সুলতানি আমলে বাংলার আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক অবস্থা


বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্র অঞ্চলের সমাজে নতুন উপাদান যুক্ত হয় এবং
বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। এতদিন পর্যন্ত বাংলায় বৌদ্ধ, হিন্দু এবং লোকাচার ধর্ম পালনকারী বিপুল
সংখ্যক লোকজন ছিল; মুসলমানরা নিয়ে আসে নতুন ধর্ম ইসলাম। মুসলমান সৈন্যদের সঙ্গে বিদ্বান,
পেশাধারী, স্থপতি, প্রশাসক এবং কারিগরগণও এদেশে আসেন। একই সঙ্গে বাংলার সামাজিক জীবনে
পীর, সুফি, ফকির প্রমুখ ধর্মীয় লোকজনেরও আগমন ঘটে যারা অত্র অঞ্চলে কার্যকর প্রভাব বিস্তার করতে
সক্ষম হন।
ভৌগোলিক দিক থেকে উপমহাদেশের সর্বপূর্বে অবস্থিত বাংলার একটি আঞ্চলিক সত্তা রয়েছে। এদেশের
অবস্থান পাহাড়, পর্বত, নদ-নদী এবং জলবায়ু জনসাধারণের জীবনযাত্রা প্রণালী এবং রাজনৈতিক আশাআকাক্সক্ষাকে প্রভাবিত করেছে। বাংলা একটি প্রাকৃতিক সীমান্তবেষ্টিত দেশ, এর উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা,
দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে আসাম, ত্রিপুরা, খাসিয়া-জয়ন্তিয়া ও চট্টগ্রাম পাহাড় এবং পশ্চিমে রাজমহল
পাহাড়, বীরভ‚মের সাঁওতাল পরগণা, ঝাড়খন্ড এবং ময়ুরভঞ্জের জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা। উত্তর-দক্ষিণে বাংলা
সুরক্ষিত, বহিরাক্রমণের আশঙ্কা তেমন ছিল না; পূর্বদিক থেকেও বহিরাক্রমণের ঘটনা দেখা যায় না,
দক্ষিণে আরাকানের সঙ্গে বাংলার সংঘর্ষের সংবাদ পাওয়া গেলেও তা তেমন একটা বিপদ ডেকে আনেনি।
কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে পশ্চিম হতে বাংলা প্রায়ই আক্রান্ত হতো। পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে বহিরাক্রমণের ফলেই
বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে বেশি। বাংলার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে গঙ্গানদী, আক্রমণকারীরা
গঙ্গা দিয়েই অগ্রসর হয়েছে। এই নদীর ধারে রাজমহলের গিরিপথে অবস্থিত ছিল তেলিয়াগড় এবং
সিকড়িগড় নামে দুটি সুরক্ষিত গড় বা দুর্গ। এই দুটি গড় রক্ষা করতে পারলে বাংলা বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা
পেতো। প্রাচীনকাল থেকে মুসলিম আমলের শেষ পর্যন্ত এই গিরিপথ এবং দুর্গগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ভ‚মিকা পালন করে। বাংলার এই ভৌগোলিক অবস্থা এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক জীবনের ওপরও বহুবিধ
প্রভাব বিস্তার করেছে এবং বাংলার ‘আঞ্চলিক ব্যক্তিত্ব' বা স্বকীয় সত্তা হিসেবে এ অঞ্চলের পরিচয় দান
করেছে।
বাংলার সঙ্গে মুসলমানদের প্রাথমিক যোগাযোগ
বখতিয়ার খলজী বাংলায় প্রথম মুসলিম রাজ্য বিস্তার করেন। প্রথম দিকে লখনৌতিকে রাজধানী করে এর
অবস্থান গড়ে ওঠে। তখন থেকে অন্যান্য অংশে মুসলমান শাসন বিস্তার লাভ করে এবং শেষ পর্যন্ত সমগ্র
বাংলায় তা প্রাধান্য বিস্তার করে।



খ্রিস্টিয় অষ্টম শতাব্দী থেকেই বাংলার সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ ছিল। প্রতœতাত্তি¡ক সাক্ষ্য, আরব
ভৌগোলিকদের বিবরণ এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত পরম্পরাগত কিংবদন্তী ও জনশ্রুতিতে এর
প্রমাণ পাওয়া যায়। বিভিন্ন তথ্য বিবরণী থেকে বলা যায় যে, তুর্কিদের বাংলা বিজয়ের আগে থেকেই
বাংলার সঙ্গে আরব মুসলমানদের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু এ যোগাযোগ ছিল একান্তভাবেই বাণিজ্যিক। চীন
পর্যন্ত বাণিজ্যিক পথ বর্ণনাকালে আরব ভৌগোলিকগণ একটি দেশ ও সামুদ্রিক বন্দরের উল্লেখ করেছেন যা
যথাক্রমে বাংলা ও চট্টগ্রাম হিসাবে সনাক্ত করা যায়। এসব সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে জানা যায়, আরব
ব্যবসায়ীরা বাংলার উপক‚লে ও সামুদ্রিক বন্দরে যাতায়াত করতেন। মাঝে মাঝে ব্যবসায় সুবিধার জন্য
তারা বাংলায় দীর্ঘদিন অবস্থান এবং উপক‚লীয় এলাকায় মানুষের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপন করতেন।
তবে সেই প্রাথমিক আমলে বাংলায় কোন সুফির আগমন ঘটেছিল কিনা এবং তাঁরা স্থানীয় জনগণের মধ্যে
ইসলাম প্রচার করেছিলেন কিনা তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয়। যৌক্তিক ব্যাখ্যা হলো যে, অতি
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার উৎপাদিত পণ্যের বহির্বিশ্বে চাহিদা ছিল। আরব বণিকগণও বাংলার সাথে
তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। তবে বাংলায় ইসলাম প্রচার এবং মুসলমান সমাজের প্রতিষ্ঠা
খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি বিজয়ের সময় থেকেই শুরু হয়।
বাংলায় ইসলাম বিস্তার
সুলতানি আমলে বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্ময়কর ঘটনা হলো এই অঞ্চলে ইসলামের
বিস্তার। বাংলা একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল। ১৮৭২ সালে প্রথম ভারতীয় আদমশুমারির রিপোর্ট
প্রকাশিত হলে বিষয়টি বিজ্ঞজনদের নজর কাড়ে। কিন্তু বাংলার এই মুসলিম প্রাধান্যের কারণ সম্পর্কে
পন্ডিতগণ একমত হতে পারেননি। এ বিষয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন যুক্তি, তত্ত¡ দাঁড় করিয়েছেন। পন্ডিতদের
মধ্যে কোন কোন গোষ্ঠী বলার চেষ্টা করেছেন যে, বল প্রয়োগ করেই মুসলমান শাসকগণ বাংলায় হিন্দু-
বৌদ্ধদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছেন। তবে এই মতটি সর্বজনগ্রাহ্য নয়। বাংলার মুসলিম প্রাধান্যের
কারণ অনুসন্ধানে অধিক গ্রহণযোগ্য মতবাদটি হল ‘পারসুয়েশন থিওরী' বা প্রচারণামূলক মতবাদ। বিভিন্ন
সময়ে বাংলায় আগত সুফি-দরবেশদের হৃদয়গ্রাহী প্রচারণার ফলেই বাংলায় ইসলামের বিস্তার ঘটেছে।
বাংলায় মুসলিম সমাজ গঠন তথা ইসলাম বিস্তারের কারণ নিয়ে যেমন মতভেদ আছে, তেমনি মতভেদ
আছে তাদের নৃতাত্তি¡ক বিভাজন নিয়ে। অর্থাৎ পন্ডিতগণ প্রায় একমত যে, বাংলায় ব্যাপক ধর্মান্তরের ফলেই
মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধর্মান্তর ব্যাপক হারে ঘটেছে নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের থেকে। তবে
অনেক পন্ডিত যেমন, ডঃ আব্দুর রহিম এই মত মানতে রাজি নন। তিনি একটি হিসাব করে দেখিয়েছেন
যে, বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ৭০ ভাগ ধর্মান্তরিত এবং বাকি ৩০ ভাগ বাইরের থেকে আগত। আর এই
ধর্মান্তরিত মুসলমানদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক উচ্চ হিন্দুজাত। বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ থাকলেও বাংলার
মুসলমানদের অধিকাংশ যে, ধর্মান্তরিত এ বিষয়ে এখন কারোই তেমন ভিন্ন মত নেই।
বাংলায় ইসলাম বিস্তার মূলত ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর রাজত্বকাল থেকেই শুরু হয়।
ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বখতিয়ার খলজির বাংলা জয়ের পূর্বে বাংলায় মুসলিম জনবসতি গড়ে
উঠেছিল। ইসলাম বিস্তারের আদিকালে বাংলায় অনেক সুফির আগমন ঘটেছিল বলে যে জনশ্রুতি আছে তার
কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। এই সময়ে বাংলার সাথে মুসলমানদের যোগাযোগ ছিল
বাণিজ্যিক কারণে। তাই পন্ডিতগণ একমত যে, বাংলায় ইসলাম বিস্তারের যাত্রা শুরু হয়েছিল সম্ভবত
বখতিয়ার খলজীর আমল থেকেই। বখতিয়ার পরবর্তী সুলতানদের আমলে ইসলামে ধর্মান্তরের হার আরো
বৃদ্ধি পায় এবং সুলতানি আমলের শেষের দিকে ইসলাম অন্যতম প্রধান ধর্মে পরিণত হয়। বাংলায় সুফিদের
আগমনের শতাব্দীওয়ারী হার থেকে বুঝা যায় যে, চতুর্দশ শতাব্দীতে সর্বাধিক ৩৬% সুফি বাংলায়
এসেছেন। তাই অনুমান করা যায় যে, এই সময়েই বাংলায় সর্বাধিক ধর্মান্তর ঘটে থাকতে পারে।


মুসলিম সমাজ গঠনে সুফি ও সুলতানদের ভ‚মিকা
ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুলতানি আমলের বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো
ইসলামের ব্যাপক বিস্তার। ইসলাম বিস্তারে প্রধান ভ‚মিকা পালন করেন অসংখ্য সুফি-সাধক এবং তাঁদের
ইসলাম বিস্তারের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেন মুসলমান সুলতানগণ।
যদিও অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন যে, বাংলায় ইসলাম বিস্তারের ক্ষেত্রে সুলতানদের ভ‚মিকাই বেশি।
কারণ তাঁরা অস্ত্রের মুখে মানুষকে ইসলামে ধর্মান্তরে বাধ্য করেন। তবে এই যুক্তি যথেষ্ট জোরালো নয়।
কেননা অস্ত্রের মুখে ইসলাম প্রচার করলে ভারতে মুসলিম শাসনের প্রাণকেন্দ্র দিল্লিতে মুসলমানদের সংখ্যা
বেশি হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বাংলায় সুলতানগণ জোর করে কাউকে ধর্মান্তরিত করেছে
এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। আবার যেহেতু বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বেও ইসলামের বিস্তার
ঘটেনি, তাই ইসলাম বিস্তার ও মুসলিম সমাজ গঠনে সুলতানদের অবশ্যই কার্যকরী ভ‚মিকা আছে।
সুলতানগণ জোর করে কাউকে ধর্মান্তরিত না করলেও একথা সত্য যে, সুলতানদের আনুক‚ল্য পাওয়ার
আশায় অনেকে হয়তো ধর্মান্তরিত হয়েছেন।
সুলতানগণ তাঁদের প্রেরিত অভিযান ও সেনাবাহিনীর দ্বারা পরোক্ষভাবে ইসলাম বিস্তারের ক্ষেত্র তৈরি
করেছেন। আর সুফিগণ বিনা বাধায় ইসলাম প্রচার করতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে সুলতানগণ মুসলিম
সুফি দরবেশদের বিভিন্ন রকম সাহায্য-সহযোগিতা তথা পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে ইসলাম বিস্তারকে
উৎসাহিত করেছেন।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলায় ইসলাম বিস্তারে প্রধান ভ‚মিকা পালনকারীরা হচ্ছেন সুফি।
তাঁদের উদার ও হৃদয়গ্রাহী প্রচারণায় সামাজিক প্রতিক‚লতার মুখে হিন্দু-বৌদ্ধগণ ব্যাপক হারে ইসলাম গ্রহণ
করেছে। সুফিগণ সামাজিক স্তরবিন্যস্ত হিন্দু সমাজে ইসলামের বাণী প্রচার করে ধর্মান্তরের গতিকে বেগবান
করেছেন।
হিন্দুদের সামাজিক অবস্থা
বাংলায় মুসলমানদের শাসনামলে জনসাধারণের অধিকাংশই ছিল হিন্দু, কিছুসংখ্যক বৌদ্ধ ছিল। কিন্তু হিন্দু
সমাজের মধ্যে বিরাজমান নানা প্রতিক‚ল অবস্থা এবং ইসলামের সাম্যের বাণীর প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে তাদের
অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং সুলতানি আমলের শেষের দিকে বাংলায় ইসলাম অন্যতম প্রধান ধর্মে
পরিণত হয়।
হিন্দু সমাজ মূলত চতুর্বর্ণে বিভক্ত ছিল যেমন, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র। তন্মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং
বৈশ্য এই তিন জাতির প্রাধান্য ছিল, শূদ্ররা ছিল একেবারে নিম্নস্তরে, অস্পৃশ্য এবং নিগৃহীত। ব্রাহ্মণেরা
আবার নানা শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। বেদ, পুরাণ প্রভৃতি শাস্ত্রে তাদের ছিল অগাধ পান্ডিত্য। কায়স্থরা
মোটামুটি লেখাপড়া জানতো। বৈশ্যরা ছিল কবিরাজ বা চিকিৎসক। ঝাড়ফুক, তন্ত্রমন্ত্রেও তাদের বুৎপত্তি
ছিল। এছাড়া বণিক, স্বর্ণকার, কাঁসারি, শাঁখারি, গোয়ালা, নাপিত, মালাকার, কুমার, ধোপা, চাঁড়াল, ছুতার,
কৈবর্ত, ডোম, মুচি, জেলে ইত্যাদি পেশার মানুষের নামও পাওয়া যায়। এক বর্ণের সাথে অন্য বর্ণের বিবাহ
নিষিদ্ধ ছিল, তবে মাঝেমধ্যে হতো। হিন্দু সমাজে আইন-কানুন বিধি নিষেধের কড়াকড়ি ছিল। এর ফল
হয়েছিল অবশ্য উল্টো। মুসলমানদের সংস্পর্শে এলে হিন্দুদের জাত নষ্ট হতো। এছাড়া নানা ধরনের বর্ণ
বৈষম্য ও শ্রেণীবিভাজন হিন্দু সমাজের একটি বড় অংশকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। ঐতিহাসিকদের অনুমান, এই
অংশটি ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়।
হিন্দু সমাজের চালকের আসনে ছিল ব্রাহ্মণ। তবে বাংলায় মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তারা
বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে অন্যান্য বর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থার
সম্মুখীন হয়। মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের প্রাক্কালে হিন্দু সমাজ অধঃপতিত ছিল। নিম্নবর্ণের হিন্দু ও
বৌদ্ধদের ওপর ব্রাহ্মণদের অত্যাচার সামাজিক জীবনকে কলুষিত করেছিল। মুসলিম শাসনে ব্রাহ্মণদের
কর্তৃত্ব লোপ পায়। মুসলিম সংস্পর্শ ও সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে সৃষ্ট আলোড়ন ব্রাহ্মণদেরকে তাদের


আত্মপ্রসাদ ও ভোগ স্পৃহার জীবন থেকে কঠোরভাবে জাগিয়ে তোলে। এর ফলে তারা তাদের জীবন ও
সমাজ সংস্কারের জরুরি প্রয়োজন উপলব্ধি করে। ব্রাহ্মণদের মধ্যে কয়েকটি সংস্কার আন্দোলনের আবির্ভাব
হয়। সমাজ সংস্কারের এই উপলব্ধির প্রবাহে ষোড়শ শতকে শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে বৈষ্ণব ধর্মের আকারে
হিন্দু সমাজে একটি বড় ধর্মীয় বিপ্লবের সূচনা হয়। শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্ম হিন্দু সমাজে একটি উন্নত
ধরনের নৈতিক জীবনের আদর্শ তুলে ধরে। চৈতন্যদেব মানুষে মানুষে প্রেমের আহŸান জানান, জাতিভেদ
তুলে দেন, সমাজের রীতি-প্রথা অনেকটাই শিথীল করেন এবং এভাবে সম্ভাব্য সংকট থেকে হিন্দু ধর্মকে
রক্ষা করেন। শ্রীচৈতন্যের আন্দোলন ‘ভক্তি আন্দোলন' হিসেবেও পরিচিত। ষোল শতকের ইতিহাসে শ্রী
চৈতন্য অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিত্ব যিনি ধর্মীয়-সামাজিক জীবনে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেন।
হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর বঙ্গ বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায়
মুসলিম শাসনের যাত্রা শুরু হয়। পুরো সুলতানি আমলে বাংলার সামাজিক ইতিহাসের রূপ-চিত্রের ব্যাপক
পরিবর্তন ঘটে। হিন্দু-বৌদ্ধ প্রধান বাংলায় ইসলাম বিস্তার লাভ করে এবং মুসলিম সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া
শুরু হয়। বাংলায় নবগঠিত মুসলিম সমাজ এবং তাদের পুরনো প্রতিবেশী হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের
মধ্যে সম্পর্কের প্রকৃতি কেমন ছিল, তা নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে।
বাংলায় হিন্দু ও মুসলমান দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসবাস করলেও তাদের জীবনযাত্রা প্রণালী ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এই ভিন্নতা সত্তে¡ও পন্ডিতগণ আলোচ্য সময়ে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে
সম্প্রীতি লক্ষ করেছেনঃ
মুসলমান শাসকগণ কোনোরকম ধর্মীয় গোঁড়ামি ছাড়াই অনেক হিন্দুকে রাজকার্যে সম্পৃক্ত করেন। সুলতান
ইলিয়াস শাহ দিল্লি সালতানাতের বিরুদ্ধে তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু সামন্ত, জমিদার, সেনাপতি ও
সৈনিকদের সমর্থন ও সাহায্য গ্রহণ করেন। তাঁর একজন হিন্দু সেনাপতি ফিরোজ শাহ তুঘলকের বিরুদ্ধে
বিরাট বাহিনী পরিচালনা করেন।
সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ বিখ্যাত সংস্কৃত পন্ডিত ও কবি বৃহস্পতি মিশুকে ‘রায়মুকুট' উপাধিতে
সম্মানিত করেন এবং সৈন্যদলে উচ্চপদও প্রদান করেন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকালে দুজন
ব্রাহ্মণ সহোদর রূপ ও সনাতন রাজদরবারে উচ্চ ও দায়িত্বপূর্ণ পদমর্যাদা লাভ করেন। এভাবে সুলতানি
আমলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমঝোতা ও সহযোগিতার পরিবেশ বিরাজ করছিল।
মুসলমান শাসকগণ হিন্দুদের ধর্মীয় ব্যাপারে কোনরূপ হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করেন। ফলে
হিন্দুরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি উদ্যাপনে, শিক্ষায় ও ধর্ম প্রচারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে সক্ষম হয়।
মুসলমানরা হিন্দুদেরকে ব্রহ্মোত্তর, দেবোত্তর, বিষ্ণু-উত্তর জমি দান করেন। মুসলমানরা অকুণ্ঠভাবে হিন্দুদের
মধ্যে নিষ্কর জমি দান করেন।
সামাজিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক আদান-প্রদানের ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন হিন্দু প্রথার অনুপ্রবেশ ঘটে।
অনেক ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজ হিন্দু সমাজের আদর্শে রূপান্তরিত হয়। হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণদের মতোই
মুসলমান সমাজে শেখ ও সৈয়দরা কৌলিন্য দাবি করে শ্রেষ্ট আসন দখল করেন। তাছাড়া হিন্দুদের
অনুকরণে মুসলমানরা তাদের সহজ-অনাড়ম্বর বিবাহ অনুষ্ঠানকে জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলে। কুসংস্কার ও
যাদুটোনার বিষয়ে উভয় সম্প্রদায়ের ধারণা ছিল প্রায় একই রকমের। হিন্দু-মুসলমান উভয়ই উভয়ের
সামাজিক বিশেষ করে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগদান করতো।
সুলতানি আমলে হিন্দু ও মুসলমান সাহিত্যে উদারপন্থী ধারা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সমন¦য় প্রচেষ্টার
নিদর্শন বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। এ আমলে মুসলমান লেখকেরা হিন্দু পুরাণ, গাঁথা এবং ঐতিহ্যকে


সাহিত্যের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। হিন্দুদের মতোই অত্যন্ত আগ্রহ ও আন্তরিকতার সাথে হিন্দু
দেব-দেবীদের আখ্যান তারা রচনা করেছেন।
সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের ফল
হিন্দু ও মুসলমানদের সংস্কৃতির পারস্পরিক আদান-প্রদানের ফলে ‘সত্যপীর' নামে হিন্দু ও মুসলমানের
একজন এজমালী দেবতার উদ্ভব ঘটে। সত্যপীরের মহিমা ও বিভ‚তিকে বিষয়বস্তু করে বহু পাঁচালী ও পীর
প্রশস্তি রচিত হয়। হিন্দুদের কাছে তিনি ছিলেন বিষ্ণুর অবতার সত্যনারায়ণ, আর মুসলমানদের কাছে
তিনি ছিলেন সত্যপীর। পীর, দরবেশ ছাড়াও বাংলার মুসলমানরা কিছু সংখ্যক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন
পৌরাণিক নায়কের প্রতি বিশেষ আসক্তি ছিল। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন খাজা খিজির। হিন্দু
সমুদ্রাধিপতি বরুণ দেবতার সাথে তার চমৎকার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পাঁচ পীরও হিন্দু ও মুসলমানদের
শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। সোনারগাঁয়ে পাঁচ পীরের দরগাহ তীর্থযাত্রীদের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ।
সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল। আর এ কারণে সুলতানি আমলের সাহিত্যে
সমাজের যে প্রতিফলন ঘটেছে তাতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রমাণ
পাওয়া যায়।
শাসনব্যবস্থা
সুলতানি আমলে বাংলার শাসনব্যবস্থাকে দুটি পর্বে বিভক্ত করে আলোচনা করতে হবে। এর প্রথম পর্বে
খলজী মালিকদের শাসন, আর দ্বিতীয় পর্বে স্বাধীন সুলতানদের শাসন। আর এই দুই পর্বের শাসকদের
শাসনব্যবস্থার বিশ্লেষণ করলে সুলতানি আমলে বাংলার শাসনব্যবস্থার একটি সাধারণ রূপরেখা পাওয়া
যাবে।
খলজী মালিকদের শাসন
ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে অর্থাৎ ১২০৪ সালে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর নেতৃত্বে বঙ্গ
বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটে। বখতিয়ার খলজী প্রথমে নদীয়া জয় করেন এবং
পরবর্তীতে লখনৌতি অধিকার করেন। লখনৌতি অধিকারের ফলে বরেন্দ্রভ‚মির বিরাট এলাকা তাঁর হস্তগত
হয় এবং এই বিস্তীর্ণ এলাকা শাসনের জন্য তাঁকে এক সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করতে হয়।
নদীয়া জয়ের পূর্বে বখতিয়ার খলজী ভিউলী ও ভাগওয়াত নামক দুটি পরগণার শাসক ছিলেন। নদীয়া
জয়ের পরেও তিনি নিজেকে কুতুবউদ্দিন আইবকের অমাত্যরূপে গণ্য করতেন। কারণ তিনি দিল্লিতে অনেক
উপঢৌকন পাঠান। আবার সুলতান মুহাম্মদ বিন সামের নামে মুদ্রা জারি করেন এবং খোৎবা পাঠের ব্যবস্থা
করেন। যেহেতু দিল্লির কুতুবউদ্দিন আইবক মুহাম্মদ বিন সামের প্রতিনিধি ও সেনাপতি ছিলেন, সেহেতু
বখতিয়ার খলজী কুতুবউদ্দিন আইবকের প্রতিও আনুগত্য প্রদর্শন করেন। তিনি লখনৌতিতে রাজধানী
স্থাপন এবং তিব্বত অভিযানের পূর্বে নব বিজিত রাজ্যকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে শাসনকর্তা নিযুক্ত
করেন। এই অংশগুলোকে ‘ইক্তা' এবং এর শাসনকর্তাকে ‘মুক্তা' বলা হতো। আলী মর্দান খলজীকে
বারসৌলের মুক্তা ও ইওয়াজ খলজীকে গঙ্গাতরীর মুক্তা নিযুক্ত করা হয়। কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর
গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজীর অধীনে বাংলার মুসলিম রাজ্য সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে পড়ে।
ইলতুৎমিশের রাজত্বকালে বাংলার স্বাধীনতার পরিসমাপ্তি ঘটে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে এবং ১২৮৭ পর্যন্ত এটি
দিল্লির অধীনস্থ প্রদেশরূপেই ছিল। অবশ্য কিছুদিনের জন্য দিল্লি কর্তৃক নিযুক্ত শাসনকর্তা মুগিসউদ্দিন
ইউজবেক ও মুগিসউদ্দিন তুঘ্রিল স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বলবন বাংলা জয় করে তাঁর পুত্র বুঘরা খানকে
এখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং অন্যান্য ইক্তায় মুক্তা নিয়োগ করেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন
বলবনের মৃত্যুর পর বুগ্রা খান বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরবর্তী সুলতান রুকনউদ্দিন কায়কাউস


ও শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন এবং এই সময়ে বাংলায় মুসলিম রাজ্যের
ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে।
স্বাধীন সুলতানদের আমল
স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলার মুসলমান রাজ্য ‘বাংলা' নামে পরিচিতি লাভ করে। এই সময়ে বাংলায়
মুসলমান শাসন বিস্তৃত হয়। সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ সর্বপ্রথম সারা বাংলা একীভ‚ত এবং একক
শাসনভুক্ত করেন। তাঁর সময় থেকে শেরশাহের সময়ের কয়েক বছর বাদ দিয়ে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত বাংলা
স্বাধীন ছিল। এই দীর্ঘ স্বাধীন সময়ে বাংলায় একটি নিজস্ব ও স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। নি¤েœ এই
সময়ের শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন দিকে তুলে ধরা হলোÑ
(ক) সুলতান
বাংলার সুলতানগণ বিভিন্ন উপাধি গ্রহণ করতেন এবং মুসলিম জাহানের অধিকর্তা খলিফার প্রতি আনুগত্য
প্রকাশ করতেন। বাংলায় সুলতানরা যেমন ‘সুলতান-উল-আজম' বা ‘সুলতান-উল-আদিল' প্রভৃতি উপাধি
গ্রহণ করতেন, তেমনিভাবে তাঁরা খলিফার প্রতি আনুগত্যের নিদর্শনসূচক ‘নাসির-ই-আমীর-উল-মোমেনীন
(বিশ্ববাসীদের নেতার সাহায্যকারী), ‘ইয়ামীন-ই-খলিফত-উল্লাহ' (আল্লাহ্র প্রতিনিধির ডান হাত) ইত্যাদি
উপাধি গ্রহণ করতেন। খিলাফতের প্রতি আনুগত্য থাকলেও এই আনুগত্য ছিল সম্পূর্ণ মৌখিক এবং
দলিলপত্রে। প্রকৃতপক্ষে বাংলার সুলতানরা সকলেই সার্বভৌম ছিলেন এবং তাঁরা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা
করেন। তবে তাঁরা মুসলমানদের কাছে নিজেদের ইসলামের ধারক ও বাহক রূপে প্রকাশ করার চেষ্টা
করতেন। ইসলামি আইন ও ইসলামি শাস্ত্রকে তাঁরা সম্মান করতেন।
সুলতানি আমলে বাংলার সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সুলতান। তিনি উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে নিয়োগ
করতেন। তিনি আইন প্রণয়ন করতেন এবং শাসন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তিনি বিচার বিভাগেরও কর্তা
ছিলেন। সুলতানরা সাধারণত ইসলামের বিধি বহির্ভুত কোন আইন প্রণয়ন করতেন না। তাছাড়া মুসলমান
ও ইসলামের উন্নতি বিধান করাও সুলতানের দায়িত্ব ছিল বলে মনে হয়।
সুলতান যে প্রাসাদে অবস্থান করতেন সেখানে হাজিব, সিলাহদার, শরাবদার, জমাদার এবং দ্বারবাস প্রভৃতি
কর্মচারী নিযুক্ত থাকতো। এসব পদস্থ কর্মচারীর বাইরে নিযুক্ত থাকতো অসংখ্য দাস-দাসী। দাস-দাসীদের
মধ্যে হাবশীদের সংখ্যাই ছিল বেশি।
(খ) অমাত্যবর্গ
বাংলার সুলতানগণ সর্বদা ‘আমীর' বা ‘মালিক' প্রভৃতি উপাধিধারী অমাত্যদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন।
এই অমাত্যশ্রেণীর সকলেই বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ পদে নিযুক্ত থাকতেন। এঁরা যুদ্ধ, শান্তি বা অন্যান্য কাজে
সুলতানকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন এবং সক্রিয়ভাবে এসব কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতেন।
সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্বাচন প্রশ্নে এই শ্রেণী গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতেন। তাঁদের পছন্দ-অপছন্দ
প্রভৃতির প্রতি সকলেই শ্রদ্ধা দেখাতে বাধ্য ছিলেন।
(গ) উজির
সুলতানি আমলে বাংলার শাসনব্যবস্থায় সুলতানের পরেই যার সর্বাধিক গুরুত্ব ও প্রভাব ছিল, তিনি হলেন
উজির। অনেক সময় সুলতান দুর্বল হলে বা রাজধানীর বাইরে গেলে উজিরই শাসনকার্য পরিচালনা
করতেন। অনেকে সুলতানের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সিংহাসনে আরোহণও করেন, যেমন, রাজা গণেশ ও
হোসেন মক্কী প্রমুখ সিংহাসন অধিকারে সমর্থ হন। সাধারণত উজির সাধারণ শাসন ও রাজস্ব শাসনের


কর্ণধার ছিলেন। তবে বাংলার উজিরদের নানারকম কর্তব্য ও দায়িত্ব ছিল এবং একই ব্যক্তি এক সঙ্গে
উজির, সর-ই-লস্কর ইত্যাদি কয়েকটি দফতরের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন।
(ঘ) রাজস্ব বিভাগ
সুলতানি আমলে বাংলায় একটি স্বতন্ত্র রাজস্ব বিভাগ ছিল। আর এই সময়ে রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল
গণিমৎ, ভ‚মি, রাজস্ব, বাণিজ্য শুল্ক এবং আবগারি প্রভৃতি। এই আমলে গণিমৎ থেকে রাজস্বের একটি অংশ
এলেও এর প্রধান উৎস ছিল ভ‚মি রাজস্ব। জমির উৎপাদিত ফসলের এক-পঞ্চমাংশ ভ‚মি রাজস্ব হিসেবে
প্রদান করতে হতো।
সুলতানি আমলে বাংলার রাজস্ব বিভাগের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল বাণিজ্য শুল্ক। এ সময়ে বাংলা
ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক অগ্রসর ছিল। বিশেষ করে পর্তুগিজ নাবিকদের আগমনের ফলে বাংলার রপ্তানি
বাণিজ্য বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। বাণিজ্য কর ব্যতিত হাটকর, পথকর এবং ঘাটকরের উল্লেখও বিভিন্ন
সাহিত্যিক সূত্রে পাওয়া যায়। তবে বাংলার সুলতান কর্তৃক জিজিয়া কর আদায়ের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়
না।
(ঙ) সামরিক বিভাগ
সুলতানি আমলে বাংলার সুলতানদের শক্তির মূল ভিত্তি ছিল সামরিক বিভাগ। অমুসলিম অধ্যুষিত এই
অঞ্চলে দক্ষ সামরিক বাহিনীর জোরেই সুলতানগণ তাঁদের শাসন ক্ষমতা সুচারুরূপে পরিচালনা করতে সক্ষম
হতেন। তাছাড়া দিল্লির সুলতানদের সম্প্রসারণ নীতির বিরুদ্ধে বাংলার সুলতানদের সব সময় সতর্ক থাকতে
হতো। প্রকৃতপক্ষে দিল্লির সুলতানগণ সুযোগ পেলেই বাংলা আক্রমণ করতেন। সর্বোপরি কামরূপ, ত্রিপুরা,
আরাকান প্রভৃতি পার্শ্ববর্তী শক্তির সাথে বাংলার সুলতানদের প্রায়ই বিরোধ লেগে থাকতো। তাদের প্রতি
সতর্ক দৃষ্টি রাখতেও সৈন্যবাহিনী প্রয়োজন ছিল। প্রকৃতপক্ষে রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্যই সামরিক বাহিনীর
প্রয়োজনীয়তা ছিল অপরিহার্য।
সুলতানি আমলে অশ্বারোহী, পদাতিক ও হস্তিবাহিনীর সমন¦য়ে সেনাবাহিনী গঠিত হতো। সুলতান নিজেই এ
বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। তবে সুলতান ভিন্ন ভিন্ন যুদ্ধের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সেনাপতি নিয়োগ করতেন।
যদিও অশ্বারোহী বাহিনীই সুলতানি বাহিনীর মূল শক্তি ছিল, তবে বর্ষাকালে এ বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তো।
বর্ষাকাল ও নদীর কথা বিবেচনা করেই সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজী সর্বপ্রথম নৌবাহিনী গঠন
করেন। এবং এরপর থেকে মুসলিম শাসনের শেষ অবধি নৌবাহিনী ছিল সামরিক বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ
অঙ্গ। সুলতানি আমলে যুদ্ধে তীর, ধনুক, নেজা (বর্শা), খঞ্জর এবং সামশীর (তরবারি) ইত্যাদি যুদ্ধাস্ত্র
ব্যবহৃত হতো। দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য সুলতানরা দুর্গ নির্মাণ করতেন।
(চ) বিচার বিভাগ
সুলতানি আমলে বাংলায় একটি স্বতন্ত্র বিচার বিভাগ ছিল। এই সময়ে বাংলায় শরীয়ত আইন বলবৎ ছিল।
সুলতানের মধ্যে অনেকেই জ্ঞানী ও ন্যায় বিচারক ছিলেন। তবে সুলতানের অধীনে দৈনন্দিন বিচারের ভার
কাজির ওপর ন্যস্ত ছিল। শহরে ও গ্রামে কাজি নিযুক্ত হতেন। আলেম বা জ্ঞানীরা বিচার বিষয়ে কাজিদের
সাহায্য করতেন। কোন কোন সুলতান নিজেদের বিরুদ্ধেও কাজির বিচার মেনে নিতেন। মুসলমান আমলে
দেশরক্ষা ও রাজস্ব আদায় ছাড়া অন্যান্য ব্যাপারে গ্রামগুলো পুরোপুরি স্বায়ত্ত¡শাসিত ছিল। গ্রামের
পঞ্চায়েতই গ্রামের শান্তি রক্ষার এবং সামাজিক ক্রিয়াকলাপের ভার নিতো। এ সকল ব্যাপারে সামাজিক
আইন চালু ছিল, বিশেষ করে হিন্দুদের সামাজিক ব্যাপারে হিন্দু আইন প্রচলিত ছিল।
(ছ) প্রাদেশিক ও স্থানীয় শাসন


সুলতানি আমলে বাংলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিভিন্ন ইউনিটে বিভক্ত হয়ে পরিচালিত হতো। গুরুত্বপূর্ণ দুটি
প্রশাসনিক ইউনিট ছিল ইকলিম এবং আরছা। ইকলিমকে বর্তমান সময়ের বিভাগ এবং আরছাকে বর্তমান
সময়ের জেলার সঙ্গে তুলনা করা যায়। ইকলিম এবং আরছার ভারপ্রাপ্ত অফিসারদের পদবি একই রকমের।
বিভিন্ন সূত্রের উল্লেখ থেকে জানা যায় যে, উজির, সর-ই-লস্কর, জামাদার-ই-গাহির মুহল্লী নামক
পদবিধারীরাই ইকলিম ও আরছার শাসক ছিলেন। লিপি ও মুদ্রাসূত্রে শহর, কসবা, এবং খিত্তা নামের আরো
কয়েকটি প্রশাসনিক ইউনিটের নাম পাওয়া যায়। তবে এই তিনটি নাম প্রায় সমার্থক। শহর শব্দের অর্থ
শহর বা নগর; কসবা এমন এক নগর যার রক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় নয় এবং খিত্তা যার রক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ়। তবে
মনে হয় শহরের সাথে কসবা এবং খিত্তার পার্থক্য এই যে, শহর ব্যবসাকেন্দ্র, কসবা এবং খিত্তা সামরিক
কারণে গঠিত নগর বিশেষ। এই হিসেবে কসবা এবং খিত্তাকে সামরিক ছাউনির সঙ্গে তুলনা করা যায়।
খিত্তা হয়তো স্থায়ী সামরিক ছাউনিকে বলা হতো, এবং অস্থায়ী সামরিক ছাউনিকে কসবা বলা হতো। শহর,
কসবা এবং খিত্তা উজির এবং সর-ই-লস্কর-এর অধীনে ছিল। এই আমলের আরেকটি প্রশাসনিক ইউনিট
ছিল থানা, থানাও সর-ই-লস্করের অধীনে ছিল। আবার কয়েকটি মহালের সমন¦য়ে শিক গঠিত হতো। এই
শিকের শাসনকর্তাকে বলা হতো শিকদার।
সুলতানি আমলের শিক্ষাব্যবস্থা
সুলতানি আমলে বাংলায় শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। সুফি-দরবেশ এবং আলেম-উলামাগণ মুসলমানদের
মধ্যে আর পন্ডিতগণ হিন্দুদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত ছিলেন। এই আমলে বাংলায় অসংখ্য মাদ্রাসা
গড়ে ওঠে।
মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা কয়েকটি স্তরে বিভক্ত ছিল। তাদের প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রকে বলা হতো ‘মকতব'।
সাধারণত গ্রামের মসজিদে এসব মক্তব বসতো। কখনো কখনো কোন ব্যক্তির গৃহেও প্রাথমিক শিক্ষার কাজ
চলতো। প্রতিটি মুসলমান বালক-বালিকা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতো। কারণ শিক্ষা মুসলমানদের ধর্মীয়
অনুশাসনের সাথে সম্পৃক্ত। অন্যদিকে হিন্দুদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ছিল পাঠশালা। সাধারণত গ্রামের
কোন শিক্ষিত যুবক এসব পাঠশালা চালাতো।
হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার কেন্দ্র ছিল যথাক্রমে টোল ও মাদ্রাসা।
সুলতানি বাংলায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বা বেসরকারি উদ্যোগে অসংখ্য মাদ্রাসা গড়ে ওঠে। এসব
মাদ্রাসায় ইসলাম ও শরীয়া বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা প্রদান করা হতো। সাধারণত প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা
পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষা ছিল অবৈতনিক। ছাত্রদের থাকা-খাওয়া সব কিছু বিনামূল্যে পরিচালিত হতো।
অন্যদিকে হিন্দুদের উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র টোলে সংস্কৃত বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা দেওয়া হতো। এখানে বেদ, পুরাণ
ইত্যাদি পড়ানো হতো। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি গুরুর গৃহে থেকে শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করতো। নবদ্বীপ
ছিল হিন্দুদের উচ্চ শিক্ষার বিখ্যাত কেন্দ্র। এখানে বাংলা এমন কি বাংলার বাইরে থেকে আগত হাজার
হাজার ছাত্র শিক্ষা গ্রহণ করতেন। তবে হিন্দুদের মধ্যে শিক্ষার সুযোগ সবার জন্য অবারিত ছিল না, অন্তত
মুসলমানদের আসার আগ পর্যন্ত। তবে সুলতানি আমলে এর কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে সবার জন্য
শিক্ষা প্রয়োজন - এই বোধ অনেকের মধ্যে দেখা যায়।
কতিপয় মুসলিম শিক্ষা কেন্দ্র
জ্ঞানার্জনে মুসলমানদের গভীর অনুরাগ, ইসলামি শিক্ষার উন্নয়নে শেখ ও উলেমাদের উদ্যম, শিক্ষিত ও
সংস্কৃতিবান শাসনকর্তাদের পন্ডিত, কবি, বিদ্বান ব্যক্তি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি উদার পৃষ্ঠপোষকতা
ইত্যাদির ফলে বাংলায় উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ আসে। শহরের প্রধান প্রধান অঞ্চলসমূহে
উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মসজিদগুলোকে কেন্দ্র করে বহু মাদ্রাসা গড়ে ওঠে। সুলতান ও আমিরওমরাহরা মাদ্রাসা স্থাপন ও এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আগ্রহ প্রদর্শন করেন এবং প্রচুর দানের ব্যবস্থা
করেন। তাঁদের সাহায্য সহযোগিতায় গড়ে ওঠা উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে লক্ষণাবতী বা গৌড়ে


প্রতিষ্ঠিত দরাসবাড়ি মাদ্রাসা বিখ্যাত। কাজি রুকনউদ্দিন সমরকন্দীসহ আরো বহু পন্ডিত গৌড়ে শিক্ষা
বিস্তারের কাজে নিবৃত্ত ছিলেন। এরপর মহিসুল যা বর্তমান রাজশাহী জেলার মহিসন্তোষ নামে খ্যাত -
এখানে মুসলিম শিক্ষার উচ্চ কেন্দ্র ছিল। বিখ্যাত সুফি পন্ডিত এহিয়া মানেরী, মাওলানা তকিউদ্দিন আরাবী,
মহিসুল শিক্ষাকেন্দ্র থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। সুলতানি আমলে সোনারগাঁও এবং সাতগাঁও উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র
ছিল। সোনারগাঁও-এর শিক্ষাকেন্দ্র অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী মাওলানা শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার
অধীনে পরিচালিত হতো। বাংলার বাইরে থেকে এসেও অনেক ছাত্র এখানে অধ্যয়ন করতো। তাছাড়া
পান্ডুয়া এবং রাজশাহীর বাঘা প্রভৃতি স্থানে মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষার কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
সুলতানি আমলে বাংলার অর্থনীতি
কৃষি
সুলতানি আমলে বাংলা অর্থনৈতিক জীবনে নিশ্চিতরূপে যথার্থ অগ্রগতি লাভ করে। পাল ও সেন রাজাদের
সময়ে বাংলার স্বর্ণমুদ্রা, এমনকি রৌপ্যমুদ্রাও অনুপস্থিত ছিল। মুসলমান শাসনের শুরু থেকে এদেশে স্বর্ণ ও
রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন ছিল। এটা মুসলমান আমলে বাংলায় অর্থনৈতিক উন্নতির সাক্ষ্য দেয়। এ আমলে
বাংলায় উন্নত কৃষি, শিল্প এবং ব্যাপক বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রচলন ছিল।
বাংলা একটি নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য নদ-নদী এবং ঋতুমাফিক বৃষ্টিপাত ও প্রাকৃতিক সেচ ব্যবস্থার ফলে
বহু শতাব্দীব্যাপী বাংলার সমতলভ‚মি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উর্বর অঞ্চল ছিল। ভ্রমণকারীগণ বাংলার
মাটির অসাধারণ উর্বরতা লক্ষ করেছেন। এই উর্বরতা প্রচুর শস্য, শাক-সব্জি এবং ফলমূল উৎপাদনে
সহায়তা করে। ধান ছিল প্রধান কৃষিজাত দ্রব্য। বাংলায় নানা রকমের ধান উৎপন্ন হতো। দেশের প্রয়োজন
মেটানোর পর প্রচুর ধান বা চাল বিদেশে রপ্তানি করা হতো। রপ্তানিযোগ্য আরেকটি শস্য ছিল ইক্ষু। এটিও
প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হতো। অন্যান্য ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল লাক্ষা, তুলা, মরিচ, সরিষা ইত্যাদি।
বাংলায় উৎপন্ন অন্যান্য ফসলের মধ্যে পাট ও গুটি পোকার চাষ তথা রেশম ছিল অন্যতম। মুসলিম
আমলের প্রথম দিকে খুবসম্ভবত চীন থেকে গুটি পোকা আনা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে বাংলায় এর উৎপাদন
প্রচুর পরিমাণে হতো এবং রেশমি বস্ত্র বিদেশে রপ্তানি হতো।
শিল্প
সুলতানি আমলে বাংলায় শিল্প-কারখানার প্রভ‚ত অগ্রগতি সাধিত হয়। বাংলার শিল্পের মধ্যে বয়ন শিল্প ছিল
অন্যতম। সূক্ষ সুতিবস্ত্রের সুনাম ও চাহিদা ছিল জগৎজোড়া। সবচেয়ে সূক্ষ ও উন্নতমানের সুতিবস্ত্রের নাম
ছিল ‘মসলিন'। এটি ছাড়াও নানা নামের এবং মানের সুতি ও রেশমিবস্ত্র বাংলায় উৎপন্ন হতো। মসলিন ও
রেশম শিল্প মুসলিম শাসক, অভিজাত ও ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রসার লাভ করে। বাংলায় ইক্ষুর
উৎপাদন ছিল অত্যন্ত ব্যাপক। এই ইক্ষু হতে চিনি উৎপাদিত হতো। মুসলমান আমলে চিনি উৎপাদন
একটি প্রধান শিল্পে উন্নীত হয়। চিনির মতো লবণ ছিল আরেকটি প্রধান শিল্প। সমুদ্রের পানি এবং লবণাক্ত
মাটি থেকে লবণ উৎপাদিত হতো। এছাড়া জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও বাংলার গৌরবজনক ঐতিহ্য ছিল।
বাণিজ্য
সুলতানি আমলে ব্যবসা-বাণিজ্যের বহুল সম্প্রসারণ ঘটে। কৃষিজ ও শিল্পজাত দ্রব্যের প্রচুর উদ্বৃত্ত ব্যাপক
বাণিজ্যের অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। মুসলিম শাসনের শুরুতে চট্টগ্রাম, সাতগাঁও প্রভৃতি সমুদ্রবন্দর দিয়ে
বাংলায় উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি হতো। আর রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল সুতিবস্ত্র, চাউল, চিনি, রেশম, আদা,
মরিচ, লাক্ষা, হরিতকী ইত্যাদি। বিপুল পরিমাণ রপ্তানির জন্য বাংলায় বৈদেশিক বাণিজ্য খুবই অনুক‚ল
ছিল। সাধারণ প্রয়োজনীয় দ্রব্য বাংলায়ই উৎপাদিত হতো বাংলায়ই সমগ্র সুলতানি আমলে বাংলায় এই
ব্যাপক অনুক‚ল বাণিজ্য বজায় ছিল।


স্থাপত্য শিল্প
সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য শিল্প এই এলাকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারার ওপর ভিত্তি করে গড়ে
ওঠে। এর ফলে বাংলার স্থাপত্য শিল্পে একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। এই প্রদেশের স্থাপত্য শিল্প এর
মাটির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সম্পর্কযুক্ত ও স্থানীয় রীতিনীতির সাথে মুসলিম চিন্তাধারার সমঝোতারই ফল।
ভারতীয় উপমহাদেশ জয় করার পূর্ব থেকেই মুসলমানদের নিজস্ব উন্নত স্থাপত্যশিল্প ছিল। এটা ছিল পশ্চিম
ও মধ্য এশিয়ার স্থাপত্যশিল্পের ঐতিহ্য। কিন্তু মুসলিম নির্মাতাগণকে উপমহাদেশে স্থাপত্য নির্মাণ করতে
স্থানীয় ও সহজলভ্য মাল-মসলা ও রাজমিস্ত্রির ওপর নির্ভর করতে এবং পরিবেশের ওপর নজর রাখতে
হয়েছে।
বাংলার স্থাপত্যশিল্প ভ‚মির প্রকৃতি, আবহাওয়া ও সহজলভ্য উপাদানের দ্বারা নির্মিত হয়। কাদামাটির
সহজলভ্যতার কারণে এখানকার স্থাপত্য নির্মিত হতো ইট দ্বারা। ইটের সাথে অলংকরণের জন্য ব্যবহৃত
হতো টেরা-কোটা। টেরা-কোটাকে অলঙ্কৃত পোড়ামাটির ফলক বলা যায়। এটি বাংলার নিজস্ব শিল্প এবং
এগুলো তৈরিতে শিল্পীরা পারিপার্শ্বিকতা থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করতো।
বাংলা অঞ্চলের ঘর-বাড়িগুলো দুই ধরনের উপাদানে নির্মিত হতো। একটির নির্মাণ উপকরণে ব্যবহৃত হতো
বাঁশ ও ছন এবং অন্যটিতে ব্যবহৃত হতো ইট। বাঁশের তৈরি ঘরের ছাদ ছিল বক্রাকার। পরবর্তীতে
মুসলমানরা তাদের ইট নির্মিত ভবনেও বক্রাকার ছাদ সংযোজন করে।
সুলতানি আমলে নির্মিত বাংলার স্থাপত্যসমূহের মধ্যে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, মালদহের গুণমন্ত
মসজিদ ও জামে-ই-মসজিদ, পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ত্রিবেণী, সাতগাঁও এবং হুগলী
জেলার ছোট পান্ডুয়ায় নির্মিত অট্টালিকাগুলো ছিল সুলতানি স্থাপত্যের গঠন পর্ব। সমাধি সৌধের মধ্যে এক
লাখী সমাধি প্রধান। গৌড়ে অবস্থিত দাখিল দরওয়াজা ও তাঁতীপাড়া মসজিদও সুলতানি স্থাপত্যের
উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।


সারসংক্ষেপ
বাংলার ভৌগোলিক অবস্থা এ অঞ্চলের অধিবাসীদের ওপর নানাবিধ প্রভাব বিস্তার করেছে। সুলতানি
আমলে বাংলার আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক অবস্থার ওপরও এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব
অনুভ‚ত হয়। বাংলার সঙ্গে মুসলমানদের প্রাথমিক যোগাযোগ এবং এরপর এ অঞ্চলে ইসলামের
বিস্তার মধ্যযুগের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান ঘটনা। অত:পর ইসলাম বাংলার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত
হয়ে বিশেষ রূপে প্রকাশিত হয়। অত্র অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনাচারের অনেক উপাদান নিয়েই
এখানে বাঙালি মুসলমানদের উত্থান ঘটে। শ্রীচৈতন্য মধ্যযুগে হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি বন্ধের উদ্যোগ নেন
এবং সমূহ ধ্বস থেকে বাংলার হিন্দুদের রক্ষা করেন। প্রশাসনিক দিক থেকে বাংলায় মুসলমানদের
হাতে বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়। প্রাদেশিক এবং স্থানীয়ভাবে সুবিন্যস্ত শাসন কাঠামো গড়ে ওঠে।
মুসলমানদের অধীনে বেশ কিছু শিক্ষাকেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। অবশ্য এসব স্থানে
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হয়। সুলতানি আমলে বাংলার আর্থ-বাণিজ্যিক জীবন
যথার্থ অর্থেই অগ্রগতি লাভ করে। ঐতিহাসিকদের মতে, এ আমলে বাণিজ্য ছিল বাংলার অনুক‚লে।
স্থাপত্য শিল্প এবং সামগ্রিকভাবে শিল্পকলার ক্ষেত্রেও স্থানীয়ভাবে ‘বঙ্গীয় মুসলিম রীতি' বিকশিত হয়।
এক্ষেত্রে মুসলমান শাসকদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা অনস্বীকার্য।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। প্রথম আদমশুমারীর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়Ñ
(ক) ১৮৮১ সালে (খ) ১৮৯১ সালে
(গ) ১৮৭২ সালে (ঘ) ১৮৮২ সালে।
২। কোন শতাব্দীতে সবচাইতে বেশি সুফি বাংলায় আসেন?
(ক) ত্রয়োদশ শতাব্দীতে (খ) চতুর্দশ শতাব্দীতে
(গ) পঞ্চদশ শতাব্দীতে (ঘ) দ্বাদশ শতাব্দীতে।
৩। পাঁচপীরের দরগাহ কোথায় অবস্থিত?
(ক) সোনারগাঁ (খ) চট্টগ্রাম
(গ) সিলেট (ঘ) ঢাকা।
৪। শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা কোন শিক্ষাকেন্দ্রে নিয়োজিত ছিলেন?
(ক) সোনারগাঁ (খ) সাতগাঁও
(গ) দরাসবাড়ি (ঘ) পান্ডুয়া।
৫। ‘শিক' গঠিত হতোÑ
(ক) থানার সমন¦য়ে (খ) মহালের সমন¦য়ে
(গ) কসবার সমন¦য়ে (ঘ) আরছার সমন¦য়ে।
৬। ইক্তার শাসনকর্তাকে বলা হতোÑ
(ক) ইক্তাদার (খ) সর-ই-লস্কর
(গ) শিকদার (ঘ) মুক্তা।
৭। ‘দাখিল দরওয়াজা' কোথায় অবস্থিত?
(ক) গৌড় (খ) পান্ডুয়া
(গ) সোনারগাঁ (ঘ) সাতগাঁও।


সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। সুলতানি আমলের বাংলায় হিন্দুদের সামাজিক অবস্থা বিবৃত করুন।
২। সুলতানি আমলের শিক্ষাব্যবস্থার বিবরণ দিন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। বাংলায় ইসলাম বিস্তার এবং মুসলমান সমাজ গঠনে সুফি ও সুলতানদের ভ‚মিকা মূল্যায়ন করুন।
২। সুলতানি বাংলার শাসন ব্যবস্থার চিত্র অংকন করুন।
৩। মধ্যযুগে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক জীবন ও শিল্পকলা সম্পর্কে আপনার মতামত ব্যক্ত করুন।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। আবদুল করিম, বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাস।
২। আবদুর রহিম, বাংলার মুসলমানদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস।
৩। গ.জ. ঞধৎধভফধৎ, ঐঁংধরহ ঝযধযর ইবহমধষ.
৪। মমতাজুর রহমান তরফদার, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক।
৫। ঔধফঁহধঃয ঝধৎশধৎ (বফ.), ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ. ঠড়ষ-ওও.
৬। রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ)।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]