বার্লিন সম্মেলন : ১৮৮৪

বার্লিন সম্মেলন : ১৮৮৪
ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের মাঝে আফ্রিকা বন্টনের নীতিমালা স্থির করার জন্য ১৮৮৪ সালে জার্মানির বার্লিন
শহরে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে আফ্রিকায় দখল প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী সকল ইউরোপীয়
দেশ অংশগ্রহণ করে। এই সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে আফ্রিকা বন্টনের একটি নীতিমালা গৃহীত হয়। এই
নীতিমালার মূল বিষয়সমূহ নি¤েœপ্রদত্ত হলো :
(ক) এই সম্মেলনে স্থির হয় যে কঙ্গো নদী আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে স্বীকৃত হবে এবং এই নদীপথে
ইউরোপের সকল জাতির চলাচলের সমান অধিকার স্বীকৃত হবে;
(খ) বার্লিন সম্মেলনে এই মর্মে সিদ্ধান্তগৃহীত হয় যে এই নীতিমালায় স্বাক্ষরকারী যে কোনো দেশ
আফ্রিকার কোনো অঞ্চল দখল করতে চাইলে কিংবা কোনো অভিযান প্রেরণ করতে চাইলে
পূর্বেই তা সকল রাষ্ট্রকে জানাতে হবে;
(গ) এই সম্মেলনে স্থির হয় যে ইউরোপের সকল প্রকার ধর্ম প্রচারক আফ্রিকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে
অবাধে মিশনারি তৎপরতা পরিচালনা করতে পারবেন;
(ঘ) কোনো রাষ্ট্র আফ্রিকায় দাস ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে না। এখানে বলা প্রয়োজন যে
ইতিমধ্যে ইউরোপে দাস ব্যবসার বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়ে উঠেছিল এবং প্রকাশ্যে দাস ব্যবসা
বন্ধ হয়ে গিয়েছিল;
(ঙ) আফ্রিকার কোনো অঞ্চল দখল নিয়ে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে কোনো বিভেদ দেখা দিলে তা
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করা হবে। কোনো অঞ্চল নিয়ে উভয় পক্ষ অনড় থাকলে ঐ
অঞ্চলটি উভয়ের মধ্যে সমভাবে বন্টিত হবে।


ইউরোপীয়দের আফ্রিকা দখল
আফ্রিকা দখলের পালা শুরু হয় ব্রাসেল্স সম্মেলনের পর থেকে। বার্লিন সম্মেলন এই প্রক্রিয়াকে
ত্বরান্বিত করেছিল মাত্র। আফ্রিকায় দেশ দখলের দিকে ফ্রান্স বরাবরই অগ্রসর ছিল। নেপোলিয়নের
সময়েই মিশর ফ্রান্সের দখলে ছিল। উত্তর আফ্রিকার মরক্কো, আলজেরিয়া তিউনিসিয়াতে ফরাসি
সাম্রাজ্য বিস্তার করে। ১৮৬৯ সালে ফরাসি সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয়ে সুয়েজ খাল খনন করে। পরে অবশ্য
বৃটিশ সরকার সুয়েজ খালের শেয়ার ক্রয় করে এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। জার্মানি
প্রথম পর্বে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও ১৮৯০ সাল নাগাদ আফ্রিকার চারটি অঞ্চল দখল করে। এই
অঞ্চলগুলি হলো টোগো, ক্যামেরুন, মোজাম্বিক, তানজানিয়া প্রভৃতি। পর্তুগাল দখল করে এঙ্গোলা,
গিনি অঞ্চল, ইতালি দখল করে ইথিওপিয়া ও সোমালিয়া অঞ্চল। ১৯১২ সালে ইটালি লিবিয়া দখল
করে নেয়। ইংল্যান্ড দক্ষিণ আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে। এটা পরবর্তীকালে দক্ষিণ আফ্রিকা
ইউনিয়ন নামে পরিচিতি লাভ করে। মিশর ও সুদান দখল করে বৃটেন। এভাবে উনিশ শতকের মধ্যেই
সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ ইউরোপীয়দের মধ্যে বন্টিত হয়ে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে
বর্তমান সময়ে আফ্রিকা মহাদেশের যে রাজনৈতিক মানচিত্র লক্ষ্য করা যায় এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোওর
কালের। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী যুগে বিভিন্ন পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে আফ্রিকা-মহাদেশ এই
রাজনৈতিক মানচিত্রে উপনীত হয়েছে।
আফ্রিকা ব্যবচেছদের ফলাফল
উনিশ শতকের শেষদিকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ভেতরে আফ্রিকা বন্টনের ফলাফল
হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। সত্যিকার অর্থে ‘অন্ধকার মহাদেশ আফ্রিকা’ এই প্রথমবারের মত সভ্য দুনিয়ার
সংস্পর্শে আসে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চরম অত্যাচার আর নির্মম শোষণের ভেতর দিয়ে আফ্রিকার কালো
মানুষেরা আধুনিক জীবনে প্রবেশ করে। আফ্রিকা ব্যবচেছদের ফলাফল হয়েছিল নি¤œরূপ :
প্রথমত, আফ্রিকা ব্যবচেছদ ও ইউরোপীয় শক্তির অধীনে চলে যাওয়ার ফলশ্রæতিতে এখানে ইউরোপীয়
শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রয়োজনে প্রশাসন ও শিল্পের জন্য দরকার হয়
শিক্ষিত জনশক্তি। তাদের প্রয়োজনের তাগিদে তারা গড়ে তোলে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়।
একই সঙ্গে গড়ে তোলে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র। এইভাবে আফ্রিকার মানুষ আধুনিক শিক্ষা ও
সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে। আফ্রিকায় পৌঁছে যায় আধুনিক সভ্যতার আলো।
দ্বিতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদী শাসনের যুগে বিশেষত মধ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকা ও পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলে
ইউরোপের খ্রিস্টান মিশনারিরা ব্যাপক তৎপরতা চালায়। মিশনারিদের তৎপরতার একটি প্রধান দিক
ছিল জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ। এখানে প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে মরক্কো অঞ্চল থেকে মিশর অঞ্চল পর্যন্ত
উত্তর আফ্রিকার মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও মধ্য ও দক্ষিণ পশ্চিম এবং দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকার
অধিকাংশ মানুষ ছিল প্রকৃতি পূজারি এবং লোকজ ধর্মে অভ্যস্ত। খ্রিস্টান মিশনারিদের তৎপরতায় প্রকৃতি
পূজারি ও লোকজ ধর্মের হাজার হাজার মানুষ খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়। ক্রমে খ্রিস্টান ধর্ম আফ্রিকার
মানুষের অন্যতম প্রধান ধর্মে পরিণত হয়।
তৃতীয়ত, আফ্রিকা ব্যবচেছদের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কাছে আফ্রিকার কালো
মানুষদের রক্তের সম্পর্ক, তাদের সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক জীবনধারা ইত্যাদি বিষয়াবলীর কোনোটিই
বিবেচিত হয়নি। ইউরোপীয়দের মূল লক্ষ্য ছিল কেবল বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে। এর ফলে একই
পরিবার, একই গোত্র কিংবা একই জীবনধারার মানুষ ইউরোপীয়দের সৃষ্ট সীমানায় বিভক্ত হয়ে পড়ে।
আফ্রিকার মানুষদের এই আন্ত:বিভক্তি দাস প্রথার মতই তাদের জীবনে নতুন অমানিশার সৃষ্টি করেছিল।


চতুর্থত, আফ্রিকার বন্টন প্রশ্নে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি বার্লিন সম্মেলনে একটি সমঝোতায়
উপনীত হলেও এই সমঝোতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। উনিশ শতকের আশির দশকেই আফ্রিকার বিভিন্ন
অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মাঝে সংঘাত শুরু হয়ে যায়। সুয়েজ খালের উপর
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য মিশরের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকল্পে ফ্রান্স ও বৃটেনের মধ্যে দীর্ঘ বিবাদের
সূত্রপাত হয়। ১৮৬৯ সালে ফরাসি সরকারের প্রচেষ্টায় সুয়েজ খাল খনন সম্পন্ন হলে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী
ডিজরেলি ৪০ লক্ষ পাউন্ডের বিনিময়ে মিশরের কাছ থেকে খালের শেয়ার ক্রয় করে। মিশরকে ঘিরে
ফ্রান্স ও মিশরের সংঘাত এখান থেকেই শুরু হয়। সুয়েজ খালের উপর উভয় শক্তির এই দ্বৈত মালিকানা
কয়েক বছর ধরে চলতে থাকে। ১৮৮২ সালে বৃটিশ সেনাবাহিনী আলেক জান্দ্রিয়া দখল করে। পরে
পর্যায়ক্রমে মিশরের উপর বৃটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯৯ সালে বৃটিশ সেনাবাহিনী সুদান দখল
করে।
মরক্কো ও আলজেরিয়ার পর ফ্রান্স তিউনিসিয়া দখল করলে ইতালি ও জার্মানি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
জানায়। ইতালি ও জার্মানির সাথে যোগ দেয় অস্ট্রিয়া। এইভাবে উত্তর আফ্রিকায় সাম্রাজ্য বিস্তারকল্পে
ফ্রান্সের বিরুদ্ধে এক ত্রিশক্তি ঐক্য গড়ে উঠে। মরক্কোয় ফরাসিদের একচেটিয়া আধিপত্য নিয়ে ফ্রান্সের
সাথে জার্মানি ও স্পেনের বিরোধ দেখা দেয়। ১৯০৬ সালে আলজিয়ার্স বৈঠকে মরক্কোর উপর ফ্রান্স ও
স্পেনের দ্বৈত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে বিশ শতকে আফ্রিকাকে কেন্দ্র করে ইউরোপের
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে দ্ব›দ্ব ক্রমাগতভাবে প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। পরিশেষে আফ্রিকা দখল
প্রথম মহাযুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পরিশেষে বলা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদীদের আফ্রিকা ব্যবচ্ছেদের ফলাফল হয়েছিল সুদূর প্রসারী। আধুনিক
সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবনধারা প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে আফ্রিকার মানুষ নিজেদের অতীত ও
বর্তমান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠতে থাকে। এই ধারা দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে প্রবল হয়ে আফ্রিকায় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সূচনা করে। এভাবেই পৃথিবীর মানচিত্রে
আবিভর্‚ত হয় আজকের আফ্রিকার।


পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। ওলন্দাজরা আফ্রিকার কেপ অঞ্চল দখল করে
(ক) ১৭৬২ সালে (খ) ১৬৫২ সালে
(গ) ১৪৯৮ সালে (ঘ) ১৪৯২ সালে
২। দাস ব্যবসার জন্য বণিক সংস্থা গঠন করে
(ক) ফরাসি বণিকেরা (খ) ইংরেজ বণিকেরা
(গ) জার্মান বণিকেরা (ঘ) ওলন্দাজ বণিকেরা
৩। ব্রাসেলস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়
(ক) ১৮৬০ সালে (খ) ১৮৭২ সালে
(গ) ১৮৭৮ সালে (ঘ) ১৮৮০ সালে
৪। ক্যামেরুন দখল করে
(ক) বৃটেন (খ) ফ্রান্স
(গ) জার্মানি (ঘ) ইতালি
৫। ১৯১২ সালে ইতালি দখল করে
(ক) আলজেরিয়া (খ) লিবিয়া
(গ) তিউনিসিয়া (ঘ) সুদান।
উত্তর : ১। (খ), ২।(খ), ৩।(গ), ৪।(গ), ৫।(খ)।
রচনামূলক প্রশ্ন
(১) আফ্রিকায় ইউরোপীয়দের দাস ব্যবসার বিবরণ দিন।
(২) ইউরোপীয় সাম্রাজ্যশক্তির আফ্রিকা বন্টনের পদক্ষেপসমূহ আলোচনা করুন।
(৩) আফ্রিকায় সাম্রাজ্য বিস্তারকল্পে বার্লিন সমঝোতার ধারাসমূহ বিশ্লেষণ করুন।
(৪) আফ্রিকা ব্যবচ্ছেদের ফলাফল আলোচনা করুন।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
(১) আন্তর্জাতিক ভৌগোলিক সংস্থা কি? এটা কবে গঠিত হয়েছিল?
(২) সুয়েজ খাল কত সালে খনন করা হয়?
(৩) আফ্রিকায় মিশনারিদের তৎপরতার মূল লক্ষ্য কি ছিল?
(৪) বৃটিশ সেনাবাহিনী কখন সুদান দখল করে?
(৫) ফ্রান্স বিরোধী ঐক্যজোটে কোন কোন দেশ যোগদান করেছিল?

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]