জাতীয়তাবাদ কাকে বলে? জাতীয়তাবাদের উপাদানসমূহ আলোচনা কর ।

জাতীয়তাবাদ কী? জাতীয়তাবাদ বিকাশের উৎসসমূহ বিশ্লেষণ কর ।
এটাকে এখন আধুনিক বিশ্বের রাজনীতির একটি প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি বললেও খুব বেশি ভুল হবে না। নতুন এর উত্তর ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ আধুনিককালে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আদর্শ বলে পরিগণিত হয়েছে।
আদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এ বিপ্লবের ফলেই জাতীয়তাবাদের ধারণা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় এবং একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রখ্যাত লেখক হ্যান্স কোন তাই যথার্থই বলেছেন যে, “ফরাসি বিপ্লবের অনুপ্রেরণার ফলেই ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে জাতি তথা জাতীয়তাবাদের ধারণা বিকশিত হয়।”
জাতীয়তাবাদ : জাতীয়তাবাদ মূলত ইউরোপীয় ধারা। মতাদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদের জন্ম কবে এ অনুসন্ধানী গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রশ্ন মাথায় রেখেও নির্দ্বিধায় বলা যায়, আধুনিক বিশ্বের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকেই জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব। জাতীয় স্বার্থের পক্ষে পরাধীন দেশগুলোতে মানুষের লড়াই ও জীবন বিসর্জন এবং বিশ শতকে বড় বড় দুটি বিশ্বযুদ্ধও হয়েছিল জাতীয় রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। ব্যাপক মাত্রায় জাতীয়তাবাদী চেতনা পৃথিবীব্যাপী বিস্তারের ফলে ৬০ ও ৭০ এর দশক পর্যন্ত পৃথিবীর মানচিত্রে পরাধীন প্রায় শতাধিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ফলে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের মন্ত্র জাতীয়তাবাদকে কেউ কেউ রাষ্ট্রধর্ম বলেও বর্ণনা করেছেন। সুতরাং রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ এক ব্যাপক স্থান দখল করে রেখেছে।
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত সংজ্ঞা বা উক্তি : প্রত্যেক জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার থাকা উচিত এ স্লোগানকে ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। জাতীয়তাবাদ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে একটি সংঘবন্ধ জনগোষ্ঠীর সার্বভৌম ক্ষমতার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো রাজনৈতিক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। কেউ কেউ মনে করেন যে, জাতীয়তাবাদের সর্বসম্মত সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব নয়। তবুও জাতীয়তাবাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকেই ঐক্যবোধ বা হ্যান্স কোন এর ভাষায় 'A state of mind' এর উপর জোর দেন।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন ঐতিহাসিক জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী C. J. H. Hayes জাতীয়তাবাদকে ‘জাতীয়তা' ও 'দেশপ্রেম' দুটি পুরানো ভাবের আধুনিক অনুভূতিপ্রবণ সংমিশ্রণ ও অতিরঞ্জন বলে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ "A modern emotional fusion and exaggeration of two very old phenomena of nationality and patriotism."
হ্যান্স কোন বলেছেন, "Nationalism first and foremost a state of mind act of consciousness." অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ মূলত এক মানসিক অবস্থার চেতনা ক্রিয়া ।
অধ্যাপক লাস্কির কথায়, “জাতীয়তাবাদ সাধারণভাবে এক ধরনের মানসিকতা। এটি দু'ধারায় পরিপুষ্ট। একটি পুরানো স্মৃতি সম্পদ এবং অন্যটি পরস্পরের একত্রে বসবাস করার সঙ্গতি।”
অধ্যাপক স্নাইডারের মতে, “জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের এক বিশেষ পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার ফলাফল। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসাধারণের মানসিকতা, অনুভূতি ও চিন্তাচেতনার ফল ।”
উপরের বর্ণিত জাতীয়তাবাদের ধারণা বা সংজ্ঞাসমূহ থেকে বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদ এক ধরনের চেতনা। যে
চেতনার ফলে কোন মানুষ বা জনগোষ্ঠী নিজেকে কোন জাতির অন্তর্ভুক্ত জ্ঞান করে। সেই জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিকাশ, অগ্রগতি, ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদির সাথে একাত্মবোধ করে এবং সংশ্লিষ্ট জাতির ঐহিত্য, মূল্যবোধ, স্বকীয়তা রক্ষা ও বিকাশে বিশ্বাসী হওয়ার মধ্য দিয়ে নিজে একত্রিত হয়ে এ মহামিলনের আনন্দে শামিল হয়। এ লড়াইয়ের দুটি দিক রয়েছে। ১. সামাজিক এবং ২. রাজনৈতিক। সামাজিক দিক থেকে উদ্বৃত্ত জনগোষ্ঠী পৃথক মনে করে এবং একসাথে এ জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক দিক থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠে। দেশপ্রেম এবং দেশাত্মবোধ যে জাতীয়তার প্রধান স্তম্ভ তা জাতীয় রাষ্ট্রীয় গঠনের মাধ্যমে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছায় ।
জাতীয়তাবাদের উপাদান : জাতীয়তাবাদ কি তা বুঝার জন্য জাতীয়তাবাদের উপাদান সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। কোন সমাজে জাতীয়তার চেতনা দানা বাঁধার পিছনে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ভূমিকা পালন করে। যা মূলত জাতীয়তাবাদের উপাদান। তবে নিম্নলিখিত উপাদানগুলো একটি জনসমষ্টিকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষভাবে
সাহায্য করে :
১. ভৌগোলিক অখণ্ডতা বা ঐক্য : জাতীয়তাবাদের প্রথম ও প্রধান উপাদান হলো ভৌগোলিক একতা। জাতি গঠন করতে হলে কোন জনসমষ্টিকে একটি নির্দিষ্ট ও সংলগ্ন ভূখণ্ডে বসবাস করতে হবে।
২. বংশগত ঐক্য : বংশগত ঐক্য জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। এটা মানুষের মধ্যে এমন একপ্রকার সুদৃঢ়, ঐক্যভাব গড়ে তোলে যা জাতি গঠনে অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। কিন্তু আধুনিক নৃতত্ত্ববিদগণ এটাকে অপরিহার্য উপাদান বলে মনে করেন না। কারণ হল্যান্ড, ইংরেজ, জার্মান জাতি একই বংশ হতে উদ্ভূত হয়েও একই জাতীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয় নি। আবার U.S.A বহু বংশের লোকের বসবাস সত্ত্বেও তারা একই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ।
৩. ধর্মীয় ঐক্য : এটা জাতীয়তাবাদের অপর একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। জাতীয়তাবাদের ধারণার সৃষ্টি এবং তা জোরদার করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় একতা একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে কাজ করে। এটা জাতীয়তাবোধের সৃষ্টির এক মহান সূত্র এবং এর উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বহু জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে।
৪. ভাষা ও সাহিত্যগত ঐক্য : ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে ভাবের আদানপ্রদান হয়। এ আদানপ্রদানই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রভূত উপায়। এছাড়া জাতি গঠনের জন্য এটা একান্তভাবে আবশ্যক নয়। বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠতে দেখা যায়। সুইজারল্যান্ডের জনগণ বিভিন্ন ভাষায় কথা বললেও তারা একই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ । আবার ইংরেজ ও আমেরিকা একই ভাষা ব্যবহার করলেও তারা দুটি ভিন্ন জাতি।
৫. অর্থনৈতিক একতা : জনগণকে জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত করে অর্থনৈতিক একতা। অর্থনৈতিক দিক হতে যখন জনগণের মধ্যে ক্ষমতা বিরাজ করে, তখন তারা একত্রে বসবাস করার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়। সব জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ যখন এক ও অভিন্ন হয়, তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বন্ধন সুদৃঢ় হয়ে উঠে।
৬. ভাবগত ঐক্য : জাতীয়তাবোধ গঠনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ভাবগত ঐক্য। এটা ব্যতীত জাতি গঠনের অপরাপর উপাদানসমূহ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ তাদের ছাড়াও একটি জাতি গড়ে উঠতে পারে। জাতীয় ঐক্য মূলত ভাবগত। Prof. Spengler বলেছেন, “জাতীয়তাবাদের উপাদান কুলগত বা ভাষাগত ঐক্য নয় বরং তা ভাবগত ঐক্য।"
৭. একক শাসনব্যবস্থা : এটা জাতীয়তাবাদ গঠনের অপর একটি উপাদান। একই শাসন ব্যবস্থার অধীনে দীর্ঘদিন থাকলে স্বভাবতই জনগণের মধ্যে জাতি গঠনের স্পৃহা দেখা দেয় এবং তারা জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের সৃষ্টি। সবদেশে একই ধরনের উপাদান এবং একইভাবে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হয়েছে তা মনে করার কোন কারণ নেই। জোর করে কৃত্রিম উপায়ে পরিকল্পনা করে কোন জাতি সৃষ্টি করা যায় না। মানব প্রবৃত্তির মধ্যেই জাতীয়তাবাদের চেতনা দেখা যায়। মানুষ তার পরিচিত নিজ পরিবেশের প্রতি আকর্ষণবোধ করে। তার সাথে একাত্ম হয়, ভালোবাসে। তাই যে কোন উপাদান নিয়ে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠতে পারে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]