নেপোলিয়নের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।


নেপোলিয়নের মূল্যায়ন
সংক্ষিপ্ত জীবনী
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ১৭৬৯ সালের ১৫ আগস্ট কর্সিকা দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম
কার্লো বোনাপার্ট এবং মাতার নাম লেটিজিয়া বোনাপার্ট। প্রথম জীবনে নেপোলিয়নের লক্ষ্য ছিল
কর্সিকার স্বাধীনতা অর্জন করা। ফ্রান্সের শাসনভুক্ত হওয়ার পর কর্সিকার উপর ফ্রান্সের অত্যাচারি শাসন
নেপোলিয়নকে ক্ষুব্ধ করেছিল। কিন্তু ফরাসি বিপ্লব শুরু হওয়ার অল্প কালের মধ্যেই কর্সিকাকে এক স্বতন্ত্র
প্রদেশের মর্যাদা দেওয়া হলে নেপোলিয়নের ফরাসি-বিরোধী মনোভাবের অবসান ঘটে এবং তিনি
ফ্রান্সের জাতীয় আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ১৭ বছর বয়সে তিনি ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীতে
যোগদান করেন এবং নিজ দক্ষতার মাধ্যমে ফ্রান্সের রাজক্ষমতার অধিকারী হন। একের পর এক
সাফল্য নেপোলিয়নকে উচ্চাকাক্সক্ষী করে তোলে। অবশেষে ১৮১৫ সালে ওয়াটারলুর যুদ্ধে তিনি
চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত হন এবং এখানেই ১৮২১ সালে তাঁর জীবনের
পরিসমাপ্তি ঘটে।
নেপোলিয়নকে প্রধানত তিনটি দিক থেকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে।
(১) বিজেতা
(২) সংস্কারক
(৩) শাসক
(১) বিজেতা নেপোলিয়ন
ফরাসি বিপ্লবের সৃষ্টি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ১৭৯৫ সালে জেনারেল পদে উন্নীত হন। সেনাবাহিনীর উচ্চ
পদ লাভ করার পর থেকে বিপুল উৎসাহে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার কর্মসূচি শুরু হয়। ১৭৯৩ সালের ডিসেম্বর
মাসে ব্রিটিশ বাহিনীকে টুলো (ঞড়ঁষড়হ) থেকে বিতাড়িত করার মাধ্যমে তাঁর সামরিক সাফল্যের সূচনা
হয়। ১৭৯৫ সালে ভেন্ডিমিয়ার এ রাজতন্ত্রীদের সশস্ত্র বিদ্রোহ দমন করেন। এরপর ডাইরেক্টরি শাসন
আমলে ১৭৯৬ সালে তিনি ইতালি অভিযানে যোগদান করেন। ১৭৯৭ সালে তিনি রিভোলির যুদ্ধে জয়
লাভ করে অস্ট্রিয়াকে ক্যাম্পোফোর্মিও সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করেন। ১৭৯৮ সালে নেপোলিয়ন মিশর
অভিযানে যোগদান করেন কিন্তু নীল নদের যুদ্ধে ব্রিটিশ নৌ-সেনাপতি নেলসন ফরাসি বাহিনীকে
পরাজিত করে। ১৮০০ সালে তিনি মরেঙ্গা ও ১৮০১ সালে লুনেভাইল এর যুদ্ধে জয়লাভ করে ব্রিটেনের
সঙ্গে আমিয়েন্স এর সন্ধি সম্পাদন করেন। ১৮০৪ সালে নেপোলিয়ন সম্রাট উপাধি ধারন করেন এবং
ইংল্যান্ড আক্রমণের অভিপ্রায়ে বুলন (ইড়ঁষড়মহ) এ শিবির স্থাপন করেন। ১৮০৫ সালে ব্রিটিশ নৌ
সেনাপতি নেলসন ট্রাফালগারের যুদ্ধে জয়লাভ করেন, কিন্তু নেপোলিয়ন উলম এর যুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে এবং
অস্টারলিজের যুদ্ধে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার যুগ্মবাহিনীকে পরাজিত করেন। ১৮০৬ সালে নেপোলিয়ন তার
দুই ভাই যোসেফ ও লুইকে যথাক্রমে নেপেলস ও হল্যান্ডের সিংহাসনের অধিষ্ঠিত করেন। নেপোলিয়ন
প্রাশিয়াকে জেনার যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন এবং একই বছর তিনি বার্লিন নির্দেশ (ইবৎষরহ
উবপৎবব) জারি করে মহাদেশীয় ব্যবস্থা চালু করেন। ১৮০৭ সালে ফ্রিডল্যান্ডের যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে



শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে রুশ সম্রাটের সঙ্গে টিলজিটের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। ১৮০৮ সালে
নেপোলিয়ন ভাই যোসেফকে স্পেনের সিংহাসনে বসান। ১৮০৯ সালে অরেন্সবার্গের যুদ্ধে অস্ট্রিয়গণকে
পরাজিত করেন এবং একই বছর রানী যোসেফিনকে বিয়ে করেন। ১৮১০ সালে তিনি ম্যারি লুইকে
বিয়ে করেন এবং একই বছর হল্যান্ড, পোপ শাসিত রাজ্য সমূহ ও জার্মানির উত্তরাঞ্চল ফরাসি
সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। ১৮১২ সালে তিনি রাশিয়া আক্রমণ করেন এবং বরোডিনোর যুদ্ধে জয়লাভ করেন
ও মস্কো দখল করেন। ১৮১৩ সালে তিনি পোপ সপ্তম পায়াস এর সঙ্গে ফন্টেনবø্যুর শান্তিস্থাপন করেন।
১৮১৪ সালে বøুশ্যার ও শোয়ারজেনবার্গের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। একই বছর এপ্রিল মাসে তিনি
সিংহাসনচ্যুত হয়ে ভূ-মধ্যসাগরের অন্তর্গত এলবা দ্বীপে নির্বাসিত হন। ১৮১৫ সালে তিনি এলবা দ্বীপ
থেকে পলায়ন করে পুনরায় ফ্রান্সে প্রবেশ করেন। ওয়াটারলুর (ডধঃবৎষড়ড়) যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি
ওয়েলিংটনের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত হন এবং ১৮২১ সালের
৫ মে সেন্ট হেলেনায় তার বৈচিত্র্যময় জীবনের অবসান ঘটে। অর্থাৎ বিজেতা হিসেবে নেপোলিয়ন প্রথম
দিকে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেন এবং একের পর এক ফ্রান্সকে এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী
করেন। বলতে গেলে সমগ্র ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ স¤প্রসারিত হয়। কিন্তু সাম্রাজ্য স্থাপনের
উচ্চকাঙক্ষা ধীরে ধীরে তাঁর পতন বয়ে আনে।
সংস্কারক হিসাবে নেপোলিয়নের মূল্যায়ন
বুরবোঁ রাজ বংশের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ফরাসি বিপ্লবের শুরু হয়েছিল কিন্তু এর ফলে
বুরবোঁ রাজবংশের স্বৈরতন্ত্রের স্থলে নেপোলিয়নের স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। কনস্যুলেট এর শাসন কালে
নেপোলিয়নই প্রকৃতপক্ষে সর্বাতœক ক্ষমতার অধিকারী হন। ১৮০৮ সালে তিনি জনগণের প্রতিনিধি
হিসেবে নিজেকে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী বলে ঘোষণা দেন। নেপোলিয়ন স্বৈরতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা করলেও তাঁর সংস্কারগুলি ছিল গঠনমূলক এবং তিনি ফ্রান্সে শান্তিশৃংখলা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ
হন। ডেভিড থমসন এ প্রসঙ্গে বলেন, "ইড়হধঢ়ধৎঃব ফরংপরঢ়ষরহবফ ঋৎধহপব ধহফ বংঃধনষরংযবফ ড়ৎফবৎ"
ফ্রান্সে লুটতরাজ বন্ধ, মানুষের জীবন ও ধন সম্পত্তি সুরক্ষিত, জন কল্যাণমূলক কর্মসূচি গৃহীত এবং
যোগ্যতার মর্যাদা স্বীকৃত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়
এবং যুব স¤প্রসাদায়কে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে তোলা হয়। বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি বিদ্যার প্রসারে
সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। নেপোলিয়ন নিজেই বিজ্ঞান ও চারু শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
এককথায় বলতে গেলে তিনি ফ্রান্সকে আধুনিকভাবে গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। ফরাসি বিপ্লব
থেকে উদ্ভূত ফ্রান্সের বিজ্ঞান সম্মত নতুন প্রশাসন ইউরোপে অনুকরণীয় হয়ে উঠে। নেপোলিয়ন রচিত
আইনগুলি (ঈড়ফব ঘবঢ়ড়ষবড়হ) ফ্রান্সের পক্ষে মঙ্গলজনক ছিল এতে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে ফ্রান্সে
নেপোলিয়নের স্বেচ্ছাতন্ত্রকে কেন্দ্রীয়করণের চেষ্টাও করা হয়। নেপোলিয়নের শাসন ও সামাজিক
সংস্কারগুলি পর্যালোচনা করে ঐতিহাসিক ফিশার মন্তব্য করেছেন যে, যদিও নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য স্থায়ী
হয়নি, তাঁর অসামরিক সংস্কারগুলি গ্রানাইট প্রস্তরের ভিত্তির উপর স্থায়ীভাবে নির্মিত হয় (ওভ ঃযব
পড়হয়ঁবংঃং ড়ভ ঘধঢ়ড়ষবড়হ বিৎব বঢ়যবসবৎধষ, যরং ঈরারষরধহ ড়িৎশ রহ ঋৎধহপব ধিং নঁরষঃ ঁঢ়ড়হ
মৎধহরঃব). নেপোলিয়নের এই সংস্কারগুলি কেবলমাত্র ফ্রান্সে পুনরুজ্জীবন ঘটায়নি, সমগ্র ইউরোপে নতুন
সমাজ সংগঠনের সূচনা করে। নেপোলিয়ন শৃংখলার সাথে স্বাধীনতা ও সাম্যের সমন্বয় সাধন করেন।
ফ্রান্সের বিপ্লবী প্রজাতন্ত্র সন্ত্রাসের রাজত্বের আমলে যে সংহার মূর্তি ধারণ করে, নেপোলিয়ন সেই
আতœঘাতী অরাজকতাকে শৃঙ্খলায় বেঁধে ফেলেন।
শাসক হিসাবে নেপোলিয়নের মূল্যায়ন
শাসক হিসাবে নেপোলিয়নকে মূল্যায়ন করতে হলে তাঁর শাসনের বিভিন্ন দিক আলোচনা করা
প্রয়োজন। এখানে তাঁর শাসনের বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হল।
ক. শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি


১৭৯৯ হতে ১৮১৪ পর্যন্তফ্রান্সের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে ইউরোপের ইতিহাস আবর্তিত হয়। এই যুগে
ফ্রান্সের ইতিহাস বলতে নেপোলিয়নের কর্মধারা বোঝায়। নেপোলিয়ন প্রতিষ্ঠিত শাসন ব্যবস্থা ছিল
ফরাসি ইতিহাসের এক উলেখযোগ্য যুগ। নেপোলিয়ন ফ্রান্সে যে রাজতন্ত্র স্থাপন করেন তা ছিল অভিনব।
এটি চিরাচরিত বংশনুক্রমিক রাজতন্ত্র ছিলনা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র ছিল একটি ভূঁইফোঁড় সামরিক
স্বৈরতন্ত্র। তিনি সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে ফরাসি সিংহাসন অধিকার করেন। সিংহাসনে বসার
পর তিনি দুভাবে এই শাসনকে মজবুত করেন। প্রথমত, গণভোটের দ্বারা তাঁর রাজতন্ত্রকে তিনি বৈপ্লবিক ভিত্তিদানের চেষ্টা করেন। অপরদিকে বংশানুক্রমিক রাজাদের ন্যায় দরবার, সভাসদ ও অনুষ্ঠান
দ্বারা তিনি এই শাসন ব্যবস্থাকে লোকচক্ষে শ্রদ্ধেয় করার চেষ্টা করেননি। কিন্তু মূলত সামরিক শক্তিই
ছিল তাঁর ক্ষমতার উৎস। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের যুগে নেপোলিয়নের এই সামরিক রাজতন্ত্র এক
অভিনব ছিল তাতে সন্দেহ নেই।
নেপোলিয়নের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে মূল্যায়ন একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। তাঁর সমকালীন লেখক গনের
লেখনীতে তিনি কালো রং এ রঞ্জিত হয়েছেন। তাঁদের ভাষায় উচ্চাকাঙক্ষামূলক যুদ্ধে ফরাসিদের
ব্যাপক রক্তদানে তিনি বাধ্য করেন, করের চাপে জনসাধারণকে নিঃস্ব করেন এবং তাদের উপর
স্বৈরশাসনের জোয়াল চাপিয়ে দেন। ঐতিহাসিক এইচ.জি ওয়েলস নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত
উচ্চকাঙক্ষাকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেন। অপর দিকে ঊনিশ শতকের ইতিহাসবিদ থিয়ার্স
(ঞযরবৎং) এবং আলবেয়ার সোরেল নেপোলিয়নকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন। সোরেলের মতে
বিপ্লবের আদর্শের জীবন্তপ্রতীক ছিলেন নেপোলিয়ন। তিনি বিপ্লবের আদর্শকে আতœস্থ করে তার বিষময়
দিকগুলি হজম করেন, মঙ্গলময় দিককেই প্রতিষ্ঠা দেন। জ্যাকোবিন যুগের শ্রেণী সংগ্রামের ঝড়ে যখন
সবকিছু তছনছ হচ্ছিল, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না, সেই সংকটময় সময়ে তিনি আবির্ভূত হন।
তিনি কৃষকদের হাতে জমি দিয়ে, অভিজাতদের শাসনের দায়িত্ব দেন এবং বুর্জোয়াদের জাতি গঠনের
জন্য কাজ করার সুযোগ দেন এবং ফলে অল্পদিনের মধ্যেই ফ্রান্সের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়। তিনি বলেন,
সপ্তদশ শতকে চতুর্দশ লুই একদা ফ্রান্সের জন্য প্রাকৃতিক সীমান্তলাভ করতে চান। বিপ্লবী ফ্রান্স রাইন
নদী পর্যন্তফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত করে ফ্রান্সের প্রাকৃতিক সীমারেখা স্থাপনের চেষ্টা করে। নেপোলিয়নের রাজ্য
জয় ছিল সেই ভাবধারার উত্তর সাধনা। মোটকথা ইতিহাসের অঙ্গনে নেপোলিয়ন যে পদচিহ্ন রেখে
গেছেন, তা ইউরোপ বহু চেষ্টা করেও মুছে ফেলতে পারেনি। তাই রোড্ডাওয়ে বলেন,‘‘যেখানেই
নেপোলিয়নের সেনাদল যায়, সেখানে আর পূর্বের অবস্থা কোনো দিন ফিরে আসেনি।
খ. নেপোলিয়নের শাসন ব্যবস্থায় সাম্যবাদী প্রভাব
নেপোলিয়ন নিজে তাঁর স্থাপিত রাজতন্ত্রের দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এজন্য তিনি বিপ্লবের
অন্যতম আদর্শ “সামাজিক সাম্য নীতি” গ্রহণ করেন। সামাজিক সাম্য নীতি প্রয়োগ করে তিনি তাঁর
শাসনকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেন। অপরদিকে বিপ্লবের স্বাধীনতার আদর্শকে তিনি বর্জন করেন।
কারণ, স্বাধীনতা অর্থাৎ গণতন্ত্রের আদর্শ এবং তাঁর স্বৈরশাসন ছিল পরস্পর বিরোধী। রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
করে তিনি পুরাতনতন্ত্রকেই ফিরিয়ে আনেন। ডেভিড থমসনের মতে, “বিপ্লবের সন্তান নেপোলিয়ন
ছিলেন অভিষিক্ত, মুকুটধারী জ্যাকোবিন”।
নেপোলিয়ন বিপ্লবের আদর্শকে প্রকৃত পক্ষে কতটুকু গ্রহণ করেন এ সম্পর্কে অধুনা ঐতিহাসিকরা
নতুনভাবে আলোচনা করেছেন। জর্জ রুডের মতে, নেপোলিয়ন সাম্য নীতিকে পুরোপুরি গ্রহণ করেন
বলে যে অভিমত প্রকাশ করা হয় তা ঠিক নয়। তাঁকে মুকুটধারী জ্যাকোবিনও বলা চলেনা। কারণ
জ্যাকোবিন দল যে সাম্যনীতির আদর্শে বিশ্বাস করত নেপোলিয়ন তা বর্জন করেন। তিনি
জ্যাকোবিনদের মত দরিদ্র, সর্বহারা শ্রেণীর উন্নতির জন্য কোনো চেষ্টা করেননি। তিনি সর্বনি¤œমজুরি
আইন, সর্বোচ্চ মূল্যমান আইন, কর্মসংস্থান আইন বর্জন করেন। তিনি ১৭৯১ সালে বুর্জোয়া সংবিধানের


কিছু কিছু আদর্শ গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৭৯২ সালের পর জ্যাকোবিন যুগের সংবিধান ও সাম্যকে বর্জন
করেন। সুতরাং, নেপোলিয়ন ছিলেন মূলত বুর্জোয়াতন্ত্রের সমর্থক।
দমননীতি
ফ্রান্সে সম্রাট পদে বসার পর নেপোলিয়ন আইন ও শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভূত সংস্কার চালু করেন। গোড়ার
দিকে তাঁর শাসন ছিল জনপ্রিয় ও কল্যাণমুখী। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের চাপে তাঁর উদার শাসন এক
দমনমূলক স্বৈরাচারী পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। নেপোলিয়ন তার রাষ্ট্রে সংগঠনশক্তি, শৃঙ্খলা স্থাপন, ব্যয়
সংকোচ , ফরাসি জাতির উপর নি¤œতম কর স্থাপনের দ্বারা শাসন ব্যবস্থার উৎকর্ষ দেখান। তিনি নিয়ম
করে দেন যে, সেনাদল ও যুদ্ধের জন্য ব্যয় ফরাসি জাতির উপর না চাপিয়ে অধিকৃত দেশগুলো থেকে
আদায় করা হবে। ফরাসি জাতির গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করলেও তিনি তাদের সুশাসন দান
করেন। তাঁর কোর্ড নেপোলিয়ন, আইনের চোখে সমান অধিকার দান ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি
চাকরিতে নিয়োগ প্রথা জনপ্রিয় ছিল।
ঘ. স্বৈরতন্ত্রী চরিত্র
নেপোলিয়নের একনায়কতন্ত্র রোবসপিয়েরের একনায়কতন্ত্রের ন্যায় অন্ধ ছিল না অথবা হিটলারি
একনায়কতন্ত্রের ন্যায় নিষ্ঠুর ও বর্বর ছিলনা। এই শাসন ব্যবস্থা উগ্রপন্থী জ্যাকোবিনদের নিকট অপ্রিয়
হলেও মধ্যবিত্ত সাধারণ লোক ও কৃষকদের নিকট জনপ্রিয় ছিল। যতদিন ফরাসি জনসাধারণ বুরবোঁপন্থী
রাজতন্ত্রবাদীদের পুনরায় ক্ষমতা লাভ এবং জ্যাকেবিনপন্থীদের সন্ত্রাসের ভয়ে ভীত ছিল ততদিন
বোনাপার্ট ছিল মধ্যপন্থা এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থের সমর্থক। কিন্তু ক্রমে লোকজন নেপোলিয়নের
স্বৈরশাসনের সমালোচনা শুরু করে। ১৮০৮ সালের পর নেপোলিয়নের বৈদেশিক নীতিতে বিপর্য়য় দেখা
দিলে তার অশুভ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফলে তাঁর শাসনের আকর্ষণ নষ্ট হয়। নেপোলিয়নের শাসনের
গুণগত দিকগুলি জনসাধারণের নিকট ¤øান হয়ে যায়। তবুও একথা সত্য যে, নেপালিয়ন ফরাসি
জাতিকে এক সময়ে পানপাত্র ভরে যুদ্ধ জয়ের গৌরব দান করেন।
৬. ফ্রান্সের বাইরে সাম্রাজ্যের আদর্শগত প্রভাব
নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য ইউরোপে বিপ্লবের আদর্শ প্রচারে সহায়ক হয়। তিনি ছিলেন বিপ্লবের তরবারি।
১) তিনি ইউরোপের পুরাতন রাজ শক্তিগুলিকে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও নির্বাসনে পাঠান, স্বর্গীয়
অধিকারের আদর্শকে নস্যাৎ করেন;
২) তিনি সামন্ততন্ত্র ও সার্ফ প্রথা ধবংস করে ইউরোপের মধ্যযুগীয় শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস
করেন;
৩) কোড নেপোলিয়ন দ্বারা তিনি নতুন সমাজ ব্যবস্থাকে আইনগত রূপ দেন। নেপোলিযনের পতনের
পরও তাঁর সংস্কারগুলি অব্যাহত থাকে;
৪) তিনি খন্ড খন্ড জার্মানিকে পুনর্গঠনকরে একে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেন। এর পরোক্ষ ফল
হিসেবে জার্মান জাতীয়তাবাদ ও ঐক্য চিন্তার উদয় হয়। নেপোলিয়ন তার অধীনে ইতালিকে
ঐক্যবদ্ধ করে ইতালীয় ঐক্যের আদর্শ স্থাপন করেন;
৫) তিনি স্বয়ং জাতীয়তাবাদের বিরোধী হলেও তাঁর শাসনের কঠোরতা অধিকৃত দেশগুলিতে
জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
নেপোলিয়নের চূড়ান্তমুল্যায়ন
এস এস এইচ এল বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস পৃষ্ঠা - ৪৯
বলা হয়ে থাকে যে, ১৭৯৯ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্তইউরোপের ইতিহাস মূলত ফ্রান্সের ইতিহাস এবং
এই সময়ের মধ্যে ফ্রান্সের ইতিহাস হল নেপোলিয়নের জীবনী ও কর্ম। প্রকৃতপক্ষে এই যুগে ফ্রান্স তথা
ইউরোপের ইতিহাসের প্রধান নায়ক ছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। নেপোলিয়নের যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য
হল পূর্বতন যুগের ব্যবস্থা ও বিপ্লবী আদর্শের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রচেষ্টা এবং বহির্বিশ্বে বিপ্লবের
আদর্শের প্রসার ঘটানো। নেপোলিয়নের শাসনকালকে কয়েকটি অধ্যায়ে ভাগ করে মূল্যায়ন করা যেতে
পারে। প্রথম অধ্যায় ১৮০২ থেকে ১৮০৪ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে নেপোলিয়নকে যাবজ্জীবনের জন্য
প্রথম কনস্যাল নিযুক্ত করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র অব্যাহত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে
নেপোলিয়নের স্বেচ্ছাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। এছাড়াও এই সময়ে নেপোলিয়ন ফ্রান্সে এক সংস্কার যুগের
সূচনা করেন। নেপোলিয়ন যুগের পরবর্তী অধ্যায় হল ১৮০৪-১৮১৪ সাল অন্তবর্তীকাল। এই সময়ে
ফরাসি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণ করা হয়। নেপোলিয়ন রাজতন্ত্রের পুনপ্রতিষ্ঠা করে ইউরোপে
ফরাসি সাম্রাজ্যের স¤প্রসারণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। একই সাথে তিনি ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ
প্রচারেও প্রয়াসী হন।
নেপোলিয়ন ছিলেন সাম্যবাদী আদর্শের পরম পৃষ্ঠপোষক। কনস্যাল ও সম্রাট হিসেবে তিনি এই
আদর্শের উপর ভিত্তি করে বহুবিধ প্রগতিশীল সংস্কার কার্য সম্পাদন করেন। তিনি স্বয়ং ছিলেন নতুন
সমাজের সন্তান। তিনি সামন্ত-প্রথা এবং অভিজাত ও যাজকদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা বিলুপ্ত করে বিপ্লব
প্রসূত নতুন ভূ-সম্পত্তির ব্যবস্থাদি বজায় রাখেন। নেপোলিয়নীয় আইন বিধি সামাজিক সাম্য ও
আইনের চোখে সকলের সমতার আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করে।
ইউরোপে নেপোলিয়ন আধুনিক ধ্যানধারণার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেন। ফ্রান্সের অধিকৃত ইউরোপের
রাষ্ট্রগুলিকে পুনর্গঠন করে তিনি পূর্বতন যুগের রাষ্ট্রীয় আদর্শের উপর চরম আঘাত করেন। তিনি একের
পর এক রাশিয়া,অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি পর্যুদস্তকরেন এবং এই সকল রাষ্ট্রের
রাজতন্ত্রের অসারতা প্রতিপন্ন করেন। যদিও নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপে অনেক রাষ্ট্রে
প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্রের পুনপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তথাপিও এটা অনস্বীকার্য যে, নেপোলিয়ন তথা ফরাসি
বিপ্লবের ভাবধারার বিরুদ্ধে সেই রাজতন্ত্রগুলি দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারেনি। নেপোলিয়নের সামাজিক
আদর্শও ইউরোপকে প্রভাবিত করেছিল। রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের সাথে তিনি ইউরোপের সমাজ পুনর্গঠনে
ব্রতী হেেয়ছিলেন এবং প্রগতিমূলক সংস্কার সম্পাদন করেছিলেন। সামন্তপ্রথা ও অভিজাতদের বিশেষ
সুযোগ সুবিধা বিলুপ্ত করায় পূর্বতন সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং সমাজে সাধারণ মানুষের মর্যাদা
স্বীকৃতি লাভ করে। ইউরোপের সামাজিক পুনর্গঠনের ব্যাপারে নেপোলিয়নের আইনবিধি আদর্শ রূপে
গৃহীত হয়। সামাজিক পুনগর্ঠনের ব্যাপারে গির্জার দাবি অস্বীকৃত হয়। অভিজাতদের ন্যায় মধ্যবিত্ত ও
কৃষক শ্রেণী সরাসরি রাষ্ট্রের প্রজারূপে স্বীকৃত হয়। সমতার আদর্শের ভিত্তির ওপর রাষ্ট্রের করধার্য ও তা
আদায় করার রীতি প্রচলিত হয়। পূর্বতন শিল্প সংঘ ও নগর শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয় এবং সেই সঙ্গে
অভ্যন্তরীণ শুল্ক ব্যবস্থাও বিলুপ্ত হয়। ডেভিড থমসন বলেন “নেপোলিয়নের রাজ্যজয়ের ফলে ইউরোপের
সর্বত্র আধুনিকতার দমকা হাওয়া প্রভাবিত হয়” (অ মঁংঃ ড়ভ সড়ফবৎহরংধঃরড়হ নষবি ঃযৎড়ঁময ঊঁৎড়ঢ়ব
রহ ঃযব ধিশব ড়ভ ঘধঢ়ড়ষবড়হ'ং পড়হয়ঁবংঃং)
নেপোলিয়ন বিপ্লবের রক্ষাকর্তা না সংহার কর্তা
ইউরোপের ইতিহাসে নেপোলিয়ন বহু আলোচিত ব্যক্তিত্ব। অনেক ঐতিহাসিক নেপোলিয়নকে ফরাসি
বিপ্লবের রক্ষা কর্তা বলেছেন। আবার অনেকের মতে নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের আদর্শকে রক্ষা
করার পরিবর্তে বরং সংহার করেছেন।
বিপ্লবের রক্ষাকর্তা হিসাবে নেপোলিয়ন
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এস এস এইচ এল
ইউনিট -১ পৃষ্ঠা - ৫০
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট নিজেকে “বিপ্লবের সন্তান” বলে দাবি করতেন। ফরাসি বিপ্লব পূর্বেকার রাষ্ট্রীয়
ব্যবস্থার বিলুপ্তি সাধন করে ও সামরিক এক নায়য়কতন্ত্রের পথ রচনা করে নেপোলিয়নকে সকল
ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের মহান আদর্শ ছিল তিনটি যথা-সাম্য, মৈত্রী
ও স্বাধীনতা। নেপোলিযন স্বাধীনতার আদর্শকে বর্জন করে অপর দুইটি আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন। এই
দুইটি আদর্শকে বাস্তবে রূপ দান করতে তিনি যতœবানও হয়েছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি
করেছিলেন যে সাম্যই ছিল ফরাসি জনগণের সর্ববৃহৎ আকাঙক্ষা। এই কারণেই তিনি বৈপ্লবিক ভুমিব্যবস্থা, সামন্তপ্রথার বিলোপ সমাজের কয়েকটি শ্রেণীর বিশেষ সুবিধা এবং করের বোঝা সকলের ওপর
সমানভাবে ধার্য করার বৈপ্লবিক বিধি ব্যবস্থা গুলি অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। ১৮০৪ সালে নভেম্বর মাসে
গণভোটের মাধ্যমে নেপোলিয়নের সম্রাট পদে নির্বাচন সমর্থন করা হয়েছিল। নেপোলিয়নের আইন
বিধি (ঈড়ফব ঘধঢ়ড়ষবড়হ) তে বিপ্লবী আইনগুলি সন্নিবিষ্ট করা হয়েছিল। যোগ্যতা অনুযায়ী তিনি
সরকারি কর্মচারী নির্বাচিত করেছিলেন এবং নিয়োগের ব্যাপারে তিনি কখনও জাতি বা বর্ণের বিচার
করেন নাই। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ ও প্রভাবকে তিনি স্থায়ী করার চেষ্টাও করেছিলেন। নেপোলিয়ন
এক সময়ে মন্তব্য করেছিলেন “আমিই বিপ্লব” (ও ধস ঃযব জবাড়ষঁঃরড়হ) একথা অস্বীকার করার উপায়
নেই যে, নেপোলিয়ন ছিলেন গণতান্ত্রিক সাম্য নীতির প্রতীক। সাধারণ বংশে জন্ম গ্রহণ করে ও অত্যন্ত
সাধারণ ভাবে লালিত পালিত হয়ে তার সম্রাট পদে উন্নীত হওয়ার মধ্যে এটা প্রমাণিত হয় যে ফরাসি
বিপ্লবের ফলে ফরাসি সমাজে সমতা স্থাপিত হয়েছিল। তিনি তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ফরাসি বিপ্লবের
অপর প্রধান আদর্শ ছিল আইনের চোখে সকলের সম মর্যদা স্বীকৃতি। সরকারি কর্মচারী নিয়োগের
ব্যাপারে তিনি এই আদর্শকে স্থায়িত্ব দান করে ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারা বিস্তার করেছিলেন।
নেপোলিয়ন ফরাসি রাষ্ট্রের অনুকরণে ইউরোপের বিজিত অঞ্চলের সর্বত্র তিনি সামন্তও দাস প্রথার বিলুপ্ত
ঘটিয়েছিলেন এবং সমাজ জীবনে সাম্যনীতির প্রয়োগ করে ছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় নেপোলিয়ন
ফরাসি বিপ্লবের রক্ষাকর্তা ছিলেন।
২) ফরাসি বিপ্লবের রক্ষাকর্তা হিসাবে নেপোলিয়ন বিদেশী শত্রæর আক্রমণ হতে ফ্রান্সকে রক্ষা করেন।
বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন ও ডাইরেক্টরীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে শক্তিশালী সুদক্ষ কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতিষ্ঠা
করে তিনি ফ্রান্সকে দারুণ অরাজকাতার হাত থেকে রক্ষা করেন। ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ জনকল্যাণ মূলক
কাজ, আইন বিধির সংস্কার, শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নের ব্যাপারেও তিনি
সক্রিয় ছিলেন।
বিপ্লবের সংহারক হিসাবে নেপোলিয়ন
নেপোলিয়নের কার্যাবলীর মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা থেকে তাকে ফরাসি বিপ্লবের রক্ষাকর্তা না
বলে সংহারক বলাই অনেকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন।
১) নেপোলিয়ন সাম্য নীতির প্রবল সমর্থক ছিলেন এবং তা কার্যকর করার জন্য জোর চেষ্টা চালান। কিন্তু
তিনি স্বাধীনতার আদর্শের প্রতি মোটেই আস্থাশীল ছিলেননা। তিনি জনগণের স্বাধীনতাকে সকল প্রকার
গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার মূল কারণ বলে মনে করতেন। এই কারণে রাষ্ট্রীয় পুনগর্ঠনের ক্ষেত্রে তিনি
জনগণের স্বাধীনতা কখনও স্বীকার করেন নাই। এছাড়া তিনি কর্মচারী মনোনীত করে সমগ্র প্রশাসনকে
নিজের হাতে কেন্দ্রীয়ভুত করেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করে বিপ্লবের আদর্শের প্রতি চরম
বিশ্বাসঘাতকতা করেন। নির্বাচনমূলক সংস্থাগুলি ভেঙে দিয়ে সেগুলোকে মনোনীত সংস্থায় পরিণত
করেন। প্রশাসনের প্রতিটি বিভাগে নিজ মনোনীত প্রিফেক্ট ও সাব প্রিফেক্ট নিয়োগ করে নেপোলিয়ন
পূর্বতন যুগে প্রচলিত ইনটেনডেন্ট নামক কর্মচারী নিয়োগ করার প্রথা পুনপ্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থা
ছিল বিপ্লবের আদর্শের বিরোধী।
২) ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম আদর্শ ছিল জাতীয়তাবাদ। কিন্তু নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য স¤প্রসারণের নীতি
গ্রহণ করে জাতীয়তাবাদ নীতির ঘোর বিরোধিতা করেন। ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতার যে বাণী প্রচার


করেছিল তার পূর্ণ বিকাশ হল জাতীয়তাবাদ। কিন্তু নেপোলিয়ন বিদেশী রাষ্ট্র জয়ে যে ধরনের স্বেচ্ছাতন্ত্র
প্রবর্তন করেন তা ছিল প্রকৃত পক্ষে বিপ্লবের আদর্শের সম্পূর্ন পরিপন্থী।
৩) ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলাকালে প্যারিসের জনগণ যে বিভীষিকার সৃষ্টি করেছিল তা নেপোলিয়নকে
অত্যন্তআতংকিত করেছিল। যে জনগণ বিপ্লবের তীব্রতা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি করেছিল, সেই জনগণের প্রতি
তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি স্পষ্ট উপলদ্ধি করেন যে, শক্তির সাহায্যে জনগণকে দমন করাই
রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য। বিপ্লব প্রসূত দ্রæত পরিবর্তনের ফলে জনগণের মধ্যে যে বিশৃঙ্খলার ও অবিবেচনার
উদ্ভব হয়েছিল তা নিবারণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে নেপোলিয়ন ঔপনিবেশিক নীতি গ্রহণ করেন এবং
প্যারিসের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনতে যতœবান হন। সরকারের সমস্যাবলী হতে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র
নিবদ্ধ করাই তিনি সরকারের প্রধান কর্তব্য বলে বিবেচনা করতেন। রাষ্ট্রে সমস্যা সমাধান করতে
জনগণ অসমর্থ এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারি শাসনের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি
করেন। এই কারণেই সম্রাট পদ গ্রহণের পূর্ব হতেই তিনি বাহ্যিক গণতন্ত্রের অন্তরালে স্বৈরাচারী
একনায়কতন্ত্র স্থাপনে সচেষ্ট ছিলেন। প্রকৃত পক্ষে তিনি শাসন কার্যে জনগণের মতামত বা সক্রিয়
অংশগ্রহণের ঘোর বিরোধী ছিলেন।
৪) ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় ঐক্য বিপদজনক করে তুলেছিল এবং কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার উপর তীব্র
আঘাত হেনেছিল। এই চিন্তা করে নেপোলিয়ন প্যারিসকে কেন্দ্র করে স্বৈরাচারী শাসনের প্রবর্তন করেন।
৫) নেপোলিয়নের স্বৈরাচারি সরকার জনগণের সার্বভৌমত্বের আদর্শকে সম্পূর্ণরূপে নস্যাৎ করেছিল।
এই সকল কারণেই নেপোলিয়ন একসময় মন্তব্য করেছিলেন “আমিই বিপ্লবকে ধ্বংস করেছি” (ও
ফবংঃৎড়ুবফ ঃযব জবাড়ষঁঃরড়হ)।
সারসংক্ষেপ
বিজেতা হিসেবে নেপোলিয়ন প্রথম দিকে বিপুল সাফল্য লাভ করলেও পরবর্তীকালে এ সাফল্যে ভাটা
পড়ে। সংস্কারক হিসাবে নেপোলিয়ন ইউরোপের ইতিহাসে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে
আছেন। তাঁর সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়েই সংস্কার করা হয়। ঐতিহাসিক থমসনের মতে তাঁর সময়ে
ফ্রান্সে আইন শৃংখলা প্রতিষ্ঠা পায় এবং তিনি দেশকে স্থায়ী ভিত্তির উপর দাঁড় করান। শাসক হিসাবে
নেপোলিয়নের শক্তির প্রধান উৎস ছিল তাঁর অনুগত বিশাল সেনাবাহিনী। ফলে তাঁর শাসন ব্যবস্থায়
দমননীতি ও স্বৈরতন্ত্রী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাঁর শাসন ভার গ্রহণের প্রাক্কালে ফরাসি জনগণ আশা
করেছিলেন তিনি সমাজে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শগুলোকে বাস্তবায়ন করবেন। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের
কিছু কিছু দিক আলোর মুখ দেখলেও সবগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। এজন্যই অনেক ঐতিহাসিক
নেপোলিয়নকে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের রক্ষাকর্তা না বলে সংহারক বলে থাকেন।


পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নোত্তর
১। বিজেতা হিসাবে নেপোলিয়নক.  প্রথম দিকে সফল ছিলেন খ. শেষের দিকে সফল ছিলেন
গ. কখনও সফল ছিলেন না ঘ. ক ও খ উভয়ই দিক।
২। কত সালে নেপোলিয়ন নিজেকে ফ্রান্সের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হনক. ১৭৯৬ খ. ১৮০০
গ. ১৮০৪ ঘ. ১৮০৮
৩। নেপোলিয়ন কোন সামাজিক সাম্য নীতি গ্রহণ করেন ?
ক.  তিনি তার রাজতন্ত্রের দুর্বলতা সর্ম্পকে সচেতন ছিল বলে
খ. স্বেচ্ছাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে
গ. জনকল্যাণের জন্য
ঘ. বিপ্লবের আদর্শ যথাযথ প্রয়োগের জন্য।
৪। “নেপোলিয়ন ফ্রান্সে পুলিশী রাষ্ট্র কায়েম করেন” কার মন্তব্য-
ক. ঐতিহাসিক ফিশার খ.  ডেভিড থমসন
গ. ফিলিপ গ. রেড্ডায়ে।
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১। শাসক হিসেবে নেপোলিয়নের মূল্যায়ন করুন।
২। বিজেতা হিসাবে নেপোলিয়নের ভূমিকা ব্যাখা করুন।
৩। সংস্কারক হিসাবে নেপোলিয়নের মূল্যায়ন করুন।
৪। ফরাসি বিপবের আদর্শের রক্ষাকর্তা হিসেবে নেপোলিয়নের ভূমিকা কতটুকু ?
৫। আপনি কি মনে করেন নেপোলিয়ন ফরাসি বিপবের আদর্শের সংস্কারক ছিলেন ?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। সংস্কারক হিসাবে নেপোলিয়নের মূল্যায়ন করুন? তিনি ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের রক্ষাকর্তা না
সংস্কার কর্তা ছিলেন?
২। নেপোলিয়নের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]