দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ


প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে ইউরোপে আবার সংকট সৃষ্টি হয়। ইউরোপের বিভিন্ন
দেশে বিশেষত প্রথম মহাযুদ্ধে পরাজিত জার্মানিতে উগ্রজাতীয়তাবাদ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। ১৯২৯-
৩০ সালের মহামন্দা বিভিন্নদেশে দূরাবস্থা সৃষ্টি করলে ফ্যাসিস্ট দলগুলি এর পূর্ণসুযোগ গ্রহণ করে
এবং জনসমর্থনকে ব্যবহার করে ইতালি ও জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করে।
জার্মানিতে হিটলার এবং ইতালিতে মুসোলিনি ব্যাপক সমরসজ্জার সূচনা করেন। সমগ্রইউরোপ দুটো
পরস্পর বিরোধী সামরিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। জার্মানি ও ইতালি যুদ্ধের সূচনা করে। হিটলার
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করে ব্রিটেন ব্যতীত পশ্চিম ইউরোপ দখল সম্পন্নকরেন।
কিন্তুকিছুদিন পরেই হিটলার হঠাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে সবাইকে বিষ্মত করেন।
বিশ্বখ্যাত স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে রুশ লাল বাহিনীর হাতে হিটলারের সেনাবাহিনীর পরাজয় যুদ্ধের মোড়
ঘুরিয়ে দেয়। দূরপ্রাচ্যের আধিপত্য নিয়ে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল। জাপান
মার্কিন নৌঘাঁটি পাল হারবার আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্রমিত্রপক্ষের হয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। পর্যায়ক্রমে
ইতালি, জার্মানি ও জাপানের পরাজয় ঘটে। বর্তমান পাঠে যুদ্ধের পর্যায়ক্রমিক বিবরণ, বিখ্যাত
যুদ্ধসমূহ এবং অক্ষশক্তির আত্মসমর্পণের বিষয়টি আলোচনা করা হবে।
যুদ্ধের বিস্তার ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সর্বাত্মক যুদ্ধ (ঞড়ঃধষ ডধৎ) বলা হয়। স্থল, জল ও অন্তরীক্ষতো
বটেই, সমুদ্রগর্ভেও যুদ্ধ বিস্তৃত হয়েছিল। মারণাস্ত্রের ব্যবহার, যুদ্ধের ব্যপ্তি, লোকক্ষয়ের বিচারে প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় দ্বিতীয়টি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। ১৯৩৯ সালে ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড
আক্রমণ করলে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তুযুদ্ধের প্রস্তুতিতে কিছু
সময় ব্যয় হলে হিটলার পোল্যান্ড দখল করে নেন। এর পর সামান্য অজুহাতে হিটলার ডেনমার্কও
নরওয়ে অধিকার করেন। শক্তিশালী আত্মরক্ষা ব্যুহ ম্যাজিনো লাইন ভেদ করে ফ্রান্স আক্রমণ কঠিন এই
বিবেচনায় হিটলার ১৯৪০ সালে মে মাসে লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম ও হল্যান্ড আক্রমণ করলেন। ভার্সাই
সন্ধি অনুযায়ী বেলজিয়ামকে দেওয়া অঞ্চলগুলি পুনরায় জার্মানগণ দখল করে। হল্যান্ডকে পদানত করে
হিটলার অতর্কিতে ফ্রান্স আক্রমণে করে। দশটি পানজার বা ট্যাঙ্ক ডিভিসন, ৩০০০ সাজোয়া গাড়ি
নিয়ে ৮৯ নম্বর জার্মান পদাতিক ডিভিশন মিত্রপক্ষের ব্যুহ ভেদ করে উত্তর ফ্রান্স এগিয়ে যায়।
মিত্রবাহিনী সম্পূর্ণঅবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ২৭ মে থেকে ৪ ঠা জুনের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ইংরেজ ও
অন্যান্য মিত্রসেনাকে ৮৫০ টি হালকা নৌযানে ফ্রান্সের ডানকার্কবন্দর থেকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া
হয়। অপ্রতিহত গতিতে অগ্রসর হয়ে জার্মান বাহিনী সমগ্রউত্তর ফ্রান্স অধিকার করে। মুসোলিনিও
মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ও ইতালি সংলগ্নফ্রান্সের কিছুঅংশ দখল করে নেন। প্রথম
বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের হাতে জার্মানির পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর
কাম্পেই-এর বনাঞ্চলে যে রেলগাড়ির মধ্যে জার্মান প্রতিনিধিদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়েছিল,



হিটলারের আদেশে সেই রেলগাড়ির কামরাটি ঠিক সেই স্থানেই আনা হয় এবং ১৯৪০ সালের ২১ জুন
কামরার অভ্যন্তরে ফরাসি প্রতিনিধিগণ জার্মান সেনাপতি কাইটেলের কাছে আত্মসমর্পণ করে। হিটলার
স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উত্তর ফ্রান্স জার্মানির অন্তর্ভূক্ত হয়। দক্ষিণ ফ্রান্সে ভিচি (ঠরপযু) নামে
একস্থান নামেমাত্র স্বাধীন ফরাসি সরকার জার্মানির তাঁবেদার হয়ে ক্ষীণ অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখলো মার্শাল
পেতাঁ হন বাঁএই পুতুল সরকারের প্রধান।
ইউরোপে হিটলারের অপ্রতিহত অগ্রগতিতে ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেইনের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া
সৃষ্টি হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯৪০ সালের ১০ মে উইনস্টন চার্চিল নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব
গ্রহণ করেন। জার্মান আক্রমণের পরবর্তী লক্ষ্য ব্রিটেন ছিল। সমুদ্রউপক‚লের বেসামরিক লোকজনকে
অপসারণ করে জার্মান নৌ-আক্রমণের বিরুদ্ধে সেখানে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক সামরিক বৃত্তি
চালুকরা হয়। অল্পবয়সী ইংরেজ বিমান চালকগণ শক্তিশালী লুফতওয়েফেঙ্কে (জার্মান বিমান বহর)
পর্যুদস্তকরে ১৫ আগস্টের মধ্যে মোট ১৮০ টি জার্মান বিমান তারা ধ্বংস করে। বার বার ব্রিটেন
আক্রমণের চেষ্টা করেও হিটলার ব্যর্থহয়।
হিটলার ইংরেজদের আফ্রিকায় জব্দ করার ব্যবস্থা করেন। ইতালি ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড অধিকার করে।
তারা মিশর ও সুয়েজ খাল দখল করে ভ‚মধ্যসাগর অঞ্চলে ব্রিটিশ প্রাধান্য খর্বকরার চেষ্টা করে। জার্মান
সেনাপতি রোমেল এক দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী নিয়ে মিশরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ইংরেজ সেনাপতি
ওয়াভেল ইতালির অগ্রগতি রোধ করেন। ইংরেজ বাহিনী আবিসিনিয়া অধিকার করে নেয়।
ইতিমধ্যে বলকান অঞ্চলে যুদ্ধ বিস্তার লাভ করে। ইতালি গ্রিস আক্রমণ করলে ব্রিটেন গ্রিসের পক্ষ
নেয়। বুলগেরিয়া তার হৃত অঞ্চলে উদ্ধারের জন্য ইতালি-জার্মানি অক্ষশক্তির পক্ষে যোগ দেয়। হিটলার
যুগে- া¯øাভিয়া অধিকার করতে চাইলে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসাহায্য দানের প্রতিশ্রæতি দেয়। কিন্তু
যুগো¯øাভিয়া স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই জার্মানির অনুগত থাকে। ক্রমে জার্মানি গ্রিস ও যুগো¯øাভিয়া অধিকার
করে নেয়। সমগ্রইউরোপে ব্রিটেন বিচ্ছিন্নহয়ে পড়ে।
সোভিয়েট ইউনিয়নের যোগদান ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিটলারের সোভিয়েত
ইউনিয়ন আক্রমণ। দুবছরেরও কম সময়ের পূর্বেসম্পাদিত অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলার এই
আক্রমণের সিদ্ধান্তনেন। এই চুক্তির প্রতি হিটলার কখনই শ্রদ্ধাবান ছিলেন না। মতাদর্শগত বিরোধ
ছাড়াও ইউক্রেনের খাদ্যশস্য ও বাকুর পেট্রোলিয়ামের প্রতি হিটলারের দৃষ্টি ছিল। অন্যদিকে বাল্টিক ও
বলকান অঞ্চলে জার্মান অগ্রগতিকে সুনজরে না দেখলেও স্টালিন জার্মানির সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে
চলেন। কিন্তুক্ষমতার গর্বেমত্ত হিটলারের কাছে এর কোন মূল্য ছিল না।
১৯৪১ সালের ২১ জুন কিছুউচ্চপদস্থরুশ কর্মচারীর সম্মানে হিটলার এক নৈশভোজের আয়োজন
করেন। সকলকে বিষ্মিত করে পরদিনই বিশাল জার্মান বাহিনী সেনাপতি পাউলাসের অধীনে রুশ সীমান্ত
অতিক্রম করে ঝটিকাগতিতে মস্কোর দিকে ছুটে যায়। উত্তরে বাল্টিক থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত
৪০০ কি:মি: সীমান্তজুড়ে রুশ-জার্মান যুদ্ধ শুরু হয়। মাত্র ২৬ দিনে জার্মান বাহিনী মস্কোর দুইতৃতীয়াংশ দূরত্ব পার হয়ে যায়। লেনিনগ্রাদ অবরুদ্ধ হয়। লালফৌজ পোড়ামাটির নীতি (ঝপড়ৎপযবফ
ঊধৎঃয চড়ষরপু) অনুসরণ করে পশ্চাদপসরণ করে। অক্টোবর মাসের গোড়ায় মস্কোও অবরুদ্ধ হয়।
হিটলার সদর্পেঘোষণা করেন, এবার চূড়ান্তযুদ্ধের শুরু। চূড়ান্তযুদ্ধ এটি ছিল ঠিকই, তবে জার্মান
পক্ষে নয়, সোভিয়েত পক্ষে।
ইতোমধ্যে প্রবল শীতের প্রকোপে জার্মান বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। সুদূর বার্লিনের সঙ্গে যোগাযোগ
রক্ষাই অসম্ভব হয়ে ওঠে। রুশ লালফৌজ জার্মানদের প্রবলভাবে বাধা দেয়। ১৯৪২ সালের প্রথম
লালফৌজ লেনিনগ্রাড মুক্ত করে। সেপ্টেম্বরে শুরু হয় বিখ্যাত স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধ। অসম সাহসিকতার
সঙ্গে রুশ জনগণ লালফৌজের সঙ্গে একযোগে জার্মানদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়। নভেম্বর
মাসে সেনাপতি ঝুকভের অধীনে রুশ বাহিনী জার্মানদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকরে দিলে ১৯৪৩ সালের


জানুয়ারি মাসে জার্মান সেনাপতি পাউলাস আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। রুশ জনসাধারণের অতুলনীয় বীরত্ব
ও দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
জাপানের যোগদান
প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানি নৌ-শক্তির অভ্যুত্থান মার্র্কিন যুক্তরাষ্ট্রসন্দেহের চোখে দেখে। চীনে
জাপানের আগ্রাসী নীতিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপছন্দ করেনি। কেননা যুক্তরাষ্ট্রইতালির সঙ্গে জাপানের
মৈত্রীও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপছন্দ ছিল। ১৯৩৮ সালে জাপানকে বিমান সরবরাহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবন্ধ
করে দেয়। ক্রমে পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য, লোহা ও যুদ্ধের প্রয়োজনীয় উপকরণ রপ্তানিও বন্ধ হয়।
জাপানে এই আশংকা দেখা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রহয়তো সব ধরনের অত্যাবশ্যক দ্রব্যের রপ্তানিই
বন্ধ করে দেবে। সেজন্য তার দৃষ্টি পড়ে তৈল-সমৃদ্ধ ওলন্দাজ অধিকৃত ইন্দোনেশিয়ার ওপর। ১৯৪১
সালের জুলাই মাসে দক্ষিণ ইন্দোচীন দখল করে নেয়। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজাপানে তেল সরবরাহ
বন্ধ করে।
নবনিযুক্ত জাপানি প্রধানমন্ত্রী তোজো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংগে এক চুক্তির প্রস্তাব করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,
চীন ও ইন্দোচীন থেকে জাপানি সৈন্যের অপসারণ দাবি করে। জাপানের কাছে এই দাবি একেবারেই
গ্রহণযোগ্য ছিল না। ওয়াশিংটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও জাপানের প্রতিনিধিদের মধ্যে যখন শেষ পর্যায়ের
আলোচনা চলছে সেই সময় ১৯৪১ সালের ৭ ই ডিসেম্বর অতর্কিত জাপানি বিমানবহর হাওয়াই দ্বীপে
পার্লহারবার নৌ-ঘাটি আক্রমণ করে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্তকরে। সেই সঙ্গে জাপান, ব্রিটেন ও মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও একইভাবে জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণ দিয়ে
ইউরোপে যে যুদ্ধের সূত্রপাত, পার্লহারবারে বোমা বর্ষণের ফলে তা দূর প্রাচ্যেও বিস্তৃত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগদান ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মার্র্কিন যুক্তরাষ্ট নিরপেক্ষ থাকলেও সেখানকার
জনমত মিত্রশক্তিভ‚ক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির পক্ষে ছিল। ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে অস্ত্রও অন্যান্য যুদ্ধের
উপকরণ বিক্রি করা শুরু হয়। কিন্তুযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলেও ক্রমশ তা আফ্রিকা, ভ‚মধ্যসাগর ও
বলকান অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়লে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্পূর্ণনিরপেক্ষতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে
পড়ে। ১৯৪১ সালের মার্চমাসে যুক্তরাষ্ট্রীয় কংগ্রেস লেন্ড-লীজ আইন (খবহফ-খবধংব অপঃ) পাশ করে
যুদ্ধরত মিত্রশক্তিবর্গকে অস্ত্র সাহায্য প্রদানের সিদ্ধান্তনেয়। ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে উত্তর
আটলান্টিকের নিউফাউন্ডল্যান্ডের নিকটে মার্কিন রণতরী আগস্টা ও ইংরেজ রণতরী প্রিন্স অফ ওয়েলসে
রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ও প্রধানমন্ত্রী চার্র্চিলের মধ্যে একাধিক বৈঠকের পর বিখ্যাত আটলান্টিক সনদ
(অঃষধহঃরপ ঈযধৎঃবৎ) প্রকাশিত হয়। বিশ্বশান্তিরক্ষায় অপরাপর ব্যবস্থার মধ্যে আক্রমণকারী রাষ্ট্রগুলির
বিরুদ্ধে সশস্ত্রপ্রতিরোধের উল্লেখ করা হয়। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক জাহাজগুলি জার্মান
ডুবোজাহাজের দ্বারা ক্রমাগত আক্রান্তহতে থাকলে মার্কিন নৌ-বাহিনীকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলা
হয়। কয়েক মাস পর পার্লহারবারে জাপানি বোমা বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবিশ্বযুদ্ধে যোগ
দেয়।
ইতালির পরাজয় ঃ হিটলার ও মুসোলিনি মোটামুটি একই মতাদর্শেবিশ্বাসী ও রোম-বার্লিন-টোকিও
অক্ষচুক্তির শরিক হলেও উভয়ের মধ্যে অনেক বিষয়েই মতের অমিল ছিল। হিটলার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের
জন্য প্রস্তুত হলেও ইতালির সে ক্ষমতা ছিল না। মুসোলিনি হিটলারকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে,
পোল্যান্ডের যুদ্ধ আঞ্চলিক যুদ্ধ ঘোষণা করলে ইতালি নিরপেক্ষ থাকবে। কিন্তুমুসোলিনি হিটলারকে
বিরত করতে ব্যর্থহন। তদুপরি ইতালির টাইরলে জার্মান অধিবাসীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উভয়ের মধ্যে
মতবিরোধ ছিল। অতএব বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মানি ও ইতালির সম্পর্কমধুর ছিল না।
জার্মানির বিষ্ময়কর সাফল্য এবং ফ্রান্সের পতন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটায়। ১৯৪০ সালে জুন মাসে
হিটলার ও মুসোলিনির মধ্যে মিউনিখে এক বৈঠক হয়। ফ্রান্সের সঙ্গে উভয় দেশেরই যুদ্ধবিরতি
স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তুদুটি প্রশ্নেআবার মতানৈক্য দেখা দেয়। প্রথমত জার্মানি ফ্রান্সকে অক্ষশক্তির
অন্তভর্‚ক্ত করে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে তাকে ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিল। ইতালি এতে আপত্তি করে।


দ্বিতীয়ত, ইতালি সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতার পক্ষে ছিল, কিন্তুজার্মানি তা মানেনি। মতবিরোধ
সত্তে¡ও মিত্রতার পক্ষে ছিল, কিন্তুজার্মানি তা মানেনি। মতবিরোধ সত্তেও ভ‚মধ্যসাগরীয় ও বলকান যুদ্ধে
জার্মানি ইতালিকে সবরকম সাহায্য প্রদান করায় ইতালি জার্মানির নেতৃত্ব স্বীকার করে নেয়। জার্মানির
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সে সমর্থন করে। জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা
করলে ইতালিও যুদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৪২ সালের মাঝামাঝি থেকে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়। আফ্রিকায় ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী ইতালিকে
পরাস্তকরে। ১৯৪৩ সালের মে মাসে মিত্রপক্ষ তিউনিস ও রিজার্টা দখল করে নিলে আফ্রিকায় আর
কোনো ইতালীয় সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব রইলো না। এর পর মিত্রপক্ষের লক্ষ্য ছিল সিসিলি। মার্কিন
সেনাপতি প্যাটন ও ইংরেজ সেনাপতি মন্টগোমারির নেতৃত্বে১০ জুলাই স্থল ও জল উভয় পথে অতর্কিত
সিসিলি আক্রমণ শুরু হয়। ১৭ আগস্ট সিসিলি অভিযান শেষ হয়। দীর্ঘযুদ্ধ, ক্রমাগত পরাজয় ও
আভ্যন্তরীণ দুরবস্থা মুসোলিনির বিরুদ্ধে দেশবাসীর মধ্যে তীব্রক্ষোভের সঞ্চার করে। রাজা তৃতীয় ভিক্টর
ইমানুয়েল পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলদ্ধি করে ১৯৪৩ সালে ২৪ জুলাই মুসোলিনিকে অপসারিত করেন।
ফ্যাসিস্ট গ্রান্ড কাউন্সিলও রাজাকে সহায়তা করে। আবিসিনিয় যুদ্ধের নায়ক মার্শাল বোদেগ্লিও নতুন
সরকার গঠন করেন। মুসোলিনিকে বন্দী করা হয়। কিন্তুজার্মান ছত্রীবাহিনী তাঁকে মুক্ত করে। তিনি
জার্মান অধিকৃত উত্তর ইতালিতে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান হন। ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন
সেনাপতি ক্লার্কপশ্চিম ইতালি অধিকার করেন। ইংরেজ বাহিনী পূর্বদিক থেকে ইতালি আক্রমণ করে।
১৯৪৪ এর জুনে রোম মিত্রপক্ষের হস্তগত হয়। ১৯৪৫ সালে মিত্রবাহিনী উত্তর ইতালি আক্রমণ করলে
আবার ইতালিতে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। মুসোলিনি সুইজারলান্ডে পলায়নের চেষ্টা করলে ধৃত হন ও তাঁকে
হত্যা করা হয়। ইতালি বিনাশর্তেআত্মসমর্পণ করে।
ইউরোপে মিত্রশক্তির আক্রমণ
১৯৪১ সালের জুন মাসে হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে পশ্চিম ইউরোপের যে কোনো
স্থানে মিত্রপক্ষের দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলার কথা বিবেচনা করা হচ্ছিল। কিন্তুদু'বছর কেটে গেলেও এ
ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তনেওয়া হয়নি, যদিও স্টালিন এই মর্মেবার বার অনুরোধ করে যান। এই
বিলম্বের কারণ নিয়ে মতবিরোধ আছে। অনেকের মতে মিত্রপক্ষের দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলার মত শক্তি
ছিল না। কেউ কেউ মনে করেন মিত্রপক্ষ এইভাবে হিটলার কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পূর্ণধ্বংস
সাধনের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তুরুশ বাহিনী নাৎসিদের প্রতিহত করে একেবারে জার্মান সীমান্ত
পর্যন্তবহিষ্কার করলে জার্মানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্তবিজয়ের কৃতিত্ব যাতে স্টালিন দাবি করতে না পারেন
সেইজন্য বিলম্বেহলেও ধুরন্ধর চার্চিলা দ্বিতীয় রণাঙ্গন খুলতে রাজি হন। অবশ্য এ ব্যাপারে চূড়ান্তসিদ্ধান্ত
নেওয়া হয় ১৯৪৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে যখন স্টালিন, চার্চিল ও রুজলেন্ট তেহরানে এক বৈঠকে
মিলিত হন।
কোন স্থানে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলা হবে তা নিয়ে বিভিন্নমত ছিল। চার্চিল ইতালি অথবা বলকান অঞ্চল
দিয়ে জার্মানিতে প্রবেশের পক্ষে ছিলেন। কিন্তুমূলত মার্কিন সেনাপতিগণ কষ্টসাধ্য হলেও সাগর পার
হয়ে পশ্চিম ইউরোপে সেনা অবতরণের পক্ষপাতি ছিল। এ কারণে উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের নরমান্ডিকে
বেছে নেওয়া হয়। প্রথম ৩৬ ডিভিশন সেনা অবতরণ করবে, পরে আরও ১০ ডিভিশন দক্ষিণ ফ্রান্সে
নামানো হবে। সিদ্ধান্তহয় যে, প্রায় ১০ হাজার বিভিন্নধরনের বিমান এতে অংশ নেবে, যুদ্ধ-জাহাজ ও
বিভিন্ন পরিবহন যানের সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত হাজার। মিত্র পক্ষের সেনাবাহিনীতে আমেরিকান,
ইংরেজ, কানাডীয়, ওলন্দাজ, পোল নরওয়েজিও, ফরাসি ও গ্রিক সৈনিক ছিল। ডি দিবস (উ উধু) বা
অবতরণ দিবসের দিন ধার্যহয় ১৯৯৪ সালের ১ জুন। কিন্তুপ্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য পিছিয়ে ৬ জুন
করা হয়। এই সুবিশাল সামরিক অভিযানের নেতা ছিরেন আমেরিকান সেনাপতি আইজেনহাওয়ার।
জার্মানি মিত্রপক্ষের অবতরণের সম্ভাবনা অনুমান করে। দীর্ঘ চার বছর সমুদ্রতীর জার্মান অধিকারে
থাকার ফলে দুর্ভেদ্য অতলান্তিক প্রাচীরে পরিণত হয়। তা সত্তে¡ও প্রতিরোধশক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মার্শাল
রুন্ডস্টেড ছাড়াও হিটলার ফিল্ড মার্শাল রোমেলকে এই বিশেষ দায়িত্বনিযুক্ত করেন। কিন্তুরণকৌশল
এস এস এইচ এল
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস - ২ পৃষ্ঠা -২৭৪
নিয়ে উভয়ের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। স্থল, নৌ ও বিমান তিন দিক থেকেই মিত্র পক্ষ জার্মানবাহিনীর
চেয়ে শক্তিশালী ছিল।
অবতরণের দিন সন্ধ্যা থেকেই মিত্রপক্ষের এক হাজার বোমারু বিমান উপক‚লবর্তীজার্মান প্রতিরক্ষা
ঘাঁটিগুলির ওপর নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করে। সব রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকরে দেওয়া হয়। শেষ রাতে
সেনা অবতরণ শুরু হয়। পশ্চিমে মন্তবুর্গথেকে পূর্বেশেন পর্যন্তকঁত তিঁন উপদ্বীপের ৯৬ কি:মি: জুড়ে
মোট পাঁচটি স্থানে মিত্র বাহিনী নামে। এছাড়া আমেরিকান ছত্রী সৈন্য অবতরণ করে। ৪ জুন স্ত্রীর
জন্মদিন ও ফুয়েরারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য রোমেল বার্লিন যান। অকস্মাৎ অবতররণের সংবাদে তিনি
দ্রæত ফ্রান্সে ফিরে আসেন। কিন্তুতখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। জার্মান গোয়েন্দারা উপযুক্ত সময়ে
সঠিক সংবাদ দিতে পারেনি। পাঁচদিন ধরে জার্মান বাহিনীর সঙ্গে ইঙ্গ-মার্কিন সেনার তুমুল যুদ্ধ হয়।
মিত্রবাহিনী নরমান্ডি উপক‚লের ১২৮ কি: মি: এলাকা অধিকার করেও ৩২ কি:মি: ভেতরে প্রবেশ করে।
‘ডি ডে' বা নরমান্ডিতে মিত্রপক্ষের অবতরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। পূর্ব
পশ্চিম দুই সীমান্তেযুদ্ধের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে জার্মান সেনানায়কগণ সেই বিসমার্কের সময় থেকে হুশিয়ারি
দিয়ে আসছে। কিন্তুভাগ্যের পরিহাস হিটলারের ক্ষেত্রেও এই আশংকা বাস্তবে পরিণত হলো। আগস্ট
মাসে ফরাসি বাহিনী তুলো বন্দরে অবতরণ করে। তারা উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে
মিলিত হওয়ার চেষ্টা করে। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ইউরোপে জার্মান প্রতিরক্ষা ঘাঁটিগুলি ধ্বংস হয়ে
যায়। মিত্রবাহিনী দ্রæতবেগে জার্মানির দিকে এগিয়ে চলে।
জার্মানির আত্মসমর্পণ
পশ্চিম সীমন্তেমিত্রবাহিনী যখন বার্লিন অভিযানে ব্যস্ত, পূর্বসীমান্তেতখন লালফৌজ পাঁচটি ফ্রন্টে ভাগ
হয়ে দুর্বার গতিতে জার্মান সীমান্তের দিকে এগিয়ে যায়। প্রথম সারির রুশ সেনানায়কগণ যেমন জুকভ,
কোনেভ, চেরনিয়াখোভস্কি এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৫ সালের ফেব্র“য়ারি মার্চেলালফৌজ
বার্লিন থেকে ৯৬ কি: মি: দূরে অবস্থান করছিল।
এপ্রিল মাসে ইঙ্গ-মার্কিন ফৌজ হামবুর্গ, উইটেনবর্গও ম্যাসাডবুর্গবরাবর এলব নদীর তীর পর্যন্তপৌঁছে
যায়। সেখানে থেকে তারা নুরেমবার্গস্টুটগার্টের দিকে অগ্রসরের অপেক্ষা করে বার্লিন থেকে ১০৫ কি:
মি: দূরে। ইঙ্গ-মার্কিন ও সোভিয়েত বাহিনীর মধ্যে এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়, কে কার পূর্বেবার্লিনে
প্রবেশ করবে।
জার্মান রাজধানী রক্ষার জন্য হিটলার শহরের প্রবেশ পথে নানা রকম বাধার সৃষ্টি করেন। ওডের ও স্প্রি
নদীর ধারে আগুয়ান বাহিনীর গতিরোধের উপযুক্ত অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়। তদুপরি বার্লিনের চারপাশে
কিছুপ্রাকৃতিক বাধাও ছিল, যেমন জলাভ‚মি, জঙ্গল, খাল, প্রভৃতি। ১৬ এপ্রিল শেষ রাত ৪ ঘটিকার
মার্শাল জুকভ প্রচন্ড গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে বার্লিন অভিযানের উদ্বোধন করেন। ১৮ই এপ্রিল স্প্রিনদী
পার হয়ে ২০ এপ্রিল রুশ সেনাবাহিনী জার্মান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে জোসেন আক্রমণ করে। ২১
এপ্রিল রুশ সেনা বার্লিন শহরে প্রবেশ করে ও রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। জুকভ, কোনেভ ও
রকোসোভস্কির সৈন্যের দ্বারা বার্লিন সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ হয়। বার্লিনবাসীর মধ্যে চরম বিপর্যয় ও
আতংকের সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী ক্রমশ এগুতে থাকলে এসব নদীর তীরে
টোরঘাউ শহরের কাছে লালফৌজের সঙ্গে ২৫ এপ্রিল তাদের দেখা হয়। তখন থেকেই ফ্যুয়েরারের
‘হাজার বছরের রাইখে'র স্বপ্নভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
বার্লিনের উপর রুশ আক্রমণ শুরু হওয়ার পূর্বথেকেই অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই
চ্যান্সেলারির ৫০ ফুট ভ‚গর্ভের নীচে বিশেষভাবে নির্মিত ব্যাংকারে হিটলার আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
সেখানে গোয়েবলস প্রমুখ ঘনিষ্ট দলীয় সহকর্মী, ডাক্তার ও পরিচালকও ছিলেন। হিটলারের তখন বয়স
৫৬ বছর। ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই বোমা বিষ্ফোরণে তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা হওয়ার পর থেকে তিনি
একটুখুঁড়িয়ে হাটতেন ও হাত দুটো কাঁপতো। ১২ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস-২ পৃষ্ঠা- ২৭৫
মৃত্যুর খবরে তিনি পুলকিত হন। আশা করেন এইবার হয়তো যুদ্ধের মোড় ঘুরবে। কিন্তুগোয়েরিং এর
ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। লাল-ফৌজের বার্লিন প্রবেশের সংবাদে নাৎসি নায়ক
বিচলিত হয়ে পড়েন। বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিদের তিনি এর জন্য দায়ী করেন। অন্তিম লগ্নসমাগত এই
উপলব্ধিতে হিটলার তাঁর রাজনৈতিক দলিল প্রস্তুত করেন।
হিটলার তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি নাৎসি দলকে দিয়ে যান। দুর্লভ চিত্রকর্মের যে সংগ্রহ তার ছিল তা
দান করেন জন্মভ‚মি ব্রাউনাউকে। গোয়েরিং ও হিমলারকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। নৌ-সেনাপতি
অ্যাডমিরাল ডোয়েনিৎস তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত হন। ইহুদিদের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম চালিয়ে
যেতে বলেন। ৩০ এপ্রিল হিটলার আত্মহত্যা করেন। তাঁর মৃতদেহ ব্যাংকারের বাইরে চ্যান্সেলারির
উদ্যানে সম্পূর্ণভাবে দাহ করা হয়। গোয়েবলসও সপরিবারে আত্মহননের পথ বেছে নেন।
হিটলারের উত্তরাধিকারী অ্যাডমিরাল ডোয়েনিৎস রুশ সেনা অপেক্ষা মিত্র পক্ষের কাছেই আত্মসমর্পণ
সুবিধাজনক বলে মনে করেন। কিন্তুতা হয়নি। ১৯৪৫ সালের ৯ মে শেষরাতে জার্মান প্রতিনিধিবর্গ
মিত্রপক্ষের প্রধান সেনাপতি আইজেনহাওয়ারের সদর দপ্তর ফ্রান্সের রেইমস শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে
আত্মসমর্পণ করে। ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই চারটি দেশের চারটি
পৃথক দলিলে জার্মানগণ স্বাক্ষর করে। এই অনুষ্ঠানে চার পক্ষের সেনাপতিগণ উপস্থিত ছিলেন। জার্মান
প্রতিনিধি ফিল্ড মার্শাল জড্ল বিজয়ী পক্ষের কাছ থেকে উদার ব্যবহারের আশা ব্যক্ত করেন।
পরদিন ৪ মে, বার্লিনের উপকন্ঠে একটি কলেজ ভবনে আত্মসমর্পণের মূল চুক্তিপত্র স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত
হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্ব করেন যথাক্রমে মার্শাল
জুকভ, সেনাপতি কার্ল-স্পাজ, মার্শাল টেডার ও সেনাপতি তাসিনি। জার্মান পক্ষে স্বাক্ষর করেন ফিল্ড
মার্শাল কাইটেল, অ্যাডমিরাল ফ্রেডবুর্গ ও সেনাপতি স্টাফ। এই অনুষ্ঠানের পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের
ইউরোপীয় অংশের অবসান হলো। দূর প্রাচ্যের রণভ‚মি তখনও উত্তাল ছিল।
জাপানের আত্মসমর্পণ
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপানি বিমান বহর পার্লহারবার নৌঘাটি ধ্বংস করার সঙ্গে সঙ্গেই দূর প্রাচ্যে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিস্তৃত হয়। তারা ফিলিপাইনসে মার্কিন বিমানবাহিনীও নিশ্চিহ্ন করে। দক্ষিণ পূর্ব
এশিয়ার অসংখ্য দ্বীপসহ হংকং, ম্যানিলা, সিঙ্গাপুর, রেঙ্গুন তারা অধিকার করে নেয়। মালয় ও
ওলন্দাজ পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) তারা অধিকার করে।
১৯৪২ সালের মে মাস থেকে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হতে থাকে। মিডওয়ে দ্বীপের যুদ্ধে মার্কিন বিমান
আক্রমণে জাপানি নৌবহর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্তহয়। ১৯৪৩ সালে উয়াদাল কানাল, নিউগিনি মিত্রপক্ষ
দখল করে। এ ঘটনার পর দ্বিমুখী আক্রমণ চালিয়ে মিত্রপক্ষ একে একে ফিলিপাইনস, গিলবার্টও
মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ উদ্ধার করে। ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণও কিনাওয়া
দ্বীপপুঞ্জও মিত্রপক্ষ অধিকার করে নেয়। সুভাষচন্দ্রবসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ জাপানি সেনার
সহায়তায় বার্মা থেকে মণিপুর পর্যন্তএগিয়ে আসে ভারতের উপর আঘাত হানার উদ্দেশ্যে। কিন্তুঅন্যত্র
জাপানিগণ পরাজিত হয়ে থাকায় এই লক্ষ্য বিফল হয়।
জার্মানির আত্মসমর্পণ ও কিনাওয়ার পতনের পর জাপান পিছুহটতে থাকে। ব্রিটেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও
সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে পটসুডাম সম্মেলনে মিলিত হয়ে জাপানকে
আত্মসমর্পণের আহবান জানায়। মিত্রপক্ষের বিমানবাহিনী জাপানের বিভিন্ন শহরে বিমান হামলা
অব্যাহত রাখে।
অন্যদিকে ১৯৪১ সালে রুশ-জাপান নিরপেক্ষতার চুক্তি বাতিল করে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপান
অধিকৃত মাঞ্চুরিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্তনেয়। ইতিমধ্যে ৬ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রহিরোশিমায় আণবিক
বোমা নিক্ষেপ করে। ৪ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে। ৯ আগস্ট মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রনাগাসাকিতে আণবিক বোমা ব্যবহার করলে জাপানের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো পথ
খোলা থাকলো না।
এস এস এইচ এল
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস - ২ পৃষ্ঠা -২৭৬
১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর মার্কিন রণতরী ‘মিশৌরীতে জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। দূর
প্রাচ্যে মিত্রপক্ষের প্রধান সেনাপতি ম্যাকআর্থারের উপস্থিতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগেমিৎসুআত্মসমর্পণ ও
সেনাপতি উমেজুদলিলে স্বাক্ষর করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রছাড়াও ইংল্যান্ড চীন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা
নিউজিল্যান্ড, হল্যান্ড, ফরাসি ও সোভিয়েত প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল। মঞ্চুরিয়াতেও জাপানি বাহিনী
পরাভ‚ত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে আত্মসমর্পন করে। এই ভাবে দূর প্রাচ্যেও বিশ্বযুদ্ধের অবসান
হয়।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়-
(ক) ১৯৩৯ সালে (খ) ১৯৪০ সালে
(গ) ১৯৪১ সালে (ঘ) ১৯৪২ সালে
২। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ফ্রান্সের পুতুল সরকারের নাম কি?
(ক) দ্যগল (খ) মার্শাল পেতা
(গ) জ্যাক মিরাক (ঘ) এর্ডওয়ার্ডবালাদুর
৩। হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেন ১৯৪১ সালের-
(ক) ২০ জুন (খ) ২১ জুন
(গ) ২২ জুন (ঘ) ২৩ জুন
৪। ডি ডে হচ্ছে-
(ক) অবতরণ দিবস (খ) পলায়ন দিবস
(গ) আক্রমণ দিবস (ঘ) যুদ্ধ বিরতি দিবস
উত্তর ১। (ক) ২। (খ) ৩। (গ) ৪। (ক)
(খ) রচনামূলক প্রশ্ন
১। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাথমিক বিস্তার (সোভিয়েত ইউনিয়নের যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত) সম্পর্কে
আলোচনা করুন।
২। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের যোগদান পরিস্থিতির মোড় কতটুকুঘুরাতে পেরেছিল?
৩। দূরপ্রাচ্য এবং ইউরোপে অক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকি ভ‚মিকা গ্রহণ করেছিল।
৪। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষ শক্তির আত্মসমর্পণের বিষয়টি বর্ণনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]