বখতিয়ার খলজী
ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলার উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাংশের সেন শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলায়
প্রাথমিক মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু বৌদ্ধ শাসনের অবসান ঘটেও সূচনা হয় বিদেশী মুসলিম
শাসনের। ইসলামের আগমন এদেশের ঐতিহ্যবাহী সমাজ ও সংস্কৃতিতে আনে ব্যাপক পরিবর্তন।
বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজী। বখতিয়ার খলজী
আফগানিস্তানের গরমশির বা আধুনিক দশত-ই-মার্গের অধিবাসী ছিলেন। তিনি তুর্কিদের খলজী
সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তাঁর বাল্যজীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তবে, মনে হয় দারিদ্র্যের
পীড়নে তিনি স্বদেশ ত্যাগ করেন এবং স্বীয় কর্মশক্তির উপর নির্ভর করে ভাগ্যানে¦ষণে সচেষ্ট হন। সুলতান
মুহাম্মদ ঘোরী তখন ভারত উপমহাদেশে অভিযানে লিপ্ত। বখতিয়ার খলজী গজনীতে সুলতান মুহাম্মদ
ঘোরীর অধীনে সৈন্য বিভাগে চাকুরি প্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হন। তখনকার দিনে প্রত্যেক সৈন্যকে নিজ নিজ ঘোড়া
এবং যুদ্ধাস্ত্র (ন্যূনপক্ষে ঢাল-তলোয়ার) সংগ্রহ করতে হতো। কিন্তু সামর্থের অভাবে বখতিয়ার খলজী ঘোড়া
বা অস্ত্র যোগাড় করতে পারেননি। তাছাড়া বেঁটে, লম্বা হাত এবং কুৎসিত চেহারার বখতিয়ার হয়তো
সেনাধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি। গজনীতে ব্যর্থ হয়ে বখতিয়ার খলজী দিল্লিতে আসেন এবং
দিল্লির শাসনকর্তা কুতুবউদ্দিন আইবেকের দরবারে উপস্থিত হন। কিন্তু সেখানেও তিনি সেনাধ্যক্ষের
সহানুভ‚তি পেতে ব্যর্থ হন। অত:পর তিনি বাদাউনে যান এবং বাদাউনের শাসনকর্তা মালিক হিজবরউদ্দিন
তাঁকে নগদ বেতনে চাকুরিতে নিয়োগ করেন। কিন্তু বখতিয়ার এই ধরনের চাকুরিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না।
কিছুদিন চাকুরি করার পর তিনি অযোধ্যায় যান। অযোধ্যার শাসনকর্তা মালিক হুসামউদ্দিন বখতিয়ার
খলজীর প্রতিভা অনুধাবন করেন এবং তাঁকে ভিউলী ও ভাগওয়াত নামে দুইটি পরগণার জায়গীর প্রদান
করেন এবং মুসলমান রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে সীমান্তরক্ষীর কাজে নিযুক্ত করেন।ভিউলী ও ভাগওয়াত
আধুনিক উত্তর প্রদেশের মীর্জাপুর জেলায় অবস্থিত। এখানে এসে বখতিয়ার খলজী তাঁর ভবিষ্যত উন্নতির
সন্ধান পান।
বখতিয়ার খলজী কর্তৃক বাংলা জয় এবং বাংলায় প্রাথমিক মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা বাংলার ইতিহাসের
একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। বখতিয়ার খলজীর জায়গীর সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় তিনি পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিন্দু
রাজ্যের সংস্পর্শে আসেন এবং স্বীয় রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে এসব পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো আক্রমণ ও লুণ্ঠন
করতে থাকেন।এ সময়ে তাঁর বীরত্বের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে, চারিদিক থেকে অনেক
ভাগ্যানে¦ষণকারী মুসলমান বিশেষ করে খলজী সম্প্রদায়ের লোক তাঁর সাথে মিলিত হয় এবং এভাবে
বখতিয়ার খলজীর সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে অগ্রসরমান বখতিয়ার খলজী তরবারি পরিচালনার
মাধ্যমে ওদন্তপুরী বিহার জয় করেন।বিহার বিজয়ের পর বখতিয়ার অনেক ধনরতœসহ কুতুবউদ্দিন
আইবকের সঙ্গে দিল্লিতে সাক্ষাত করতে যান। এখানে আরো সৈন্য সংগ্রহ করেন এবং এরপরই নদীয়া
আক্রমণ করেন। এ সময় বাংলার রাজা লক্ষণসেন নদীয়ায় অবস্থান করছিলেন। বখতিয়ার খলজী এতই
ক্ষিপ্রতার সাথে ঝাড়খন্ড অরণ্য অঞ্চলের ভিতর দিয়ে এসে নদীয়া আক্রমণ করেন যে, তাঁর সঙ্গে মাত্র
আঠারজন অশ্বারোহী ছিল এবং তাঁর মূল বাহিনী পেছনে ছিল। তিনি সোজা রাজা লক্ষণসেনের প্রাসাদদ্বারে
উপস্থিত হন এবং প্রাসাদরক্ষীদের হত্যা করেন। ইতোমধ্যে শহরের অভ্যন্তরে শোরগোল শোনা যায়। রাজা
লক্ষণসেন তখন মধ্যাহ্নভোজে লিপ্ত ছিলেন। খবর শুনে তিনি পশ্চাৎদ্বার দিয়ে পলায়ন করেন এবং পূর্ববঙ্গের
রাজধানী বিক্রমপুরে গিয়ে আশ্রয় নেন। প্রায় বিনা যুদ্ধেই নদীয়া মুসলমানদের হস্তগত হয়। পরে সম্পূর্ণ
বাহিনী বখতিয়ার খলজীর সাথে মিলিত হয়। তিনি তিন দিনব্যাপী নদীয়া লুণ্ঠন করেন এবং রাজা
লক্ষণসেনের বিপুল ধনসম্পদ এবং অনেক হস্তি বখতিয়ার খলজীর হস্তগত হয়। অত:পর বখতিয়ার খলজী
নদীয়া ত্যাগ করেন এবং লখনৌতি বা লক্ষণাবতী (গৌড়) অধিকার করেন এবং সেখানে রাজধানী স্থাপন
করেন। লখনৌতি বা লক্ষণাবতী বা গৌড়েই মুসলমান আমলে বাংলার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে।
অত:পর বখতিয়ার খলজী তাঁর নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যে সুশাসনের ব্যবস্থা করেন এবং মুসলমান সমাজ প্রতিষ্ঠার
উদ্দেশ্যে মসজিদ, মাদ্রাসা এবং খানকাহ্ তৈরি করেন।
বখতিয়ারের সহজ সাফল্যের কারণ
বখতিয়ার খলজীর জায়গীর সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত থাকায় তিনি রাজ্যবিস্তারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন
এবং এই অভিলাষে পার্শ্ববর্তী হিন্দুরাজ্যগুলোতে অভিযান পরিচালনা করেন। পার্শ্ববর্তী হিন্দুরাজ্যগুলোতে
পূর্বেই তুর্কি বিজয়ের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল। তদুপরি তাদের মধ্যে অন্তর্বিরোধি থাকাতে তাদের পক্ষে
সংঘবদ্ধ হওয়া সম্ভব ছিল না। বখতিয়ার খলজীর ন্যায় একজন বীরের জন্য এটি ছিল উপযুক্ত সুযোগ এবং
তিনি কিছু সংখ্যক সৈন্য সহকারে এক একটি করে হিন্দু রাজ্য আক্রমণ এবং লুণ্ঠন করতে থাকেন। এভাবে
অগ্রসর হওয়ার সময় একদিন তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে একটি প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গের সম্মুখীন হন এবং সঙ্গে
সঙ্গে তরবারি পরিচালনা করেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ হতে তিনি কোন বাধাই পেলেন না। বিনা প্রতিরোধে
ওদন্তপুরী বিহার জয় করে নেন। এভাবে প্রতিরোধহীনতা এবং কুতুবউদ্দিন আইবক কর্তৃক পুরস্কার লাভ
উচ্চাভিলাষী বখতিয়ার খলজীর রাজ্য বিস্তারের স্পৃহা ক্রমশ: বাড়িয়ে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায়
পরবর্তীতে তিনি নদীয়া আক্রমণ করেন এবং বিনা যুদ্ধেই নদীয়া জয় করে লখনৌতিতে রাজধানী স্থাপনের
মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া বখতিয়ার খলজীর কৌশলগত নীতি বাংলা জয়কে
অনেক সহজ করে দেয়। পশ্চিম দিক হতে বাংলায় প্রবেশের স্বাভাবিক পথ ছিল রাজমহলের নিকটবর্তী
তেলিয়াগড়ি গিরিপথ। তেলিয়াগড়ির দক্ষিণে বাংলার পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। এই জঙ্গলাকীর্ণ
অঞ্চল ‘ঝাড়খন্ড' নামে অভিহিত। তেলিয়াগড়ির উত্তর-পশ্চিমে ছিল খরস্রোতা নদী। সুতরাং তেলিয়াগড়ি
জয় করতে না পারলে পশ্চিম দিক হতে কোন আক্রমণকারীর পক্ষে বাংলায় প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। খুব
সম্ভব রাজা লক্ষণসেন তেলিয়াগড়ি গিরিপথ রক্ষা করার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু বখতিয়ার খলজী শুধু দুর্ধর্ষ
বীরই ছিলেন না, তিনি একজন কৌশলী সমরবিদও ছিলেন। তিনি তেলিয়াগড়ির ধার দিয়েও গেলেন না,
বরং গোপনে প্রস্তুতি নিয়ে ‘ঝাড়খন্ড' বা দুর্গম জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হলেন। যেহেতু দুর্গম অঞ্চলের
ভিতর দিয়ে বিরাট সৈন্যবাহিনীসহ একসঙ্গে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু তিনি নিজ সৈন্যবাহিনীকে ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করেন এবং তিনি নিজে এরূপ একটি ক্ষুদ্র দলের প্রথমটির নেতৃত্ব দেন। ফলে তিনি যখন
নদীয়া পৌঁছেন, তখন কেউ ভাবতেও পারেননি যে, তুর্কি বীর বখতিয়ার খলজী নদীয়া জয় করতে
এসেছেন। এবং সকলেই মনে করে যে, তাঁরা ঘোড়া ব্যবসায়ী এবং রাজা লক্ষণসেনের দরবারে ঘোড়া বিক্রি
করতে এসেছেন। কিন্তু যখন রাজা লক্ষণসেন বুঝতে পারেন যে, বখতিয়ার খলজী আক্রমণকারী মুসলিম
সৈন্যবাহিনীর নায়ক তখন লক্ষণসেন রাজধানী বিক্রমপুরে পলায়ন করেন। প্রায় বিনা প্রতিরোধে খুব
সহজেই বখতিয়ার খলজী নদীয়া জয় করে বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত