ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল
পূর্বাঞ্চল নিয়ে উনবিংশ শতাব্দীতে দুটি সমস্যা ছিল। প্রথম সমস্যাটি ছিল বাইরের শক্তি তথা রাশিয়া
কর্তৃক কৃষ্ণ সাগরে নিয়ন্ত্রণ এবং কোন বাধা ছাড়া ভ‚মধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে নৌ চলাচলের অধিকার।
দ্বিতীয় সমস্যাটি হচ্ছে তুরস্ক সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং এর ফলে তুরস্ক সাম্রাজ্যের
ব্যবচ্ছেদ। প্যারিস শান্তিচুক্তি এই দুটি সমস্যা মোকাবেলার চেষ্টায় রাশিয়ার অভিলাশকে রাশ টেনে
ধরেছে এবং সুলতানের ক্ষমতাকে উচুঁ করে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শীঘ্রই দেখা যায় প্যারিস সন্ধি
এখানে শান্তিআনতে সফল হতে পারে নি। তুরস্কের অভ্যন্তরে জাতীয়তাবাদ চাঙ্গা হয়ে উঠে এবং
রাশিয়া আবার আগ্রাসী ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়। এই সব কারণে অনেক ঐতিহাসিক ক্রিমিয়ার যুদ্ধের
ফলাফলে অসম্পূর্ণ ও নিস্পত্তিহীন মনে করে। কিন্তু গভীর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ক্রিমিয়ার যুদ্ধের
পরোক্ষ ফল ছিল সূদূর প্রসারী।
ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের পতন
প্যারিসের সম্মেলনে ইউরোপের প্রায় সকল বৃহৎশক্তির যোগদান, বৃটেন ও ফ্রান্সের পুলিশী ব্যবস্থার
অধীনে বিপথগামী রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা এবং তুরস্ককে শক্তি সমবায়ের সদস্য
হিসাবে স্বীকৃতি দানের দ্বারা এই ধারণা জন্মায় যে ১৮১৫ সালের পর গড়া ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বুঝি
আবার কার্যকরী হতে চলেছে। দানীয়ুব নদীকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করার দ্বারা এ ধারণা হলো যে
ইউরোপীয় সম্পদায় তাদের যৌথ দায়িত্বের পরিধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। শক্তি সমবায়ের উদ্দেশ্য
ছিল ইউরোপে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য যৌথ সিদ্ধান্তও যৌথ দায়িত্ব গ্রহণ। কিন্তু ক্রিমিয়ার যুদ্ধ
পরবর্তী দেখা গেল বেশ কিছু রাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যুদ্ধ চালিয়ে
যাচ্ছে। নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে প্রæশিয়া তিনটি এবং ফ্রান্স দুটি লড়াই লড়েছে। শক্তি সমবায় ঙেঙ্গে
যাওয়া এবং ঘনঘন যুদ্ধ হওয়ার কারণ ছিল শক্তিসাম্য নীতির নিশ্চয়তা প্রদানকারী দুই বৃহৎশক্তি রাশিয়া
এবং অস্ট্রিয়ার দুর্বল হয়ে পড়া। এই শক্তির শূন্যতার ফলে নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্র নায়ক ক্যাভুর, তৃতীয়
নেপোলিয়ন এবং বিসমার্ক ১৮১৫ সালের পর গড়া ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়া এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য
শক্তি প্রয়োগের নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেন।
রাশিয়ার ক্ষতি
এই যুদ্ধে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় রাশিয়া। রাশিয়া একটা বিশাল শক্তি এত দিন ধরে প্রচলিত এই ধারণা
যে বাস্তবতা বিবর্জিত ক্রিমিয়ার যুদ্ধ তা প্রমাণ করে। ১৭২১ সাল থেকে রাশিয়া ইউরোপে যে প্রতিপত্তি
নিয়ে প্রাধ্যন্য বিস্তার করছিল ১৮৫৬ সালের পর তার অবসান ঘটতে শুরু করল। অস্ট্রিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ
দিনের যে মিত্রতা ছিল তাও সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল। জার নিকোলাস আশা করেছিলেন হাঙ্গেরির
বিদ্রোহের সময় তিনি অস্ট্রিয়াকে যে সহায়তা দিয়েছিলেন তার বিনিময়ে অস্ট্রিয়া হয় নিরপেক্ষ থাকবে
অথবা রাশিয়ার শত্রæদের আহŸানে সাড়া দিবেনা। কিন্তু রাশিয়া দেখল অস্ট্রিয়া তার সঙ্গে শত্রæতা মূলক
আচরণ করছে। ১৮৫৪ সালে সামরিক দিক দিয়ে না হলেও অস্ট্রিয়া বৃটেন এবং ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রীতে
আবদ্ধ হয়েছে। রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে যে সম্পর্ক শীতল তা প্রমাণিত হলো ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর।
রাশিয়া অস্ট্রিয়ার প্রতি অনুরক্ত নেসেলরোডকে পরিবর্তন করে অষ্ট্রিয়া বিদ্বেষী গোরচাকভকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী
হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে।
অষ্ট্রিয়ার ক্ষতি
এই যুদ্ধে অষ্টিয়াও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যদিও অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর মেটারনিক ইউরোপীয় স্থিতাবস্থার মূল চালক
ছিলেন তথাপি তিনি রাশিয়ার ক‚টনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অস্ট্রিয়ার প্রভাব ইউরোপে
সমুন্নত রেখেছিলেন। কিন্তু ১৮৫০ এবং ১৮৬০ এর দশকে অস্ট্রিয়া বন্ধুহীন হয়ে পড়ে। রাশিয়ার
সহযোগিতা ছাড়া মধ্য ইউরোপের রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কিছু করা
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস - ২ পৃষ্ঠা-১৬২
অস্ট্রিয়ার জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফ্রান্স ও প্রæশিয়ার তুলনায় অস্ট্রিয়া এখন অর্থনৈতিক এবং শিল্পের
দিক থেকে দূর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছিলো।
ব্রিটেনের ক্ষতি
যদিও ক্রিমিয়ার যুদ্ধে বিজয়ী ছিল বৃটেন কিন্তু পরবর্তী দুই দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্রিটেন তার
প্রাধান্য হারিয়ে ফেলে। ব্রিটেন ইউরোপে মিত্রহীন হয়ে একাকীত্বে পড়ে যায়। পরবর্তীকালে ইতালির
একত্রীকরণে, ১৮৬৩ সালের পোলান্ডের বিদ্রোহে এবং úেজভিগ ও হোলস্টেন বিরোধে ব্রিটেন তেমন
কোনো ভ‚মিকা রাখতে পারে নি। অন্য সরকারের সহযোগিতার অভাবে এসব সমস্যায় ব্রিটেন অসহায়ের
মতো বসে থাকে। আগে আন্তর্জাতিক সমস্যায় যে সব দেশের কোনো ভ‚মিকা ছিল না যেমন ফ্রান্স
পিডমন্ট এবং প্রæশিয়ার মত দেশগুলি অস্ট্রিয়াকে আক্রমণ করে প্রতিপত্তি প্রদর্শন করতে থাকে।
ফ্রান্সের লাভ
ক্রিমিার যুদ্ধে ফ্রান্স কিছুদিনের জন্য অন্তত বেশ সুবিধা লাভ করে। ভিয়েনা সম্মেলনের মাধ্যমে ফ্রান্সকে
যে ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয় তৃতীয় নেপোলিয়ন তার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উদগ্রিব ছিলেন।
১৮৬৩ সালের পোলান্ডের বিদ্রোহের সময় পর্যন্ততিনি রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তিনি
জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে বলেছিলেন, “আপনি প্যারিসের চুক্তি পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন, আমি
১৮১৫ সালের চুক্তিকে আংশিক পরিবর্তন করতে চাই”। তিনি আশা করেছিলেন ইউরোপের ক‚টনীতির
কেন্দ্র বিন্দু হবে প্যারিস এবং তিনি হবেন নতুন ক‚টনৈতিক বিন্যাসের নিয়ন্ত্রক। তিনি মধ্য ইউরোপের
বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোর জাতীয়তাবাদী আকাংক্ষার প্রতি সহানুভ‚তিশীল ছিলেন। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর
শক্তি সমবায় দূর্বল হয়ে পড়লে নেপোলিয়ন সুযোগ লাভ করেন। ১৮৫৮ সালে রাশিয়ার সঙ্গে
সহযোগিতা করে রুমানিয়ার স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করেন। ১৮৫৯ সালে পিডমন্টের সহায়তায়
সৈন্য প্রেরণ করে লোম্বার্ডি থেকে অস্ট্রিয়ানদেরকে উৎখাত করে। তাছাড়া উত্তর ইতালিতে তিনি
ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে একটি স্বাধীন রাজ্য বানাতে চেয়েছিলেন।
সারসংক্ষেপ
তুরস্কের দুর্বলতার সুযোগে ইউরোপীয় বৃহৎ শক্তিবর্গ অটোমান সাম্রাজ্যকে নিয়ে নানামুখী পরিকল্পনা
করে। রাশিয়া তার নিরাপত্তা নিশ্চয়তার জন্য ভ‚মধ্যসাগর পর্যন্তঅগ্রসর হতে চায়। ব্রিটেন তুরস্ক
সাম্রাজ্যের অখন্ডতা অটুট রেখে তার মূল্যবান উপনিবেশ ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতে চায়,
অস্ট্রিয়া চাচ্ছিল মধ্য ইউরোপের অঞ্চল গুলোতে তার প্রতিপত্তি অটুট থাকুক। এই সব স্বার্থের
টানাপোড়নে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ সংগঠিত হয়, রাশিয়া পরাজিত হয়, ইঙ্গ-ফরাসিরা এবং তুর্কিরা জয়লাভ
করে। প্যারিস শান্তিচুক্তি যা দিয়ে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে তা মোটেই শান্তিআনতে পারে নি।
রাশিয়া অসন্তুষ্ট হয়ে আক্রমণকারীর ভ‚মিকা অবলম্বন করে, তুর্কি সাম্রাজ্যে জাতিগত বিরোধ চাঙ্গা হয়ে
উঠে। এই যুদ্ধে রাশিয়া ছাড়া অস্ট্রিয়া ও ব্রিটেন ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। রাশিয়ার সাহায্য ছাড়া অস্ট্রিয়ার
পক্ষে পূর্বের প্রতিপত্তি ধরে রাখা সম্ভবপর ছিল না। ব্রিটেন ইউরোপে বন্ধুহীন হয়ে পূর্বের মতো প্রভাব
বিস্তার করতে কিছুদিনের জন্য অপারগ হয়। শক্তি সমবায়ের পরাশক্তি রাশিয়া ও অস্টিয়ার দুর্বলতার
সুযোগে সবচাইতে লাভবান হয় প্রæশিয়া, ইতালি এবং ফ্রান্স।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () টিক দিন
১। রাশিয়া কৃষ্ণ সাগরে এবং ভ‚মধ্য সাগরে যেতে চেয়েছিলো কেননা -
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস - ২ পৃষ্ঠা-১৬৩
(ক) তার কোনো সমুদ্র বন্দর ছিল না
(খ) তার সমুদ্র বন্দর গুলো শত্রæরা দখল করে নিয়েছে
(গ) এসব সমুদ্রে যাওয়ার পথ খুব সহজ
(ঘ) শীতকালে তার নৌবন্দরগুলো বরফে জমে যায়।
২। রাশিয়া তুরস্ক সাম্রাজ্যের খ্রিস্টানদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিল কেননা।
(ক) খ্রিস্টান জনগণ রাশিয়াকে এজন্য আহŸান করেছে
(খ) এটা রাশিয়া তার ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করেছে
(গ) এ দাবির অন্তরালে কৌশলগত সুবিধা লাভ করা সহজ
(ঘ) খ্রিস্টানদের দাবির কথা তুললে তুরস্ক সম্রাট বিপদে পড়বে।
৩। ব্রিটেন রাশিয়ার অগ্রাভিযানের ব্যাপারে শঙ্কিত ছিল কেননা সে
(ক) এক সময় রাশিয়া ভারত দখল করবে
(খ) রাশিয়া অনেক শক্তিশালী হয়ে ব্রিটেনকে পরাজিত করবে
(গ) ব্রিটেনের পক্ষে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কঠিন হবে
(ঘ) তুরস্ক সাম্রাজ্য রাশিয়া দখল করে ফেলবে।
৪। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্তহয়েছে
(ক) অস্ট্রিয়া
(খ) রাশিয়া
(গ) ব্রিটেন
(ঘ) তুরস্ক
রচনামূলক প্রশ্ন
১। অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ে রুশ পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করুন।
২। ক্রিমিয়ার যুদ্ধ কী ভাবে ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের পতন ঘটায় তা আলোচনা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
১. ঘ ২. গ ৩. গ ৪. খ
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। প্যারিস শান্তিচুক্তি কীভাবে তুরস্কের সুলতানের ক্ষমতাকে অটুট রেখেছে?
২। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে তৃতীয় নেপোলিয়ন কীভাবে লাভবান হয়েছেন?

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]