জাতীয়তাবাদের ভিত্তি এবং এর সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ লিখ । অথবা, জাতীয়তাবাদের কাঠামো সহ এর সুফল ও কুফলসমূহ লিখ ।

উত্তর ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ বর্তমান যুগের রাজনৈতিক জগতে একটি প্রবল শক্তি। জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে এর আদর্শ বিশ্ব ইতিহাসকেও নাড়া দিয়েছে। উনিশ ও বিশ শতকের মানচিত্রে এটি চরম পরিবর্তন ঘটিয়েছে। জাতিই হচ্ছে প্রধান চরিত্র, যার জন্য মানুষ সংগ্রাম করে, যুদ্ধ করে এবং মৃত্যুবরণ করে। জাতীয়তাবাদের প্রশ্নেই বিশ্বে দুটি মহাযুদ্ধে হাজার হাজার গ্রাম নগর এবং লক্ষ লক্ষ নরনারী ধ্বংসের করাল গ্রাসের স্বীকার হয়েছিল। সুদূর অতীতকাল থেকে এ জাতীয়তাবাদই আবার মুক্তির মন্ত্র হিসেবে কাজ করে আসছিল। আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাই জাতীয়তাবাদ বিশ্বের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ ।
জাতীয়তাবাদের ভিত্তি : জাতীয় সচেতনতাকে অনাবৃত করতে বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব সম্মিলিতভাবে কাজ করেছে। ওয়াটসন লিখেছেন, “প্রাচীন জাতিগুলোর মধ্যে জাতীয় সচেতনতার জন্ম দিয়েছে রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য।” এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স। উভয় রাষ্ট্রের সম্রাটদেরকে কট্টর আঞ্চলিক শক্তি এবং স্বাধীন মনস্ক সামাজিক অভিজাতদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিছুসংখ্যক লেখকের মতে, জাতীয় সচেতনতার জন্য একটি সাধারণ অধিবাস অঞ্চল সবচেয়ে জরুরি। সাধারণ অধিবাসের ধারণা জাতিকে শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল করতে সহায়ক হতে পারে কিন্তু জাতিগঠনে অনিবার্য উপাদান কখনই হতে পারে না। ধর্ম আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ইসরায়েল রাষ্ট্রের তৈরি সম্ভব হয়েছে জাতি হিসেবে ইহুদিদের চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়েই। তবে এক্ষেত্রে একই ধর্ম বা সাধারণ ধর্মাবলম্বী সবাইকে হতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। সাধারণ ভাষা একটি জনগোষ্ঠীকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে সক্ষম হয় এবং বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে যার ফলে দূরত্ব কমে আসে। এতে করে জাতীয় সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। বেশিরভাগ রাষ্ট্রই অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করে থাকে। আরব জাতীয়তাবাদ হলো কেবল ভাষা ও ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের একমাত্র উদাহরণ। জাতীয় সাহিত্য জাতীয় ঐতিহ্য ও জাতীয় ইতিহাস সংকলনের পথে একটি বৃহৎ পদক্ষেপ। একে বলা যায় জাতীয় ঐতিহ্যের পরিবাহক, যানবাহন। রামসে মুর এর মতে, “বীরত্ব গাথা সম্বলিত ইতিহাস ও ঐতিহ্য জাতির জাতীয় সত্তাকে শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে।”
২১২

অভিন্ন রাজনৈতিক অভিব্যক্তি বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছা একটি জাতিগঠনের সর্বা বিভিন্ন রকম উপাদান থাকতে পারে যেমন- অর্থনৈতিক স্বার্থভিত্তিক সমাজ। কিন্তু এ জন্য অনিবার্য নিয়ামক নয়। স্পেনগেলের মতে, “একটি জাতি না ভাষাভিত্তিক, জৈবভিত্তিক, জাতির মূলে আছে স্পিরিচুয়াল উপাদান।” স্বার্থ ও আদর্শের সমাজ ও নিহিত । সত্যিকার জাতীয়তাবাদ সবসময়ই মানবতাবাদী ও সাংস্কৃতিক।
জাতীয়তাবাদের সুবিধা : নিম্নে জাতীয়তাবাদের সুবিধাসমূহ দেয়া হলো ১. ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলো বৃহত্তর একটি পরিচয়ের আবর্তে নিয়ে এসে তাদের মধ ২. জাতীয়তাবাদ হলো জনগণকে সংঘবদ্ধ বা ঐক্যবদ্ধ করার উপায়। অম
অভিন্ন গ্রুপকে একটি বৃহত্তর গ্রুপ বা শ্রেণিতে ঐক্যবদ্ধ করে।”
৩. একটি অঞ্চল বা দেশের প্রাকৃতিক ও অন্যান্য সম্পদের উৎকৃষ্টতম ব্যবহা ৪. একটি সাধারণ শাসকের দ্বারা শাসিত হতে হয় বলে বিভিন্ন শক্তির অপ ব্যবহৃত হয়, যা জাতি গঠিত না হলে ধ্বংসাত্মক খাতে ব্যবহার হতে পার ৫. দেশের জন্য জাতির প্রত্যেক সদস্য জীবন উৎসর্গ করতে মনস্থ। ৬. আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার চর্চা করা যায়।
৭. সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে জাতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রা জাতীয়তাবাদের অসুবিধা : সুবিধা বা গুণ থাকার পাশাপাশি জাতীর বিদ্যমান। এগুলো নিম্নরূপ :

51

১. ব্যবহারিক বা বাস্তবক্ষেত্রে এর প্রয়োগ উৎকৃষ্ট কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে
এক জাতীয়তাবাদের অন্তর্গত মানুষ, অন্য জাতীয়তাবাদকে ঘৃণা করতে মানবসভ্যতার ইতিহাসে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে এবং প্রতিষ্ঠা

প্রায়ই জাতীয়তাবাদ সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মত হুমকির ভিত্তিে দখলদার চরিত্র গ্রহণ করতে পারে।
৫. রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভাণ্ডারীর মতে, “সংকীর্ণ ধারণার জন্য জাতীয়তাবাদ মানুে
সংঘাতময় সম্পর্কের সূচনা করতে পারে।”
৬. বিকৃত জাতীয়তাবাদ একটি ক্ষতিকারক বিষয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ধারণা হিসেবে কার্যকরী হয়েছে, যেখানে এর সম্পর্কে অন্তত একটি বৃহত্তর জন জাতীয়তাবাদ আগ্রাসী এবং নির্মম হতে পারে কিন্তু আমরা তা থেকে বেরিয়ে আ প্রক্রিয়া এবং মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ এক সহজাত প্রবণতা।
প্রশ্নাত৷ আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের কারণসমূ অথবা, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের মাধ্যমসমূহ লিখ । অথবা, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের উৎসসমূহ বিশ্লেষণ অথবা, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের উপাদানসমূহ বিশ্লে
উত্তর ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা। একপ্রকার জাতীয়তাবাদ সৃষ্ট। এটি মূলত একত্রিত হওয়ার এবং একত্রে বসবাস করার আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই মূর্ত হয়ে উঠে। কিন্তু আফ্রিকার ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম ঘটেছে সমাজকাঠামো এবং ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আফ্রিকায় শা

২১৩
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের কারণ : পৃথিবীর যেখানেই জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে, সেখানেই কোন না কোন কারণ নিহিত ছিল। অর্থাৎ কারণ ছাড়া জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠা সম্ভব নয়। ঠিক আফ্রিকার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। অর্থাৎ আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠার পশ্চাতে কতিপয় কারণ নিহিত ছিল। নিম্নে এ কারণগুলো
সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. পাশ্চাত্য ভাষার প্রভাব : ভাষা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। এটি আফ্রিকানদের জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এ ভাষা হচ্ছে পাশ্চাত্য ভাষা যাকে একটি অভিন্ন ভাষা হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল। কারণ ঔপনিবেশিক শাসকবর্গ তাদের নিজ স্বার্থেই পাশ্চাত্য ভাষা প্রচলন করে এবং এ ভাষা আফ্রিকানরা শিখে নিজেদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান শুরু করে। ফলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে ।
২. খেলাধুলা : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে খেলাধুলা একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ঔপনিবেশিক শাসকবর্গ বিভিন্ন সময়ে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এবং এ খেলাধুলার মধ্যে ফুটবল, ক্রিকেট ছিল উল্লেখযোগ্য। এসব খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে, বিভিন্ন আফ্রিকানরা একস্থানে মিলিত হয়ে তাদের ভাবের আদানপ্রদান করে। ফলে তা পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়তা করে ।
৩. ঔপনেশিক প্রশাসনের প্রভাব : ইউরোপীয় শক্তিবর্গ আফ্রিকান উপনিবেশ স্থাপনের পর সেখানে তাদের নিজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু এ প্রশাসনিক যন্ত্র চালাতে হলে প্রচুর জনশক্তির দরকার, যা ইউরোপ থেকে আমদানি সম্ভব নয়। ফলে ইউরোপীয়রা বাধ্য হয়ে স্থানীয় আফ্রিকানদের প্রশাসনে যুক্ত করে। এর ফলে আফ্রিকানরা প্রশাসনিক কর্মকর্তা সম্পর্কে অবহিত হয় এবং ইউরোপীয় শাসন ও শোষণ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। এতে তাদের মনে নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার মানসে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে।
৪. ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র : আফ্রিকানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে অঞ্চল ভিত্তিক ও সময় ভিত্তিক। অর্থাৎ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে। কারণ ইউরোপীয় বিভিন্ন শক্তি আফ্রিকার ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল দখল করে সেখানে তাদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। ফলে এ শাসন চরিত্রের উপর আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। যেমন- ব্রিটিশ শাসিত আফ্রিকায় দ্রুত জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকশিত হয়। কিন্তু ফ্রান্স কিংবা বেলজিয়ামের আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয় দেরিতে
৫. আফ্রো-আমেরিকানদের অবদান : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেছেন আফ্রো-আমেরিকান নেতৃবৃন্দ। এ আফ্রো-আমেরিকান হচ্ছে আমেরিকায় বসবাসরত দাস শ্রেণির বংশধর। অর্থাৎ যেসব আফ্রিকানদের দাস হিসেবে আমেরিকায় বিক্রি করা হয়েছিল তারা কিংবা তাদের বংশধর পরবর্তীতে দাসত্ব প্রথা হতে মুক্তি পেয়েছিল ১৮৬৫ সালের পর থেকে। এরা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে আফ্রিকায় ফিরে এসে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জজ প্যাডমোর, ডুবয়, মার্কাস গার্ডে, সিলভেস্টার প্রমুখ। এডওয়ার্ড ব্লাইডেনের মতে, “প্রত্যেক জাতিকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে হলে তাকে জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে।”
৬. পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত নেতৃবৃন্দের অভিজ্ঞতা : আফ্রিকায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করা হলে বহু আফ্রিকান পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় যান। কিন্তু তারা এখানে এসে বর্ণবাদের শিকার হন। ফলে তাদের মনে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের শাসন ও শোষণ সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় এবং এ অভিজ্ঞতা থেকেই তাদের মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।
৭. দুই মহাযুদ্ধের প্রভাব : ইউরোপে অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি মহাযুদ্ধ বা বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ দুটি মহাযুদ্ধেই আফ্রো-এশিয়ানদের সৈনিক হিসেবে পাঠানো হয়। এসব সৈন্যরা যুদ্ধে থাকাকালে ইউরোপীয়দের কাছ থেকে যে আচরণ পেয়েছে, যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তার ঠিক উল্টো আচরণ পেয়েছে। ফলে এসব যুদ্ধ ফেরত সৈন্যদের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দেয় এবং তারা ইউরোপীয় শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
৮. প্যান আফ্রিকানিজম : প্যান আফ্রিকানিজম হচ্ছে সারা বিশ্বে কালোদের নিয়ে গঠিত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষকরে ইউরোপ ও আমেরিকায় যেসব কালো আফ্রিকানরা বসবাস করতো তাদের নিয়ে একটি সংগঠন করে এবং এর মাধ্যমে শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ আন্দোলন জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ আন্দোলনের বক্তব্য ছিল, “আমরা কালো আফ্রিকানদের জন্য স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা দাবি করছি। আমরা যুদ্ধ করব গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য।'
২১৪

৯. খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা : আফ্রিকায় প্রথম আসে ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিরা এবং ধর্ম প্রচারই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল । তবে ধর্ম প্রচারের স্বার্থেই তারা আফ্রিকায় প্রথম মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এবং এ স্কুলে আফ্রিকানরা শিক্ষা লাভ করে আধুনিক বিশ্বের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। এ মিশনারি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আফ্রিকানরা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম কথা বলে যা জাতীয়তাবাদের প্রথম পদক্ষেপ।
১০. গোত্ৰতন্ত্র : গোত্রতন্ত্রকে বলা হয় আফ্রিকার জাতীয় সংহতি অর্জনের পথে প্রধান বাধা। তাই স্বাভাবিকভাবে এটা জাতীয়তাবাদের পথেও বাধা হওয়ার কথা। কিন্তু কতিপয় ঐতিহাসিক বলেছেন, গোত্রতন্ত্র আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়তা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, Richard L. Sklar এর মন্তব্য ধরা যায়। তিনি বলেছেন যে, একটা পর্যায় পর্যন্ত গোত্ৰতন্ত্র জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। যেমন- নাইজেরিয়ার ইউরোবা গোত্র। তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, “এটা বড় গোত্রের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য, ছোট গোত্রের ক্ষেত্রে নয়।”
মূল্যায়ন : জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা যা জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি। কিন্তু এ ভিত্তি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দ্রুত গড়ে উঠলেও আফ্রিকার ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটে। কারণ আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে দেরিতে। তবে তা আবার দ্রুত বিকশিত হয়। অবশ্য এর পিছনে আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কতিপয় কারণ নিহিত ছিল। আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এবং তা ধীরগতিতে এগিয়ে চলে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ জাতীয়তাবাদ দ্রুত বিকশিত হয় এবং মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে তা স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসে। অর্থাৎ ১৯৬০ সালে একসাথে ১৩টি আফ্রিকান দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র ধারায় গড়ে উঠেছে এবং এ জাতীয়তাবাদ হঠাৎ করে একদিনে একটি মাত্র কারণে উদ্ভব ও বিকাশ হয় নি। আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উপর্যুক্ত উপাদানের সমন্বয়ে উদ্ভব ও বিকশিত হয়েছে এবং কোনটির ভূমিকা কারও চেয়ে কম নয়। অর্থাৎ প্রায় সব উপাদানই আফ্রিকান জাতীয়তাবাদে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে এবং তাইতো আফ্রিকা মহাদেশ আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম।
প্রশ্ন॥৫॥ জাতীয়তাবাদ কাকে বলে? জাতীয়তাবাদের উপাদানসমূহ আলোচনা কর ।
অথবা,
জাতীয়তাবাদ কী? জাতীয়তাবাদ বিকাশের উৎসসমূহ বিশ্লেষণ কর ।
এটাকে এখন আধুনিক বিশ্বের রাজনীতির একটি প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি বললেও খুব বেশি ভুল হবে না। নতুন এর উত্তর ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ আধুনিককালে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আদর্শ বলে পরিগণিত হয়েছে।
আদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এ বিপ্লবের ফলেই জাতীয়তাবাদের ধারণা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় এবং একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রখ্যাত লেখক হ্যান্স কোন তাই যথার্থই বলেছেন যে, “ফরাসি বিপ্লবের অনুপ্রেরণার ফলেই ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে জাতি তথা জাতীয়তাবাদের ধারণা
বিকশিত হয়।”
জাতীয়তাবাদ : জাতীয়তাবাদ মূলত ইউরোপীয় ধারা। মতাদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদের জন্ম কবে এ অনুসন্ধানী গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রশ্ন মাথায় রেখেও নির্দ্বিধায় বলা যায়, আধুনিক বিশ্বের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকেই জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব। জাতীয় স্বার্থের পক্ষে পরাধীন দেশগুলোতে মানুষের লড়াই ও জীবন বিসর্জন এবং বিশ শতকে বড় বড় দুটি বিশ্বযুদ্ধও হয়েছিল জাতীয় রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। ব্যাপক মাত্রায় জাতীয়তাবাদী চেতনা পৃথিবীব্যাপী বিস্তারের ফলে ৬০ ও ৭০ এর দশক পর্যন্ত পৃথিবীর মানচিত্রে পরাধীন প্রায় শতাধিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ফলে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের মন্ত্র জাতীয়তাবাদকে কেউ কেউ রাষ্ট্রধর্ম বলেও বর্ণনা করেছেন। সুতরাং রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ
এক ব্যাপক স্থান দখল করে রেখেছে।
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত সংজ্ঞা বা উক্তি : প্রত্যেক জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার থাকা উচিত এ স্লোগানকে ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। জাতীয়তাবাদ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে একটি সংঘবন্ধ জনগোষ্ঠীর সার্বভৌম ক্ষমতার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো রাজনৈতিক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। কেউ কেউ মনে করেন যে, জাতীয়তাবাদের সর্বসম্মত সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব নয়। তবুও জাতীয়তাবাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকেই ঐক্যবোধ বা হ্যান্স কোন এর ভাষায় 'A state of mind' এর উপর জোর দেন।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন ঐতিহাসিক জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী C. J. H. Hayes জাতীয়তাবাদকে ‘জাতীয়তা' ও 'দেশপ্রেম' দুটি পুরানো ভাবের আধুনিক অনুভূতিপ্রবণ সংমিশ্রণ ও অতিরঞ্জন বলে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ "A modern emotional fusion and exaggeration of two very old phenomena of nationality and patriotism."
হ্যান্স কোন বলেছেন, "Nationalism first and foremost a state of mind act of consciousness." অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ মূলত এক মানসিক অবস্থার চেতনা ক্রিয়া ।
অধ্যাপক লাস্কির কথায়, “জাতীয়তাবাদ সাধারণভাবে এক ধরনের মানসিকতা। এটি দু'ধারায় পরিপুষ্ট। একটি পুরানো স্মৃতি সম্পদ এবং অন্যটি পরস্পরের একত্রে বসবাস করার সঙ্গতি।”
ইতিহাস ৩য় বর্ষ (১৫৭৭)-২৮
জা
সা
কর
এক নৃত হয়ে জাত
জো
মহা
প্রতি
জা
উদ্বুদ্ধ
জন
যখন
গঠ
মূল
থাক
সব
কৃত্রি
মানু
নিয়ে

২১৭
অধ্যাপক স্নাইডারের মতে, “জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের এক বিশেষ পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার ফলাফল। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসাধারণের মানসিকতা, অনুভূতি ও
চিন্তাচেতনার ফল ।”
উপরের বর্ণিত জাতীয়তাবাদের ধারণা বা সংজ্ঞাসমূহ থেকে বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদ এক ধরনের চেতনা। যে
চেতনার ফলে কোন মানুষ বা জনগোষ্ঠী নিজেকে কোন জাতির অন্তর্ভুক্ত জ্ঞান করে। সেই জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিকাশ, অগ্রগতি, ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদির সাথে একাত্মবোধ করে এবং সংশ্লিষ্ট জাতির ঐহিত্য, মূল্যবোধ, স্বকীয়তা রক্ষা ও বিকাশে বিশ্বাসী হওয়ার মধ্য দিয়ে নিজে একত্রিত হয়ে এ মহামিলনের আনন্দে শামিল হয়। এ লড়াইয়ের দুটি দিক রয়েছে। ১. সামাজিক এবং ২. রাজনৈতিক। সামাজিক দিক থেকে উদ্বৃত্ত জনগোষ্ঠী পৃথক মনে করে এবং একসাথে এ জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক দিক থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠে। দেশপ্রেম এবং দেশাত্মবোধ যে জাতীয়তার প্রধান স্তম্ভ তা জাতীয় রাষ্ট্রীয় গঠনের মাধ্যমে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছায় ।
ইতিহাস ৩য় বর্ষ (১৫৭৭)-২৮
জাতীয়তাবাদের উপাদান : জাতীয়তাবাদ কি তা বুঝার জন্য জাতীয়তাবাদের উপাদান সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। কোন সমাজে জাতীয়তার চেতনা দানা বাঁধার পিছনে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ভূমিকা পালন করে। যা মূলত জাতীয়তাবাদের উপাদান। তবে নিম্নলিখিত উপাদানগুলো একটি জনসমষ্টিকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষভাবে
সাহায্য করে :
১. ভৌগোলিক অখণ্ডতা বা ঐক্য : জাতীয়তাবাদের প্রথম ও প্রধান উপাদান হলো ভৌগোলিক একতা। জাতি গঠন করতে হলে কোন জনসমষ্টিকে একটি নির্দিষ্ট ও সংলগ্ন ভূখণ্ডে বসবাস করতে হবে।
২. বংশগত ঐক্য : বংশগত ঐক্য জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। এটা মানুষের মধ্যে এমন একপ্রকার সুদৃঢ়, ঐক্যভাব গড়ে তোলে যা জাতি গঠনে অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। কিন্তু আধুনিক নৃতত্ত্ববিদগণ এটাকে অপরিহার্য উপাদান বলে মনে করেন না। কারণ হল্যান্ড, ইংরেজ, জার্মান জাতি একই বংশ হতে উদ্ভূত হয়েও একই জাতীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয় নি। আবার U.S.A বহু বংশের লোকের বসবাস সত্ত্বেও তারা একই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ।
৩. ধর্মীয় ঐক্য : এটা জাতীয়তাবাদের অপর একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। জাতীয়তাবাদের ধারণার সৃষ্টি এবং তা জোরদার করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় একতা একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে কাজ করে। এটা জাতীয়তাবোধের সৃষ্টির এক মহান সূত্র এবং এর উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বহু জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে।
৪. ভাষা ও সাহিত্যগত ঐক্য : ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে ভাবের আদানপ্রদান হয়। এ আদানপ্রদানই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রভূত উপায়। এছাড়া জাতি গঠনের জন্য এটা একান্তভাবে আবশ্যক নয়। বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠতে দেখা যায়। সুইজারল্যান্ডের জনগণ বিভিন্ন ভাষায় কথা বললেও তারা একই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ । আবার ইংরেজ ও আমেরিকা একই ভাষা ব্যবহার করলেও তারা দুটি ভিন্ন জাতি।
৫. অর্থনৈতিক একতা : জনগণকে জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত করে অর্থনৈতিক একতা। অর্থনৈতিক দিক হতে যখন জনগণের মধ্যে ক্ষমতা বিরাজ করে, তখন তারা একত্রে বসবাস করার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়। সব জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ যখন এক ও অভিন্ন হয়, তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বন্ধন সুদৃঢ় হয়ে উঠে।
৬. ভাবগত ঐক্য : জাতীয়তাবোধ গঠনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ভাবগত ঐক্য। এটা ব্যতীত জাতি গঠনের অপরাপর উপাদানসমূহ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ তাদের ছাড়াও একটি জাতি গড়ে উঠতে পারে। জাতীয় ঐক্য মূলত ভাবগত। Prof. Spengler বলেছেন, “জাতীয়তাবাদের উপাদান কুলগত বা ভাষাগত ঐক্য নয় বরং তা ভাবগত ঐক্য।"
৭. একক শাসনব্যবস্থা : এটা জাতীয়তাবাদ গঠনের অপর একটি উপাদান। একই শাসন ব্যবস্থার অধীনে দীর্ঘদিন থাকলে স্বভাবতই জনগণের মধ্যে জাতি গঠনের স্পৃহা দেখা দেয় এবং তারা জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের সৃষ্টি। সবদেশে একই ধরনের উপাদান এবং একইভাবে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হয়েছে তা মনে করার কোন কারণ নেই। জোর করে কৃত্রিম উপায়ে পরিকল্পনা করে কোন জাতি সৃষ্টি করা যায় না। মানব প্রবৃত্তির মধ্যেই জাতীয়তাবাদের চেতনা দেখা যায়। মানুষ তার পরিচিত নিজ পরিবেশের প্রতি আকর্ষণবোধ করে। তার সাথে একাত্ম হয়, ভালোবাসে। তাই যে কোন উপাদান নিয়ে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠতে পারে।
করোজ
ATTA
২১৮

প্রশ্ন৷৬৷ আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে অভ্যন্তরীণ উপাদানসমূহ কী কী,
এর বিভিন্ন পর্যায় উল্লেখ কর।
অথবা, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে অভ্যন্তরীণ কারণগুলো কী কী এবং বিভিন্ন পর্যায় লিখ।
উত্তরা ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা বা অনুভূতি; যে অনুভূতি নির্দিষ্ট কোন জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে এবং জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর করে তোলে। জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে ইউরোপে পঞ্চদশ শতকে রেনেসাঁর মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য ঔপনিবেশিক দেশসমূহে এর প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। কারণ যেখানে অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণ প্রক্রিয়া চলে সেখানেই জাতীয়তাবাদ উঠে। আফ্রিকা মহাদেশকে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ দখল করে নিয়ে সেখানে ঔপনিবেশিক শাসন চালু করে এবং শোষণ নির্যাতন শুরু করে। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আফ্রিকানরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলে।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে অভ্যন্তরীণ কারণ/উপায় : ঔপনিবেশিক শাসন যুগে আফ্রিকান _জাতীয়তাবাদ বিকশিত হওয়ার পশ্চাতে শুধু বাহ্যিক কারণই নিহিত ছিল না। এর পশ্চাতে কতিপয় অভ্যন্তরীণ উপাদান
সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. মিশনারি শিক্ষার প্রভাব : আফ্রিকায় প্রথম আসে ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিরা এবং ধর্ম প্রচারই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তবে ধর্ম প্রচারের স্বার্থেই তারা আফ্রিকায় প্রথম মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এবং এ স্কুলে আফ্রিকানরা শিক্ষালাভ করে আধুনিক বিশ্বের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। এ মিশনারি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আফ্রিকানরা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম কথা বলে যা জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রথম পদক্ষেপ।
২. গোত্রতন্ত্র : গোত্রতন্ত্রকে বলা হয় আফ্রিকায় জাতীয় সংহতি অর্জনের পথে প্রধান বাধা। তাই স্বাভাবিকভাবে এটা জাতীয়তাবাদের পথেও বাধা হওয়ার কথা। কিন্তু কতিপয় ঐতিহাসিক বলেছেন, গোত্রতন্ত্র আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়তা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, Richard L. Sklar এর মন্তব্য ধরা যাক। তিনি বলেছেন, “একটা পর্যায় পর্যন্ত গোত্রতন্ত্র জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভূমিকা রেখেছে।” যেমন- নাইজেরিয়ার ইউরোবা গোত্র। তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, এটা বড় গোত্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ছোট গোত্রের ক্ষেত্রে নয়।
৩. ইসলাম ধর্ম : আফি, জাতীয়তাবাদ বিকাশে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ইসলাম ধর্ম। খ্রিস্টধর্ম যদিও মানবতার কথা বলে, তবে এখানে বর্ণবাদ প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মে বর্ণবাদের কোন স্থান নেই। এখানে সব মানুষের সমান অধিকার। তাই আফ্রিকান নিগ্রোদের জন্য এটি একটি গ্রহণযোগ্য ধর্ম ছিল যা জাতীয়তাবাদ বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছে। এ সম্পর্কে এডওয়ার্ড ব্লাইডেন মন্তব্য করেছেন যে, “ইসলাম ধর্ম আফ্রিকানদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করেছে যা জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের পূর্বশর্ত।”
2
৪. রাজনৈতিক সংগঠন : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উদ্ভব হয়েছে বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে। কিন্তু তা বিকশিত হয়েছে আফ্রিকার বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে। যেমন- National Congress of British West Africa, ঘানা (১৯১৮) ও West African Student Union এই দুটি সংগঠন পশ্চিম আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া African National Congress বা ANC ১৯১২ সালে গঠিত হয় এবং সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
৫. ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিবাচক প্রভাব : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিবাচক প্রভাব। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর আফ্রিকায় নেতিবাচক প্রভাবের পথে কিছু ইতিবাচক প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়। যেমন- পাশ্চাত্য শিক্ষা, শাসনকার্যে আফ্রিকানদের নিযুক্ত, একই শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের জোর করে নিয়োগ, গোত্রীয় শাসন বিলুপ্তি প্রভৃতি। এসব ইতিবাচক প্রভাব আফ্রিকার ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের পর্যায় : আফ্রিকায় যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল তা তিনটি পর্যায় পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করেছিল। যেমন-
বি
জা
যা
এব
CD
বে
pe
পি
১. সচেতনতার পর্যায়,
২. প্রস্তুতির পর্যায় ও
৩. চূড়ান্ত পর্যায়

নিম্নে এ তিনটি পর্যায় সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
২১৯
১. সচেতনতার পর্যায় : আফ্রিকা ছিল পৃথিবীর অন্যান্য দেশ হতে বিচ্ছিন্ন এবং এখানে আধুনিক যুগের কোন বৈশিষ্ট্য ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হওয়ার পর আফ্রিকানরা আধুনিক যুগের মধ্যে প্রবেশ করে এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি পায়। এ আত্মসচেতনতা থেকে তারা ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ সম্পর্কে অবহিত হয় যা তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। ফলে এ ঔপনিবেশিক শাসনের যুগ থেকে সচেতনতার পর্যায় চিহ্নিতকরণ হয় এবং তা স্থায়ী ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী অধ্যায় পর্যন্ত। এ সময় তারা ইউরোপীয় শক্তিবর্গের শাসন ও শোষণ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে সচেতনতার শেষ পর্যায় পৌঁছে যা তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম দেয় ।
২. প্রস্তুতির পর্যায় : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এবং তা স্থায়ী ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত। অর্থাৎ এই দু' বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় আফ্রিকানরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং এর মাধ্যমে তারা তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পর্যায় আফ্রিকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্ভব হয় যা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য প্রস্তুত হয়। যেমন- ১৯১২ সালে গঠিত হয় ANC বা African National Congress.
10
৩. চূড়ান্ত পর্যায় : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ঔপনিবেশিক রাজ্য ধরে রাখার সামর্থ্য হারায়। এ সুযোগ গ্রহণ করে আফ্রিকানরা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এ পর্যায় সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় বলা হয়। কারণ এর ফলে আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে এবং আফ্রিকা মহাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। তাই আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত পর্যায় ধরা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অর্থাৎ ১৯৪৫ পরবর্তী থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে। কারণ ১৯৬০ সালে ১৩টি আফ্রিকান দেশ স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের সমাপ্তি হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হওয়ার পর আফ্রিকার জনগণ আধুনিক যুগে পদার্পণ করে এবং তারা নিজেদের সম্পর্কে জানতে পারে। এদিকে ঔপনিবেশিক শাসনের কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে আফ্রিকানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। এ জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও সফল করার ক্ষেত্রে আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ উপাদানসমূহ বিশেষভাবে দায়ী ছিল। এ জাতীয়তাবাদ বিকাশ তিন পর্যায় শেষ হয় এবং আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ সফল হয়।
প্রশ্ন৭। জাতীয়তাবাদ বিকাশের বহিস্থ বা বাহ্যিক উপাদানসমূহ লিখ ।
অথবা, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উদ্ভব ও বিকাশে বাহ্যিক উপাদানসমূহ কী ভূমিকা রেখেছিল লিখ অথবা, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে বাহ্যিক মাধ্যমগুলো বিশ্লেষণ কর ।
1
উত্তর ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা বা অনুভূতি যা রাজনৈতিক দিক হিসেবে বিবেচিত । জাতি থেকেই জাতীয়তাবাদের উদ্ভব। জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি জাতি হলো রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ একদল মানুষ যাদের আছে রাজনৈতিক উৎসাহ উদ্দীপনা, যাদের একই রকম ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে, আছে অভিন্ন সাংস্কৃতিক যোগ এবং সাধারণত যারা একই ভৌগোলিক অখণ্ড অঞ্চলে বসবাস করে। এ অর্থে জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি ঐক্যবদ্ধ মানুষের চেতনা যারা একটি জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে। এ সম্পর্কে 'Essays on Nationalism' গ্রন্থে JH. Hayes বলেছেন, "Nationalism consists of modern emotional fusion and exaggeration of two very pehnomena_nationality and patriotism." পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশভিত্তিক ও অঞ্চলভিত্তিক। সেক্ষেত্রে আফ্রিকায় যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে তা মূলত আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ ।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের বহিস্থ বা বাহ্যিক উপাদান : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পিছনে দুটি উপাদান কাজ করেছে। যথা :
i. বাহ্যিক বা বহিস্থ উপাদান ও
ii. অভ্যন্তরীণ উপাদান।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে বহিস্থ উপাদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দিয়া আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে বহিস্থ উপাদানসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র : আফ্রিকানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে অঞ্চলভিতি ও সময়ভিত্তিক। অর্থাৎ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে। কারণ ইউরোপীয় বিভিন্ন শক্তি আফ্রিকায় ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল দখল করে সেখানে তাদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। ফলে এ শাসন চরিত্রের উপর আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। যেমন- ব্রিটিশ শাসিত আফ্রিকায় বর জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকশিত হয়। কিন্তু ফ্রান্স কিংবা বেলজিয়ামের আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয় দেরিতে।
২. আফ্রো-আমেরিকানদের অবদান : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেছেন আফ্রো-আমেরিকান নেতৃবৃন্দ। এ আফ্রো-আমেরিকান হচ্ছে আমেরিকায় বসবাসরত দাস শ্রেণির বংশধর। অর্থাৎ যেসব আফ্রিকানদের দাস হিসেবে আমেরিকায় বিক্রি করা হয়েছিল, তারা কিংবা তাদের বংশধর পরবর্তীতে দাসত্ব প্রধা হতে মুক্তি পেয়েছিল ১৮৬৫ সালের পর থেকে। এরা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে আফ্রিকায় ফিরে এসে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জজ প্যাডমোর, ডুবয়, মার্কাস গার্ভে, সিলভেস্টার প্রমুখ। এগুলোর রাইডেনের মতে, “প্রত্যেক জাতিকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে হলে তাকে জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে।”
৩. পশ্চিম আফ্রিকার জাতীয় নেতৃবৃন্দের অভিজ্ঞতা : আফ্রিকায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করা হলে বহু আফ্রিকান পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় যান। কিন্তু তারা এখানে এসে বর্ণবাদের শিকার হন। ফলে তাদের মনে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের শাসন ও শোষণ সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় এবং এ অভিজ্ঞতা থেকেই তাদের মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে ।
৪. দুই মহাযুদ্ধের প্রভাব : ইউরোপে অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি মহাযুদ্ধ বা বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ দুটি মহাযুদ্ধেই আফ্রো-এশিয়ানদের সৈনিক হিসেবে পাঠানো হয়। এসব সৈন্যরা যুদ্ধে থাকাকালে ইউরোপীয়দের কাছ থেকে যে আচরণ পেয়েছে, যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তার ঠিক উল্টো আচরণ পেয়েছে। ফলে এসব যুদ্ধ ফেরত সৈন্যদের মাঝে হতাশা ক্ষোভ দেখা দেয় এবং তারা ইউরোপীয় শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
৫. প্যান আফ্রিকানিজম : প্যান আফ্রিকানিজম হচ্ছে সারা বিশ্বে কালোদের নিয়ে গঠিত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় যেসব কালো আফ্রিকানরা বসবাস করতো তাদের নিয়ে একটি সংগঠন করে এবং এর মাধ্যমে শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ আন্দোলন জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ আন্দোলনের বক্তব্য ছিল, “আমরা কালো আফ্রিকার জন্য স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা দাবি করছি। আমরা যুদ্ধ করব, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য।”
৬. বিদেশি আদর্শের প্রভাব : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে অন্যতম প্রভাব ফেলেছে কতিপয় বিদেশি আদর্শ। এ বিদেশি আদর্শগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
নিম্নে এ আদর্শগত প্রভাব বিশ্লেষণ করা হলো :
ক. অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও খ. মার্কসবাদ ।
ক. অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের অন্যতম বহিস্থ উপাদান হচ্ছে অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এ অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ হচ্ছে যেসব দেশ উপনিবেশবাদের শিকার তাদের অঞ্চলে সংঘটিত জাতীয়তাবাদ। এ আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। যেমন- ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা মহাত্মা গান্ধীর সাথে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী নেতা ড. নক্রুমা ও মার্কাস গার্ডের বিশেষ যোগাযোগ ছিল এবং তারা একে অপরের দেশের জাতীয়তাবাদ আদানপ্রদান করতো। এতে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ দ্রুত বিস্তার লাভ করে ।
খ. মার্কসবাদ : মার্কসবাদ হচ্ছে সমাজতন্ত্র এবং এ সমাজতন্ত্র ইউরোপের দেশ রাশিয়ায় উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে পরে রাশিয়া সমগ্র বিশ্বে তা ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে এবং প্রায় সফলও হয়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ সরকার ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলে ত বিলোপের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান করে। আফ্রিকান অনেক ছাত্র রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য যায় এব তারা সমাজতন্ত্রের ধারণা নিয়ে আফ্রিকায় ফিরে এসে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে যা পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ নেয় ।

২২১
৭. বহির্বিশ্বের ঘটনাবলির প্রভাব : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে বহির্বিশ্বের ঘটে যাওয়া কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে । নিম্নে এগুলো উল্লেখ করা হলো :
ক. আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৬) : বিশ্বে প্রথম ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয় আমেরিকা। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্ববাসীর কাছে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। কারণ তাদের এ স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন বিভিন্ন ঔপনিবেশিক জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বিশেষকরে আফ্রিকান জনগণের কাছে এ যুদ্ধ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
খ. ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে ১৭৮৯ সালে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লব
কারণ ফরাসি বিপ্লব ছিল স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এ আন্দোলনের মূল স্লোগান ছিল স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি আদর্শ । এ আদর্শগুলো জাতীয়তাবাদের ভিত্তি যা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে।
গ. রুশ-জাপান যুদ্ধ (১৯০৪-০৫) : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরেকটি ঘটনা বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে, সেটা হচ্ছে ১৯০৪-০৫ সালে সংঘটিত রুশ-জাপান যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে পরাশক্তি রাশিয়ার পরাজয়। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শক্তি রাশিয়া এশিয়ান ক্ষুদ্র দেশ জাপানের কাছে পরাজিত হয়। রাশিয়ার এ পরাজয় আফ্রিকার ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উৎসাহ যুগিয়েছিল ।
ঘ. রুশ বিপ্লব (১৯১৭) : ১৯১৭ সালে রাশিয়ার জনগণ স্বৈরাচারী জার শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জার শাসনের পতন ঘটিয়ে সেখানে সমাজতন্ত্র কায়েম করে যা রুশ বিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লব নামে পরিচিত। এ বিপ্লব ঔপনিবেশিক শাসনের বিপক্ষে কথা বলে বিধায় আফ্রিকান জনগণ তা দ্বারা প্রভাবিত হয়।
৮. জাতিসংঘের ভূমিকা : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উদ্ভব হয় কতিপয় উপাদানের মাধ্যমে, বিকশিত হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে এবং পরিপূর্ণতা পায় জাতিসংঘের হাত ধরে। কেননা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সময় এর সনদের ৭৩ ও ৭৬(খ) অনুচ্ছেদে সংযুক্ত করা হয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংক্রান্ত প্রস্তাব যা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে উৎসাহিত করে এবং জাতীয়তাবাদ বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া জাতিসংঘের একটি দল আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে সমর্থন ও সাহায্য করেছিল।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর আফ্রিকান জনগণ আধুনিক জগতে প্রবেশ শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে তারা জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে থাকে। তাদের এ জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগ্রত ও বিকশিত করার পিছনে উপর্যুক্ত বাহ্যিক উপাদানসমূহ বিশেষভাবে দায়ী ছিল। এসব উপাদানের সমন্বয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে এবং এর প্রেক্ষাপটে সেখানে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়। ফলে ১৯৬০ এর দশকে একযোগে ১৩টি দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে ।
প্রশ্ন ৮। জাতীয়তাবাদ বিকাশে আফ্রিকান নেতৃবৃন্দের ভূমিকা কী ছিল? জাতীয়তাবাদের বিকাশের অভ্যন্তরীণ উপাদান আলোচনা কর ।
অথবা, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে নেটিভদের অবদান বিশ্লেষণ করে এর নিজস্ব
উপাদান আলোচনা কর।
উত্তরা ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একপ্রকার মানসিক অবস্থা যা অধিক সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিস্তৃত এবং যা সমগ্র জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে। এটা জাতীয় রাষ্ট্রকে একটি আদর্শ রাজনৈতিক সংগঠন এবং জাতীয়তাকে সকল সৃজনশীল গোষ্ঠীগত এবং অর্থনৈতিক কল্যাণের উৎস বলে মনে করে। সুতরাং মানুষের চূড়ান্ত আনুগত্য তার জাতীয়তাবাদের ফলস্বরূপ। তাই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জাতীয়তাবাদের ন্যায় আফ্রিকায়ও জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে। কিন্তু আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় যাকে বলা হয় আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ ।
জাতীয়তাবাদ বিকাশে আফ্রিকান নেতৃবৃন্দের ভূমিকা : পৃথিবীর প্রতিটি দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পিছনে সে দেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাদের আন্দোলনের ফলেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সফল ও সার্থক হয়। তেমনি আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশে আফ্রিকান নেতৃবৃন্দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নিম্নে কয়েকজন আফ্রিকান নেতৃবৃন্দের ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
প্রশ্ন ১২। আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ কী? আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে
মিশনারি শিক্ষা ও গোত্রতন্ত্রের ভূমিকা লিখ।
অথবা, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ কী? এই জাতীয়তাবাদ বিকাশে মিশনারী শিক্ষা ও গোত্রতল
চেতনা
কতটুকু অবদান রাখতে পেরেছিল বলে তুমি মনে কর?
উত্তরা ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক ধারণা বা অনুভূতি, যা কোন নির্দিষ্ট জনসমষ্টিকে ঐক্যবন্ধ করে জাতীয় রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্নে বিভোর করে তোলে। কিন্তু এ সূত্র আফ্রিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদী বিকশিত হয় ভিন্ন ধারায় এবং ভিন্নসূত্রে এবং সে সূত্র হচ্ছে উপনিবেশবাদ। অর্থাৎ ১৮৮০ এর দশকে আফ্রিকা ইউরোপীয় শক্তিবর্গের উপনিবেশবাদের শিকার হয় এবং আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপীয়রা আফ্রিকায় শাসন ও শোষণ শুরু করে এবং এক পর্যায় আফ্রিকানরা সচেতন হয়ে উঠে ঔপনিবেশিক শাসনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে তারা ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে, যা তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় এবং এটাই আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ নামে পরিচিত। এ আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের পশ্চাতে মিশনারি শিক্ষা ও গোত্রতন্ত্রের বেশ ভূমিকা ছিল।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ : জাতীয়তাবাদ কথাটির জন্ম ইউরোপে এবং তা ১৭৮৯ সালে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে বিশ্বে সর্বত্র তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং আধুনিক বিশ্বের প্রধান আদর্শ হচ্ছে এ জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো এমন একটি মানসিক ধারণা বা অনুভূতি, যা কোন নির্দিষ্ট জনসমষ্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর করে তোলে। এ জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর সর্বত্র প্রায় একই ধারায় বিকশিত হলেও আফ্রিকায় ভিন্ন ধারায় গড়ে উঠেছে। অবশ্য এর পশ্চাতে কতিপয় কারণও নিহিত ছিল। যাহোক, আফ্রিকায় যেভাবে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে, তা মূলত ব্যতিক্রমধর্মী জাতীয়তাবাদ । তাই একে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বলাই শ্রেয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন ঐতিহাসিক আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের কয়েকটি সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :
“আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ইউরোপীয় শাসনের বিরুদ্ধে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এমন একটি রাজনৈতিক অনুভূতি।” - N. Sithole, African Nationalism ]
'African Nationalism is a consiousness of belonging to a common group in being or increation." [Dr. Coleman, the Politics of African Nationalism. P-6]
“আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ ছিল সমকালীন আফ্রিকার সর্বাপেক্ষা সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি।” [টম মোবোয়া]
“আমরা দেখেছি প্রায় সমগ্র আফ্রিকাই তীব্র জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় উদ্বেলিত হয়ে রয়েছে। সমগ্র আফ্রিকায় এ একটি মাত্র প্রবণতাই সর্বত্র নজরে পড়ে যে, অধিকাংশ আফ্রিকানই ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেতে, কিংবা অন্ততপক্ষে নির্যাতনমূলক ব্যবস্থাদির সংশোধন করতে চাইছে।” [জন গান্থার, আফ্রিকার অভ্যন্তরে p-574 অনুবাদ —চৌধুরী শামসুর রহমান]
কারণ আন
আফ্রিকান দেশে জাতীয় স
অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক
আফ্রিকা মহাদেশ প্রধানত গোত্র বিভাজিত সমাজব্যবস্থা এবং
জনসচেতনতার সৃষ্টি সম্ভব হয় নি, যা জাতীয়তাবাদ বিকাশের অন্যতম উপাদান।
জাতীয়তাবাদ বিকাশে বাধা। কিন্তু একথা একদল আফ্রিকান পণ্ডিত স্বীকার করতে নারাজ। তাে

২৩১
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়তা করেছে। তারা যুক্তি দেখান যে, যদিও বৃহত্তর ঐক্য সম্ভব হয় নি, কিন্তু গোত্ৰতন্ত্র
ক্ষুদ্রতর
ঐক্য সাধনে সহায়তা করেছে, যা বৃহত্তর ঐক্য অর্জনের পথ সহজ করে দেয়। এ পণ্ডিত দলের মধ্যে প্রধান হলেন
রিচার্ড আর স্কালার। তিনি যুক্তি দেখান যে, আফ্রিকার জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে গোত্রতন্ত্র বৃহত্তর ঐক্য সাধন করতে না। পারলেও ক্ষুদ্র ঐক্যের মাধ্যমে বৃহত্তর ঐক্যের পথে অগ্রসর হয়েছিল। তিনি উদাহরণস্বরূপ নাইজেরিয়ার ইউরোবা গোত্রের কথা বলেছেন । এ গোত্রে কিছুসংখ্যক ছাত্র আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যায় এবং ১৯৪৪ সালে সেখানে তারা 'Pan Youruba Culture Society' নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। ১৯৫১ সালে এর একটি শাখা 'Action Group ' নাইজেরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে সরকার গঠন করে। এভাবে নাইজেরিয়ার জাতীয়তাবাদ বিকাশে ইউরোবা গোত্র সাহায্য করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীর অন্যান্য জাতীয়তাবাদ থেকে ভিন্ন ধারায় যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে তা মূলত আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ নামে পরিচিত। এ জাতীয়তাবাদ বিকাশে মিশনারি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আফ্রিকানরা আধুনিক জগতে প্রবেশ করে এবং সেখানে তারা সচেতন হয়ে উঠে। এ সচেতনতা থেকে তাদের মধ্যে প্রতিবাদের জন্ম দেয় বা জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়তা করে। তাই মিশনারি শিক্ষার গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই। গোত্রতন্ত্র জাতীয়তাবাদ বিকাশের পথে বাধা হলেও তা জাতীয়তাবাদ বিকাশের পথে সহায়তা করেছে বলে অনেক পণ্ডিত মনে করেন, বিশেষ করে ক্ষুদ্রতর ঐক্যের পথে গোত্রতন্ত্র ভূমিকা রেখেছে।
প্রশ্ন ১৩৷ আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে দুই মহাযুদ্ধের প্রভাব আলোচনা
কর।
অথবা, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে দুই বিশ্বযুদ্ধ কতটা অবদান রাখতে
পেরেছিল বলে তুমি মনে কর?
অথবা, দুই বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব কিভাবে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে প্রভাবিত করেছিল? তোমার
উত্তরের সপক্ষে মতামত দাও ।
উত্তর ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা বা অনুভূতি, যা রাজনৈতিক দিক হিসেবে বিবেচিত। জাতি থেকেই জাতীয়তাবাদের উদ্ভব। জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি জাতি হলো রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ একদল মানুষ, যাদের আছে রাজনৈতিক উৎসাহ উদ্দীপনা, যাদের একই রকম ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে, আছে ভিন্ন সাংস্কৃতিক যোগ এবং সাধারণত যারা একই ভৌগোলিক অখণ্ড অঞ্চলে বসবাস করে। এ অর্থে জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি ঐক্যবদ্ধ মানুষের চেতনা যারা একটি জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে। এ সম্পর্কে 'Essays on Nationalism' গ্রন্থে J. H. Hayes বলেছেন, "Nationalism consists of modern emotional fusion and exaggeration of two very pehnomena nationality and patriotism." পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে বিভন্ন দেশভিত্তিক ও অঞ্চলভিত্তিক। সেক্ষেত্রে আফ্রিকায় যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে তা মূলত আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ। এ আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে দু' মহাযুদ্ধের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ বিকাশে দুই মহাযুদ্ধের প্রভাব : "The civils of war world assume specially fatal character if the natives were late to zake siglized power." (আমরা সাদারাই যদি মারামারি করি, তাহলে কালোরাও আমাদের উপর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে।) উক্তিটি করেছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর প্রিন্স অটোফন বিসমার্ক তাঁর সভাপতিত্বের ভাষণে ১৮৮৪ সালে বার্লিন সম্মেলনে। অর্থাৎ আফ্রিকার উপনিবেশ স্থাপনকে কেন্দ্র করে যখন ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যে দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে রক্ষার জন্য বার্লিন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তখন বিসমার্ক উপর্যুক্ত উক্তি করেছিলেন। কারণ ইউরোপীয়রা ছিল শ্বেতাঙ্গ তথা সাদা বর্ণের আর আফ্রো-এশিয়ানরা কালো বর্ণের। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখে বিসমার্কের মনে ভয় লেগেছিল যে, শ্বেতাঙ্গদের মারামারির সুযোগে কালোরা হয়ত একদিন তাদের উপর চড়াও হবে এবং উপনিবেশগুলো স্বাধীন হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত বিসমার্কের ভয়ই সত্যি হলো। কারণ তার প্রমাণ দুটি বিশ্বযুদ্ধ বা মহাযুদ্ধ। এ মহাযুদ্ধের পরপরই উপনিবেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জোরদার হয় এবং তারা তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয় । তাই আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে দুই মহাযুদ্ধের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

প্রথম মহাযুদ্ধের প্রভাব : অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্দিনান্ডের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ইউরোপে যে যুদ্ধ সংঘটিত হ প্রথম মহাযুদ্ধ। এটি শুরু হয় ১৯১৪ সালে যখন সর্বত্র উপনিবেশবাদ চলছিল। ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, রাশিয়া একপক্ষে এবং অন্যপক্ষে ছিল জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম। এরা সবাই তখন ঔপনিবেশিক শক্তি। তাই নিজস্বার্থেই ঔপনিবেশিক রাজ্য থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে তাদেরকে যুদ্ধে পাঠানো হয়। তেমনি আফ্রিকান উপনির থেকেও সৈন্য সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত আফ্রিকার সিয়েরালিওন, লাইবেরিয়া, ঘানা প্রভৃতি দেশ হতে সৈন্য সংগ্রহ ক হয় এবং এসব সৈন্যদের এশিয়ান ইউনিটে পাঠানো হয়। যুদ্ধের সময় এদের সাথে শ্বেতাঙ্গরা খুব ভালো ব্যবহার কর কিন্তু যুদ্ধ শেষে কিছু সৈন্যদের ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ শহরে রাখা হয় এবং বাকি সৈন্যদের আফ্রিকায় পাঠানো ইউরোপে অবস্থানরত সৈন্যরা শ্বেতাঙ্গদের সংস্পর্শে আসে এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদি যুদ্ধ ফেরত সৈন্যদেরকে অবহেলা করা হয়। ফলে তাদের মনে ঘৃণা ও প্রতিশোধ পরায়ণতা কাজ করে এবং ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে, যা তাদের মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব : জার্মান কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং এ যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ রূপ লাভ করে। এ বিশ্বযুদ্ধেও ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গ তাদের ঔপনিবেশিক রাজ্য থেকে নৈ সংগ্রহ করে যুদ্ধে প্রেরণ করে। যুদ্ধ শেষে ঔপনিবেশিক সৈন্যদের সাথে খারাপ আচরণ করা হয়। তাছাড়া এ যুদ্ধ শে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং উপনিবেশ ধরে রাখার মতো ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে এ সুযোগ গ্রহণ আফ্রিকা উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। এ সময় আফ্রিকান নেতারা ঔপনিবেশিক শা ও শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। এ সময় আফ্রিকান নেত ঔপনিবেশিক শাসকদের হয়ে আর যুদ্ধ করতে রাজি ছিল না। কারণ তারা বলল যে, "Don't us about Hitlar, we a not interested, we are only interested about the enemy on our shoulder now." এ বক্তব্য থেকেই য যায় যে, আফ্রিকানরা কিভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
মূল্যায়ন : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের ইতিহাস একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। এ ইতিহাস সফল করা পিছনে যেসব উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল তার মধ্যে দুটি উপাদান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ যুদ্ধের ইউরোপীয়রা আফ্রিকানদের সৈন্য হিসেবে ব্যবহার করে। এসব নিগ্রো সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে দেখলো যে, তাদের শ্বেতাঙ্গরা মারা যাচ্ছে। তাদের মনে এ ধারণা জন্মে যে, শ্বেতাঙ্গরা অজেয় নয়, তাদেরও পরাজয় আছে। এক্ষেত্রে আফ্রিকানরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে তাহলে অবশ্যই ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গকে পরাজিত করা যুদ্ধরত সৈন্যদের এ ধারণা হতেই তাদের মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বয় চলাকালে ১৯৪১ সালে প্রণীত আটলান্টিক চার্টারের একটি সনদে বলা হয় যে, ঔপনিবেশিক রাজ্যের জনগণকে যুদ্ধে সমাপ্তিতে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দেয়া হবে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তা বাস্তবায়ন করা না হলে আফ্রিকান জনগণ বিদ্রোহী হয়ে এবং তারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবশেষে তাদের স্বাধীনতা আসে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীতে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে তা থেকে আফ্রিকায় ভিন্ন ধারায় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল, যা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ নামে খ্যাত। এ আফ্রিক জাতীয়তাবাদ বিকাশে দুই মহাযুদ্ধের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত। প্রথম মহাযুদ্ধের পর আফ্রিকানদের যা জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে তা বিকশিত হতে থাকে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে তা চূড়ান্ত আকার ধারণা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ সফল হয় অর্থাৎ এর মাধ্যমে আফ্রিকার স্বাধীনতা আসে।
প্রশ্ন ১৪। 'ফিরে চলো আফ্রিকা' সম্পর্কে লিখ।
অথবা, মাকার্স গার্ডের ‘আফ্রিকানদের জন্য আফ্রিকা' সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর ভূমিকা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে এবং অবশে তা স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৬০ এর দশকে আফ্রিকান দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করে। আফ্রিকান জাতীয়তাবা আন্দোলনে যেসব উপাদান বিশেষভাবে সহায়তা করেছে তার মধ্যে 'ফিরে চলো আফ্রিকা' সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং এ চলো আফ্রিকা'র প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন মার্কাস গার্ভে। মাকার্স গার্ডের এ আন্দোলন ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং তিনি সফলতা পর কারণ তাঁর প্রচেষ্টায় আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সফল হয়। তাইতো ঘানার সাংবাদিকগণ লিখেছেন, “প্যান আফ্রিকা কংগ্রেসের বদলে মার্কাস গার্ভের আন্দোলন আফ্রিকার জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।”
ইতিহাস ৩য় বর্ষ (১৫৭৭) ৩০
কাপটে প্যান আফ্রিকান মুভমেন্ট সংঘাতে মোহণা
ালার পথে
প্রতিষ্ঠার G
পর
> এর দশকে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করলেও বহু পূর্ব থেকে করতো, বিশেষকরে দাস ব্যবসায় করতো এবং ঔপনিবেশিক শাসন াবে চলতে থাকে। এ দাসদেরকে আমেরিকায় বিক্রি করে দেয়া হতো এবং তার সবাস করতে থাকে। পরবর্তীতে এ দাস শ্রেণি বা তাদের বংশধরগণ আমেরিকার করে শিক্ষিত শ্রেণিতে পরিণত হয়। কিন্তু এখানে তারা বর্ণবাদের শিকার হন। অন্যদিয়ে শোষণ চলতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে আফ্রো-আমেরিকান নেতৃবৃন্দ ও আফ্রিকার জাতীয় ন গড়ে তোলে, যা প্যান আফ্রিকানিজম বা প্যান আফ্রিকান আন্দোলন নামে পরিচিত। এ তা সংঘটিত হয় পশ্চিমা বিশ্বের দেশসমূহে। তাই এ আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম নর পটভূমি বা প্রেক্ষাপট : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের সময়ে যে পান তার পশ্চাতে কতিপয় কারণ নিহিত ছিল, যা তার প্রেক্ষাপট বা পটভূমি হিসেবে কাজ াচনা করা হলো :
চানদের অভিজ্ঞতা : আফ্রিকায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করা হলে বহু আফ্রিকান পাশ্চাত ক্ষার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় যান। কিন্তু তারা এখানে এসে বর্ণবাদের শিকার হন ক্তবর্গের শাসন ও শোষণ সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় এবং এ অভিজ্ঞতা থেকেই তাদের ঘটে। তবে এটা ছিল প্যান আফ্রিকান আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ। তাছাড়া এ হয় যে, এর মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব আফ্রিকার মূল শিকড় বিচ্ছিন্ন করতে চায়। এ সম্পর্কে াধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। তবে তিনি ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কবি ক্লান্ড ম্যাকি। তিনি তাঁর
Something in me is lost,
Forever lost
Some vital thing has,
Some out of my heart.

fo
হয়

হে যাব
পরি
হো মর্যা
Ba
উক্ত

২৩৫
কবিতার চরণে দেখা যাচ্ছে যে, কালোদের শিকড় হারানোর আকুতি যা তাদের মধ্যে বর্ণবৈষম্যের শিকড় দ্বারা সংঘটিত হয়েছে এবং তা আবার ফিরে পেতে আগ্রহী।
3. ব্লোকনেস বা কৃষ্ণবর্ণ : Blackness এসেছে ইংরেজি ভাষা থেকে যার বাংলা শব্দ কালোত্ব বা কৃষ্ণবর্ণ। আফ্রিকান জনগণ ছিল কালো এবং তারা সাধারণত দাস হিসেবে ইউরোপ ও আমেরিকায় বিক্রি হতো। এসব কালো আফ্রিকানরা শ্বেতাঙ্গ সমাজে ঘৃণার ও অবহেলার পাত্র ছিল। কারণ ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণ ছিল সাদা চামড়ার বা বর্ণের অর্থাৎ তাদের গায়ের রং সাদা ছিল। এ সাদা রং নিয়ে তারা সর্বদা গর্ববোধ করত এবং কালোদের অবহেলা ও ঘৃণা করে তাদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন করতো। এর ফলে কালোরা সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত থাকত এবং এক ধরনের হীনম্মন্যতা তাদের মধ্যে কাজ করতো। অবস্থার প্রেক্ষাপটে তারা এক সময় সচেতন হয়ে উঠে এবং তারাও কালো বর্ণ নিয়ে গর্ববোধ করতে শুরু করে। কারণ অত্যাচারিতরা অত্যাচার সহ্য করতে করতে এক সময় হয়ে উঠে নির্মম অত্যাচারী। আফ্রিকার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে এবং তারাও এক সময় আবেগময় যুক্তি দাঁড় করায় যে, সাদার সমান্তরালে কালোও একটি বর্ণ। তারা বলতে থাকে, “সাদারা যদি তাদের সাদা রং নিয়ে গর্ববোধ করতে পারে তাহলে আমরা কেন আমাদের কালো রং নিয়ে। গর্ববোধ করতে পারব না।” এ সম্পর্কে কবি R. A. Armattoe লিখেছেন যে,
"Our God is black,
Black is eternal blackness."
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এক সময় কালোরা তাদের কালো রং নিয়ে গর্ববোধ করতে শুরু করে এবং এ চেতনা থেকেই প্যান আফ্রিকান আন্দোলনের উদ্ভব।
৩. ব্যক্তিত্ব ও নিগ্রোত্ব : ব্যক্তিত্ব ও নিগ্রোত্ব বলতে বুঝায় আফ্রিকানদের মধ্যে কালো নিয়ে যে গর্ববোধের জন্ম হয়, সে গর্ববোধ থেকে তাদের মধ্যে মর্যাদাবোধেরও সৃষ্টি হয়। এটিই Personality and Negritude নামে খ্যাত। এর প্রবক্তা ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ কবি এ্যামি সিজারে এবং এটি প্রথম উত্থাপন করা হয় ১৯৫৬ সালের প্যারিস সম্মেলনে, যেখানে নিগ্রো লেখক ও সাহিত্যিকদের সভা আহ্বান করা হয়েছিল। এ নিগ্রোত্ব হচ্ছে আফ্রিকানদের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলার ভিত্তি। এ সম্পর্কে জ্যা পল সার্ত্রে মন্তব্য করেছেন যে, “নিগ্রোত্ব হলো আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কৃষ্ণ আত্মার আত্মপ্রকাশের একটি চেতনা।
৪. আফ্রো-আমেরিকান নেতৃত্বের উদ্ভব : প্যান আফ্রিকান আন্দোলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেছেন আফ্রো-আমেরিকান নেতৃবৃন্দ। এ আফ্রো-আমেরিকান হচ্ছে আমেরিকায় বসবাসরত দাস শ্রেণির বংশধর। অর্থাৎ যেসব আফ্রিকানদের দাস হিসেবে আমেরিকায় বিক্রি করা হয়েছিল তারা কিংবা তাদের বংশধর পরবর্তীতে দাসত্ব প্রথা হতে মুক্তি পেয়েছিল ১৮৬৫ সালের পর থেকে। এরা পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ করে আফ্রিকায় ফিরে এসে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জজ প্যাডমোর, ডুবয়, মার্কাস গার্ভে, সিলভেস্টার প্রমুখ। এরা কয়েকটি সংগঠন তৈরি করে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যান। যেমন- First American Negro Academy (1897), National Association for the Advancement of the Colonial People (1906), Negro Society for Historical Research (1911) ইত্যাদি।
৫. ব্যাক টু আফ্রিকান মুভমেন্ট : আফ্রিকা থেকে যেসব লোকদের ধরে নিয়ে আমেরিকায় দাস হিসেবে বিক্রি করা হয় তারা ১৮৬৫ সালের পর মুক্তি পায় এবং সাধারণ নাগরিকের মর্যাদা পায়। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ সমাজে তারা কোন নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারে নি। তাদেরকে সবসময় ঘৃণা করা হতো এবং নীচ বলে মনে করা হতো। এর ফলে আফ্রিকানদের মধ্যে হীনম্মন্যতা কাজ করে এবং তারা তাদের পূর্বপুরুষদের জন্মস্থান আফ্রিকায় ফিরে আসার জন্য উৎসাহী হয়ে পড়ে। কারণ এদের প্রচুর মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এরা তার মূল্যায়ন পেত না। ফলে তারা আফ্রিকায় ফিরে যাবার জন্য পরিকল্পনা করে এবং এটাই Back to African Movement বা ফিরে চলো আফ্রিকা আন্দোলন নামে পরিচিত
। এর প্রবক্তা ছিলেন মার্কাস গার্ভে। এ সম্পর্কে মার্কাস গার্ভে বক্তব্য রাখেন যে, “একজন কৃষ্ণাঙ্গ যত মেধাসম্পন্ন হোক না কেন শ্বেতাঙ্গ সমাজে তার মেধার মূল্যায়ন হবে না। কালোরা যদি আফ্রিকায় ফিরে যায় তাহলে তারা তাদের মর্যাদা ফিরে পাবে ।” তার এ আন্দোলন সফল হয় এবং এ সম্পর্কে ঘানার সাংবাদিকগণ বলেছেন যে, মার্কাস গার্ভের Back to African Movement প্যান আফ্রিকান আন্দোলনের ক্ষেত্রে বেশি প্রাসঙ্গিক।
৬. মার্কসবাদ : মার্কসবাদ হচ্ছে সমাজতন্ত্র এবং এ সমাজতন্ত্র ইউরোপের দেশ রাশিয়ায় উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে। পরে রাশিয়া সমগ্র বিশ্বে তা ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে এবং প্রায় সফলও হয়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ সরকার ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলে তা বিলোপের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। আফ্রিকান অনেক ছাত্র রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য যায় এবং তারা সমাজতন্ত্রের ধারণা নিয়ে আফ্রিকায় ফিরে এসে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা প্যান আফ্রিকান আন্দোলনে সহায়তা করে ।
৭. আরব বিশ্ব : আরব বিশ্ব বলতে বুঝায় আফ্রিকা মহাদেশের সাহারা মরুভূমির উপরের অংশের রাষ্ট্রসমূহ নিয়ে গঠিত এলাকাকে। এ অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে মিশর, আলজেরিয়া, লিবিয়া, তিউনিশিয়া, মরক্কো প্রভৃতি দেশ। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যে, এসব দেশ বর্ণবাদের শিকার না হয়েও প্যান আফ্রিকান আন্দোলনে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, মিশরের সাংবাদিক দোস্ত মোহাম্মদ আলী 'African Times' এবং 'Orient Review' নামক দুটি পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে প্যান আফ্রিকান আন্দোলনে সহায়তা করেছে।
৮. ঘানার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশ : প্যান আফ্রিকান আন্দোলনের পিছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পটভূমি ছিল ঘানার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশ। যে কোন দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সহ গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনগুলোর পিছনে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিশেষ অবদান থাকে। কারণ তাদের নেতৃত্বেই আন্দোলন সফল হয়। তেমনি ঘানার মধ্যবিত্ত শ্রেণির সকল নেতৃত্বে প্যান আফ্রিকান আন্দোলন সফল হয়। ঘানায় ব্রিটিশ শাসন প্রচলিত ছিল। ঘানার ত্রিশটি ঔপনিবেশিক সরকার, নিজেদের প্রয়োজনেই এখানে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ঘানা অধিবাসীদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়। ফলে ঘানার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ সম্পর্কে অবহিত হয় এবং তারা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। তাছাড়া আমেরিকায় বসবাস করতো ঘানা বাসীরাও আন্দোলন শুরু করে যার নেতৃত্ব দেন ড. নক্রুমা। এদের আন্দোলনই প্যান আফ্রিকান আন্দোলন নামে খ্যাত ৷
৯. আমেরিকার দাসপ্রথা বিলুপ্তি : দাসত্ব প্রথার উদ্ভাবক ইউরোপীয়রা হলেও এ প্রথার অবসান করে ইউরোপীয়রাই। তবে প্যান আফ্রিকান আন্দোলনের পশ্চাতে আমেরিকার দাসত্ব প্রথা বিলুপ্তির বিশেষ ভূমিকা ছিল। কারণ যাদেরকে আফ্রিকা থেকে ধরে নিয়ে আমেরিকার দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল; তারা ১৮৬৫ সালের দাসপ্রথা বিলুপ্তি আইনে মুক্ত মানুষে পরিণত হয়। ফলে তারা আমেরিকার নাগরিকের মর্যাদা লাভ করে এবং এরাই আফ্রো আমেরিকান নামে পরিচিত। এ আফ্রো-আমেরিকানগণ আফ্রিকার উপনিবেশবাদের অবসানের জন্য বিদেশের মাটিতে যে আন্দোলন করে তাই প্যান আফ্রিকান আন্দোলন নামে খ্যাত।
মূল্যায়ন : প্যান আফ্রিকান আন্দোলন ছিল আফ্রো-আমেরিকান ও স্থানীয় আফ্রিকানদের নিয়ে গড়ে উঠা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। এ আন্দোলনের উদ্ভব হয় বর্ণবাদের শিকার থেকে এবং ঔপনিবেশিক শোষণ প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে। আফ্রিকানরা মানুষ হয়েও শুধু কালো বর্ণের হওয়ার কারণে দাস হিসেবে আমেরিকায় বিক্রি হতো এবং তারা অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতো। বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তারা মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা পেলেও শ্বেতাঙ্গ সমাজ তাদের গ্রহণ করে নি, বরং তাদেরকে কালো বলে গালি দিত এবং নীচ মনে করে ঘৃণা করতো। এ বর্ণ বৈষম্যের শিকার হয়ে এক সময় আফ্রিকানরা সচেতন হয়ে উঠে এবং তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য প্যান আফ্রিকান আন্দোলন গড়ে তোলে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, প্যান আফ্রিকান আন্দোলন ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং এটা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সহায়ক অংশ হিসেবে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। কারণ এ আন্দোলনে শুধু আফ্রিকানরাই অংশগ্রহণ করে নি, বরং আফ্রো-আমেরিকান সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করে এবং নেতৃত্ব তারাই দেয়। ফলে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছিল। তবে এ আন্দোলনের ভিত্তি রচিত হয়েছিল বর্ণবাদের শিকড় হতে এবং শেষ পর্যন্ত বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে আফ্রিকানরা তাদের স্বাধীনতা অর্জন করে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]