আফ্রিকান জাতাবাদ বিকাশের কারণসমূহ লিখ।


অথবা, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের উপাদানসমূহ বিশ্লেষণ কর।
উত্তরা ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা। একপ্রকার মানবিক প্রবৃত্তি এবং ভাব প্রবণতা থেকে জাতীয়তাবাদ সৃষ্ট। এটি মূলত একত্রিত হওয়ার এবং একত্রে বসবাস করার মানসিক প্রবণতা। এটা জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই মূর্ত হয়ে উঠে। কিন্তু আফ্রিকার ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম ঘটেছে। কারণ আফ্রিকা ছিল বহুগোত্র বিভাজিত সমাজকাঠামো এবং ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আফ্রিকায় শাসন ও শোষণ চলতে থাকে। অন্যদিকে, পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। ফলে আফ্রিকার জনগণের মধ্যে একই ভাবগত মিল ও ভাবের আদানপ্রদান শুরু হয় যা জাতীয়তাবাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অবশেষে আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য জাতীয়তাবাদ হতে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। তাই এটাকে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের কারণ : পৃথিবীর যেখানেই জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে, সেখানেই কোন না কোন কারণ নিহিত ছিল। অর্থাৎ কারণ ছাড়া জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠা সম্ভব নয়। ঠিক আফ্রিকার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। অর্থাৎ আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠার পশ্চাতে কতিপয় কারণ নিহিত ছিল। নিম্নে এ কারণগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. পাশ্চাত্য ভাষার প্রভাব : ভাষা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। এটি আফ্রিকানদের জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এ ভাষা হচ্ছে পাশ্চাত্য ভাষা যাকে একটি অভিন্ন ভাষা হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল। কারণ ঔপনিবেশিক শাসকবর্গ তাদের নিজ স্বার্থেই পাশ্চাত্য ভাষা প্রচলন করে এবং এ ভাষা আফ্রিকানরা শিখে নিজেদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান শুরু করে। ফলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে ।
২. খেলাধুলা : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে খেলাধুলা একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ঔপনিবেশিক শাসকবর্গ বিভিন্ন সময়ে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এবং এ খেলাধুলার মধ্যে ফুটবল, ক্রিকেট ছিল উল্লেখযোগ্য। এসব খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে, বিভিন্ন আফ্রিকানরা একস্থানে মিলিত হয়ে তাদের ভাবের আদানপ্রদান করে। ফলে তা পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়তা করে।
৩. ঔপনিবেশিক প্রশাসনের প্রভাব : ইউরোপীয় শক্তিবর্গ আফ্রিকান উপনিবেশ স্থাপনের পর সেখানে তাদের নিজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু এ প্রশাসনিক যন্ত্র চালাতে হলে প্রচুর জনশক্তির দরকার, যা ইউরোপ থেকে আমদানি সম্ভব নয়। ফলে ইউরোপীয়রা বাধ্য হয়ে স্থানীয় আফ্রিকানদের প্রশাসনে যুক্ত করে। এর ফলে আফ্রিকানরা প্রশাসনিক কর্মকর্তা সম্পর্কে অবহিত হয় এবং ইউরোপীয় শাসন ও শোষণ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। এতে তাদের মনে নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার মানসে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে।
৪. ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র : আফ্রিকানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে অঞ্চল ভিত্তিক ও সময় ভিত্তিক। অর্থাৎ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে। কারণ ইউরোপীয় বিভিন্ন শক্তি আফ্রিকার ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল দখল করে সেখানে তাদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। ফলে এ শাসন চরিত্রের উপর আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। যেমন- ব্রিটিশ শাসিত আফ্রিকায় দ্রুত জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকশিত হয় । কিন্তু ফ্রান্স কিংবা বেলজিয়ামের আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয় দেরিতে।
৫. আফ্রো-আমেরিকানদের অবদান : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান, পালন করেছেন আফ্রো-আমেরিকান নেতৃবৃন্দ। এ আফ্রো-আমেরিকান হচ্ছে আমেরিকায় বসবাসরত দাস শ্রেণির বংশধর। অর্থাৎ যেসব আফ্রিকানদের দাস হিসেবে আমেরিকায় বিক্রি করা হয়েছিল তারা কিংবা তাদের বংশধর পরবর্তীতে দাসত্ব প্রথা হতে মুক্তি পেয়েছিল ১৮৬৫ সালের পর থেকে। এরা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে আফ্রিকায় ফিরে এসে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জজ প্যাডমোর, ডুবয়, মার্কাস গার্ভে, সিলভেস্টার প্রমুখ। এডওয়ার্ড ব ইিডেনের মতে, “প্রত্যেক জাতিকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে হলে তাকে জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে।”
৬. পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত নেতৃবৃন্দের অভিজ্ঞতা : আফ্রিকায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করা হলে বহু আফ্রিকা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় যান। কিন্তু তারা এখানে এসে বর্ণবাদের শিক্ষার হন। ফলে তাদের মনে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের শাসন ও শোষণ সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় এবং এ অভিজ্ঞতা থেকেই
তাদের মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।
৭. দুই মহাযুদ্ধের প্রভাব : ইউরোপে অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি মহাযুদ্ধ বা বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ দুটি মহাযুদ্ধেই আফ্রো-এশিয়ানদের সৈনিক হিসেবে পাঠানো হয়। এসব সৈন্যরা যুদ্ধে থাকাকালে ইউরোপীয়দের কাছ থেকে যে আচর পেয়েছে, যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তার ঠিক উল্টো আচরণ পেয়েছে। ফলে এসব যুদ্ধ ফেরত সৈন্যদের মাঝে হতাশা ও
ক্ষোভ দেখা দেয় এবং তারা ইউরোপীয় শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
৮. প্যান আফ্রিকানিজম : প্যান আফ্রিকানিজম হচ্ছে সারা বিশ্বে কালোদের নিয়ে গঠিত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। অর্থাত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষকরে ইউরোপ ও আমেরিকায় যেসব কালো আফ্রিকানরা বসবাস করত তাদের নিয়ে একটি সংগঠন করে এবং এর মাধ্যমে শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ আন্দোলন জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ আন্দোলনের বক্তব্য ছিল, “আমরা কালো আফ্রিকার জন্য স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা পাঠি করছি। আমরা যুদ্ধ করব গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য।”
৯. খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা : আফ্রিকায় প্রথম আসে ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিরা এবং ধর্ম প্রচারই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তবে ধর্ম প্রচারের স্বার্থেই তারা আফ্রিকায় প্রথম মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এবং এ স্কুলে আফ্রিকানরা শিক্ষা লাভ করে আধুনিক বিশ্বের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। এ মিশনারি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আফ্রিকানর
ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম কথা বলে যা জাতীয়তাবাদের প্রথম পদক্ষেপ।
১০. গোত্রতন্ত্র : গোত্রতন্ত্রকে বলা হয় আফ্রিকার জাতীয় সংহতি অর্জনের পথে প্রধান বাধা। তাই স্বাভাবিকভাবে এটা জাতীয়তাবাদের পথেও বাধা হওয়ার কথা। কিন্তু কতিপয় ঐতিহাসিক বলেছেন, গোত্রতন্ত্র আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়তা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, Richard L. Sklar এর মন্তব্য ধরা যায়। তিনি বলেছেন যে, একটা পর্যন্ত পর্যন্ত গোত্রতন্ত্র জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। যেমন- নাইজেরিয়ার ইউরোবা গোত্র। তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, “এটা বড় গোত্রের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য, ছোট গোত্রের ক্ষেত্রে নয়।”
১১. ইসলাম ধর্ম : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে ইসলাম ধর্ম। খ্রিস্টধর্ম যদিও মানবতার কথা বলে, তবে এখানে বর্ণবাদকে প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মে বর্ণবাদের কোন স্থান নেই । এখানে সব মানুষের সমান অধিকার। তাই আফ্রিকান কালোদের জন্য এটি একটি গ্রহণযোগ্য ধর্ম ছিল যা জাতীয়তাবাদ বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছে। এ সম্পর্কে এডওয়ার্ড বাইডেন মন্তব্য করেছেন যে, “ইসলাম ধর্ম আফ্রিকানদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করেছে যা জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের পূর্বশর্ত।”
১২. রাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকা : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উদ্ভব হয়েছে বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে কিন্তু তা বিকশিত হয়েছে আফ্রিকার বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে। যেমন- National Congress of British West Africa, ঘানা (১৯১৮) ও West African Student Union। এ দুটি সংগঠন পশ্চিম আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
১৩. ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিবাচক প্রভাব : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিবাচক প্রভাব। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর আফ্রিকায় নেতিবাচক প্রভাবের সাথে কিছু ইতিবাচক প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়। যেমন— পাশ্চাত্য শিক্ষা, শাসনকার্যে আফ্রিকানদের নিযুক্ত, একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অঞ্চলের লোককে জোর করে নিয়োগ, গোত্রীয় শাসন বিলুপ্তি প্রভৃতি। এসব ইতিবাচক প্রভাব আফ্রিকার ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
১৪. জাতিসংঘের ভূমিকা : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উদ্ভব হয় কতিপয় উপাদানের মাধ্যমে, বিকশিত হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে এবং এর পরিপূর্ণতা পায় জাতিসংঘের হাত ধরে। কেননা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সময় এর সনদের ৭৩ ও ৭৬খ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত করা হয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংক্রান্ত প্রস্তাব যা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে উৎসাহিত করে এবং জাতীয়তাবাদ বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া জাতিসংঘের একটি দল আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের প্রতি সমর্থন ও সাহায্য করেছিল।

। দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে কী আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি হয়েছিল? আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে কী কী উপাদান অবদান রেখেছিল?


অথবা, দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালীন সময়ে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের উপর বিকাশ ও চর্চা লিখ। উত্তর ভূমিকা : জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক চেতনা। একপ্রকার মানসিক প্রবৃত্তি এবং ভাব প্রবণতা থেকে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি। এটি মূলত একত্রিত হওয়ার এবং একত্রে বসবাস করার মানসিক প্রবণতা। এটা জনগণের আশা- অন্যদিকে, আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই মূর্ত হয়ে উঠে। কিন্তু আফ্রিকার ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম ঘটেছে। কারণ আফ্রিকা ছিল বহুগোত্র বিভাজিত সমাজকাঠামো এবং ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আফ্রিকার শাসন ও শোষণ চলতে থাকে। পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। ফলে আফ্রিকার জনগণের মধ্যে একই ভাবগত মিল ও ভাবের আদানপ্রদান শুরু হয়, য জাতীয়তাবাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অবশেষে আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য জাতীয়তাবাদ হতে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। তাই এটাকে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়
দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালে জাতীয়তাবাদ : ১৯১৪ সালে একটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং তা শেষ হয় ১৯১৯ সালে। আবার ১৯৩৯ সালে একটি বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, যা শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। অর্থাৎ এ দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে সময়ের ব্যবধান মাত্র ২০ বছর এবং এ ২০বছর সময়কালকে বলা হয় দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময়। এ সময় আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের বিকাশ পর্ব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আফ্রিকানদের সৈনিক হিসেবে ইউরোপে পাঠানো হয় এবং যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা দেশে ফিরে আসে। দেশে ফিরে তারা ঔপনিবেশিক শাসকদের শোষণ সম্পর্কে অবহিত হয় এব ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়, যা জাতীয়তাবাদ উন্মেষের পথে প্রথম পদক্ষেপ। এরপর এ সময়ে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ বিকাশ হতে থাকে। কিন্তু এ সময় জাতীয়তাবাদ বিকাশ ধীরগতিতে চলতে থাকে। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চূড়ান্ত রূপ লাভ করে এবং অবশেষে বিজয় আসে। তাই বলা যায় যে, দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আফ্রিকান জাতীয়াতাবাদ গড়ে উঠে এবং তা ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করে। তবে এটা ধীরগতিতে বিকশিত হয়।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের উপাদানসমূহ : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ যেসব উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল সেগুলোকে মোটামুটিভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায় । যথা :
ক. অভ্যন্তরীণ উপাদান ও খ. বাহ্যিক উপাদান ।
নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো : ক. অভ্যন্তরীণ উপাদান : ঔপনিবেশিক শাসন যুগে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠার পশ্চাতে শুধু বাহ্যিক কারণই নিহিত ছিল না । এর পশ্চাতে কতিপয় অভ্যন্তরীণ উপাদান সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. মিশনারি শিক্ষার প্রভাব : আফ্রিকায় প্রথম আসে ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিরা এবং ধর্ম প্রচারই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তবে ধর্ম প্রচারের স্বার্থেই তারা আফ্রিকায় প্রথম মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এবং এ স্কুলে আফ্রিকান শিক্ষ লাভ করে আধুনিক বিশ্বের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। এ মিশনারি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আফ্রিকানরা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম কথা বলে, যা জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রথম পদক্ষেপ ।
২. গোত্রতন্ত্র : গোত্রতন্ত্রকে বলা হয় আফ্রিকার জাতীয় সংহতি অর্জনের পথে প্রধান বাধা। তাই স্বাভাবিকভাবে জাতীয়তাবাদের পথেও বাধা হওয়ার কথা। কিন্তু কতিপয় ঐতিহাসিক বলেছেন, গোত্রতন্ত্র আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়তা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, Richard L. Sklar এর মন্তব্য ধরা যাক। তিনি বলেছেন, “একটা পর্যায় পর্যন্ত। গোত্রতন্ত্র জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভূমিকা রেখেছে।” যেমন- নাইজেরিয়ার ইউরোবা গোত্র। তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, এটা বড় গোত্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ছোট গোত্রের ক্ষেত্রে নয় ।
ইসলাম ধর্ম : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে ইসলাম ধর্ম। খ্রিস্টানধর্ম যদিও মানবতার কথা বলে, তবে এখানে বর্ণবাদকে প্রশয় দেয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মে বর্ণবাদের কোন স্থান নেই। এখানে সব মানুষের সমান অধিকার। তাই আফ্রিকান কালোদের জন্য এটি একটি গ্রহণযোগ্য ধর্ম ছিল, যা জাতীয়তাবাদ বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছে। এ সম্পর্কে এডওয়ার্ড বাইডেন মন্তব্য করেছেন যে, “ইসলাম ধর্ম আফ্রিকানদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করেছে, যা জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের পূর্বশর্ত।
৪. রাজনৈতিক সংগঠন : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উদ্ভব হয়েছে বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে, কিন্তু তা বিকশিত হয়েছে আফ্রিকার বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে। যেমন- National Congress of British West Africa. ঘানা (১৯১৮) ও West African Student Union, এ দুটি সংগঠন পশ্চিম আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ।
৫. ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিবাচক দিক : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিবাচক প্রভাব। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর আফ্রিকায় নেতিবাচক প্রভাবের সাথে কিছু ইতিবাচক প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়। যেমন- পাশ্চাত্য শিক্ষা, শাসনকার্যে আফ্রিকানদের নিযুক্ত, একই শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অঞ্চলের লোককে জোর করে নিয়োগ, গোত্রীয় শাসন বিলুপ্তি প্রভৃতি। এসব ইতিবাচক প্রভাব আফ্রিকার ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে বহিস্থ বা বাহ্যিক উপাদান : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে বহিস্থ উপাদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নিম্নে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে বহিস্থ উপাদানসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র : আফ্রিকানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে অঞ্চলভিত্তিক ও সময়ভিত্তিক। অর্থাৎ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে। কারণ ইউরোপীয় বিভিন্ন শক্তি আফ্রিকায় ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল দখল করে সেখানে তাদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। ফলে এ শাসন চরিত্রের উপর আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। যেমন- ব্রিটিশ শাসিত আফ্রিকায় দ্রুত জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকশিত হয়। কিন্তু ফ্রান্স কিংবা বেলজিয়ামের আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয় দেরিতে।
২. আফ্রো-আমেরিকানদের অবদান : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেছেন আফ্রো আমেরিকান নেতৃবৃন্দ। এ আফ্রো আমেরিকান হচ্ছে আমেরিকায় বসবাসরত দাস শ্রেণির বংশধর। অর্থাৎ যেসব আফ্রিকানদের দাস হিসেবে আমেরিকায় বিক্রি করা হয়েছিল তারা, কিংবা তাদের বংশধর পরবর্তীতে দাসত্ব প্রথা হতে মুক্তি পেয়েছিল ১৮৬৫ সালের পর থেকে। এরা পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে উলেখযোগ্য ছিলেন জজ প্যাডমোর, ডুবয়, মার্কাস গার্ডে, সিলভেস্টার প্রমুখ। এডওয়ার্ড বাইডেনের মতে, “প্রত্যেক জাতিকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে হলে তাকে জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে।”
৩. পশ্চিম আফ্রিকায় জাতীয় নেতৃবৃন্দের অভিজ্ঞতা : আফ্রিকায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করা হলে বহু আফ্রিকান পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় যান। কিন্তু তারা এখানে এসে বর্ণবাদের শিকার হন। ফলে তাদের মনে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের শাসন ও শোষণ সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় এবং এ অভিজ্ঞতা থেকেই তাদের মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে <
৪. দুই মহাযুদ্ধের প্রভাব : ইউরোপে অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি মহাযুদ্ধ বা বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ দুটি মহাযুদ্ধেই আফ্রো এশিয়ানদের সৈনিক হিসেবে পাঠানো হয়। এসব সৈন্যরা যুদ্ধে থাকাকালে ইউরোপীয়দের কাছ থেকে যে আচরণ পেয়েছে, যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তার ঠিক উল্টো আচরণ পেয়েছে। ফলে এসব যুদ্ধ ফেরত সৈন্যদের মাঝে হতাশা এবং ক্ষোভ দেখা দেয় এবং তারা ইউরোপীয় শাসন শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
৫. প্যান আফ্রিকানিজম : প্যান আফ্রিকানিজম হচ্ছে সারাবিশ্বে কালোদের নিয়ে গঠিত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। অর্থাৎ
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষকরে ইউরোপ ও আমেরিকায় যেসব কালো আফ্রিকানরা বসবাস করতো তাদের নিয়ে সংগঠন করে এবং এর মাধ্যমে শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ আন্দোলন জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ আন্দোলনের বক্তব্য ছিল “আমরা কালো আফ্রিকার জন্য স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা দ করছি। আমরা যুদ্ধ করব, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য।”
৬. বিদেশি আদর্শের প্রভাব : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বিকাশে অন্যতম প্রভাব ফেলেছে কতিপয় বিদেশি আদর্শ। এ
বিদেশি আদর্শগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
নিম্নে এ আদর্শগত প্রভাব বিশেষণ করা হলো :
i. অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও ii. মাকর্সবাদ ।
i. অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ : আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের অন্যতম বহিস্থ উপাদান হচ্ছে অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এ অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ হচ্ছে যেসব দেশ উপনিবেশবাদের শিকার তাদের অঞ্চলে সংঘটি জাতীয়তাবাদ। এ আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ আফ্রিকান জাতীয়তাবাদকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। যেমন- ভারতীয় জাতীয়তাবাদ । ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা মহাত্মা গান্ধীর সাথে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী নেতা ড. নক্রুমা ও মার্কার গার্ভের বিশেষ যোগাযোগ ছিল এবং তারা একে অপরের দেশের জাতীয়তাবাদ আদানপ্রদান করতো। এতে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
ii. মার্কসবাদ : মার্কসবাদ হচ্ছে সমাজতন্ত্র এবং এ সমাজতন্ত্র ইউরোপের দেশ রাশিয়ায় উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে পরে রাশিয়া সমগ্র বিশ্বে তা ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে এবং প্রায় সফলও হয়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ সরকার ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলে তা বিলোপের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান করে । আফ্রিকান অনেক ছাত্র রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য যায় এবং তারা সমাজতন্ত্রের ধারণা নিয়ে আফ্রিকায় ফিরে এসে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ নেয় ৷
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র ধারায় গড়ে উঠেছে এবং এ জাতীয়তাবাদ হঠাৎ করে একদিনে একটি মাত্র কারণে উদ্ভব ও বিকাশ হয় নি। আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ উপর্যুক্ত উপাদানের সমন্বয়ে উদ্ভব ও বিকশিত হয়েছে এবং কোনটি ভূমিকা কারও চেয়ে কম নয়। অর্থাৎ প্রায় সব উপাদানই আফ্রিকান জাতীয়তাবাদে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তাইছে আফ্রিকান মহাদেশ আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]