আফ্রিকায় সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার কারণসমূহ ব্যাখ্যা কর।

আফ্রিকার সামরিক শাসনের পটভূমি বিশ্লেষণ কর।
অথবা, আফ্রিকায় কেন বারবার সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বিংশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত আফ্রিকা মহাদেশের সামরিক শাসনের কারণগুলো
বিশ্লেষণ কর ।
অথবা, কোন অবস্থার প্রেক্ষাপটে আফ্রিকার সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? তোমার মতামত দাও।
উত্তর ভূমিকা : আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনী একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও বিংশ এবং একবিংশ শতকের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও ভূমিকা পালনের বিষয়টি রাজনৈতিক আলোচনাতে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছে। আফ্রিকান রাষ্ট্রের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী নানাভাবে জড়িয়ে পড়েছে। তবে এটাকে কেবলমাত্র তৃতীয় বিশ্বের একক কোন বিষয় বলা চলে না। কেননা উন্নত অনুন্নত গণতান্ত্রিক অগণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজবাদী, বৈধ-অবৈধ, নির্বিশেষে সকল প্রকার রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ হস্তক্ষেপ বা শাসন পরিলক্ষিত হয়। দুর্যোগময় পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি সুশৃঙ্খল অবস্থা ফিরিয়ে আনার অজুহাতে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করলেও এটা মূলত সংবিধান বহির্ভূত কতিপয় সামরিক এলিটদের শাসন ছাড়া আর কিছু নয়।
সামরিক অভ্যুত্থানের কারণ : কোন একটি বিশেষ কারণে আফ্রিকান দেশে স্বাধীনতার পর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে নি। আফ্রিকার সামরিক অভ্যুত্থানের পশ্চাতে কতিপয় বিশেষ কারণ চিহ্নিত ছিল। নিম্নে এ কারণসমূহ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. জাতীয় সংহতির অভাব : জাতীয় সংহতির অভাব আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেসামরিক সরকার যখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেশের জাতীয় সংহতি অর্জনের পথের বাধা দূর করতে পারে নি। তখনই আফ্রিকার সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।
২. সরকারের বৈধতার সংকট : সরকারের বৈধতার সংকটের ফলে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে। এ বৈধতার সংকট হলো কোন বিশেষ সরকার নির্বাচনে পরাজিত হলে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে জনগণের রায়কে মেনে নিবে। কিন্তু আফ্রিকান কতিপয় দেশে এর ব্যতিক্রম ঘটে। তারা নির্বাচনে পরাজিত হলেও ক্ষমতা ছাড়তে চায় নি। ফলে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপের সুযোগ পায় ।
৩. সামরিক বাহিনীর উৎকর্ষতা : সামরিক বাহিনীর দক্ষতাসম্পন্ন সুষ্ঠু সংগঠন ও ঐক্য গোপনীয়তা রক্ষা এবং সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদী সমর্থন সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণে বাধ্য ও উৎসাহী করে তোলে। আফ্রিকান দেশের সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য সামরিক বাহিনীর উৎকর্ষতা অনেকাংশে দায়ী।
৪. সেনাবাহিনীর উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা : যুদ্ধ সাধারণত সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত হয়। বেসামরিক শক্তি যেখানে অক্ষম সেখানেই প্রমাণ মেলে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ক্ষমতায় কতটুকু বিস্তৃতি ঘটেছে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতির ক্ষেত্রেও সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভরতা লক্ষণীয়। জাতীয় বাজেটের একটা ব্যাপক অংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হয় যা পুরো জাতীয় অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে।
৫. ক্ষমতার মোহ : ক্ষমতার মোহ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। Man is by nature selfish. উন্নয়নশীল দেশের লোকদের ক্ষমতার মোহ সবচেয়ে বেশি। সেনাবাহিনীর মধ্যেও এ মোহ পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে আফ্রিকান দেশগুলোতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতার মোহ বেশি।
৬. বেসামরিক সরকারের দুর্বলতা : আফ্রিকান দেশের বেসামরিক সরকারের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতায় রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে সামরিক বাহিনীর আবির্ভাব বিস্তৃত পরিসরে রাজনৈতিক বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কোন কোন রাষ্ট্রে বেসামরিক সরকার থেকে সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ পৃথকভাবে অবস্থান করে কিন্তু পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। আফ্রিকান দেশগুলোতে এ প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
৭. অনুন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি : সামরিক অভ্যুত্থানের কারণ প্রসঙ্গে আলোচনায় Finer বলেছেন যে, যেসব দেশে High political culture রয়েছে, সেসব দেশে সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না বা করে না। কিন্তু যেসব দেশে Low political culture রয়েছে সেসব দেশে সামরিক বাহিনী সহজেই রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। আফ্রিকান দেশগুলোতে অনুন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিরাজ করছে। তাই এখানে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ বেশি হচ্ছে।
৮. সংকটকালীন পরিস্থিতি : আফ্রিকান রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়ার ফলে সংকট দেখা দেয়। এ ধরনের সংকট দীর্ঘদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে এবং মীমাংসার কোন উপায় না থাকলে সামরিক বাহিনী সংকট মোচনের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে।
৯. রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা : আফ্রিকান দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক কোন্দলের ফলে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এর ফলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধস নামে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে।
১০. শাসক শ্রেণির স্বেচ্ছাচারিতা : আফ্রিকান দেশের শাসক শ্রেণির স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি প্রভৃতি চরম আকার ধারণ করলে জনগণ অসহিষ্ণু মনোভাব পোষণ করে। ফলে সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটে।
১১. অর্থনৈতিক সংকট : অর্থনীতি ছাড়া রাজনীতি অর্থহীন। মুদ্রাস্ফীতি, কালোবাজারি, দুর্নীতি, খেলাপী ঋণগ্রহীতার সংখ্যা বৃদ্ধি প্রভৃতি অর্থনৈতিক অবসানের জন্য রাজনীতি অচল হয়ে পড়ে এবং এ সময় আফ্রিকান রাষ্ট্রে সামরিক হস্তক্ষেপ
দেখা দেয়।
১২. সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চার অভাব : আফ্রিকান দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চাগত সমস্যা আছে। এখানে সমাজের নিম্নস্তর হতে উচ্চস্তরে রাজনৈতিক গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ খুবই কম। তাই রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক দিক যা সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল বা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রতিহত করতে পারে তা গড়ে না উঠায় দেশ চলে যায় সামরিক শাসনাধীনে।
১৩. গোত্রীয় সংঘাত : আফ্রিকা মহাদেশ হচ্ছে গোত্র বিভাজিত সমাজব্যবস্থা। এখানে গোত্রীয় রাজনীতিই প্রধান এবং জাতীয় রাজনীতি গৌণ। যে গোত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যায় সে গোত্রের জনগণ সুযোগ সুবিধা বেশি ভোগ করে। অন্য গোত্রের জনগণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ও শোষিত হয়। ফলে শুরু হয় গোত্রীয় দ্বন্দ্ব বা সংঘাত। এ গোত্রীয় দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। যার ফলে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।
১৪. নেতৃত্বের সংকট : আফ্রিকার সামরিক অভ্যুত্থানের পশ্চাতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে নেতৃত্বের সংকট। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সঠিক নেতৃত্ব দিলে ও স্বাধীনতার পর তাঁরা দেশ পরিচালনায় সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারে নি। ফলে আফ্রিকা সামরিক অভ্যুত্থানের কবলে পড়ে।
১৫. পাশ্ববর্তী দেশের সেনাশাসন : একটি দেশের সামরিক শাসন আরেকটি দেশের সামরিক শাসনকে ডেকে আনে কারণ কোন দেশে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যদেশও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে উৎসাহী হয়ে পড়ে। আফ্রিকার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। কারণ আফ্রিকার একটি দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলে অন্যান্য দেশেও দ্রুত এ প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আফ্রিকান দেশে ঘন ঘন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, গোত্র বিভাজিত সমাজকাঠামোতে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে এবং শাসন ও শোষণ করে। এক পর্যায়ে তারা আফ্রিকার স্বাধীনতা দিয়ে চলে যায়। কিন্তু স্বাধীনতার পর আফ্রিকান দেশগুলোতে কোন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি। এর কারণ বার বার সামরিক অভ্যুত্থান। অবশ্য সামরিক অভ্যুত্থানের পশ্চাতে উপর্যুক্ত কারণসমূহ দায়ী ছিল ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]