দুই মহাযুদ্ধের অন্তবর্তীকালীন ইউরোপ
মহামন্দা


দুই মহাযুদ্ধের অন্তবর্তীসময়ে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে মহামন্দা (ঞযব এৎবধঃ উবঢ়ৎবংংরড়হ) অর্থনৈতিক
মন্দা মানে গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিপর্যয়, অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিতে ছেদ। ১৯২৯ সালের
অক্টোবর মাসে এই মহামন্দার সূচনা হয়। এটা বিস্ময়কর যে, পাশ্চাত্যের কোনো নেতা বা অর্থনীতিবিদ
ভাবতে পারেননি যে, অর্থনীতিতে এরকম একটি সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। উপরন্তুমার্কিন
প্রেসিডেন্ট হার্ভার্ডহুভার ১৯২৯ সালেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন এই বলে যে, "ও যধাব হড় ভবধৎ
ধনড়ঁঃ সু পড়ঁহঃৎু'ং ভঁঃঁৎব" এই আশাবাদ শুধুমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রনয়, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিরও
ছিল। কিন্তুদেখা গেল ১৯২৯ সালের ২৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার মহামন্দার শুরু হয়। পাশ্চাত্যের
সমকালীন ইতিহাসে এই দিনটি কালো বৃহস্পতিবার (ইষধপশ ঞযঁৎংফধু) নামে পরিচিত। ঐ দিন
নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট স্টক এক্সচেঞ্জটি (ডধষষ ঝঃৎববঃ ঝঃড়পশ ঊীপযধহমব) হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে
যায়। শেয়ারের দাম এতই নি¤œগামী হয়েছিল যে, স্টক এক্সচেঞ্জটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন
উদ্যোক্তারা। ঐতিহাসিক এ,এইচ কারের মতে, “১৯২৯ সালের শরৎকালে ইউরোপে মার্কিন ঋণের
স্থগিতকরণ ছিল এ সংকটের প্রথম বহিঃপ্রকাশ এবং খুব শীঘ্রই সমগ্রবিশ্বজুড়ে ক্রয় ক্ষমতা একেবারে
শুকিয়ে যায়Ñ যার পরিণতি হল সার্বিক ও সর্বনাশা মূল্যহ্রাস।”
কেন মহামন্দা?
সাম্প্রতিক পৃথিবীর অর্থনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল বিষয়টি হল মহামন্দা। কতকগুলো কারণ ও
সূচককে ভিত্তি করে গবেষকরা ১৯৩০ দশকের অর্থনৈতিক সংকটকে মহামন্দা বলে অভিহিত
করেছেন।
প্রথমত, প্রথম মহাযুদ্ধের পর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমৃদ্ধ ও পুঁজিবাদী দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
উত্তরণ ঘটে। অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশ তার উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই যখন এই সমৃদ্ধ পুঁজিবাদী দেশে
বিপর্যয় শুরু হয়, তখন সমগ্রপুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তা ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় মহামন্দা। ঝড়ের বেগে এই
অর্থনৈতিক সংকট গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে গ্রাস করে ফেলে।
দ্বিতীয়ত, রেনেসাঁসের পরবর্তীকালে পশ্চিমা বিশ্বে পুঁজিবাদের বিকাশ শুরু হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার
বিকাশের একটি স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে, মাঝে মাঝে এতে মন্দা সৃষ্টি হয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি হচ্ছে
সমৃদ্ধ ও সংকটের একটি চক্র, যার ফলে পালাক্রমে আসে মন্দা। যেমন ১৬২০Ñ২৫-এ ইংল্যান্ডে মন্দা
হয়। ১৮৭০ এর দিকে ইউরোপে মন্দা দেখা দেয়। উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে পাশ্চাত্য বিশ্বএই মন্দা
কাটিয়ে ওঠে। তবে আগের মন্দাগুলোকে ছাড়িয়ে যায় ১৯২৯ সালের মহামন্দা। এতবড় সংকট আগের
মন্দাগুলোতে লক্ষ্য করা যায়নি। তখন এত কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়নি, এত বেকার সমস্যা দেখা
যায়নি, ইউরোপ ও আমেরিকার নেতৃবৃন্দকে প্রচÐ অসহায় মনে হচ্ছিল।



কতগুলো গুরুত্বপূর্ণসূচক প্রমাণ করে যে, এটি মহামন্দা ছিল। প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক ব্যবস্থার কথা
বলা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে১৯২৯Ñ৩৫ সালে পাঁচ হাজার দেউলিয়া ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়। এর অর্থ
হচ্ছে সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাÐ স্থবির হয়ে যাওয়া।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় গাড়ি কোম্পানি ছিল জেনারেল মটরস (এবহবৎধষ গড়ঃড়ৎং) ১৯২৯ সাল
পর্যন্তএই কোম্পানি প্রতি বছর পাঁচ মিলিয়ন গাড়ি তৈরি করতো, কিন্তু১৯৩২ সালে এতে দেখা যায়
যে, কোম্পানি মাত্র ২০৫ মিলিয়ন গাড়ি তৈরি করে। অর্থাৎ দেশে ও বহিঃর্বিশ্বে তাদের বাজার পড়ে
যায়।
এসব দৃষ্টান্তশুধুযুক্তরাষ্ট্রেনয়, দেখা যাচ্ছে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ছোট ব্যাংকগুলোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সবচেয়ে জটিল ও কঠিন অবস্থা সৃষ্টি হয় জার্মানি ও অস্ট্রিয়ায়। অস্ট্রিয়ায় সবচেয়ে বড় ব্যাংক ক্রেডিট
আনস্টল্ট (ঈৎবফরঃ অহংঃষধঃ) দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হয়ে যায় ১৯৩১ সালের মে মাসে। একই সময়ে
জার্মানির সবচেয়ে বড় ব্যাংক ড্রামাস্টেডার (উৎধসংঃধফবৎ) এবং ন্যাশনাল ব্যাংক (ঘধঃরড়হধষ ইধহশ)
দেউলিয়া হয়ে যায়। একইভাবে পুঁজিবাদী বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ওয়াল স্ট্রিট স্টক এক্সচেঞ্জ-এর ঘটনার
প্রভাবে ভেঙ্গে পড়ে। পাশাপাশি এসব দেশের বাৎসরিক শিল্প উৎপাদনের হারও প্রকটভাবে কমে
আসতে থাকে। সারণি এক-এ বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হলো।
সারণি-এক
বিভিন্নদেশে শিল্পোৎপাদন পরিস্থিতি
বছর শতকরা হার
১৯২৯ ১০০%
১৯৩০ ৮৬.০৫%
১৯৩১ ৭৪.৮%
১৯৩২ ৬৩.৮%
অথচ ১৯২৯ সালের আগে উৎপাদনের হার গড়ে ৭% বৃদ্ধি বা হ্রাস পেয়েছিল। সারণি এক বিশ্লেষণ
করলে দেখা যায় যে, ১৯২৯ সালের তুলনায় ১৯৩২ সালে এসে উৎপাদন প্রায় ৩৭% কমে গিয়েছিল।
যখন কলকারখানায় উৎপাদন কমে যায়, একইভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও হ্রাস পায়। সারণি দুই-এ
বিষয়টি তুলে ধরা হল।
সারণি-দুই
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্রমহ্রাসমান প্রবণতা
বছর বাণিজ্যের পরিমাণ
১৯২৯ ৬৮.৬ বিলিয়ন ডলার
১৯৩০ ৫৫.৬ বিলিয়ন ডলার
১৯৩১ ৩৯.৭ বিলিয়ন ডলার
১৯৩২ ২৬.৬ বিলিয়ন ডলার
১৯৩৩ ২৪.২ বিলিয়ন ডলার।
সারণিÑ দুই-এ লক্ষ্য করা যায় যে, ক্রমাগতভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হ্রাস পাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয়
কত জটিল ছিল এই মন্দা। এই মহামন্দা অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিশেষজ্ঞদের নিকট
একটি জটিল ও রহস্যপূর্ণবিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছে। কারণ ২০ এর দশকের প্রথম দিকে
পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশের অর্থনীতি ছিল স্বাভাবিক।


মহামন্দার কারণসমূহ
(ক) শিল্প খাতের প্রসার ঃ প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে শিল্প খাতের ব্যাপক প্রসার হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড়
পুঁজিবাদী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পখাতে উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। যখন যুদ্ধ বন্ধ হয়, তখনও অতি
উৎপাদন চলতে থাকে। কিন্তুতখন বাজারের অভাব দেখা দেয়। ফলে শিল্পখাতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়।
কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়, নজিরবিহীন বেকার সমস্যার সৃষ্টি হয়।
(খ) পুঁজিবাদের সংকট ঃ যখন কোনো পুঁজিবাদী বিনিয়োগকারী মুনাফা অর্জনের আশা দেখেন তখন সে
বিনিয়োগ করে না, ফলে নতুন শিল্প স্থাপিত হয় না। দুষ্টচক্রের আবর্তেপড়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতি। এই
দুটি সাধারণ লক্ষণের পাশাপাশি আরও কতগুলো গভীর ও সূক্ষèকারণ ছিল।
এক. অভ্যন্তরীণ কারণ ঃ কৃষি পণ্যের আকস্মিক মূল্যহ্রাস
কেন কৃষি পণ্যের মূল্য কমে গেল? সহজে বলতে গেলে বলা যায়, অতি উৎপাদনের কারণে এই মূল্য
হ্রাস ঘটে। যুদ্ধের সময়ে অন্যান্য খাতের মতো কৃষি খাতেও অতি উৎপাদন ঘটে। কিন্তুযুদ্ধের পর দেখা
গেল চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি। যে কারণে কৃষি পণ্যের আকস্মিক মূল্য হ্রাস ঘটে।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে উৎপাদন পদ্ধতিকে আধুনিকায়ন করা হয়। জরুরি পরিস্থিতিতে অনেক বেশি
খাদ্য উৎপাদনের জন্যে যন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়া হয়। প্রয়োজনের তাগিদে উদ্ভাবিত নতুন
নতুন প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। যুদ্ধের পরও কিন্তুএই অতি উৎপাদন থেমে থাকেনি।
ফলে কৃষিপণ্যের জন্যে বাজারের সংকট দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও বাজার ছিল না। কারণ প্রথম
মহাযুদ্ধের পর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের খাদ্যের প্রয়োজন ছিল না। ১৯৩০ সালের আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন
ছিল খাদ্য ঘাটতির দেশ। কিন্তু১৯৩০ সালে দেশটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণহয়ে উঠে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের
বিশাল বাজার হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দেশ নির্বিশেষে
কৃষিপণ্যের অতি উৎপাদন কৃষি পণ্যের আকস্মিক মূল্য হ্রাস সৃষ্টি করে।
দুই. আন্তর্জাতিক কারণ
যদি কিছুঅর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেয়া হতো তাহলে ছয়তোবা পরিস্থিতি এত জটিল হতো না। বরং এর
সাথে যুক্ত হয়েছিলো কতগুলো আন্তর্জাতিক কারণ। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হুভারের
আত্মজীবনী থেকে। হুভার হার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “অভ্যন্তরীণ কারণের সাথে কিছু
আন্তর্জাতিক কারণ সংযুক্ত না হলে কিছুপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এই মহামন্দা কাটিয়ে উঠা যেতো।”
১৯৩১ সালের ৩১ এপ্রিল থেকে এই মন্দা পরিস্থিতির সাথে আন্তর্জাতিক কারণগুলো যুক্ত হয়। এগুলো
হলোÑ
(ক) ক্ষতিপূরণ ও আন্তঃমৈত্রীয় ঋণ ঃ প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে মিত্র ও সহযোগী শক্তির মধ্যে ঋণের
আদান প্রদান হয়। তবে প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশগুলোকে ঋণ দিয়েছে।
অন্যদিকে প্রথম মহাযুদ্ধের পর ভেঙ্গে পড়া জার্মানিকে অর্থসাহায্য ও ঋণ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাই
ক্ষতিপূরণ ও আন্তঃমিত্রশক্তি ঋণ মন্দা পরিস্থিতিকে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থাকে
জটিল করে তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সংকটের ফলে ইউরোপীয় দেশগুলোর ঋণ লাভের
সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছিলো। ফলে ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি পায় ও শিল্পে বিনিয়োগের জন্য অর্থাভাব দেখা
দেয়। নি¤েœর চিত্রের সাহায্যে এই জটিলতাকে দেখানো যেতে পারে।


অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া টাকাই আবার যুক্তরাষ্ট্রেফেরত আসছিলো, যার ফলে বিনিয়োজিত টাকার
কোনো মুনাফাই যুক্তরাজ্য পায়নি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পুঁজির সংকট দেখা দেয়।
(খ) অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ ঃ এ সময়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ
মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এর ফলে অনেক খাদ্য ঘাটতির দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণহয়ে উঠে। ফলে খাদ্য
রফতানিকারক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রখাদ্য রফতানি করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রেমন্দা পরিস্থিতি আরো
জটিল আকার ধারণ করে। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধিকার রক্ষা এবং
সংরক্ষণ নীতি। ফলে এ সময় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ লক্ষণীয়ভাবে প্রকট ছিল। এ
বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপ্রথম দৃষ্টান্তছিল। বড় আকারে এবং কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্যে
১৯৩০ সালে পাস হয় “স্মুট হলি আইন”। এ আইনে কৃষি পণ্যের আমদানির ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ
থেকে বাড়িয়ে ৩৪ শতাংশ করা হয়। অন্যান্য সাধারণ যে কোনো পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক ৩৩১/২
থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালি একই
রকম আইন করে। যার ফলে আমদানি নিয়ন্ত্রণ এসব দেশে কঠোর হয়। ফলে অনুন্নত ও দরিদ্র
দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্তহয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ে, আর দীর্ঘায়িত হয় মহামন্দা।
(গ) আন্তর্জাতিক অর্থবাজার নিয়ন্ত্রণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনভিজ্ঞতা ঃ প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত
ব্রিটেনের মুদ্রা পাউন্ড বিশ্ব অর্থনৈতিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের পর
বিশ্বরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। টিউডর
আমল থেকে প্রায় সাড়ে তিনশত বছরের অভিজ্ঞতা ছিল ব্রিটেনের। কিন্তুহঠাৎ করে বিশ্বরাজনৈতিক ও
অর্থনৈতিক বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পায় যুক্তরাষ্ট্র। এজন্যে অনেক আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিশেষজ্ঞ বলেন
যে, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাব সংকট ঘনীভ‚ত করতে সহায়ক হয়।
(ঘ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক ব্যবস্থার ত্রট্টটি ঃ যুক্তরাষ্ট্রবিশাল ও সম্পদশালী একটি দেশ। ঐতিহ্যগত
কারণে এবং নিজস্বপ্রয়োজন না থাকায় দেশটি বাইরের বিশ্বের সাথে সম্পর্করাখতে উৎসাহী ছিল না।
কাজেই ব্যাংকগুলো অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্ষেত্রে দক্ষ ছিল। কিন্তুযখন যুক্তরাষ্ট্রআন্তর্জাতিক পর্যায়ে
নেতৃত্বের আসনে চলে আসলো, তখন এই ব্যাংক ব্যবস্থা নিজেকে মানিয়ে নিতে সক্ষম ছিল না।
পরিশেষে বলা যায়, যতটা না অভ্যন্তরীণ কারণ জড়িত ছিল, তারচেয়ে বেশি দায়ী ছিল আন্তর্জাতিক
কারণ। এর সাথে প্রথম মহাযুদ্ধের সম্পর্কতেমন একটা নেই। এটি সৃষ্টি হয়েছিল মূলত পুঁজিবাদী
ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সংকট ও দুর্বলতা থেকে।
মহামন্দার ফলাফল
মহামন্দার দুটো ফলাফল লক্ষ্য করা যায়। একটি সামাজিক অন্যটি অর্থনৈতিক। সে সময়ে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রও পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী দেশে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। এ ধরনের বেকার
সমস্যা আগে আর কখনও দেখা যায়নি। ১৯৩৩ সালের মার্চমাসে যুক্তরাষ্ট্রেবেকারের সংখ্যা ছিল ১৪
মিলিয়ন অর্থাৎ মোট শ্রমিকের একতৃতীয়াংশ বেকার ছিল। জার্মানিতে বেকারের সংখ্যা ছিল দুইতৃতীয়াংশ এবং ব্রিটেনে ৩ (তিন) মিলিয়ন।
যুক্তরাষ্ট্র ঋণ জার্মানি
ব্রিটেন
ফ্রান্স
জার্মানি
মিত্রশক্তি


পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যারা এক নামে পরিচিত ছিল তাদের অবস্থা ছিল অত্যন্তনাজুক। গোটা পশ্চিমী
দুনিয়ায় অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। যুদ্ধের ফলে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি এসব পরাজিত দেশের
অবস্থা ছিল ভয়াবহ। এসব দেশে জীবনকে বলা হতো জীবাস্মৃত (খরারহম উবধঃয)।
রাজনৈতিক ফলাফল
সাধারণত একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হয়ে গেলে রাজনৈতিক অবস্থাও হয়ে যায় জটিল ও
সংকটময়। কারণ সকল রাজনৈতিক কর্মকাÐের মূলে রয়েছে অর্থনীতি। বড় বড় পুঁজিবাদী দেশে
রাজনৈতিক প্রভাব পড়ে দ্রæত। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হার্ভাট হুভার। তিনি ১৯৩২ সালে
নির্বাচনে ডেমোক্রেট এফ.ডি. রুজভেল্ট এর কাছে পরাজিত হন। অথচ হুভার ছিলেন আমেরিকার
একজন জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি।
ইংল্যান্ডেও মহামন্দার কারণে একটি রাজনৈতিক তোলপাড় হয়েছিল। ঐ সময় ক্ষমতায় ছিল শ্রমিকদল।
দু'বছর চেষ্টা করেও ব্যর্থহয়ে শ্রমিকদল নিজেদের সরকার বাতিল করে। সংকট মোকাবিলার জন্যে
তৎকালীন শ্রমিকদল, কনজারভেটিভ পার্টিও উদারপন্থী দল মিলে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন
করে। ইংল্যান্ডে এ সময় ফ্যাসিবাদী দলের সমর্থন বাড়ছিলো। কিন্তুজাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়
দেশটি সংকট উত্তরণে সফল হয়।
ফ্রান্সের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে ঘন ঘন সরকার বদল হয়, কিন্তুমৌলনীতির কোনো পরিবর্তন
হয় না। তখন ক্ষমতায় ছিল একটি বামপন্থী দল। ১৯৩২ সালে বামপন্থী সরকার বেকার সমস্যার
সমাধানে ব্যর্থ হলে একটি কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় আসে। ১৯৩৪-এ আস্থা-অনাস্থা প্রস্তাবের
মাধ্যমে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হয়Ñ গণতন্ত্রের ক্ষতি না হলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়।
একই সময়ে ফ্রান্সে ডানপন্থী ও ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো শক্তি সঞ্চয় করে।
স্পেনে এ সময় ধর্মভিত্তিক, দক্ষিণপন্থী, সামরিক শক্তি ক্ষমতায় আসার জন্যে তুমুল আন্দোলন শুরু
করে। এ কারণে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ১৯৩৯ সালে গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে জেনারেল ফ্রাংকো ক্ষমতায়
আসেন।
মহামন্দার ফলে জার্মানিতে হিটলারের ক্ষমতা লাভ সহজ হয়। তবে মহামন্দার ফসল হিসেবে তিনি
ক্ষমতায় যান ধারণাটি সঠিক নয়। ১৯১৯ সালে জার্মানির উপর যে অন্যায় চুক্তি চাপিয়ে দেওয়া হয় তার
বিরুদ্ধে সত্যিকার প্রতিরোধ গড়ে তোলে নাৎসি দল। জার্মানির জনগণ এটাকে তাদের মৃত্যুর পরওয়ানা
হিসেবে ধরে নেয়। জার্মানি রূঢ়ভাবে আক্রান্তহওয়ার পর নাৎসিদলের জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়।
১৯৩২ সালে মহামন্দার সময়ে নির্বাচনে হিটলারের জনপ্রিয়তার মাত্রা ছিল কম। কিন্তু১৯৩৩ সালে
তিনি ক্ষমতায় আসার পূর্বেজার্মানির উপর মিত্র শক্তির অবিচারের ইস্যুটিকে কাজে লাগান অর্থাৎ
জনগণের নেতিবাচক সমর্থন লাভে সক্ষম হন তিনি।
মহামন্দার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচিত হয়। অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে একনায়কত্ত¡,
ঘনীভ‚ত হয় রাজনৈতিক সংকট এবং একনায়কদের আগ্রাসী নীতির কারণে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন।
১। মহামন্দার সূচনা হয়েছিল ১৯২৯ সালের ২৪ অক্টোবরÑ
(ক) রবিবার (খ) সোমবার
(গ) বুধবার (ঘ) বৃহস্পতিবার।
২। জেনারেল মটরস কোনো দেশের কোম্পানিÑ
(ক) যুক্তরাষ্ট্র (খ) ফ্রান্স
(গ) ব্রিটেন (ঘ) রাশিয়া।
৩। ক্রেডিট আনস্টল্ট কোনো দেশের ব্যাংকÑ
(ক) ব্রিটেন (খ) অস্ট্রিয়া
(গ) হাঙ্গেরি (ঘ) জার্মানি।
৪। মহামন্দার কারণে ১৯২৯ সালের তুলনায় ১৯৩২ সালে পাশ্চাত্য বিশ্বের শিল্পোৎপাদন কমেছিলÑ
(ক) ১৭% (খ) ২৭%
(গ) ৩৭% (ঘ) ৪৭%।
৫। মহামন্দার ফলে বেড়ে যায়Ñ
(ক) চাকুরি (খ) ব্যবসা-বাণিজ্য
(গ) খেলাধূলা (ঘ) বেকার সমস্যা।
উত্তর ১। (ঘ), ২। (ক), ৩। (খ), ৪। (গ), ৫। (ঘ)।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। মহামন্দা সম্পর্কেআপনার ধারণা ব্যক্ত করুন।
২। মহামন্দার কারণগুলো বিশ্লেষণ করুন।
৩। মহামন্দার ফলাফল কি হয়েছিল।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১. ঊ.খরঢ়ংড়হ: ঊঁৎড়ঢ়ব রহ ১৯ঃয ধহফ ২০ঃয ঈবহঃঁৎু.
২. জ.ঙ. চধীঃড়হ: ঊঁৎড়ঢ়ব রহ ঃযব ঞবিহঃরবহঃয ঈবহঃঁৎু.
৩. ই.এইচ.কার: দুই মহাযুদ্ধের অন্তবর্তীকালীন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস (বাংলা একাডেমি)

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]