বার্লিন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল কেন? সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো লিখ ৷

অথবা, বার্লিন সম্মেলনের কারণগুলো কী ছিল? এ সম্মেলনের গৃহীত সিদ্ধান্তে কতটুকু ফল
এসেছিল? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দেখাও।
অথবা, বার্লিন সম্মেলনের কারণগুলো বিশেষণ কর। এর ফলাফল কী ছিল লিখ।
উত্তর ভূমিকা : পৃথিবীর যে সাতটি মহাদেশ রয়েছে তার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশ হচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশ। বর্তমানে আফ্রিকা মহাদেশে ৫৩টি স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব দেশ রয়েছে। কিন্তু উনিশ শতকের পূর্বে আফ্রিকায় অসংখ্য ছোট বড় গোত্রভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল এবং এদের কোন জাতীয় রাষ্ট্র ছিল না। তাই এ আফ্রিকা মহাদেশকে বলা হতো অসভ্য ও অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ। উনিশ শতকের শেষ দশকে আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের জন্য পাশ্চাত্যের সভ্যদেশ ও শক্তিশালী দেশগুলো বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশসমূহ ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্র্যাম্বলের সৃষ্টি করে। এ Scramble for Africa নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের উপক্রম হয়। এ দ্বন্দ্ব অবসানের লক্ষ্যে জার্মানির বার্লিনে একটি সম্মেলন আহ্বান করা হয় এবং এতে আফ্রিকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সকল ইউরোপীয় দেশ অংশগ্রহণ করে যা বার্লিন সম্মেলন নামে পরিচিত। এ সম্মেলনে আফ্রিকার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায় এবং আফ্রিকা উপনিবেশবাদের শিকার হয়।
বার্লিন সম্মেলনের কারণ : ইউরোপে বার্লিন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার মূল কারণ ইউরোপের শক্তিসাম্য নীতি বজায় রাখা ও আফ্রিকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। তাছাড়া এ বার্লিন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পশ্চাতে কতিপয় কারণ নিহিত ছিল। নিম্নে এ কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. ইউরোপের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশ : ইউরোপে বার্লিন সম্মেলনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তৎকালীন ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। কারণ উনিশ শতকের ইউরোপ ছিল উগ্রজাতীয়তাবাদের ইতিহাস। এ সময় ইউরোপীয় শক্তিবর্গ সর্বদা নিজেদের সভ্য ও উন্নত জাতি বলে মনে করে এবং তারা অন্যদের পদানত করতে চাইত। এ সময় একটি দেশ কোথাও উপনিবেশ স্থাপন করতে চাইলে অন্যদেশও সেখানে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। ফলে তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের উপক্রম হতো এবং দ্বন্দ্ব খোদ ইউরোপেই বিরাজ করত।
২. ইউরোপীয়দের পারস্পরিক সন্দেহ : ইউরোপে বার্লিন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পিছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ নিহিত ছিল যেটি ইউরোপীয়দের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ প্রবণতা। অবশ্য এ সন্দেহ প্রবণতার জন্য কিছু কারণ বিদ্যমান ছিল। যথা :
ক. পর্তুগাল আফ্রিকার জলপথ আবিষ্কার করে এবং আফ্রিকায় তার উপনিবেশ স্থাপনের অধিকার সবচেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু পর্তুগালের শক্তি ও সামর্থ্য তেমন ছিল না। কারণ সে ছিল ইউরোপের দ্বিতীয় সারির শক্তি। ফলে তার ভয় ছিল সবচেয়ে বেশি।
খ. ব্রিটেনের ভয় ছিল ফ্রান্সের প্রতি।
গ. এসময় ফ্রান্সের জনসাধারণ আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন নিয়ে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। যেমন-
i.
একদল ছিল Doctrine of Effacement এর পক্ষে অর্থাৎ ফ্রান্সের উচিত জার্মানির সাথে পুনরায় যুদ্ধ করে
আলসেস ও লরেন্স উদ্ধার করা।
ii. অন্যদল ছিল Doctrine of Compensation এর পক্ষে অর্থাৎ ফ্রান্সের উচিত আফ্রিকায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা
করে জার্মানির সাথে যুদ্ধের ক্ষতি পুশিয়ে নেয়া।
ঘ. অটোফন বিসমার্কের প্রচেষ্টায় ও নেতৃত্বে খণ্ডিত জার্মানি একত্রীতকরণ করা হয় ১৮৭০ সালে এবং এয়ে বিসমার্ককে সহায়তা করে জার্মানির ব্যবসায়ী শ্রেণি। জার্মানির একত্রীকরণের পর ব্যবসায়ী শ্রেণি আফ্রিকার উপনিবেশ স্থাপনের জন্য বিসমার্ককে চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু বিসমার্ক পূর্ব ইউরোপ দখল করে হ্যাপসবার্গ,
তুর্কি ও রোমান সাম্রাজ্যের প্রাধান্য বিনষ্ট করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
৩. ব্রিটেনের মিশর দখল : ফ্রান্স ও ব্রিটেন যৌথভাবে মিশরে সুয়েজখাল খনন করে ১৮৬০ সালে এবং তা উন্মুক্ত করা হয় ১৮৬৯ সালে। এ খালটি ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত থাকায় এ অঞ্চলের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। কারণ এটিই ছিল ভারতবর্ষসহ চীনে আসার একমাত্র জলপথ। অন্যদিকে, ভারতবর্ষসহ এশিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকায় এখানে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ নিহিত ছিল। এ কারণে ব্রিটেনের কাছে আফ্রিকার মিশর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিস্থিতিতে ব্রিটেন ১৮৮২ সালে মিশর দখল করে। ফলে ফ্রান্স এতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ।
৪. ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়া ও মাকাকো চুক্তি অনুমোদন : ব্রিটেন কর্তৃক মিশর দখলকে ফ্রান্স তীব্র প্রতিবাদ করে এবং এর প্রতিবাদস্বরূপ মাকাকো চুক্তি স্বাক্ষর করে। মাকাকো একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বাক্ষরিত চুক্তি যা স্বাক্ষর করে ফরাসি পর্যটক ডি. ব্রাজা। ডি. ব্রাজা ১৮৮২ সালে আফ্রিকার কঙ্গো এলাকায় গিয়ে সেখানকার বড় গোত্র বাটিকার গোত্র প্রধান মাকাকোর সাথে একটি চুক্তি করেন এবং এ চুক্তির নাম দেয়া হয় মাকাকো-ডি. ব্রাজা চুক্তি। এ চুক্তির সূত্র ধরে তিনি কঙ্গোর বিস্তীর্ণ এলাকার মালিক হয়ে তা অনুমোদনের জন্য ফরাসি সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিল। এ পর্যায়ে এসে তা ফরাসি সরকার অনুমোদন করল ।
৫. ইঙ্গ-পর্তুগিজ সন্ধি : ফরাসি সরকার কর্তৃক মাকাকো চুক্তি অনুমোদনের পর ব্রিটেনসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ চিন্তিত ও বিচলিত হয়ে পড়ে। তবে সবচেয়ে বেশি বিচলিত হয়ে পড়ে ব্রিটেন। কারণ ফ্রান্স কর্তৃক কঙ্গো এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের ফলে কঙ্গো নদী দিয়ে অন্যান্য দেশের জাহাজ চলাচল করতে পারবে না এবং ফ্রান্স তা বাধা দিবে অন্যদিকে, পর্তুগাল দাবি করে আসছিল যে কঙ্গো এলাকা সম্পূর্ণ তার প্রাপ্ত। এ অবস্থায় ব্রিটেন পর্তুগালের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যার নাম দেয়া হয় ইঙ্গ-পর্তুগিজ সন্ধি । এ সন্ধির শর্তানুসারে-
ক. কঙ্গো নদীর অববাহিকায় পর্তুগিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় ।
খ. কঙ্গো নদীতে ব্রিটিশ জাহাজ ও নৌবাহিনী চলাচলের অধিকার পায়।
তবে এ চুক্তির দ্বারা পর্তুগালের তেমন লাভ হয় নি, বরং ক্ষতি হয়েছে। তাইতো পর্তুগাল আন্তর্জাতিক কমিশনের ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করে। ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়।
সম্মেলনের সিদ্ধান্ত : বার্লিন সম্মেলনে ১৪টি দেশের সমর্থনে এবং সিদ্ধান্ত অনুসারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এ চুক্তির শর্তাবলি নিম্নরূপ :
১. কঙ্গো ও নাইজার নদীকে আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বলা হয় যে, এ দুটি নদীতে সকল দেশের নৌ
ও বাণিজ্যিক জাহাজ অবাধে চলাচল করবে।
২. আফ্রিকান দেশে কেউ ঔপনিবেশিক রাজ্য স্থাপন করতে চাইলে তাকে অবশ্যই সে ব্যাপারে বার্লিন সম্মেলনে
অংশগ্রহণকারী দেশসমূহকে অবহিত করতে হবে।
৩. আফ্রিকান দেশে ঔপনিবেশিক রাজ্য স্থাপনকারী শক্তিকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, পূর্ব থেকে এখানে তার উপস্থিতি ছিল এবং বর্তমানে স্থিতাবস্থা বজায় আছে। অর্থাৎ আফ্রিকান জনগণ ঔপনিবেশিক শক্তিকে মেনে নিয়েছে। উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আফ্রিকার দখলকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যে যে উত্তেজনা দেখা দেয় তা প্রশমনের উদ্দেশ্যেই বার্লিন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের দ্বারা ইউরোপীয়দের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাস করা হয় এবং আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের চার্টার ইউরোপীয়দের হাতে দেয়া হয় যার পরিণতিতে মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে সমগ্র আফ্রিকা ইউরোপীয়দের দখলে চলে যায়। তাই বার্লিন সম্মেলন ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]