অথবা, আফ্রিকায় ইউরোপীয় শক্তিবর্গের স্ক্র্যাম্বলের পটভূমি বিশ্লেষণ কর।
উত্তরা ভূমিকা : ১,১২,৬২,০০০ বর্গমাইলবিশিষ্ট আফ্রিকা সম্মিলিতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ, ভারত ও চীন দেশের সমান। পৃথিবীর সমগ্র ভূভাগের এক-পঞ্চমাংশ স্থান দখল করে আছে এ মহাদেশ। অথচ এ বিশাল মহাদেশ এক সময় ইউরোপীয়দের উপনিবেশবাদের শিকার হয়েছিল যদিও আজ স্বাধীন মহাদেশ। আফ্রিকার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা শুরু হয় ১৮৮০ সালের দিকে এবং ১৮৯৮ সালের মধ্যেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ প্রতিযোগিতা পরিণতিতে গিয়ে পৌঁছে। অবশেষে মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে সমগ্র আফ্রিকা ইউরোপীয়দের দখলে চলে যায়। উনিশ শতকের শেষ পর্যায় এবং তার অব্যবহিত পরের অবস্থা এই দাঁড়ায় যে, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন ও জার্মানি সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশকে এক তরমুজের মত টুকরা টুকরা করে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়।
স্ক্র্যাম্বুলের পটভূমি : কোন একটি বিশেষ কারণে বা হঠাৎ করে 'ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা' সংঘটিত হয় নি। এর পশ্চাতে কতিপয় কারণ নিহিত ছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. কয়েকটি তত্ত্ব : ফ্র্যাম্বল ফর আফ্রিকার পটভূমি সম্পর্কে কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি তাঁদের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন, যা তত্ত্ব নামে পরিচিত। নিম্নে কয়েকটি তত্ত্বের মন্তব্য তুলে ধরা হলো :
“সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়। ইউরোপে শিল্পবিপ্লব হওয়ার ফলে সবচেয়ে বেশি উন্নতি ঘটে শিল্পকারখানাতে। কিন্তু শিল্পের পিছনে যে মূলধন বিনিয়োগ করা হতো তার যোগান দেয়া হতো কৃষিখাত থেকে। তাই শিল্পবিপ্লবে তিনটি সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমন- ক. উদ্বৃত্ত উৎপাদন, খ. উদ্বৃত্ত পুঁজি ও গ. কাঁচামালের উৎস। প্রধানত এ তিনটি সমস্যা আধুনিক পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। আর এ পুঁজিবাদের বিকাশই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়ে উপনিবেশবাদের উদ্ভবে সাহায্য করে।” [কার্ল মার্কস তত্ত্ব, জার্মানি]
ভ্রমণকারিগণ আগমন করে এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখে। আফ্রিকার বিপুল ঐশ্বর্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ দেখে ২. ভ্রমণকারীদের প্রভাব কলম্বাসের জলপথ আবিষ্কারের পর ভারতবর্ষসহ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ইউরোপী তারা আশ্চর্য হয়ে যায় এবং ইউরোপের উন্নয়নের পথ খুঁজে পায়। তারা ইউরোপে ফিরে সরকারকে আফ্রিকার উপনিবে স্থাপনে উৎসাহ প্রদান করেন। এসব ভ্রমণকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ডিব্রাজা, লিভিংস্টোন, বার্থে ও স্টানলেট
৩. খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাব : আফ্রিকাকে বলা হতো পৃথিবীর অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ। কারণ তারা শিক্ষার আে থেকে বঞ্চিত এবং তারা ছিল সভ্য জাতি থেকে অনেক দূরে। আফ্রিকানদের সভ্য জাতিতে পরিণত করা এবং শিক্ষার আলো দর
করার জন্য ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের আফ্রিকায় প্রবেশ করতে দেখা যায়। তাদের যুক্তি ছিল, তারা যেহেতু সভ্য জাতি অসভ্যদের জ্ঞান দান করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে এল. বি. স্টোন নামক এক খ্রিস্টান মিশনারির মন্তবে
৪. নব খাজার অনুসন্ধান : অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর শিল্পকারখানায় প্রচুর দ্রব্যসহ উৎপাদিত হতে থাকে। অন্যদিকে, ইংল্যান্ডের পর ইউরোপীয় অন্যদেশগুলোতেও শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়। এর কার শিল্পকারখানায় উদ্বৃত্ত উৎপাদনসামগ্রী বিক্রয়ের জন্য বাজারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কারণ ইতোমধ্যে ইউরোপার ভারতবর্ষের বাজারেও ইউরোপীয় দ্রব্যসামগ্রীতে সয়লাব হয়ে গেছে। একমাত্র বাকি ছিল আফ্রিকা মহাদেশ। ইউরোপীয় শক্তিবর্গ তাদের নতুন বাজার সৃষ্টির জন্য একযোগে আফ্রিকার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৫. পুঁজির বিনিয়োগ : ইউরোপের শিল্পবিপ্লব পুঁজিবাদী শ্রেণির উত্থান ঘটায় এবং এর ফলে শিল্পকারখানা মালিকদের হাতে প্রচুর অর্থ আসে। বিপুল পরিমাণে অর্থের সমাগম ঘটলেও তা বিনিয়োগ করার মত স্থান ইউরোপে চি না। তাই পুঁজিবাদী শ্রেণি তাদের অর্থ বিনিয়োগ করার জন্য নতুন দেশ খুঁজতে শুরু করে। কারণ পুঁজির ধর্মই হচ্ছে বিস্তার লাভ করা। অতএব পুঁজির বিস্তার ও বিনিয়োগ করার জন্যই আফ্রিকাকে বেছে নেয়া হয়।
৬. কাঁচামালের প্রয়োজনীয়তা : শিল্পকারখানায় উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর জন্য যে জিনিস বেশি প্রয়োজন তা হলে কাঁচামাল। শিল্পকারখানার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ইউরোপে ছিল না। এসব কাঁচামালের মধ্যে রয়েছে সোনা, রুপ হীরা, লোহা, গ্যাস, কয়লা, পিতল, রাবার, ইস্পাত প্রভৃতি। এসব কাঁচামাল আফ্রিকায় প্রচুর পাওয়া যেত। এ হস্তগত করার জন্য ইউরোপীয় শক্তিবর্গ আফ্রিকায় একসাথে প্রবেশের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
৭. জঙ্গি বা উগ্র জাতীয়তা উনিশ শতকের ইউরোপের ইতিহাস ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের ইতিহাস। কার ইউরোপীয় সভ্যতা ছিল স...য়ে উন্নত। তাই ইউরোপীয় শক্তিবর্গ তখন নিজেদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে চিহ্নি করত। ইউরোপের পাঁচটি দেশ সর্বদা নিজেদেরকে প্রত্যেকের চেয়ে সেরা ভাবত। এ পাঁচটি দেশ হচ্ছে ব্রিটেন, জার্মান, ফ্রান্স, রাশিয়া ও ইতালি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডিজরেলী নিজ জাতিকে জাতীয় গৌরবে উৎসাহিত করে তুলে অন্য জাতিকে পদানত করার চেষ্টা চালান। অন্যদিকে, জার্মানির বিসমার্ক পূর্ব ইউরোপে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে না পেরে আফ্রিকার সাম্রাজ্য বিস্তারের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে সবাই আফ্রিকার দিকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টি মনোনিবেশ করে।
৮. ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক নীতি : ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ফ্রান্স। ১৮৭০ সালে ফ্রান্সের সাথে জার্মানির অস্ট্রিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এ যুদ্ধে ফ্রান্স পরাজিত হয়ে অপমানজনক চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এতে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জুলিস ফেরি তাঁর শক্তি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্যে তিনি একটি ঔপনিবেশিক নীতি গ্রহণ করেন। প্রধানত দুটি কারণে ঔপনিবেশিক নীতি গ্রহণ করেন। যেমন- ক. ব্যবসায় বাণিজ্যের উন্নতির দ্বারা রাষ্ট্রের উন্নতি ও খ. জাতীয় গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
৯. ইউরোপের শক্তিসাম্য নীতি : আফ্রিকার ব্যাপারে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের ঔপনিবেশিক রাজ্য স্থাপনের নীতি গ্রহণের ফলে ইউরোপে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ সময় ইউরোপীয়রা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত করে । এ দ্বন্দ্বে শামিল হয় ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল ও বেলজিয়াম। এরা সবাই আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনে আগ্রহী হয়ে পড়ে। ১৮৯০ এর দশক হতে পর্তুগাল আফ্রিকায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালায় । এদিকে ইংল্যান্ড ১৮৮২ সালে আফ্রিকান দেশ মিশরের সাথে গোপন চুক্তির দ্বারা আফ্রিকায় প্রবেশের চেষ্টা চালায়। অন্যদিকে, ফ্রান্স আফ্রিকান দেশ কঙ্গো ও কঙ্গো নদী দখল করে নেয়। এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হিসেবে ১৮৮৪ সালে ইংল্যান্ড ও পর্তুগাল 'ইঙ্গ-পর্তুগীজ যৌথ' চুক্তি স্বাক্ষর করে। এতে বলা হয় যে, কঙ্গো নদী ব্যবহার করার সবার সমান অধিকার থাকবে। এ অবস্থায় ইউরোপে শক্তি সাম্য নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়।
১০. বার্লিন কংগ্রেস : ইউরোপের ইতিহাসে বার্লিন কংগ্রেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা এ কংগ্রেসের মাধ্যযে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ আফ্রিকার স্ক্র্যাম্বল ঘটায়। ইউরোপে যখন শক্তি ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়, তখন জার্মানির বিসমার্ক অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ে। ইউরোপের শক্তি ভারসাম্য রক্ষার জন্য তিনি ১৮৮৪ সালে জার্মানির বার্লিনে ইউরোপের রাষ্ট্রপ্রধানদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। উক্ত সম্মেলনের দুটি প্রধান কারণ নিহিত ছিল। যথা :
শিল্পায়ন
ও উগ্র জাতীয়তাবাদ। এ সম্মেলনে ..., জার্মানি, ফ্রান্স, পর্তুগাল, বেলজিয়ামসহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশ অংশগ্রহণ করে। এ সম্মেলন ১৮৮৪ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে ১৮৮৫ সালের ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত চলে। এ সম্মেলনে দুটি সিদ্ধান্ত
গ্রহণ করা হয় । যথা :
ক. কঙ্গো ও নাইজার নদীকে আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং বলা হয় যে, ইউরোপীয় যে কোন
দেশ এ নদীকে ব্যবহার করে আফ্রিকার সাথে ব্যবসায় বাণিজ্য করতে পারবে।
খ. ইউরোপীয় শক্তিবর্গ আফ্রিকার যে কোন অংশে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করতে পারবে। তবে শর্ত থাকবে যে, i. বার্লিন সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ইউরোপীয় দেশসমূহকে জানাতে হবে।
ii. ঔপনিবেশিক রাজ্যের জনগণ তা মেনে নিয়েছে অর্থাৎ ঐ রাজ্যে স্থিতাবস্থা বজায় আছে ।
:
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইউরোপের ইতিহাসে শিল্পবিপ্লব আফ্রিকার জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। কারণ এ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটেই ইউরোপীয় দেশসমূহ আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের দিকে দৃষ্টি দেয় এবং এ উপনিবেশ স্থাপন নিয়ে ইউরোপীয় দেশসমূহের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যা থেকে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্বের। এ দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত হয় বার্লিন কংগ্রেসের এবং এ কংগ্রেসের মাধ্যমেই আফ্রিকার ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। কারণ এ সম্মেলনের শেষে ইউরোপীয় দেশসমূহ আফ্রিকার ক্র্যাম্বলের মাধ্যমে উপনিবেশ স্থাপন করে ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত