১৮৩২ সালের সংস্কার বিল সম্পর্কে আলোচনা করুন
চার্টিস্ট আন্দোলনের বিবরণ দিন।
১৮৬৭ সালের ভোটাধিকার আইন ব্যাখ্যা করুন।
বৃটেনে শ্রমিক দলের উৎপত্তির ইতিহাস আলোচনা করুন।


বর্তমান পৃথিবীতে বৃটেনকে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আধুনিক গণতন্ত্র,
সংসদীয় ব্যবস্থা, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা, সংসদের কাছে জবাবদিহিতা, সংসদের দায়বদ্ধতা
প্রভৃতি বিষয়াবলী বৃটেনে সর্বপ্রথম বিকশিত হয়েছে। আর বৃটেন থেকে এই বিষয়সমূহ নিয়েছে পৃথিবীর
অনান্য জাতিসমূহ। গণতন্ত্রতথা সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো মানুষের ভোটাধিকার।
বৃটেন সংসদীয় গণতন্ত্রের মডেল হলেও আধুনিক ভোটাধিকার পদ্ধতি হঠাৎ করেই কিম্বা স্বল্প সময়ে
সেদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিভিন্ন আন্দোলন, বহুমুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে সুদীর্ঘ সময়
অতিক্রম করে বৃটেনে মানুষের ভোটাধিকার সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করে।
ঊনিশ শতকের পূর্বে বৃটেনে মানুষের ভোটাধিকার পদ্ধতি সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালায় উপনীত হয়নি।
ত্রয়োদশ শতক থেকে যখন ইউরোপে পার্লামেন্ট পদ্ধতির উদ্ভব হয় তখন প্রত্যেক কাউন্ট্রি থেকে দুইজন
নাইট হাউজ অব কমন্সে প্রতিনিধিত্ব করতো। আর বরো (ইড়ৎড়ঁময) বা কান্ট্রি বহির্ভূত নির্বাচনী
এলাকা থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন এবং কমন্স সভায় প্রেরণের বিষয়টি রাজা নির্ধারণ করে দিতেন।
আঠারো শতকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব এবং সামাজিক জনবিন্যাসে পরিবর্তনের ফলে অনেক বরো
(ইড়ৎড়ঁময) জনশূন্য হয়ে পড়ে। আবার জমিদারদের বেশ কিছু পকেট বারো ছিল। কিন্তু বরোর হিসাব
অনুযায়ী জমিদার বা রাজার আদেশে বরো থেকে প্রতিনিধি কমন্স সভায় আসন গ্রহণ করতো। অন্যদিকে
দ্রæত শিল্পায়ন ও বিকশিত জনসংখ্যা সমৃদ্ধ শহরগুলি থেকে কমন্স সভায় কোনো প্রতিনিধি নির্বাচনের
সুযোগ ছিল না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে ম্যানচেস্টার শহরের
জনসংখ্যা ছিল ৮৫০০০ এবং বার্মিংহামের জনসংখ্যা ছিল ১৩৩০০০। অথচ কমন্স সভায় তাদের
কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। আবার সকল শহরে ভোটাধিকারের নিয়ম একই রকম ছিল না। বিভিন্ন
বরোর বিভিন্ন ভোটাধিকার ছিল। এই সকল ক্ষেত্রে ভোটাধিকার সীমিত করার একটি অন্যতম কারণ
ছিল গুটিকয়েক পরিবারের মধ্যে কমন্স সভার সদস্যদের সীমাবদ্ধ রাখা এবং সদস্যের বিষয়টি
বংশানুক্রমিক করা। আর এই সীমিত ভোটাধিকারের কারণে ঘুষ প্রথা, প্রচুর নির্বাচনী খরচ একটি
নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়।
ভোটাধিকার পদ্ধতি পরিবর্তন ও পার্লামেন্টারি সংস্কার আন্দোলন
ঊনিশ শতকের পূর্বেই বৃটেনে ভোটাধিকার পদ্ধতি ও পার্লামেন্টের সংস্কারের জন্য আন্দোলন দানা বেঁধে
উঠে। ১৭৮০ সালে ‘সোসাইটি অব ফ্রে›ন্ডস অব দ্যা পিপল’ নামের একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে।
পরবর্তীকালের প্রধানমন্ত্রী লর্ড গ্রে ছিলেন এই সংস্থার শক্তিশালী নেতা। এই সংগঠন বৃটেনে জনসংখ্যার
অনুপাতে ভোটাধিকার আন্দোলন গড়ে তোলে। অবশ্য রক্ষণশীল সমাজে বিশেষত সমাজের ধনাঢ্য

বিত্তশালীদের প্রবল বিরোধিতার মুখে এই আন্দোলন বহুদূর অগ্রসর হতে পারেনি। ১৭৮৫ সালে
বৃটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কনিষ্ঠ পিট কমন্স সভায় ভোটাধিকার বিষয়ে একটি সংস্কার বিল উত্থাপন
করেন। এই বিলে অকার্যকর ও জনসংখ্যাবিহীন বরো অর্থাৎ রটন বরোগুলিকে বিলুপ্ত করে দেয়ার প্রস্তাব
করা হয়। কিন্তু রাজার বিরোধিতার কারণে এই সংস্কার বিল পাশ হয়নি। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব
সাময়িকভাবে বৃটেনের রাজনৈতিক আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেয়। ইংরেজ রাজশক্তির বিপ্লব ভীতিই
ছিল এর প্রধান কারণ। কিন্তু নেপোলিয়নীয় যুদ্ধের কারণে পার্লামেন্টারি সংস্কারের দাবি জোরালো হয়ে
ওঠে। ১৮২০ সাল নাগাদ এই দাবি জনপ্রিয় দাবিতে পরিণত হয়। এই সময় পার্লামেন্টারি সংস্কারকে
প্রধান কর্মসূচিতে রেখে গড়ে উঠে বার্মিংহাম পলিটিক্যাল ইউনিয়ন। ১৮৩০ সালের ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লব
বৃটেনে ভোটাধিকার আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ১৮৩০ সালের জুন মাসে বৃটেনের রাজা
চতুর্থ জর্জ মৃত্যুবরণ করেন এবং তার ভাই ডিউক অব ক্লারেন্স চতুর্থ উইলিয়াম নামধারণ করে বৃটিশ
সিংহাসনে আরোহন করেন।
এর পরপরই অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে লর্ড গ্রে প্রধানমন্ত্রী হন। লর্ড গ্রের মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন
লর্ড পামারষ্টোন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন লর্ড মেলবোর্ন। এই মন্ত্রিসভা বৃটেনে ভোটাধিকার সংস্কার
পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
১৮৩২ সালের সংস্কার বিল
বৃটেনের ভোটাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে ১৮৩২ সালের সংস্কার বিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
প্রধানমন্ত্রী লর্ড গ্রের নির্দেশে লর্ড জন রাসেল এই ভোটাধিকার বিল প্রণয়ন ও পেশ করেন। এই বিলের
মূল বিষয়াবলী ছিল নি¤œরূপ :
(ক) সকল জনসংখ্যাবিহীন বরো অর্থাৎ রটন বরো ও পকেট বরোর বিলুপ্তি;
(খ) ১০ পাউন্ড ভাড়া প্রদানকারী সকল ভাড়াটিয়াদের ভোটাধিকার প্রদান;
(গ) একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার বিষয়টি বাতিল;
(ঘ) প্রাপ্ত ১৬০টি আসন দেশের বড় বড় শহর ও কান্ট্রির মধ্যে বিতরণ;
(ঙ) বছরে ৫০ পাউন্ড খাজনা প্রদানকারী প্রজাদের ভোটাধিকার প্রদান।
এই সংস্কার বিলে দুই হাজারের কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত অন্তত ৫৬টি বারোর পার্লামেন্টে প্রতিনিধি
প্রেরণ বন্ধ হয়ে যায়। ইতিপূর্বে এই বরোগুলি থেকে দুইজন করে প্রতিনিধি প্রেরিত হতো। আরও ৩০টি
বরো থেকে একজন করে প্রতিনিধি পার্লামেন্টে পাঠানোর সিদ্ধান্তগৃহীত হয়। প্রত্যেকটিতে চার হাজার
জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই বরোসমূহ এই সংস্কার বিলের পূর্বে দুজন করে প্রতিনিধি পার্লামেন্টে প্রেরণ
করতো। ১৮৩২ সালের এই সংস্কার আইনে মোট ৪,৫৫০০০ নতুন ভোটার তালিকাভুক্ত হয়।
চার্টিস্ট আন্দোলন : ১৮৩৮-১৮৪৮
১৮৩২ সালের সংস্কার বিলের পর ১৮৩৮ সালে পুনরায় ভোটাধিকার আন্দোলন শুরু হয়। এই
আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করে কর্মজীবী সমিতি (ডড়ৎশরহম সবহ’ং ধংংড়পরধঃরড়হ) নামের একটি সংস্থা।
এই সংগঠন ১৮৩৮ সালের ৮ মে তারিখে ৬ দফা দাবি সম্বলিত একটি দি পিপল চার্টার প্রকাশ করে।
এই দাবি সমূহের ভিত্তিতে বৃটেনে যে জনপ্রিয় আন্দোলন পরিচালিত হয় এটাকে চার্টিস্ট আন্দোলন নামে
অভিহিত করা হয়। এই আন্দোলনের দাবিসমূহের মধ্যে প্রধান ছিল ভোটাধিকার স¤প্রসারণ করা।
বৃটেনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে সৃষ্ট এই চার্টিস্ট আন্দোলনের প্রতি
সমাজের অবহেলিত বিশেষত শ্রমিক শ্রেণীর স্বত:স্ফূর্ত সমর্থন ছিল। শিল্প বিপ্লবের পটভূমিতে উনিশ
শতকের প্রথমার্ধে বৃটেনে পুঁজির প্রবল স্ফীতি ঘটে। মালিক ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি
হয়। শ্রমিক অসন্তোষ বৃটেনের নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। এই সামাজিক অস্থিরতার পর্যায়ে
১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কর্মজীবী সমিতি। এই সমিতির নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন ফেরারগাস,

কোনার, উইলিয়াম লভেট, ফ্রান্সিস প্লেস প্রমুখ। ১৮৩৮ সালের ৮ মে তারিখে ঘোষিত তাদের ছয়টি
মূল দাবি ছিল :
১. প্রাপ্ত বয়স্ক সকল নাগরিকের ভোটাধিকার;
২. সমগ্র বৃটেনে সমান নির্বাচনী জেলা প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ প্রতিটি নির্বাচনী জেলার সীমানা সমসংখ্যক
ভোটারের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা;
৩. ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান পদ্ধতির প্রচলন করা;
৪. পার্লামেন্ট সদস্যদের নিয়মিত ভাতা প্রদান করা;
৫. বাৎসরিক পার্লামেন্টের অধিবেশন অনুষ্ঠান;
৬. পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার জন্য সম্পত্তি সম্পর্কিত যোগ্যতার বিলুপ্তি।
চার্টিস্ট আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনকে বেগবান ও সফল করার জন্য চার্টারের সমর্থক
জনগণের স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে। ১৮৩৯ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে লন্ডনে
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এক জাতীয় সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে চার্টিস্ট আন্দোলনের কার্যক্রম শুরু হয়। এই
বছরের জুন মাসে এক লাখ বিশ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদন পত্র পার্লামেন্টে পেশ
করা হয়। কিন্তু কমন্স সভা এই দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করে। এই আন্দোলনের নেতাদের গ্রেফতার
করা হয়। ফলে আন্দোলন সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৮৪২ সালে পুনরায় তিন লাখ মানুষের
স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদন পত্র কমন্স সভায় পেশ করা হয়। কিন্তু কমন্স সভা এটাকে প্রত্যাখ্যান
করে। ১৮৪৮ সালে চার্টার আন্দোলনের চূড়ান্তপর্ব সূচিত হয়। এখানে প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে ১৮৪৮
সালে ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই বিপ্লবের প্রচন্ড ঢেউ এসে লাগে
ইংল্যান্ডে। ইউরোপের জনগণের আন্দোলন বৃটেনের ভোটাধিকার আন্দোলন এবং একইসঙ্গে শ্রমিক
শ্রেণীর আন্দোলনকে প্রভাবিত করে। নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে চার্টিস্টরা আন্দোলন গড়ে তোলে।
এই বছর চার্টার এর ছয়টি দাবি সম্বলিত একটি আবেদন পত্র ছয় লাখ মানুষের স্বাক্ষরসহ কমন্স সভায়
পেশ করা হয়। কিন্তু প্রতিকুল আবহাওয়ার কারণে তাদের আন্দোলন ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়।
চার্টিস্ট আন্দোলন আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও এই আন্দোলনের ফলাফল হয়েছিল অত্যন্তসুদূরপ্রসারী।
এই আন্দোলনের দাবিসমূহ ছিল বাস্তব। এই দাবিসমূহের প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল স্বত:স্ফূর্ত। পরবর্তী
ছয় দশক সময়কালের মধ্যে চার্টিস্টদের এই দাবিগুলি বাস্তবায়ন করা হয়।
১৮৬৭ সালের ভোটাধিকার আইন
চার্টিস্ট আন্দোলনের পর বৃটেনের ভোটাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে ১৮৬৭ সালের ভোটাধিকার
আইন একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ১৮৬৭ সালে সংসদ নেতা ডিজরেলি ভোটাধিকার বিষয়ে একটি
সংস্কার বিল সংসদে উত্থাপন করেন। কমন্স সভার রক্ষণশিল সদস্যরা এই বিলের বিরোধিতা করলেও
উদারপন্থীদের সমর্থনে বিলটি পাশ হয়। এই বিলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো :
(ক) এই আইন বরোতে রেন্ট প্রদানকারী এক বছর ধরে বসবাসকারী বাসগৃহের মালিককে ভোটাধিকার
প্রদান করে;
(খ) এই আইন শহরাঞ্চলে দশ পাউন্ড ভাড়া প্রদানকারী ভাড়াটিয়াকে ভোটাধিকার প্রদান করে।
(গ) এই আইনের দ্বারা ১৮৩২ সালের আইনের অধীনে ৫০ পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তির মালিকানার
ভোটাধিকারের যোগ্যতা ১২ পাউন্ড সম্পত্তির মূল্যে হ্রাস করা হয়।
(ঘ) এই আইনের ভিত্তিতে পার্লামেন্টের আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়। স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের
সংস্কার আইনকে ১৮৬৭ সালের আইনের সাথে সমন্বিত করে ২ সদস্যের ৬টি বরো এবং ১

সদস্যের ৫টি বরোর সদস্যপদ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়। আরও ৩৫টি বরোকে ১ জন করে
সদস্যপদ কমিয়ে দেয়া হয়।
১৮৬৭ সালের সংস্কার আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হলো মোট ভোটার সংখ্যা বৃদ্ধি। বিশেষত
শহর অঞ্চলে শ্রমিকরা ভোটাধিকার লাভ করে। অকার্যকর এবং কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত বরোসমূহের
পার্লামেন্ট সদস্যপদ বিলুপ্তি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এই আইনের নেতিবাচক দিক হলো কৃষি
শ্রমিকেরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে।
ব্যালট আইন : ১৮৭২
বৃটেনে ১৮৩২ সালের সংস্কার আইন এবং ১৮৬৭ সালের সংস্কার আইন ভোটারের সংখ্যা বৃদ্ধি করলেও
নির্বাচন পদ্ধতিতে এটা ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর মূল কারণ ছিল বৃটেনে প্রকাশ্যে ভোটদান
পদ্ধতি প্রথা। তখনকার রীতি অনুযায়ী ভোটারকে প্রকাশ্যে ভোট প্রদান করতে হতো। ফলে ভোটারের
রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা গোপনীয় থাকতো না। এইক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল খামার
মালিক, জমিদার, মিল মালিক, কারখানার মালিক কিংবা শিল্পপতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করা
তাদের অধীনস্থদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে ভোট প্রদানে ছিল না স্বাধীনতা কিংবা কোনো দলের
প্রতি আনুগত্য স্বীকারের ব্যক্তিগত অধিকার। তাই নতুন ভোটারদের কাছে ভোটদান একটা প্রহসনে
পরিণত হয়েছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোটাররা ইচ্ছার বিরুদ্ধে মালিককে জয়ী করার জন্যই ভোট দিত।
এই অবস্থায় সাধারণ ভোটারদের ভেতরে একটা অসন্তোষ চলতে থাকে। ভোট দান পদ্ধতি নির্ধারণের
জন্য ১৮৬৯ সালে একটি রয়্যাল কমিশন গঠিত হয়। কমিশন ভোটদানের সামগ্রিক পদ্ধতি পর্যালোচনা
করে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদানের পক্ষে সুপারিশ করে। এই সুপারিশের ভিত্তিতে ১৮৭২
সালে ব্যালট এ্যাক্ট প্রবর্তিত হয়। তখন থেকে বৃটেনের পার্লামেন্টে নির্বাচনে গোপন ব্যালেটের মাধ্যমে
ভোট প্রদান পদ্ধতির প্রচলন হয়। এই পদ্ধতি বৃটেনের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্মাণে এক ব্যাপক
ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
ভোটাধিকার সংস্কার আইন : ১৮৮৪
১৮৭০ সালের পর থেকে বৃটিশ সরকারের গৃহীত শিক্ষানীতির ফলে বৃটেনে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পায়। এই
শিক্ষা বিস্তার না হওয়ার বিষয়টি ছিল ভোটাধিকার বি¯তৃতির পথে প্রধান অন্তরায়। বৃটেনের রক্ষণশীল
সমাজ ভোটাধিকার বি¯তৃতির বিপক্ষে এই বিষয়টিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতো। ১৮৮০ সালে
বৃটেনে নির্বাচনের সময় গøাডস্টোন কৃষি শ্রমিকদেরকে ভোটাধিকার দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন।
১৮৮৪ সালে গদ্বাডস্টোন কৃষি শ্রমিকদেরকে ভোটাধিকার প্রদানের বিল উত্থাপন করেন। পার্লামেন্টের
রক্ষনশীল সদস্যরা এই বিলের বিরোধিতা করলেও রানীর মধ্যস্থতায় এই বিল পাশ হয়ে যায়। এই
সংস্কার বিল অনুযায়ী সকল বাসগৃহের মালিককে এবং দশ পাউন্ড ভাড়া প্রদানকারী ভাড়াটিয়াদেরকে
ভোটাধিকার প্রদান করে। এই বিলে প্রাপ্ত বয়স্ক কৃষি শ্রমিকেরা ভোটাধিকার পায়। বৃটেনে ভোটাধিকার
বি¯তৃতির ক্ষেত্রে ১৮৮৪ সালের ভোটাধিকার আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই বিলের ফলে
বৃটেনে ভোটারের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়।
পার্লামেন্টের আসন পুনর্বিন্যাস আইন : ১৮৮৫
বৃটেনে ভোটাধিকার বি¯তৃতির ক্ষেত্রে ১৮৮৫ সালের পার্লামেন্টের আসন পুনর্বিন্যাস আইন একটি
উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এই আইন বৃটেনের ভোটাধিকার বি¯তৃতির ধারাকে শক্তিশালী করে। ১৮৮৫
সালে এই আসন পুনর্বিন্যাস আইন পাশ হয়। এই আইনে ১৫,০০০ হাজার জনসংখ্যার কম অধ্যুষিত
শহরগুলি থেকে পার্লামেন্টে প্রতিনিধি পাঠানো বাতিল ঘোষণা করা হয়। ১৫,০০০ থেকে ৫০,০০০
জনসংখ্যা অধ্যুষিত শহরগুলি থেকে একজন করে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচনের বিধান করে দেয়া হয়।
আর ২ জন করে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত করার অধিকার প্রদান করা হয় ৫০,০০০ থেকে

১,৬৫,০০০ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ২৮টি শহরকে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া সারা বৃটেনে বরো ও
কাউন্ট্রিকে একত্রিত করে এক সদস্যের নির্বাচনী এলাকায় পরিণত করা হয়। এই পুনর্বিন্যাস আইন
বাস্তবায়নের ফলে বৃটেনে কমন্স সভার সদস্য সংখ্যা ৬৭০ জনে উন্নীত হয়। সারা দেশ থেকে
পার্লামেন্টে প্রতিনিধি পাঠানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বৃটেনে শ্রমিক দলের জন্ম
বৃটেনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হলো শ্রমিক দলের জন্ম। শিল্প বিপ্লবোত্তর বৃটেনে
শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পরিচালিত হয়। ১৭৯৯ সালে পিট শ্রমিকদের
অধিকার সম্পর্কিত একটি আইন পাশ করেন। এই আইনে মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ
হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। পরের বছর অর্থাৎ ১৮০০ সালে অপর একটি আইনে কারখানার
মালিকদেরকে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক কম দেয়ার নিমিত্তে সংঘবদ্ধ হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত
হয়। এই দুটি আইনকে একত্রে কোমবিনেশন আইন নামে অভিহিত করা হয়। অবশ্য মালিক শ্রমিকের
মাঝে সম্পর্কের ব্যাপক অবনতির মুখে ১৮২৪ সালে এই আইন বাতিল করা হয়। এই আইন বাতিলের
সাথে সাথে শ্রমিকদের ধর্মঘট বৃদ্ধি পায়। প্রচুর সম্পদের অধিকারী মিল মালিকেরা শ্রমিক ধর্মঘটের ভয়ে
তাদের কারখানা বন্ধ করে দেয়। ফলে অর্থের অভাবে শ্রমিকেরা অনাহারে নিপতিত হয় এবং সমাজে
বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে বৃটিশ পার্লামেন্ট ১৮২৫ সালে একটি আইন পাশ করে বৃটেনে
ট্রেড ইউনিয়নকে আইন সম্মত করে দেয়। কিন্তু একইসঙ্গে এই আইন কারখানায় বা শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক
ধর্মঘট নিষিদ্ধ করে দেয়। পরবর্তী ১৮৭৬ সালে একটি আইনের দ্বারা ট্রেড ইউনিয়নের ধর্মঘট কিংবা
শ্রমিকদের কাজে না যাওয়ার বিষয়টি তাদের অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়। বস্তুত তখন থেকেই বৃটেনে
ট্রেড ইউনিয়ন আইন সম্মত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
উনিশ শতকের সত্তরের দশকে জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কসের (১৮১৮-১৮৮৩) কালজয়ী দর্শন, সমাজ
পরিবর্তনের তত্ত¡, শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের দিক নির্দেশনা প্রভৃতি বিষয় বৃটেনের শ্রমিক
সমাজকে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করে। ফলে শ্রমিক শ্রেণী রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি আগ্রহী হয়ে
উঠে। ১৮৭৪ সালের বৃটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে মোট তের জন শ্রমিক নেতা ও শ্রমিক পার্লামেন্ট
নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। এদের মধ্যে দুজন নির্বাচিত হন। এরা হলেন টমাস বাট এবং
আলেকজান্ডার ম্যাকডোনাল্ড। এটা বৃটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মূলত তখন
থেকে এখানকার রাজনীতিতে বিশেষত পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে শ্রমিক শ্রেণীর বিচরণ শুরু হয়। কিন্তু
তখনো পর্যন্তশ্রমিক শ্রেণীর কোনো রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। ১৮৯২ সালে সমাজতন্ত্রের আদর্শে
বিশ্বাসী কের হার্ডি নামের একজন শ্রমিক পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৮৯৩ সালে স্বাধীন
শ্রমিক দল নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি ছিলেন এই দলের সভাপতি। ১৮৯৯ সালে
স্বাধীন শ্রমিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস এবং অন্যান্য সংগঠনের নেতারা একত্রে মিলিত হয়ে একটি
লেবার রিপ্রেজেনটেশন কমিটি গঠন করে। এই কমিটির আহŸবায়ক ছিলেন ম্যাকডোনাল্ড। এই কমিটির
দায়িত্ব ছিল সঠিক কর্মসূচি প্রণয়ন করে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা। ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়
বৃটিশ লেবার পার্টি।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১. উনিশ শতকের প্রথম দিকে ম্যাঞ্চেস্টার শহরের জনসংখ্যা ছিল
ক. ৬০,০০০ খ. ৭০,০০০
গ. ৮৫,০০০ ঘ. ৯০,০০০
২. ১৮২০ সালের দিকে পার্লামেন্টারি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে
ক. লন্ডন শ্রমিক ইউনিয়ন খ. ওয়েলস পলিটিক্যাল ইউনিয়ন
গ. বার্মিংহাম পলিটিক্যাল ইউনিয়ন ঘ. লন্ডন ক্লাব
৩. ৬ দফা কর্মসূচি পেশ করে
ক. কর্মজীবী সমিতি খ. বণিক সমিতি
গ. শিল্প মালিক সমিতি ঘ. লন্ডন মহিলা সমিতি
৪. ১৮৬৭ সালে বৃটেনের সংসদ নেতা ছিলেন
ক. পামারস্টোন খ. ডিজরেলি
গ. চার্চিল ঘ. এডওয়ার্ড হিথ
৫. বৃটেনে শ্রমিক দলের জন্ম হয়
ক. ১৮৯৮ সালে খ. ১৮৯৯ সালে
গ. ১৯০০ সালে ঘ. ১৯০১ সালে
উত্তর : ১।গ ২।গ ৩।ক ৪।খ ৫।গ
রচনামূলক প্রশ্ন
১. ১৮৩২ সালের সংস্কার বিল সম্পর্কে আলোচনা করুন
২. চার্টিস্ট আন্দোলনের বিবরণ দিন।
৩. ১৮৬৭ সালের ভোটাধিকার আইন ব্যাখ্যা করুন।
৪. বৃটেনে শ্রমিক দলের উৎপত্তির ইতিহাস আলোচনা করুন।
৫. পার্লামেন্ট আসনের পুনর্বিন্যাস আইনের বিবরণ দিন।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. ফ্রেন্ডস অব দি সোসাইটি অব দি পিপল কখন গঠিত হয়?
২. বরো বলতে কি বুঝায়?
৩. চার্টিস্ট আন্দোলনের ছয়টি মূল দাবি কি ছিল?
৪. ব্যালট আইনের মূল বক্তব্য কি ছিল?
৫. বৃটেনের কৃষি শ্রমিকেরা কখন ভোটাধিকার পায়?
৬. ১৮৮৫ সালের আসন পুনর্বিন্যাস আইনে কমন্স সভার সদস্য সংখ্যা কতজন ছিল?

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]