আফ্রিকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে কী কী সমস্যা রয়েছে? অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের কারণসমূহ কী?

উত্তর ভূমিকা : পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তর মহাদেশ হচ্ছে আফ্রিকা। এর আয়তন ১,১২,৬২,০০০ বর্গমাইলের কম নয় এবং সম্মিলিতভাবে আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ, ভারত ও চীন দেশের সমান। পৃথিবীর সমগ্র ভূভাগের এক- পঞ্চমাংশ স্থান দখল করে রয়েছে এ মহাদেশ। সবগুলো মহাদেশের মধ্যে আফ্রিকাই সর্বাপেক্ষা দুরধিগম্য এবং এজন্যই এখানকার অধিকাংশ স্থান এখনো অনুন্নত। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিরাজ করছে মরুভূমি, ঘাসের জঙ্গল ও গভীর বনভূমি; মাত্র এক-দশমাংশ স্থান কর্ষণযোগ্য। নানা প্রকার কাঁচামালের অফুরন্ত ভাণ্ডার সঞ্চিত রয়েছে এ মহাদেশে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিপুল সম্পদ রাশি আহরণের বিশেষ কোন ব্যবস্থা হয় নি। ফলে আজও আফ্রিকান দেশ অনুন্নতই রয়ে গেছে।
আফ্রিকার অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের কারণ : এক সময় বলা হতো পৃথিবীর একমাত্র অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ হচ্ছে আফ্রিকা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এটি অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ রয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক যুগের শোষণ প্রক্রিয়ার ফলে আফ্রিকা অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও একধাপ পিছিয়ে পড়ে। তাই স্বাধীনতার পরও আফ্রিকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। এর পশ্চাতে বহুবিধ কারণ নিহিত আছে। নিম্নে কতিপয় কারণ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ : ১৮৮০ এর দশকে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ আফ্রিকায় স্ক্র্যাম্বলের মাধ্যমে আগমন করে এবং সেখানে তাদের শাসন পদ্ধতি কায়েম করেন। ইউরোপীয় শক্তিবর্গ আফ্রিকায় আগমনের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের শিল্পের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ এবং সেই কাঁচামাল থেকে প্রস্তুতকৃত দ্রব্যের বাজার আফ্রিকাতেই তৈরি করা। এ কার্যসিদ্ধির জন্যই ইউরোপীয়রা কৃষিপ্রধান দেশকে শিল্পপ্রধান বিশেষত কাঁচামালের শিল্প প্রধান দেশে পরিণত করেছেন। কারণ তাদের খাদ্যশস্যের প্রয়োজন ছিল না। প্রয়োজন ছিল কাঁচামালের। এর মাধ্যমে আফ্রিকার কৃষিকে ইউরোপীয় স্বার্থে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছিল। ফলে আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ নির্বিচারে পাচার হতে থাকে। এর জন্য আফ্রিকা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়তে থাকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ আফ্রিকার অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের জন্য অনেকাংশে দায়ী। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক উইলিয়াম রোডনির মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি মন্তব্য করেন যে, “ঔপনিবেশিক শাসন আফ্রিকার অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার জন্য প্রধানত দায়ী। কারণ ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে আফ্রিকার সম্পদ ইউরোপে পাঁচার করা হয়েছিল, যা মহাদেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল।"
[How Europe Underdevelop Africa: William Rodney (P. 227-228)
২. নব্য উপনিবেশবাদ : প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ কর্তৃক স্বাধীনতা প্রাপ্ত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর উপর প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা হলো নব্য উপনিবেশবাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। একে একে তাদের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে। অতঃপর তারা হারানো উপনিবেশগুলোর উপর নানা কলাকৌশল প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার প্রয়াস পায়। নব্য উপনিবেশবাদের ফলে আফ্রিকার দেশগুলো পশ্চিম ইউরোপীয় দেশসমূহের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক প্রাধান্যের স্থলে অর্থনৈতিক প্রাধান্য বজায় থাকে। ফলে আফ্রিকার দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। এ সম্পর্কে ঘানার প্রেসিডেন্ট ড. নক্রুমা বলেছেন যে, “নব্য উপনিবেশবাদ হলো সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পর্যায়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দেয়া হলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয় ৷ এর মাধ্যমে একটি দেশকে সাম্রাজ্যবাদী দেশের উপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়।”
[Neo-Colonialism: The Last Stage of Imperialism by Dr. Nkrumah]. ৩. নেতৃত্বের সংকট ও অদূরদর্শিতা : আফ্রিকার অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে নেতৃত্বের সংকট ও অদূরদর্শিতা। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে কতিপয় বিখ্যাত নেতার নেতৃত্বে আফ্রিকায় বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং আফ্রিকায় স্বাধীনতা আসে। কিন্তু স্বাধীনতার পর তারা দেশকে সেভাবে পরিচালনা করতে পারে নি, বরঞ্চ তাদের পরিচালিত দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যায় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক কারচুপি ধরা পড়ে। ফলে তারা দেশের শাসন ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। অথচ তারাই ছিলেন স্বাধীনতার জনক। যেমন- ঘানার ড. নক্রুমা, নাইজেরিয়ার স্যার আবু বকর তাফেওয়া বলেওরা, তাঞ্জানিয়ার জুলিয়াস নায়ারে প্রমুখ।
৪. দুর্নীতি : বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাধি হচ্ছে দুর্নীতি, যা সমগ্র তৃতীয় বিশ্বকে গ্রাস করেছে বিশেষকরে আফ্রিকার দেশগুলোতে। এ দুর্নীতি এতই বেড়েছে যে সমগ্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলো পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে প্রচুর প্রকল্প সাহায্য নিয়ে আসে। অথচ অর্থনীতির কোন উন্নয়ন না করে উন্নয়ন করে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের। ফলে আফ্রিকার দেশ ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সম্পর্কে একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। যেমন- ১৯৮৫ সালে গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট তাঁর ব্যক্তিগত আরাম আয়াসের জন্য ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেছেন। অথচ গ্যানের জনসাধারণের -ধা নিবারণের জন্য খাদ্য ছিল না। অপরদিকে, নামিবিয়ার প্রেসিডেন্ট ৩০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি ব্যক্তিগত জেট বিমান ক্রয় করেছেন। আফ্রিকার এ দুর্নীতি সম্পর্কে ব্লাইন হারলেন বলেছেন, "It is live termities hibbling at the structure of society." (দুর্নীতি উইপোকার মত সবকিছু নিঃশেষ করে ফেলেছে)। [Africa : Desperateness from a Fragile Continent London, Blain Harlen (P-87)]
৫. সামরিক শাসন : সামরিক শাসন কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে না বরঞ্চ অনুন্নয়ন ঘটায়। কারণ সামরিক বাহিনী নিজের স্বার্থ বেশি দেখে এবং অস্ত্র উৎপাদনের দিকে বেশি জোর দেয়। অন্যদিকে বেসামরিক খাতকে অবহেলিত করে রাখে। ফলে উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। তাইতো বিশ্বের উন্নত দেশে কোন সামরিক শাসন নেই। অথচ আফ্রিকা ঘন ঘন সামরিক শাসনের কবলে পড়ে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
৬. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বজায় থাকলে কোন দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না। আফ্রিকার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। এখানে সুপ্রাচীনকাল থেকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে এবং বর্তমানে তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ঔপনিবেশিক যুগে সবার কাছে অভিন্ন শত্রু ছিল ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গ। কিন্তু স্বাধীনতার পর আফ্রিকানরা নিজেরা নিজেদের শত্রু হয়ে যায় এবং শুরু হয় সংঘাত। ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্র হয়ে উঠে অশান্ত। তাছাড়া স্বাধীনতার পর সুযোগ্য নেতার অভাব দেখা দেয় এবং ঘন ঘন সামরিক অভ্যুত্থান আসে যার ফলে রাজনীতি হয়ে উঠে অরাজনীতি। এই প্রভাব গিয়ে পড়ে অর্থনীতির উপর যার কারণে আফ্রিকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সুপ্রাচীনকাল হতে আফ্রিকা ছিল গোত্র বিভাজিত সমাজব্যবস্থা। ফলে আফ্রিকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন তেমন অগ্রসর হয় নি। এরপর ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের দ্বারা আফ্রিকার সম্পদ পাচার হয়েছে। ফলে আফ্রিকা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মুখ দেখে নি। এদিকে বর্তমানের নব্য উপনিবেশবাদের দ্বারা আফ্রিকার অর্থনীতি শোষিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে গঠিত হয়েছে 'নিউ পার্টনারশীপ ফর আফিকা স ডেভলপমেন্ট' । এখন দেখা যাক অর্থনীতিতে আফ্রিকা কেমন উন্নতি করে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]