ইতালিতে ফ্যাসিস্ট দলের উত্থানের পটভ‚মি আলোচনা করুন।
বেনিতো মুসোলিনির উত্থান, ক্ষমতা দখল এবং একনায়কতন্ত্রপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিশ্লেষণ করুন।


ইতালিতে গণতন্ত্রের পতন এবং স্বৈরতন্ত্রবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির উদ্ভব প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপের
ইতিহাসের অন্যতম প্রধান ঘটনা। যুদ্ধ-পরবর্তী ইতালির অবস্থা নানাদিক থেকেই শোচনীয় ছিল।
দ্রæতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব এবং শিল্পে অনগ্রসরতার কারণে ইতালির
জনসাধারণ এক ধরনের হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। তারা উদারপন্থিসরকারের প্রতি আস্থা
হারিয়ে ফেলে। ইতালিবাসী এমন একটি সরকার চেয়েছিল যা তাদের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে
সক্ষম হয়। এই পরিস্থিতিতে ইতালিতে সর্বাত্মকবাদী এবং উগ্রচরমপন্থী দল হিসেবে ফ্যাসিস্ট দল
ক্ষমতা দখল করে।
এক. ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের কারণ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীপরিস্থিতিই ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের জন্য দায়ী ছিল। এর কারণগুলো
ছিল নি¤œরূপ:
সাম্রাজ্য বিস্তারের আশায় ইতালি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষে যোগ দিয়েছিল। মিত্রপক্ষ অঙ্গীকার করেছিল
যে ট্রেনটো, ট্রেয়েস্ট, ফিউম এবং ডালমাশিয়া উপক‚লে ইতালির প্রাধান্য স্বীকৃত হবে এবং
আলবেনিয়াকে ইতালির সংরক্ষিত দেশ হিসেবে গণ্য করা হবে। কিন্তুযুদ্ধ শেষ হবার পর মিত্রপক্ষ এসব
প্রতিশ্রæতি যথাযথভাবে পূরণ করেনি। ভার্সাই সন্ধি ইতালির সাম্রাজ্যবাদী আকাক্সক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ
হয়। প্যারিস শান্তিসম্মেলনে ক্ষতিপূরণ প্রশ্নেও ইতালিকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে ইতালির জনগণ ধরে
নেয় যে, ভার্সাই সন্ধির দ্বারা তাদেরকে প্রতারিত করা হয়েছে, দাবি আদায়ে ব্যর্থসরকার সাধারণ
মানুষের চোখে অক্ষমতার প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হয়। উগ্রজাতীয়তাবাদীরা প্রচার করতে শুরু করে
যে বর্তমান উদারপন্থী সরকার ইতালিবাসীর আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে অক্ষম। এভাবে ভার্সাই সন্ধি
ইতালিতে এক উগ্রজাতীয়তাবাদী মনোভাবের জন্ম দেয় যা শেষ পর্যন্তফ্যাসিস্ট শক্তিতে পরিণত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে দারুণ অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়,
আর্থিক সংকট চরমে ওঠে এবং দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধ ফেরত সৈন্য, কারখানা শ্রমিক,
চাকুরিজীবীসহ সকলেই কাজের অভাবে বেকার হয়ে পড়ে। ফলে দেশে ধর্মঘট ও অরাজকতার সৃষ্টি
হয়। সমগ্রদেশব্যাপী শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হয়। এই দুর্দশা মোকাবিলায় তৎকালীন উদারতন্ত্রী সরকার
চূড়ান্তভাবে ব্যর্থহয়।
ইতালিতে অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগে সমাজতান্ত্রিক দল প্রচার করতে শুরু করে যে সমাজতন্ত্র
প্রতিষ্ঠাই মুক্তির একমাত্র পথ। তাদের প্রচারণায় কৃষক ও শ্রমিকরা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। এর ফলে
কৃষকেরা জমিদারদের কাছ থেকে জমি এবং শ্রমিকরা মালিকের হাত থেকে কলকারখানা দখল করতে
শুরু করে। সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নিরন্তর ধর্মঘট, রাস্তাঘাটে খÐযুদ্ধ, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নামে



সর্বহারা শ্রেণীকে ক্ষেপিয়ে তোলার ফলে উদারতন্ত্রী সরকার অসহায় হয়ে পড়ে। ইতালির শিল্পপতি ও
বুর্জোয়া শ্রেণী উদারতন্ত্রী সরকারের উপর আস্থা হারিয়ে একটি শক্তিশালী সরকার দ্বারা তাদের স্বার্থ
রক্ষার কথা চিন্তা করে।
দুই. ফ্যাসিস্ট দল গঠন এবং ফ্যাসিস্ট কর্মসূচি
ইতালিতে এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে আবির্ভাব হয় বেনিতো মুসোলিনির। ১৮৮৩ সালে মুসোলিনি
উত্তর ইতালির রোমনাত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেন এবং
এরপর তিনি ভাগ্যানে¦ষণে সুইজারল্যান্ড চলে যান। সমাজতান্ত্রিক দলের সাথে যুক্ত থাকায় সেখান থেকে
তিনি বহিষ্কৃত হন। দেশে ফিরে তিনি সমাজতন্ত্রী দলে যোগ দেন এবং ১৯১২ সালে ‘অভান্তি' নামে
একটি সমাজতন্ত্রী পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রথম মহাযুদ্ধে ইতালির যোগদান করাকে
সমর্থন করায় সমাজতন্ত্রীরা তাকে বহিষ্কার করে এবং তিনি ‘অভান্তি' থেকে বিতাড়িত হন। তখন তিনি
নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশ করে ইতালির যুদ্ধে যোগদানের পক্ষে জনমত গঠন করতে থাকেন। এই
সময় তিনি এ বিষয়ে বিভিন্নস্থানে বক্তৃতা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে মিলান শহরে যুদ্ধে
কর্মচ্যুত সৈনিক এবং অন্যান্য দেশ প্রেমিক মানুষের এক সম্মেলন আহŸান করেন। এ সম্মেলনেই যুদ্ধ
ফেরত বেকার সেনা এবং বেকার যুবকদের নিয়ে মুসোলিনি এক আধা সামরিক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী
গঠন করেন। তিনি এর নাম দেন ফ্যাসিস্ট। ফ্যাসিস্ট শব্দটি মূলত ল্যাটিন ঋধংপরড় শব্দ হতে উদ্ভূত।
ঋধংপরড় কথাটির অর্থহলো বল বা শক্তি। আবার এর অন্য অর্থহচ্ছে আঁটি (ইঁহফষব)।
ফ্যাসিস্ট দলের নেতা বেনিতো মুসোলিনির মতবাদই ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ হলো একটি স্বতন্ত্রবিশ্বাস।
ফ্যাসিবাদে রাষ্ট্রেব্যক্তিসত্ত¡ার কোনো মূল্য নেই এবং রাষ্ট্র, জাতি ও সমাজ হতে অভিন্নএক সংগঠন।
ব্যক্তিগত জীবনের উত্থান পতনে জাতীয় জীবনের গতি কোনোক্রমেই ব্যহত হয় না। ফ্যাসিবাদের
মূলমন্ত্র‘রাষ্ট্রই সকল শক্তির আধার'। এক কথায় ফ্যাসিবাদে গণ-সার্বভৌমত্বের স্থান নেই। ফ্যাসিস্ট
দলের কর্মসূচির মধ্যে ছিল শিল্পে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব, শ্রমিক কল্যাণে আইন প্রণয়ন, অস্ত্রশস্ত্রের
কারখানা জাতীয়করণ, চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, ধনিক শ্রেণীর উপর কর বসানো ইত্যাদি।
ফ্যাসিবাদীরা দেশবাসীর নিকট প্রাচীন ইতালির ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করার জন্যে আবেদন জানায়। এরা
কমিউনিজ্ম এর বিরোধী ছিল। ফ্যাসিবাদীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কর্মসূচি বস্তুত
অগণতান্ত্রিক ও বিপ্লববাদী হলেও তা উগ্রজাতীয়তাবাদী ছিল। মুসোলিন ফ্যাসিবাদী আন্দোলনকে পার্টি
বিহীন একটি জাতীয় আন্দোলন বলে অভিহিত করেন। ১৯১৯ সালের পর থেকে ফ্যাসিস্ট দল
উত্তরোত্তর জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। যুব সমাজ ও সৈনিকরা এ দলের কর্মসূচির প্রতি আকৃষ্ট হয়।
সামরিক কায়দায় দলের সংগঠন গড়ে ওঠে। মুসোলিনি ঘোষণা করেন যে, তিনি অরাজকতা ও
বিশৃ´খলা থেকে দেশকে মুক্ত করবেন এবং কমিউনিজ্ম দূর করবেন। ফ্যাসিবাদীগণ কালো পোশাক
পরতো এবং সামরিক কুচকাওয়াজ ও নিয়মানুবর্তিতা ফ্যাসিবাদী সংঘের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। সামরিক
কুচকাওয়াজের ফলে ফ্যাসিবাদীদের মধ্যে সৈনিক সুলভ অভিজ্ঞতা ও যুদ্ধ মনোভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে।
অল্প সময়ের মধ্যে ফ্যাসিবাদীগণ একটি সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সৈন্যবাহিনী গঠন করে। এরপর শুরু হয়
ফ্যাসিবাদী ও সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে প্রকাশ্য সংঘর্ষ। সমাজতন্ত্রীদের সভা সমিতি ও এদের কার্যকলাপের
উপর ফ্যাসিবাদীদের আক্রমণ চলে। প্রকাশ্যে সমাজতন্ত্রী নেতাগণকে ভীতি প্রদর্শন ও অনেক ক্ষেত্রে
হত্যা করা হতে থাকে। সরকার পক্ষ নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করে প্রকারন্তরে ফ্যাসিবাদী
আন্দোলনকে সহায়তা করতে থাকে। ১৯২০ সালে সমাজতন্ত্রী শ্রমিকরা ব্যাপক ধর্মঘটের মাধ্যমে
কলকারখানাগুলো দখল করে নেয়। বলশেভিক বিপ্লবের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারায়
জনসাধারণ ফ্যাসিস্ট দলের মুখাপেক্ষী হয়। সমাজতন্ত্রবিরোধী শিল্পপতি, জমিদার ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়
অযোগ্য সরকার অপেক্ষা মুসোলিনির সমর্থনে এগিয়ে আসে। সম্রাট ভিক্টর ইমানুয়েলও পরোক্ষভাবে
ফ্যাসিস্ট দলের প্রতি আস্থাবান হয়ে ওঠেন। ইতালির ধনিক শ্রেণী ফ্যাসিস্ট দলকে ত্রাণকর্তা মনে করে
এই দলকে প্রচুর অর্থ সাহায্য দেয়। এভাবে ফ্যাসিস্টরা কমিউনিজম বিরোধী আন্দোলনে সাফল্য
দেখিয়ে ধনিক শ্রেণীর সমর্থন ও সাহায্য লাভ করে দ্রæত শক্তিশালী হয়ে ওঠে।


ফ্যাসিবাদের প্রধান লক্ষ্য ছিলÑ
(১) রাষ্ট্রের মর্যাদা বৃদ্ধি করা;
(২) ব্যক্তিগত ধন সম্পত্তি রক্ষা করা;
(৩) ইতালিকে বিশ্বরাষ্ট্রেউন্নীত করার উপযোগী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা এবং
(৪) দেশ থেকে সমাজতন্ত্রদূর করা।
তিন. মুসোলিনির ক্ষমতা দখল এবং একনায়কতন্ত্রপ্রতিষ্ঠা
১৯২২ সালে মুসোলিনি রাজধানী রোম দখলের জন্য হাজার হাজার ফ্যাসিস্ট স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে রোমের
উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সরকারের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে ফ্যাসিবাদ খুবই জনপ্রিয় ছিল। রাজা তৃতীয়
ভিক্টর ইমান্যুয়েল সৈন্য বাহিনীকে এই বিদ্রোহীদের দমনের জন্যে নির্দেশনা দেয়ায় নির্বাচিত বৈধ
মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। ভিক্টর ইমান্যুয়েল মুসোলিনিকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। এভাবে ইতালিতে
ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়।
মুসোলিনি প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসলেও পরবর্তীকালে তিনি একজন পরিপূর্ণস্বৈরশাসকে
পরিণত হন। মুসোলিনি জরুরি ক্ষমতার সাহায্যে সরকারি প্রশাসন ও অন্য সকল দপ্তরে ফ্যাসিকরণ
নীতি চালুকরেন। সকল বিরোধী দলকে কঠোর হাতে দমন করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, স্থানীয়
স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিলুপ্ত করা হয়। নির্বাচন সংক্রান্তআইনগুলো ফ্যাসিস্ট দলের
অনুক‚লে নতুন করে প্রণয়ন করা হয়। চেম্বার অফ ডেপুটিস নামক প্রতিনিধিমূলক প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত
করে ২২টি প্রতিষ্ঠানের একটি কাউন্সিল গঠন করা হয়। ১৯২৫ সালে তিনি নেতা উপাধি নিয়ে
ডিরেক্টরে পরিণত হন। মুসোলিনি সর্বময় ক্ষমতার অধীশ্বর হন।
চার. ফ্যাসিস্ট ইতালির পররাষ্ট্রনীতি
মুসোলিনির সময় ইতালির পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল ইতালির সম্প্রসারণ। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির
সকল সুযোগ নিয়ে ইতালির রাষ্ট্রীয় গৌরব বৃদ্ধি ও প্রতিপত্তি স্থাপন করাই মুসোলিনির মুখ্য উদ্দেশ্য
ছিল। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মুসোলিনি ঘোষণা করেন যে, “ফ্যাসিস্ট ইতালির প্রধানতম কর্তব্য হলো
ইতালির পদাতিক, নৌ ও বিমান বাহিনীকে সকল সময়ের জন্য প্রস্তুত রাখা। এক মুহ‚র্তের মধ্যে আমরা
যাতে পঞ্চাশ লক্ষ সৈন্যকে সামরিক সজ্জায় সজ্জিত করতে পারি। সেই দিকে আমাদের দৃষ্টি রাখতে
হবে তবেই আমাদের দাবি ও অধিকার স্বীকৃতি লাভ করবে।” মুসোলিনি যুদ্ধকেই তার পররাষ্ট্রনীতি
বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে মনে করতেন। তিনি বলতেন “আমি যুদ্ধ ভালবাসি, যুদ্ধ করা আমার
সহজাত প্রবণতা।”
সাম্রাজ্য বিস্তার ও উপনিবেশ স্থাপনের পেছনে ইতালির যুক্তি ছিল ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার স্থান সংকুলান
করা। এছাড়া শিল্পোন্নয়নের জন্য ইতালির কাঁচামালের প্রয়োজন ছিল। ভার্সাই চুক্তির দ্বারা ইতালির প্রতি
অবিচার করা, ইতালির ভৌগোলিক দাবি প্রভৃতিকে যুক্তি হিসেবে দাঁরা করান। সাম্রাজ্য বিস্তারের
ব্যাপারে প্রধান প্রতিদ্বন্দ¡ী ছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স উভয়কে পরস্পরের সাথে বিবাদে লিপ্ত করে, ব্রিটেন ও
ফ্রান্সকে জার্মানির বিরুদ্ধে নিয়োজিত করে এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিকে সম্মিলিতভাবে সোভিয়েত
রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিয়োজিত করে ইতালি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আধিপত্য স্থাপন করার ও সাম্রাজ্য বিস্তার
করার নীতি গ্রহণ করে।
একথা অনস্বীকার্য যে, মুসোলিনির একনায়কতান্ত্রিক শাসনের প্রথম দশকে ইতালির আন্তর্জাতিক
প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল। ইতালির পূর্বতন সরকারের অক্ষমতা হেতুইতালি যে সকল ভ‚খÐ হারিয়েছিল
মুসোলিনি তা উদ্ধার করতে সমর্থহন।
১৯২৩ সালে জনৈক ইতালিয় সেনাপতিকে হত্যা করার অজুহাতে মুসোলিনি গ্রিসের কুফর্‚দ্বীপ দখল
করেন। শেষ পর্যন্তলীগ অব নেশনস এর মধ্যস্থতায় তিনি মোটা ক্ষতিপূরণ নেন এবং গ্রিস ক্ষমতা প্রার্থনা

করায় তিনি কর্ফুদ্বীপ গ্রিসকে ফিরিয়ে দেন। এই ঘটনার ফলে স্বদেশবাসীর কাছে মুসোলিনির মর্যাদা
দারূণ বৃদ্ধি পায়।
১৯৩৩ সালে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি দল ক্ষমতায় আসে। মুসোলিনি হিটলারের আগ্রাসী কর্মকাÐে
উৎসাহী হয়ে ওঠেন। মুসোলিনি আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত আবিসিনীয়ার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন।
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স আফ্রিকা মহাদেশের সকল স্থান অধিকার করলেও একমাত্র আবিসিনিয়া ছিল তাদের
সাম্রাজ্যবাদী থাবার বাইরে। ১৯২৩ সালে আবিসিনিয়ার জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ লাভ করেছিল। ১৮৯৬
সালে ইতালি আবিসিনিয়া দখলের চেষ্টা করেছিল। কিন্তুএ্যাডোয়ার যুদ্ধে আবিসিনিয় ইতালিকে
পরাজিত করে। মুসোলিনি এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার লক্ষ্যে আবিসিনিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা
নেন। তিনি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কাছ থেকে আবিসিনিয় আক্রমণের জন্যে গোপন সমর্থন পান। ১৯৩৪
সালে ওয়াল-ওয়াল নামক স্থানে ইতালি ও আবিসিনীয়া সেনাবাহিনীর মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষহলে ইতালি
আবিসিনিয়া আক্রমণের অজুহাত খুঁজে পান। ১৯৩৪ সালে ওয়াল-ওয়াল নামক স্থানে ইতালি ও
আবিসিনিয়া সেনাবাহিনীর মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হলে ইতালি আবিসিনিয়া আক্রমণের অজুহাত খুঁজে
পায়। আবিসিনীয়া এই ঘটনাটি লীগ কাউন্সিলের মধ্যস্থতার জন্যে উপস্থাপন করে। লীগ কাউন্সিল
ঘোষণা করে যে, যেহেতুবিবদমান দুই রাষ্ট্রই ওয়াল-ওয়াল অঞ্চলটিকে নিজ রাজ্যভুক্ত বলে মনে করে
তাই এই ঘটনার জন্যে কোনো পক্ষকেই দায়ী করা যায় না। জাতিপুঞ্জের কাউন্সিল আবিসিনিয়া সমস্যার
চূড়ান্তসমাধান দানের পূর্বেইতালি লীগের নির্দেশ অমান্য করে ১৯৩৫ সালে আবিসিনীয়া আক্রমণ
করে। মূলত ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ইতালিকে তোষণ করার নীতি অনুসরণের ফলে ইতালি লীগের বিরুদ্ধে
অবস্থান গ্রহণে সাহস পায়। জাতিপুঞ্জ এ্যাসেম্বলী ইতালিকে যুদ্ধ অপরাধী ঘোষণা করে। ইতালির
বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে। ইতালি এই ঘটনার প্রতিবাদে জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ ত্যাগ
করে। ইতালি আবিসিনিয়াকে তার রাজ্যভুক্ত ঘোষণা করে। এই ঘটনা জাতিপুঞ্জের মর্যাদা অনেকাংশে
নষ্ট করে এবং যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিফলতা প্রমাণ করে।
এরপর ইতালি আলবেনিয়া গ্রাস করার লক্ষ্যে ব্যাংক স্থাপন করে। আলবেনিয়ার বহুবিধ অভ্যন্তরীণ
উন্নয়নের জন্যে ইতালি প্রচুর অর্থসাহায্য দিয়েছিল। এভাবে ইতালি আলবেনিয়ার উপর আধিপত্য
বিস্তারের সুযোগ পায়। ১৯২৫ সালে টিরানার সন্ধির দ্বারা আলবেনিয়া ও ইতালির মধ্যে যৌথ নিরাপত্তা
চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর ফলে যুগোশ্লাভিয়া নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কেচিন্তিত হয়। ইতালি ও
যুগোশ্লাভ সম্পর্কের অবনতি হয়। ইতোমধ্যে আলবেনিয়ার শাসক আহমদ জগু আলবেনিয়ার ক্ষমতায়
বসেন। তিনি ইতালি থেকে আলবেনিয়াকে মুক্ত করার চেষ্টা করলে মুসোলিনি ১৯৩৯ সালে আলবেনিয়া
আক্রমণ করে।
১৯৩৬ সালে মুসোলিনি স্পেনের পপুলার ফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী সেনাপতি ফ্রাঙ্কোর পক্ষ নিয়ে
স্পেনের গৃহযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট শাসন
স্থাপন করে ফ্রান্সকে বেষ্টন করা। তাছাড়া মিত্র ফ্রান্সের সহায়তায় পশ্চিম ভ‚মধ্যসাগরে ফ্রান্সের নৌ
প্রতিপত্তি তিনি ধ্বংস করার কথা ভাবেন। এজন্যে স্পেনের পপুলার ফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট
সেনাপতি জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে স্পেনের শাসন ক্ষমতা লাভে মুসোলিনি প্রত্যক্ষ সহায়তা দেন। ফ্রান্স ও
ব্রিটেন সহ ইউরোপের ২৭টি রাষ্ট্রস্পেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ না করে নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্তনিলেও
মুসোলিনি তা গ্রাহ্য করেননি। নাৎসি জার্মানি ও ইতালি স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্রাঙ্কোর পক্ষ নেয়। জেনারেল
ফ্রাঙ্কো স্পেনের গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করেন।
নাৎসি জার্মানির নেতা হিটলার মুসোলিনির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে এগিয়ে আসেন। হিটলারের উদ্দেশ্য
ছিল ফ্রাঙ্কো বৃটিশ জোটের বিরুদ্ধে নাৎসি ফ্যাসিস্ট জোট গড়ে তোলা। জার্মানির ন্যায় ইতালিকেও
ভার্সাই সন্ধির দ্বারা প্রতারিত করা হয়েছিল। কাজেই উভয়ে জোট করলে ভার্সাই স্থিতাবস্থা ভেঙ্গে ফেলা
যাবে বলে হিটলার মনে করে। মুসোলিনি হিটলারের মৈত্রী প্রস্তাবে সাড়া দেন। আবিসিনীয়া যুদ্ধের সময়
হিটলার ইতালিকে সমরাস্ত্রদিয়ে সাহায্য করে। ১৯৩৯ সালে ইতালি ও জার্মানির মধ্যে একটি
সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।


পাঁচ. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির যোগদান ও পরাজয়
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে পোল্যান্ডে জার্মান আক্রমণের প্রতিবাদে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির
বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মুসোলিনি জার্মানির ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও এই যুদ্ধে কিছুদিন নিরপেক্ষ থাকেন।
কারণ মুসোলিনিকে অগ্রাহ্য করে নাৎসি নেতা হিটলার রুশ-জার্মান চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং এ্যান্টিকমিন্টার্নচুক্তির দ্বারা জার্মানি ও ইতালি কমিউনিস্ট রাশিয়ার বিরোধিতা করার জন্যে যে নীতি নেয়,
হিটলার রুশ-জার্মান চুক্তির দ্বারা সেই নীতি থেকে বিচ্যুত হন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের গতি কোনো দিকে
যাবে তা না বুঝে মুসোলিনি জার্মানির পক্ষে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণে
উদ্যত হলে মুসোলিনি জানিয়ে দেন, আপাতত ইঙ্গ-ফরাসি মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে জার্মানিকে একাই যুদ্ধ
করতে হবে। ইতালি এখন যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত নয়। তবে শেষ পর্যন্তহিটলারের অনুরোধে জার্মানির
কারখানায় কাজ করার জন্যে কিছুশ্রমিক এবং কৃষিক্ষেত্রে কাজ করার জন্যে মুসোলিনি কিছুকৃষক
পাঠান।
হিটলার পোল্যান্ডের যুদ্ধ শেষ করে ডেনমার্কও সুইডেন দখলের পর ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের ওপর ঝাঁপিয়ে
পড়েন। ডানকার্কের যুদ্ধে ইংল্যান্ডের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ফ্রান্সের ভেতর জার্মান বাহিনী ঢুকে পড়লে
ফ্রান্সের পতন আসন্নহয়। এতদিন মুসোলিনির ধারণা হয় যে, মিত্রশক্তির পরাজয় ঘটতে চলেছে।
মুসোলিনি জার্মানির সঙ্গে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এইভাবে ইতালি দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুন হিটলার ও মুসোলিনি মিউনিক-এর বৈঠকে মিলিত
হন। মুসোলিনি নীস, কর্সিকা, ফরাসি সোমালিল্যান্ড, তিউনিসিয়া ও মাল্টা দাবি করেন। ২২ ও ২৫
জুন যথাক্রমে ফ্রান্স ও জার্মানি এবং ফ্রান্স ও ইতালির মধ্যে যুদ্ধ বিরতির শর্তাদি স্বাক্ষরিত হয়।
ইতালি বাহিনীর ক্রমাগত পরাজয়, জনসাধারণের যুদ্ধ-বিরোধী মনোভাব, নাৎসি জার্মানির প্রতি
ইতালিবাসীর ঘৃণা, অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট, বুদ্ধিজীবী ও শ্রমিক শ্রেণীর অসন্তোষ প্রভৃতি কারণে
মুসোলিনি ও ইতালির পতন আসন্নহয়ে ওঠে। ১৯৪৩ সালের ১০ জুলাই মিত্রপক্ষ সিসিলি আক্রমণ করে
এবং একই সময় রোম বিধ্বস্তকরে। ঋধপরংঃ এৎধহফ ঈড়ঁহপরষ মুসোলিনি ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে
অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং মুসোলিনিকে বন্দি করা হয়। জার্মানি মুসোলিনির সাহায্যে অগ্রসর হয়।
মুসোলিনিকে মুক্ত করে জার্মান বাহিনী ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলন নির্মমভাবে দমন করতে উদ্যোগী
হয়। কিন্তু১৯৪৫ সালে মিত্রপক্ষ উত্তর ইতালি আক্রমণ করলে ইতালিবাসী পুনরায় মুসোলিনির উপর
ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং মুসোলিনিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ইতালি মিত্রপক্ষের নিকট বিনা শর্তে
আত্মসমর্পন করে। এভাবে ফ্যাসিবাদী ইতালির পতন হয়।


পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন।
১। ১৮৮৩ সালে মুসোলিনি জন্মগ্রহণ করেন উত্তর ইতালিরÑ
(ক) রোমে (খ) রোমানাত
(গ) ফ্লোরেন্সে (ঘ) ভিনাসে।
২। মুসোলিনি সম্পাদিত পত্রিকার নামÑ
(ক) সানডে টাইমস (খ) ইকনমিস্ট
(গ) অভান্তি (ঘ) ভোগান্তি।
৩। বিশের দশকে ইতালির সম্রাট ছিলেনÑ
(ক) গ্যারিবল্ডি (খ) ভিক্টর ইমানুয়েল
(গ) অল্যান্ডো (ঘ) ক্যাভুর।
৪। ইতালি চূড়ান্তভাবে আলবেনিয়া দখল করেÑ
(ক) ১৯৩৪ সালে (খ) ১৯৩৮ সালে
(গ) ১৯৩৯ সালে (ঘ) ১৯৪০ সালে।
৫। মুসোলিনি নিহত হনÑ
(ক) ১৯৪১ সালে (খ) ১৯৪২ সালে
(গ) ১৯৪৪ সালে (ঘ) ১৯৪৫ সালে।
উত্তর ১। (খ), ২। (গ), ৩। (খ), ৪। (গ), ৫। (ঘ)
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ইতালিতে ফ্যাসিস্ট দলের উত্থানের পটভ‚মি আলোচনা করুন।
২। বেনিতো মুসোলিনির উত্থান, ক্ষমতা দখল এবং একনায়কতন্ত্রপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিশ্লেষণ করুন।
৩। মুসোলিনির পররাষ্ট্রনীতির বিবরণ দিন।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১. ঊ.খরঢ়ংড়হ ঊঁৎড়ঢ়ব রহ ঃযব ১৯ঃয ্ ২০ঃয ঈবহঃঁৎু.
২. জ.ঙ. চধীঃড়হ, ঊঁৎড়ঢ়ব রহ ঃযব ঞবিহঃরবহঃয ঈবহঃঁৎু.
৩. জড়নবৎঃ ঊ. খবৎহবৎ, ডবংঃবৎহ ঈরারষরধুধঃরড়হ, ঠড়ষ.১
৪. অসিত কুমার সেন: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস
৫. ই.এইচ.কার, দুই মহাযুদ্ধের অন্তবর্তীকালীন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস (বাংলা একাডেমি)।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]