প্যারিস শান্তিসম্মেলনে স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তির বিভিন্নদিক বিশ্লেষণ করুন।


প্যারিস শান্তিসম্মেলন কি?
প্যারিস শান্তিসম্মেলন হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত দেশগুলোর সাথে বিজয়ী দেশগুলোর শান্তিচুক্তি
সম্পাদনের লক্ষ্যে প্যারিসে আহ‚ত একটি সম্মেলন। ১৯১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি ফ্রান্সের রাজধানী
যুদ্ধক্লান্তপ্যারিসে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের উত্তেজনা চূড়ান্তভাবে প্রশমিত হবার আগেই
প্যারিসে এ ধরনের সম্মেলনের আয়োজন যুক্তিযুক্ত হয়নি। সুইজারল্যান্ডের ন্যায় কোনো নিরপেক্ষ দেশে
শান্তিসম্মেলন হওয়া উচিত ছিল। বিজয়ী ফ্রান্স প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে ১৮৭১ সালে সেডানের যুদ্ধে
জার্মানির হাতে পরাজিত হয়েছিল এবং এই প্যারিসেই জার্মানি পরাজিত ফ্রান্সের উপর কতিপয় শর্ত
আরোপ করেছিল। ফলে বিজয়ী ফ্রান্স পূর্ববর্তীঅপমানের প্রতিশোধ নিতে প্যারিসে সম্মেলন প্রধান
ভ‚মিকা পালন করে।
শান্তিসম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতৃবর্গও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি
সম্মেলনে পৃথিবীর ৩২টি দেশের প্রতিনিধি যোগ দেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ, ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জক্লিমেনশোঁ,
ইতালির প্রধানমন্ত্রী ভিত্তোরিও অর্ল্যান্ডো। ফরাসি প্রতিনিধি জর্জক্লিমেশোঁকে ঐ সম্মেলনের সভাপতি
নির্বাচিত করা হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে মিত্রশক্তিকে যারা সহযোগিতা করেছিল সেসব দেশের প্রতিনিধিরাও
এতে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে প্রধান ভ‚মিকা পালন করেছিলেন প্রথমোক্ত চারজনই। এজন্যে
তাঁদেরকে ‘চার প্রধান' (ইরম ভড়ঁৎ) বলা হতো। প্রথম মহাযুদ্ধে পরাজিত জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি,
তুরস্ক, বুলগেরিয়াকে সম্মেলনে প্রতিনিধিত্বকরতে দেওয়া হয়নি। চুক্তিপত্র রচনা সম্পন্নহলে তা স্বাক্ষর
করার জন্য পরাজিত রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিগণকে আহŸান করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন ছিলেন গণতান্ত্রিক আদর্শেবিশ্বাসী। শত্রæর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের পরিবর্তে
তিনি ন্যায় ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে দীর্ঘকাল স্থায়ী শান্তিস্থাপনের পক্ষপাতি ছিলেন। অনেকেই আশা
করেছিলেন যে, জার্মানির বিরুদ্ধে সমগ্রবিশ্বে যে মানসিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তার থেকে
উইলসন গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবেন। জার্মানিতেও উইলসনকে রক্ষাকর্তারূপে অভিহিত করা
হয়েছিল। তবে ইউরোপীয় সমস্যা এবং দ্বন্দ¡মুখর রাজনীতি সম্পর্কেউইলসনের খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল না
বলেই প্রতীয়মান হয়। ফলে তার উচ্চ আদর্শবাদ ইউরোপের সংঘাতময় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে
পড়ে।
প্যারিস শান্তিসম্মেলনে ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্বকরেন প্রধামন্ত্রী লয়েড জর্জ। তিনি ব্রিটিশ জনগণের পূর্ণ
সমর্থনপুষ্ট হয়েই সম্মেলনে এসেছিলেন। চারিত্রিক গুণাবলী, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং ইউরোপীয় সমস্যা
সম্পর্কেসুস্পষ্ট ধারণা তার ছিল। ইউরোপীয় রাজনীতিতে ব্রিটেনের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের জন্যে
এখানে তিনি তার মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়েছেন।


ফ্রান্সের প্রতিনিধি, জর্জ ক্লিমেনশোঁ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। কঠোর মনোভাবসম্পন্ন
ক্লিমেনশোঁকে বলা হতো বাঘ (ঞরমবৎ)। বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কেতার সুস্পষ্ট ধারণা ছিল এবং তিনি
অংশগ্রহণকারীদের গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তার একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এটি হল
জার্মানিকে পঙ্গু ও দুর্বল করে ফেলা। ইতালির প্রতিনিধি ভি অল্যাÐো প্রকাশ্যে তার দেশের স্বার্থ
আদায়ের চেষ্টা করেন। মিত্র পক্ষে যোগদানের শর্তহিসেবে ইতোপূর্বেবিভিন্নগোপন চুক্তিতে ইতালিকে
কয়েকটি ভ‚খÐ দেয়ার প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছিল। এই প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়নের জন্যে তিনি সম্মেলনে
প্রকাশ্যে চাপ প্রয়োগ করে বিরক্তি উৎপাদন করেছিলেন।
এই ‘চার প্রধান' (ইরম ঋড়ঁৎ) ব্যতীত অন্যান্য ক‚টনৈতিক প্রতিনিধিগণ এবং দূর থেকে অনেকেই
সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট পোয়াঁকারে এবং সেনাপাতি
মার্শাল ফচ্ প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলনে যোগদান না করেও বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন। তাদের
একমাত্র লক্ষ্য ছিল জার্মানির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়া। এ বিষয়ে তারা ক্লিমেনশোঁ অপেক্ষা কঠোর
ছিলেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট উইলসনীয় আদর্শবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড
জর্জব্যতীত আরও দুই প্রতিনিধি ছিলেন আর্থার ব্যালফোর এবং জর্জবার্নেস নামে। গ্রিসের প্রতিনিধিত্ব
করেন ভেনিজেলস। পোল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করেন রোমান দামোস্কি। জাপানের প্রতিনিধি ছিলেন
কিমোচি ও নুবয়াকি থাকিনো। তারা সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণভ‚মিকা পালন করেন। জাপানি প্রতিনিধিরা
ইউরোপের চেয়ে দূরপ্রাচ্যের ভবিষ্যত নিয়ে আগ্রহী ছিলেন।
প্যারিস শান্তিসম্মেলনকে ১৮১৫ সালের ভিয়েনা সম্মেলনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ভিয়েনা
সম্মেলনের মতো প্যারিসে উপস্থিত প্রতিনিধিরা আদর্শবাদের কথা ঘোষণা করে কার্যক্ষেত্রে স্বার্থপরতার
পরিচয় দিয়েছিলেন। জার প্রথম আলেকজান্ডারের মতো রাষ্ট্রপতি উইলসন ছিলেন আদর্শবাদের
প্রতীক। তাঁর চৌদ্দ দফা নীতি আলোচিত হয়েছে কিন্তুমানা হয়নি। কারণ যুদ্ধ চলার সময় অনেক
দেশই পরস্পরের সাথে গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। তারা সেগুলো রূপায়নের জন্যে সচেষ্ট ছিল।
ফলে তারা উইলসনীয় আদর্শবাদকে স্বার্থসিদ্ধির আবরণরূপে ব্যবহার করেছিল।
তাছাড়া চার বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মিত্র রাষ্ট্রগুলো জার্মানির প্রতি তীব্রপ্রতিশোধ স্পৃহা পোষণ
করতো। প্রতিটি বিজয়ী রাষ্ট্রই নিজের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষায় মনোযোগী ছিল।
ফলে প্যারিস শান্তিসম্মেলনে আদর্শবাদ ও বাস্তব প্রয়োজনের মধ্যে চলেছে দ্বিধা-দ্বন্দ¡। তবে শেষ পর্যন্ত
ইউরোপের বিজয়ী দেশসমূহের স্বার্থ চিন্তা এবং বাস্তববোধেরই প্রাধান্য সূচিত হয়েছিল। যুদ্ধক্লান্ত
মিত্রশক্তিবর্গের প্রতিনিধিগণ জনমতের চাপে ও আশু ভবিষ্যতের কথা ভেবে আদর্শবাদকেই জলাঞ্জলি
দিয়েছিলেন।
প্যারিস শান্তিসম্মেলনে স্বাক্ষরিত বিভিন্নচুক্তি
প্যারিসে শান্তিসম্মেলনে মিত্রশক্তিবর্গও বিজিত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মোট পাঁচটি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়।
(১) জার্মানির সঙ্গে ভার্সাই-এর সন্ধি (ঞৎবধঃু ড়ভ ঠবৎংধরষষবং)
(২) অস্ট্রিয়ার সঙ্গে সেন্ট জার্মানের সন্ধি (ঞৎবধঃু ড়ভ ঝঃ. এবৎসধরহ)
(৩) বুলগেরিয়ার সঙ্গে নিউলির সন্ধি (ঞৎবধঃু ড়ভ ঘবঁরষষবু)
(৪) হাঙ্গেরির সঙ্গে ট্রিয়ানর সন্ধি (ঞৎবধঃু ড়ভ ঞৎরধহড়হ)
(৫) তুরস্কের সঙ্গে সেভার্সের সন্ধি (ঞৎবধঃু ড়ভ ঝবাৎবং)
(৬) সেভার্সের চুক্তি কিছুদিন পর সংশোধিত হয়ে ল্যসেনের চুক্তি (ঞৎবধঃু ড়ভ খধঁংধহহব) স্বাক্ষরিত
হয়েছিল।
১৯১৯ সালের ২৮ জুন ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। ভার্সাই প্যারিসের অদূরে অবস্থিত। সন্ধির খসড়া
জার্মান প্রতিনিধিবর্গকে দেখানো হয় ও মন্তব্য করতে খসড়ার বিভিন্নশর্ততাঁরা আপত্তি জানান, কিন্ত
সেগুলো গ্রাহ্য হয়নি। একতরফা ভাবে ইউরোপের আঞ্চলিক পুনর্গঠন, সাময়িক, অর্থনৈতিক ও
রাজনৈতিক শর্তাবলী জার্মানির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।


ভার্সাই সন্ধির শর্তঅনুসারে জার্মানি ফ্রান্সকে আলসাস-লোরেন, বেলজিয়ামকে মরেসনেট, ইউপেন,
মালমেডি, লিথুয়ানিকে মেমেল, পোল্যান্ডকে পোজেন ও পশ্চিম প্রæশিয়ার অংশ বিশেষ ছেড়ে দিতে বাধ্য
হয়। ডানজিগ উন্মুক্ত বন্দর হিসেবে ঘোষিত হয়। উপনিবেশ ও বিশ্বের বিভিন্নস্থানে অর্জিত বিশেষ
অধিকারগুলো জার্মানিকে প্রত্যার্পন করতে বলা হয়। উত্তর সাইলেশিয়া ও পূর্বএশিয়ার অধিবাসীগণ
গণভোটের মাধ্যমে স্থির করবে তারা পোল্যান্ডের সঙ্গে সংযুক্তির পক্ষপাতি কিনা। জার্মানির শিল্প ও
খনিজ প্রধান সার (ঝধধৎ) অঞ্চলে ১৫ বছরের জন্য ফ্রান্সের কর্তৃত্বস্থাপিত হয়।
জার্মানি ভবিষ্যতে যাতে অন্য কোনো দেশ আক্রমণে প্রবৃত্ত হতে না পারে সেজন্য তার সামরিক শক্তি
প্রচুর পরিমাণে হ্রাস করা হয়। রাইন নদীর পূর্বতীরে তিরিশ মাইল পর্যন্তঅঞ্চল থেকে সবরকম সামরিক
ঘাঁটি অপসারিত হলো। সৈন্যসংখ্যা এক লক্ষ কমিয়ে আনা হয়, বিমান ও নৌবাহিনীকেও দুর্বল করে
দেওয়া হয়। অস্ত্রউৎপাদন সীমিত করা হয়। জার্মানির ব্যয়েই মিত্রবাহিনীকে জার্মানিতে মোতায়েন করা
হয়। বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগদানের নীতি বাতিল করা হয়।
জার্মান অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয়। জার্মান বাণিজ্য পোতগুলো ফ্রান্সকে দেওয়া হয়।
কয়লাসমৃদ্ধ সার অঞ্চল আপাতত অধিকার করায় জার্মান শিল্প ক্ষতিগ্রস্তহয়। জার্মানিকে কয়লা ও লোহা
অন্যান্য দেশকে সরবরাহ করতে বলা হয়। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রচুর অর্থজার্মানির ওপর ধার্য
করা হয়।
বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টির জন্য জার্মানিকে দায়ী করা হয়। এই অপরাধে সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামকে
যুদ্ধাপরাধী বিচারের জন্য মিত্রপক্ষের কাছে সমর্পণের দাবি জানানো হয়। পরে অবশ্য এটি কার্যকর করা
হয়নি। জার্মানির প্রতিবেশি ক্ষুদ্ররাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রæতি দেওয়া হয়।
বিশ্বশান্তিরক্ষার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার শর্তও ভার্সাই সন্ধিতে সংযোজিত
হয়। রাষ্ট্রপতি উইলসনের চৌদ্দ দফা নীতির ভিত্তিতে জাতিপুঞ্জ (খবধমঁব ড়ভ ঘধঃরড়হ) গঠিত হয়।
এছাড়া জার্মানি ও তার মিত্রবর্গের উপনিবেশগুলো কেড়ে নিয়ে জাতিপুজ্ঞের তত্ত¡াবধানে অছি
(গধহফধঃব) হিসেবে মিত্র রাষ্ট্রবর্গের হাতে ন্যস্তকরা হয়।
‘যুদ্ধ বন্ধের যুদ্ধ' ভার্সাই ও অন্যান্য সন্ধিগুলোকে এই নামে অভিহিত করা হয়। ভার্সাই সন্ধি যেহেতু
জার্মানির সঙ্গে সম্পাদিত হয়েছিল, সেহেতুএটিই সর্বাধিক আলোচিত ঘটনা। এক দিকে যেমন ভার্সাই
সন্ধির শর্তাবলী ও যেভাবে আরোপিত হয়েছিল তা তীক্ষèসমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল, অন্যদিকে তীব্র
চাপের মধ্যে তাদের কাজ করতে হয়েছে তাও বিবেচনা করা উচিত।
ভার্সাই সন্ধিতে রাষ্ট্রপতি উইলসনের ‘চৌদ্দ দফা' নীতির অধিকাংশই ভঙ্গ করা হয়েছে। আদর্শবাদকে
পাশ কাটিয়ে সন্ধিটি পরাজিত অসহায় জার্মানদের ওপর জোর করে আরোপিত হয়েছে। প্রকৃত অর্থে
এটি শান্তিচুক্তি ছিল না, এটি বিজয়ী রাষ্ট্রবর্গের নিজেদের মধ্যে একটি চুক্তি ছিল। কেননা বিজিত
পক্ষের প্রতিনিধিবর্গকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। জাতিপুঞ্জকে ভার্সাই সন্ধির সঙ্গে
সংযুক্ত করা উচিত হয়নি। এর ফলে জার্মানরা প্রথম থেকেই এ প্রতিষ্ঠানটিকে বিজয়ী মিত্র শক্তিবর্গের
হাতিয়ার বলে মনে করতো। এই কারণে জাতিপুঞ্জ বা লীগের ভিত্তি প্রথম থেকেই ছিল দুর্বল। জার্মান
বন্দর ডানজিগকে উন্মুক্ত করে, ‘সার' খনি অঞ্চলকে জার্মানি থেকে পৃথক করে ও তিরিশ লক্ষ
জার্মানকে নবগঠিত চেকোশ্লোভাকিয়ায় হস্তান্তরিত করে মিত্র রাষ্ট্রবর্গ রাষ্ট্রপতি উইলসনের ঘোষিত
প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে অমান্য করে।
নিরস্ত্রীকরণের (উরংধৎসধসবহঃ) চুক্তিতে মিত্রশক্তি জার্মানির সামরিক শক্তি হ্রাস করলেও নিজেরা তা
মেনে চলেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল দীর্ঘদিনের জটিল ঘটনা স্রোতের পরিণতি, এর জন্য কেবলমাত্র
জার্মানিকে এককভাবে দায়ী করা ঠিক হবে না। কিন্তুজার্মানিকে যুদ্ধ অপরাধী অপবাদ দিয়ে তার
কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণ দাবি করে জার্মানিকে মিত্ররাষ্ট্রবর্গের ‘দাসে'
পরিণত করা হয়। এর ফলে দেশটির অর্থনীতি একেবারে ভেঙ্গে পড়ে।


তদুপরি জার্মানির আরও কিছুসুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল, যেমন আলসাস-লোরেন ফ্রান্সকে প্রদান, কিছু
জার্মান অঞ্চল বেলজিয়ামকে, পোজেন ও পশ্চিম প্রæশিয়া, পোল্যান্ডকে প্রদান, ‘সার' অঞ্চলকে ১৫
বছরের জন্যে জার্মানি থেকে পৃথকীকরণ এবং ডানজিগ বন্দরকে আন্তর্জাতিক বা মুক্ত বন্দর ঘোষণা
ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এগুলো জার্মান জাতীয়াতাবাদকে দারুণভাবে আহত করে।
অস্ট্রিয়ার সাথে মিত্রশক্তি সেন্ট জার্মানির চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির বিভিন্নধারা পুরাতন অস্ট্রোহাঙ্গেরি সাম্রাজ্যকে দুর্বল ও পঙ্গুকরে ফেলে। জাতীয়তাবাদ নীতিকে ফর্মুলা হিসেবে গ্রহণ করে উক্ত
সাম্রাজ্যকে একাধিক নতুন রাষ্ট্রেবিভক্ত করা হয়। অস্ট্রিয়ান প্রদেশ রোহময়া ও মোরাভিয়াকে বিছিন্ন
করে এই দুটোকে একত্রিত করে চেকোশ্লোভাকিয়া নামে একটি নতুন রাষ্ট্রগঠন করা হয়। বোসনিয়া ও
হার্জেগোভিনাকে সাটিয়ার সাথে সংযুক্ত করা হয় এবং এই সম্প্রসারিত নতুন রাষ্ট্রটি যুগোশ্লাভিয়া নামে
পরিচিত হয়। এছাড়া দক্ষিণ টিরল, ট্রেনটিনো বন্দর ও দ্বীপ ইতালিকে দেওয়া হয়। অস্ট্রিয়ান একটি
জেলা পোল্যান্ডকে দেয়া হয় এবং হাঙ্গেরিকে অস্ট্রিয়া হতে বিচ্ছিন্নকরা হয়। অস্ট্রিয়াকে একটি ক্ষুদ্র
রাষ্ট্রেপরিণত করা হয় এবং জার্মানির সাথে অস্ট্রিয়ার সংযুক্তি নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে জনগণের
আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার নীতি এখানে রক্ষিত হয়নি।
মিত্রশক্তি হাঙ্গেরির সাথে স্বাক্ষর করে ট্রিয়াননের সন্ধি। এটি স্বাক্ষরিত হয় ১৯২০ সালে। এ সন্ধি দ্বারা
হাঙ্গেরিকে বিচ্ছিন্নকরা হয়। হাঙ্গেরি কর্তৃক রুমানিয়াকে ট্রান্সিলভানিয়া, চেকোশ্লাকিয়াকে শ্লোভা প্রদেশ
এবং যুগোশ্লাভিয়াকে ক্রোশিয়া দিতে বাধ্য করা হয়। অস্ট্রিয়ার ন্যায় হাঙ্গেরির সমুদ্রপথও সম্পূর্ণভাবে
রুদ্ধ করা হয়।
মিত্রশক্তি ১৯১৯ সালে বুলগেরিয়ার সাথে লিউলির চুক্তি করে। এই সন্ধি অনুসারে বুলগেরিয়াকে গ্রিসের
কাছে থ্রেস (ঞযৎধপব) ছেড়ে দিতে হয়। এছাড়া মেসিডোনিয়ার কিয়দংশ যুগোশ্লাভিয়াকে এবং
দোবরোজা (উড়নৎঁলধ) রুমানিয়ার কাছে অর্পণ করতে হয়।
মিত্রশক্তি তুরস্কের সাথে ১৯২০ সালে সেভার্সের চুক্তি করে। এই সন্ধিতে মিত্রশক্তিবর্গতুরষ্কের প্রতি
অত্যন্তকঠোর মনোভাবের পরিচয় প্রদান করে এবং তারা বিরাট তুর্কিসাম্রাজ্যকে খÐ বিখÐ করে একে
সম্পূর্ণভাবে দুর্বল ও পঙ্গুকরে ফেলে। তুরষ্কের জাতীয়তাবাদী দল এই সময় মোস্তাফা কামাল-এর
নেতৃত্বে সুলতান কর্তৃক সেবার্সের চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া সত্তে¡ও তা মেনে নিতে অস্বীকার করে। ফলে
পরবর্তীকালে তুরষ্কের স্বার্থেমিত্রশক্তি নমনীয় শর্তেলাওসান (খধঁংধহহব) চুক্তি করে।
প্যারিস শান্তিসম্মেলনের মূল্যায়ন
প্যারিস শান্তিসম্মেলনে স্বাক্ষরিত বিভিন্নচুক্তি বিশেষত ভার্সাই সন্ধি ছিল ভালমন্দের সমাহার। প্যারিসে
সমবেত শান্তির সংগঠকদের একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। ফলে এসব
সীমাবদ্ধতাকে বিবেচনা করে কিছুটা উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের কার্যাবলী মূল্যায়ন করা উচিত।
সমবেত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দ তাদের দেশের জনমতকে কোনো মতেই উপেক্ষা করতে
পারেননি। প্রচুর রক্তের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে সেখানে বিজিত শক্তিগুলোর ওপর
প্রতিহিংসার মনোভাব কাজ করবে, এটি ছিল স্বাভাবিক। তাছাড়া যুদ্ধকালীন সম্পাদিত গোপন
চুক্তিগুলোকেও শান্তিচুক্তির মধ্যে স্থান দিতে হয়েছে, যেমন লন্ডন ও কনস্টান্টিনোপলের চুক্তি।
১৯১৯ সালে ইউরোপে দীর্ঘযুদ্ধের অবসানে ন্যায় নীতির ওপর শান্তিপ্রতিষ্ঠার আদর্শবাতুলতা মাত্র।
সুপ্রাচীন শক্তিসাম্যের নীতিই রাষ্ট্রনায়কদের প্রভাবিত করতো বেশি। তা সত্তে¡ও অন্তুদুই দশক ইউরোপে
শান্তিবজায় ছিল। রাষ্ট্রপতি উইলসনের আদর্শবাদের মর্ম রাষ্ট্রনায়কগণ সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে
পারেননি। কাইজারের জার্মানি ছিল আগ্রাসী মনোভাবের, কিন্তু শাস্তি দেওয়া হয় প্রজাতান্ত্রিক
জার্মানিকে। প্যারিস সম্মেলনে এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। জার্মানদের অতীত ইতিহাস বিচার
করলে তাদের আপত্তির তীব্রতা অনেকটাই কমে যায়। রাশিয়ার সঙ্গে ব্রেস্টলিটভসকের ও রুমানিয়ার
সঙ্গে বুখারেস্টের চুক্তিতে জার্মানরাও যথেষ্ট কঠোর শর্তআরোপ করেছিল।

ভার্সাই তথা প্যারিসের সম্মেলন সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। কিন্তুশান্তিস্থাপনের জন্যে মিত্রপক্ষের
রাষ্ট্রনায়কবৃন্দ আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সংকীর্ণকাঠামোর মধ্যে কাজ করেও তাঁরা অনেক
ক্ষেত্রে মৌলিক চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন। জাতিসংঘের জন্ম, নিরস্ত্রীকরণের ধারণা, জাতীয়
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রভৃতি আদর্শের উৎপত্তি এখানেই। আজও এদের উপযোগিতা শেষ হয়ে
যায়নি।
ভিয়েনা ও ভার্সাই, এ দুয়ের মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাবে, উভয় ক্ষেত্রেই শক্তি সাম্য বজায় রাখার
ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল বেশি। উভয় ক্ষেত্রেই উচ্চ আদর্শকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। উভয় ক্ষেত্রে
নিরাপত্তার প্রশ্নটিই সর্বাধিক গুরুত্বপায়। উভয় ক্ষেত্রেই ইউরোপ একটি বিশেষ শক্তি থেকে ভীত ছিল,
১৮১৫-এ ফ্রান্স, ১৯১৯-এ জার্মানি। উভয়ক্ষেত্রেই মিত্ররাষ্ট্রবর্গ। নিরাপত্তার সঙ্গে আরোপিত শান্তি
(উরপঃধঃবফ চবধপব) মিশিয়ে ফেলেন। উভয় শান্তিসম্মেলনই ভবিষ্যত ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত
করতে ব্যর্থহয়েছে। তা সত্তে¡ও ভার্সাই সন্ধি, আশীর্বাদ বা অভিশাপ যাই হোক, একটি গুরুত্বপূর্ণঘটনা
হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। অনেক ভবিষ্যত ঘটনাবলীর উৎস এর মধ্যে নিহিত ছিল।
পরবর্তীকয়েক দশকের ইউরোপীয় রাজনীতি প্যারিস শান্তিসম্মেলনের সিদ্ধান্তসমূহ প্রভাবিত করেছিল।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন

নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন।
১। প্যারিস শান্তিসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯১৯ সালেরÑ
(ক) ১০ জানুয়ারি (খ) ১২ জানুয়ারি
(গ) ১৫ জানুয়ারি (ঘ) ১৮ জানুয়ারি।
২। প্যারিস শান্তিসম্মেলনে অংশগ্রহণকারী চার প্রধান কারাÑ
(ক) উইলসন, লয়েড জর্জ, ক্লিমেনশোঁ ও অল্যাÐো
(খ) রুজভেল্ট, স্ট্রালিন, চার্চিল ও দাগল
(গ) উইলসন, ক্লিমেশশোঁ, বালফুর, অল্যাÐো
(ঘ) স্ট্যালিন, মুসোলিনি, কাইজার, ক্লিমেনশোঁ।
৩। প্যারিস শান্তিসম্মেলনে স্বাক্ষরিত হয় মোট চুক্তির সংখ্যাÑ
(ক) ৩টি (খ) ৪টি
(গ) ৫টি (ঘ) ৬টি।
৪। ভার্সাই সন্ধি অনুযায়ী কোন বন্দরকে মুক্ত বা আন্তর্জাতিক বন্দর ঘোষণা করা হয়Ñ
(ক) ডানজিগ (খ) লÐন
(গ) কায়রো (ঘ) কলকাতা।
৫। প্যারিস শান্তিসম্মেলনে কে চৌদ্দদফা উত্থাপন করেনÑ
(ক) লয়েড জর্জ (খ) উড্রো উইলসন
(গ) ক্লিমেনশোঁ (ঘ) ব্যালফুর।
উত্তর ১। (খ) ২। (ক) ৩। (গ) ৪। (ক) ৫। (খ)
রচনামূলক প্রশ্ন
১। প্যারিস শান্তিসম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করুন।
২। প্যারিস শান্তিসম্মেলনে স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তির বিভিন্নদিক বিশ্লেষণ করুন।
৩। প্যারিস শান্তিসম্মেলনে স্বাক্ষরিত বিভিন্নচুক্তির একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করুন।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. প্যারিস সম্মেলন কী?
২. ‘বিগ ফোর' কী?
৩. প্যারিস শান্তিসম্মেলনে কী কী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল?
৪. প্যারিস শান্তিসম্মেলনের মূল্যায়ন কর।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। ঊ.ঐ. ঈধৎৎ: ওহঃবৎহধঃরড়হধষ জবষধঃরড়হং নবঃবিবহ ঃযব ঃড়ি ডড়ৎষফ ডধৎ.
২. ঈড়ৎহবিষষ জউ : ডড়ৎষফ ঐরংঃড়ৎু রহ ঃযব ঞবিহঃরবহঃয ঈবহঃঁৎু.
৩. এ,এইচ কার : দুই মহাযুদ্ধের অন্তবর্তীকালীন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক(বাংলা একাডেমি)

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]