ক্রিমিয়ার যুদ্ধ কী ভাবে ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের পতন ঘটায় তা আলোচনা করুন।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণসমূহ


১৮৫৪ সাল থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্তঅটোমান সাম্রাজ্য নিয়ে একদিকে রাশিয়া অন্যদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স
এবং অটোমান সাম্রাজ্য যৌথভাবে মিলে যে যুদ্ধ করে এটাই ক্রিমিয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত। ভিয়েনা
সন্ধির পর প্রায় চল্লিশ বছর যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ থাকার পর বৃহৎ ইউরোপীয় শক্তিগুলি এই যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ে রাশিয়ার পরিকল্পনা
রাশিয়া চর্তুদিকে ভ‚খন্ড ঘেরা একটি দেশ। তার সীমানায় যে সব সমুদ্র আছে সেখানে প্রচন্ড বরফ পড়ার
কারণে নৌবন্দরগুলো শীতে নাব্যতা হারায়। তাই রাশিয়া অনেক দিন থেকে এমন সমুদ্রে যাওয়ার রাস্তা
খুঁজছিলো যা শীতের তীব্রতায় জমে যাবেনা। এই প্রেক্ষাপটে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে পিটার দি গ্রেটের
উদ্যোগে রাশিয়া ভ‚মধ্য সাগর এবং কৃষ্ণসাগরে পৌঁছার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৭৬০ সাল নাগাদ
রাশিয়া তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে কৃষ্ণসাগর এলাকায় বিশাল ভ‚খন্ড দখল করে। ১৭৭৪ সালে সম্রাজ্ঞী
দ্বিতীয় ক্যাথরিন তুরস্ককে যুদ্ধে পরাভ‚ত করে কাইনার্ডজির সন্ধি চাপিয়ে দেন। এর ফলে রাশিয়া এই
এলাকায় বেশ কিছু দুর্গের উপর অধিকার লাভ করেন এবং কৃষ্ণসাগর, বসফরাস এবং দার্দানালেসে
নৌচালানোর স্বাধীনতা লাভ করে। ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া তুরস্ক সাম্রাজ্য থেকে ক্রিমিয়া অধিকার করে
নেয়। ১৮০৬ -১২ সালের মধ্যে-রাশিয়া তুরস্কের বিরুদ্ধে আরো বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা
করে, ১৮১২ সালে বুখারেস্টের সন্ধির মাধ্যমে সে বেসারাবিয়া অধিকার করে নেয়। যদিও কৌশলগত
কারণে রাশিয়া তুরস্ক সাম্রাজ্যের ভ‚মি দখল করছিলো, কিন্তু আক্রমণের প্রকাশ্য অজুহাত ছিল ধর্মীয়
কারণ। অটোমান সাম্রাজ্যে প্রচুর খ্রিস্টান ধর্মাম্বলম্বী বাস করত। ধর্মমত এবং জাতিগত দিক থেকে
রুশদের সঙ্গে এদের মধ্যে যথেষ্ট মিল ছিল। শত শত বছর ধরে এরা তুর্কিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ
সহঅবস্থান করলেও তুর্কিশাসকরা এখন খ্রিস্টানদেরকে অত্যাচার করছে এই অজুহাতে রাশিয়া তুরস্কের
বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে থাকে।
অটোমান সাম্রাজ্য ও ব্রিটেনের পরিকল্পনা
ব্রিটেন অন্যদিকে অটোমান সাম্রাজ্য অটুট থাকুক এটা চাইত। তুরস্কের প্রতি কোনো ভালবাসার কারণে
বিটেন এই অবস্থান নেয় নি। ব্রিটেন মনে করত পূর্ব ইউরোপে রুশ প্রাধান্য বাড়লে ইংল্যান্ডের জন্য তা
বিপজ্জনক। তার আশঙ্কা ছিল যদি রুশ যুদ্ধ জাহাজ কৃষ্ণ সাগর থেকে দার্দনেলেস প্রণালী দিয়ে
ভ‚মধ্যসাগর এলাকায় ঢুকে পড়ে, তাহলে তবে শুধু ঐ অঞ্চলে ব্রিটিশ নৌপ্রাধান্যই বিপন্ন হবে না,



ব্রিটেনের সবচাইতে মূল্যবান উপনিবেশ ভারতের সঙ্গেও ব্রিটেনের যোগাযোগ হুমকির সম্মুখীন হবে।
অবশ্য আধুনিক কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন ব্রিটেন তখন অমূলক রাশিয়া ভীতিতে ভ‚গছিল। রাশিয়া
যতটা না শক্তিশালী তার থেকে বেশি বা অতিরঞ্জিত নৌশক্তির অধিকারী বলে ব্রিটেন ধরে নিয়ে
নিয়েছে। এসব ঐতিহাসিক মনে করেন ১৮২০ সালের দিকে রাশিয়া যে আত্মরক্ষা নীতি অবলম্বন
করেছে ব্রিটেন তার সঠিক মূল্যায়ন না করে ধরে নিয়েছে যে রুশ কার্যকলাপ ব্রিটিশ স্বার্থের বিপক্ষে। যা
হোক, উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্তব্রিটেন চেষ্টা করছে যে তুরস্ক সাম্রাজ্য অটুট থাকুক এবং তুরস্ক ছাড়া
অন্য কোনো জাতির নৌজাহাজ বসফরাস এবং দার্দানেলেসে প্রবেশ করতে না পারে। অবশ্য তুরস্কের
অন্তর্গত খ্রিস্টানরা যখন তুরস্ক সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে তখন বৃটেন তার ঐতিহ্যগত
নীতি ত্যাগ করে অটোমানদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ১৭৯১ সালে ব্রিটেন রাশিয়ার কৃষ্ণসাগর এলাকায়
ওচাকভ দুর্গ থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করে। ১৮০৯ সালে স্বাক্ষরিত দার্দালেলেসের শান্তিচুক্তি দ্বারা
ব্রিটেন নিশ্চিত করে যে শান্তিকালীন সময়ে তুরস্ক ছাড়া অন্য কোন দেশের জাহাজ প্রণালীতে ঢুকতে
পারবেনা, আর যুদ্ধকালে এটা শুধুমাত্র তুরস্কের মিত্রদের জন্য খোলা থাকবে।
তুর্কী সাম্রাজ্যে ফ্রান্সের পরিকল্পনা
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিক হতে এই এলাকায় ফ্রান্সের স্বার্থ ছিল। ১৭৭০ থেকে ১৭৮০ নাগাদ তুরস্কের
সৈন্যদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ফরাসি বিশেষজ্ঞরা তুরস্কে উপস্থিত ছিল। ১৭৯৭-৯৮ সালে
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ভারতে ব্রিটেনের স্বার্থ ক্ষুন্ন করার উদ্দেশ্যে মিশর আক্রমণ করেন। ১৮০১ সাল
নাগাদ এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও এশিয়া মাইনর এবং উত্তর আফ্রিকায় ক্রমবর্ধমান ফরাসি উপনিবেশের
কারণে অটোমান সাম্রাজ্য অটুট থাকার ব্যাপারে ফ্রান্সের স্বার্থ নিহিত ছিল। তাই রাশিয়ার উপস্থিতি এই
অঞ্চলে ফরাসি আধিপত্য ক্ষতিগ্রস্তকরবে বলে ফ্রান্স মনে করে।
তুর্কী সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়ার পরিকল্পনা
অস্ট্রিয়া যদিও অটোমানদের শত্রæ ছিল তবুও অস্ট্রিয়া এই সাম্রাজ্যকে অটুট দেখতে চেয়েছিলো দুটি
কারণে। দানিয়ুবের নি¤œাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ কোনো শত্রæর হাতে পড়ূক এটা অস্ট্রিয়া চাইত না। দ্বিতীয়ত
বলকান অঞ্চলে úাভ জাতীয়তাবাদ অস্ট্রিয়ার কাম্য হলেও এর থেকে বিপদও কম ছিল না। কেননা úাভ
জাতির অনেকে ছিল অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যভুক্ত। ইউরোপীয় শক্তিসমবায়ের এবং ইউরোপীয় স্থিতাবস্থার দুই
বড় সমর্থক রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া পরস্পরের সহযোগিতা করলেও অস্ট্রিয়া পূর্বাঞ্চলে রাশিয়াকে সন্দেহের
চোখে দেখত। একমাত্র স্বাধীন úাভ রাষ্ট্র রাশিয়া যদি প্যানúাভিজমের শ্লোগান তুলে বলকান অঞ্চলে
প্রাধান্য বিস্তার করতে চায় তাহলে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের úাভদেরকে নিয়ে একটি সাম্রাজ্য গড়ে উঠবে।
এভাবে হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্যকে কঠোর মূল্য দিতে হবে। ১৭৮৮-৯১ সালে অস্ট্রিয়া রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত
হয়ে বলকান অঞ্চলকে ভাগ করার জন্য তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং উত্তর বসনিয়া লাভ করে।
কিন্তু এটা একটা ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। অটোমান সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের সঙ্গে হ্যাপসবার্গ রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব
একই সুতায় বাধা ছিল। এক সময় ইউরোপে তুর্কি অগ্রাভিযানের বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়া ছিল একটা বাঁধার
প্রাচীর এখন বসফরাস উপক‚ল পর্যন্তরাশিয়ার বিস্তারের চেষ্টার বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়া একটা শক্ত দেয়াল হতে
চাইল।
ক্রিমিয়া যুদ্ধের পূর্বে পূর্বাঞ্চলে ইউরোপীয় শক্তিসমূহরে দ্ব›দ্ব
উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে গ্রিসের জনগণ তুির্ক সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতার জন্য
সংগ্রাম শুরু করে। তুরস্ক স্বাভাবিক ভাবে এই বিদ্রোহ দমন করতে চেষ্টা করে। গ্রিসের জনগণকে
সহায়তা করার উদ্দেশ্যে রাশিয়া ১৮২৮ সালে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৮২৯ সালে বলকান
পর্বত মালা অতিক্রম করে রাশিয়ার সৈন্যরা আড্রিয়ানোপোল দখল করে এবং তুরস্কের রাজধানী
কনস্টান্টিনোপোল অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আড্রিয়ানোপোলে স্বাক্ষরিত সন্ধি


অনুযায়ী রাশিয়া তুির্কদের থেকে অনেক সুবিধা আদায় করে। রাশিয়া জর্জিয়া, পূর্ব আর্মেনিয়া এবং
দানিয়ুবের মুখে ভ‚খন্ড লাভ করে। শান্তির সময়ে সকল বাণিজ্যতরী বসফরাস এবং দার্দানেলেসে চলাচল
করার নিশ্চয়তাও এই চুক্তি প্রদান করে। এছাড়া মোলদাভিয়া এবং ওয়ালাচিয়া প্রদেশের উপর রাশিয়ার
রক্ষণাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। চুক্তিতে গ্রিসের জন্য পূর্ণ এবং সার্বিয়ার জন্য সীমিত সায়ত্বশাসন স্বীকার
করে নেওয়া হয়। ১৮৩২ সালে গ্রিস স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স গ্রিসের স্বাধীনতাকে এই জন্য
সমর্থন করে যে স্বাধীন গ্রিস অনেক সহজে রুশ প্রভাব থেকে দূরে থাকতে পারবে।
খ্রিস্ট, ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে জার প্রথম নিকোলাস তুরস্কের শত্রæ হওয়ার বদলে ত্রাণকর্তা হিসাবে আবিভর্‚ত
হন। রাশিয়া ঐতিহ্যগতভাবে তুরস্কের শত্রæ থেকে বন্ধু হওয়ার কারণ ছিল মিশরের পাশা মুহাম্মদ আলীর
বিদ্রোহ। মুহাম্মদ আলীর আক্রমণের মুখে বিপর্যস্ততুর্কি সুলতান কোথায়ও কোনো সাহায্য না পেয়ে
রাশিয়ার শরণাপন্ন হয়। এর আগে রুশদের একটি গোপন কমিটি তুরস্কের উপর বেশি চাপ প্রয়োগ না
করার জন্য জার প্রথম নিকোলাসকে পরামর্শ দান করে। তাদের বক্তব্য ছিল ভেঙ্গে যাওয়া অটোমান
সাম্রাজ্য থেকে অটুট এবং একীভ‚ত তুর্কি সাম্রাজ্য রাশিয়ার জন্য অনেক বেশি সুবিধাজনক। সুলতানকে
সহায়তার বিনিময়ে রাশিয়া উনকিয়ার úেলেসির সন্ধির (১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ) মাধ্যমে পুরো তুরস্কের উপর
রক্ষণাধিকার প্রতিষ্ঠা করে। সন্ধিতে বলা হয় আক্রমণের মুখে রাশিয়া এবং তুরস্ক পরস্পরকে সহায়তা
করবে। যদি রাশিয়া কোনো শত্র দ্বারা আক্রান্তহয় তাহলে বসফরাস এবং দার্দানেলেস প্রণালী বিদেশী
জাহাজের জন্য তুরস্ক বন্ধ করে দেবে।
এই চুক্তির ফলে ব্রিটেন এই অঞ্চলে রাশিয়ান প্রভাব বৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। ব্রিটেন মনে করে
তুরস্ক এখন রাশিয়ার অনুগত সামন্তেপরিণত হয়েছে এবং কৃষ্ণ সাগর রাশিয়ার একটি হ্রদে রূপান্তরিত
হয়েছে। এই সময় ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়া মানচেনগ্রাটজে মিলিত হয়। ব্রিটেন মনে
করতে থাকে তুর্কি সাম্রাজ্যকে টুকরা করার ষড়যন্ত্রচলছে। ব্রিটেন এই অঞ্চলে তার প্রভাব প্রতিষ্ঠা এবং
অটোমান সাম্রাজ্যকে অটুট রাখার সুযোগ পেল। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তুরস্কের পাশা ফরাসি সমর্থনে
মিশর ও সিরিয়ার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য সুলতানের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেন।
রাশিয়া এবং বৃটেন উভয়েই এ অঞ্চলে ফরাসী প্রভাব বৃদ্ধিকে পছন্দ করত না। রাশিয়া ও ব্রিটেনের চাপে
সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিকরণ করা হয়। ১৮৪০ সালে লন্ডনের কনভেশনে ব্রিটেন, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া এবং
প্রæশিয়া সিদ্ধান্তগ্রহণ করে যে পাশা মিশরের স্বাধীন বংশানুক্রমিক শাসক থাকবে, তবে সিরিয়ার উপর
তার কোন দাবি থাকবে না এই চুক্তির মাধ্যমে বৃটেন তুর্কি সাম্রাজ্যকে অটুট রাখার নীতি বজায় রাখে
এবং ফরাসি প্রভাবকে ক্ষুন্ন করে। মোহাম্মদ আলী লন্ডন চুক্তি মানতে অস্বীকার করলে ব্রিটেন এবং
অস্ট্রিয়ার যৌথবাহিনী শক্তি প্রয়োগ করে বৈরুত এবং আকার দখল করে নিলে মোহাম্মদ আলী পরাজয়
মেনে নেন। এই সূযোগে বৃটেন স্টেটস কনভেনশনের (১৮৪১ খ্রিস্টাব্দ) মাধ্যমে তুরস্ক সুলতান থেকে
কৌশলগত কিছু সুবিধা আদায় করে নেন। ঠিক হয় তুরস্ক যুদ্ধে লিপ্ত না থাকলে বসফরাস ও
দার্দানেলেসে কোনো দেশের যুদ্ধ জাহাজ ঢুকতে পারবে না। এর ফলে রাশিয়া উনকিয়ার স্কেলেসি সন্ধির
দ্বারা যে সুবিধা লাভ করেছিলো ব্রিটেন তা থেকে রাশিয়াকে বঞ্চিত করে। এই অঞ্চলে বৃটিশ প্রভাব
প্রতিষ্ঠিত হয়, তুির্ক সাম্রাজ্য অটুট থাকে। কিন্তু ১৮৫৪ সালের দিকে এই অঞ্চলকে নিয়ে ইউরোপীয়
শক্তি গুলোর মধ্যে আবার রণ দামামা বেজে উঠে, এটাই ক্রিমিয়ার যুদ্ধ।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণসমূহ ঃ ফ্রান্সের দাবি
প্যালেস্টাইনে অবস্থিত ষিশু খ্রিস্টের জন্মস্থান এং অন্যান্য পবিত্র স্থানগুেেলার অধিকার ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে
স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের সুলতান ক্যাথলিক গির্জা তথা পোপকে দান করেন। ক্যাথলিক
দেশ ফ্রান্স পোপের এই অধিকারের রক্ষাকারী ছিল। ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্স দুর্বল হয়ে পড়লে


রাশিয়া সুলতানের কাছ থেকে এই অধিকার নিয়ে নেয়। এই অধিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় ফরাসিরা
ক্ষুব্ধ ছিল। সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ান জনপ্রিয়তার লোভে প্যালেস্টাইনের মন্দির ও অন্যান্য সম্পত্তির
অধিকার ফিরিয়ে দিতে সুলতানকে বাধ্য করে (১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ)।
রাশিয়ার দাবি
রাশিয়ার জার প্রথম নিকোলাস মনে করলেন প্যালেস্টাইনের ধর্মীয় স্থানসমূহের দায়িত্ব সম্পর্ক বিষয়টি
এমন একটি ইস্যু যাকে নিয়ে জার প্রচুর জনসমর্থন লাভ করবেন। জার প্রথম নিকোলাস যুবরাজ
মেনসিকভকে কনস্টানটিনোপোলে পাঠান। রাশিয়ার দাবি ছিল দুটি (১) পবিত্র তীর্থস্থানগুলির রক্ষণের
অধিকার রাশিয়াকে দিতে হবে, (২) পূর্ব ইউরোপের খ্রিস্টান প্রজাদের উপর রাশিয়ার রক্ষণাধিকারের
স্বীকৃতি দিতে হবে। রাশিয়া হুমকি প্রদর্শন করে যে যদি সুলতান রাশিয়ার দাবি মেনে না নেয় তাহলে
রাশিয়া তুরস্কের অধীন মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া প্রদেশ দখল করে নেবে। রাশিয়ার এমন
সাহসিকতাপূর্ণ দাবির পিছনে কয়েকটি কারণ ছিল। রাশিয়া মনে করেছে যে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন
অত্যাসন্ন। তাছাড়া রাশিয়া মনে করেছে যে ১৮৪৯ সালে হাঙ্গেরিতে মাইগারদের বিদ্রোহ দমনে সে
অস্ট্রিয়াকে যে সহায়তা দান করেছে তার প্রতিদানে অস্ট্রিয়া এখন রাশিয়াকে তুর্কিদের বিরুদ্ধে সাহায্য
করবে।
তুরস্কের প্রতিক্রিয়া
১৮৫৩ সালের জুন মাসে সুলতান রাশিয়ার দাবি নাকচ করে দিলেন। রাশিয়ার দাবির প্রতি কর্ণপাত না
করার ছিল কারণ দুটি। এই সময় ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত তীব্র রাশিয়া বিদ্বেষী লর্ডস্টাডফোর্ড রেডক্লিফ
সুলতানকে রাশিয়াকে অগ্রাহ্য করার জন্য সাহস জোগান। একই সময় মালটা থেকে কিছু ব্রিটিশ যুদ্ধ
জাহাজ দার্দানেলের নিকট বেসিকা উপসাগরে উপস্থিত হয়। তুরস্কের সুলতান এটাকে ব্রিটেনের সমর্থন
মনে করেন। বস্তুত: বৃটেনের উপর তুরস্কের নির্ভরতা সুলতানের পক্ষে অমূলক ছিল না। কেননা ১৮৪০
দশক থেকে ব্রিটেন পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় রাশিয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। প্রকৃত পক্ষে
১৮৪৪ সালে জার ব্রিটেন সফরকালে তুরস্কের সাম্রাজ্য ব্যবচ্ছেদ করার জন্য বৃটেনের সহযোগিতা কামনা
করেন। প্যালেষ্টাইনের পবিত্র স্থান সমূহ নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে রাশিয়ার বিরোধের সময় আবারও তুরস্ককে
ব্যবচ্ছেদ করার উপযুক্ত সময় বলে রাশিয়া ব্রিটেনের সাহায্য কামনা করে। ইংল্যান্ড এই সব রুশ
প্রস্তাবের ব্যাপারে ক‚টনৈতিক সৌজন্যের কারণ সরাসরি নাকোচ না করলেও সম্মতি দেয় নি। কিন্তু
ব্রিটেন নিশ্চিত হয় যে রাশিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে পূর্ব ইউরোপ গ্রাস করে ভ‚মধ্যসাগরের পথে ভারতের সঙ্গে
ব্রিটেনের সমস্তযোগাযোগের রাস্তা বন্ধ করা। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বরারই ছিল রাশিয়া বিদ্বেষী।
তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার দুর্ব্যবহারকে কেন্দ্র করে সংবাদপত্রগুলো ব্রিটেনে যুদ্ধং দেহি মনোভাব জাগিয়ে
তোলে। তাদের দাবি ছিল রাশিয়ান অগ্রসরমান ভল্লুককে শক্তি দ্বারা সমূচিত শিক্ষা দেওয়া।
রাশিয়ার দাবি অগ্রাহ্য করায় যুদ্ধ অত্যাসন্ন হয়ে উঠে। অস্ট্রিয়া ১৮৫৩ সালের জুলাই মাসে ভিয়েনা
নোটের মাধ্যমে একটা আপোষমূলক প্রস্তাব পাঠায়। এটা প্রত্যাখ্যান করা হয়। অক্টোবর মাসে রাশিয়ার
সৈন্য মোলদাভিয়া এবং ওয়ালাচিয়া আক্রমণ করে। নভেম্বর মাসে রাশিয়ান যুদ্ধ জাহাজ সিনোপে নামক
স্থানে তুর্কি একটি নৌ-স্কোয়ার্ডন ধ্বংস সাধন করে। ১৮৫৪ সালের মার্চে ব্রিটেন ও ফ্রান্স তুরস্ক
সুলতানের সঙ্গে মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের তিনটি পর্যায় ছিল :
দানিয়ুব অঞ্চলের যুদ্ধ
এখানে ১৮৫৪ সালের মার্চ থেকে আগস্টের মধ্যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ব্রিটিশ ও ফরাসি যৌথ নৌ-


বাহিনী আগস্ট মাসে বাল্টিক সাগর অভিমুখে অভিযান চালায়, কিন্তু এ অভিযান তেমন সুফল বয়ে
আনতে পারেনি। অবশ্য এই অঞ্চল যুদ্ধের জন্য খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা। বলকান এলাকায়
সুবিধাজনক অবস্থানে যাওয়ার জন্য গ্যালিপোলিতে সৈন্য প্রেরণ করা হয়। অস্ট্রিয়ার আক্রমণের হুমকিতে
রাশিয়া আগস্টে মোলদাভিয়া এবং ওয়ালাচিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। আসলে এই সময়
অস্ট্রিয়া এক নাজুক অবস্থায় ছিল। রাশিয়া এবং ইঙ্গফরাসি শক্তি উভয়েই মনে করত অস্ট্রিয়া তাদের
মিত্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু অস্ট্রিয়া অভ্যন্তরীণ ভাবে এতই দুর্বল ছিল যে তার পক্ষে যুদ্ধে গিয়ে
কোন ঝুকির সম্মুখীন হওয়া সম্ভব ছিল না।
ক্রিমিয়ায় যুদ্ধ
১৮৫৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে এ স্থানে সংঘর্ষ অব্যাহত। কৃষ্ণ
সাগরে রাশিয়ার প্রাধান্য রোধ করার জন্য অর্ধ লক্ষ ব্রিটিশ ও ফরাসি সৈন্য অভিযান শুরু করে। তাদের
প্রধানতম লক্ষ্য ছিল সেবাসটাপুলে অবস্থিত সুরক্ষিত নৌঘাঁটি দখল করা। সেপ্টেম্বরে আলামায় মিত্র
বাহিনী একটি প্রাথমিক বিজয় লাভ করে। কিন্তু এ সাফল্যকে তারা এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। এর পর
ব্রিটিশ জেনারেল র‌্যাগলান এবং ফরাসি জেনারেল সেন্ট আরনাউড সেবাসটাপুল অবোরোধ করেন। কিন্তু
রাশিয়ানরা সেবাসটাপুলকে এমন ভাবে সুরক্ষিত করে রেখেছিল যে যৌথবাহিনী এটাকে সম্পূর্ণভাবে
বেষ্টনীবদ্ধ করতে পারেনি, ফলে রুশদের রসদ এবং সৈন্য সরবরাহ অব্যাহত ছিল। অনেকদিন
যৌথবাহিনী অবরোধ অব্যাহত রাখে। শীতের তীব্রতা, খাবার, ঔষধপত্র এবং যথাযথ পোশাকের অভাবে
অসুস্থ হয়ে তাদের প্রচুর সৈন্য মারা পড়ে।
ক্রিমিয়ায় আবারও যুদ্ধ
এখানে তৃতীয় পর্যায়ে ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে সংঘর্ষ সংগঠিত হয়। যৌথবাহিনীর
সৈন্যদের দুর্দশা ও বিড়ম্বনার খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে। এর
ফলে সৈন্য কমান্ডার, রসদ সরবরাহ, যোগাযোগ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়।
এরই মাঝে জানুয়ারিতে পিডমন্টের ১৭০০০ সুশিক্ষিত সৈন্য যৌথবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে যোগদান করলে
তাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। সেপ্টেম্বরে যৌথবাহিনীর অবরোধের সম্মুখে রুশরা সেবাসটাপুল ছেড়ে দিয়ে
পিছু হটে যায়।
উভয় বাহিনী যুদ্ধে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দুই পক্ষের ৬৭৫,৫০০০ সৈন্য প্রাণ হারায়। জার
দ্বিতীয় আলেকজান্ডার অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের কথা ভেবে বিচলিত হয়ে উঠেন। অস্ট্রিয়া আবারও
মিত্রশক্তির পক্ষে হস্তক্ষেপের হুমকি প্রদান করে। ১৮৫৬ সালের জানুয়ারি নাগাদ রাশিয়া পরাজয় মেনে
নেয়। প্যারিসের সন্ধির মাধ্যমে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
প্যারিস সন্ধির শর্তাবলী
(১) কৃষ্ণ সাগরে যে কোনো দেশের সামরিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়। শান্তির সময়ে বসফরাস এং
দার্দানেলেসে কোন বিদেশী জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে না।
(২) সুলতান তার অধীন খ্রিস্টান প্রজাদেরকে সহানুভ‚তি দিয়ে শাসন করবে এবং ব্যাপক সংস্কারের
সূচনা করবে। মোলদাভিয়া, ওয়ালাচিয়া এবং সার্বিয়াকে আরো স্বাওত্তশাসন দেয়া হবে, তবে
এগুলোর উপর তুরস্কের সার্বভৌমত্ব বজায় থাকবে।
(৩) সুলতান এবং তার নাগরিকদের মধ্যে বিরোধ বাধলে বা তাঁর অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থায় কোনো
সমস্যা দেখা দিলে কোনো বিদেশী শক্তি যৌথ বা এককভাবে কোন রুপ হস্তক্ষেপ করতে পারবে
না।
(৪) দানিয়ুব নদীকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হবে এবং দানিয়ুব নদীতে সকল বাণিজ্য জাহাজ
চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল
পূর্বাঞ্চল নিয়ে উনবিংশ শতাব্দীতে দুটি সমস্যা ছিল। প্রথম সমস্যাটি ছিল বাইরের শক্তি তথা রাশিয়া
কর্তৃক কৃষ্ণ সাগরে নিয়ন্ত্রণ এবং কোন বাধা ছাড়া ভ‚মধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে নৌ চলাচলের অধিকার।
দ্বিতীয় সমস্যাটি হচ্ছে তুরস্ক সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং এর ফলে তুরস্ক সাম্রাজ্যের
ব্যবচ্ছেদ। প্যারিস শান্তিচুক্তি এই দুটি সমস্যা মোকাবেলার চেষ্টায় রাশিয়ার অভিলাশকে রাশ টেনে
ধরেছে এবং সুলতানের ক্ষমতাকে উচুঁ করে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শীঘ্রই দেখা যায় প্যারিস সন্ধি
এখানে শান্তিআনতে সফল হতে পারে নি। তুরস্কের অভ্যন্তরে জাতীয়তাবাদ চাঙ্গা হয়ে উঠে এবং
রাশিয়া আবার আগ্রাসী ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়। এই সব কারণে অনেক ঐতিহাসিক ক্রিমিয়ার যুদ্ধের
ফলাফলে অসম্পূর্ণ ও নিস্পত্তিহীন মনে করে। কিন্তু গভীর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ক্রিমিয়ার যুদ্ধের
পরোক্ষ ফল ছিল সূদূর প্রসারী।
ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের পতন
প্যারিসের সম্মেলনে ইউরোপের প্রায় সকল বৃহৎশক্তির যোগদান, বৃটেন ও ফ্রান্সের পুলিশী ব্যবস্থার
অধীনে বিপথগামী রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা এবং তুরস্ককে শক্তি সমবায়ের সদস্য
হিসাবে স্বীকৃতি দানের দ্বারা এই ধারণা জন্মায় যে ১৮১৫ সালের পর গড়া ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বুঝি
আবার কার্যকরী হতে চলেছে। দানীয়ুব নদীকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করার দ্বারা এ ধারণা হলো যে
ইউরোপীয় সম্পদায় তাদের যৌথ দায়িত্বের পরিধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। শক্তি সমবায়ের উদ্দেশ্য
ছিল ইউরোপে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য যৌথ সিদ্ধান্তও যৌথ দায়িত্ব গ্রহণ। কিন্তু ক্রিমিয়ার যুদ্ধ
পরবর্তী দেখা গেল বেশ কিছু রাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যুদ্ধ চালিয়ে
যাচ্ছে। নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে প্রæশিয়া তিনটি এবং ফ্রান্স দুটি লড়াই লড়েছে। শক্তি সমবায় ঙেঙ্গে
যাওয়া এবং ঘনঘন যুদ্ধ হওয়ার কারণ ছিল শক্তিসাম্য নীতির নিশ্চয়তা প্রদানকারী দুই বৃহৎশক্তি রাশিয়া
এবং অস্ট্রিয়ার দুর্বল হয়ে পড়া। এই শক্তির শূন্যতার ফলে নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্র নায়ক ক্যাভুর, তৃতীয়
নেপোলিয়ন এবং বিসমার্ক ১৮১৫ সালের পর গড়া ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়া এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য
শক্তি প্রয়োগের নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেন।
রাশিয়ার ক্ষতি
এই যুদ্ধে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় রাশিয়া। রাশিয়া একটা বিশাল শক্তি এত দিন ধরে প্রচলিত এই ধারণা
যে বাস্তবতা বিবর্জিত ক্রিমিয়ার যুদ্ধ তা প্রমাণ করে। ১৭২১ সাল থেকে রাশিয়া ইউরোপে যে প্রতিপত্তি
নিয়ে প্রাধ্যন্য বিস্তার করছিল ১৮৫৬ সালের পর তার অবসান ঘটতে শুরু করল। অস্ট্রিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ
দিনের যে মিত্রতা ছিল তাও সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল। জার নিকোলাস আশা করেছিলেন হাঙ্গেরির
বিদ্রোহের সময় তিনি অস্ট্রিয়াকে যে সহায়তা দিয়েছিলেন তার বিনিময়ে অস্ট্রিয়া হয় নিরপেক্ষ থাকবে
অথবা রাশিয়ার শত্রæদের আহŸানে সাড়া দিবেনা। কিন্তু রাশিয়া দেখল অস্ট্রিয়া তার সঙ্গে শত্রæতা মূলক
আচরণ করছে। ১৮৫৪ সালে সামরিক দিক দিয়ে না হলেও অস্ট্রিয়া বৃটেন এবং ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রীতে
আবদ্ধ হয়েছে। রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে যে সম্পর্ক শীতল তা প্রমাণিত হলো ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর।
রাশিয়া অস্ট্রিয়ার প্রতি অনুরক্ত নেসেলরোডকে পরিবর্তন করে অষ্ট্রিয়া বিদ্বেষী গোরচাকভকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী
হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে।
অষ্ট্রিয়ার ক্ষতি
এই যুদ্ধে অষ্টিয়াও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যদিও অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর মেটারনিক ইউরোপীয় স্থিতাবস্থার মূল চালক
ছিলেন তথাপি তিনি রাশিয়ার ক‚টনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অস্ট্রিয়ার প্রভাব ইউরোপে
সমুন্নত রেখেছিলেন। কিন্তু ১৮৫০ এবং ১৮৬০ এর দশকে অস্ট্রিয়া বন্ধুহীন হয়ে পড়ে। রাশিয়ার
সহযোগিতা ছাড়া মধ্য ইউরোপের রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কিছু করা
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস - ২ পৃষ্ঠা-১৬২
অস্ট্রিয়ার জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফ্রান্স ও প্রæশিয়ার তুলনায় অস্ট্রিয়া এখন অর্থনৈতিক এবং শিল্পের
দিক থেকে দূর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছিলো।
ব্রিটেনের ক্ষতি
যদিও ক্রিমিয়ার যুদ্ধে বিজয়ী ছিল বৃটেন কিন্তু পরবর্তী দুই দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্রিটেন তার
প্রাধান্য হারিয়ে ফেলে। ব্রিটেন ইউরোপে মিত্রহীন হয়ে একাকীত্বে পড়ে যায়। পরবর্তীকালে ইতালির
একত্রীকরণে, ১৮৬৩ সালের পোলান্ডের বিদ্রোহে এবং úেজভিগ ও হোলস্টেন বিরোধে ব্রিটেন তেমন
কোনো ভ‚মিকা রাখতে পারে নি। অন্য সরকারের সহযোগিতার অভাবে এসব সমস্যায় ব্রিটেন অসহায়ের
মতো বসে থাকে। আগে আন্তর্জাতিক সমস্যায় যে সব দেশের কোনো ভ‚মিকা ছিল না যেমন ফ্রান্স
পিডমন্ট এবং প্রæশিয়ার মত দেশগুলি অস্ট্রিয়াকে আক্রমণ করে প্রতিপত্তি প্রদর্শন করতে থাকে।
ফ্রান্সের লাভ
ক্রিমিার যুদ্ধে ফ্রান্স কিছুদিনের জন্য অন্তত বেশ সুবিধা লাভ করে। ভিয়েনা সম্মেলনের মাধ্যমে ফ্রান্সকে
যে ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয় তৃতীয় নেপোলিয়ন তার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উদগ্রিব ছিলেন।
১৮৬৩ সালের পোলান্ডের বিদ্রোহের সময় পর্যন্ততিনি রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তিনি
জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে বলেছিলেন, “আপনি প্যারিসের চুক্তি পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন, আমি
১৮১৫ সালের চুক্তিকে আংশিক পরিবর্তন করতে চাই”। তিনি আশা করেছিলেন ইউরোপের ক‚টনীতির
কেন্দ্র বিন্দু হবে প্যারিস এবং তিনি হবেন নতুন ক‚টনৈতিক বিন্যাসের নিয়ন্ত্রক। তিনি মধ্য ইউরোপের
বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোর জাতীয়তাবাদী আকাংক্ষার প্রতি সহানুভ‚তিশীল ছিলেন। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর
শক্তি সমবায় দূর্বল হয়ে পড়লে নেপোলিয়ন সুযোগ লাভ করেন। ১৮৫৮ সালে রাশিয়ার সঙ্গে
সহযোগিতা করে রুমানিয়ার স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করেন। ১৮৫৯ সালে পিডমন্টের সহায়তায়
সৈন্য প্রেরণ করে লোম্বার্ডি থেকে অস্ট্রিয়ানদেরকে উৎখাত করে। তাছাড়া উত্তর ইতালিতে তিনি
ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে একটি স্বাধীন রাজ্য বানাতে চেয়েছিলেন।
সারসংক্ষেপ
তুরস্কের দুর্বলতার সুযোগে ইউরোপীয় বৃহৎ শক্তিবর্গ অটোমান সাম্রাজ্যকে নিয়ে নানামুখী পরিকল্পনা
করে। রাশিয়া তার নিরাপত্তা নিশ্চয়তার জন্য ভ‚মধ্যসাগর পর্যন্তঅগ্রসর হতে চায়। ব্রিটেন তুরস্ক
সাম্রাজ্যের অখন্ডতা অটুট রেখে তার মূল্যবান উপনিবেশ ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতে চায়,
অস্ট্রিয়া চাচ্ছিল মধ্য ইউরোপের অঞ্চল গুলোতে তার প্রতিপত্তি অটুট থাকুক। এই সব স্বার্থের
টানাপোড়নে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ সংগঠিত হয়, রাশিয়া পরাজিত হয়, ইঙ্গ-ফরাসিরা এবং তুর্কিরা জয়লাভ
করে। প্যারিস শান্তিচুক্তি যা দিয়ে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে তা মোটেই শান্তিআনতে পারে নি।
রাশিয়া অসন্তুষ্ট হয়ে আক্রমণকারীর ভ‚মিকা অবলম্বন করে, তুর্কি সাম্রাজ্যে জাতিগত বিরোধ চাঙ্গা হয়ে
উঠে। এই যুদ্ধে রাশিয়া ছাড়া অস্ট্রিয়া ও ব্রিটেন ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। রাশিয়ার সাহায্য ছাড়া অস্ট্রিয়ার
পক্ষে পূর্বের প্রতিপত্তি ধরে রাখা সম্ভবপর ছিল না। ব্রিটেন ইউরোপে বন্ধুহীন হয়ে পূর্বের মতো প্রভাব
বিস্তার করতে কিছুদিনের জন্য অপারগ হয়। শক্তি সমবায়ের পরাশক্তি রাশিয়া ও অস্টিয়ার দুর্বলতার
সুযোগে সবচাইতে লাভবান হয় প্রæশিয়া, ইতালি এবং ফ্রান্স।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () টিক দিন
১। রাশিয়া কৃষ্ণ সাগরে এবং ভ‚মধ্য সাগরে যেতে চেয়েছিলো কেননা -
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস - ২ পৃষ্ঠা-১৬৩
(ক) তার কোনো সমুদ্র বন্দর ছিল না
(খ) তার সমুদ্র বন্দর গুলো শত্রæরা দখল করে নিয়েছে
(গ) এসব সমুদ্রে যাওয়ার পথ খুব সহজ
(ঘ) শীতকালে তার নৌবন্দরগুলো বরফে জমে যায়।
২। রাশিয়া তুরস্ক সাম্রাজ্যের খ্রিস্টানদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিল কেননা।
(ক) খ্রিস্টান জনগণ রাশিয়াকে এজন্য আহŸান করেছে
(খ) এটা রাশিয়া তার ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করেছে
(গ) এ দাবির অন্তরালে কৌশলগত সুবিধা লাভ করা সহজ
(ঘ) খ্রিস্টানদের দাবির কথা তুললে তুরস্ক সম্রাট বিপদে পড়বে।
৩। ব্রিটেন রাশিয়ার অগ্রাভিযানের ব্যাপারে শঙ্কিত ছিল কেননা সে
(ক) এক সময় রাশিয়া ভারত দখল করবে
(খ) রাশিয়া অনেক শক্তিশালী হয়ে ব্রিটেনকে পরাজিত করবে
(গ) ব্রিটেনের পক্ষে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কঠিন হবে
(ঘ) তুরস্ক সাম্রাজ্য রাশিয়া দখল করে ফেলবে।
৪। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্তহয়েছে
(ক) অস্ট্রিয়া
(খ) রাশিয়া
(গ) ব্রিটেন
(ঘ) তুরস্ক
রচনামূলক প্রশ্ন
১। অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ে রুশ পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করুন।
২। ক্রিমিয়ার যুদ্ধ কী ভাবে ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের পতন ঘটায় তা আলোচনা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
১. ঘ ২. গ ৩. গ ৪. খ
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। প্যারিস শান্তিচুক্তি কীভাবে তুরস্কের সুলতানের ক্ষমতাকে অটুট রেখেছে?
২। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে তৃতীয় নেপোলিয়ন কীভাবে লাভবান হয়েছেন?

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]