স্পেনের গৃহযুদ্ধের বিভিন্নপর্যায় সম্পর্কেআলোচনা করুন।

৩। স্পেনের গৃহযুদ্ধের ফলাফল বর্ণনা করুন।


পটভ‚মি
ইউরোপের এক সময়ের শক্তিশালী দেশ স্পেন সব গৌরব, সমৃদ্ধি হারিয়ে উনবিংশ শতাব্দীতে এক দুর্বল
রাষ্ট্রেপরিণত হয়। সমাজ ব্যবস্থা ছিল মধ্যযুগীয় ধাঁচের। আঞ্চলিক বৈষম্য ও দ্বন্দ¡ছিল ব্যাপক। শিল্প
অনগ্রসরতার কারণে অর্থনীতি ছিল কৃষি নির্ভর। অযোগ্যতা, অর্থনৈতিকতা ও দুর্নীতি ছিল সর্বত্র
দৃশ্যমান। ১৮৯৮ সালে দক্ষিণ আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশগুলো হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় স্পেন তার
শেষ মর্যাদাটুকুহারায়। ব্রিটেন জিব্রালটার দখল করে নিলে স্পেনের জাতীয়তাবাদী ও রক্ষণশীলরা ক্ষুব্ধ
হয়। তাই প্রথম মহাযুদ্ধের সূচনা হলে তারা স্পেনকে ব্রিটেনের বিপক্ষে এবং জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগ
দিতে বলে। অন্যরা ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পক্ষে যুদ্ধে যোগদানের প্রস্তাব করে। কিন্তুরাজা ত্রয়োদশ
আলফোনসো এবং স্পেনের জাতীয় সভা কর্তেস (ঈড়ৎঃবং) নিরপেক্ষ ভ‚মিকা পালন করে। বৈদেশিক
শক্তিগুলোর মধ্যে ইতালি ও জার্মানি জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বাধীন প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রত্যক্ষ সমর্থন
দেয়। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিভিন্নদেশের উদারপন্থী জনগণ স্পেনের গণতন্ত্রী এবং
বামপন্থীদের জোট সরকারকে সমর্থন দেয়। কিন্তুগণতান্ত্রিক বিশ্বের তৎকালীন নেতৃস্থানীয় দেশ ব্রিটেন ও
ফ্রান্স নিরপেক্ষ ভ‚মিকা পালন করে। বৈদেশিক শক্তিগুলোর মধ্যে ইতালি ও জার্মানি জেনারেল ফ্রাঙ্কোর
নেতৃত্বাধীন প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রত্যক্ষ সমর্থন দেয়। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিভিন্নদেশের
উদারপন্থী জনগণ স্পেনের গণতন্ত্রী এবং বামপন্থীদের জোট সরকারকে সমর্থন দেয়। কিন্তুগণতান্ত্রিক
বিশ্বের তৎকালীন নেতৃস্থানীয় দেশ ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিরপেক্ষ ভ‚মিকা পালন করে। নি¤েœবিষয়টি
পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হল।
প্রথম পর্যায় ঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী দুই দশক কালে স্পেনের রাষ্ট্রীয় জীবনে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন
ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল অস্থির, নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র, সামরিক
একনায়কতন্ত্রও প্রজাতন্ত্রএইসব বিপরীতধর্মী শাসন ব্যবস্থা একের পর এক প্রবর্তিত হয়। পরিস্থিতি
জটিল হয়ে ওঠে। একদিকে শ্রমিক আন্দোলনের মাত্রা অসম্ভব বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে স্পেনের বিভিন্ন
অঞ্চলে উগ্রপ্রাদেশিকতা এক বিস্ফোরক অবস্থা সৃষ্টি করে। দেশের বাইরে মরোক্কোয় জাতীয়তাবাদীদের
কাছে বিশ হাজার স্পেনের সৈন্য বন্দী হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে অনুমান করে রাজা
আলফোনসো (অষভড়হংড়) স্পেনে সামরিক একনায়কতন্ত্র স্থাপনের ঘোষণা করেন। ১৯২৩ সালে
জেনারেল প্রাইমো দে রিভেরা (চৎরসড় ফব জরাবৎধ) দেশব্যাপী সামরিক একনায়কতন্ত্রস্থাপন করেন।
দ্বিতীয় পর্যায় (১৯২৩-৩১ সাল) ঃ রিভেরার দমনমূলক সামরিক শাসন ক্রমশ জনসাধারণের মধ্যে
বিক্ষোভ সৃষ্টি করে। ১৯২৮ সালের পর গণবিক্ষোভ প্রবল হয়ে ওঠে। রিভেরা পদত্যাগ করলে (১৯৩০
সাল) স্পেনের পূর্বতন শাসনব্যাবস্থা বলবৎ হয় এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে প্রজাতন্ত্রীরা বিপুল
ভোটে জয় লাভ করে এবং প্রজাতন্ত্রী দলের নেতা আলকালা জামোরা (তধসড়ৎধ) দেশে রাজতন্ত্রের
অবসান ঘটিয়ে স্পেন প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন (ডিসেম্বর, ১৯৩১ সালে)।
তৃতীয় পর্যায় (১৯৩১-৩৬ সাল) ঃ স্পেনের প্রজাতান্ত্রিক সরকার একটি আধুনিক প্রগতিশীল রাষ্ট্র
গঠনের পথে অগ্রসর হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শপ্রবর্তিত হয়। তদুপরি আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের



জন্য বিভিন্নসংস্কারমূলক কর্মসূচি গৃহীত হয়। অভিজাতদের ভ‚-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং এই সব
জমি কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। কিন্তুপ্রজাতান্ত্রিক সরকার স্পেনের বিভিন্নদল ও সামাজিক
গোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি সাধন করতে পারে নি। একদিকে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি যেমন যাজক, রাজতন্ত্রীরা
ও অভিজাতবর্গপ্রজাতন্ত্রের অবসান ও রাজতন্ত্রের পুনপ্রতিষ্ঠা কামনা করে অন্যদিকে উগ্রবামপন্থীরা
বিশেষত সিন্ডিক্যালিস্ট ও কমিউনিস্টরা সোভিয়েট রাশিয়ার অনুকরণে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনে আগ্রহী
ছিল। ১৯৩৩ সালেয় নির্বাচনে উদারনৈতিকদের পরাজয় ঘটে এবং ক্যাথালিক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীদের
সম্মিলিত দল জয়যুক্ত হয়। এই দলটির নাম (ঈধঃযড়ষরপ চড়ঢ়ঁষধৎ অপঃরড়হ চধৎঃু)। ১৯৩৬ সালের
ফ্রেরুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে স্পেনের রাজনৈতিক দলগুলি দু'টি বিবদমান গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে
পড়ে। একদিকে ছিল বাম ও গণতান্ত্রিক পপুলার ফ্রন্ট ও অন্যদিকে ক্যাথলিক ও রাজতন্ত্রীদের মিলিত
জাতীয় ফ্রন্ট। নির্বাচনে পপুলার ফ্রন্ট অধিকাংশ আসন দখল করে। ১৯৩৬ সালে এপ্রিলে ম্যানুয়েল
অজানা রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হলেন।
প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গৃহযুদ্ধের সূচনা ঃ বাম গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতা লাভের ফলে
রাজতন্ত্রের সমর্থক কর্মচারী ও সৈন্যবাহিনীর মনে প্রচন্ড ক্ষোভ সৃষ্টি করে। সমর নায়করা প্রজাতন্ত্রের
বিরুদ্ধে ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ স্পেনের ব্যাপারে হস্তুক্ষেপ না করার নীতি (চড়ষরপু ড়ভ ঘড়-ওহঃবৎাবহঃরড়হ)
গ্রহণ করল। এর শর্তানুসারে স্পেনের বিবাদমান কোনো পক্ষকেই কোনোরূপ সাহায্য না করতে
চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রবর্গসম্মত হয়। কিন্তুপ্রকৃতপক্ষে ইতালি, জার্মানি ও রাশিয়া গোপনে ও প্রকাশ্যে স্পেনের
বিবদমান দুই পক্ষকেই সাহায্য করতে লাগল। এই অবস্থায় ‘হস্তক্ষেপ নিবারণ কমিটি' (ঘড়হওহঃবৎাবহঃরড়হ ঈড়সসরঃঃবব) স্পেনে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানির চুক্তি অগ্রাহ্য করে ইতালির
যুদ্ধজাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ করল এবং স্পেন থেকে বিদেশী স্বেচ্ছাসেবকদের অপসারণ করার নির্দেশ
দিল। কিন্তুকার্যত কমিটির নির্দেশ ইতালি ও জার্মানি অগ্রাহ্য করল। জেনারেল ফ্রাঙ্কোও ‘হস্তক্ষেপ
নিবারণ' কমিটির নির্দেশ পালনে অসম্মতি প্রকাশ করলেন এবং ইতালি ও জার্মানির কাছ থেকে সাহায্য
নিতে লাগলেন।
বিদ্রোহীরা মাদ্রিদ, ভ্যালেনশিয়া ও ক্যাটালিনিয়া বিপন্ন করে তুললে স্পেন সরকারের রাজধানী
ভ্যালেনশিয়া থেকে বার্সিলোনায় (ইধৎপবষড়হধ) স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৩৭ সালে জানুয়ারি মাসে
স্পেনের প্রেসিডেন্ট অজানা প্যারিসে পলায়ন করলেন এবং বার্সিলোনার সরকারি সৈন্যবাহিনী বিনা
বাধায় আত্মসমর্পণ করে। হাজার হাজার স্পেনবাসী ও স্পেন সরকারের অনুগত সৈনিকরা ফ্রান্সে আশ্রয়
গ্রহণ করে। এই অবস্থায় স্পেনের প্রচলিত মন্ত্রিসভা জেনারেল ফ্রাঙ্কো ও তাঁর অনুগামীদের বাধা প্রদান
করার সংকল্প ত্যাগ করলেন। স্পেন সরকারের সৈন্যবাহিনীর সর্বোচ্চ সেনাপতি জেনারেল মিয়াজা
(গরধুধ) শান্তির জন্য আবেদন করলেন। এর ফলে মাদ্রিদে কমিউনিস্টরা বিদ্রোহী হ‘ল এবং
যথেচ্ছভাবে এক সপ্তাহ ধরে হত্যাকান্ড ও গোলযোগ চলল। এই অবস্থায় সেনাপতি মিয়াজা মাদ্রিদ ত্যাগ
করেন এবং ১৯৩৯ সালের মার্চমাসে জেনারেল ফ্রাঙ্কো সসৈন্যে মাদ্রিদে বিনা বাধায় প্রবেশ করেন।
ইতিমধ্যে ১৯৩৯ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ফ্রাঙ্কো কর্তৃক স্থাপিত সরকারকে স্বীকার করে
নেয়। এইভাবে স্পেনের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং স্পেনে একনায়কতন্ত্রী শাসন চালুহয়।
বিভিন্নদেশের পরস্পর বিরোধী ভ‚মিকা ঃ স্পেনের গৃহযুদ্ধের চরিত্র ও গতিধারা ইউরোপের বিভিন্ন
শক্তির পরস্পর-বিরোধী মনোভাব ও অবস্থান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। ইউরোপীয় শক্তিবর্গের অবস্থান
ছিল তিন প্রকার। (১) জার্মানি ও ইতালি সরাসরি বিদ্রোহীদের পক্ষ অবলম্বন করে প্রজাতান্ত্রিক
সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছিল। (২) ব্রিটেন ও ফ্রান্স স্ববিরোধী নীতি অনুসরণ করে এবং
নিরপেক্ষ ও নির্লিপ্ত মনোভাব গ্রহণ করে। (৩) ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একমাত্র সোভিয়েত
ইউনিয়ন গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি পূর্ণসমর্থন ও সাধ্যমত সাহায্য দান করে।
ইতালি ও জার্মানির ভ‚মিকা ঃ ইতালি ও জার্মানি উভয়েই কয়েকটি কারণে বিদ্রোহী নেতা জেনারেল
ফ্রাঙ্কোকে সামরিক উপকরণ ও সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করেছিল। প্রথমত, স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হবার
ঠিক পূর্বে ইতালি আবিসিনিয়া আক্রমণ করে, কিন্তুইতালিকে আক্রমণকারী সনাক্ত করা হলেও
জাতিপুঞ্জ ইতালির বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। যৌথ নিরাপত্তা রক্ষায়


জাতিপুঞ্জের এই চূড়ান্তব্যর্থতা ইতালি ও জার্মানিকে স্পেনে হস্তক্ষেপ করতে উৎসাহিত করে। দ্বিতীয়ত,
সমাজতন্ত্রী দলগুলি কর্তৃক সমর্থিত প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে যদি স্পেন থেকে উৎখাত করা যায় এবং
সেখানে একনায়কতন্ত্রী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তাহ'লে স্পেনে জার্মানি ও ইতালির প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক দিক থেকেও ইতালি ও জার্মানি স্পেনের আকরিক খনিজ সম্পদ আহরণ করতে
আগ্রহী ছিল এবং এর দ্বারা নিজ নিজ দেশের আর্থিক উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল। চতুর্থত,
এই গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া এইসব দেশের প্রকৃত মনোভাব ও তাদের মধ্যে
ঐক্যের সম্ভাবনা যাচাই করার সুযোগ পাওয়া গেল। পরিশেষে বলা যায়, স্পেন যদি বিদ্রোহীপক্ষ
জয়লাভ করে তাহলে ফ্যাসিস্ট শক্তিবর্গভ‚মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে এবং
গুরুত্বপূর্ণসামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা যাবে।
তবে ইতালি ও জার্মানি সমধর্মীয় মনোভাব নিয়ে স্পেনে হস্তক্ষেপ করেনি। ইতালিমূল উদ্দেশ্য ছিল
সামরিক আর জার্মানির উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক। হিটলার একদিকে যেমন মূল্যবান
আকরিক লৌহ ও তামা সংগ্রহ করে জার্মানির সামরিক প্রস্তুতির কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন,
অন্যদিকে স্পেনের গৃহযুদ্ধকে দীর্ঘসূত্রী করে ইউরোপের বিভিন্নশক্তির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখতে পারলে
জার্মানি মধ্য ইউরোপ ও পূর্বইউরোপে স্বচ্ছন্দ্যে সম্প্রসারণের দিকে এগুতে পারবে। ভ‚মধ্যসাগরীয়
সংকটে পশ্চিমী-ইউরোপীয় দেশগুলি ব্যস্তথাকায় হিটলার অবলীলাক্রমে মধ্য ও পূর্বইউরোপে দৃষ্টির
অন্তরালে অথবা বিনা বাধায় সম্প্রসারণনীতি শুরু করার সুযোগ পাবেন। অধ্যাপক টেলর মনে করেন যে,
হিটলার স্পেনের গৃহযুদ্ধে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর আপাত কূটনৈতিক লক্ষ্য ছিল ফ্রান্স ও
ইতালির বন্ধুত্বেফাটল সৃষ্টি করা। কারণ, স্পেনে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিজয়ই তার মূল লক্ষ্য ছিল না।
সোভিয়েত ইউনিয়ানের ভ‚মিকা ঃ সোভিয়েত ইউনিয়ান জার্মানি ও ইতালির মতই স্পেনের গৃহযুদ্ধে
সক্রিয় ভ‚মিকা গ্রহণ করেছিল। তবে তার লক্ষ্য ছিল প্রতিবিপ্লবী বিদ্রোহের হাত থেকে ক্ষমতাসীন
প্রজাতান্ত্রিক সরকারের অস্তিত্ব রক্ষা করা। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন আদর্শগত উদ্দেশ্যের চেয়ে
নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকেই স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করেছিল। স্পেনে ফ্রাঙ্কোর
বিদ্রোহ জয়যুক্ত হলে জার্মানি ও ইতালির শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং এর ফলে যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিধ্বস্ত
হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সাধ্যমত সাহায্য দিয়েই ক্ষান্তহয়নি, স্পেনের প্রজাতন্ত্রের সপক্ষে বিশ্বজনমত
গঠনে প্রয়াসী হয়েছিল। যদিও সোভিয়েত সাহায্যের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম ছিল,
সোভিয়েত সাহায্য না পেলে ১৯৩৬ সালের শেষ ভাগেই প্রজাতন্ত্রী সরকারের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ত
এবং ঐ সরকারের পতন হতো তথাপি ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৩৬টি উড়োজাহাজ,
৬০,০০০ রাইফেল, ৩৭২৭ মেশিনগান সরবরাহ করে। সোভিয়েত বুদ্ধিজীবী রয় মেদভেদভ (জড়ু
গবফাবফড়া) দেখিয়েছেন যে, ১৯৩৭ সালে থেকে সোভিয়েত সাহায্যের পরিমাণ বিশেষভাবে হ্রাস
পায়। ১৯৩৮ সালে সাহায্যের পরিমাণ ছিল নগন্য। মেদভেদভ মনে করে যে, স্টালিন এই সময়
রাশিয়ায় ব্যাপকহারে নির্মম দমন নিপীড়ন শুরু করেন, তাই স্পেনের গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্রে নিস্পৃহ মনোভাব
দেখান। মেদভেদভ এমনও ধারণা ব্যক্ত করেছেন যে, স্টালিন ইচ্ছাকৃতভাবে স্পেনের ফ্যাসিস্ট
বিদ্রোহকে বিধ্বস্তকরতে চাননি, কোনোা রাশিয়া জার্মানির সঙ্গে সম্পর্কবিচ্ছিন্নকরতে প্রস্তুত ছিল না।
দুঃখের বিষয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশগুলি যদি ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
গ্রহণ করতো তা'হলে শুধুমাত্র স্পেন সংকট থেকে মুক্ত হতো তা নয়, একনায়তন্ত্রী জার্মানিও ইতালির
পক্ষে বিশ্বশান্তিবিপন্নকরা সম্ভব হতো না। স্পেনের ঐতিহাসিক ডি. স্মাইথের (উ. ঝসুঃয) মতামত
হলো যে, স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সমর্থন করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পাশ্চাত্য
বিশ্বের মধ্যে মৈত্রী গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল।
ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ভ‚মিকা ঃ ব্রিটেন ও ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধে সতর্কনিরপেক্ষতামূলক অবস্থান
গ্রহণ করেছিল। ফ্রান্সের সহানুভ‚তি ছিল প্রজাতন্ত্রী সরকারের প্রতি এবং দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তেজার্মানির
মিত্র ফ্রান্সের জয়লাভ ফ্রান্সের নিরাপত্তার পক্ষে উদ্বেগের কারণ ছিল। কিন্তুফ্রান্সে এই সময় রাজনৈতিক
পরিস্থিতি স্থিতিশীল ছিল না, দক্ষিণপন্থী দলগুলি স্পেনে কমিউনিস্ট সমর্থিত প্রজাতান্ত্রিক সরকারের
প্রতিষ্ঠা সহজভাবে মেনে নেয়নি। স্বভাবতই ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী বøারম (ইষঁৎস) জাতীয় সংহতির স্বার্থে
নিরপেক্ষ থাকার নীতি অনুসরণ করা বাস্তব সম্মত বলে মনে করেছিলেন। ফ্রান্সের মনে আরও ভয় ছিল।
এস এস এইচ এল
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস - ২ পৃষ্ঠা -২৬৬
কেননা ফ্রান্স যদি প্রকাশ্যভাবে স্পেনে প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করে তাহলে ইতালি ও জার্মানির সঙ্গে প্রকাশ্য
সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে। তাই ফ্রান্স বৈদেশিক যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট হতে ঝুকি নিতে রাজি ছিল না।
ব্রিটেনেরও মনোভাব ছিল হস্তক্ষেপ-বিরোধী। ব্রিটেনের রাজনীতিতে রক্ষণশীল দলের প্রভাব ছিল ঢের
বেশি, তারা স্পেনে কমিউনিস্ট সমর্থিত ও সোভিয়েত সাহায্য প্রাপ্ত প্রজাতান্ত্রিক সরকারের প্রতি বিরূপ
মনোভাবাপন্ন ছিল। ইংল্যান্ডে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত আই, মাইস্কি (ও.গধরংশু) তাঁর প্রতিবেদনে
জানিয়েছিলেন (১ নভেম্বর, ১৯৩৬ সাল) যে, ব্রিটিশ সরকার স্পেনে প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে সাহায্য
দিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। বরং তাদের ধারণা যে ফ্রাঙ্কো জয়লাভ করলে তার উপর প্রভাব বিস্তার করে
ভ‚মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটিশ স্বার্থসুরক্ষিত করা সম্ভব হবে।
ব্রিটেনও ফ্রান্স নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করার ফলে শেষ পর্যন্তফ্রাঙ্কোর জয়লাভ অনিবার্যহয়ে ওঠে।
ঐতিহাসিক এ.জে.পি. টেলর মনে করেন, স্পেনে ফ্রাঙ্কোর বিদ্রোহের মূলে প্রধানত দায়ী ছিল ব্রিটিশ ও
ফরাসি নিস্ক্রিয়তা। টেলর মনের করেন যে, প্রজাতান্ত্রিক সরকারের সহায় সম্পদ ও জনসমর্থন দুইই
বেশি ছিল। যদি দুই বিবদমান পক্ষই বৈদেশিক সাহায্য পেতো অথবা দু'পক্ষই ঐ সাহায্য থেকে বঞ্চিত
হতো তাহলেও প্রজাতান্ত্রিক সরকারের জয় অবধারিত ছিল।
স্পেনের গৃহযুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাষ ঃ স্পেনের গৃহযুদ্ধের বেদনাদায়ক অবসান ঘটলেও
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এর গুরুত্ব ইঙ্গিতবাহী। স্পেনের গৃহযুদ্ধ সমগ্রমহাদেশে এমনকি সমগ্রবিশ্বে
আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অনেক ঐতিহাসিক স্পেনের গৃহযুদ্ধের আদর্শগত চরিত্রের ওপর বেশি গুরুত্ব
দিয়েছেন- এ যুদ্ধকে সচরাচর গণতন্ত্রবনাম একনায়কতন্ত্রের জীবন মরণ সংগ্রাম বলা হয়। অবশ্য
বহিরঙ্গের দিক থেকে এই ব্যাখ্যা যুক্তিযুক্ত মনে হলেও ফ্রাঙ্কের মূল সমর্থক ছিলেন সামরিক, ধর্মীয় ও
ভ‚সম্পত্তির মালিককূল। এদের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে ফ্যাসিবাদী আদর্শের সহমত ছিল না। এছাড়া ১৯৩৯
সালে জয়লাভ করার পর ফ্রাঙ্কো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মধ্যপন্থী অবস্থান গ্রহণ করেন। ইতালি ও
জার্মানির সাহায্যের প্রয়োজন না থাকায় তিনি ইতালি-জার্মানি ক‚টনৈতিক জোটে যোগদান করেন নি।
এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অন্য পক্ষকে সমর্থন করেন নি। প্রজাতান্ত্রিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও কোনো
সুস্পষ্ট আদর্শগত সংহতি লক্ষ্য করা যায় না। উদারনীতির সমর্থক, সমাজতন্ত্রী, সাম্যবাদী, সন্ত্রাসবাদী,
প্রজাতন্ত্রী-এসব বিভিন্নমতাদর্শের সমর্থকরা প্রজাতান্ত্রিক সরকারের পক্ষ গ্রহণ করে। রাজনৈতিক ও
সামরিক রণকৌশল নিয়ে এদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের আপাতত ফলাফল হল প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিলুপ্তি ও ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে একটি
প্রতিক্রিয়াশীল সমরবাদী রাজনীতির সাফল্য। কিন্তুস্পেনের গৃহযুদ্ধের প্রকৃত গুরুত্বনিহিত ছিল স্পেনের
বাইরে। এই গৃহযুদ্ধের ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ভ্রান্তনিরপেক্ষতা নীতির ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠল এবং
তাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরাজয় প্রতিভাত হল। যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যত অচল বলে
প্রতিপন্নহল। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মনোভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষুব্ধ হল-এই দুই পক্ষের মধ্যে যোগসূত্র
রচনার সম্ভাবনা নির্মূল হয়ে গেল। অধ্যাপক টেলর মন্তব্য করেছেন যে, স্পেনের গৃহযুদ্ধ সোভিয়েত
ইউনিয়নও পশ্চিমা শক্তির মধ্যে দূরত্ববৃদ্ধি করেছিল।
স্পেনের গৃহযুদ্ধে সবদিক থেকেই লাভবান হয়েছিল জার্মানি। ডেভিড টমসনের মতে, স্পেনের গৃহযুদ্ধে
মুসোলিনীর চেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিলেন হিটলার। অথচ মুসোলিনি ফ্রাংকোকে বেশি সহায়তা
করেছিলেন। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হিটলার তাঁর সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিমান বাহিনীর দক্ষতা ও বিভিন্ন
মারণাস্ত্রের ক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ পেলেন। ক‚টনৈতিক দিক থেকে ইতালিকে ব্রিটেন ও
ফ্রান্সের কাছ থেকে সরিয়ে এনে জার্মানির মিত্রদেশে পরিণত করলেন। সর্বোপরি পশ্চিম-পূর্বইউরোপে
ঝটিকা কেন্দ্রেঅন্যান্য দেশের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকার সুযোগ নিয়ে হিটলার মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্বইউরোপে
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে উদ্যত হলেন। এভাবে দেখা যায়, স্পেনের গৃহযুদ্ধ ইউরোপে
একটি যুদ্ধজনিত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে প্রথম ইউরোপীয় সংঘাতের
দৃষ্টান্তস্থাপন করেছিল। স্পষ্টই বোঝা গেল, ইউরোপে এখন এক বৃহৎ যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবল। বার্লিনে
নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত ফ্রাসোয়া পঁসে (ঋৎধহপড়রং চড়হপবঃ) ১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বরে সতর্ক বাণী
উচ্চারণ করে বলে ছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শান্তিবিরাজ করছে না বরং অঘোষিত যুদ্ধ চলছে। এ
জন্যেই অনেকে স্পেনের গৃহযুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাষ বলে অভিহিত করেছেন।




পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। দক্ষিণ আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশগুলো হাতছাড়া হয়ে যায় কত সালে
(ক) ১৮৮০ (খ) ১৮৮৫
(গ) ১৮৯৮ (ঘ) ১৯৯০
২। ১৯২৩ সালে স্পেনে সামরিক শাসন জারি করেন কে ?
(ক) আলফনেসো (খ) প্রাইমো রিভেরা
(গ) ফ্রাঙ্কো) (ঘ) ভালদেরো
৩। স্পেনে গৃহযুদ্ধের সময় সে দেশের প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন ?
(ক) রিভেরা (খ) জিরাল
(গ) বøুম (ঘ) মিয়াজা
৪। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে কে স্পেনের গণতান্ত্রিক বা ‘পপুলার ফ্রন্ট' সরকারকে সমর্থন
করেছিল ?
(ক) সোভিয়েত ইউনিয়ন (খ) ব্রিটেন
(গ) ফ্রান্স (ঘ) ইতালি।
উত্তর ১। (গ) ২। (খ) ৩। (গ) ৪। (ক)
রচনামূলক প্রশ্ন
১। স্পেনের গৃহযুদ্ধের বিভিন্নপর্যায় সম্পর্কেআলোচনা করুন।
২। স্পেনের গৃহযুদ্ধ প্রশ্নে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের সম্পৃক্ততার একটি
বিশ্লেষণ দিন।
৩। স্পেনের গৃহযুদ্ধের ফলাফল বর্ণনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]