নেপোলিয়নের পতনের কারণ


নেপোলিয়নের পতনের কারণ (ঞযব পধঁংবং ড়ভ ঘবঢ়ড়ষবড়হ'ং ভধষষ)
নেপোলিয়ন বোনপার্ট সামরিক বাহিনী থেকে ফরাসি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবির্ভূত হন। তাঁর
নিরলস পরিশ্রমে, বহুমুখী কৃতিত্বপূর্ণ কার্যাবলীর দ্বারা এক সময়ে দেশকে এক চরম বিপর্যয়ের হাত
থেকে তিনি রক্ষা করেন। গৌরবের উচ্চ শিখরে আরোহণ করে শেষ পর্যন্ততিনি ভাগ্যের নিষ্ঠুর
পরিহাসে “শান্তিভঙ্গকারী’’ হিসেবে চিহ্নিত হন এবং ১৮১৫ সালে ওয়াটারলুর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সেন্ট
হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত হন।
নেপোলিয়নের পতনের সূচনা পর্ব
ঐতিহাসক টমসনের মতে এ্যমিয়েন্সের সন্ধি ভঙ্গের পর (১৮০২) নেপোলিয়নের পতন ঘটতে থাকে।
গ্র্যান্ট ও টেমপারলির মতে ১৮০৭ সালের টিলজিটের সন্ধির পর নেপোলিয়নের পতন সূচিত হয়।
নেপোলিয়নের শাসননীতি ও সাম্রাজ্য বিস্তারের মধ্যে তার পতনের বীজ লুকানো ছিল। ১৮০৭ সাল
থেকে তা প্রকট হতে থাকে। নেপোলিয়নের পতনের কারণগুলি নিচে আলোচনা করা হল ঃ১। অনমনীয় উচ্চাকাঙক্ষা
নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম কারণ ছিল তার সীমাহীন উচ্চাকাঙক্ষা ও প্রবল আত্মপ্রত্যয়। সামরিক
শক্তির সাহায্যে একের পর এক রাজ্য জয় করে তার সাম্রাজ্যবাদী আকাঙক্ষা সীমা অতিক্রম করেছিল।
তিনি কখনও অনুভব করতে পারেননি যে, এক বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করে তা সুষ্ঠুভাবে শাসন করা
এক দুঃসাধ্য কাজ হবে। তিনি ছিলেন একজন প্রবল প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তি প্রত্যেক মানুষের প্রতিভা ও
ক্ষমতার সীমা ও আছে। নেপোলিয়ন এই বাস্তব সত্যকে অগ্রাহ্য করে মারাত্মক ভুল করেন। গভীর
আত্মপ্রত্যয় ও অহমিকার বলে তিনি জীবনে কতকগুলো শ্রেষ্ঠ সুযোগ হাতছাড়া করে ভ্রান্তপথে নিজেকে
পরিচালিত করেন। এই প্রসঙ্গে স্পেন ও রাশিয়া আক্রমণ উল্লেখযোগ্য। লিপজিকের যুদ্ধের পর
মিত্রপক্ষের সন্ধির প্রস্তাব অনুসারে বেলজিয়াম প্রত্যাবর্তন করলে নেপোলিয়নকে ওয়াটারলুর যুদ্ধের
অপমান সহ্য করতে হতনা। সামরিক সাফল্যের উন্মাদনার সঙ্গে যে প্রবল আত্মপ্রত্যয়ের উন্মেষ
ঘটেছিল তাই ছিল তার বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ।
২। সাম্রাজ্যের দুর্বল ভিত্তি
নেপোলিয়ন বংশানুক্রমিক রাজা ছিলেন না। তিনি তার সামরিক প্রতিভাবলে ফান্স ও ইউরোপে
আধিপত্য স্থাপন করেন। তাঁর এই সামরিক একনায়কত্বের গৌরবময় অতীতের মহিমা অথবা বংশ
গরিমা ছিলনা। তার সাম্রাজ্য ও শাসন নিরন্তন সামরিক সাফল্য অথবা ফরাসি জনগণের অকুন্ঠ সমর্থন
পেলে তবেই টিকে থাকতে পারত। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি সামরিক সাফল্য এবং ফরাসি জাতির আনুগত্য
এই দুইটিই ১৮১০ সালের পর হারাতে থাকেন। নেপোলিয়ন এ জন্য তার ভাই যোসেফকে বলেন,
“আমি যতদিন শক্তিশালি থাকব ততদিন আমার সাম্রাজ্য থাকবে”। তিনি ইউরোপের জনগণকে
স্বৈরাচারী শাসনের কবল থেকে মুক্ত করার আশ্বাস দিয়ে নিজেই বিজিত রাজ্যসমুহে স্বৈরাচারী শাসনের



প্রবর্তন করেছিলেন। ফলে বিশাল সাম্রাজ্যের জনগণের প্রীতি ও আনুগত্য লাভ থেকে বঞ্চিত হন। তার
শাসন ব্যবস্থার এই দুর্বল ভিত্তি তার পতনের অন্যতম কারণ।
৩। ভ্রান্তস্পেনীয় নীতি
স্পেন আক্রমণ ছিল নেপোলিয়নের একটি মারাত্মক ভুল। স্পেনের সিংহাসনে নিজ ভাইকে বসিয়ে
তিনি স্পেনবাসীর দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের উপর চরম আঘাত করেন। এতে তিনি কূটনৈতিক
অদূরদর্শিতার পরিচয়ও দেন। স্পেনবাসী জীবন মরণ যুদ্ধ করে নেপোলিয়নকে পরাজিত করেছিল।
স্পেনের যুদ্ধে ফ্রান্সের বিখ্যাত সেনাপতি জুনো পর্যন্তপরাজিত হন। ১৮০৮ সালে নেপোলিয়নের ২৩
হাজার সৈন্য স্পেনবাসীর হাতে নিহত হয়। স্পেনে হস্তক্ষেপ করায় তিনি ইংরেজ সৈন্য স্পেনে আসার
পথ প্রস্তুত করেন। ইংরেজ সেনাপতি ডিউক অফ ওয়েলিংটন স্পেনবাসীদের গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব
দেন। স্পেনের যুদ্ধ ছিল জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ। স্পেনেই সর্বপ্রথম নেপোলিয়নকে সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে
যুদ্ধ করতে হয়। এই জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ ইউরোপের অন্যদেশ গুলিকে প্রেরণা যোগায়। রাশিয়ার
যুদ্ধে তার প্রচুর সৈন্যের দরকার হলেও স্পেনে তাঁর সৈন্যবাহিনীয় বিরাট অংশ আটকে থাকে। ফলে
তিনি রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করতে পারেননি। নেপোলিয়ন নিজে মনে করতেন,
স্পেনের ক্ষতেই তাঁর সর্বনাশ হয় (ঞযব ঝঢ়ধহরংয ঁষপবৎ ৎঁরহবফ যরস) স্পেনের যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল
অপেক্ষা পরোক্ষ ফল ছিল মারাত্মক। স্পেনেই নেপোলিয়ন প্রথম পরাজয় বরণ করেন। স্পেনের যুদ্ধে
তার ঝটিকা আক্রমণের রণকৌশল ব্যর্থ হয়। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে স্পেনের সাফল্য সমগ্র
ইউরোপকে অনুপ্রাণিত করে। প্রকৃত পক্ষে ইউরোপে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ নেপোলিয়নের
পতনের অন্যতম কারণ।
৪। মস্কো অভিযানের অদূরদর্শিতা
মস্কো অভিযান ছিল নেপোলিয়নের পরাজয়ের আরেকটি কারণ। প্রাকৃতিক অসুবিধা অগ্রাহ্য করে সুদূর
মস্কো অভিযান ছিল মারাত্মক ভুল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ রুশ জনগণের গেরিলা
যুদ্ধের ফলে অগণিত ফরাসি সেনা ও সেনাপতি মৃত্যু বরণ করে। রাশিয়া ছিল বৃহৎ দেশ। বিশাল
জনবহুল ও সম্পদের অধিকারী জারকে পরাস্তকরা সহজ ছিলনা। রুশ সেনাপতি ছিলেন এক অভিজ্ঞ
রণকৌশলী। নেপোলিয়ন রুশ আক্রমণ করলে তিনি নেপোলিয়নকে বাধা না দিয়ে পিছু হটতে থাকেন।
ফলে নেপোলিয়ন তার পিছু নিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। অতঃপর সেনাপতি কুটুজফ
আঘাত হানলে নেপোলিয়ন বিভ্রান্তহয়ে পড়েন। নেপোলিয়নের গ্রান্ড আর্মি রাশিয়ার বরফ, শীত ও
কামানের আক্রমণে ধবংস হয়। রাশিয়ায় নেপোলিয়নের বিরাট পরাজয় ঘটলে ইউরোপের সর্বত্র তাঁর
বিরুদ্ধে বিদ্্েরাহ দেখা দেয়। মস্কো অভিযান ছিল নেপোলিয়নের সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকারক পরাজয়।
৫। সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক ত্রæটি
১৮০৮ থেকে ১৮১২ সালের মধ্যে নেপোলিয়নের সোনাবাহিনীর সাংগঠনিক চরিত্রের ব্যাপক পরিবর্তন
ঘটে। বিপ্লবী যুদ্ধের সময় যে মহান সেনাবাহিনাী (এৎধহফ অৎসু) নেপোলিয়ন গড়ে তুলেছিলেন
অস্টারলিজ ও জেনার যু্েদ্ধ ও স্পেন অভিযানে তা প্রায় ধবংস হয়ে যায় এবং নেপোলিয়নকে বিদেশী
সৈন্যের উপর নির্ভর করতে হয়, কারণ নিরন্তর যুদ্ধ বিগ্রহ চলায় নেপোলিয়নের অভিজ্ঞতা ও দক্ষ সেনরা
নিহত হয়। অনভিজ্ঞ লোক নিয়ে সেনাদল গঠন করায় সেনাদলের গঠন দুর্বল হয়। নেপোলিয়নের
সাম্রাজ্য যতই বিস্তৃত হয়, ততই বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ও পাহারার জন্য বহু সেনার দরকার হয়। ফ্রান্সের
লোকবল যথেষ্ট না থাকায় তিনি ইতালি, জার্মানি ও বেলজিয়াম থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে এই অভাব
পূরণ করেন। ফলে সেনাদলে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়। এই সকল বিদেশী সেনার মধ্যে বৈপ্লবিক
উন্মাদনা ও নেপোলিয়নের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য ছিলনা। রাশিয়ার যুদ্ধে নেপোলিয়নের ব্যর্থতা আরম্ভ
হলে এই বাহিনীর ঐক্য ও মনোবল ভেঙ্গে যায়। নেপোলিয়নের যুদ্ধ কৌশলের চমকপ্রদ ক্ষমতা ধীরে
ধীরে বিনষ্ট হয়।


৬। নেপোলিয়নের জনপ্রিতা হ্্রাস
নেপোলিয়নের ক্ষমতার মূল উৎস ছিল ফান্সের জনসাধারণ, বিশেষত, বুর্জোয়া শ্রেণীর সমর্থন। দেশের
সম্পদের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ তাঁকে ইউরোপের উপর আধিপত্য এনে দেয়। ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়ন
ফরাসি জাতির কাছে ছিলেন বিপ্লবের মূল্যবান সংস্কারের সংগঠক। ১৮১৪ সালে সেই নেপোলিয়নই
হয়ে উঠলেন ফরাসি জাতির ঘৃণার পাত্র। তাঁর স্বৈরশাসন ফরাসি জনসাধারণের নিকট তাঁর জনপ্রিয়তা
বিনষ্ট করে। গণতন্ত্রকে ধবংস করার জন্যে ফরাসি জনসাধারণের নিকট তাঁর মহিমা বিনষ্ট হয়। গোড়ার
দিকে বৈদেশিক যুদ্ধে জয়লাভের ফলে তাঁর জনপ্রিয়তা থাকলেও ক্রমে ক্রমে তা হ্্রাস পায়। ডেভিড
টমসনের মতে, নেপোলিয়নের স্বৈরশাসনের ফ্রান্স ক্রমে ক্রমে একটা পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
(ঋৎধহপব ৎবষধঢ়পবফ সড়ৎব ধহফ সড়ৎব রহঃড় ধ চড়ষরপব ংঃধঃব ঁহফবৎ ধহ ধঁঃড়পৎধপু)। পেনিনসুলা এবং
রুশ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে তাঁর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখা দেয়। তাঁর অধীনস্তকর্মচারীও তার
বিরুদ্ধে চক্রান্তেযোগ দেয়। তাঁর পুলিশ বিভাগের প্রধান ফুশে ঋড়ঁপযব এবং তাঁর কূটনৈতিক দপ্তরের
কর্তা ট্যালির‌্যান্ড (ঞধষষবুৎধহফ) এমন কি তাঁর ভাই যোসেফ বোনাপার্টও তার বিরুদ্ধে চক্রান্তেঅংশ
নেয়। ফরাসি নেতারা বুঝতে পারেন যে, নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য জয়ের ফরাসি জাতির কোনো লাভ
হয়নি বরং এজন্য তাদের জীবন ও অর্থ বলি দিতে হয়েছে।
৭। মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থার ফল
মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা ছিল নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। ইংল্যান্ডের অর্থনীতি ও
ব্যবসা-বাণিজ্য ধবংস করার জন্য নেপোলিয়ন মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তুু এই
অবরোধ ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য যে নৌশক্তির প্রয়োজন ছিল তা নেপোলিয়নের ছিলনা। এই
অবরোধ কার্যকর করার ফলে ইউরোপের রাজ্যগুলি এক চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় এবং
তাদের মনে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সমুদ্রের উপর ইংল্যান্ডের নৌশক্তি অপ্রতিহত থাকায় ইউরোপের
বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে গোপন ব্যবসা-বাণিজ্য চলতে থাকে। ফলে মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়।
এই অবস্থায় নেপোলিয়নের মিত্র রুশ-সম্রাট আলেকজান্ডারও তাঁর প্রতি রুষ্ট হন। সাথে সাথে অপর মিত্র
শক্তিগুলিও তাঁর বিরোধী হয়ে ওঠে।
একথা সত্য যে, মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা কঠোরভাবে কার্যকর করতে নেপোলিয়ন নিজেই ইউরোপ
থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং এই বিচ্ছিন্নতাই তাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। মহাদেশীয় অবরোধ
ব্যবস্থা কঠোরভাবে বলবৎ করতে গিয়ে তিনি অহেতুক কতকগুলি জটিলতার সৃষ্টি করেন যা ফ্রান্সের
জন্য ক্ষতিকর ছিল। ফ্রান্সের যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী শুরু থেকে নেপোলিয়নকে সমর্থন দিয়ে আসছিল তারা
নেপোলিয়নের প্রতি বিরাগ ভাজন হয় এবং তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। যে অর্থনৈতিক অস্ত্রের
দ্বারা নেপোলিয়ন ব্রিটেনকে আঘাত করতে চেয়েছিল সে অস্ত্রের আঘাতে নিজেই আহত হয়ে পড়েন।
৮। ফরাসি জাতির আনুগত্য থেকে বিচ্ছিন্নতা
১৮১৪ সালে ফ্রান্সের সাধারণ জনসাধারণ নিকট থেকে নেপোলিয়ন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ১৭৯৩
সালে বৈদেশিক আক্রমণের মুখে যে ফরাসি জাতি অদম্য উৎসাহে শক্রদের বিতাড়ন করে, ১৮১৩ সালে
লিইপজিগে তাঁর পরাজয়ের পর শত্রæসেনা ঢুকে পড়লে সেই ফরাসি জাতি ছিল উদাসীন। এমনকি
নেপোলিয়নের ‘পিতৃভুমি বিপন্ন’ ধ্বনি কোনো ফল হয়নি। নীরব দাবি ওঠে যে “আর যুদ্ধ নয়, জাতি
এখন শান্তিচায়’’। নেপোলিয়ন জাতির সেই নীরব দাবি আগে বোঝেননি, শোনেননি। ফলে ফরাসিরা
প্রায় বিনা প্রতিরোধে শত্রæসেনাকে নিজ দেশে ঢুকতে দেয়। এর মূল কারণ নেপোলিয়নের সাধারণ
জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা। আইন সভা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে প্রস্তাব নেয় যে, “আজ পিতৃভূমির দ্বারে
শত্রæ সেনা দেশের বাণিজ্য, শিল্প ধ্বংস প্রায় স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা, অতিরিক্ত করভার, নির্বিচার


সৈন্যসংগ্রহ এবং এক বর্বর যুদ্ধের চাপে ফরাসি জাতি ধ্বংসের মুখে’’। “আইন সভার এই প্রস্তাব প্রমাণ
করে যে, নেপোলিয়ন সমগ্র জাতির সমর্থন হারান।
৯। সাম্রাজ্যের অন্তর্নিহিত স্ববিরোধ
নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের বিপর্যয় ছিল সুনিশ্চিত, কারণ সাম্রাজ্যের অন্তর্নিহিত স্বার্থ ছিল স্ববিরোধী এবং
অসংগতিপূর্ণ। ডেভিড থমসনের ভাষায় “অন্তর্নিহিত, আত্মঘাতী স্ববিরোধ, তাঁর পতনের জন্য দায়ী
ছিল”। (ঞযব ঘধঢ়ড়ষবহরপ ঊসঢ়রৎব ধিং ফড়ড়সবফ নবপধঁংব ড়ভ রঃং রহযবৎবহঃ ধহফ ংবষভ ফবভবধঃরহম
পড়হঃৎধফরপঃরড়হং)। ১৮০৪ সালে যে যুদ্ধের শুরু ১৮১৪ সালে তা শেষ হয়। নেপোলিয়নের সিংহাসন
ত্যাগ এই দীর্ঘ সাময়ের মধ্যে ফ্রান্সে যুদ্ধ বিরতি ঘটেনি। মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে
নেপোলিয়ন ব্রিটেনের নৌ শক্তি ও বাণিজ্য ধ্বংস করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এই ব্যবস্থা কার্যকর
করতে নেপোলিয়ন রাজ্য জয়ের এক সর্বাত্মক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এটা ছিল রাজ্য জয় ও প্রতিরোধের
এক জোট পাকানোর আবর্ত যা নেপোলিয়নের সম্রাজ্যে সংহতির পক্ষে ক্ষতি কারক হয়। নেপোলিয়নের
বংশগত ও জাতীয়তাবাদী স্বার্থে ও নীতির মধ্যে প্রচন্ড আন্তবিরোধ ছিল যা সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল করে
ফেলে। তিনি হল্যান্ড, নেপলস, ওয়েস্টফেলিয়া ও স্পেনের সিংহাসনে নিজের আত্মীয়দের বসিয়ে
ইউরোপে এক নতুন বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য স্থাপন করেন যা ছিল বিপ্লবের আদর্শের পরিপন্থী। যে
আদর্শের কথা প্রচার করে তিনি ক্ষমতার চরম শিখরে আরোহণ করেছিলেন তা তিনি নিজেই ধবংস
করে নিজের পতন অনিবার্য করে তোলেন।
১০। মিত্রশক্তির জোট ও নেপোলিয়নের বিরোধিতা
নেপোলিয়ন প্রথম দিকে যে সামরিক সাফল্য অর্জন করেন তার অন্যতম কারণ ছিল শত্রু পক্ষের দুর্বলতা
ও একতার অভাব । এই সময় নেপোলিয়ন ভেদ নীতি ও সামরিক চাপ দ্বারা শত্রæ জোট গুলো ভাঙতে
সক্ষম হন। কিন্তু চতুর্থ শক্তি জোট গঠিত হলে নেপোলিয়নের পক্ষে তা ভাঙা সম্ভব হয়নি। কারণ এই
জোটের সদস্যরা নেপোলিয়নের পতন না ঘটা পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সংকল্প গ্রহণ করে।
ইংল্যান্ড এই জোটকে অর্থ ও নেতৃত্ব দেয়। ইউরোপের সম্মিলিত শক্তি জোটের বিরুদ্ধে নেপোলিয়নের
জনবল ও সম্পদ ছিল নগন্য। ইউরোপীয় রাজ শক্তিগুলি বুঝতে পারে যে, যতক্ষণ নেপোলিয়নের
ক্ষমতায় থাকবেন ততক্ষণ তাদের সিংহাসন নিরাপদ নয়। এই রাজশক্তি গুলির সামরিক জোটই
নেপোলিয়নের পতন ঘটায়। প্রথম জোট গুলি কূটনীতি ও সামরিক বিষয় দ্বারা ভাঙতে পারলেও চতুর্থ
জোট তাঁর পতন অনিবার্য করে।
১১। পোপের সঙ্গে বিরোধ
পোপের সংগে বিবাদ ও পোপের প্রতি দুর্ব্যবহার নেপোলিয়নের পতনের অপর কারণ। নেপোলিয়ন
পোপের অধিকারভুক্ত সকল বন্দরে ব্রিটিশ পণ্যবাহী জাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার দাবি করেছিলেন।
কিন্তু পোপ নিরপেক্ষ থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলে নেপোলিয়নের সংগে তার সংঘর্ষ বাধে। নেপোলিয়ন
পোপকে বন্দি করে তাঁর রাজ্য দখল করেন। ফলে নেপোলিয়ন ফ্রান্সের ক্যাথলিক স¤প্রদায়ের ঘৃণা ও
বিদ্বেষ অর্জন করেন। ক্যাথলিক স¤প্রদায়ের বিরোধিতা স্বদেশে নেপোলিয়নের জনপ্রিয়তা বহুলাংশে ক্ষুন্ন
করে।
১২। ইংল্যান্ডের নৌশক্তির প্রভাব
সমুদ্রের উপর ব্রিটিশ নৌশক্তির প্রাধান্য নেপোলিয়নের পতনের অপর কারণ ছিল। নেপোলিয়নের
মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা ব্রিটিশ শক্তিকে খর্ব করতে পারেনি। বরং সমুদ্রের উপর ব্রিটিশ নৌশক্তি
অপ্রতিহত থাকায় ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি ব্রিটেনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ইংল্যান্ডের নৌশক্তি নেপোলিয়নের
মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থাও ভেঙ্গে ফেলে। ট্রাফালগারের যুদ্ধে জয়লাভের পর ইংল্যান্ড সমুদ্র পথে
অপরাজেয় হয়। ফ্রান্সে দ্রব্যের আমদানি রপ্তানি ইংল্যান্ড একেবারেই বন্ধ করে। ফ্রান্স কর্তৃক ইংল্যান্ডকে
এস এস এইচ এল বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস পৃষ্ঠা - ৪৩
অবরোধের বদলে বরং ইংল্যান্ডই ফ্রান্সকে অবরোধ করে। ইংল্যান্ড বুঝতে পারে যে নেপোলিয়নের
অবরোধ ব্যবস্থা সফল হলে ইংল্যান্ডের বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাজার ধ্বংস হবে। সুতরাং, নেপোলিয়নের
ক্ষমতা ধবংসের জন্য ইংল্যান্ডের চেষ্টা অব্যাহত থাকে একের পর এক শক্তি জোট গড়ে তোলে।
ইংল্যান্ডের নেতৃত্বে চতুর্থ শক্তি জোট নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয়ে সহায়ক হয়।
সারসংক্ষেপ
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সাধারণ সৈনিক অবস্থা থেকে নিজ যোগ্যতা ও পারিপার্শ্বিক আনুকূল্যের কারণে
ফ্রান্সে ক্ষমতার শীর্ষস্থান লাভে সক্ষম হন। কিন্তু তাঁর একগুঁয়েমি উচ্চাশা তাঁর জীবনে বয়ে আনে চরম
ব্যর্থতা যার পরিণাম সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন এবং করুণ পরিণতি। নেপোলিয়ন ক্ষমতা লাভের পর
ফরাসি জাতির যে অকুন্ঠ সমর্থন পেয়েছিলেন তাঁর কার্যকলাপে তিনি তাদেরই সমর্থন হারান। মহাদেশীয়
অবরোধ ব্যবস্থা কার্যকর করা এবং দীর্ঘকাল যুদ্ধে জড়িয়ে থাকার কারণে তার সৈন্যদের মাঝে দুর্বলতা
দেখা দেয় এবং ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। এছাড়া তিনি তাঁর সৈন্য দল সম্পর্কে যে
উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন তা ভ্রান্তপ্রমাণিত হয় এবং ইউরোপে সামরিক জোট মোকাবিলা করা তার
পক্ষে সম্ভবপর ছিলনা। স্পেন ও মস্কো আক্রমণে তাঁর সামরিক দুর্বলতা ইউরোপবাসীর কাছে ধরা পড়ে
এবং সমগ্র ইউরোপে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং শেষ পরিণামে তার পতন অনিবার্য হয়ে
পড়ে।


পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্র্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থায় প্রকৃত পক্ষে ক্ষতিগ্রস্তহয়
ক. রাশিয়া খ. ব্রিটেন
গ. ফ্রান্স ঘ. স্পেন
২। কত সালে লিপজিগের যুদ্ধ হয়?
ক. ১৮০৭ খ. ১৮০৮
গ.১৮১২ ঘ. ১৮১৩
৩। “ঞযব ঝঢ়ধহরংয ঁষপবৎ ৎঁরহবফ সব” এটা কার উক্তি ?
ক. নেপোলিয়নের খ. আলেকজান্ডারের
গ. সেনাপতি কুটুজফ এর ঘ. প্রিন্স ওয়েলিংটনের
৪। নেপোলিয়নের ভাইয়ের নাম কি ?
ক. নেপোলিয়ন জুনিয়র খ. যোসেফ বোনাপার্ট
গ. প্রিন্স ওয়েলিংটন ঘ. কুটুজফ ।

সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. নেপোলিয়নের পতনের সূচনা সম্পর্কে কি জানেন ?
২. নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর কি ত্রæটি ছিল ?
৩. মস্কো অভিযান নেপোলিয়নের পতনের জন্য কতটুকু দায়ী ?
৪. আপনি কি মনে করেন নেপোলিয়নের স্পেনীয় নীতি ভ্রান্তছিল ?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। নেপোলিয়নের পতনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করুন।
২। নেপোলিয়নের গৃহীত নীতিই তার পতনের জন্য দায়ী, ব্যাখ্যা করুন ?
৩। স্পেন ও রাশিয়া অভিযান নেপোলিয়নের পতনের জন্য কতখানি দায়ী ছিল?

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]