রাষ্ট্রকর্তৃক ব্যাপক সংস্কারের পক্ষে মতামত পেশ করেন। তিনি সরকারি
আইনের মাধ্যমে শ্রম ঘন্টাকে সীমিত করে দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত
সম্পত্তি এবং ভ‚মির ওপর অনার্জিত আয়ের উপর ট্যাক্স আরোপ করে তা পূর্ণবন্টন করার মাধ্যমে
সরকার সমাজের কল্যাণ বৃদ্ধি করতে পারে বলে তিনি মত দেন। তাঁর চৎরহপরঢ়ষবং ড়ভ চড়ষরঃরপধষ
ঊপড়হড়সু গ্রন্থে তিনি মজুরী ব্যবস্থার পরিবর্তে শ্রমিকদের জন্য উৎপাদক সমবায় কায়েমের প্রতি গুরুত্ব
আরোপ করেন যেন শ্রমিকরা কারখানাগুলোর না মালিকানা লাভ করতে পারে এবং তা চালানোর জন্য
নিজেরাই নিজেদের ম্যানেজার নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু মিল একজন সমাজতন্ত্রী ছিলেন না, রাষ্ট্রকে
তিনি সন্দেহের চোখে দেখতেন। তিনি উৎপাদকদের সমবায়ের ওপর জোর দেন ও কারণে নয় যে তিনি
শ্রমিক শ্রেণীকে উপরে তুলে ধরতে চেয়েছেন বরং এ জন্য যে শ্রমদানকারী ব্যক্তি যেন তার পরিশ্রমের
ফল ভোগ করতে পারে। ১৮৫৯ সালে তিনি ঙহ খরনবৎঃু গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এতে তিনি ব্যক্তির
স্বাধীনতার সপক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। ঐ গ্রন্থে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারকে তিনি আক্রমণ করেন।
ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লিবারেলদের চিরাচরিত বক্তব্য এ গ্রন্থে
সুষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মিল লিখেছেন একজন লোকের হাতে যদি এমন ক্ষমতা থাকে যা সে শক্তির
শক্তিতে সমগ্র মানবজাতির ভিন্নমত প্রকাশ রুদ্ধ করে দিতে পারে, ঐ ব্যক্তির পক্ষে সে ক্ষমতা প্রয়োগ
যেমন অন্যায় হবে, তেমনি সমগ্র মানবজাতির জন্যও সমষ্টিগত ভাবে ককতা প্রয়োগের মাধমে একজন
ভিন্নমতাবলম্বীর ভিন্নতবাম্বীর কণ্ঠ রোধ করে দেয়াটা হবে অন্যায় ও নীতিবিরুদ্ধ”।
লিবারেলিজমের পতন
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ লিবারেলিজমের জোয়ারে ভাটা পড়ে। লিবারেলিজমের আদর্শ আগের
মতো গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে যদিও ভিন্নমত পোষণকারী চিন্তাবিদ হিসাবে অনেক লিবারেল অস্তিত্ব
বজায় রাখেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ শিল্পায়নের যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছি না। একদিকে
সম্পদের পাহাড় তৈরি হতে থাকে, অন্য দিকে চরম দারিদ্র্য মানুষকে গ্রাম ছাড়া করতে থাকে, শহরেও
বস্তিতে ঠাঁই পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যুদ্ধ বিগ্রহ দখলদারিত্ব ইত্যাদির ফলে জাতিগত বিদ্বেষ বৃদ্ধি
পেতে থাকে।
একজাতির সঙ্গে অন্য জাতির হিংসা বিদ্বেষ, সামরিক প্রতিদ›িদ্বতা উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের
ইউরোপের বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এসে অন্তর্জাতিক বাণিজ্য নষ্ট করে দেয় বহুলাংশে, আর
জাতিগুলির সামরিক সাজসজ্জাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ থেকে রেশনিং ব্যবস্থা,
সেন্সরশিপ, প্রচারণা ইত্যাদি কাজে সরকার জড়িয়ে পড়ে। সোভিয়েট ইউনিয়ন কম্যুনিজমকে আদর্শ
হিসেবে গ্রহণ করার পর রাষ্ট্রীয়করণের পক্ষে অনেকের আগ্রহ বাড়তে থাকে। সরকারের ক্রমবর্ধমান
বিস্তৃতি, আইনের মাধ্যমে সামাজিক অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের দাবি যেন বিশ্বব্যাপী একটি স্বাভাবিক
পরিণতি লাভ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো লিবারেল দেশ উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে তার আদর্শ
পরিত্যাগ করে সামাজিক কর্মসূচি এবং কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক পকিল্পনায় জড়াতে থাকে। ব্যক্তির স্বাধীনতা
বিশ্বব্যাপী হুমকির মুখে পড়ে।
সার সংক্ষেপ
মানুষ হিসেবে মানুষের অধিকার বিভিন্ন যুগে শক্তিশালী ব্যক্তি বা গ্রট্টপের হাতে জিম্মি ছিল। তারপরও
মানুষ মানবাধিকার ফিরে পেতে তার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। আধুনিক যুগের সূচনাতে জন লক
লিবারেলিজমকে সুষ্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা দান করেন। স্বাধীনতা মানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, যার অর্থ হচ্ছে
কোনো রূপ হস্তপেক্ষ ছাড়া মানুষ নিজের অধিকার ভোগ করবে। ব্যক্তি যেমন প্রাকৃতিক আইন দ্বারা
পরিচালিত হবে তেমনি অর্থনীতিও চলবে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক আইন দ্বারা।
উনবিংশ শতাব্দী নাগাদ লিবারেল মতের অনুসারীরা শক্তিশালী হতে থাকে। তারা ক্ষমতাসীন
রক্ষণশীলদেরকে পরাজিত করে শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত¦ করতে চায়। এই দ্ব›েদ্ব তরা সাধারণ মানুষের
সমর্থন লাভের চেষ্টা চালালেও গণমানুষের শাসনে তাদের কোনো বিশ্বাস ছিল না। তাদের মতে সরকার
মানে প্রতিভাবান, সম্পদশালী ও যোগ্য লোকের শাসন। অশিক্ষিত, উচ্ছৃংখল এবং ভাবাবেগ দ্বারা
পরিচালিত মানুষ ক্ষমতার জন্য অনুপুযুক্ত। শ্রমিক শ্রেণী উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ নাগাদ রাজনৈতিক
শক্তি হিসেবে আবিভর্‚ত হয়। লিবারেল নীতি অনুযায়ী তারাও অধিকার দাবি করে। উপযোগবাদ
লিবারেল ও গণতন্ত্রের এই দ্ব›েদ্বর সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদকে উর্ধ্বে তুলে ধরার
সঙ্গে সঙ্গে তারা বৃহত্তর সামজের কল্যাণে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। রাষ্ট্র কিছু
বললে দরিদ্র ও হতাশাগ্রস্তরা বিদ্রোহ করে যোগ্য ও শিক্ষিত লোকদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির কল্যাণ করার
ক্ষমতা ধ্বংস করে দিতে পারে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে লিবারেলিজমের প্রভাব কমতে থাকে, উগ্র
জাতীয়তাবাদ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের স্বার্থ একাকার করে ফেলে। সমাজতন্ত্রের সাফল্যের সাথে সাথে পুঁজিবাদী
রাষ্ট্রগুলোও লিবারেল অর্থনীতির কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর
হতে থাকে। সা¤প্রতিককালে সমাজতন্ত্রের পতনের পর আবার লিবারেলিজমের পুনরুত্থান ঘটেছে।
বিভিন্ন দেশে বিরাষ্ট্রীকরণ, বাণিজ্য উদারীকরণ ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা লিবারেলদের
সাফল্যরই প্রমাণ দেয়। বর্তমানে সম্পূর্ণবাধাহীন এবং দ্রæততম বিশ্বায়নের পিছনে সবচেয়ে জোরালো
কন্ঠস্বর হচ্ছেন লিবারেলরা। তবে এর অভ্যন্তরেও রয়েছে বহুমাত্রিক সংকট যা ভবিষ্যতে বিশ্ব
রাজনীতিতে নতুন কোনো সংকট তৈরি করতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। জন লকের মতে নাগরিকরা বিপ্লব করতে পারে যদি
ক) রাষ্ট্র নাগরিককে সুযোগ সুবিধা না দেয়া হয়
খ) নাগরিকের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে
গ) রাষ্ট্র নাগরিকের লেখা পড়া ও অর্থনৈতিক উন্নতি না করে
ঘ) মানুষের কথা বলার অধিকার না দেয়া
২। লিবারেল অর্থনীতি মানে
ক) রাষ্ট্র অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দ্রব্য মূল্য কমিয়ে রাখবে।
খ) রাষ্ট্র ব্যক্তি সম্পত্তি ভোগ করার পূর্ণ সুবিধা দান করবে না।
গ) রাষ্ট্র অর্থনীতির স্বাভাবিক আইনে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না
ঘ) রাষ্ট্র সমাজে ধন বৈষম্য দূর করবে।
৩। ম্যালথাস ও রিকার্ডোর মতে
ক) দারিদ্র্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি
খ) দারিদ্র্য দূর করার জন্য রাষ্ট্রের অনেক করণীয় রয়েছে
গ) মজুরী কম হলে শ্রমিকের কষ্ট কম হয়
ঘ) দারিদ্র্য প্রকৃতির অলংঘনীয় নিয়ম, রাষ্ট্রের কিছুই করণীয় নাই।
৪। উপযোগবাদ
ক) ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্টীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে।
খ) পুঁজিবাদকে উৎসাহিত করে।
গ) সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে ব্যক্তির অধিকারকে অস্বীকার করে।
ঘ) সমাজতন্ত্রের সপক্ষে ভিত রচনা করে।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। লকের মতামত পর্যালোচনা করুন।
২। উপযোগবাদ কীভাবে লিবারেলিজম ও গণতন্ত্রের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
১।খ ২।গ ৩।ঘ ৪।ক।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। দারিদ্র্য সম্পর্কে লিবালে অর্থনীতিবিদদের মত কি?
২। গণতন্ত্রসম্পর্কে বুর্জোয়া লিবারেলদের ধারণার উপর আলোকপাত করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত