নেপোলিয়নের সংস্কার সমূহ

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট নিজের সম্পর্কে বলেছেন "Work is my element. I am born and built for work. I have known the limits of my legs. I have known the limits of my eyes. I have never known the limits of my work" একটি সাধারণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে নেপোলিয়ন
বোনাপার্ট নিজ কর্মদক্ষতার মাধ্যমে ফ্রান্সের সেনাবাহিনাীর উর্ধ্ব পদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম
হন। ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব অবসানের পর ভাইরেক্টরি শাসনের অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির ফলে ফ্রান্সের
জনগণ ডাইরেক্টরি শাসন ব্যবস্থার প্রতি যখন বীতশ্রদ্ধ ঠিক তখন নেপোলিয়নের ইতালি থেকে
প্রত্যাবর্তনকে ফরাসি জনগণ স্বাগত জানায়। নেপোলিয়ন ফ্রান্সবাসীর মনের দাবি বুঝতে পারেন এবং
কতিপয় ডাইরেক্টরের সহায়তায় এ শাসনের পতন ঘটিয়ে নিজে শাসন ভার গ্রহণের সিদ্ধান্তনেন। এ
জন্য তিনি এ্যাবে সিয়েসের উপর একটি নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব অর্পণ করেন যা কনস্যুলেটের
সংবিধান নামে পরিচিত। সংবিধান অনুসারে দশ বছরের জন্য তিন জন কনস্যাল নিয়োগ করা হয়।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট প্রথম কনস্যাল হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। কার্যত প্রথম কনস্যালই ছিলেন
সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ১৮০২ সালে কনসুলেটের সংবিধান সংশোধন করে নেরপোলিয়ন আজীবন
কনসালের ক্ষমতা পান। নেপোলিয়ন সিনেটের সভাপতির পদ লাভ করেন। এছাড়া তাদের
উত্তরাধিকারী মনোয়নেরও অধিকার পান। ১৮০৪ সালে সিনেটের ঘোষণাক্রমে নেপোলিয়ন
বংশানুক্রমিক সম্রাটে পরিণত হন। নেপোলিয়ন ফ্রান্সে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ফ্রান্সের প্রাচীন
ঘুনে ধরা সমাজকে নতুন রূপ দানের মানসে সংস্কার কাজে হাত দেন। ফলে অল্পকালের মধ্যে ফ্রান্সে
দৈনন্দিন জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ফিরে আসে। নি¤েœনেপোলিয়নের সংস্কার সমূহ আলোচনা
করা হল।
১) প্রশাসন কেন্দ্রীয়করণ নীতি
নেপোলিয়ন প্রথম কনস্যাল পদে নিয়োগ লাভের পর প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের
কাজে হাত দেন। তিনি তার শাসন সংস্কারের কাজ শুরু করার জন্য প্রধানত ঈড়ঁহপরষ ড়ভ ঝঃধঃব এর
উপর নির্ভর করেন। তিনি প্রশাসনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের মনোনয়ন দানের মাধ্যমে
ঈড়ঁহপরষ গঠন করেন। দক্ষ প্রশাসক জোগাড় করাই তার লক্ষ্য ছিল। ঈড়ঁহপরষ এর অভিজ্ঞ সদস্যদের
তিনি দায়িত্ব দেন এবং এদের স্বৈর শাসন দৃঢ় করেন।
এর পর নেপোলিয়ন প্রদেশের উপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করে জাতীয় ঐক্য ও কেন্দ্রীয়কভূতকরণ
নীতিকে প্রসারিত করার জন্য কতকগুলি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথমত, ১৭৮৯ সালে সংবিধান সভার
সিদ্ধান্ত অনুসারে বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রদেশে ও জেলায় কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়। নেপোলিয়ন
কেন্দ্রীয়ভূতকরণ চালু করে প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন করেন। প্রদেশ ও জেলার শাসনকর্তা প্রিফেক্ট
ও সাব প্রিফেক্ট এবং পৌর সভার মেয়র নিয়োগের অধিকার তিনি নিজ হাতে নেন। পূর্বে এই শাসন



কর্তারা স্থানীয় ভোটে নির্বাচিত হতেন। নেপোলিয়ন নির্বাচনের পরিবর্তে মনোনয়নকে প্রাধান্য দেন।
স্থানীয় নির্বাচিত প্রাদেশিক সভাগুলিকে বিলোপ না করা হলেও প্রদেশ শাসনে এই সভার ক্ষমতা সীমিত
রাখেন।
দ্বিতীয়ত, এখন থেকে ডিপার্টমেন্ট বা প্রদেশগুলির যাবতীয় ক্ষমতা প্রথম কনস্যাল দ্বারা নিযুক্ত
প্রিফেক্টদের হাতে রাখা হয়। স্থানীয় সভাগুলিকে বছরে মাত্র পনের দিনের অধিবেশনের সুযোগ দেওয়া
হয়। গ্রাম ও শহরের উপর ধার্যকৃত রাজস্বের হার এই সভা অনুমোদন করত।
নেপোলিয়ন প্রিফেক্টদের নিয়োগের সময় যোগ্যতাকে একমাত্র মাপকাঠি ধার্য করেন। ফলে যোগ্যতার
জোরে জ্যোকোবিন অথবা রাজতন্ত্রীরাও এই পদ পায়। ক্রমে তারা নেপোলিয়নের প্রতি অনুগত থাকে।
তৃতীয়ত, প্রিফেক্টের অধীনে উপ-প্রিফেক্টরা কাজ করত। এরাও প্রথম কনস্যাল দ্বারা নিযুক্ত হত।
প্রিফেক্ট প্রথার মাধ্যমে নেপোলিয়ন প্রাদেশিক শাসনকে কেন্দ্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনেন। এদিক থেকে
তার এ শাসন সংস্কারকে বিপ্লবের বিকেন্দ্রীয়করণ আদর্শের বিরোধী এবং রাজতান্ত্রিক যুগের অনুসারী
বলা চলে। নির্বাচনের মাধ্যমে সকল শ্রেণীর সরকারি কর্মচারী নিয়োগ প্রথা বাতিল করে প্রথম
কনস্যাল দ্বারা তাদের নিযুক্তি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
অর্থনৈতিক রাজস্ব সংস্কার
ষোড়শ লুইয়ের আমল থেকে ফান্সের অর্থ ব্যবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। নেপোলিয়ন শুরুতে একটি
দৃঢ় অর্থ ব্যবস্থা গড়ার কাজে হাত দেন এবং অর্থ ও রাজস্ব সংস্কারের জন্য নি¤েœাক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ
করেন :
ক. নেপোলিয়ন সরকারি দপ্তর গুলিতে ব্যয় সংকোচনের নির্দেশ দেন। তিনি স্বয়ং সরকারি বাজেট
পরীক্ষা করে বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেন;
খ. তিনি অর্থ দপ্তরকে দুই ভাগ করে রাজস্ব দপ্তর ও অডিট দপ্তর গঠন করেন। অডিট বিভাগ সরকারি
ব্যয়ের হিসাব পুংখানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করত। নেপোলিয়ন নিজে অডিট রিপোর্টগুলি পাঠ
করতেন এবং কোনো দপ্তরের ব্যয় সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে সে দপ্তরকে সতর্ক করে দিতেন;
গ. নেপোলিয়ন ফরাসি জনসাধারণকে বুঝিয়ে দেন যে, সরকারকে কর প্রদান নাগরিকের কর্তব্য।
তিনি সকল প্রকার বাড়তি কর রহিত করে কয়েকটি নির্দিষ্ট কর আদায়ের ব্যবস্থা করেন। তিনি
প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে পরোক্ষ করের প্রতি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং নিয়ম করেন যে
প্রাদেশিক সভাগুলির পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীরাই একমাত্র সরকারি কর আদায়
করতে পারবে। নিয়মিত কর আদায় এবং ব্যয় সংকোচনের ফলে সরকারি অর্থ -সংকট দূর হয়,
ঘ. নেপোলিয়ন ১৮০০ সালে ইধহশ ড়ভ ঋৎধহপব স্থাপন করেন। এর সাহায্যে মুদ্রা ব্যবস্থা সংগঠন ও
ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি সাধন করেন। এ ব্যাংক বার্ষিক ৬% অর্থ ঋণ প্রদান সহ নোট
ছাপানোরও অধিকার পায়। তিনি ধাতব মুদ্রার প্রচলন করেন। নেপোলিয়নের অর্থনৈতিক
সংস্কারের ফলে ফ্রান্সে কৃষি ও শিল্পের উন্নতি ঘটে। দৈনন্দিন ব্যবহৃত জিনিস পত্রের মূল্য হ্্রাস
পাওয়ার ফলে জনমনে স্বস্তিফিরে আসে। নেপোলিয়ন ফ্রান্সে নিজ নামে স্বর্ণ মুদ্রা প্রচলন করেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্তউপুর্যপরি যুদ্ধের চাপে তাঁর সৃষ্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
আইন সংস্কার
নেপোলিয়নের অন্যতম প্রধান সংস্কার হচ্ছে ফ্রান্সে আইন সংস্কার যা ঈড়ফব ঘবঢ়ড়ষরড়হ নামে খ্যাত।
বিপ্লবের পর ফান্সে বহু নতুন আইন পাশ হয়। আবার পূর্ববর্তী সরকারের অনেক আইনও বহাল
ছিল। তাছাড়া প্রতি প্রদেশে প্রথাগত আইন বলবৎ ছিল । উপরন্তছিল গির্জার আইন। এই সব
আইনের মধ্যে কেনো সামঞ্জস্য ছিল না। পূর্বের নাগরিক ও সম্পত্তির অধিকার এবং বিপ্লবের যুগে
এ সম্পর্কিত আইনের কোনো মিল ছিলনা । এই অবস্থায় বিচারক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত


নিতে সমস্যা দেখা দিত। নেপোলিয়ন স্থির করেন যে, বিপ্লবের অন্যতম মূল আদর্শ সামাজিক সাম্য বা
ঝড়পরধষ ঊয়ঁধষরঃু কে স্বীকার করে ফ্রান্সে নতুন সমাজ গঠনের জন্য আইনগুলি সংকলন ও
পরিমার্জন করা দরকার। এই উদ্দেশ্যে তিনি আইনজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন।
নেপোলিয়ন নিজে এই কমিটির ৩৬ টি সভায় যোগ দিয়ে আইনবিধি সম্পর্কিত আলোচনায় অংশ
নেন। আইনজ্ঞরা উৎসাহিত হতেন এবং এতে কোড গঠনের অহেতুক বিলম্ব পরিহার করা সম্ভব হয়।
মোট ৮৪ টি অধিবেশনে এই আইন বিধির মূল সূত্রগুলো স্থির করা হয়। এই আইন বিধির সর্বাপেক্ষা
উল্লেখযোগ্য যুক্তিবাদী প্রাকৃতিক আইন বিধির সাথে ফান্সের প্রথাগত এবং বিপ্লবী যুগের আইন
বিধির সমন্বয় সাধন করা হয়। উপরন্তু রোমান আইন বিধি যা প্রধানত রাজতান্ত্রিক যুগে প্রচলিত ছিল
তার তত্তে¡র সঙ্গে বিপ্লবী যুগের আইনের সমন্বয় করা হয়। ফলে রোমান আইনের সম্পত্তির অধিকার ও
রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের অধিকারের সঙ্গে বিপ্লবী যুগের সামাাজিক সাম্য ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নীতি
গৃহীত হয়।
৪) কোড নেপোলিয়ন
কোড নেপোলিয়নর প্রায় ২২৮০টি ধারা এবং তা দেওয়ানি কোড, ফৌজদারি কোড এবং বাণিজ্যিক
কোর্ড এ তিন অংশে বিভক্ত ছিল। আইনের ধারাগুলি সহজ ও স্পষ্ট ভাষায় রচিত হয়। কোড
নেপোলিয়ন বিশ্লেষণ করলে নি¤েœাক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি পরিলক্ষিত হয় ঃ
দেওয়ানি আইন
ক. আইনের চোখে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়;
খ. সামাজিক সাম্য স্থাপিত হয় এবং কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের বিশেষ অধিকার বিলোপ করা হয়।
অর্থাৎ সকল নাগরিকের সমান মর্যাদা ও সুযোগ লাভের অধিকার স্বীকৃত হয়;
গ. একমাত্র যোগ্যতার ভিত্তিতে যে কোনো নাগরিকের চাকরি লাভের অধিকার স্বীকৃত হয়;
ঘ. সামন্ততন্ত্র লোপ করে নতুন ভূমিবন্দোবস্তচালু করা হয়। ফলে বিপ্লবী যুগে কৃষক ও মধ্যবিত্তরা
ভূমিতে বৈধ স্বত্ব লাভ করে। ভূমিদাস ও ম্যানর প্রভৃতি শোষণ মূলক প্রথার অবসান ঘটানো হয়।
মোট কথা বিপ্লবের সময় বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা রোধ করে যে নতুন আইন করা হয়েছিল
নেপোলিয়ন তা বহাল রাখেন ;
ঙ. বিপ্লবী যুগে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়েছিল। স্ত্রীর উপর স্বামীর স্বাভাবিক কর্তৃত্ব বিনষ্ট হয়।
কোড নেপোলিয়ন দ্বারা পুনরায় পারিবারিক শৃংখলা ফিরিয়ে আনা হয়। স্ত্রী ও সন্তানদের উপর
স্বামীর বা পিতার কর্তৃত্ব পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়। পারিবারিক বন্ধন মজবুত করার জন্য বিবাহ আইনকে
মজবুত করা হয়। সন্তানদের ভরণ-পোষণ পিতার বৈধ দায়িত্ব বলে স্বীকৃত হয়। পৈত্রিক
সম্পত্তিতে সকল বৈধ সন্তানের সমান অধিকার দেওয়া হয়;
চ. গির্জার বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তি বিপ্লবের আমলে যারা কিনে নিয়েছিল কোড নেপোলিয়নের মাধ্যমে
তাদের অধিকারকে বৈধতা দেওয়া হয়;
ছ. বিচারের ক্ষেত্রে জুরি প্রথা চালু করা হয়;
জ. রাজনৈতিক অপরাধীদের সাধারণ অপরাধী অপেক্ষা স্বতন্ত্র মর্যাদা দেওয়া হয়;
ঝ. ফৌজদারি আইন বিধি যুক্তিবাদ ও প্রাকৃতিক আইনের আলোকে সমন্বয় করা হয়। অপরাধীর প্রতি
বর্বর শাস্তিপ্রথা লোপ করা হয়। তবে আইনের বিচারে অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তির বিধান রাখা
হয়।
৫। শিক্ষা সংস্কার


নেপোলিয়ন ফ্রান্সে জাতীয় ভাবে শিক্ষা সংস্কার করেন । শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য
ছিল রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য সম্পন্ন সুনাগরিক সৃষ্টি করা। শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল রাষ্ট্রের প্রতি
আনুগত্য শিক্ষা দেওয়া। কঁদরসেত (ঈড়হফধৎংবঃ) নামক শিক্ষাবিদ শিক্ষা ব্যবস্থার যে কাঠামো তৈরি
করেন তার উপর ভিত্তি করেই নেপোলিয়ন শিক্ষা সংগঠন গড়ে তোলেন। প্রতি কমিউনে প্রিফেষ্ট বা
সাব-প্রিফেক্টের অধীনে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের প্রচেষ্টা নেয়া হয়। মাধ্যমিক ও গ্রামার
বিদ্যালয়ে ভাষা শিক্ষার নিয়ম করা হয়। শহরে কয়েকটি আদর্শ সরকরি বিদ্যালয় বা লিসে (খুপবব)
স্থাপন করা হয়। নেপোলিয়ন এই সকল বিদ্যালয়ে প্রাচীন ল্যাটিন ভাষা শিক্ষা আবশ্যিক করেন।
লিসেগুলি ছিল আধাসামরিক বিদ্যালয়, পোপের কনকর্ডাট (ঈড়হপড়ৎফধঃ) বা আপোষমূলক চুক্তির পর
গির্জায় পরিচালিত মাধ্যমিক বিদ্যালয় আবার ফিরে আসে। কাজেই নেপোলিয়নের শাসনকালে তিন
ধরনের মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল বলে জানা যায়। যেমন - ক) ন্যাশনাল কনভেনশনের আমলে
প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়, খ) লিসে বা আধাসামরিক বিদ্যালয়, যা নেপোলিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন এবং গ)
পুনপ্রতিষ্ঠিত গির্জা পরিচালিত বিদ্যালয়। নেপোলিয়ন লিসেগুলোর পিছনে বেশি টাকা প্রদান করতেন
এবং সর্বদা সুনজর রাখতেন। যাতে সকল বিদ্যালয়ে সমমানের পাঠ্যসূচি চালু হয় তিনি সেদিকেও দৃষ্টি
দেন। বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি রচনায় নেপোলিয়ন ব্যবহারিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব
আরোপ করেন। তিনি চান বিদ্যালয়ের ছাত্ররা যেন কঠোর শৃংখলাপরায়ণ, রাষ্ট্র ও জাতির প্রতি
আনুগত্য পরায়ণ ও দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হয়। লিসে গুলিতে সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদেও
সন্তানেরা অধ্যয়ন করত। ফলে এগুলো এলিট (ঊষরঃব) বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। মাধ্যমিক
বিদ্যালয়গুলিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিপ্লবী যুগে গির্জার যে সমস্ত
সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় পোপ তা মেনে নেয়। ফ্রান্সে ক্যাথলিক ধর্ম বহাল থাকবে কিন্তু তা অবশ্যই
রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ফ্রান্সে এই ধর্মকে “সংখ্যা গরিষ্ঠের ধর্ম মত’’ এই নামে সরকার স্বীকৃতি
দিবেন। ক্যাথলিকরা স্বাধীন ভাবে ধর্ম পালনের অধিকার পাবে। কিন্তু পোপের সাথে চুক্তির পরে
নেপোলিয়ন কতকগুলি আইন চালু করেন। এতে ফ্রান্সে পোপের কোনো আদেশনামা বা পোপের
কোনো প্রতিনিধি প্রেরণ সরকারি অনুমতি ছাড়া অবৈধ বিবেচিত হয়। বিশপগণ জেলার প্রিফেক্টদের
নিয়ন্ত্রণে থাকবেন। পোপের নির্দেশক্রমে রবিবার থাকবে ছুটির দিন। প্রোটেস্টান্ট ও অন্য স¤প্রদায়ের
খ্রিস্টানরাও ধর্মীয় স্বাধীনতা পাবে। তাদের স¤প্রদায়ের বিশপদের ও সরকার থেকে বেতন ভাতা প্রদান
করা হয়। নেপোলিয়নের এই আইনের বিরুদ্ধে পোপ সপ্তম পায়াস প্রতিবাদ করলেও কোনো ফল
হয়নি।
৬। ধর্ম সংস্কার
নেপোলিয়নের অন্যতম গুরুত্বপুর্ন সংস্কার ছিল ধর্ম সংস্কার যা ইতিহাসে কনকর্ড্যাট বা মীমাংসা নীতি
নামে পরিচিত। বিপ্লবী আমলে সিভিল কন্সটিটিউশন অব ক্লার্জি (ঈরারষ ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ ড়ভ ঈষবৎমু)
(১৭৯১) দ্বারা গির্জা জাতীয়করণ করে পোপের ক্ষমতা লোপ করা হয়। পোপ এই ব্যবস্থা মেনে
নেননি। এ জন্য বিপ্লবী ফ্রান্সের সঙ্গে তাঁর স্থায়ী বিরোধ দেখা দেয়। ধর্ম বিশ্বাসী ফরাসি ক্যাথালিকরা
ঈরারষ পড়হংঃরঃঁঃরড়হ ড়ভ ঃযব পষবৎমু মেনে নিতে আপত্তি জানায়। নেপোলিয়ন বিপ্লবী ফ্রান্সে জাতীয়
গির্জা নীতির সঙ্গে পোপের দাবির সামঞ্জস্য করে মীমাংসা করেন। ১৮০১ সালে এই মীমাংসা নীতি
দ্বারা স্থির হয় যে ফরাসি গির্জার যাজকেরা রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত হবার পর পোপ এই নিয়োগ অনুমোদন
করবেন, অর্থাৎ কন্সটিটিউশন দ্বারা নিযুক্ত বিশপদের পোপ মেনে নেবেন। বাকি বিশপদের ক্ষেত্রে
কনস্যাল নিয়োগ করলেও চূড়ান্তনিয়োগ পোপ করবেন এবং যাজকগণ রাষ্ট্রের নিকট থেকে বেতন
ভাতা পাবেন।
৭। বাণিজ্য আইন


ব্যবসা-বাণিজ্য সুনিয়ন্ত্রিত করার জন্য বাণিজ্য সংক্রান্তকতগুলি আইন বিধিবদ্ধ করা হয়। বণিকদের
মধ্যে বাণিজ্য সংক্রান্তবিবাদ নিষ্পত্তির জন্য কতগুলি বাণিজ্য আদালতও স্থাপন করা হয়।
৮ । ইমিগ্রান্টদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ
নেপোলিয়ন দেশত্যাগীদের সম্পর্কে উদার নীতি গ্রহণ করেন। ১৮০২ সালে একটি প্রশাসনিক আদেশ
জারি করে তিনি দেশত্যাগী ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে সকল আইন বহাল করা হয়েছিল তা
বাতিল করেন। দেশত্যাগীরা বিদেশের সরকারগুলির সঙ্গে স্বদেশ বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থেকে
ফ্রান্সের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করায় এ উদারতা গ্রহণ করা হয়। দেশত্যাগী অধিকাংশ ছিল
অভিজাত ও বিত্তশালী শ্রেণীর। নেপোলিয়ন তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের আহবান জানান এবং তাদের
সম্পত্তি প্রত্যার্পণের আশ্বাস দেন।
৯। জনহিত কর কাজ
নেপোলিয়ন রাষ্ট্রে সেবা ও অন্যান্য যোগ্যতার পুরস্কার স্বরূপ লিজিয়ন অব অনার (খবমরড়হ ড়ভ ঐড়হড়ঁৎ)
নামে এক প্রকার উপাধি প্রবর্তন করেন। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য ১৭৮৯ সালে সংবিধান সভায়
সকল প্রকার উপাধি বা খেতাব লোপ করে। লিজিয়ন অব অনার খেতাব প্রবর্তন করেন। সম্রাট
হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর নেপোলিয়ন তার দরবার নতুন খেতাব প্রাপ্ত অভিজাতদের দ্বারা গড়ে
তোলেন এবং তিনি ফ্রান্সে বহু রাস্তঘাট ও পুল নির্মাণ করেন। ইতালির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য
আত্মস পর্বতের গিরিপথ দিয়ে দুটি রাস্তা নির্মাণ করেন। লুভ (খড়াঁড়ৎব) জাদুঘরকে তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ
জাদুঘরে পরিণত করেন। ফ্রান্সে বহু উদ্যান প্রাসাদও তিনি নির্মাণ করেন। তার সময়ে সমগ্র ফ্রান্সে কর্ম
চাঞ্চল্য ফিরে আসে।
১০ । শিল্প কলা
নানাবিধ সংস্কারের পাশাপাশি নেপোলিয়ন শিল্প কলারও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি রাষ্টীয়
প্রাসাদগুলিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনেন এবং স¤প্রসারণ করেন। তার সময়ে প্যারিস শহরের সৌন্দর্য্য
বৃদ্ধি করা হয়।
১১। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য
নেপোলিয়ন ফ্রান্সের জন্য ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এবং এই লক্ষ্যে ব্যাপক
প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন, কিন্তু ইংল্যান্ডের প্রবল নৌশক্তির মোকাবেলায় তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং
তিনি লুইজিয়ানা (খড়ঁংরধহধ) ১৮০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট বিক্রি করেন।
নেপোলিয়নের সংস্কারের বৈশিষ্ট্য
নেপোলিয়নের প্রশাসনিক ও সামাজিক সংস্কার গুলিকে পর্যালোচনা করে ঐতিহাসিক ফিসার মন্তব্য
করেছেন যে, যদিও নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য স্থায়ী হয়নি, তাঁর অসামরিক সংস্কারগুলি গ্রানাইট
প্রস্তরের উপর স্থায়ীভাবে নির্মিত হয় (ওভ ঃযব ঈড়হয়ঁবংঃং ড়ভ ঘধঢ়ড়ষবড়হ বিৎব বঢ়যবসধৎধষ, যরং
পরারষরধহ ড়িৎশ রহ ঋৎধহপব ধিং নঁরষঃ ঁঢ়ড়হ মৎধহরঃব)। নেপোলিয়নের এই সংস্কারগুলি কেবলমাত্র
ফ্রান্সের পুনরুজ্জীবন ঘটায়নি, সমগ্র ইউরোপে তা নতুন সমাজ গঠনের সূচনা করে। তাই বলা হয়
“যেখানেই নেপোলিয়নের সেনাদল গিয়েছে সেখানে আর পূর্বাবস্থা ফিরে আসেনি (ডযবৎবাব ঃযব
ঘধঢ়ড়ষরড়হরপ ধৎসু বিহঃ, ঃযরহমং বিৎব হড়ঃ ঃযব ংধসব ধমধরহ)। নেপোলিয়ন শৃংখলার সাথে স্বাধীনতা
ও সাম্যের সমন্বয় সাধন করেন ফ্রান্সে বিপ্লবী প্রজাতন্ত্র ও সন্ত্রাসের রাজত্বের সময় যে বিভীষিকাময়
মূর্তি ধারণ করেছিল নেপোলিয়ন সেই বিশাল অরাজকতা ও স্বৈরাচারকে শৃংখলায় বেধে ফেলেন। তাঁর
শাসনে ফ্রান্সে স্বস্তিও রাজনৈতিক শৃংখলা ফিরে আসে এবং বহু উন্নয়ন মূলক কাজ সম্পন্ন হয়। ডেভিড
টমসনের মতে বোনাপার্ট “ফ্রান্সকে শৃংখলার আবদ্ধ করে শান্তি স্থাপন করেন। (ইড়হধঢ়ধঃব
ফরংপরঢ়ষরহবফ ঋৎধহপব ধহফ বংঃধনষরংযবফ ড়ৎফবৎ)।


নেপোলিয়নের সংস্কারের সীমাবদ্ধতা
ফ্রান্সকে স্থায়ী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠার জন্য নেপোলিয়ন ফ্রান্সে যে সংস্কার কার্য সম্পাদন করেছিলেন তা যে
সর্বক্ষেত্রেই সফল হয়েছিল একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তার সংস্কার কার্যাবলী অনেক ক্ষেত্রে
ব্যর্থ হয়। নেপোলিয়নের সংস্কারেও যে সব ক্রটি পরিলক্ষিত হয় এখানে আলোচনা করা হল।
প্রথমত, নেপোলিয়ন প্রিফেক্ট প্রথার দ্বারা সারাদেশে প্রশাসনিক ঐক্য ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ মজবুত করেন
একথা সত্য। কিন্তু রাষ্ট্র নিরন্তর যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় প্রিফেক্টগণ জনকল্যাণমূলক কাজ অপেক্ষা যুদ্ধ প্রচেষ্টা
সফল করার জন্য ব্যস্তহয়। নেপোলিয়ন মাঝে মাঝে গণভোট নিয়ে তার ক্ষমতা দৃঢ় করতেন। এই
গণভোট যাতে প্রথম কনস্যালের অনুকূলে যায় তার জন্য প্রিফেক্টদের প্রভাব খাটাতে হত। যুদ্ধের
জন্য বাধ্যতামূলক সেনাদল সংগ্রহ, যুদ্ধের ঘোড়া সংগ্রহও তাদের করতে হত। এই কারণে
কৃষকদের উপর বহু জবরদস্তিকরা হয় । যুদ্ধ বন্দিদের দেশে আনা হলে প্রদেশের বন্দিশিবিরে
বন্দিদের দেখা শোনার কাজ প্রিফেক্টদের করতে হতো, তাছাড়া যুদ্ধের আর্থিক দায় মেটনোর জন্য
নিয়মিত কর আদায় করতে হতো। এরপরে প্রিফেক্টদের পক্ষে জনকল্যাণ মূলক কাজ করার সময়ও
লোক বলের অভাব দেখা দিত। নেপোলিয়নের স্বৈরতন্ত্রের যন্ত্র হিসাবে কাজ করতে প্রিফেক্টগণ বাধ্য
হয়।
দ্বিতীয়ত, প্রিফেক্ট ও কাউন্সিলের সদস্যদের দ্বারা নেপোলিয়ন যে আমলাতন্ত্র গড়েন তার একমাত্র
ক্ষমতার উৎস ছিল নেপোলিয়ন নিজে। প্রিফেক্টগণের স্থানীয় কোনো ভিত ছিলনা। ১৮১০ সালের,পরে
নেপোলিয়নের জীবনে যখন দুর্দিন শুরু হয় তখন প্রিফেক্টদের মধ্যে অনেকে সাবেক রাজতন্ত্রী ও
জ্যাকোবিন ছিল। প্রিফেক্টদের অনেকেই নেপোলিয়নের দুর্দিনে তাকে পরিত্যাগ করে। প্রিফেক্টদের
যদি স্থানীয় ভিত শক্ত হতো, তবে তারা সম্রাটের জন্য স্থানীয় শাসন রক্ষা করতে পারত। এই কারণে
আলফ্রেড কোব্বান মন্তব্য করেছেন ‘‘প্রিফেক্ট ব্যবস্থার সাফল্যের দিক থাকা সত্তে¡ও এই ব্যবস্থার
অত্যাধিক কেন্দ্রিয়তা ও কঠোরতার সাথে অত্যাধিক অনিশ্চয়তা জড়িত ছিল (ঞযব ঢ়ৎবভবপঃঁধষ
ঝুংঃবস, ভড়ৎ ধষষ রঃং সবৎরঃং, পড়হঃধরহবফ ঃযব ারপবং ড়ভ বীপবংংরাব ৎরমরফরঃু ধহফ বীপবংংরাব
রহংঃধনরষরঃু)।
নেপোলিয়নের কোড বা আইন বিধি ত্রæটিহীন ছিলনা। তিনি এই আইন বিধি দ্বারা পুরাতন তন্ত্রের
যুগের রোমান আইন চালু করায় সমাজে স্থিতি আসে। কিন্তু এর ফলে প্রথমত, প্রগতিশীল পরিবর্তনের
পথ রুদ্ধ হয়। দ্বিতীয়ত, ফ্রান্সের নারী সমাজে বন্ধন মুক্তি ও সমান অধিকার লাভের যে আশ্বাস
পেয়েছিল, কোড নেপোলিয়ন দ্বারা তা দুরীভূত হয়। নারীদের পুনরায় গৃহকোণে স্বামীর অধীনে জীবন
কাটাতে বাধ্য করা হয়। নারীদের সম্পত্তির অধিকারও সংকুচিত করা হয়। তৃতীয়ত, পারিবারিক
সংগঠন দৃঢ় করার জন্য পিতাকে পরিবারের উপর সামন্ততান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফলে স্ত্রী ও
সন্তানদের ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হয়। চতুর্থত, নেপোলিয়নের কোডে শ্রমিকদের জন্য কোনো অধিকার
স্বীকার করা হয়নি। তাদের নি¤œতম মজুরির অধিকার অবহেলিত হয়। শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকারও
দেওয়া হয়নি। কোড নেপোলিয়ন সম্পত্তি ভোগী বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার বাহন ছিল। ঘোষণা পত্রে
যে সকল মানব অধিকারের প্রতিশ্রæতি ছিল তা রক্ষা করা হয়নি। তারপরও কোড নেপোলিয়ন
স্থিতাবস্থার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
নেপোলিয়নের শিক্ষা সংস্কারও ত্রæটিহীন ছিল না। তার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান ত্রæটি ছিল যে, গির্জা
বিদ্যালয়ে ধর্মীয় প্রভাব ও সাধারণ বিদ্যালয়ে ধর্মনিরপেক্ষ প্রভাবের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ফ্রান্সের
জীবনে ঈষবৎরপধষরংস ধহফ ধহঃর-ঈষবৎপধষরংস অর্থাৎ যাজকবাদী শিক্ষা ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার বিরোধের
বীজ এভাবে রোপিত হয়। বিপ্লবের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাকে তিনি পুরো রক্ষা করেননি। দ্বিতীয়ত,


সৃজনশীল চিন্তধারা ও মৌলিক সৃষ্টি ও গবেষণাকে উৎসাহ না দেওয়ার ফলে ফ্রান্সে শুধু অধিক সংখ্যক
ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, আমলা, সেনাপতি তৈরি হয়।
মাধ্যমিক বিদ্যালয় উত্তীর্ন হলে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষা লাভ করার ব্যবস্থা করা হয়। বিদ্যালয় ¯তরে
রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও ইতিহাস পাঠ্যসূচিকে ঢেলে সাজানো হয়, যাতে ছাত্রদের মনে কনস্যুলেট সম্পর্কে
বিতর্ক ও স্বাধীন চিন্তার বিকাশ না ঘটে। এ জন্য এ দুইটি বিষয়কে সতর্কতার সাথে পড়ানো হতো।
ইঞ্জিনিয়ারিং/কারিগরি, সামরিক বিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষাদানের জন্য পৃথক বিদ্যালয় স্থাপন করা
হয়। নেপোলিয়নের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বাধীন চিন্তার স্থান ছিলনা। সংবাদপত্র, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি রাষ্ট্রের
অধীনে আনা হয়। এতে কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকের অভাব দেখা দেয়। এই যুগের
অধিকাংশ লেখক ছিলেন মৌলিকতাহীন স্তাবক। অর্থনীতি, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের গভীর গবেষণার ছাপ
এই যুগে দেখা যায়নি। সংবাদপত্র গুলি ছিল রাষ্ট্রের প্রচার মাধ্যম। নাট্যশালা গুলি গভীর কোনো
সামাজিক সমস্যা তুলে ধরেনি। এই সময়ে সুস্থ সংস্কৃতি ফরাসি জীবন ধারা থেকে নির্বাসিত হয়।
নেপোলিয়নের সংস্কার এর মূল্যায়ন
বিপ্লব পূর্ব স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ ফরাসি বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল। কিন্তু অচিরেই
রাজবংশের স্বৈরতন্ত্রের স্থলে নেপোলিয়নের স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কনস্যুলেট এর শাসন আমলে
নেপোলিয়ন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। ফ্রান্সের সিনেট তার অজ্ঞাবাহী যন্ত্রে পরিণত হয়। শিক্ষা
ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় বিভাগে পরিণত হয়। শিক্ষিত স¤প্রদায়কে রাজতন্ত্রের সমর্থকে পরিণত করা হয়। সংবাদ
পত্রগুলিকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় এবং পূর্বতন অভিজাত স¤প্রদায়ের স্থানে নতুন অভিজাত
সমপ্রদায়ের সৃষ্টি করা হয়। কিন্তুু এতো কিছুর পরেও নেপোলিয়নের সংস্কারগুলি গঠনমূলক ছিল এবং
তিনি ফ্রান্সে শান্তিশৃংখলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। ডেভিড থমসনের ভাষায় “ইড়হধঢ়ধৎঃব
ফরংপরঢ়ষরহবফ ঋৎধহপব ধহফ বংঃধনষরংযবফ ড়ৎফবৎ’’ তাঁর সময়ে ফ্রান্সে লুটতরাজ বন্ধ হয়। মানুষের জীবন
ও ধনসম্পত্তি সুরক্ষিত হয়, জন কল্যাণমূলক কর্মসূচি গৃহীত হয় এবং যোগ্যতার মর্যাদা স্বীকৃত হয়।
শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদিগকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয় এবং যুব স¤প্রদায়কে
জাতীয়তাবোধে উদ্ভুত করে তোলা হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও কারিগরি বিদ্যার প্রসারে সরকারি
উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। নেপোলিয়ন নিজেই বিজ্ঞান ও চারুশিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এক কথায়
তিনি ফ্রান্সকে আধুনিকভাবে গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। ফরাসি বিপ্লবোত্তর এবং বিজ্ঞান সম্মত
নতুন প্রশাসন সমগ্র ইউরোপে অনুকরণীয় হয়েছিল। নেপোলিয়নের আইনগুলি ফ্রান্সের জন্য মঙ্গলজনক
হলেও এই আইনের মাধ্যমে ফ্রান্সে নেপোলিয়নের স্বেচ্ছাতন্ত্রকে কেন্দ্রীয় করণের চেষ্টা চলে এতে কোন
সন্দেহ নাই।
সারসংক্ষেপ
সেনাপতি থেকে নেপোলিয়ন নিজ যোগ্যতা বলে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে ফ্রান্সে সর্বময়
ক্ষমতার অধিকারী হন। তিনি ফ্রান্সকে একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানো এবং নিজের ক্ষমতাকে
দৃঢ় করার জন্য প্রশাসনসহ আইন, বিচার, ধর্ম, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে সময় উপযোগী সংস্কার সাধন
করেন। নেপোলিয়নের সংস্কার ফ্রান্সের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা
ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। তিনি নতুন ও পুরাতন ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটিয়ে (ঈড়ফব ড়ভ ঘবঢ়ড়ষরড়হ)
নামে নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করেন। তার শাসন ব্যবস্থা ও আইন ও সংস্কার এর মধ্যে ত্রæটি বিচ্যুতি যাই
থাকুক না কেন তার প্রচেষ্টায় ফ্রান্সে শান্তি, শৃংখলা ফিরে এসেছিল এবং দেশে সম্পূর্ণ এক নতুন যুগের
সুচনা হয়েছিল।


পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। কনস্যুলট সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় কার উপর?
ক. এ্যাবেসিয়েস খ. রাজা ষোড়শ লুই
গ. ডাইরেক্টরদের উপর ঘ. নেপোলিয়নের উপর।
২। কিসের ভিত্তিতে প্রিফেক্ট নিয়োগ করা হতো ?
ক. বংশমর্যাদা খ. অর্থনৈতেক অবস্থা
গ. যোগ্যতা ঘ. আনুগত্য
৩। ট্রনসেট (ঞৎড়হপযবঃ) কে ছিলেন ?
ক. নেপোলিয়নের উপদেষ্টা খ. সফর সঙ্গী
গ. রাজনীতিবিদ ঘ. আইনজ্ঞ।
৪। লিজিয়ন অব অনার (খবমরড়হ ড়ভ ঐড়হড়ঁৎ) কি ?
ক. এক প্রকার শাসনতন্ত্র খ. একপ্রকার উপাধি
গ. ফ্রান্সের প্রধান সড়ক ঘ. ফ্রান্সের আইন সভার নাম।
৫। কনকর্ড্যাট (ঈড়হপড়ৎফধঃ) কি ?
ক. নেপোলিয়নের রাজনৈতিক সংস্কারের নাম খ. নেপোলিয়নের ধর্ম সংস্কারের নাম
গ.বাণিজ্য আইন ঘ. ইমগ্রিদের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা।
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১। নেপোলিয়নের সংস্কারের বৈশিষ্ট্য কি ছিল ?
২। নেপোলিয়নের যে কোনো দুটি সংস্কার আলোচনা করুন।
৩। মীমাংসা নীতি কি ? মীমাংসা নীতি ব্যাখ্যা করুন।
৪। নেপোলিয়নের শিক্ষা সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করুন।
৫। কোড নেপোলিয়ন সম্পর্কে আলোচনা করুন।
৬। নেপোলিয়নের প্রশাসন কেন্দ্রীয়করণ নীতি পর্যালোচনা করুন।
রচনা মুলক প্রশ্ন
১। নেপোলিয়নের সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করুন।
২। ফ্রান্সে নেপোলিয়ন কর্তৃক গৃহীত সংস্কার নীতি ব্যাখ্যা করুন। এই ব্যবস্থা কি ত্রæটি মুক্ত ছিল ?
৩। “ডড়ৎশ রং সু বষবসবহঃ. ও ধস নড়ৎহ ধহফ নঁরষঃ ভড়ৎ ড়িৎশ. ও যধাব শহড়হি ঃযব ষরসরঃং ড়ভ সু
ষবমং, ও যধাব শহড়হি ঃযব ষরসরঃং ড়ভ সু বুবং. ও যধাব হবাবৎ শহড়হি ঃযব ষরসরঃং ড়ভ সু ড়িৎশ”
ব্যাখ্যা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]