অনুপনিবেশিকরণের উৎসসমূহ আলোচনা কর। অথবা, অনুপনিবেশিকরণের উপাদানগুলো লিখ ।

উত্তর ভূমিকা : অনুপনিবেশিকরণ হচ্ছে ঔপনিবেশিক দেশ হতে ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গের চলে আসা এবং শাসন ক্ষমতা নেটিভদের হাতে অর্পণ করা। ইউরোপীয় শক্তিবর্গ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ঔপনিবেশিক রাজ্য স্থাপন করে। সেখানে তাদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করে শোষণ প্রক্রিয়া চালু করে। ইউরোপীয় শক্তিবর্গ সর্বশেষ উপনিবেশ স্থাপন করে। আফ্রিকা মহাদেশে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপীয় রাজনীতি পরিবর্তিত হতে থাকে এবং সেখানে নিজেরা নিজেদের মধ্যে
দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যেই এবং এ যুদ্ধ শেষে তারা দ হয়ে পড়ে। ফলে উপনিবেশ ধরে রাখার মত সামর্থ্য তাদের ছিল না। এদিকে আফ্রিকা মহাদেশসহ বিভিন্ন উপনিবেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গ নিজেদেরকে ঔপনিবেশিক রাজ্য হয়ে। প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু করে এবং ঔপনিবেশিক দেশ স্বাধীনতা পেতে শুরু করে। এটাই অনুপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়া।
অনুপনিবেশিকরণের উৎস বা প্রক্রিয়া : যেসব উৎসের ভিত্তিতে বা প্রক্রিয়ার আলোকে আফ্রিকার অনুপনিবেশিকরণ শুরু হয়, সেটা তিনভাগে বিভক্ত । যথা :
ক. ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব,

খ. বহির্বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি ও
গ. ঔপনিবেশিক রাজ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।
নিম্নে এ উৎস তিনটি সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
ক. ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব : আফ্রিকার ইউরোপীয় শক্তিবর্গ উপনিবেশ স্থাপনের পর সেখানে তাদের নিজস্ব শাসন পদ্ধতি, রীতিনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি চালু করে। আফ্রিকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও গোত্র বিভাজিত জাতি ইউরোপীয় উন্নত শাসন পদ্ধতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয় এবং এগুলোর কিছু কিছু তারা গ্রহণ করে বিশেষ করে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তারা জাতীয়তাবোধে জাগ্রত হয়। তারাও উন্নত জাতি হওয়ার আশ ইউরোপীয়দের সাথে একযোগে কাজ করার কামনা করে কিন্তু ইউরোপীয়রা তা মানতে নারাজ ছিল। ফে আফ্রিকানদের সাথে ইউরোপীয়দের মানসিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে আফ্রিকানরা ইউরোপীয় শাসকবর্গে বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে, যা অনুপনিবেশিকরণে ভূমিকা রেখেছে।
২. বহির্বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি : ইউরোপীয়রা যখন আফ্রিকার উপনিবেশ স্থাপন করে, তখন আন্তর্জাতিক বিশ্বের ইতিহাসে কতিপয় স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যা অনুপনিবেশিকরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। নিম্নে এ ঘটনাসমূহ
আলোচনা করা হলো :
১. তুর্কি বিপ্লব : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্কের সুলতান ছিলেন দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ। অবশ্য তিনি যুদ্ধের অনেক পূর্বেই ক্ষমতায় আসেন এবং তুরস্কে তিনি স্বৈরশাসন কায়েম করেন। তাঁর অত্যাচারে তুরস্কের জনগণ অতিষ্ঠ ছিল এবং তাঁর অত্যাচারের প্রেক্ষাপটে ১৮৯৬ সালে তুর্কি সাম্রাজ্যের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতগণ দেশ ছেড়ে যান। তারা ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে যান এবং সেখানে গিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। মিত্র জার্মানি পরাজিত হলে ভার্সাই সন্ধি দ্বারা তুরস্কের উপর কিছু শর্ত আরোপ করা হয়, যাতে তুর্কি সাম্রাজ্যের অখণ্ডতার উপর আঘাত হানে। এতে তুরস্কের জনগণ দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, যা তুর্কি বিপ্লব নামে খ্যাত। তুর্কি বিপ্লবের ফলে ১৯২৪ সালে দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের পতন ঘটে এবং কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এ বিপ্লব আফ্রিকা অনুপনিবেশিকরণে সহায়ক ভূমিকা রাখে ।
২. চীনের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব : অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে চীনের মুক্তদ্বার উন্মুক্তকরণ নীতি দ্বারা বৈদেশিক শক্তিবর্গ চীনে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধা লাভ করে। চীনে তখন মাঞ্চু সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং এ সরকার বিদেশি শক্তির হাতের পুতুলে পরিণত হতে থাকে, যা মাঞ্চু সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করে। এদিকে চীনের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ শুরু হলে চীনের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে ১৯১১ সালে ড. সান ইয়াৎ সেনের নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রী বিপ্লব সংঘটিত হয়, যাতে মাঞ্চু সরকারের পতন ঘটে এবং বৈদেশিক তথা ঔপনিবেশিক শক্তির ভিত কেঁপে উঠে। ফলে অনুপনিবেশিকরণ একধাপ এগিয়ে যায়।
তাদের
৩. রুশ-জাপান যুদ্ধের প্রভাব : আফ্রিকার অনুপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তথা (১৯০৪-০৫) সালের রুশ-জাপান যুদ্ধের প্রভাব। শাখালিন দ্বীপপুঞ্জের মাঞ্চুরিয়ার দখলকে কেন্দ্র করে প্রাচ্য দেশের ক্ষুদ্র শক্তি জাপানের সাথে পাশ্চাত্যের বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার যুদ্ধ বাধে ১৯০৪ সালে এবং ১৯০৫ সালে জাপানের হাতে রাশিয়ার পরাজয় ঘটে। এ ঘটনা বিশ্বে আলোড়িত হয় এবং অজেয় ইউরোপের ইতিহাস প্রকম্পিত হয়। এ ঘটনা আফ্রিকার অনুপনিবেশিকরণে সাহায্য করে।
৪. রুশ বিপ্লবের প্রভাব : বিশ্বের যে কয়টি বিপ্লব সাড়া জাগানো ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল রুশ বিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লব। এ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল ১৯১৭ সালে এবং এর স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র ১০ দিন। এ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল রাশিয়ায়। রাশিয়া ছিল জার শাসিত অঞ্চল এবং এখানে সামন্ত প্রভুরা ছিল সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। সামন্ত প্রভু বা জমিদার শ্রেণি সার্ফ বা ভূমিদাসদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন করত। ফলে নির্যাতিত জনগণের ক্ষোভ গিয়ে পড়ে জারের উপর। কারণ জার ছিল অত্যাচারী। তাই রাশিয়ার জনগণ লেনিনের নেতৃত্বে জার শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং জার শাসনের পতন ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তাই এ বিপ্লবকে বলা হয় বলশেভিক বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। রাশিয়ার এ বিপ্লব আফ্রিকানদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রেরণা যোগায়, যা অনুপনিবেশিকরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়
৫. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব : অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্ডিনান্দের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং এ যুদ্ধ ছিল ইউরোপীয়দের মধ্যে পারস্পরিক দুটি শিবির তৈরি হওয়ার সুবাদে। এ যুদ্ধ যাদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল তারা ছিল ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গ এবং যুদ্ধ শেষে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে ঔপনিবেশিক জনগণ বিদ্রোহ করতে শুরু করে এবং তারা জাতীয়তাবাদের চেতনায় জাগ্রত হয়। এ জাগ্রত হওয়াই অনুপনিবেশিকরণে সাহায্য করে।
৬. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই পোল্যান্ডকে কেন্দ্র করে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের মূল নায়ক ছিলেন হিটলার। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে হিটলারের পতন ঘটে। তথাপিও এ যুদ্ধে সমগ্র ইউরোপীয় শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে উপনিবেশ ধরে রাখার সামর্থ্য তাদের ছিল না। তাইতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই অনুপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
৭. মার্কিন নীতির প্রভাব : প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র ছিল ইউরোপ এবং এর অধিকাংশ দে ইউরোপীয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়েই মিত্রপক্ষ অক্ষয় শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা ইউরোপীয় দেশগুলো শুনতে বাধ্য ছিল। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঔপনিবেশিক রাজ্যগুলোর প্রতি উদারনীতি গ্রহণ করে এবং তাদেরকে স্বাধীনতা দেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। এক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের চৌদ্দ দফা স্মরণীয়। এতে প্রস্তাব করা হয় যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো প্রতিষ্ঠিত হবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধীনে । তাই দেখা যাচ্ছে।
যে, আফ্রিকার অনুপনিবেশিকরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদারনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ।
গ. ঔপনিবেশিক রাজ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন : আফ্রিকার ইউরোপীয় শক্তিবর্গ ঔপনিবেশিক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পর সেখানে তাদের নিজস্ব শাসন পদ্ধতি চালু করে এবং এ শাসন পদ্ধতি অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে সেখানে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। প্রথম পর্যায়ে আফ্রিকানরা ইউরোপীয়দের সাহায্য করলেও পরবর্তীতে প্রতিরোধ করে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আফ্রিকানরা জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং তারা ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। তীর আন্দোলনের মুখে ইউরোপীয়রা আফ্রিকা ছাড়তে বাধ্য হয় এবং শেষপর্যন্ত অনুপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
মূল্যায়ন : ১৮৮০ এর দশকে স্ক্র্যাম্বলের মাধ্যমে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ আফ্রিকা দখল করে নিয়ে সেখানে তাদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। প্রথম পর্যায়ে আফ্রিকানরা তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করে। ফলে তাদের কোন ঝামেলা বা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় নি। তারা প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল ধরে বেশ নিশ্চিন্ত মনেই আফ্রিকা শাসন করেছিল। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলি ইউরোপীয়দের বিপক্ষে চলে বিশেষ করে পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ তাদেরকে দুর্বল করে দেয়। উপরন্তু ঔপনিবেশিক রাজ্যে জনগণের অসন্তোষ ও বিপ্লব ইউরোপীয়দের শক্ত ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে ইউরোপীয়দের অজান্তেই এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আফ্রিকার অনুপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়া কোন একটি বিশেষ কারণে কিংবা উৎসের ভিত্তিতে সংঘটিত হয় নি এবং এটা কোন আকস্মিক ঘটনার পরিণতিও নয়। এটা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আত্মপ্রকাশ। তবে আফ্রিকানদের অজ্ঞতার কারণে এবং ঔপনিবেশিক শক্তির অনিচ্ছার কারণেই আফ্রিকার অনুপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়া বিলম্বে সংঘটিত হয়।

অনুপনিবেশিকরণের বহির্বিশ্বের বা আন্তর্জাতিক কারণগুলো কী কী লিখ।


অথবা, আফ্রিকা অনুপনিবেশিকরণের জন্য আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি কতটুকু দায়ী ছিল?
তোমার পক্ষে যুক্তি দেখাও।
অথবা, অনুপনিবেশিকরণের বহিস্থ বা বর্হিবিশ্বের কোন কোন পটভূমি প্রধানত দায়ী? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর' ভূমিকা : অনুপনিবেশিকরণ হচ্ছে ঔপনিবেশিক দেশ হতে ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গের চলে আসা এবং শাসনক্ষমতা নেটিভদের হাতে অর্পণ করা। ইউরোপীয় শক্তিবর্গ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ঔপনিবেশিক রাজ্য স্থাপন করে সেখানে তাদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করে শোষণ প্রক্রিয়া চালু করে। ইউরোপীয় শক্তিবর্গ সর্বশেষ উপনিবেশ স্থাপন করে আফ্রিকা মহাদেশে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপীয় রাজনীতি পরিবর্তিত হতে থাকে এবং সেখানে নিজেরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যেই এবং এ যুদ্ধ শেষে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ঔপনিবেশিক রাজ্য ধরে রাখার মত সামর্থ্য তাদের ছিল না। এদিকে আফ্রিকা মহাদেশসহ বিভিন্ন উপনিবেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গ নিজেদেরকে ঔপনিবেশিক রাজ্য হতে প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু করে এবং ঔপনিবেশিক দেশ স্বাধীনতা পেতে শুরু করে। এটাই অনুপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়া।
অনুপনিবেশিকরণে আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির দায়বদ্ধতা : ইউরোপীয়রা যখন আফ্রিকায় উপনিবেশ। স্থাপন করে তখন আন্তর্জাতিক বিশ্বের ইতিহাসে কতিপয় স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যা অনুপনিবেশিকরণের ক্ষেত্রে
প্রস্তুত করেছিল। নিম্নে এ ঘটনাসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. তুর্কি বিপ্লব : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্কের সুলতান ছিলেন আব্দুল হামিদ। অবশ্য তিনি যুদ্ধের পূর্বেই ক্ষমতায় আসেন এবং তুরস্কে তিনি দ্বৈতশাসন কায়েম করেন। তাঁর অত্যাচারে তুরস্কের জনগণ অতিষ্ঠ ছিল এবং তাঁর অত্যাচারের প্রেক্ষাপটে ১৮৯৬ সালে তুর্কি সাম্রাজ্যের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতগণ দেশ ছেড়ে যান। তারা ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। যান এবং সেখানে গিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের মিত্র জার্মানি পরাজিত হলে ভার্সাই সন্ধি দ্বারা তুরস্কের উপর কিছু শর্ত আরোপ করা হয়, যাতে তুর্কি সাম্রাজ্যের অখণ্ডতার উপর আঘাত হানে। এতে তুরস্কের জনগণ দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, যা তুর্কি বিপ্লব নামে খ্যাত। তুর্কি বিপ্লবের ফলে ১৯২৪ সালে দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের পতন ঘটে এবং কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এ বিপ্লব আফ্রিকা অনুপনিবেশিকরণে সহায়ক ভূমিকা রাখে ।
২. চীনের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব : অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে চীনের মুক্তদ্বার উন্মুক্তকরণ নীতি বৈদেশিক শক্তিবর্গ চীনে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধা লাভ করে। চীনে তখন মাঞ্চু সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং এ সরকার বিদেশি শক্তির হাতের পুতুলে পরিণত হতে থাকে, যা মাঞ্চু সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করে। এদিকে চীনের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ শুরু হলে চীনের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে ১৯১৯ সালে ড. সান ইয়াৎ সেনের নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রী বিপ্লব সংঘটিত হয়, যাতে মাঞ্চু সরকারের পতন ঘটে এবং বৈদেশিক তথা ঔপনিবেশিক শক্তির ভিত কেঁপে উঠে। এর ফলে অনুপনিবেশিকরণ একধাপ এগিয়ে যায় ।
৩. রুশ-জাপান যুদ্ধের প্রভাব : আফ্রিকায় অনুপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তথা ১৯০৪-০৫ সালের রুশ-জাপান যুদ্ধের প্রভাব। শাখালিন দ্বীপপুঞ্জের মাঞ্চুরিয়ার দখলকে কেন্দ্র করে প্রাচ্য দেশের ক্ষুদ্র শক্তি জাপানের সাথে পাশ্চাত্যের বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার যুদ্ধ বাধে ১৯০৪ সালে এবং ১৯০৫ সালে জাপানের হাতে রাশিয়ার পরাজয় ঘটে। এ ঘটনা বিশ্বে আলোড়িত হয় এবং অজেয় ইউরোপের ইতিহাস প্রকম্পিত হয়। এ ঘটনা আফ্রিকার অনুপনিবেশিকরণে সাহায্য করে।
৪. রুশ বিপ্লবের প্রভাব : বিশ্বের যে কয়টি বিপ্লব সাড়া জাগিয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল রুশ বিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লব। এ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল ১৯১৭ সালে এবং এর স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র ১০ দিন। এ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল রাশিয়ায়। রাশিয়া ছিল জার শাসিত অঞ্চল এবং এখানে সামন্ত প্রভুরা ছিল সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। সামন্ত প্রভু বা জমিদার শ্রেণি সার্ফ বা ভূমিদাসদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন করত। ফলে নির্যাতিত জনগণের ক্ষোভ গিয়ে পড়ে জারের উপর। কারণ জার ছিল অত্যাচারী। তাই রাশিয়ার জনগণ লেনিনের নেতৃত্বে জার শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং জার শাসনের পতন ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তাই এ বিপ্লবকে বলা হয় বলশেভিক বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। রাশিয়ায় এ বিপ্লব আফ্রিকানদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রেরণা যোগায়, যা অনুপনিবেশিকরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয় ।
৫. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব : অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্ডিনান্দের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং এ যুদ্ধ ছিল ইউরোপীয়দের মধ্যে পারস্পরিক দুটি শিবির তৈরি হওয়ার সুবাদে। এ যুদ্ধ যাদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল তারা দুর্বল হতে থাকে। এ সুযোগে ঔপনিবেশিক জনগণ বিদ্রোহ করতে শুরু করে এবং তারা জাতীয়তাবাদের চেতনায় জাগ্রত হয়। এ জাগ্রত হওয়াই অনুপনিবেশিকরণে সাহায্য করে।
৬. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই পোল্যান্ডকে কেন্দ্র করে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের মূল নায়ক ছিলেন হিটলার। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে হিটলারের পতন ঘটে। তথাপি এ যুদ্ধে সমগ্র ইউরোপীয় শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে উপনিবেশ ধরে রাখার সামর্থ্য তাদের ছিল না। তাইতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই অনুপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
৭. মার্কিন নীতির প্রভাব : প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র ছিল ইউরোপ এবং এর অধিকাংশ দেশ ছি ইউরোপীয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়েই মিত্রপক্ষ অক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা ইউরোপীয় দেশগুলো শুনতে বাধ্য ছিল। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঔপনিবেশিক রাজ্যগুলোর প্রতি উদার নীতি গ্রহণ করে এবং তাদেরকে স্বাধীনতা দেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। এক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের চৌদ্দ দফা স্মরণীয়। এতে প্রস্তাব করা হয় যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো প্রতিষ্ঠিত হবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধীনে। তাই দেখা যাচ্ছে যে, আফ্রিকার অনুপনিবেশিকরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদার নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ১৮৮০ এর দশকে ফ্র্যাম্বলের মাধ্যমে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ আফ্রিকা দখল করে নিয়ে সেখানে আফ্রিকানরা তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করে। ফলে তাদের ঝামেলা বা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় নি। তারা প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ধরে বেশ নিশ্চিন্ত মনেই আফ্রিকা শাসন করেছিল। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলি ইউরোপীয়দের বিপক্ষে চলে যায় বিশেষ করে পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ তাদেরকে দুর্বল করে দেয়। ফলে ইউরোপীয়দের অজান্তেই এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]