আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে অভ্যন্তরীণ কারণগুলো কী কী এবং বিভিন্ন পর্যায় লিখ।

উত্তরা ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা বা অনুভূতি; যে অনুভূতি নির্দিষ্ট কোন জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে এবং জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর করে তোলে। জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে ইউরোপে পঞ্চদশ শতকে রেনেসাঁর মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য ঔপনিবেশিক দেশসমূহে এর প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। কারণ যেখানে অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণ প্রক্রিয়া চলে সেখানেই জাতীয়তাবাদ উঠে। আফ্রিকা মহাদেশকে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ দখল করে নিয়ে সেখানে ঔপনিবেশিক শাসন চালু করে এবং শোষণ নির্যাতন শুরু করে। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আফ্রিকানরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলে।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে অভ্যন্তরীণ কারণ/উপায় : ঔপনিবেশিক শাসন যুগে আফ্রিকান _জাতীয়তাবাদ বিকশিত হওয়ার পশ্চাতে শুধু বাহ্যিক কারণই নিহিত ছিল না। এর পশ্চাতে কতিপয় অভ্যন্তরীণ উপাদান
সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. মিশনারি শিক্ষার প্রভাব : আফ্রিকায় প্রথম আসে ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিরা এবং ধর্ম প্রচারই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তবে ধর্ম প্রচারের স্বার্থেই তারা আফ্রিকায় প্রথম মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এবং এ স্কুলে আফ্রিকানরা শিক্ষালাভ করে আধুনিক বিশ্বের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। এ মিশনারি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আফ্রিকানরা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম কথা বলে যা জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রথম পদক্ষেপ।
২. গোত্রতন্ত্র : গোত্রতন্ত্রকে বলা হয় আফ্রিকায় জাতীয় সংহতি অর্জনের পথে প্রধান বাধা। তাই স্বাভাবিকভাবে এটা জাতীয়তাবাদের পথেও বাধা হওয়ার কথা। কিন্তু কতিপয় ঐতিহাসিক বলেছেন, গোত্রতন্ত্র আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়তা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, Richard L. Sklar এর মন্তব্য ধরা যাক। তিনি বলেছেন, “একটা পর্যায় পর্যন্ত গোত্রতন্ত্র জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভূমিকা রেখেছে।” যেমন- নাইজেরিয়ার ইউরোবা গোত্র। তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, এটা বড় গোত্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ছোট গোত্রের ক্ষেত্রে নয়।
৩. ইসলাম ধর্ম : আফি, জাতীয়তাবাদ বিকাশে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ইসলাম ধর্ম। খ্রিস্টধর্ম যদিও মানবতার কথা বলে, তবে এখানে বর্ণবাদ প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মে বর্ণবাদের কোন স্থান নেই। এখানে সব মানুষের সমান অধিকার। তাই আফ্রিকান নিগ্রোদের জন্য এটি একটি গ্রহণযোগ্য ধর্ম ছিল যা জাতীয়তাবাদ বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছে। এ সম্পর্কে এডওয়ার্ড ব্লাইডেন মন্তব্য করেছেন যে, “ইসলাম ধর্ম আফ্রিকানদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করেছে যা জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের পূর্বশর্ত।”
2
৪. রাজনৈতিক সংগঠন : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উদ্ভব হয়েছে বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে। কিন্তু তা বিকশিত হয়েছে আফ্রিকার বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে। যেমন- National Congress of British West Africa, ঘানা (১৯১৮) ও West African Student Union এই দুটি সংগঠন পশ্চিম আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া African National Congress বা ANC ১৯১২ সালে গঠিত হয় এবং সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
৫. ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিবাচক প্রভাব : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিবাচক প্রভাব। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর আফ্রিকায় নেতিবাচক প্রভাবের পথে কিছু ইতিবাচক প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়। যেমন- পাশ্চাত্য শিক্ষা, শাসনকার্যে আফ্রিকানদের নিযুক্ত, একই শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের জোর করে নিয়োগ, গোত্রীয় শাসন বিলুপ্তি প্রভৃতি। এসব ইতিবাচক প্রভাব আফ্রিকার ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের পর্যায় : আফ্রিকায় যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল তা তিনটি পর্যায় পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করেছিল। যেমন-
১. সচেতনতার পর্যায়,
২. প্রস্তুতির পর্যায় ও
৩. চূড়ান্ত পর্যায়

নিম্নে এ তিনটি পর্যায় সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. সচেতনতার পর্যায় : আফ্রিকা ছিল পৃথিবীর অন্যান্য দেশ হতে বিচ্ছিন্ন এবং এখানে আধুনিক যুগের কোন বৈশিষ্ট্য ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হওয়ার পর আফ্রিকানরা আধুনিক যুগের মধ্যে প্রবেশ করে এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি পায়। এ আত্মসচেতনতা থেকে তারা ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ সম্পর্কে অবহিত হয় যা তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। ফলে এ ঔপনিবেশিক শাসনের যুগ থেকে সচেতনতার পর্যায় চিহ্নিতকরণ হয় এবং তা স্থায়ী ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী অধ্যায় পর্যন্ত। এ সময় তারা ইউরোপীয় শক্তিবর্গের শাসন ও শোষণ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে সচেতনতার শেষ পর্যায় পৌঁছে যা তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম দেয় ।
২. প্রস্তুতির পর্যায় : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এবং তা স্থায়ী ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত। অর্থাৎ এই দু' বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় আফ্রিকানরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং এর মাধ্যমে তারা তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পর্যায় আফ্রিকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্ভব হয় যা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য প্রস্তুত হয়। যেমন- ১৯১২ সালে গঠিত হয় ANC বা African National Congress.
৩. চূড়ান্ত পর্যায় : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ঔপনিবেশিক রাজ্য ধরে রাখার সামর্থ্য হারায়। এ সুযোগ গ্রহণ করে আফ্রিকানরা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এ পর্যায় সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় বলা হয়। কারণ এর ফলে আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে এবং আফ্রিকা মহাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। তাই আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত পর্যায় ধরা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অর্থাৎ ১৯৪৫ পরবর্তী থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে। কারণ ১৯৬০ সালে ১৩টি আফ্রিকান দেশ স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের সমাপ্তি হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হওয়ার পর আফ্রিকার জনগণ আধুনিক যুগে পদার্পণ করে এবং তারা নিজেদের সম্পর্কে জানতে পারে। এদিকে ঔপনিবেশিক শাসনের কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে আফ্রিকানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। এ জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও সফল করার ক্ষেত্রে আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ উপাদানসমূহ বিশেষভাবে দায়ী ছিল। এ জাতীয়তাবাদ বিকাশ তিন পর্যায় শেষ হয় এবং আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ সফল হয়।

জাতীয়তাবাদ বিকাশের বহিস্থ বা বাহ্যিক উপাদানসমূহ লিখ ।
অথবা, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উদ্ভব ও বিকাশে বাহ্যিক উপাদানসমূহ কী ভূমিকা রেখেছিল লিখ অথবা, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে বাহ্যিক মাধ্যমগুলো বিশ্লেষণ কর ।


উত্তর ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা বা অনুভূতি যা রাজনৈতিক দিক হিসেবে বিবেচিত । জাতি থেকেই জাতীয়তাবাদের উদ্ভব। জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি জাতি হলো রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ একদল মানুষ যাদের আছে রাজনৈতিক উৎসাহ উদ্দীপনা, যাদের একই রকম ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে, আছে অভিন্ন সাংস্কৃতিক যোগ এবং সাধারণত যারা একই ভৌগোলিক অখণ্ড অঞ্চলে বসবাস করে। এ অর্থে জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি ঐক্যবদ্ধ মানুষের চেতনা যারা একটি জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে। এ সম্পর্কে 'Essays on Nationalism' গ্রন্থে JH. Hayes বলেছেন, "Nationalism consists of modern emotional fusion and exaggeration of two very pehnomena_nationality and patriotism." পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশভিত্তিক ও অঞ্চলভিত্তিক। সেক্ষেত্রে আফ্রিকায় যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে তা মূলত আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ ।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের বহিস্থ বা বাহ্যিক উপাদান : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পিছনে দুটি উপাদান কাজ করেছে। যথা :
i. বাহ্যিক বা বহিস্থ উপাদান ও
ii. অভ্যন্তরীণ উপাদান।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে বহিস্থ উপাদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দিয়া আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে বহিস্থ উপাদানসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র : আফ্রিকানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে অঞ্চলভিতি ও সময়ভিত্তিক। অর্থাৎ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে। কারণ ইউরোপীয় বিভিন্ন শক্তি আফ্রিকায় ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল দখল করে সেখানে তাদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। ফলে এ শাসন চরিত্রের উপর আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। যেমন- ব্রিটিশ শাসিত আফ্রিকায় বর জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকশিত হয়। কিন্তু ফ্রান্স কিংবা বেলজিয়ামের আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয় দেরিতে।
২. আফ্রো-আমেরিকানদের অবদান : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেছেন আফ্রো-আমেরিকান নেতৃবৃন্দ। এ আফ্রো-আমেরিকান হচ্ছে আমেরিকায় বসবাসরত দাস শ্রেণির বংশধর। অর্থাৎ যেসব আফ্রিকানদের দাস হিসেবে আমেরিকায় বিক্রি করা হয়েছিল, তারা কিংবা তাদের বংশধর পরবর্তীতে দাসত্ব প্রধা হতে মুক্তি পেয়েছিল ১৮৬৫ সালের পর থেকে। এরা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে আফ্রিকায় ফিরে এসে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জজ প্যাডমোর, ডুবয়, মার্কাস গার্ভে, সিলভেস্টার প্রমুখ। এগুলোর রাইডেনের মতে, “প্রত্যেক জাতিকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে হলে তাকে জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে।”
৩. পশ্চিম আফ্রিকার জাতীয় নেতৃবৃন্দের অভিজ্ঞতা : আফ্রিকায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করা হলে বহু আফ্রিকান পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় যান। কিন্তু তারা এখানে এসে বর্ণবাদের শিকার হন। ফলে তাদের মনে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের শাসন ও শোষণ সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় এবং এ অভিজ্ঞতা থেকেই তাদের মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে ।
৪. দুই মহাযুদ্ধের প্রভাব : ইউরোপে অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি মহাযুদ্ধ বা বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ দুটি মহাযুদ্ধেই আফ্রো-এশিয়ানদের সৈনিক হিসেবে পাঠানো হয়। এসব সৈন্যরা যুদ্ধে থাকাকালে ইউরোপীয়দের কাছ থেকে যে আচরণ পেয়েছে, যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তার ঠিক উল্টো আচরণ পেয়েছে। ফলে এসব যুদ্ধ ফেরত সৈন্যদের মাঝে হতাশা ক্ষোভ দেখা দেয় এবং তারা ইউরোপীয় শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
৫. প্যান আফ্রিকানিজম : প্যান আফ্রিকানিজম হচ্ছে সারা বিশ্বে কালোদের নিয়ে গঠিত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় যেসব কালো আফ্রিকানরা বসবাস করতো তাদের নিয়ে একটি সংগঠন করে এবং এর মাধ্যমে শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ আন্দোলন জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ আন্দোলনের বক্তব্য ছিল, “আমরা কালো আফ্রিকার জন্য স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা দাবি করছি। আমরা যুদ্ধ করব, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য।”
৬. বিদেশি আদর্শের প্রভাব : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে অন্যতম প্রভাব ফেলেছে কতিপয় বিদেশি আদর্শ। এ বিদেশি আদর্শগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : নিম্নে এ আদর্শগত প্রভাব বিশ্লেষণ করা হলো :
ক. অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও খ. মার্কসবাদ ।
ক. অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের অন্যতম বহিস্থ উপাদান হচ্ছে অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এ অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ হচ্ছে যেসব দেশ উপনিবেশবাদের শিকার তাদের অঞ্চলে সংঘটিত জাতীয়তাবাদ। এ আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। যেমন- ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা মহাত্মা গান্ধীর সাথে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী নেতা ড. নক্রুমা ও মার্কাস গার্ডের বিশেষ যোগাযোগ ছিল এবং তারা একে অপরের দেশের জাতীয়তাবাদ আদানপ্রদান করতো। এতে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ দ্রুত বিস্তার লাভ করে ।
খ. মার্কসবাদ : মার্কসবাদ হচ্ছে সমাজতন্ত্র এবং এ সমাজতন্ত্র ইউরোপের দেশ রাশিয়ায় উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে পরে রাশিয়া সমগ্র বিশ্বে তা ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে এবং প্রায় সফলও হয়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ সরকার ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলে ত বিলোপের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান করে। আফ্রিকান অনেক ছাত্র রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য যায় এব তারা সমাজতন্ত্রের ধারণা নিয়ে আফ্রিকায় ফিরে এসে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে যা পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ নেয় ।
৭. বহির্বিশ্বের ঘটনাবলির প্রভাব : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে বহির্বিশ্বের ঘটে যাওয়া কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে । নিম্নে এগুলো উল্লেখ করা হলো :
ক. আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৬) : বিশ্বে প্রথম ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয় আমেরিকা। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্ববাসীর কাছে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। কারণ তাদের এ স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন বিভিন্ন ঔপনিবেশিক জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বিশেষকরে আফ্রিকান জনগণের কাছে এ যুদ্ধ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
খ. ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে ১৭৮৯ সালে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লব
কারণ ফরাসি বিপ্লব ছিল স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এ আন্দোলনের মূল স্লোগান ছিল স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি আদর্শ । এ আদর্শগুলো জাতীয়তাবাদের ভিত্তি যা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে।
গ. রুশ-জাপান যুদ্ধ (১৯০৪-০৫) : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরেকটি ঘটনা বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে, সেটা হচ্ছে ১৯০৪-০৫ সালে সংঘটিত রুশ-জাপান যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে পরাশক্তি রাশিয়ার পরাজয়। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শক্তি রাশিয়া এশিয়ান ক্ষুদ্র দেশ জাপানের কাছে পরাজিত হয়। রাশিয়ার এ পরাজয় আফ্রিকার ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উৎসাহ যুগিয়েছিল ।
ঘ. রুশ বিপ্লব (১৯১৭) : ১৯১৭ সালে রাশিয়ার জনগণ স্বৈরাচারী জার শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জার শাসনের পতন ঘটিয়ে সেখানে সমাজতন্ত্র কায়েম করে যা রুশ বিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লব নামে পরিচিত। এ বিপ্লব ঔপনিবেশিক শাসনের বিপক্ষে কথা বলে বিধায় আফ্রিকান জনগণ তা দ্বারা প্রভাবিত হয়।
৮. জাতিসংঘের ভূমিকা : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উদ্ভব হয় কতিপয় উপাদানের মাধ্যমে, বিকশিত হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে এবং পরিপূর্ণতা পায় জাতিসংঘের হাত ধরে। কেননা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সময় এর সনদের ৭৩ ও ৭৬(খ) অনুচ্ছেদে সংযুক্ত করা হয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংক্রান্ত প্রস্তাব যা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে উৎসাহিত করে এবং জাতীয়তাবাদ বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া জাতিসংঘের একটি দল আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে সমর্থন ও সাহায্য করেছিল।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর আফ্রিকান জনগণ আধুনিক জগতে প্রবেশ শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে তারা জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে থাকে। তাদের এ জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগ্রত ও বিকশিত করার পিছনে উপর্যুক্ত বাহ্যিক উপাদানসমূহ বিশেষভাবে দায়ী ছিল। এসব উপাদানের সমন্বয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে এবং এর প্রেক্ষাপটে সেখানে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়। ফলে ১৯৬০ এর দশকে একযোগে ১৩টি দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]