সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ
ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত্যা করে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর পাঁচ
বৎসরব্যাপী রাজত্বকালে হুসেন শাহী বংশের অবসান ঘটে। বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই পাঁচ
বৎসর ছিল পরিবর্তনের যুগ। শের খান সুরের নেতৃত্বের আফগান শক্তি পুনরুত্থানের চাপে বাংলায় হুসেন
শাহী বংশের শাসনের এবং একই সাথে দীর্ঘ দুই শতবর্ষব্যাপী স্বাধীন সুলতানি আমলের অবসান ঘটে।
বিহারের হাজীপুরের শাসনকর্তা মখদুম আলমের বিদ্রোহ এই পতনের সূচনা করে। মখদুম আলম শের খান
সুরের সাহায্য পায়। গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ জালাল খান লোহানীর সাথে মিত্রতা স্থাপন করে মখদুম আলমকে
দমন করতে সচেষ্ট হন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের সম্মিলিত শক্তি শের খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৫৩৪
খ্রিস্টাব্দে সুরজগড়ের যুদ্ধে জালাল খানের পরাজয় শের খান সুরের পক্ষে বিহারের ভাগলপুর পর্যন্ত জয়ের
সুযোগ এনে দেয়।
এই বিজয়ের পথ ধরেই শের খান সুর গৌড় পর্যন্ত এসে উপস্থিত হন। দ্বিতীয় বার গৌড় আক্রমণ করে
১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল শের খান গৌড় অধিকার করেন। মাহমুদ বিহারের হাজীপুরে পলায়ন করে
হুমায়ূনের সাথে জোট বেধে রাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর দুই পুত্রের হত্যার কথা শুনে তিনি
শোকে ও নিস্ফল আক্রোশে হুমায়ূনের শিবিরেই প্রাণত্যাগ করেন।
গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালেই সর্বপ্রথম পর্তুগিজগণ বাংলায় বাণিজ্যিক ঘাঁটি স্থাপন করার
সুযোগ পায়। পর্তুগিজ সাহায্যের আশায় তিনি চট্টগ্রাম ও সাতগাঁও-এ পর্তুগিজ ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি
দিয়েছিলেন।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এবং তাঁর বংশধরগণ প্রায় অর্ধ-শতাব্দীকাল বাংলা শাসন করেন। বাংলায় স্বাধীন
সুলতানি আমলের ইতিহাসে এটি ছিল এক গৌরবোজ্জল যুগ। রাজ্যসীমা সম্প্রসারণ, প্রশাসনিক
স্থিতিশীলতা এবং ধর্ম , সাহিত্য ও শিল্পকলা ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ উৎকর্ষ ছিল এ যুগের বৈশিষ্ট্য। দিল্লির লোদি
সুলতানদের ক্ষীণ অবস্থায় এবং হুসেন শাহী বংশের প্রথম দুজন সুলতানের সামরিক ও কূটনৈতিক কৃতিত্বের
ফলে পশ্চিমে গোগরা এবং গঙ্গানদীর সঙ্গমস্থল হতে পূর্বদিকে চট্টগ্রাম এবং উত্তর-পূর্ব দিকে কামতাকামরূপ হতে দক্ষিণ-পশ্চিমে মন্দারণ ও চব্বিশ পরগণা পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল ভূ-খন্ডে হুসেন শাহী
সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দিল্লির সুলতানের সাথে বিবাদের সুযোগে হুসেন শাহ ভাগলপুরের পশ্চিমে
রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হন এবং এই কৃতিত্বের স্মারকস্বরূপ তিনি ‘খলিফাতুল্লাহ' উপাধি লাভে সমর্থ হন।
রাজ্যচ্যুত শর্কী সুলতানকে ভাগলপুরে আশ্রয়দান বাংলার মুসলিম রাজ্যকে দিল্লির প্রভাব হতে সম্পূর্ণরূপে
বিচ্ছিন্ন করতে সাহায্য করে।
রাজ্যজয় এবং দিল্লির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা বূহ্যকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল
হুসেন শাহী শাসনের প্রতি জনগণের আনুগত্য। হুসেন শাহী শাসকগণ তা ভালভাবেই উপলব্ধি করতে
পেরেছিলেন। তাই তাঁরা এদেশীয় অভিজ্ঞ লোকদের শাসনকার্যে সম্পৃক্ত করেন। রাজকর্মচারী নিয়োগের
ক্ষেত্রে যে উদারতা হুসেন শাহী যুগে পরিলক্ষিত হয় তা শাসক ও শাসিতের মধ্যে ব্যবধান ঘুচাতে যথেষ্ট
সাহায্য করেছিল। ফলে রাজ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছিল এবং একই সাথে অন্যান্যক্ষেত্রে সাফল্য
অর্জনের পথ সুগম হয়েছিল।
দিল্লির প্রভাব হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং স্থানীয় জনসাধারণের সহযোগিতায় এ যুগেই বাংলা খুঁজে পায় তার
সাংস্কৃতিক সত্তা। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ করে বাংলা ভাষার মাধ্যমে যে নবজাগরণ এ যুগে সূচিত হয় তা
এদেশীয় জনগণের মেধা ও মননশীলতারই স্বত:স্ফ‚র্ত অভিব্যক্তি যা বহুদিন যাবৎ চাপা পড়েছিল। বাংলা
ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি শাসকবর্গের উদারনীতি এই নবজাগরণের দ্বারকে করেছিল উন্মুক্ত। এছাড়া
চৈতন্যদেবের জন্ম এ যুগকে দান করেছিল নতুন মহিমা। ভক্তি মতবাদ ও এ সম্পর্কীয় সাহিত্য এ সময়ে
এক নব দিগন্তের সূচনা করেছিল।
সর্বদিক বিবেচনা করে এ কথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, হুসেন শাহী যুগেই প্রথম বাংলার মুসলিম রাজ্য
স্থানীয় আশা-আকাক্সক্ষা সম্বলিত এক শক্তির রূপ পরিগ্রহ করেছিল। এই যুগের কৃতিত্ব বাস্তবিকই এই যুগকে
বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জল যুগরূপে চিহ্নিত করেছে।
সারসংক্ষেপ
হাবশী শাসনের পর সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। উড়িষ্যা
হতে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাঞ্চল পর্যন্ত তাঁর নাম সুপরিচিত ছিল। সুশাসনই এ জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণ।
সামান্য চাকুরি হতে নিজ যোগ্যতা বলে হুসেন শাহ বাংলার সুলতান হন। ২৬ বছরের রাজত্বে তিনি
শান্তি-শৃ´খলা প্রতিষ্ঠা এবং সাম্রাজ্যের সীমা বৃদ্ধিতে সক্ষম হন। হোসেন শাহ মসজিদ-মাদ্রাসা
নির্মাণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা দান ইত্যাদি নানা কারণে একজন উল্লেখযোগ্য
সুলতান। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা তাঁর আমলের বিশেষবৈশিষ্ট্য। উত্তরসুরী নসরৎ শাহও রাজ্যশাসনে দক্ষতার
স্বাক্ষর রাখেন। বিশেষ করে বাবরের বিরুদ্ধে নিজের অস্তিত্ব সংরক্ষণ নসরৎ শাহের দূরদর্শিতার
পরিচায়ক। পিতার ন্যায় তিনিও বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। গৌড়ের বিখ্যাত বারদুয়ারী বা
সোনা মসজিদ তাঁর অমর স্থাপত্যকীর্তি। পরবর্তী সুলতানদের আমলে হুসেন শাহী যুগের শক্তিক্ষয়
ঘটে ও পতন ত্বরানি¦ত হয়। সামগ্রিকভাবে একথা বলা যায় যে, হুসেন শাহী যুগেই বাংলার মুসলিম
রাজ্য স্থানীয় আশা-আকাক্সক্ষা সম্বলিত এক শক্তির রূপ পরিগ্রহ করে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। শ্রী চৈতন্যদেব কোন সুলতানের সমসাময়িক?
(ক) নসরৎ শাহ (খ) গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ
(গ) আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ (ঘ) আলাউদ্দিন হুসেন শাহ।
২। হুসেন শাহের রাজত্বকালে কারা প্রথম বাংলায় পদার্পণ করেন?
(ক) ইংরেজগণ (খ) ফরাসিরা
(গ) পর্তুগিজগণ (ঘ) আরবিয়রা।
৩। দানিয়েলের ওপর কোন রাজ্য অর্পণ করা হয়?
(ক) আসাম (খ) কামরূপ
(গ) উড়িষ্যা (ঘ) ত্রিপুরা।
৪। চট্টগ্রামের ওপর হুসেন শাহী শাসকদের অধিকার ছিল কতোদিন পর্যন্ত Ñ
(ক) ১৫১৭ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (খ) ১৫০০ থেকে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
(গ) ১৫২৭ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (ঘ) ১৫৩৮ থেকে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
৫। হুসেন শাহকে ‘নৃপতি তিলক' আখ্যা দেয়া হয়েছে কোন কাব্যে?
(ক) চৈতন্য চরিতামৃত কাব্যে (খ) মহাভারত মহাকাব্যে
(গ) মনসামঙ্গল কাব্যে (ঘ) চৈতন্য ভাগবত বাক্যে
৬। নসরৎ শাহের অমর স্থাপত্যকীর্তি কোনটি?
(ক) ঝনঝনিয়া মসজিদ (খ) লোটন মসজিদ
(গ) ছোট সোনা মসজিদ (ঘ) বারদুয়ারী মসজিদ।
৭। হুসেন শাহী বংশের রাজত্ব শেষ হয়Ñ
(ক) ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে (খ) ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে
(গ) ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে (ঘ) ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের বাল্যজীবন ও ক্ষমতা লাভ সম্পর্কে যা জানেন লিখুন।
২। দুলাল গাজি সম্পর্কে একটি টীকা লিখুন।
৩। হুসেন শাহী যুগকে কেন বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। হোসেন শাহী বংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস রচনা করুন। এই আমলে বাংলার অবস্থা কিরূপ ছিল?
২। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সামরিক অভিযানসমূহের সাফল্য-ব্যর্থতা নিরূপণ করুন। তাঁর সাম্রাজ্য
কতোদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
৩। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন। তাঁকে কি মধ্যযুগে বাংলার শ্রেষ্ঠ মুসলিম সুলতান
বলা যায়?
৪। মুগল শক্তির বিরুদ্ধে বাংলার মুসলিম রাজ্য রক্ষায় সুলতান নসরৎ শাহের কৃতিত্ব বর্ণনা করুন।
সহায়ক প্রন্থপঞ্জি
১। গ.জ. ঞধৎধভফধৎ, ঐঁংধরহ ঝযধযর ইবহমধষ.
২। আবদুলকরিম, বাংলার ইতিহাস।
৩। সুখময়মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাসের দু'শো বছর, স্বাধীন সুলতানদের আমল।
৪। আবদুল মমিন চৌধুরী ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস।
৫। আবদুর রহিম, বাংলার মুসলমানদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাস।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত