আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস পৃষ্ঠা - ৯
নেপোলিয়নের ক্ষমতারোহণ ও সাফল্যের কারণ
নেপোলিয়নের সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানতে পারবেন;
নেপোলিয়নের ক্ষমতা গ্রহণের ধাপগুলো বর্ণনা করতে পারবেন;
ফ্রান্সে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নেপোলিয়নের সাফল্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন;
কনস্যুলের সংবিধান ও ফ্রান্সের সমকালীন আইনসভা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে যে সব সম্রাট বিজেতা ও সংস্কারক হিসেবে ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ
করেছেন তাদের মধ্যে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট অন্যতম। শুধু ফ্রান্স ও ইউরোপের ইতিহাসেই নয় বিশ্বের
ইতিহাসেও তিনি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। তাঁর নির্ভীক চরিত্র, আত্মবিশ্বাস এবং দৃঢ় মনোবল তাকে
সামান্য অবস্থা থেকে ফ্রান্সের রাজ সিংহাসনে আরোহণে সাহায্য করেছে। নেপোলিয়ন ছোট বেলা থেকে
বিশ্বাস করতেন যে তাঁর মধ্যে এমন কিছু ক্ষমতা লুকায়িত আছে যা তাকে একদিন বিজয়ী ও গর্বিত
করবে। তিনি তাঁর অনুসারীদের উৎসাহিত করতে পারতেন, সৈন্যদের ভালবাসতেন এবং সৈন্যদের
আনুগত্য ও ভালবাসা পেয়েছেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ স্মরণ শক্তি সম্পন্ন- এমনকি তাঁর রেজিমেন্টের
সৈন্যদের নাম মনে রাখতেন।
নেপোলিয়নের পরিচয়
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ১৭৬৯ সালে ফ্রান্সের অধিকৃত দ্বীপ কর্সিকার আজাচিও (অলধপপরড়) নামক স্থানে
জন্ম গ্রহণ করেন। এই দ্বীপটি ছিল মূলত ইতালির অধীন। তাঁর জন্মের বছরেই দ্বীপটি ইতালি ফ্রান্সের
নিকট বিক্রি করে। ফলে তিনি ইতালি বংশদ্ভুত হলেও ফ্রান্সের নাগরিকত্ব লাভ করেন। নেপোলিয়নের
বাবা চার্লস বোনাপার্ট ছিলেন একজন আইনজীবী। মা খধবঃরঃরধ জধসড়ষরহড় অল্প শিক্ষিত হলেও অত্যন্ত
সুন্দরী ছিলেন। নেপোলিয়নের তের ভাই বোনের মধ্যে ৮ জন জীবিত ছিলেন। জীবিত পাঁচ ভাই ও
তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ছোট সন্তানের বয়স যখন তিন মাস তখন তাঁর বাবা মারা
যান। নেপোলিয়ন ফ্রান্সের মিলিটারি স্কুলে লেখাপড়া করেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবি। অংক,
ইতিহাস ও ভূগোল ছিল তার প্রিয় বিষয়। ১৭ বছর বয়সে তিনি স্কুল ত্যাগ করেন এবং ফ্রান্সের পদাতিক
বাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসাবে যোগদান করেন। ১৭৯৫ সালে তিনি রাজতন্ত্রী দলের বিদ্রোহ
দমন করে জাতীয় সম্মেলনকে রক্ষা করেন। পরে তিনি ইতালি অভিযানের সেনাপতি নিযুক্ত হন এবং
সেখানে তিনি তাঁর পরবর্তী গৌরবের ভিত্তি স্থাপন করেন।
নেপোলিয়নের ক্ষমতায় আরোহণ
(১) ফরাসি জনগণের মনোভাব নেপোলিয়ন যখন বিদেশে যুদ্ধে লিপ্ত সে সময় ডাইরেক্টরি শাসনের
অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার প্রতি ফ্রান্সের সকল শ্রেণী ও স¤প্রদায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ফরাসি জনগণ এক
শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সরকার গঠণের জন্য উদগ্রীব ছিল। কাউন্সিলের অনেকে ডাইরেক্টরি শাসন
ব্যবস্থা উৎখাত করে এক শক্তিশালী সামরিক শাসনের প্রয়োজন অনুভব করেন। এদের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য সিয়েস, ব্যারাস ও রোজার ডুকো (জড়মবৎ উঁপড়ং)। ডাইরেক্টরির মধ্যে রাষ্ট্রের প্রকৃত
ক্ষমতা লাভের জন্য যখন মতানৈক্য চরমে সেই সময় নেপোলিয়ন মিশর হতে স্বদেশে ফিরে আসেন।
তাঁর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ফরাসি জনগণের মনে এক নতুন উৎসাহের ও উদ্দীপনার সঞ্চার করে।
জনসাধারণের মধ্যে এক শক্তিশালী সরকার গঠনের তীব্র বাসনা লক্ষ্য করে নেপোলিয়ন উৎসাহিত হন
এবং তিনি অযোগ্য ডাইরেক্টরি শাসন লোপ করার সিদ্ধান্তগ্রহণ করেন। প্রকৃত পক্ষে সেই সময় ফ্রান্সের
জনমত প্রজাতন্ত্রী অথবা রাজতন্ত্রী শাসনের পরিবর্তে এক শৃংখলাপূর্ণ ও স্থিতিশীল সরকার গঠনের অনুকূল
ছিল। এই অবস্থায় নেপোলিয়ন সিয়েস ও বারাস এর সহায়তায় ডাইরেক্টরদের পদচ্যূত করে কনস্যুলেট
নামে এক নতুন শাসন প্রবর্তন করেন। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে শাসন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন
ঘটিয়ে একটি দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। কিন্তু এতে তিনি ফ্রান্সে এক স্বেচ্ছাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
করেন। ডাইরেক্টরির অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ নীতির প্রতি ফরাসি জনগণ যখন আস্থা হারিয়ে ফেলে তখন
নেপোলিয়ন নিজের অনুরোধে ডাইরেক্টরগণকে পদচ্যুত করে স্বহস্তেফ্রান্সের শাসন ভার গ্রহণ করেন (৯
নভেম্বর ১৭৯৯)। এ সময় ব্যাবিয়েস এর নেতৃত্বে একটি নতুন সংবিধান রচিত হয় যা “অষ্টম সালের
সংবিধান” নামে অভিহিত।
(১) কনস্যুলেট সংবিধান
নতুন সংবিধান অনুসারে রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য দশ বছরের জন্য তিনজন
কনসাল(ঈড়হংঁষ) নিযুক্ত হন। প্রথম কনসালকে সকল ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং একমাত্র তিনিই আইন
প্রণয়ন এবং সকল প্রকার সামরিক ও বে-সামরিক কর্মচারী নিয়োগ করার অধিকারী হন। দ্বিতীয় ও
তৃতীয কনসালকে শুধুমাত্র পরামর্শ দানের অধিকার দেওয়া হয় তবে কারো নিকট জবাবদিহি করার
বাধ্যবাধকতা ছিলনা। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট প্রথম কনসাল পদে নিযুক্ত হন।
(২) আইন সভা
নতুন সংবিধান অনুসারে চারটি শাখা বিশিষ্ট আইন সভা গঠিত হয়। যথা (১) রাজ্যপরিষদ (ঈড়ঁহপরষ
ড়ভ ঝঃধঃব) (২) বিচারালয় (ঞৎরনঁহধঃব) (৩) বিধান সভা (খবমরংষধঃরাব ইড়ফু) (৪) সিনেট
(ঝবহধঃব)। রাজ্য পরিষদ আইন ও সরকারি অনুশাসনগুলি প্রণয়ন করত এবং আপীল আদালতের
ভূমিকা পালন করতো। বিচারালয় একশত সদস্য নিয়ে গঠিত ছিল এবং সরকারের পক্ষ হতে প্রস্তাবিত
আইন গ্রহণ বা বর্জন করতে পারত। কিন্তু কোনোরূপ সংশোধন মূলক পরিবর্তন করতে পারত না।
বিধান সভা তিনশত সদস্য নিয়ে গঠিত হয় এবং প্রস্তাবিত আইনগুলি আলোচনা ব্যতিরেকে গ্রহণ ও
বর্জন করতে পারত। সিনেট আশিজন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। সংবিধান বিরোধী যেকোনো আইন
সিনেট বাতিল করতে পারত। আইন সভার ক্ষমতা এভাবে বন্টিত হওয়ায় কনসালদের হাতেই প্রকৃত
ক্ষমতা রয়ে যায়। প্রতিটি শাসন বিভাগ ও কমিউনের অধিকর্তাগন প্রথম কনসাল কর্তৃক মনোনীত
হতেন। নেপোলিয়ন প্রথম কনসাল হওয়ায় ফ্রান্সের সর্বময় কর্তা হিসাবে আবির্ভূত হন।
সম্রাটরূপে নেপোলিয়ন
১৭৯৯ সালে নেপোলিয়ন প্রথম কনসাল নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে বিভিন্নভাবে তাঁর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি
উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় এবং ধাপে ধাপে নেপোলিয়ন নিজেকে সম্রাট পদে উন্নীত করেনএক. সফল ইতালিয় অভিযানের পুরস্কার হিসাবে তাঁকে প্রথম কনসাল নিযুক্ত করে তার হাতে রাষ্ট্রের
সর্ব্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল;
দুই. সংস্কারের মাধ্যমে তিনি বিপক্ষ দল গুলোর সমর্থন লাভে সক্ষম হন;
তিন. ১৮০২ সালে লিজিয়ন অব অনার (খবমরড়হ ড়ভ ঐড়হড়ঁৎ) নামে এক সম্মান সূচক পদবীর সৃষ্টি
করে তিনি তার উপর নির্ভরশীল এক নতুন অভিজাত শ্রেনীর উদ্ভব ঘটান। এ পদক্ষেপ তাঁর সম্রাট পদ
অর্জনের প্রথম সোপান বলা যায়। ১৮০২ সালে তিনি আজীবন কনসাল নিযুক্ত হন। এটা তাঁর সম্রাট
পদ লাভের পূর্বাভাস বলা যায়। প্রকৃত পক্ষে এই সময় তিনি ফ্রান্সের সর্বময় ভাগ্যনিয়ন্তা হিসাবে
পরিগণিত হন।
চার. পরিশেষে তাঁর বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রীদের ষড়যন্ত্রের সুযোগে নেপোলিয়ন ১৮০৪ সালে প্রজাতন্ত্রের
মুখোশ বর্জন করে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য নেপোলিয়ন যে সকল মন্ত্রী, প্রিফেক্ট ও
মেয়র নিযুক্ত করেছিলেন তারা প্রত্যেকেই যোগ্য এবং তাঁর প্রতি অনুগত ছিলেন। প্রথম কনসাল হিসাবে
নেপোলিয়ন ফ্রান্সে শান্তিও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। ফলে তাঁর ব্যক্তিগত মর্যাদা ও
প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়।
সম্রাট পদে নেপোলিয়নের অভিষেক
১৮০৪ সালে ফরাসি সিনেট কর্তৃক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সম্রাট পদে অভিষিক্ত হন। পোপ ষষ্ঠ পায়াস
সম্রাটের প্রতীক চিহ্ন ও রাজমুকুট নিজ হাতে নেপোলিয়নকে প্রদান করেন কিন্তু তিনি নিজ হাতে
নিজের মাথায় রাজমুকুট পড়েন। গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানের এই পরিবর্তন অনুমোদন লাভ করে।
নবলব্ধ মর্যাদা আরো বৃদ্ধির জন্য তিনি রাজকীয় মর্যাদাসম্পন্ন কিছু নতুন রাজ কর্মচারী নিয়োগ করেন
এবং ঈগল পাখি অংকিত পতাকা রাষ্ট্রীয় পতাকা হিসাবে গ্রহণ করেন। এই ভাবে নেপোলিয়ন তাঁর উপর
নির্ভরশীল এক নতুন গোষ্ঠী সৃষ্টি করেন এবং বিভিন্ন রাজকীয় উৎসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজের
সার্বভৌম ক্ষমতা সর্বত্র ঘোষণা করেন। তাই বলা হয়ে থাকে-ঞযব ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ যধফ নববহ হধৎৎড়বিফ
ঃড় ড়হব সধহ; ধহফ ঃযধঃ সধহ ষধফ পবধংবফ ঃড় নব হধঃরড়হধষ.
নেপোলিয়নের সাফল্যের কারণ
নেপোলিয়নের সাফল্য দু'পর্যায়ে আলোচনা করা যায়এক. একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং
দুই. সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে।
একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নেপোলিয়নের সাফল্যের কারণগুলো নি¤œরুপ-
(১) সন্ত্রাসের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া
নেপোলিয়নের একনায়কতন্ত্রের উৎপত্তির একটি প্রধান কারণ ছিল বিপ্লব সম্পর্কে ফরাসি জাতির
হতাশাবোধ। বিপ্লবের আশাবাদ শেষ পর্যন্তহতাশায় পরিণত হয়। সন্ত্রাসের রাজত্বের রক্তাক্ত ও
ভয়ংকরী রূপ সাধারণ মানুষের মনে বিপ্লব সম্পর্কে হাতাশা জাগায়। ওঃ ধিং যড়ঢ়ব ঃযধঃ সধফব ঃযব
ৎবাড়ষঁঃরড়হ, রঃ ধিং ফবংঢ়ধরৎ ঃযধঃ ষবঃ রঃ ধঃ ঃযব ভববঃ ড়ভ ঘবঢ়ড়ষরড়হ। লোকে ভাবতে থাকে যদি বিপ্লবের
অর্থই হয় অজস্র রক্তপাত তবে এই শাসন রাজতন্ত্র অপেক্ষা ক্ষতিকর। সন্ত্রাসের রাজত্বের বাড়াবাড়ি
বিপ্লবের আশাবাদকে বিনষ্ট করে। দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া বিপ্লবের মূল শিকড় গুলিকে
ধ্বংস করে দেয়। জ্যাকোবিন দমনের নামে বুর্জোয়া শ্রেণী ক্ষমতা দখল করে এক প্রতিক্রিয়াশীল
ব্যবস্থার পত্তন করে। বিপ্লবের প্রকৃত সন্তানেরা পরাস্তহয়। ফলে ডাইরেক্টরি শাসনকালে বুর্জোয়া শ্রেণী
পুনরায় ক্ষমতায় আসে।
(২) নেপোলিয়নের প্রতি জনগণের আস্থা
চরম হতাশার মধ্যে নেপোলিয়নের ফ্রান্সের রঙ্গমঞ্চে নতুন নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন। লোকের
বিশ্বাস ছিল এই প্রতিভাবন সেনাপতি ফ্রান্সের মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার অবসান
ঘটিয়ে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন এবং তাঁর দ্বারা কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অধিকার সংরক্ষিত
হবে। নেপোলিয়ন তাই জনসমর্থনের জোরে একনায়কত্ব কায়েম করতে সমর্থ হন।
(৩) নেপোলিয়নের সামরিক সাফল্য
ফ্রান্সের সাথে ইউরোপের রাজশক্তিগুলোর যে যুদ্ধ চলছিল, সেই যুদ্ধে নেপোলিয়নের অসাধারণ সাফল্য
জাতিকে উৎসাহিত করে। ডাইরেক্টরগণ অপেক্ষা নেপোলিয়নের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়।
নেপোলিয়নই ফ্রান্সের একমাত্র ত্রাণকর্তা- একথা অনেকেই ভাবতে থাকে। যুদ্ধে তিনি যে পারদর্শিতা
দেখান, অভ্যন্তরীণ শাসনের ক্ষেত্রেও তিনি তা দেখাতে পারবেন - এই বিশ্বাস লোকের মনে বদ্ধমূল হতে
থাকে। এক সময়ে রোমে জুলিয়াস সিজার তার সামরিক গৌরবকে পুঁজি করে যেভাবে রোমের
প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস করেন, নেপোলিয়ন তার সামরিক গৌরবকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার
কাজে লাগান। ফ্রান্সের সেনাবাহিনী নেপোলিয়নের উত্থানকে স্বাগত জানায়।
(৪) নেপোলিয়ন কর্তৃক বিপ্লবের মূল্যবান পরিবর্তনগুলি রক্ষার আশা
নেপোলিয়ন সাধারণ পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর শাসনে বিপ্লবের মূল পরিবর্তনগুলো রক্ষা পাবে এবং
শৃংখলা ফিরে আসবে এই আশা ফরাসি জাতিকে প্রভাবিত করে। প্রবীণ বিপ্লবী নেতারা নেপোলিয়নকে
সমর্থন করায এই ধারণা দৃঢ়তর হয়। ব্যাবেমিয়েস কনস্যুলেটের সংবিধান রচনার প্রাক্কালে ঘোষণা
করেন যে, নতুন সংবিধানে জনগণের আস্থার সঙ্গে শৃংখলা সমন্বয় করা হবে (ঈড়হভরফবহপব ভৎড়স
নবষড়ি ধহফ ধঁঃযড়ৎরঃু ভৎড়স ধনড়াব রিষষ নব পড়সনরহবফ )।
(৫) নেপোলিয়ন কর্তৃক সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা
নেপোলিয়নের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা তার সাফল্যের মূলে কাজ করে। বাস্তববাদী নেপোলিয়ন বুঝতে
পারেন যে, ফরাসি জাতির একটি বৃহৎ অংশ কৃষক ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর। বিপ্লবের ফলে যে সুযোগ হাতে
পান তারা তা বজায় রাখতে আগ্রহী। নেপোলিয়ন এই সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা করেন।
তিনি বলেন লোকে যেরূপ শাসন ব্যবস্থা চায়, আমি তাই করছি (গু ঢ়ড়ষরপু পড়হংরংঃং রহ মড়াবৎহরহম
সবহ ধং ঃযবু রিংয ঃড় নব মড়াবৎহবফ)। ঐতিহাসিক ফিশার মনে করেন, “বিপ্লবের চরমপন্থী আদর্শের
প্রতি সাধারণ লোকের সমর্থন ছিলনা। নেপোলিয়ন জনসাধারণের আকাঙক্ষা ও উদাসীন্যের সুযোগ
গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান শাসক। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি বিপ্লবের আদর্শ
গুলিকে তিনি গ্রহণ করেন। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন, “ফরাসি জাতির জন্য স্বাধীনতার চেয়ে
সাম্য অধিকতর কাম্য।”
খ. সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ইউরোপে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তাঁর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার
ক্ষেত্রে সাফল্যের কারণগুলো নি¤েœআলোচনা করা হলো :
(১) তাঁর সামরিক প্রতিভার জন্য অতি দ্রæততার সঙ্গে ইউরোপ মহাদেশে এক বিরাট অংশ জুড়ে তার
সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। নেপোলিয়নের সামরিক প্রতিভা যে অসাধারণ ছিল তাতে কেনো সন্দেহ
নেই। স্থলযুদ্ধের রণপরিকল্পনা এবং যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারে তিনি এক অদ্বিতীয় ভূমিকা পালন করেন।
তিনি কেবলমাত্র সাহস ও বীরত্ব খাটিয়ে যুদ্ধ জয়ের কথা ভাবতেন না। মৌলিক সুযোগ সুবিধা
গ্রহণ, আগ্নেয়াস্ত্রের সফল প্রয়োগ, সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি এবং সেনাদলের মনোবল অক্ষুন্ন
রাখতে সচেষ্ট থাকতেন। এক কথায় রণকৌশলের বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগের সঙ্গে নিজ সেনাদলের
মনোবলকেও তিনি সমান গুরুত্ব দিতেন। নেতৃত্বদানে তার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল।
(২) ব্যক্তিগত গুণাবলী দ্বারাও তার বিরুদ্ধে ইউরোপের জোট বা কোয়ালিশন ভেঙে দেয়া সহজ
ছিল। কারণ, নেপোলিয়নের সেনাদল কেবলমাত্র বেতনভোগী পেশাদার সেনা ছিলনা। তার
সেনাদল ছিল রাজনৈতিক আদর্শে উদ্দীপিত। তারা বিশ্বাস করত যে, তারা ইউরোপ জয়ে বিপ্লবী
ফ্রান্সের পতাকা বহন করছে। তারা নিজেদেরকে ইউরোপের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ভাবত। আদর্শে
উদ্দীপিত নাগরিক সেনা সাধারণ বেতনভোগী সেনাদল অপেক্ষা অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা
পালন করে।
(৩) নেপোলিয়ন সেনাদের রসদ পত্র ও যুদ্ধের খরচা প্রধানত অধিকৃত দেশ থেকে আদায় করতেন
কাজেই তাকে স্বদেশ থেকে দীর্ঘ পথ পার হয়ে রসদ আনতে হত না। তার বিপ্লবী প্রচারে
প্রভাবিত হয়ে আক্রান্তদেশ থেকেই যুদ্ধের রসদ যোগানো হতো।
(৪) তিনি এবং তাঁর অধীনস্থ সেনাপতিরা আক্রান্তদেশের সাধারণ মানুষের প্রতি উদার ব্যবহার
করতেন। নেপোলিয়ন তাঁর ভাইকে জার্মানির শাসনভার গ্রহণের আগে নির্দেশ দেন যে, সাধারণ
মানুষরাই ফরাসিদের মিত্র হতে পারে একথা ভুললে চলবে না। নেপোলিয়ন সামন্তশাসক ও
স্বৈরাচারী রাজাদের হাত থেকে তাদের মুক্তি দিতে এসেছেন জনসাধারণের মাঝে এ ধারণা দিতে
হবে। নেপোলিয়ন প্রথমদিকে তাঁর বিপ্লবী ভাবমূর্তি এমনভাবে ব্যবহার করেন যে, ইউরোপের
জনগণ তাকে মুক্তিদাতারুপে বরণ করে নেয়। ইউরোপের রাজশক্তিগুলি নিজ দেশের প্রজাদের
কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় নেপোলিয়নের সুবিধা হয়।
(৫) ইউরোপীয় রাজারা বেতনভোগী সেনাদের সাহায্যে নেপোলিয়নকে বাধা দেন। প্রজাদের স্বতঃস্ফুর্ত
সহায়তা তারা পাননি। দু’ একটি যুদ্ধে বেতনভোগী সেনারা পরাস্তহলে তারা নতি স্বীকারে বাধ্য
হন। তারা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। যতদিন
নেপোলিয়নের ভাবমূর্তি বজায় ছিল ততদিন ইউরোপের রাজশক্তিগুলি ব্যর্থ হয়।
(৬) প্রকৃতপক্ষে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যে ইউরোপীয় শক্তি জোট গঠিত হয়, সেগুলো তেমন
শক্তিশালী ছিলনা। এগুলো কেবলমাত্র পারস্পরিক অবিশ্বাস ও নিজ নিজ রাজ্য বিস্তারে গুরুত্ব
দানের ফলে শক্তি জোট গুলি নেপোলিয়নকে উপযুক্ত বাধা দিতে সক্ষম হয়নি। ইউরোপীয় শক্তি
জোটগুলির পারস্পরিক আস্থাহীনতা নেপোলিয়নের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয়ের জন্য দায়ী ছিল।
নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে শক্তি জোট ভেঙে যাওয়ার ফলে তিনি একের পর এক রাজ্য জয় নীতি গ্রহণ
করেন। প্রতিপক্ষ দেশগুলোকে পরাজিত করে নিজ সাম্রাজ্য স¤প্রসারণ করতে সক্ষম হন।
সারসংক্ষেপ
ফরাসি বিপ্লব থেকে সৃষ্ট হিসাবে খ্যাত নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও নিজের
অসাধারণ যোগ্যতা বলে প্রধান সেনাপতিসহ ফ্রান্সের সম্রাট রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
ফ্রান্সের সমকালীন রাজনৈতিক দুরবস্থা এবং তাঁর অসামান্য রণকৌশল ও বাস্তব জ্ঞান তাঁকে একের পর
এক সাফল্য এনে দেয়। তিনি ফ্রান্সের মানুষের মানবিক দাবি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং তা
যথাযথ পূরণ করায় ফ্রান্সের মানুষ তাঁর ক্ষমতা লাভকে আর্শীবাদ হিসাবে গ্রহণ করে। নেপোলিয়নও
সময়ের দাবি বুঝতে পেরে তা পূরণ করেন। তাঁর নেতৃত্ব এবং দেশপ্রেমে সেনাবাহিনীকে বিপুল প্রভাবিত
করে। ফলে সৈন্যরা নিজেদেরকে ইউরোপের মুক্তিবাহিনী মনে করত। ইউরোপীয় রাজাদের দুর্বলতা ও
পারস্পরিক অবিশ্বাস তাকে সাম্রাজ্য বিস্তারের সুযোগ করে দেয়। এ ছাড়া তাঁর কূটনীতি ও কৌশল
সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। নেপোলিয়নের জন্মের পূর্বে কসির্কা দ্বীপ কার অধীন ছিল?
ক. ফ্রান্সের খ. ইতালির
গ. ব্রিটেনের ঘ. গ্রিস
২। নেপোলিয়নের কত বছর বয়সে ফ্রান্সের সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেন?
ক. ১৩ খ. ১৫
গ. ১৭ ঘ. ১৯
৩। সম্রাটরূপে নেপোলিয়নের ক্ষমতা লাভের প্রাক্কালে ফ্রান্সের সর্বময় ক্ষমতা কার হাতে ছিল?
ক. ডাইরেক্টরদের হাতে খ. প্রথম কনসালের হাতে
গ. ষোড়শ লুইয়ের হাতে ঘ. ব্যারাসের হাতে
৪। যুদ্ধের সময় নেপোলিয়ন রসদ যোগাড় করতেন কোথা থেকে?
ক. অধিকৃত দেশ থেকে খ. নিজ দেশ থেকে
গ. প্রতিবেশী দেশ থেকে ঘ. মিত্র দেশ থেকে
৫। নেপোলিয়নের সেনাপতিরা আক্রান্তদেশেরে মানুষের সাথে কেমন ব্যবহার করত?
ক. প্রভুর ন্যায় খ. নিষ্ঠুর
গ. স্বাভাবিক ঘ. উদার
রচনমূলক প্রশ্ন
১। নেপোলিয়নের বাল্যকাল ও ক্ষমতা লাভ আলোচনা করুন।
২। নেপোলিয়নের সাফল্যের কারণগুলো বিশ্লেষণ করুন।
৩। নেপোলিয়নের ক্ষমতা লাভ ও সাফল্যের বিভিন্ন দিক আলোচনা করুন।
৪। ফ্রান্সে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে নেপোলিয়ন কতটুকু সফল ছিলেন?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। নেপোলিয়নের বাল্য জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিন।
২। নেপোলিয়নের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে ফরাসি জনগণের মনোভাব কেমন ছিল?
৩। কনস্যুলেট সংবিধান কি?
৪। সম্রাট পদে নেপোলিয়নের অভিষেক বর্ণনা করুন।
৫। কেন সাম্রাজ্য বিস্তারে নেপোলিয়ন সফল হয়েছিলেন?
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত