জার্মানির একত্রীকরণ মানে হচ্ছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত থাকা জার্মান রাজ্যগুলো একীভ‚ত হয়ে
একটি রাষ্ট্র গঠন করা। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্টফালিয়ার সন্ধির দ্বারা জার্মানিকে ৩৬০ টির মতো ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত করা হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে বিচ্ছিন্ন এই রাজ্যগুলিকে একত্রীকরণের প্রচেষ্টা শুরু
হয় এবং ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে এই প্রচেষ্টা পূর্ণতা লাভ করে, এরই ফলশ্রæতিতে জার্মান সাম্রাজ্য গঠিত হয়।
জার্মান একতা ইউরোপের ইতিহাসের সবচাইতে গতিপরিবর্তনকারী ঘটনা হিসাবে পরিগণিত হয়।
কেননা ঐক্যবদ্ধ জার্মানি প্রথমবার ১৯১৪ সালে, আবার ১৯৩৯ সালে পৃথিবীকে চ্যালেঞ্জ করে। দুভাবেই
জার্মান পরাজয় বিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিপথকে প্রভাবিত করে।
উনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানির রাজনৈতিক অনৈক্য
উনবিংশ শতাব্দীতে জার্মান রাজ্যগুলির মধ্যে একটি মাত্র মিল ছিল যে তারা সবাই পবিত্র রোমক
সাম্রাজ্যের প্রতি নামমাত্র আনুগত্য পোষণ করত। অন্যান্য সব বিষয়ে রাজ্যগুলো ছিল সম্পূর্ণপৃথক।
রাজ্যগুলোর মধ্যে আকার এবং প্রতিপত্তির দিক থেকে বিশাল পার্থক্য ছিল। অস্ট্রিয়া বা হ্যাপসবার্গ
সাম্রাজ্য ছিল ১১৫,৫৩৩ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট অপর পক্ষে সোয়াস্টবার্গ সন্ডারহাউজেন ছিল মাত্র
৩৩ বর্গমাইল আয়তনের। সবচাইতে প্রতিপত্তিশালী রাজ্য ছিল অস্ট্রিয়া এবং এর শাসনকারী রাজবংশ
হ্যাপসবার্গ। আরেকটি রাজ্য প্রæশিয়া সামরিক শক্তিতে বেশ অগ্রসর ছিল এবং এ রাজ্যটি অস্ট্রিয়াকে
তার প্রতিদ্ব›দ্বী মনে করত। ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রেখে অস্ট্রিয়া না হয় প্রæশিয়ার
প্রভাব বলয়ে থাকার চেষ্টা করত। ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্যের দিক থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে
বিশাল তফাৎ ছিল। উত্তরের প্রটেস্টান্ট এবং রক্ষণশীল এলাকাগুলোর সঙ্গে দক্ষিণের ক্যাথলিক এবং
অপেক্ষাকৃত উদার রাজ্যগুলোর সঙ্গে সাংস্কৃতিক পার্থক্য নজর কাড়ার মত ছিল।
অর্থনৈতিক অবস্থা
জার্মানির প্রায় নব্বই শতাংশ লোক মফস্বলে বসবাস করত এবং কৃষিকাজই তাদের পেশা ছিল। উন্নত
অর্থনীতির জন্য যে সব শর্তের প্রয়োজন ছিল জার্মানিতে তার অভাব ছিল। বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা ও ওজন
ব্যবস্থা ছিল পুরো জার্মানির বৈশিষ্ট্য। এক হিসাব মতে ১৭৯০ থেকে ১৮০০ মতো শুল্কবাধা জার্মানিতে
বজায় ছিল। একজন ফরাসি পর্যবেক্ষক এ সম্পর্কে বলেছিলেন, জার্মানির বণিকরা লোহার খাঁচার মধ্যে
আবদ্ধ বন্দির ন্যায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে’’। যোগাযোগ ব্যবস্থা এত শোচনীয় ছিল যে একজন ভ্রমণকারির
ওয়াইমার থেকে এরফুটের মত স্বল্প দূরত্বের শহরে পৌঁছাতে পাঁচ ঘন্টার মত সময় লাগত। রাজ্যগুলোর
মধ্যে সামরিক ব্যাপারে প্রতিবেশী রাজ্যের উপর নির্ভরতা পরিহার করার প্রবণতা ছিল, ফলে সামরিক
ব্যয় বেড়ে যায়। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বিকশিত হবার পথে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। সমাজ ব্যবস্থা
ছিল মান্ধাতা আমলের, যেখানে ব্যক্তির বিকাশকে বাধা দেওয়া হতো। এলব নদীর পূর্ব প্রান্তেতখনও
পর্যন্ত সার্ফ ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। যদিও এর পশ্চিম পাড়ের কৃষকরা কিছুটা স্বাধীন ছিল, কিন্তু তারা
নানা করভারে জর্জরিত ছিল। ইউরোপের অন্যান্য দেশে গিল্ড প্রথা ভেঙ্গে গেলেও জার্মানিতে তা
অনেক দিন বজায় ছিল। অবৈধ কারিগরদের শাস্তিদেওয়ায় আসলে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে স্তব্ধ করে
দেওয়া হয়।
নেপোলিয়নের শাসন
১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরবর্তী কুড়ি বছর ধরে
নেপোলিয়নের সুশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে জার্মান রাজ্যগুলো পাঁচটি বড় ধরনের অসফল যুদ্ধ চালিয়ে
পরাজয় বরণ করে। ১৮১২ সালে নেপোলিয়ন যখন মস্কো থেকে পর্যুদস্তহয়ে পিছু হটে আসেন তখন
প্রæশিয়া, অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়া মিলিত হয়ে লিপজিগের যুদ্ধে নেপোলিয়নকে পরাজিত করে। ১৮১৪
সালে মিত্রশক্তি ফ্রান্স অধিকার করে। যদিও ফরাসি শাসনের উদ্দেশ্য ছিল জার্মানদেরকে পদানত রাখা,
কিন্তু ফরাসি শাসন জার্মানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। প্রথমত,
এলাকার পুর্নবন্টনের মাধ্যমে নেপোলিয়ন জার্মান রাজ্য ব্যবস্থার মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোকে তিনি ভেঙ্গে দুইশত রাজ্যের পরিবর্তে ৩৯টি রাজ্য গঠন করেন। এ ভ‚খন্ডগত
পরিবর্তনের ফলে জার্মানির রাজনৈতিক মানচিত্র সহজীকরণ করা হলো এবং জামানির ঐক্য সম্ভবনাময়
হয়ে উঠল। প্রæশিয়া নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হবার পর আধুনিকায়নের পথ ধরে এক সময়
জার্মান একত্রীকরণের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। নেপোলিয়নের অধীনে থাকার সময় এক ধরনের
জার্মান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়।
প্রæশিয়ার আধুনিকায়ন
১৮০৬-৭ সালে প্রæশিয়া ভয়ানকভাবে নেপোলিয়নের হাতে পর্যুদস্তহয়। প্রæশিয়াকে বড় পরিমাণের
ক্ষতিপূরণ, একদল ফরাসি সৈন্যের উপস্থিতি এবং পূর্বের তুলনায় ছোট আকারের প্রæশিয়ান সৈন্য বাহিনী
অপমানজনকভাবে মেনে নিতে হয়েছিলো। ধীরে ধীরে প্রæশিয়া সংস্কারের পথ বেছে নেয়। স্কটল্যান্ডের
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এ্যাডাম স্মিথ বলেছেন ’’মুক্ত মানুষের দ্বারা উৎপন্ন দ্রব্য দাসদের বানানো পণ্যের
তুলনায় সস্তা পড়ে’’। প্রæশিয়ার রাষ্ট্রনায়কদের কাছে এই বাণী আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। প্রæশিয়ার ক্ষমতাবান
মন্ত্রী ব্যারন হাইনরিখ ফম স্টাইন (ইধৎড়হ ঐবরহৎরপয ঠড়স ঝঃবরহ) এবং তার পরবর্তী যুবরাজ কার্লফন
হার্ডেনবার্গ (কধৎষ ঠড়হ ঐধৎফবহনবৎম)-এর নেতৃত্বে প্রæশিয়া গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংস্কার করে
আধুনিকতার পথে পা বাড়ায়।
১৮০৭-১০ সালের মধ্যে সার্ফদের মুক্তি দেওয়া হয়। কঠোর শ্রেণী প্রথার মধ্যে কিছুটা শিথিলতা
আনয়ন করা হয়। যেমন অভিজাতরা ব্যবসা ও শিল্প কলকারখানায় প্রবেশ করার এবং বুর্জোয়ারা ভ‚মি
মালিকানা লাভ করার অধিকার লাভ করে। ১৮০৮ সালে মিউনিসিপাল আইন পাশ করা হয়। শহরগুলো
নির্বাচিত মিউনিসিপাল কাউন্সিল লাভ করার অধিকার পায়। স্টেন নির্বাচিত রাজ্যসভার পরিকল্পনাও
করেন, কিন্তু রাজা এত চরম ব্যবস্থায় যেতে রাজি হন নি। সারা রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষাবিস্তারের ব্যবস্থা
করা হয়। প্রচুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ১৮১০ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা
হয়।
উল্লেখযোগ্য সামরিক সংস্কার করে আধুনিক সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। পুরনো এবং অযোগ্য
সামরিক অফিসারদেরকে বিদায় দেওয়া হয়। প্রতিভা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সামরিক
বাহিনীতে স্থান দেওয়া হয়। চাবুক দ্বারা সৈন্যদেরকে প্রহার ও অন্যান্য অপমানজনক শাস্তিতুলে দেওয়া
হয়। সারা দেশে সর্বজনীন সামরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এখানে আমাদেরকে মনে রাখা দরকার
নেপোলিয়নের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে প্রæশিয়ার সৈন্য সংখ্যা ৪২,০০০ -এর বেশি বাড়ানোর কোনো উপায়
ছিল না।
জার্মান জাতীয়তাবাদ
১৭৮৯ সালের পূর্বে জার্মান দেশপ্রেমের খুব অল্প চিহ্নই ছিল। জার্মানরা ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি
অনুকরণ করত। জার্মান উদারনৈতিকরা ফরাসি বিপ্লব এমন কি ফরাসি সামরিক সাফল্যকে অভিনন্দিত
করেছিলো। ১৮০৬ সালে দার্শনিক হেগেল আশা করেছিলেন যে, নেপোলিয়ন জার্মানির শত্রæদেরকে
পরাজিত করবে। কিন্তু ১৮১৩-১৪ সালে এটা সুষ্পষ্ট হয়ে উঠে যে জার্মানিতে জাতীয়তাবাদ শক্তি অর্জন
করছে।
জার্মান জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানোর পিছনে বিরাট অবদান রাখেন কয়েকজন জার্মান দার্শনিক।
জোহান ফন হার্ডার (ঔড়যধহহ ঠড়হ ঐবৎফবৎ, ১৭৮৮-১৮০০) জোর দেন যে জার্মান জাতির একটা
আলাদা ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কোনো সভ্যতা সঠিক ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারে না
যদি সে তার সাধারণ মানুষের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে প্রকাশ করার সুযোগ না দেয়। হার্ডার জার্মান
লোকসাহিত্য ও বীর গাঁথাকে সংকলিত করে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেন। বিখ্যাত জার্মান
দার্শনিক হেগেল (১৭৭০-১৮৩১) জার্মান রাজ্যগুলোর অনৈক্যকে অভিহিত করেন থিসিস (ঃযবংরং)
হিসেবে, এই থিসিস বা অনৈক্য জন্ম দিয়েছে একত্রিত হওয়ার বাসনাকে, যা তাঁর মতে এন্টিথেসিস
(ধহঃরঃযবংরং), আর এই এন্টিথেসিস একত্রিত হবার আকাংক্ষা জন্ম দিবে সুষ্ঠু, সুন্দর একটি আধুনিক
জাতীয় রাষ্ট্র বা সিনথেসিস (ংুহঃযবংরং) এ। হেগেলের মতে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে
ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্ট একটি সংগঠন যার অভ্যন্তরে আইন ও ঐতিহ্যের দ্বারা মানুষ পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ
করতে পারে। জে, ডি, ফিশটে নামক আরেকজন দার্শনিক হার্ডারের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের ধারণাকে
গ্রহণ করে অভিমত প্রকাশ করেন যে, জার্মান জাতির সহজাত প্রাণ-উদ্দীপনা অন্য জাতির থেকে
জার্মানদেরকে শ্রেষ্ঠতর করেছে। তাঁর মতে, পৃথিবী এখনো জার্মান জাতির এই বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে
পারে নি, ভবিষদ্বাণী করে তিনি বলেন যে, শীঘ্রই পৃথিবীর মানুষ এর পরিচয় পাবে।
দার্শনিক বা কবি সাহিত্যিকদের লেখার বাইরে জাতীয়তাবাদকে ছড়িয়ে দেবার প্রচেষ্টায় একটি
সংগঠনের আর্বিভাব ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত এই সংগঠনের নাম বারসেনশাফট
(ইঁৎংবযবহপযধভঃ)। প্রæশিয়ার ফ্রেডারিখ জান (ঋৎরবফৎরপয ঔধযহ) ছাত্রদের মাঝে শারীরিক কসরৎ ব্যয়াম
এবং জাতীয়তার চেতনাকে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জার্মান
জাতীয়তাবাদ জার্মান ভাষা এবং জার্মান রক্তের উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলো। ইহুদি ও অন্যান্য
বিদেশী বংশোদ্ভুতদেরকে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সঙ্গে দেখা হতো।
ফরাসি শাসনাধীনে থাকার সময় জাতীয়তাবাদীদের বন্দনা ও প্রেরণা দান করার মত দুটো ঘটনা ঘটে যা
জাতীয়তাবাদকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। জার্মান ছাত্রদের একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রæশিয়ান
সেনা কর্মকর্তা এডলফ ফন লুটজোর নেতৃত্বে গড়ে উঠে। কালো কাপড় পরিহিত, লাল সোনালী
পতাকা বহনকারী জীবনবাজি রেখে যুদ্ধকারী এই বাহিনী জার্মানদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলো।
১৮১৩ সালে জার্মান কনফেডারেশন সৈন্যরা এই বাহিনী নিশ্চিহ্ন করলেও মানুষের হৃদয় থেকে
তাদেরকে অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮১২ সালের যুদ্ধের সময়
ফরাসিদেরকে তাড়ানোর জন্য। নেপোলিয়ন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাদাপসরণের সময় তার
সহযোগিতাকারী প্রæশিয়ান জেনারেল ফন ইয়র্কের নেতৃত্বাধীন বাহিনী নেপোলিয়নের বাহিনী হতে
নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এদের প্রতিরোধ দেখে নেপোলিয়ন
বলে ফেলেছিলেন “তাহলে জানোয়ারগুলো কিছু শিখেছে”। ঘটনা দুটো বিচ্ছিন্ন হলেও জার্মান
জাতীয়তাবাদীদের জন্য এগুলো অনুকরণীয় উদহারণ হয়ে রয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে তাদেরকে
উজ্জীবীত করেছে।
জার্মান কনফেডারেশন
১৮১৪ সালের পর জার্মানির পক্ষে ১৮০১ সালের পূর্বাবস্থা কিংবা একত্রীকরণ কোনোটাই সম্ভব ছিল না।
ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার জন্য দায়ী ছিল রাজ্যগুলোর সন্দেহ অবিশ্বাস এবং কায়েমী স্বার্থবাদ। মেটারনিক
৩৯টি রাজ্যের সমন্বয় করে একটি কনফেডারেশন বা ইঁহফ স্থাপন করে এক ধরনের ঐক্য স্থাপনের
চেষ্টা করেন। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর ঐ অঞ্চলে মূলত স্থিতিশীলতা এং নিয়ন্ত্রণমূলক
প্রতিষ্ঠান হিসেবে মেটারনিক কনফেডারেশনকে গড়ে তোলেন। এই কনফেডারেশনকে জার্মান ঐক্যের
ব্যাপারে কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে।
প্রথমত, এটি এমন একটি সংগঠন ছিল যা জনগণের আশা আকাংক্ষার প্রতিভ‚ ছিল না, ছিল
রাজন্যবর্গের ক‚টনৈতিক একটি সভা। সবচাইতে অদ্ভুত ব্যাপার ছিল বৃটেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস
আইনগতভাবে এই কনফেডারেশনের সদস্য ছিল, কেননা ১৮৩৭ সালে পর্যন্তব্রিটেন হ্যানোভারকে
শাসন করত, ডেনমার্কের রাজা হোলস্টেনের ডিউক ছিলেন, নেদারল্যান্ডের রাজা লুক্সেমবার্গের গ্র্যান্ড
ডিউক ছিলেন। তাছাড়া কনফেডারেশনের ক্ষমতা ছিল সীমিত, কোনো সদস্য রাজ্য ইচ্ছা করলে এর
আইন মানতে অস্বীকৃতি জানাতে পারত। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তনেওয়ার জন্য দুই তৃতীয়াংশ
সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হতো যা বাস্তবে ছিল অসম্ভব। কনফেডারেশনের কোনো নিজস্ব সেনাবাহিনী
ছিল না। যদিও কাগজে কলমে ১৮২১ সাল থেকে সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে সৈন্য নিয়ে এ রকম একটি
বাহিনী থাকার কথা ছিল, কিন্তু কোনো রাজ্যই এ দায়িত্ব পালনে উৎসাহী হয় নি। স্বাতন্ত্র্য এবং রাজাদের
স্বাধীনতা বজায় রাখার চেষ্টা শতাব্দী ধরে জার্মান অনৈক্যের কারণ ছিল, এটা এখন কনফেডারেশনেও
একটা অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। কনফেডারেশনের উদ্দেশ্য ছিল দুই শক্তিশালী রাজ্য প্রæশিয়া ও
অস্ট্রিয়ার শক্তির মধ্যে সমন্বয় এনে জার্মানিতে স্থিতি আনয়ন করা। কিন্তু ক্রমেই দেখা গেল দুই শক্তির
স্থান এক সঙ্গে হওয়া সম্ভব নয়। অস্ট্রিয়া এবং মেটারনিকের প্রাধান্যই কনফেডারেশনে স্থাপিত হলো।
তারপরও উদারনৈতিকগণ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বিভিন্ন পেশাজীবী
সংগঠনটিকে জার্মানি ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মেনে নিয়েছিলো। কেউ কেউ চাচ্ছিলেন কনফেডারেশনটি
ফ্রান্স বা বৃটেনের মডেল অনুযায়ী উদার এবং প্রগতিশীল হবে। এখানে শাসনতন্ত্রঅনুযায়ী জনগণের
নির্বাচিত প্রতিনিধি শাসন করবে, বিচার চলবে জুরিদের দ্বারা এবং মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা
থাকবে। কিন্তু উদারনৈতিকদের এবং জাতীয়তাবাদীদের এসব ধারণা অস্ট্রিয়া, প্রæশিয়া এবং সদ্য
সিংহাসনে বসা ব্যাভারিয়া, হ্যানোভার, র্উটেমবার্গ, স্যাকসনির রাজাদের দ্বারা তীব্র প্রতিবাদের বিষয়
হয়ে দাঁড়ায়। জাতীয়তাবাদকে তাঁরা তাদের কর্তৃত্বের উপর হুমকি স্বরূপ মনে করে। ১৮১৯ সালে
কার্লসবার্গে জার্মান শাসকদের এক সম্মেলনে মেটারনিক ঘোষণা করেন যে, জার্মান কনফেডারেশনের
অভ্যন্তরে যে কোনো সম্ভাব্য বিপ্লবী হুমকি মোকাবেলা করা হবে। সকল রাজন্যবর্গ এই বক্তব্যকে সমর্থন
করেন।
বৈদেশিক নীতিতে কনফেডারেশনের উদ্দেশ্য বিদেশীদের হাত থেকে জার্মান স্বার্থ রক্ষা করা হলেও
দেশের অভ্যন্তরে ক্রমেই এর উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় উদারনৈতিক এবং জাতীয়তাবাদীদের হাত থেকে
রাজন্যবর্গকে রক্ষা করা। দুটি ঘটনার পর থেকে উদারনৈতিক এবং জাতীয়তাবাদীদের উপর
মেটারনিকের দমন ও নিপীড়ন বেড়ে যায়। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের তিনশত জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠান
উপলক্ষে তাঁর জন্মস্থান র্উটেমবার্গে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। র্উটেমবার্গ উৎসবে জেনা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজন্যবর্গ এবং সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এর পরে
মেটারনিকের অনুসারী জার্মান সাংবাদিক ও কবি কোৎসেবুকে কার্লসাবন্ড নামে এক ছাত্র হত্যা করে।
এসব ঘটনায় বিচলিত হয়ে মেটারনিক বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন কনফেডারেশনের কার্যনির্বাহী পরিষদ
বা ডায়েটের মাধ্যমে পাশ করেন। ১৮১৯ সালে কার্লসবাড আইন পাশ করা হয়। এর মাধ্যমে
বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ড, সংবাদপত্র ও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে সরকারি খবরদারি বাড়ানো
হয়। গোপন সংগঠনগুলোর কার্যাবলির উপর অনুসন্ধান চালানো এবং বিচারের জন্য প্রমাণাদি সংগ্রহের
জন্য মেইনজে একটি কেন্দ্রীয় কমিশন গঠন করা হয়। ১৮২০ সালে ভিয়েনার চ‚ড়ান্তআইন (ঋরহধষ অপঃ
ড়ভ ঠরবহহধ) পাশ করা হয়। এই আইনে নির্বাচিত পরিষদগুলোর আলোচনার বিষয়বস্তু সীমিত করা হয়
এবং ডায়েট বিভিন্ন রাজ্যগুলোর কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা লাভ করে।
১৮৩০ এর জুলাই বিপ্লব ও জাতীয়তাবাদ
নিবর্তনমূলক আইন প্রবর্তন করার ফলে জার্মানিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে কিছুটা ভাটা পড়ে। কিন্তু
১৮৩০ সালের জুলাই বিপ্লবের ফলে এ আন্দোলন আবার উৎসাহিত হয়। হ্যানোভারে এক বিশাল
জনসমাবেশে জার্মানির ঐক্য ও সংহতির শপথ নেওয়া হয়। ব্রনসউইক, স্যাক্সনি, হেস-কেসেলে
বিপ্লবের ফলে নতুন শাসনতন্ত্রঘোষণা করা হয়। ১৮৩২ সালে হ্যামবাক উৎসবে ২৫,০০০ জনতা
সমবেত হয়ে পবিত্র মৈত্রীর বিরুদ্ধে এবং জার্মানির ঐক্যের পক্ষে দাবি তোলে। এই প্রেক্ষাপটে ছয়
আইন (ঝরী অপঃং) পাশ করা হয়। এই সব আইনে জনসভা নিষিদ্ধ হয় এবং জার্মান রাজাদের
সার্বভৌমত্ব হানিকর যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে বলা হয়। তারপরও জার্মানিতে জাতীয়তাবাদ
বিকশিত হতে থাকে। ১৮৪০ -এর দশকে অনেকে ধারণা করতে থাকেন যে, দূর প্রাচ্যে ফরাসিদের
অপমানের কারণে (ফরাসি সমর্থিত মিশরের পাশা মোহাম্মদ আলীর পরাজয়) ফরাসিরা জার্মানিতে
তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। এই আশঙ্কার প্রেক্ষাপটে জার্মানিতে এক ধরনের ফরাসি বিরোধী
মনোভাব এবং জার্মান দেশপ্রেমের অপূর্ব জাগরণ ঘটে।
অর্থনৈতিক উন্নতি
এই পর্যন্তআমরা জার্মানির যে চিত্র পাচ্ছি তাতে দেখা যাচ্ছে যে, একদিকে জার্মান কবি সাহিত্যিক,
দার্শনিক এবং তাদের প্রভাবে উদারনৈতিক এবং জাতীয়তাবাদীরা জার্মান ঐক্যের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছে, আর অপরদিকে মেটারনিকের নেতৃত্বে জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যের রাজন্যবর্গ তা মরিয়া হয়ে
প্রতিহত করছে। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে একটি নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধিত হলো যা জার্মানির
একতাকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে। বেশ কিছু অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে জার্মানির রাজনৈতিক
বিচ্ছিন্নতা সত্তে¡ও বিভিন্ন রাজ্যগুলি এক অর্থনৈতিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো। ১৮১৮ সালে প্রæশিয়া
বিদ্যমান বিভিন্ন শুল্ক ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে মানসম্পন্ন একক অভ্যন্তরীণ শুল্ক ব্যবস্থা চালু করে। ১৮১৯
সালে প্রæশিয়া তার রাজ্যের বাইরে অবস্থিত রাজ্যগুলোর সঙ্গে শুল্ক সংক্রান্তচুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ১৮৩৪
খ্রিস্টাব্দ জোলভেরাইন নামে একটি শুল্কসংঘ রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৪৪ সাল নাগাদ
হ্যানোভার বুল্ডেনবার্গ, ম্যাকলেনবার্স, হ্যানসেটিক শহরগুলো এবং হ্যাপসবার্গ রাজতন্ত্রছাড়া আর সব
রাজ্য এই সংস্থার সভ্য হয়। এর ফলে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরদার হয় এবং তারা
একত্রীকরণের ফলে যে সুবিধা প্রত্যক্ষ করে তা আরো বিস্তৃত করার জন্য রাজ্যগুলো জার্মান ঐক্যের প্রতি
আগ্রহী হয়ে উঠে। প্রæশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কি রকম বৃদ্ধি পায় তা একটা উদহারণ দিলে সুষ্পষ্ট
হবে। ১৮১৫ সালে প্রæশিয়ায় চলাচলের রাস্তা ছিল ২৪,০০০ মাইল, ১৮২০ সাল নাগাদ তা বেড়ে
৫২,০০০ মাইলে গিয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে প্রæশিয়ার মর্যাদা বৃদ্ধি
পায়, আর হ্যাপসবার্গের প্রভাব হ্রাস পায়। হ্যাপসবার্গ রাজতন্ত্রের একজন মুখপাত্র ১৮৩৩ সালে বলেন
“জোলভেরাইন ছিল কনফেডারেশনের কফিনের উপর একটি প্রধান পেরেক”। ১৮৫৭ সাল নাগাদ
হ্যাপসবার্গ রাজতন্ত্র একদিকে জোলভেরাইনে যোগদান করতে অসমর্থ হয়, অপর দিকে একটা পাল্টা
অর্থনৈতিক সংঘ করতেও ব্যর্থ হয়। হ্যাপসবার্গ রাজতন্ত্রীরা ছিল অত্যন্তসংরক্ষণবাদী, প্রæশিয়া অবাধ
অর্থনীতির ফলে অগ্রগতি লাভ করে, কিন্তু অস্ট্রিয়রা সংরক্ষণবাদিতার জন্য সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে
থাকে। ব্যাপক রেল লাইন স্থাপনের ফলেও জার্মানির ঐক্য ত্বরান্বিত হয়। ১৮৪০ সালে জার্মানিতে
রেললাইন ছিল ৩৪৩ মাইল, ১৮৫০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭৫০ মাইলে, ১৮৬০ সালে তা আরো
বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে ৬৮৭৫ মাইলে গিয়ে দাঁড়ায়।
সামাজিক সমস্যা ও জার্মান জাতীয়তাবাদ
অর্থনৈতিক অগ্রগতি জামানিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু এর ফলে বিশাল সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি হয়।
এসব সমস্যার সমাধানের জন্য অনেকে মনে করেছেন জার্মানির ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। জন্ম হার
বৃদ্ধির ফলে ১৮৭০ সাল নাগাদ জার্মানির জনসংখ্যা ৪০ মিলিয়নে দাঁড়ায়। বিভিন্ন শহরে জনসংখ্যার চাপ
বাড়তে থাকে। ঐ শতাব্দীতে বার্লিন শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় প্রায় নয়গুণ। মফস্বল ও কৃষিখাত থেকে
শ্রমিকরা শহরে শিল্প কলকারখানায় জড়ো হয়। ক্ষুদ্র কারখানার বদলে বড় বড় ফ্যাক্টরি আবির্ভূত হয়,
আর মালিক শ্রমিক সম্পর্কও তিক্ত হয়ে উঠে। শ্রমিকদের কাজের সময় ছিল দীর্ঘ এবং শর্তগুলো শ্রমিক
স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। ১৮৩০ সালে দিনে তেরো ঘন্টা খাটুনি ছিল শ্রমিকদের জন্য স্বাভাবিক।
একদিকে শ্রমিকের মজুরি কমছিলো, আর অপর দিকে জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছিলো। এই সমস্যা
সঙ্কুল জার্মানিতে জাতীয়তাবাদীদের কাছে মনে হচ্ছিল যতদিন রাজন্যবর্গ রাজত্ব করবে এবং হ্যাপসবার্গ
রাজতন্ত্রতাদেরকে রক্ষা করবে ততদিন জার্মানি এই সব সমস্যা হতে মুক্তি পাবে না।
১৮৪৮ সালের বিপ্লব ও জার্মান ঐক্য
১৮৪৮ সালে প্যারিসে বিপ্লব শুরু হয় এবং তা সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। হাঙ্গেরি, বোহেমিয়া,
মোরাবিয়া প্রভৃতি স্থানে জাতীয়তাবাদী দল বিদ্রোহী হয়ে উঠে। অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিক পদত্যাগ
করেন, আর অস্ট্রিয়ার সম্রাট প্রথম ফার্দিনান্ড তাঁর ভ্রাতষ্পুত্র প্রথম জোশেফ ফ্রান্সিসকে ক্ষমতা তুলে
দিয়ে সিংহাসন ত্যাগ করেন। বিপ্লবের ফলে ব্যাভারিয়া, প্রæশিয়া এবং দক্ষিণ পশ্চিম জার্মানিতে ব্যাপক
দাঙ্গা হাঙ্গামা দেখা দেয়। আতঙ্কিত রাজন্যবর্গ সিদ্ধান্তনিলেন যে, তারা ফ্রাঙ্কফুর্টের এ্যাসেম্বলিতে
জার্মানির জন্য একটি শাসনতন্ত্রতৈরি করবেন এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু
১৮৪৮ সালের অক্টোবর নাগাদ বিপ্লব স্তিমিত হয়ে আসে। অস্ট্রিয়াতে উদারনৈতিক এ্যাসেম্বলি বাতিল
করা হয়। হাঙ্গেরিতে যে প্রজাতন্ত্রঘোষিত হয়েছিলো তাও বাতিল ঘোষণা করা হলো। প্রæশিয়াতে চতুর্থ
ফ্রেডারিখ উইলিয়াম একটা স্বৈরাচারী শাসনতন্ত্রঘোষণা করেন।
ফ্রাঙ্কফুর্ট এ্যাসেম্বলি
ইতিমধ্যে ফ্রাঙ্কফুট এ্যাসেম্বলি ঐক্যবদ্ধ জার্মানির জন্য একজন বংশানুক্রমিক সম্রাটের অধীনে
উদারনৈতিক একটি শাসনতন্ত্ররচনা করে। অস্ট্রিয়া তার অধীনস্তজার্মান এলাকা ঐক্যবদ্ধ জার্মানির জন্য
ছাড়তে অস্বীকার করে। শেষ পর্যন্তফ্রাঙ্কফুর্ট এ্যাসেম্বলি সিদ্ধান্তনেয় যে অস্ট্রিয়া ব্যতীরেকে শুধুমাত্র
জার্মান রাজ্যগুলো নিয়েই জার্মানি গঠিত হবে। আর কোনো উপায় না থাকায় জার্মান রাজমুকুট প্রæশিয়ার
ফ্রেডারিখ উইলিয়ামকে গ্রহণ করতে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু ফ্রেডারিখ উইলিয়াম এ প্রস্তাব গ্রহণ
করতে সম্মত হন নি, কেননা তিনি মনে করেন যে, এ প্রস্তাব গ্রহণ করলে ১৮৪৮ সালে বিপ্লবের
নায়কদের দাসে পরিণত করা হবে। শেষ পর্যন্তফ্রাঙ্কফুর্ট এ্যাসেম্বলি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৮৫০ সাল
নাগাদ স্বৈরতান্ত্রিক জার্মান কনফেডারেসি আবার জার্মানির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিপ্লবি এবং
উদারনৈতিকরা নির্বাসনে কিংবা জেলখানায় স্থান লাভ করে। ফ্রাঙ্কফুর্ট পার্লামেন্টের ব্যর্থতার ফলে
শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পথে জার্মানির ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা বিফলে যায়। কিন্তু বিসমার্কের রক্ত ও লৌহ
নীতির দ্বারা জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস - ২ পৃষ্ঠা-১৪৫
অসংখ্য রাজ্যে বিভক্ত জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করার ধারণা জন্মলাভ করে দার্শনিক, কবি সাহিত্যিক এবং
উদারপন্থী মতবাদের অনুসারীদের মধ্যে। তাদের ধারণা পরবর্তী সময়ে ছাত্র, শিক্ষক ও বিভিন্ন
পেশাজীবীদের মধ্যে বিস্তৃত হয়। জার্মানির ঐক্যের বিরোধী ছিলেন স্বৈরতন্ত্রী বিভিন্ন রাজন্যবর্গ যারা মনে
করেছেন জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হলে উদারনৈতিকরা প্রাধান্য পাবে এবং তাদের ক্ষমতা হ্রাস পাবে।
জাতীয়তাবাদী ও উদারনৈতিকদের সাথে মেটারনিকপন্থী স্বৈরতন্ত্রীদের আদর্শগত বিরোধের বাইরে
নীরবে আরেকটি বৈপ্লবিক অর্থনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছিল যা পরবর্তী সময়ে জার্মানির ঐক্যকে
অনেকদূর এগিয়ে দিয়ে যায়। জোলভেরাইন নামক সংগঠনের মাধ্যমে জার্মানির রাজ্যগুলো
অর্থনৈতিকভাবে একত্রিত হয়ে নিজেদের সমৃদ্ধির সোপান রচনা করে এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুফল
অনুভব করে। অর্থনৈতিক উদারনীতির ফলে প্রæশিয়া অন্যরাজ্যগুলোকে সমৃদ্ধি, প্রভাবের দিক থেকে
পেছনে ফেলে দেয় এবং ঐক্যআন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভ‚মিকা গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠে।
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস - ২ পৃষ্ঠা-১৪৬
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। উনবিংশ শতাব্দীতে জার্মান রাজ্যগুলোর মধ্যে আয়তনের দিক থেকে এবং প্রতিপত্তির দিক থেকে
সবচাইতে অগ্রগামী ছিল।
ক) প্রæশিয়া খ) অস্ট্রিয়া
গ) ব্যাভারিয়া ঘ) সোয়ার্টবার্গ- সন্ডার হাউজেন।
২। নেপোলিয়নের হাতে পরাজয়ের পর যে রাজ্যটি প্রথম আধুনিকায়নের পথ ধরে সেটি হলো
ক) প্রæশিয়া খ) অস্ট্রিয়া
গ) ব্যাভারিয়া ঘ) স্যাকসনি
৩। জার্মান কনফেডারেশন মাধ্যমে লাভবান হন
ক) উদারনৈতিক ও জাতীয়তাবাদীরা খ) মেটারনিক
গ) অর্থনেতিক সংস্কারবাদীরা ঘ) সমাজতন্ত্রীরা
৪। ফ্রাঙ্কফুর্ট এ্যাসে¤^িল জার্মানির জন্য শাসনতন্ত্রপ্রণয়ন করে।এটি ছিল
ক) গণতান্ত্রিক খ) প্রজাতান্ত্রিক
গ) উদারনৈতিক ঘ) রাজতন্ত্রের অধীনে উদারনৈতিক।
খ. রচনামূলক প্রশ্ন
১. ফরাসিশাসন কীভাবে জার্মানির ঐক্য আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছে?
২. “রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার পূর্বে জার্মানি অর্থনৈতিক ঐক্য গঠন করেছে’’ বিশ্লেষণ করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
১. খ ২. ক
৩. খ ৪. ঘ
গ. সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. জার্মানির ঐক্য আনয়নে জার্মান কনফেডারেশন সফল হয় নি কেন?
২. জার্মান ঐক্যে ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের ভ‚মিকা আলোচনা করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত