বৃটেনে অপরাধ আইন সংস্কার প্রচেষ্টার বিবরণ দিন।
বৃটেনে দাস প্রথা বিলুপ্তির আইন প্রণয়ন এবং এর ফলাফল আলোচনা করুন।
বৃটেনে পৌরসভা সংস্কার আইনের বিবরণ দিন।


১৮১৫ সালে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিভারপুল। নেপোলিয়নের আক্রমণ এবং মহাদেশীয় ব্যবস্থার
অধীনে প্রবল অবরোধের মুখে এই সময়ের বৃটেনের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এক অস্থির
পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। উনিশ শতকের প্রথম দশকের পূর্ব পর্যন্তবৃটেন ছিল একটি অতিমাত্রায়
রক্ষণশীল দেশ। শিল্প বিপ্লবোত্তরকালে দেশের শিল্প এবং শ্রমিক শ্রেণী বিকাশের পটভূমিতে আর্থ-
সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও সংস্কার পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়ে। পুরনো ধ্যান-ধারণা, রক্ষণশীল নীতি,
সমাজ জীবনে সামন্তধারার প্রভাব অবসানকল্পে উনিশ শতকের প্রথমপাদ থেকে বৃটেনের আর্থ-সামাজিক
ক্ষেত্রে বহুমুখী সংস্কারের পদক্ষেপ গৃহীত হয়। এই সংস্কারমুখী কর্মকান্ডের ভেতর দিয়ে বৃটেন পুরনো
রক্ষণশীলতা থেকে উদারনৈতিক সমাজের দিকে যাত্রা করে। বস্তুত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে
আধুনিক বৃটেনের মূল গোড়াপত্তন এখান থেকেই শুরু। বিশেষত বৃটেনের আইন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা,
পুলিশ প্রশাসন, পৌর প্রশাসন, শ্রম আইন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। বৃটেনের আর্থ-
সামাজিক ইতিহাসে এই সকল সংস্কারকে রক্ষণশীলতা থেকে উদারতার দিকে যাত্রা হিসেবে অভিহিত
করা হয়।
ক্রিমিনাল কোড সংস্কার : ১৮১৯
উনিশ শতকের প্রথম দিকে সম্পাদিত সংস্কার কর্মের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বৃটেনের
ক্রিমিনাল কোড সংস্কার। তখনো পর্যন্তঅপরাধের জন্য শাস্তিছিল চরম অমানবিক এবং অসঙ্গতিপূর্ণ।
১৮২০ সালে বৃটেনের রাজা তৃতীয় জর্জ মৃত্যু হলে প্রিন্স রিজেন্ট চতুর্থ জর্জ নাম ধারণ করে বৃটেনের
সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই সময়ে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লর্ড লিভারপুল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন
রবার্ট পিল। বৃটেনের তৎকালীন অপরাধ আইনে প্রায় দুইশত অপরাধের শাস্তিছিল মৃত্যুদন্ড। আরও
ছিল নির্বাসন, দ্বীপান্তর এবং সশ্রম কারাদন্ড। এই সময়ে আইনের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল লঘু অপরাধের জন্য
গুরুদন্ড আর গুরুতর অপরাধের জন্য লঘুদন্ড। যেমন, সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ পশু হত্যা করলে অপরাধ
ছিল মৃত্যুদন্ড। আবার ডাকাতির অপরাধ প্রমাণ করতে না পারলে শাস্তিছিল কারাদন্ড। ডাকাতি,
দস্যুবৃত্তি, খুন, রাহাজানি ইত্যাদির শাস্তিছিল মৃত্যুদন্ড। তবে এই শাস্তির পূর্বশর্ত ছিল প্রত্যক্ষদর্শীর
সাক্ষ্য প্রদান। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন দুর্বল হওয়ার কারণে সাক্ষ্য প্রক্রিয়া সম্পাদন কিংবা অপরাধীকে
চিহ্নিত করা ছিল কঠিন কাজ। ফলে বিচারক রায় প্রদান করতে পারতেন না। এদিকে লঘু অপরাধীরা
দ্রæত শাস্তিপেয়ে যেত। বৃটেনের অপরাধ আইন পরীক্ষা ও পরিবর্তনের জন্য ১৮১৯ সালে একটি কমিটি
গঠিত হয়। কমিটির সুপারিশক্রমে নি¤œলিখিত পদক্ষেপসমূহ গৃহীত হয়।
ক. বিদ্যমান আইনের পরিবর্তন করে প্রায় শতাধিক অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড বাতিল করা হয়;

খ. সব ধরনের শাস্তির মেয়াদকাল অর্ধেকের বেশি হ্রাস করা হয়;
গ. বৃটেনের নাগরিকদের জন্য দ্বীপান্তর ও নির্বাসন আইন বহুলভাবে কমিয়ে দেয়া হয়;
ঘ. কমিটির সুপারিশক্রমে গোয়েন্দাদের প্রদত্ত তথ্য একচেটিয়াভাবে গ্রহণের বিষয়টি বাতিল করে দেয়া
হয়। এই গোয়েন্দাদের প্রায় সকলেই কারখানা মালিক, শিল্পপতি ও বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে
মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ করে তাদের স্বার্থে রিপোর্ট প্রদান করতো;
ঙ. এই কমিটির সুপারিশের আলোকে বৃটেনের কারাগারসমূহের ব্যাপক সংস্কার ও উন্নতি সাধন করা
হয়;
চ. অপরাধ আইনের অনেক ধারা উপধারা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করে দেয়া হয়;
ছ. পুলিশ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করে পুলিশ বিভাগকে নতুনভাবে বিন্যাস করা হয়;
১৮১৯ সালের ক্রিমিনাল কোড সংস্কার আইন বৃটেনের সমাজ জীবনে ব্যাপক ইতিবাচক ফল প্রদান
করে। এই আইনের ফলে মানুষের উপর অমানবিক শাস্তিপ্রথা বন্ধ হয়। লঘুপাপের জন্য গুরুদন্ড এবং
গুরুপাপের জন্য লঘুদন্ডের মত হাস্যকর শাস্তিপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে। অপরাধ আইন আধুনিক রূপ পরিগ্রহ
করে। পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর পটভূমিতে ১৮২৯ সালে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ গঠন করা
হয়। তাদের জন্য প্রবর্তিত হয় নতুন আইন, নতুন প্রশিক্ষণ পদ্ধতি এবং নতুন বেতন ভাতার কাঠামো।
ক্রমে সততা, দক্ষতা এবং শৃঙ্খলার জন্য লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ সারা পৃথিবীর কাছে অনুসরণীয়
হয়ে দাঁড়ায়।
বৃটেনে দাস প্রথার বিলুপ্তি : ১৮৩৩
দাস প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি বৃটেনের রক্ষণশীলতা থেকে উদারতার দিকে যাত্রার একটি ঐতিহাসিক
পদক্ষেপ। সতেরো এবং আঠারো শতকে পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি বিশেষত বৃটেন, ফ্রান্স, স্পেন,
ইটালি, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশ আফ্রিকা মহাদেশে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করতে থাকে। এই সময়ে এই
দেশগুলির বনিকেরা স্থায়ী উপনিবেশ স্থাপনের পরিবর্তে দাস বাণিজ্যের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ
করে। নব আবিষ্কৃত আমেরিকা মহাদেশ তখন পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির উপনিবেশ ছিল। সমগ্র
আমেরিকা অঞ্চলে বসতি স্থাপন, কৃষি উৎপাদন এবং বহুবিধ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ছিল বিশাল
শ্রমশক্তির। দখলদার ইউরোপীয়দের হাতে এই শ্রম শক্তি ছিল না। এই পটভূমিতে শুরু হয় দাস
বাণিজ্যের। পশ্চিম ইউরোপের বণিক কোম্পানিগুলি আফ্রিকা মহাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে একেবারে
পশ্চাৎপদ কালো মানুষদেরকে জোরপূর্বক ধরে এনে দাস হিসেবে আমেরিকা মহাদেশে চালান দিতে
থাকে। এই দাস বাণিজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে পশ্চিম ইউরোপের শক্তিগুলি আফ্রিকা মহাদেশে এক
বিভীষিকাময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আফ্রিকার কালো মানুষদের উপর উক্ত বর্বর অমানবিক
অত্যাচার মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। উনিশ শতকের
শুরুতে পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সকল দেশে বিশেষত বৃটেনে উক্ত অমানবিক দাস প্রথা ও দাস
বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়। এখানে প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, সতেরো শতকে
স্পেন, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশ দাস বাণিজ্যে অগ্রণী থাকলেও আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে
বৃটিশ কোম্পানিসমূহ দাস বাণিজ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই শতকের শেষদিক থেকে
বৃটেনে দাস প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন উইলিয়াম
উইলবারফোর্স (১৭৫৯-১৮৩৩)। সমগ্র বৃটেনে এই আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করলে বৃটিশ সরকার
১৮৩৩ সালে দাস প্রথা বিলুপ্তি সংক্রান্তএকটি আইন পার্লামেন্টে পাশ করে। উক্ত আইন প্রণয়ন,
পার্লামেন্টে উত্থাপন এবং বিল পাশকরণের ক্ষেত্রে উদারপন্থীরা শুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৮৩৩
সালে বৃটিশ পার্লামেন্টে পাশ করা দাস মুক্তি আইনের ধারাসমূহ ছিল নি¤œরূপ :

ক. এই আইনের ধারা বলে ছয় বছর বয়স পর্যন্তসকল শিশুকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়।
আরও বিধান করে দেয়া হয় যে অত:পর আর কোনো শিশুকে দাস হিসেবে ক্রয় বিক্রয় করা
আইনত দন্ডনীয় হবে;
খ. এই আইনে দাসের সন্তান দাস এই প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। বিধান করে দেয়া হয় যে
অত:পর জন্মগ্রহণকারী সকল শিশু মুক্ত মানুষ হিসেবে পরিগণিত হবে;
গ. এই আইনের বলে ১৮৩৪ সালের ১ আগস্ট থেকে সমগ্র বৃটিশ সাম্রাজ্যের দাস প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা
করা হয়;
ঘ. যারা দাস হিসেবে জীবনের একটা বড় সময় অতিক্রম করেছে এবং দাস জীবনে অভ্যস্তহয়ে
পড়েছে তাদের জন্য সাত বছর মেয়াদের একটি সময়কে নবীশ কাল হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।
এই সময় কালো দাসরা প্রতি দিনের দুই তৃতীয়াংশ সময় মালিকের অধীনে কাজ করবে এবং এক
তৃতীয়াংশ সময় স্বাধীনভাবে কাজ করবে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে এবং এর মধ্য দিয়ে তারা
আস্তেআস্তেস্বাধীন জীবনে ফিরে আসবে;
ঙ. এই আইনের বাস্তবায়ন এবং দাস মালিকদের ক্ষতিপূরণের জন্য বৃটিশ সরকার ২০,০০০০০০
পাউন্ড মঞ্জুর করে।
১৮৩৩ সালের দাস মুক্তি আইনের ফলাফলের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই লক্ষ্য করা যায়।
শিক্ষানবীশকাল সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই বন্দি দাসদের একটা বিরাট অংশ পালিয়ে যায়। দাসদের মুক্ত
করার জন্য বৃটিশ সরকারের আর্থিক ক্ষতিপূরণ ছিল পরিমাণের তুলনায় অনেক কম। ফলে বৃটিশ
উপনিবেশ সমূহে বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকা অঞ্চলে ক্ষতিপুরণের অর্থের বিষয়টি নিয়ে ওলন্দাজদের সাথে
বৃটিশদের ব্যাপক মত পার্থক্য ঘটে। অন্যদিকে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে কৃষিক্ষেত্রে দাস শ্রমিকের
অভাবে উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকদের পারিশ্রমিক ছিল নিগ্রোদের তুলনায় অনেক
বেশি। দাস প্রথা বিলুপ্তির বিষয়টি আর্থিক বিবেচনায় অনেক ক্ষতির কারণ হলেও সাংস্কৃতিক ও মানবিক
বিবেচনায় এর ফলাফল ছিল ইতিবাচক। দাস প্রথা বিলুপ্তির ফলে আফ্রিকার নিগ্রো আদিবাসীদের
সংস্কৃতি ও জীবনধারা রক্ষা পায়। এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও। বস্তুত
আদিবাসীদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি রক্ষার একটি প্রাথমিক প্রয়াস তখন থেকেই লক্ষ্য করা যায়। এই
আইন সারা পৃথিবীতে মানবাধিকার আন্দোলন সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
পৌরসভা সংস্কার বিল : ১৮৩৫
বৃটেনে একটি উদার সমাজ নির্মাণে এবং আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ শহর জীবন গড়ে
তোলার ক্ষেত্রে ১৮৩৫ সালের পৌরসভা সংস্কার আইন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আঠারো
শতকের শিল্প বিপ্লব বৃটেনের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে। সারা বৃটেনে
গড়ে উঠে অনেক শিল্প কারখানা। গড়ে উঠে অনেক শিল্প শহর। খুব দ্রæত গড়ে উঠা এই শহরগুলি ছিল
অপরিকল্পিত। শহরগুলিতে রাস্তাঘাট ছিল অপ্রতুল। প্রশস্তরাস্তা না থাকায় শহরগুলি হয়ে পড়ে বস্তিবহুল।
শহরগুলির পয়:প্রণালী এবং পানি নিষ্কাসন ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। পানীয় জলের সরবরাহ ছিল না
বললেই চলে। বৃটেনের শহরগুলিতে বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। শিল্প বিপ্লবের পটভূমিতে গড়ে
উঠা এই সকল শহরে তখন অসংখ্য শ্রমিক বসবাস করতো। শ্রমিকদের তখনো পর্যন্তকাজের সময়
নির্ধারিত হয়নি। প্রত্যেকদিন তাদেরকে গড়ে ১৬/১৭ ঘন্টা কাজ করতে হতো। শ্রমিক শ্রেণীর এই
অমানুষিক পরিশ্রমের সাথে জড়িত ছিল শহরে বসবাসের পরিবেশ, বিনোদনের সুযোগ -সুবিধা এবং
নাগরিক সুবিধাসমূহের বিষয়টি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো উনিশ শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত
বৃটেনে কোনো শক্তিশালী ও কার্যকর পৌর প্রশাসন গড়ে উঠেনি। ফলে পৌর অঞ্চলের বহুবিধ সমস্যা
দেখাশোনা করার মত কোনো প্রকার সংস্থা ছিল না। উপরন্তু সরকারি বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে কোনো
সমন্বয় না থাকার কারণে পৌর সমস্যাসমূহ জটিল আকার ধারণ করে পৌর জীবনকে দুর্বিষহ করে
তোলে। আর এই পুরো অবস্থা বৃটেনের সামাজিক উন্নয়নের পথে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বৃটেনের

পৌর জীবনের বহুমুখী সমস্যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সমাধানের উপায় নির্দেশের জন্য ১৮৩২ সালের
একটি রয়্যাল কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৮৩৫ সালে পার্লামেন্টে পাশ হয়
পৌরসভা সংস্কার বিল। এই বিল উত্থাপন ও আইনে পরিণত করার ক্ষেত্রে উদারপন্থীদের ভূমিকা ছিল
খুবই উল্লেখযোগ্য। উক্ত সংস্কার বিলের উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ হলো :
ক. এই বিল পৌর অঞ্চলে খাজনা প্রদানকারী ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত পৌর কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করে;
খ. প্রথমে পৌর কাউন্সিলের ক্ষমতা সীমিত থাকলেও সময়ের প্রয়োজনে তা বাড়ানোর ব্যবস্থা রাখা হয়;
গ. এই আইনে পৌর কাউন্সিলের উপর শহরাঞ্চলের উন্নয়নের দায়িত্ব অর্পণ করে;
ঘ. শহরের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার সমগ্র দায়িত্ব অর্পিত হয় এই নির্বাচিত কাউন্সিলের উপর;
১৮৩৫ সালের পৌরসভা সংস্কার আইন বৃটেনের শহর জীবনে এক নতুন গতি সঞ্চার করে। প্রতিটি
শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় পুলিশ ব্যবস্থা। শহরে বাতি ও পয়:প্রণালীর ব্যবস্থা করা হয়। অপ্রশস্তরাস্তাঘাট ভেঙে
বড় বড় রাস্তা নির্মাণ করা হয়। অপরিসর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বাড়িসমূহ ভেঙে ফেলা হয়। শহরে
বাড়ি নির্মাণের নীতিমালা ঘোষণা করা হয়। শহরাঞ্চলে বিনোদনের জন্য নির্মিত হয় পার্ক ও বিনোদন
কেন্দ্র। ১৮৫০ সাল থেকে বৃটেনের বিভিন্ন শহরে যাদুঘর, পাঠাগার, আর্ট গ্যালারি প্রভৃতি নির্মাণের কাজ
শুরু হয়। এভাবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বৃটেনে একটি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন
শহরজীবন গড়ে উঠে। ক্রমে বৃটেনের এই পৌর আইন ও পৌরসভা উন্নয়নের নীতিমালা পৃথিবীর প্রায়
সবদেশে অনুসরণ শুরু হয়।
কারখানা আইন : ১৮৩৩ ও ১৮৪৪
উনিশ শতকের শুরু থেকেই বৃটেনে শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। শিল্প কারখানায় লক্ষ লক্ষ শ্রমিক
নিয়োজিত হয়। এই সকল শিল্প কারখানায় শ্রমিকদের বেতন ছিল খুবই কম। তাদের কাজের সময়
নির্ধারিত ছিল না। কলকারখানায় শিশু শ্রমিক নিয়োগ ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। হাজার হাজার শ্রমিক
তাদের উপার্জিত অর্থে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতে পারত না। তাই বাধ্য হয়ে তারা তাদের
সন্তানদেরকে বাড়তি উপার্জনের জন্য কলে কারখানায় পাঠাতো। এই সুযোগে পুঁজিপতি মিল ও
কারখানা মালিকেরা যে কোনো মূল্যে অধিক উৎপাদন ও অধিক মুনাফার জন্য ইচ্ছা মত শিশু শ্রমিকদের
ব্যবহার করতো। এই শিশু শ্রমিকদের রক্ষার জন্য যথাক্রমে ১৮০২ ও ১৮১৯ সালে দুটি আইন পাশ
হলেও কারখানা মালিকদের কারণে এগুলি কার্যকরী হয়নি। ১৮৩০ সাল থেকে বৃটেনে শ্রমিকদের
কল্যাণের জন্য আন্দোলন শুরু হয়। এই বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্য লর্ড
এ্যাশলে। তার উদ্যোগে ১৮৩৩ সালে পার্লামেন্ট একটি কারখানা কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের
সুপারিশের ভিত্তিতে ১৮৩৩ সালে বৃটিশ পার্লামেন্ট কারখানা আইন অনুমোদন করে। এই কারখানা
আইনের ধারাসমূহ হলো নি¤œরূপ :
১. এই আইনে শিল্প কারখানায় নয় বছর বয়েসের কম শিশুর নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়;
২. এই আইনে নয় থেকে তের বছর বয়েসের শিশুদের কাজের সময়সীমা নয় ঘন্টা বেধে দেয়া হয়;
৩. তের থেকে আঠারো বছর বয়েসের তরুণদের জন্য কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয় বার
ঘন্টা;
৪. এই আইন কার্যকরী করার জন্য এবং আইনের ধারা ঠিকমত পালিত হচ্ছে কিনা তা তদারক করার
জন্য পরিদর্শক নিয়োগের বিধান করে দেয় হয়;
১৮৩৩ সালের কারখানা আইন শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও কল্যাণের জন্য তৎকালীন আর্থ-সামাজিক
বাস্তবতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই আইনের দ্বারা শ্রমিকদের পরিপূর্ণ কল্যাণ সাধন সম্ভব হয়নি।
তবে কারখানায় শ্রমিক কল্যাণের বিষয়টি বাস্তবতা অর্জন করেছিল। কারখানা শ্রমিকদের কল্যাণের

বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা এবং আন্দোলন অব্যাহত থাকে। এই আইনের দশ বছর পর ১৮৪৪ সালে
আরেকটি কারখানা আইন বৃটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয়। ১৮৪৪ সালের কারখানা আইনের ধারা সমূহ ছিল
নি¤œরূপ :
১. এই আইনে মহিলা শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা দিনে বার ঘন্টায় নির্ধারণ করে দেয়া হয়;
২. তের বছরের কম বয়েসের শিশুদের জন্য দিনে সর্বোচ্চ ছয় ঘন্টা কাজ করার সময় নির্ধারণ করে
দেয়া হয়;
৩. দশ বছরের কম শিশুদের কারখানায় নিয়োগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়;
৪. কারাখানায় শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করে দেয়া
হয়;
৫. পূর্ববর্তী আইনের তদারকির ধারা বহাল রাখা হয়;
বলাই বাহুল্য যে এই আইনে ১৮৩৩ সালের আইনের চেয়ে অধিকতর কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়। ১৮৫০
সাল নাগাদ শ্রমিকদের জন্য সাপ্তাহিক ছুটি নির্ধারিত হয়। এভাবে বৃটেনের শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তন
প্রক্রিয়া শুরু হয়।
খনি আইন : ১৮৪২
বৃটেনে কারখানার শ্রমিকদের মত খনি শ্রমিকদের অবস্থাও খারাপ ছিল। খনির অত্যন্তঝুঁকিপূর্ণ কাজে
শিশু ও মহিলাদের নিয়োগ করা হতো। পার্লামেন্ট সদস্য লর্ড এ্যাশলে কারখানার শ্রমিকদের কল্যাণের
জন্য আন্দোলনের পাশাপাশি খনি শ্রমিকদের জন্যও আন্দোলন গড়ে তোলেন। খনি শ্রমিকদের মধ্যেও
এই সময়ে আন্দোলন দানা বেঁেধ উঠে। এই পটভূমিতে ১৮৪০ সালে বৃটিশ পার্লামেন্ট গঠন করে
মাইনস কমিশন। উক্ত কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৮৪২ সালে বৃটিশ পার্লামেন্ট খনি আইন
অনুমোদন করে। এই আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো নি¤œরূপ :
ক. এই আইনে দশ বছরের কম বয়েসের শিশুদেরকে খনির কাজে নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা
হয়;
খ. খনির সুরঙ্গপথ প্রশস্ত, পরিষ্কার এবং সুরঙ্গপথে আলোর ব্যবস্থা করার বিধান করে দেয়া হয়;
গ. খনিতে শ্রমিকদের উপর মালিকদের মারধোর বা সকল প্রকার অত্যাচার বেআইনি ঘোষণা করা হয়;
ঘ. এই আইন ঠিকভাবে অনুসরণ হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য তদারক দল গঠনের বিধান জারি হয়।
এই খনি আইন বৃটেনের খনি শ্রমিক নিয়োগ পদ্ধতি, ঝুঁকি দূরীকরণ এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানের
ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপের সূচনা করে। পরবর্তী পর্যায়ে এই আইন আরও উন্নত ও যুগোপযোগী
করা হয়।
এছাড়াও উনিশ শতকের বিশ এবং ত্রিশের দশকে প্রণীত দরিদ্র আইন, মুক্ত বাণিজ্য প্রবর্তন,
ভোটাধিকার বিস্তৃতি প্রভৃতি বিষয়া বৃটেনের সমাজ ও রাজনীতিকে রক্ষনশীলতার পথ থেকে উদারনৈতিক
ধারার দিকে নিয়ে আসে। এই সময়ে বৃটেনে একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক সমাজ
নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তুত হয়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন

১. ক্রিমিনাল আইনে মৃত্যুদন্ডের বিষয়টি
ক. কমিয়ে দেয়া হয় খ. বাড়িয়ে দেয়া হয়
গ. বাতিল করা হয় ঘ. স্থিতি অবস্থা বজায় রাখা হয়
২. দাসপ্রথা বিলুপ্তি আইন বৃটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয়
ক. ১৮৩০ সালে খ. ১৮৩৩ সালে
গ. ১৮৪০ সালে ঘ. ১৮৪২ সালে
৩. দাস মুক্তির লক্ষ্যে বৃটিশ সরকার মঞ্জুর করে
ক. ২০,০০০০০০ পাউন্ড খ. ৩০,০০০০০০ পাউন্ড
গ. ৪০,০০০০০০ পাউন্ড ঘ. ৫০,০০০০০০ পাউন্ড
৪. পৌরসভা সংস্কার বিল পাশ হয়
ক. ১৮২৫ সালে খ. ১৮৩০ সালে
গ. ১৮৩৫ সালে ঘ. ১৮৪০ সালে
৫. খনি আইন পাশ হয়
ক. ১৮৩৮ সালে খ. ১৮৪০ সালে
গ. ১৮৪২ সালে ঘ. ১৮৪৪ সালে
উত্তর : ১.গ ২।খ ৩। ক ৪।গ ৫।গ
রচনামূলক প্রশ্ন
১. বৃটেনে অপরাধ আইন সংস্কার প্রচেষ্টার বিবরণ দিন।
২. বৃটেনে দাস প্রথা বিলুপ্তির আইন প্রণয়ন এবং এর ফলাফল আলোচনা করুন।
৩. বৃটেনে পৌরসভা সংস্কার আইনের বিবরণ দিন।
৪. কারখানা আইনের বিভিন্ন ধারাসমূহ বিশ্লেষণ করুন।
৫. খনি আইনের বিবরণ দিন।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. অপরাধ আইন কত সালে প্রণীত হয়?
২. উইলবারফোর্স কে?
৩. পৌর কাউন্সিল কিভাবে নির্বাচিত হতো?
৪. দুটি খনি আইন কোন কোন সালে প্রণীত হয়?
৫. লর্ড এ্যাশলে কে?

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]