ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর ১৮৫৬ সালের প্যারিস শান্তিচুক্তি দ্বারা অটোমান সাম্রাজ্যকে অটুট রাখা এবং
ইউরোপীয় শক্তির ভারসাম্য রক্ষার জন্য ইউরোপীয় শক্তিসমূহ চেষ্টা করে। তুরস্ক সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে
রাখার এই প্রচেষ্টা অবশ্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র এক দশকের মধ্যে চারটি বড় ধরনের যুদ্ধ যেমন
১৮৫৯ সালে ইতালিকে নিয়ে ফরাসি-অস্ট্রীয় যুদ্ধ ১৮৬৪ সালে ডেনমামার্কের বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়া ও
প্রæশিয়া যৌথ আক্রমণ, ১৮৬৬ সালে অস্ট্রীয়দের উপরে প্রæশিয়ার বিজয় এবং ১৮৭০ সারে ফরাসিদের
উপর প্রæশিয়ার অপ্রত্যাশিত জয় ইউরোপের শক্তি সাম্যকে তছনছ করে দেয়। অটোম্যান সাম্রাজ্যর
অখন্ডতা রক্ষাকারী শক্তিসমূহ পূর্বের শক্তি হারিয়ে ইউরোপে বড় ধরনের ভ‚মিকা পালন করতে অসমর্থ
হয়ে পড়ে। অস্ট্রিয়া ইতালীয় এবং জার্মান অঞ্চলে তার প্রাধান্য হারিয়ে ফেলে, ফ্রান্স আলসাস ও
লোরেন হারিয়ে এবং বিরাট ক্ষতিপূরণের বোঝা কাঁধে নিয়ে ইউরোপের দুর্বলতম রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
অপর পক্ষে গদ্বাডস্টোনের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে বেশি ব্যস্তহয়ে উঠে এবং
ইউরোপীয় কোনো সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানো থেকে দূরে থাকতে শুরু করে। ইউরোপের এ অবস্থায়
বিভিন্ন শক্তি তুরস্কের অধীন বলকান অঞ্চলে তাদের উচ্চাভিলাষ চারিতার্থ করার জন্য প্রচেষ্টা শুরু
করে। আর এইভাবে ইউরোপ আরেকটি যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে উঠে। বার্লিন সন্ধি দ্বারা কিছু দিনের জন্য
বড় ধরনের সংঘর্ষের পথ বন্ধ করা হয়। বলকান অঞ্চল নিয়ে বিভিন্ন শক্তির পরিকল্পনা :
প্যারিস শান্তিচুক্তির দ্বারাই সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্তহয় রাশিয়া। ১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্কো-প্রæশিয়ার যুদ্ধ নিয়ে
ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বাস্ততার সুযোগ রাশিয়া প্যারিস সন্ধির কৃঞ্চসাগর সংক্রান্তধারাটি মানতে
অস্বীকৃতি জানায়। অপর দিকে বলকান অঞ্চলে রাশিয়া প্যানúাভ আন্দোলনকে উৎসাহিত করতে শুরু
করে। ১৮৩০ - দশকে জন্ম নেওয়া এই আন্দোলনের মূল কথা হচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু পশ্চিমী সংস্কৃতি হতে úাভ
সংস্কৃতি অনেক প্রাণবন্তএবং উচুঁমানের। এই আন্দোলনের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি ছিল সকল úাভদেরকে
একত্রীকরণ। একমাত্র স্বাধীন úাভ রাজ্য রাশিয়া এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে এবং তুরস্ক ও
অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির অন্তভর্‚ক্ত সকল úাভদেরকে মুক্ত করার জন্য প্রচেষ্টা করে। ১৮৬৪ সাল থেকে ১৮৭৭
পর্যন্তকনস্ট্যানটিনোপলে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত কাউন্টি নিকোলাস ইগনাটিয়েভ প্যানúাভ আন্দেলেনের
সবচাইতে বড় প্রবক্তা ছিলেন, তিনি úাভদেরকে তুরস্ক এবং অস্ট্রিয়ার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধ
করার পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুবরাজ গোরচাকফ এর বিরোধী ছিলেন, তিনি
তুরুস্কের অধীন úাভ এলাকা মুক্ত করে অস্ট্রিয়াকে দিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু জার দ্বিতীয়
আলেকজান্ডার গোরচাকফকে সমর্থন করতেন না। জার কনস্টাটিনোপলকে রাজধানী করে সকল
úাভদেরকে নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের স্বপ্ন দেখতেন।
অস্ট্রিয়া
অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাউন্ট জুলিয়াস এ্যান্ডরেসি রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী যুবরাজ গোরচকভকে এক সময়
বলেছিলেন বলকান অঞ্চলে অস্ট্রিয়ার কোনো উচ্চাকাক্সক্ষা নেই। এ্যান্ডরেসির নির্লিপ্ততার কারণ ছিল এই
যে তিনি নিজে ছিলেন মাইগার জাতিভুক্ত, তিনি চাইছিলেন না যে তুর্কি সাম্রাজ্যভুক্ত úাভরা অস্ট্রিয়ার
সঙ্গে যুক্ত হয়ে অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত সার্বদের প্রতিপত্তি আরো বেড়ে যাক, আর মাউগাররা
সংখ্যালঘিষ্ট হউক। কিন্তু তার ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের মূল্য খুব কমই ছিল, কেননা অস্ট্রিয়ার ভিতরে
থাকা অধিকাংশ úাভই চাইত তুরস্কের অধীন úাভরা তাদের সঙ্গে যোগ দিক। অস্ট্রিয়ার সামরিক বাহিনী
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তুরস্কের অধীন বসনিয়া-হার্জিগোভিনা অঞ্চলটিকে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার
সবচাইতে বড় প্রবক্তা ছিলেন। তাঁরা যুক্তি প্রদর্শন করেন যে আড্রিয়াটিক উপক‚লে অবস্থিত ডালমাটিয়ার
প্রতিরক্ষার জন্য বসনিয়া-হার্জেগোবিনা এলাকাটি দখল করা প্রয়োজন। তাদের আগ্রহে অস্ট্রীয় সম্রাট
ফ্রান্সিস ১৮৭৫ সালের বসন্তকালে এক মাসের জন্য ডালমাটিয়া সফরে যান। তিনি বসনিয়াহার্জেগোভিনার খ্রিস্টানদেরকে তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য প্ররোচিত করতে থাকেন। বসনিয়ায়
বিদ্রোহ শুরু হলে ডালমাটিয়ায় অবস্থিত অস্ট্রীয় সৈন্যদেরকে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় ঢুকে পড়ারও
নির্দেশ তিনি দিয়ে আসেন।
বৃটেন
তুরস্কের অখন্ডতার সবচাইতে বড় সমর্থক বৃটেন এক সময় গদ্বাডস্টোনের নেতেৃত্বে বৈদেশিক ব্যাপারে
এক ধরনের নির্লিপ্ততায় ডুবে পড়ে। ইতিহাসে বৃটেনের এই নীতিকে বলা হয় “চমৎকার একাকীত্ব” বা
“úেনডিড আইসোলেসান”। কিন্তু এই নীতি পরিত্যক্ত হয় ১৮৭৪ সালে যখন ডিসরেলি বৃটেনের
প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ঘোষণা করলেন, “আমাদের সামনে এখন এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে,
নতুন প্রভাব কার্যকরী হচ্ছে। আমাদেরকে অজানা বিষয় এবং বিপদ মোকাবেলা করতে হবে, শক্তির
ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়েছে, এর ফলে যে দেশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং নতুন পরিস্থিতির শিকার
হয়েছে সে দেশটি হচ্ছে ইংল্যান্ড”। তিনি ভারতের সঙ্গে বৃটেনের সম্পর্ক আরো গভীর করেছেন এবং
মহারানী ভিক্টোরিয়াকে ভারতের মহারানী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ১৮৭৫ সালে মিশরের খেদিবের
নিকট থেকে সুয়েজ খালের শেয়ার কিনেছেন তিনি। অর্থাৎ ডিসরেলির সময় তুরস্কের অখন্ডতা রক্ষা
ব্রিটেনের বৈদেশিক নীতিতে নতুন মাত্রা লাভ করেছে।
জার্মানি
বলকান অঞ্চলে জার্মানির কোনো সরাসরি স্বার্থ জড়িত ছিল না। কিন্তু ১৮৭০-দেশকের ইউরোপে শক্তির
ভারসাম্য ভেঙ্গে পড়ায় সবচাইতে লাভবান হয়েছে জামার্নী। ঐ সময়কার সবচাইত শক্তিশালী রাষ্ট্র
জার্মানি বিসমার্কের অধীনে স্থিতাবস্থার সবচাইতে বড় সমর্থক। ফ্রান্স যেন ভবিষ্যতে আর মাথা চাড়া
দিয়ে উঠতে না পারে বিসমার্ক তার জন্য সদ সতর্ক ছিলেন। ফ্রান্সকে বন্ধুহীন কারা জন্য বিসমার্ক
রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়াকে মিলে “ইমপেররস লীগ” বা “সম্রাটের লীগ” নামক একটি মৈত্রী জোট গঠন
করেন। ১৮৭২ এবং ১৮৭৩ সালে গঠিত এই সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপে শান্তিঅক্ষুন্ন রাখা।
বলকান অঞ্চলে ইমপেররস লীগ তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলো। কিন্তু শীঘ্রই বিসমার্ক বুঝতে পারলেন
বলকান অঞ্চলটিতে যুদ্ধের সম্ভাবনা তিনি বন্ধ করতে পারবেন না। বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় বিদ্রোহ
ইউরোপকে অশান্তকরে তুলল।
বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনা বিদ্রোহ
অটোমান সাম্রাজ্যের সর্বপশ্চিমে অবস্থিত ছিল বসনিয়া ও হার্জেগোবিনা প্রদেশ। এই দুই প্রদেশের জন
সংখ্যা ছিল ১.২ মিলিয়ন এর মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ ছিল সার্ব মুসলমান, ৪২ ভাগ ছিল অর্থোডক্স
খ্রিস্টান, ১৮ ভাগ ছিল ক্যাথলিক। মুসলমান সার্বদের মধ্যে কিছু সংখ্যাক বৃহৎ জমিদার ছিলেন, খ্রীষ্টান
ও মুসলমান কৃষক সবাই জমিদারের হাতে নানা বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। ১৮৭৫ সালে ব্যাপক
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস - ২ পৃষ্ঠা-১৬৬
শস্যহানি হলে শুধুমাত্র খ্রিস্টান কৃষকরাই বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহের মধ্যে রুশরা এবং অস্ট্রিয়ানরা
তাদের এত দিনের লালিত অভিলাষ পূরণ করার পূর্ণ চেষ্টা শুরু করে। রুশ কর্মকর্তারা এবং
ডালমাটিয়ায় অবস্থিত হ্যাপসবার্গ কর্মকর্তারা বিদ্রোহীদেরকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা সৃষ্টি করেনি
নাই, কিন্তু এটাতে আমরা লাভবান হয়েছি। একটি ক্ষুদ্র ধারা হিসাবে এটা শুরু হয়েছিলো, কোন রকম
নিদেশনা ছাড়া এটাতে আমরা লাভবান হয়েছি। একটি ক্ষুদ্র ধারা হিসাবে এটা শুরু হয়েছিলো, কোন
রকম নির্দেশনা ছাড়া এটা মরুভ‚মিতে পথ হারিয়ে ফেলতে পারত। আমি এখানে ওখানে পাথর বসিয়ে
স্রোতের ধারাটাকে একত্রিত করে প্রবাহমান রেখেছি।” বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর ইউরোপীয় শক্তিগুলো
পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আলাপ আলোচনা শুরু করে। সব শক্তি তুরস্ককে বসনিয়াহার্জিগোবিনায় কিছু সংস্কার আনতে আহবান জানায়। বিভিন্ন সংস্কার দাবী সম্বলিত এ আহŸান।
এ্যান্ডরেসী নোট নামে পরিচিত। অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এঈতন্ডরেসীর নাম অনুসারে এর নামকরণ করা
হয়। ১৮৭৬ সালের ফেব্রæয়ারিতে তুরস্ক এটাকে গ্রহণ করলেও বিদ্রোহীরা কোন রুপ সমঝোতার
পক্ষাপাতী ছিল না। বিদেশী সহয়তায় তারা বিদ্রোহ চালিয়ে যেতে থাকে এই আশায় যে অসন্তোষ পুরো
বলকান এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে। তাদের আশা কিছুটা পূর্ণ হলো বুলগেরিয়ায়।
বুলগেলিয়ায় বিদ্রোহ
বসনিয়া-হার্জেগোভিনার বিদ্রোহের পথ ধরে বুলগেরীয়রা তুরস্কের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা
করে। তুর্কী কর্তৃপক্ষ কঠোর হস্তেএই বিদ্রোহ দমন করে যেন অন্য অঞ্চলের বিদ্রোহীরা সমুচিত শিক্ষা
গ্রহণ করে। প্রাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যমে মুসলমানদের হাতে খ্রীষ্টান গণ তহ্যারুপে বুলগেরিয়ার বিদ্রোহ
দমনকে চিত্রায়িত করা হয। সারা ইউরোপে তুর্কী বিদ্বেষ জাগ্রত হয়। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী
গদ্ব্যাডষ্টোন দাবী জানান, “তুরুস্ককে পোঁটলা পুটলিসহ উইরোপ থেকে চলে বাধ্য করা দরকার”।
রাশিয়ার ইঙ্গিতে এবং সহযোগিতায় ২রা জুলাই ১৮৭৬ সালে সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো তুরুস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
ঘোষণা করে। অটোমানদের বিরুদ্ধে রাশিয়া সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে না কেননা রাশিয়া তনি
সম্রাটের লীগ চুক্তির অন্যমত সদস্য। কিন্তু সার্বিয়া তুর্কীদের হাতে বসনিয়ায় প্রচন্ড মার খায়। সার্বিয়া
তার জনসংখ্যার ছয় ভাগের একভাগকে এই যুদ্ধে মোতায়েন করেছিলো, এদের দশ ভাগ্যের এক ভাগ
তুর্কীদের হাতে আহত বা নিহত হয়েছিলো।
বুলগেরিয়া সংকট ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো
এদিকে বুলগেরিয়ার সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ তুরস্ক সাম্রাজ্যেকে কি করা যায় তা নিয়ে
চিন্তিত হয়ে পড়ে। জার্মানী চ্যান্সেলর বিসমার্ক তুরস্ক সাম্রাজ্যকে বিভক্ত করে বলকান জাতিগোষ্ঠি এবং
ইউরোপীয় শক্তিগুলোকে সন্তষ্ট করার প্রস্তাব পেশ করেন। বৃটেন তুরস্কের অখন্ডতা বজায় রাখার নীতি
থেকে সরে দাঁড়াতে রাজী হলো না। ভিসরেলীর মতে খ্রীষ্টান বিধন নিয়ে ইংল্যান্ডে যে জনবিক্ষোভ সৃষ্টি
হয়েছে তা সাময়িক ব্যপার, শীঘ্রই জনগণ আবেগমুক্ত হয়ে বাস্তব পরিস্থিতির সপক্ষে দাঁড়াবে। রাশিয়া ও
অস্ট্রিয়া বলকান এলাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে এক গোপন সমঝোতায় আসে। ৮ই জুলাই ১৮৭৭ সালে
সম্পাদিত এই চুক্তি রাইখষ্ট্যাডের সন্ধি নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী দুটি দেশ ঠিক করে যদি
সার্বিয়া এবং মন্টিনিগ্রো যুদ্ধে পরাজিত হয় তাহলে দুই শক্তি যুদ্ধের পূর্ববস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ
দিবে। আর যদি এই দুটি রাজ্য জয়ী হয় তাহলে দুই শক্তি যুদ্ধের পূর্বস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ
দিবে। আর যদি এই দুটি রাজ্য জয়ী হয় তবে রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া মিলিত হয়ে বলকান এলাকায়
ভৌগলিক পরিবর্তন আনবে। তারা আরো সিদ্ধান্তগ্রহণ করে যে এ সীমানা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে যায়।
রাশিয়া ধরে নেয় যদি সার্বিয়া এবং মন্টিনিগ্রো জয়লাভ করে তাহলে এরাই বসনিয়া হারজিগোবিনিয়ার
বিরাট অংশ তাদের দেশের সঙ্গে যুক্ত করবে, বাকী সামান্য অংশ অষ্ট্রিয়া পাবে। অপর পক্ষে অষ্ট্রিয়া
ধরে নেয় বসনিয়া-হারজিগোবিনা হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্যের একটি অংশ হবে। যাই ইউক, এদিকে তুর্কী
সৈন্যরা সার্বিয়াকে পরাজিত করে বেলগ্রেডের দ্বার-প্রান্তে উপস্থিত হয়। রাশিয়ার জার দ্বিতীয়
আলেকজান্ডার দেখলেন চুপচাপ বসে থকা যায় না, তিন তুরস্কের প্রতি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ছয় সপ্তাহের
জন্য যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করার জন্য এক চরমপত্র দান করলেন। তুরস্ক রাজী হলো, ৩১ শে অক্টোবর
১৮৭৬ সারে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা হয়।
কনষ্টানন্টিনোপল সম্মেলন
ইউরোপীয় শক্তিগুলো তাদের প্রতিনিধি কনষ্টানন্টিনোপলে পাঠায় যুদ্ধবিরতীয় শর্তগুলো ঠিক করার
জন্য। ১২ই ডিসেম্বর ১৮৭৬ সালে কনষ্টানন্টিনোপলে সম্মেলন শুরু হয়। বৃটিশ প্রতিনিধি লর্ড সলসবেরী
রাশিয়ার প্রতি সহানুভ‚তিশীল ছিলেন এবং চাইতেন যে বলকান খ্রীষ্টানরা তুরস্ক থেকে সুবিধা আদায়
করুক। ইংল্যান্ড এবং রাশিয়া মিলে তুরস্ককে একটি সমঝোতা প্রস্তাব পেশ করে। এই প্রস্তাব বলা হয় যে
বুলগেরিয়াকে পূর্বএবং পশ্চিম প্রদেশ ভাগ করা হবে, বসনিয়া ও হার্জিগোবিনাকে একটি প্রদেশে
রুপান্তরিত করা হবে, বুলগেরিয়া ও বসনিয়া-হার্জিগোবিনায় স্বায়ত্বশাসন দেয়া হবে। এছাড়া আরো টিক
হয় যে সার্বিয়া থেকে কোন এলাকা কেড়ে নেওয়া হবে না, মনিন্টনিগ্রো হার্জিগোবিয়া এবং উত্তর
আলবেনিয়ায় এলাকা দখল করেছে তা সে রেখে দিবে। যুদ্ধে জয়ী তুরস্কের পক্ষে এই সকল
অপমানজনক শর্ত কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই তুরস্ক এগুলো প্রত্যাখান করে। অনেক
ঐতিহাসিক অবশ্য মনে করেন বৃটেনের গোপন সমর্থন তুরস্ককে কনস্ট্যানন্টিনোপল সম্মেলনের প্রস্তাব
অগ্রাঞ্য করতে সাহসী করে তোলে। বৃটেনের রাষ্ট্রদূত স্যার হেনরী ইলিয়ট সম্মেলনের প্রতিনিধি
সলসবেরীর মতের বিরুদ্ধে তুরস্ককে সর্মন দান করেন। ইলিয়টের পিছনে প্রধানমন্ত্রী ভিসরেলী এবং
পররাষ্ট্র মন্ত্রী লর্ড ডার্বের সমর্থন ছিল। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে তুরস্ক বৃটেনের ক্ষমতার শীর্ষস্থানীয়
ব্যক্তিদের মনোভাব জানতেন এবং আশা করতো যদি রাশিয়া তুরস্ক আক্রমন করে তাহলে বৃটেনের
সমর্থন সে পাবে।
রাশিয়ার তৎপরতা
কনষ্টানন্টিনোপল সম্মেলন যে কিছু করতে পারবে না এটা রাশিয়া পূর্বেই কিছুটা অনুমান াকরতে
পেরেছিলো। রাশিয়া মনে মনে সিদ্ধান্তনেয় তুর্কীদের বিরুদ্ধে তাকে একাই লড়াই করতে হবে। তবে
বলকান অঞ্চলে যুদ্ধ করতে গেলে যদি অষ্ট্রিয়ানদের সহায়তা পাওয়া যায় তাহলে খুবই ভাল হয়।
কনষ্টনন্টিনোপল সম্মেলন শেষ হওয়ার পূর্বে রাশিয়া অস্ট্রিয়ানদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। ১৮৭৭
সালের ১৫ জানুয়ারি দুই পক্ষের মধ্যে বুদাপেষ্ট চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্ততে ঠিক হয় যদি
কনষ্টানন্টিনোপল সম্মেলন ব্যর্থ হয় এবং রাশিয়ার সঙ্গে তুর্কীদের যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে অস্ট্রিয়া
নিরপেক্ষ থাকবে। বিনিময়ে অস্ট্রিয়া বর্সনিয়া বসনিয়া হাজিগোবিনা দখল করে নেবে। ১৮৫৬ সালে
হারানো বেসারবিয়া রাশিয়া পূনরায় ফিরে পাবে। রাইখষ্ট্যাডের সন্ধির মত আনে ঠিক হয় যে বলকান
অঞ্চলে কোন বৃহৎ রাজ্য গঠন করা হবে না। চুক্তি সাক্ষরের পর রাশিয়ার অবশ্য মনে হয়েছে রাশিয়াকে
যদ্ধ করতে হবে আর অষ্ট্রিয়ানরা বিনা আয়াসে সব সুবিধা নিবে। তাই শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান
করা যায় কিনা তার জন্য রাশিয়া চেষ্টা শুরু করে। রাশিয়ার আহবানে ৩১ মার্চ, ১৮৭৭ সালে লন্ডনে
সম্মেলনে বসে। কিন্তু তুরস্ক কোনরকম ছাড় দিতে প্রস্তুত না হওয়ায় লন্ডন সম্মেলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত
হয়। ২৪শে এপ্রিল ১৮৭৭ সালে রাশিয়া তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
রুশ তুর্কী যুদ্ধ
রাশিয়া যুদ্ধে প্রবেশ করার পর যুদ্ধের গতি রাশিয়া স্বপক্ষে মোড় নেয়। খুব সহজে তারা রুমানিয়া দখল
করে নেয়। শিপকা গিরিপথ পার হয়ে তারা দক্ষিণ বুলগেরিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। দানিউব নদীর তীরে
রাশিয়ার একটি পুলের নিকট প্লেবনা নামক স্থানে একটি তুর্কী দূর্গের সামনে রাশিয়ার সেনাবাহিনী প্রচন্ড
বাধাপ্রাপ্ত হয়। জেনারেল টডলিবেন, ক্রিমিয়ার যুদ্ধে বিখ্যাত বীরকে রাশিয়ানরা ডেকে পাঠায়। কিন্তু
অনেক চেষ্টার পরও রাশিয়াকে ক্ষতি স্বীকার করে প্লেববনায় অসহায়ের মত বসে থাকতে হয়। মরিয়া
হয়ে রাশিয়া বলকান রাজ্যগুলোর সহায়তা কামনা করে। রাশিয়ার এই দু:সময়ে রুমানিয়া ছাড়া আর
কোন রাজ্য এগিয়ে এলো না। রুমানয়িার আশা ছিল যুদ্ধে জয়লাভ করলে যথোপোযোক্ত পুরষ্কার সে
লাভ করবে। প্রায় ছয় সাতমাস অবরোধের পর শেষ পযন্তপ্লেবনায়র পতন হয়। ৪ঠা জানুয়ারী ১৮৭৮
সারে রাশিয়ান সৈন্যরা সোফিয়া দখল করে কনস্টানন্টিনোপোলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
ডিসরেইলী সাথে যোগাযোগ করলেন। কিন্তু বুদাপেষ্ট চুক্তি অনুযায়ী অস্ট্রিয়ার পক্ষে রাশিয়া বিরুদ্ধে কিছু
করা সম্ভব ছিল না, রাশিয়া ঐ চুক্তির ধারা লঙ্ঘন করে তবেই অস্ট্রিয়া অস্ত্রহাতে নিতে পারে।
ডিসরেইলী বৃটিশ নৌবহরকে কনষ্টানন্টিনোপলের দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিলেন। রুশ সৈন্যরা
কনষ্টানন্টিনোপলের দশ মাইলের মধ্যে সানষ্টিফানো নামক স্থানে উপস্থিত হয়। এর পূর্বেই রাশিয়া
সিদ্ধান্তগ্রহণ করে যে তারা কনষ্ট্যানন্টিনোপল দখল না করে বাকী দখল করা ভ‚মির উপর অধিকার
বজায় রাখবে।
ষ্টানস্টিফানোর সন্ধি
অস্ত্রবিরতি শেষে তুরস্কের সানষ্টিফানোতে রুশ এবং তুর্কীদের মধ্যে শান্তিআলোচনা শুরু হয়। ৩রা মার্চ
১৮৭৮ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে সানস্টিফানো চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির শতৃগুলো নি¤œরূপ:
১। বসনিয়া ও হার্জিগোবিনাতে সংস্কার চালু করা হবে।
২। সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রদুটিকে এত ভ‚খন্ড দেওয়া হয় যে দেশ দুটি
প্রায় লাগোয়া হয়ে দাঁড়ায়।
৩। রুমানিয়াকেও পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। তবে রুমানয়িাকে দক্ষিণ বেসারবিয়া রাশিয়াকে ছেড়ে
দিতে হয়। এর বিনিময়ে সে তুস্কের অধীনস্তদাবরুজার কিছু অংশ লাভ করবে বলে ঠিক হয়।
৪। রাশিয়া যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রাপ্ত বিশাল অর্থের একটি অংশের বদরে পূর্ব এশিয়া মাইনার
এলাকায় বাটুম, কারস, আরদাহান এবং বাইজিদ এলাকা লাভ করবে।
৫। এই সন্ধির সবচাইতে উল্লেযোগ্য দিন হচ্ছে বিশাল বুলগেরিয়া রাজ্য সৃষ্টি। কনস্টানন্টিনোপল,
আড্রিয়ানোপল, সালোনিকি ছাড়া এই রাজ্য উত্তরের দানিউপ নদী, পূর্বেকৃঞ্চ সাগর, দক্ষিণে
ঈজিয়ান সাগর এবং পশ্চিমে অহরিদ হ্রদ পর্যন্তএলাকা নিয়ে বৃহত্তর বুলগেরিয়া গঠিত হয়। সন্ধিতে
আরো ঠিক হয় যে বুলগেরিয়া একজন নির্বাচিত রাজার অধীনে স্বায়ত্বশাসন ভোগ করবে।
সানস্টিফানো চুক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন শক্তির ক্ষোভ
ইউরোপীয় বিভিন্ন শক্তি রাশিয়া কর্তৃক তুরুস্কের উপর একতরফা সিদ্ধান্তচাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভ
প্রকাশ করে। অস্ট্রিয়া বৃহত্তর বুলগেরিয়া রাষ্ট্র স্থাপনের প্রতিবাদ করে কেননা এটা ছিল বুদাপেষ্ট চুক্তির
বলখেলাপ। বুদাপেষ্ট চুক্তিতে বরা হয়েছিলো বলকান এলাকায় কোন বৃহৎ রাষ্ট্র সৃষ্টি করা যাবে না।
ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এই চুক্তিতে অসন্তুষ্ট ও শঙ্কিত হন। কেননা বৃহৎ বৃহৎ বুলগেরিয়া সৃষ্টি মানে হচ্ছে
দেশিটি রাশিয়ার একটি দুরবর্তী সীমান্তছাউনিতে পরিণত হবে। তাছাড়া রাশিয়া ঈজিয়ান সাগরে সহজে
প্রবেশাধিকার পাবে এবং কনস্টানন্টিনোপলের উপর চ‚ড়ান্তকর্তৃত্ব লাভ করবে। ডিজরেলী াারো আশঙ্কা
করেন। এশিয়া মাইনরে কর্তৃত্বের মাধ্যমে রাশিয়া এক সময়ে আলেকজান্ডারটেটা উপসাগরে নৌঘাটি
স্থাপনের দিকে এগিয়ে যাবে। গ্রীক এবং সার্বরাও তাদের অসন্তষ্টি প্রকাশ করে। প্লেবনার পতনের পর
গ্রীকরা তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু যেহেতু গ্রীস নৌ শক্তিতে দূর্বল তাই বৃটেন
নৌঅবরোধের হুমকি দিলে গ্রীস বাধ্য হয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নেয় । স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধ শেষে যখন
বিশাল বুলগেরিয়া সৃষ্টি হলো আর গ্রীকরা কিছুই লেনা তখন গ্রীস হতাশ হয়। সার্বিয়া প্লেবনার
আতœসমর্পনের দু‘দিনের মধ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অষ্ট্রিয়া সার্বিয়া বাহিনীতে পশ্চিমদিকে বসনিয়ার
দিকে আক্রমন পরিচালনা না করে দক্ষিণে মেসোডিনিয়ার দিকে আক্রমন করার জন্য নির্দেশ দেয়।
সার্বিয়ানরা আস্ট্রিয়ার সতর্কবানী শুনে রুশদের সামনে পলায়নপর তুর্কীদের নিকট থেকে বিস্তৃর্ণ এলাকা
দখল করে নিয়েছিলো। কিন্তু এই দখলকৃত । এলাকা বুলগেরিয়ার মধ্যে পড়ে, সার্বরা কিছুই পেলো না।
সার্বরা রাশিয়ার কাছে প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু রুশরা সার্বদাবীকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। রুশরা বুঝতে
পেরেছিলো তাদের একতরফা সিদ্ধান্তএবং অন্যান্য দেশসমূহের বিরোধিতা স্বাভাবিক। রুশরা আরো
জানত ১৮৫৬ সালের প্যারিস শান্তিচুক্তি অনুযায়ী সকল শক্তি মিলে তুর্কী সাম্রাজ্য সংক্রান্তসমস্যা
সম্পর্কে সিদ্ধান্তনিবে। তাছাড়া সৈন্যরা এত ক্লান্তহয়ে পড়েছিল যে রুশদের পক্ষে আর যুদ্ধ চালিয়ে
যাওয়ার সম্ভবপর ছিল না এবং দেশের অভ্যন্তরে একটা বিপ্লবী আন্দোলন বিষ্ফোরক পরিস্থিতির সৃষ্টি
করছিলো। রাশিয়া বৃটেনের প্রস্তাব অনুযায়ী আলাপ আলোচনায় বসতে রাজী হলো। অস্ট্রিয়া দেখল
কংগ্রেস না বসরে অস্ট্রিয়ার দাবী অগ্রাহ্য করা হতে পারে। ৫ই জুনে অস্ট্রিয়া ইংল্যান্ডের সাথে এক
চুক্তিতে উপনীত হয়। অস্ট্রিয়া অঙ্গীকার করে যে বলগেরিয়ার ব্যাপারে সে বৃটেনকে সমর্থন করবে
বিনিময়ে বৃটেন বসনিয়া-হার্জিগোবিনার সম্পর্কে অস্ট্রিয়ার দাবী সমর্থন করবে।
বার্লিন সম্মেলন
১৩ই জুন ১৮১৮ সালে বার্লিনে সম্মেলন শুরু হয়। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী স্বাগতিক জার্মানীর বিসমার্ক
সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হন। বয়সের ভারে নুহ্য, এবং নানারোগে আক্রান্তবিসমার্ক যদিও আগের
তেজস্বীত হারিয়েছেন তবুও সম্মেলনের মধ্যমণি ছিলেন তিনি। নানা টানাপোড়ন এবং ভেঙ্গে পড়ার
উপক্রম হতে তিনি সম্মেলনকে সফল করেছিলেন। সম্মেলনের আরেকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিরেন বৃটেনের
প্রধানমন্ত্রী আশি বছর বয়স্ক যুবরাজ গোর চাকব। সম্মেলনে বলকান অঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যও সম্মেলনে
প্রতিনিধি পাঠায়। তুরস্কের প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে শুধু উপেক্ষা করা হয়নি
অপমানিত করা হয়েছিলো। বিসমার্ক তাঁকে কঠোরভাবে শুনিয়ে দেন যে যদি তিনি মনে করেন যে
সম্মেলন বসেছে তুরুস্ককে রক্ষা করতে তা হবে ভুল ধারণা। যদি সানষ্টিফানোর চুক্তির ফলে কিছু
ইউরোপীয় দেশের স্বার্থহানি না ঘটতো তাহলে ওটিই চ‚ড়ান্তথাকত। আগে থেকে ঠিকঠাক করা
সিদ্ধান্তসমূহকে চ‚ড়ান্তঅনুমোদন দেওয়ার জন্য বার্লিন কংগ্রেস বসে নি। বৈঠক বসার পূর্বে সাধারণ
একটা নীতিমালা ঠিক হয়েছিল, কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তনেওয়া হয়নি। বার্লিন আলোচনা কালে কয়েকটি
বিষয়ে বিশেষ করে এশিয়া মাইনর এলাকায় রাশিয়া কতটু এলাকা লাভ করবে এবং দক্ষিণ বুলগেরিয়া
তুরস্ক কতটুকু কর্তৃত্ব রাখবে এসব বিষয়ে প্রচুর রাক বিতন্ডা হয়েছিলো, অনেক সময় মনে হয়েছে
সম্মেলন বুঝি ভেঙ্গে যাবে। শেষ পর্যন্ত১৩ জুলাই ১৮৭৮ সালে বার্লিন সন্ধি সাক্ষরিত হয়।
বার্লিন সন্ধির শর্তাবলী
১) স্যানষ্টিফানো সন্ধিার দ্বারা সৃষ্ট বুলগেরিয়াকে তিনটিভাগে বিভক্ত করা হয়। ম্যাসিডোনিয়া অঞ্চল
বুলগেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুর্কী সুলতানের প্রত্যক্ষ শাসনে রাখা হয়। বলকান পর্বতের দক্ষিণে
অবিস্থিত পূর্ব রুমেলিযাকে বুলগেরিয়া থেকে আলাদা করে তুর্কী সুলতানের শাসনাধীনে সায়ত্ত¡শাসন
দেওয়া হয়। ঠিক হয় এ অঞ্চল একজন খ্রীষ্টান গভর্ণর শাসন করবে। বলকান পর্বতের উত্তরের অংশ
নিয়ে গঠিত হবে বুলগেরিয়া রাজ্য গঠিত হয়ে। বুলগেরিয়ার শাসনকর্তা বুলগারদের দ্বারা নির্বাচিত হবে,
তুরস্কের সুলাতান এই নির্বাচিত প্রার্থীকে অনুমোদন দিতে বাধ্য থাকবেন। মোট কথা স্যানস্টিফানোর
সন্ধিতে যে বুলগেরিয়া গঠিত হয়েছিলো বার্লিন চুক্তি তার তিনভাগের একভাগ নিয়ে গঠিত নব্য
বুলগেরিয়ার জন্ম দেয়।
২। সার্বিয়া এবং মন্টিনিেেগ্রার স্বাধীনতা তুর্কী সুলতান স্বীকার করে নেন। অবশ্য সানষ্টিফানোর চুক্তি
দ্বারা এই দুটিরাষ্ট্রযে ভ‚খন্ড লাভ করেছিলো তা বার্লিন সন্ধি দ্বারা কমিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
৩) রুমানিয়া ও তুর্কী সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনাত স্বাধীনতা লাভ করে। অবশ্য রুমানিয়া হতে দক্ষিণ
বেসারাবিয়া অঞ্চল আলাদা করে দিয়ে দেওয়া হয়। যদিও তুর্কী অঞ্চলভুক্ত দোবরুজা অঞ্চলের কিছু
অংশ ক্ষতিপুরণ হিসাবে রুমানিয়াকে দেওয়া হয় তুবুও। রুমানিযা বেসারবিয়া হারানোর শোক
ভ‚লতে পারে ন।ি এই বিষয় নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে তার শত্রæতা লেগেই ছিলো।
৪। বসনিয়া হার্জেগোবিনা সেখানে থকে সমস্যার উদ্ভব হয়েছিলো তা অষ্ট্রিয়াকে দখল ও শাসন করার
অধিকার দিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য অঞ্চল দুটিকে অষ্ট্রিয় সাম্রাজ্যভুক্ত করার অধিকার অষ্ট্রিয়াকে
দেওয়া হয় নি। সার্বিয়া এবং মন্টিনিগ্রোর মধ্যবর্তী বসনিয়া হার্জিগোবিনার অন্তর্গত নবীবাজার
এলাকার সঞ্জক নামক স্থানে অস্ট্রিয়াকে একটি দূর্গ স্থাপন করতে অনুমতি দেওয়া হয়।
৫। রাশিয়া দক্ষিণ বেসারবিয়া ছাড়া এশিয়া মাইনর এলাকার বাটুম, কারস আরদাহান এলাকা লাভ
করে।
৬। রাশিয়ার এশিয়া মাইনর এলাকায় এ অঞ্চলগুলো লাভ করায় বৃটেন সাইপ্রসাসের অধিকার করে।
বিনিময়ে বৃটেন প্রতিশ্রæতি দেয় যে ভবিষতে তুরস্কের অখন্ডতার প্রতি কোন রূপ হুমকি দেখা দিলে
বৃটেন তুরস্ককে সামরিক সহায়তা দান করবে। অবশ্য বৃটেন কোন দিনই তার এই প্রতিশ্রæতি রক্ষা
করে নি।
৭। গ্রীস সম্মেলনে ক্রীট, থেসালি, ইপিরাস এবং মেসিডোনিয়ার অংশ বিশেষ দাবী করে। কিন্তু
সম্মেলনে গ্রীসের দাবী অগ্রাহ্য করা হয়। তুরুস্কের সুলতানকে গ্রীসের সঙ্গে সীমান্তসংক্রান্তবিবাদ
মিটিয়ে ফেলার জন্য সম্মেলন আহবান জানায়।
বার্লিন চুক্তির প্রতিক্রিয়া
বলকান অঞ্চল : বার্লিন চুক্তি বলকান অঞ্চলে স্থায়ী শান্তিআনতে ব্যর্থ হয়। পূর্বেই বলা হয়েছে রুমানিয়া
দক্ষিণ বেসারবিয়া হারানোতে ক্ষুদ্ধহয়েছে এবং সে রাশিয়ার সঙ্গে এটাকে নিয়ে শত্রæতায় লিপ্ত হয়।
মেসোডোনিয়া সমুদ্রে যাবার পথ হারানোতে হতাশ হয়েছে এবং সানস্টিফানো চুক্তিতে যে বুলগেরিয়া
সুষ্টি করা হয়েছিলো তা সঙ্কুচিত করায় বুলগেরিয়াও বিক্ষুদ্ধ ছিলআর্বিয়ার হতাশা ছিল সবচাইতে তীব্র।
সার্বিয়া ঐ অঞ্চলে সার্ভদের নেতা হতে চেয়েছিলো এবং আশা করেছিলো বসনিয়া হার্জেগোবিনার
অধাকার সে লাভ করবে। কিন্তু এ প্রদেশ দুটি অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরীকে দেওয়ায় সার্বিয়া অস্ট্রিয়াকে ককা
করতে পারে নি। সার্ব ও অষ্ট্রিয়ানদের দ্ব›দ্ব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটি বড় কারণ ছিল।
তুরস্ক
বার্লিন চুক্তিতে তুরুস্ককে যে অপমানা করা হয়েছে তুরস্ক তা হজম করতে পারে নি। তুরস্কের ভ‚মি
রাশিয়া, বৃটেন এবং অন্যান্যদেরকে দেয়াই শুধু হয় নাই বরং তুরুস্ককে অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং তার
অধীনস্তখ্রীষ্টান প্রজাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করার প্রতিশ্রæতি দিতে হয়েছে। মোটকথা তুরস্ককে
বাধ্যকরে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে যে খ্রীষ্টান প্রজাদেরকে সে ধর্মীয় কারণে নির্যাতন করছে।
বার্লিন চুক্তির হতাশা থেকে তুরুস্ক পরবর্তীতে তার ঐতিহ্যগত বন্ধু ইংল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক বিসর্জন
দিয়ে মিত্র খুঁজতে হতাশা থেকে তুরস্ক পরবর্তীতে তার ঐতিহ্যগত বন্ধু ইংল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক বিসর্জন
দিয়ে মিত্র খুঁজতে থাকে।
রাশিয়া
এই চুক্তি দ্বারা সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে রাশিয়া। তুরস্কের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার
ছেয়ে লাভবান হয়েছে অস্ট্রিয়া এবং বৃটেন। রাশিয়া বৃহৎ বুলগেরিয়া সুষ্টি করে তার প্রভাববলয় বাড়াতে
চেয়েছিলো, কিন্তু এই চুক্তি তা নস্যাৎ করে দিয়েছে।
সারসংক্ষেপ
১৮৭৫ সালে বসনিয়া হার্জেগোনিয়ায় কৃষক বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বলকান পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
তুর্কী সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যে দুটি দেশ এ অঞ্চলে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করতে
চেয়েছিলো তারা এই বিদ্রোহের পূর্ণ সদ্বব্যবাহার করে। úাভদের অধিকার এবং খ্রীস্টান নির্যাতনের
অভিযোগ রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী বলকান বিদ্রোহকে উৎসাহিত ও সহযোগিতা করতে থাকে। তুরস্ক
যখন বিদ্রোহীদের দমন করতে শুরু করে তখন রাশিয়া “প্যানúাভ” বাদের শ্লোগান তুরে তুরস্কের
বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে নেয়। রাশিয়ার হাতে তুরস্কের চ‚ড়ান্তপরাজয় বৃটিশ স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর তাই বৃটেন
রাশিয়ার অভিলাশের সামনে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। বৃটেন আশঙ্কা করে ভারতের সাথে বৃটেনের
যোগাযোগের পথ এবং সুয়েজ খালে বৃটিশ আধিপত্য রুশ হুমকির সম্মুখীন হয়। ১৮৭৮ সালে বার্লিন
সম্মেলনে ইউরোপীয় সকল শক্তির স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়। তুরস্কের ভুমি ছিনিয়ে অস্ট্রিয়া বৃটেন
ও রাশিয়াকে দেওয়া হয়। সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো এবং রুমানিয়া স্বাধীনতা ও অতিরিক্ত ভ‚মি লাভ করে।
বুলগেরিয়া স্বায়ত্বশাসন লাভ করে। যদিও অধিকাংশ দেশ এই চুক্তিতে অসন্তষ্ট থাকে তবুও বার্লিন
চুক্তিতে যে ভৌগোলিক পরিবর্তন আনা হয় তা ১৯১২-১২১৩ পর্যন্তবহাল থাকে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। রাশিয়া úাভদের বড় বন্ধু রুপে আবিভর্‚ত হয় কেননা -
ক) রাশিয়া ও বলকান úাভরা একই জাতিভ‚ক্ত
খ) তুর্কীরা úাভদেরকে অত্যাচার করত তাই রাশিয়া তাদেরকে রক্ষা করতে চেয়েছে।
গ) বন্ধুত্বের সুযোগে úাভ অঞ্চল দখল করলে রাশিয়ার সীমানা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হবে।
ঘ) অস্ট্রিয়াকে সমুচিত শিক্ষা দিতে পারবে।
২। অষ্ট্রিয়ার পররষ্ট্র মন্ত্রী এ্যান্ডরেসী বসনিয়া-হার্জিগোবিনা অস্ট্রিয়ার সঙ্গে একত্রীত হউক এটা চাইতেন
না কেননা।
ক) তিনি অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যবাদী নীতি পছন্দ করতেন না।
খ) তিনি তুরস্কের প্রতি সহানূভ‚তিশীল ছিলেন।
গ) তিনি বসনিয়া-হার্জিগোবিনার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন
ঘ) মাইগাররা অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরীতে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে।
৩। বসনিয়া-হার্জিগোবিনার বিদ্রোহের বিস্তারের কারণ
ক) ইংল্যান্ডের প্ররোচনা
খ) রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার উৎসাহ
গ) মুললমানদের দ্বারা খ্রীষ্টানদের উপর নির্যাতন
ঘ) বিসমার্কের সাহায্য সহযোগিতা
৪। সানস্টিফানো চুক্তি অনুযায়ী বুলগেরিয়া সৃষ্টি হলে -
ক) এটি স্বাধীন রাষ্ট হিসাবে স্বীকৃতি পাবে
খ) বলকান জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি পাওয়া যাবে
গ) রাশিয়ার ছাউনিতে পরিণত হবে
ঘ) তুরস্ক খুশী হবে।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। বসনিয়া-হার্জিগোবিনা নিয়ে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার দ্ব›েদ্বর কারণ বিশ্লেষণ করুন।
২। সানস্টিফানো চুক্তি বাস্তবায়িত হরে বৃটেনের স্বার্থ কিভাবে ক্ষুন্ন হয় তা আলোচনা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
১। ক ২। ঘ ৩। খ ৪। গ
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। বুলগেরিয়া সঙ্কটে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়া আলোচনা করুন।
২। বার্লিন চুক্তি কিভাবে বিভিন্ন শক্তিকে অসুন্তুষ্ট করেছিলো তা পর্যালোচনা করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত