সুলতান নাসিরউদ্দিন নসরৎ শাহ


সুলতান নাসিরউদ্দিন নসরৎ শাহ
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নসরৎ শাহ নাসিরউদ্দিন আবুল মুজাফ্ফর নসরৎ শাহ উপাধি
ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। হুসেন শাহের রাজত্বকালে নসরৎ শাহ যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত
ছিলেন এবং পিতা কর্তৃক মুদ্রা প্রকাশের ক্ষমতাও পেয়েছিলেন। ৯২২ হি:/১৫১৬ খ্রি: ও ৯২৩ হি:/ ১৫১৭
খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মুদ্রা তাঁর যুবরাজ অবস্থায় প্রকাশিত মুদ্রা বলে মনে করা হয।
নসরৎ শাহ যখন বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন সে সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরির্তন ঘটছিল উত্তর
ভারতের রাজনীতি ক্ষেত্রে। ইব্রাহিম লোদির দুর্বলতার সুযোগে লোহানী ও ফার্মুলী আফগানগণ পাটনা হতে
জৌনপুর অঞ্চলে প্রায় স্বাধীন হয়ে উঠেছিল। বিহারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লোহানী বংশের শাসন। নসরৎ এই
সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আজমগড় পর্যন্ত তাঁর রাজ্যসীমা সম্প্রসারণ করেন। প্রায় সমগ্র উত্তর বিহার
অধিকার করে নসরৎ এই অঞ্চলের শাসনভার আলাউদ্দিন ও মখ্দুম আলমের ওপর অর্পন করেন। এ সময়
গন্ধক ও গঙ্গানদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় এই অঞ্চলের শাসনকেন্দ্র।
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর লোদি সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়ে উত্তর ভারতের অধীশ্বর
হন। বাবরের অভ্যুদয় ও লোদি সাম্রাজ্যের অবসান বাংলার মুসলিম সাম্রাজ্যের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে।
পলায়মান আফগান নেতাগণ নসরৎ শাহের সাহায্যপ্রার্থী হলেমানবিক কারণে নসরৎ শাহ তাঁদের সাহায্য
করেন।
১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে বাবর গোগরা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হন। তিনি মোল্লা মুহাম্মদ মাজহার নামক একজন দূত
নসরৎ শাহের কাছে পাঠিয়ে নসরৎ-এর মনোভাব জানতে চাইলে নসরৎ-এর জন্য সমস্যা দেখা দেয়। তিনি


কোন স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে বাবরের দূতকে প্রায় এক বৎসরকাল নিজ দরবারে রেখে দিলেন। শেষ পর্যন্ত
নসরৎ নিরপেক্ষতার পথ অবলম্বন করেন এবং নসরৎ-এর পাল্টা দূত ১৫২৯ খিস্টাব্দে বাবরের দরবারে
নসরৎ কর্তৃক প্রেরিত বহু উপঢৌকন নিয়ে হাজির হন। এ ক্ষেত্রে বাবর নসরৎ-এর নিরপেক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে
বাংলা আক্রমণের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। সম্ভবত আফগান নেতৃবর্গ ও নসরৎ-এর মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপনের
সম্ভাবনা না থাকায় বাবর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।
পরবর্তীকালে বিহারে বাবরের বিরুদ্ধে আফগান নেতাদের মধ্যে যে ঐক্য স্থাপিত হয় তাতে নসরৎ শাহ
প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বলে মনে হয় না। মাহমুদ লোদির নেতৃত্বে মুঘল বিরোধী যে আঁতাত গড়ে
উঠেছিল তাতে নসরৎ-এর যোগদানের কোন উল্লেখ বাবরের আতœকাহিনীতে পাওয়া যায়নি। মাহমুদের
নেতৃত্বে আফগান নেতা বায়েজীদ, বীবন, ফতেহ খান ও শের খান সুরের যে জোট স্থাপিত হয় তাতে
জালাল খান লোহানী ও জালাল খান শর্কী স্বভাবতই যোগদান করেননি। কারণ তাঁদের নিজ নিজ অধিকার
অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্য ছিল। একই উদ্দেশ্যে জালাল লোহানী ও জালাল শর্কী বাবরের কাছে আতœসমর্পণ
করেছিলেন। সুতরাং এ ধরনের মুঘল বিরোধী আঁতাতে নসরৎ-এর যোগদানে তাঁর নিজস্ব কোন স্বার্থ তো
ছিলই না বরং স্বরাজ্যের প্রতি মুঘল আক্রোশ উত্থাপনের আশঙ্কার প্রকাশ ঘটে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত নসরৎ-এর পক্ষে মুঘলদের সাথে সংঘর্ষ পরিহার করা সম্ভব হয়নি। ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে
আফগান নেতাগণ বাবরের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন। গঙ্গা নদীর উভয় তীর অনুসরণ করে মাহমুদ
লোদি এবং শের খান চুনার হতে বারাণসী অভিমুখে সৈন্য পরিচালনা করেন। বীবন ও বায়েজীদ গোগরা
অতিক্রম করে গোরক্ষপুর অভিমুখে অগ্রসর হলেন। বাবরও সসৈন্যে এগিয়ে যান বিহার অভিমুখে। মাহমুদ
লোদি বাবরের আগমনে যুদ্ধ না করে মহোবার দিকে পলায়ন করেন। শের খান বারাণসী অধিকার করেই
বাবরের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। এছাড়া জালাল খানও বক্সারের নিকট বাবরের বশ্যতা স্বীকার করে
নেন। এসময় বাবর তীরহুত অধিকার করে গঙ্গা ও গন্ধকের সঙ্গমস্থলে বীবন ও বায়েজীদের অধীন আফগান
সৈন্যদলকে পরাজিত করেন। ফলে বাবরের সৈন্যদল বাংলার সৈন্যদলের সম্মুখীন হন। বক্সারের শিবির
হতে বাবর দূত পাঠিয়ে নসরৎ-এর সৈন্যদলকে গোগরা নদীর তীর ত্যাগ করতে আদেশ দেন। নসরৎ উত্তর
দিতে বিলম্ব করলে একমাস কাল অপেক্ষা করে বাবর পুনরায় নসরৎ-এর কাছে দূত পাঠালেন। এ সময় যুদ্ধ
অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং তিন দিন ধরে যুদ্ধ চলে। বাংলার পদাতিক, অশ্বারোহী ও নৌবাহিনী যথেষ্ট বীরত্ব
প্রদর্শন করেও মুঘল রণকৌশলের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হন। ফলে গোগরা নদীর পূর্বতীরে
স্থাপিত হয় বাবরের আধিপত্য এবং আফগান জোটের পরাজয়ের পথ হয় সুগম। ক‚টনৈতিক কারণে বাবর
বিহার ও অযোধ্যা জয়ের পূর্বে বাংলা আক্রমণ করা সমীচীন মনে করেননি। এ সময় বাবর কর্তৃক
আরোপিত শর্তাবলী বাংলার সুলতান স্বীকার করে নেন। ফলে মুঘলদের প্রত্যক্ষ আক্রমণের হাত থেকে
বাংলার মুসলিম রাজ্য রক্ষা পায়।
১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে বাবরের মৃত্যু হলে নসরৎ শাহ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলার সুযোগ পেলেন। বাবরের
উত্তরাধিকারী হুমায়ূন এ সময় বাংলা আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন। বাবরের মৃত্যুর পর মাহমুদ লোদি
পুনরায় মুঘলদের বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করেন। বীবন খান, বায়েজীদ খান ও শের খান জৌনপুর হতে
বিতাড়িত করেন মুঘল সৈন্য। মাহমুদ লোদির বিরুদ্ধে দাওরার যুদ্ধে বীবন খান ও বায়েজীদ খান নিহত হন।
শের খান আবার মুঘল বশ্যতা স্বীকার করলেন। মাহমুদ লোদি পরাজিত হয়ে রাজ্য ত্যাগ করেন। হুমায়ূন
বাংলা আক্রমণের উদ্যোগ নেন। নসরৎ শাহ এ সময় হুমায়ূনের রাজ্যের অপর সীমান্তের শত্রু গুজরাটের
সুলতান বাহাদুর শাহের সাথে মিত্রতা স্থাপনের উদ্দেশ্যে দূত হিসেবে পাঠান মালিক মরজানকে। এসময়
বাহাদুর শাহ হুমায়ূনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন গ্রহণ করছিলেন। সংবাদ পেয়ে হুমায়ূন বাংলার বিরুদ্ধে
আর অগ্রসর না হয়ে গুজরাট অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। নসরৎ শাহের আকস্মিক মৃত্যুতে বাংলা-গুজরাটের
মৈত্রী পরিপূর্ণভাবে কার্যকর না হলেও নসরৎ-এর সময়োপযোগী ক‚টনীতি বাংলাকে আসন্ন যুদ্ধ হতে রক্ষা
করে। মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে বাংলার মুসলিম রাজ্যকে যুদ্ধে লিপ্ত না করে নসরৎ
শাহ দুরদর্শিতারই পরিচয় দিয়েছিলেন।


নসরৎ শাহ তাঁর রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলেন যে, অন্য সীমান্তে দৃষ্টি দেয়ার মতো অবকাশ
তাঁর ছিল না। কামতার মুসলমান শাসনকর্তা নিজ উদ্যোগেই অহোম রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। সেনাপতি
তুরবক অহোম সৈন্যদলকে পশ্চাদপদ হতে বাধ্য করেছিল। এই অভিযানের পরিসমাপ্তি দেখার পূর্বেই
১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে নসরৎ শাহের মৃত্যু হয়।
উড়িষ্যা সীমান্তেও কিছু সংঘর্ষ দেখা দিয়েছিল। তাই উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্রদেব নিজ রাজ্যসীমা
সম্প্রসারণে সচেষ্ট হন। তবে তাঁর সাফল্য সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা সম্ভব নয়। নসরৎ শাহের রাজত্বকালে
পর্তুগিজরা বাংলায় ঘাঁটি স্থাপনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। সিলভেয়ার অগমনের পর হতে পর্তুগীজরা প্রায় প্রতি
বৎসরই বাংলায় জাহাজ পাঠাতো।
পিতার ন্যায় নসরৎ শাহও বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি
রচনায় তাঁর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। কবি শেখর ছিলেন নসরৎ শাহের কর্মচারী। স্থাপত্য শিল্পেও তাঁর
অবদান রয়েছে। গৌড়ের বিখ্যাত বারদুয়ারী বা সোনা মসজিদ তাঁর অমর স্থাপত্যকীর্তি। গৌড়ের কদমরসুল
ভবনে তিনি একটি মঞ্চ নির্মাণ করান। যদিও নসরৎ শাহের মৃত্যু সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা যায় না। তথাপি
বিভিন্ন বিবরণে জানা যায় যে, তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন।
সুলতান আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ
নসরৎ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ফিরোজ শাহ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। মুদ্রা প্রমাণে মনে করা যায় যে,
নসরৎ শাহ তাঁর ভাই মাহমুদ শাহকে উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেছিলেন। রিয়াজ-উস-সালাতীন হতে জানা
যায়,রাজ্যের একদল আমীরের সহায়তায় ফিরোজ শাহ সিংহাসনে বসেন। মাত্র নয় মাস কাল শাসনের পর
মাহমুদ শাহ তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। ফিরোজ শাহের স্বল্পকালীন রাজত্বের বিশেষ কোন
ঘটনা জানা যায় না। নসরৎ শাহের মৃত্যুর পূর্বে অহোম রাজ্যের সাথে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল তা তাঁর
রাজত্বকালেও অব্যাহত ছিল। ফিরোজ শাহ যুবরাজ থাকাকালীন তাঁর আদেশে শ্রীধর কবিরাজ ‘বিদ্যাসুন্দর'
কাব্য রচনা করেন। এ থেকে ধারণা করা হয় পিতা ও পিতামহের ন্যায় ফিরোজও বাংলা সাহিত্যে উৎসাহী
ছিলেন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]