গণতন্ত্র কী? উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতন্ত্র রক্ষার উপায়গুলো লিখ ।

গণতন্ত্র কী? গণতন্ত্রের ধারা বজায় রাখতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে লিখ। অথবা, গণতন্ত্র কী? গণতন্ত্রের সফলতার শর্তাবলি কী কী লিখ ৷
উত্তরা ভূমিকা : বর্তমান সময় হলো গণতন্ত্রের জন্য স্বর্ণময় সময়। গণতন্ত্র বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় একটি আলোচিত শব্দ। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আফ্রিকান দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের জন্ম হলেও আজ পর্যন্ত এটা বিশ্বের বুকে সবচেয়ে উত্তম শাসনব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এ উত্তম শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে কিছু শর্ত পালন করতে হয়, যা গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ।
গণতন্ত্র : ইংরেজি 'Democracy' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো গণতন্ত্র। এ শব্দটি গ্রিক শব্দ 'Demos kratia' থেকে এসেছে। যার অর্থ যথাক্রমে জনগণ ও ক্ষমতা। সুতরাং উৎপত্তিগত অর্থে গণতন্ত্র হলো জনগণের ক্ষমতা বা মামিন। আধুনিককালে ‘গণতন্ত্র' বলতে এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থাকে বুঝায়, যেখানে জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে তাদের কয়েকটি সংজ্ঞা
উপস্থাপন করা হলো :
সি. এফ. স্টোন বলেছেন, “শাসিতের সক্রিয় সম্মতির উপর যে সরকার প্রতিষ্ঠিত তাকে গণতন্ত্র বলে।" অধ্যাপক সেলি বলেছেন, “গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ আছে।" আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, "Democracy is a government of the people, by the people and for the
people. "
সুতরাং একথা বলা যায় যে, গণতন্ত্র হলো এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং জনগণই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসন কাজে অংশ নিয়ে থাকে ।
গণতন্ত্রের সফলতার উপায় বা শর্তাবলি : হেনরি মেইনের মতে, "Of all the forms of government democracy is by for the most difficult." কেননা সর্বোৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হওয়া সত্ত্বেও গণতন্ত্রের সফলতার জন্য কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করা উচিত। সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে গণতন্ত্রকে বাস্তবায়ন ও যথার্থভাবে উপযোগী করা সম্ভব হবে। বর্তমানে গণতন্ত্র অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাই এর সফলতার শর্তগুলোর প্রতি মনোযোগ দেয়া দরকার। উন্নয়নশীল তথা আফ্রিকাসহ তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে নিম্নোক্ত শর্ত বা পন্থা অবলম্বন করতে হবে :
১. শিক্ষার প্রসার : ম্যাকাইভার বলেছেন, অশিক্ষিত ও অসচেতন জনগণের নিকট গণতন্ত্র বিভিন্নভাবে হীনকর্ম সম্পাদনের ও জঘন্য স্বেচ্ছাচার অনুষ্ঠানের বিরাট আবরণস্বরূপ এবং অগ্নিবর্ষী বক্তা জনগণের নির্বুদ্ধিতার আবেদন করে তাদের আবেগ উৎসারিত করেছেন। কাজেই গণতন্ত্রের সফলতার প্রথম ও প্রধান শর্ত জনগণকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা। এজন্য প্রয়োজন ব্যাপক শিক্ষার প্রসার।
২. গণতান্ত্রিক জনগণ : মিলের মতে, গণতান্ত্রিক জনগণের উপর গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে। গণতান্ত্রিক জনগণের জন্য পুঁথিগত শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা ও ভাবধারা যতই বিস্তার লাভ করবে গণতন্ত্র ততই সাফল্যের পথে এগিয়ে যাবে ।
৩. সহিষ্ণুতা : গণতন্ত্রে সকলেই যাতে নিজ নিজ মতাদর্শ প্রচার করতে পারে, ইচ্ছানুযায়ী যে কোন আদর্শকে সমর্থন করতে পারে, সেজন্য অনুকূল পরিবেশের প্রয়োজন। এ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন আত্মসংযম এবং সহিষ্ণুতার। সরকারকে মান্য করা যেমন বিরোধীদলের কর্তব্য, ঠিক তেমনি বিরোধী পক্ষের মতামতকে যথাযোগ্য মর্যাদা দান করা সরকারের কর্তব্য। এ পরম সহিষ্ণুতা ও বুঝাপড়া না থাকলে গণতন্ত্র সফল হতে পারে না।
৪. গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য : গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য না থাকলে গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। কেননা গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য না থাকলে গণতন্ত্রের স্বরূপ ও সার্থকতা যথার্থভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ফলে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে জনগণ অবতীর্ণ হতে পারে না ।
৫. ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ : গণতন্ত্র সফলতার জন্য ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ একান্ত প্রয়োজন। লর্ড ব্রাইস বলেছেন, গণতান্ত্রিক ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন একান্ত প্রয়োজন ।
৬. সুযোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব : সুমপিটার এর মতে, গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন ন্যায়পরায়ণ, যুক্তিবাদী এক বিবেকবান নেতৃত্ব। মনের সংকীর্ণতা দূর করে জনগণকে সুষ্ঠু পথে পরিচালিত করার জন্য সৎ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রয়োজন ।
৭. অর্থনৈতিক সাম্য : গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য অর্থনৈতিক সাম্যের প্রয়োজন। লাস্কি বলেছেন, “কেবল রাজনৈতিক
ও সামাজিক অধিকারসমূহ স্বীকৃত হলেই গণতন্ত্রের সাফল্য আসে না। এর জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা।”
৮. রাজনৈতিক দল : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল 'বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল
জনগণকে রাজনৈতিক দীক্ষা দান করে এবং সুষ্ঠু নীতি নির্ধারণ করে গণতন্ত্রকে সফল করে।
৯. বহুদলীয় ব্যবস্থা : গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে একদলীয় বা দ্বিদলীয় ব্যবস্থা নয়, বরং বহুদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
১০. আইনের শাসন আইনের শাসন বলতে আইনের চোখে সবাই সমান, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তাই আইন সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। গণতন্ত্রের সফলতার জন্য আইনের শাসন প্রয়োজন ।
১১. জাতীয় স্বার্থের প্রাধান্য: জাতীয় স্বার্থের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত না হলে বিভিন্ন দল এবং গোষ্ঠীর অবাধ প্রতিযোগিতায় জাতীয় কল্যাণ ব্যাহত হতে পারে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষতবিক্ষত হয়। তাই গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য জাতীয় স্বার্থের প্রাধান্য থাকা চাই।
১২. ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা : গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা। সামাজিক সমস্যা ও রাজনৈতিক সংকট নিরসন করতে হলে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
১৩. নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক আমলাতন্ত্র : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমলাদের উপর নির্ভরশীল। তাই গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক আমলাতন্ত্র থাকা প্রয়োজন।
১৪. সুষ্ঠু জনমত : জনমত যে কোন শাসনব্যবস্থার মূলভিত্তি। গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে সুষ্ঠু জনমত গঠনের পরিবেশ সৃষ্টি হতে হবে।
১৫. নাগরিকদের স্বাধীনতা : নাগরিকদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রদান গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম পূর্বশর্ত।
১৬. সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ : সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য দূর করে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করতে
গণতন্ত্র সফল হবে।
১৭. মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ : জনগণের বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাঁচার অধিকার, অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা অর্থাৎ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সফল করা সম্ভব।
১৮. কৃষ্টিগত স্বকীয়তা : গণতন্ত্রের সফলতার জন্য নিজস্ব কৃষ্টির বিকাশ ও প্রসার ঘটানো দরকার। উন্নত বিশ্বের কৃষ্টির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে গণতন্ত্রের সাফল্য আনা সম্ভব হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, গণতন্ত্র সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা এবং জনগণই শাসনক্ষমতার অধিকারী। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের জন্ম হলেও আজ পর্যন্ত এটা বিশ্বের বুকে সবচেয়ে উত্তম শাসনব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সজাগ থাকলে গণতন্ত্র সাফল্য অর্জন করবে।

ইউরোপীয় গণতন্ত্রের সাথে আফ্রিকান গণতন্ত্রের পার্থক্য নিরূপণ কর।
অথবা, আফ্রিকান গণতন্ত্রের সাথে ইউরোপীয় গণতন্ত্রের স্বতন্ত্রতা লিখ। অথবা, আফ্রিকান গণতন্ত্র ও ইউরোপীয় গণতন্ত্রের মধ্যে বৈসাদৃশ্য নিরূপণ কর।


উত্তরঃ ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বে ‘গণতন্ত্র' শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্র বা 'Democracy' শব্দটি বিশে শাসনব্যবস্থা বলতে বুঝায় না। আধুনিককালে ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্রকে একটি জীবনদর্শন বলা যেতে পারে। তবে জীবনদর্শনের মূল হলো সাম্য ও স্বাধীনতা। তাই গণতন্ত্র আধুনিক বিশ্বে সর্বাপেক্ষা কল্যাণধর্মী শাসনব্যবস্থা বলে সুবিদিত তবে এ শাসনব্যবস্থাকে সফল করে তোলা খুব একটি সহজ কাজ নয়। এজন্য অনেক প্রয়োজনীয় শর্ত পালন করতে হয় আফ্রিকান গণতন্ত্রের সাথে ইউরোপীয় গণতন্ত্রের স্বতন্ত্র বা পার্থক্য : আফ্রিকান গণতন্ত্রের স ইউরোপীয় গণতন্ত্রের পার্থক্য খুঁজতে হলে প্রথমেই দেখতে হবে গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ। গণতন্ত্রের কিছু নিজস্ব বৈি রয়েছে, যা অন্যান্য শাসনব্যবস্থায় অনুপস্থিত। এ বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে-
১. প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন পদ্ধতি ।
৩. সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন পদ্ধতি।
৫. জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত শাসন পদ্ধতি । ৭. দলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান।
২. প্রতিনিধিত্ব সরকার পদ্ধতি।
৪. জনস্বার্থে পরিচালিত শাসন পদ্ধতি।
৬. গণসার্বভৌমত্বের অধিকার ।
৮. রাজনৈতিক সাম্য ব্যবস্থা প্রচলিত।
বর্ণবাদ ও তার ব্যবহার : ইংরেজি Colour শব্দের অর্থ হচ্ছে বর্ণ। ভারতীয় সমাজে এটা কা পরিচিত। ইউরোপীয়রা এ বর্ণকে মানুষের গায়ের রঙের সাথে তুলনা করেছে এবং মানুষকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন। নিগ্রো বা কালো এবং শ্বেতাঙ্গ বা সাদা। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ শব্দটি বেশি প্রচলিত। মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার Apartheid শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যার বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে বর্ণবাদ। এ Apartheid শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন ত ম্যালান, যিনি ন্যাশনাল পার্টির সদস্য ছিলেন। তিনি এ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ১৯৪৩ সালের ২৬ মার্চ Die Burger নামক পত্রিকার প্রবন্ধে । এরপর আফ্রিকান ন্যাশনাল পার্টি ১৯৪৮ সালে বর্ণবাদ শব্দটির তিনটি অর্থের কথা প্রচার করে। যথা। ১. ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত থাকবে।
২. বসতি এলাকা স্বতন্ত্র হবে। শহরে বসবাস করবে শ্বেতাঙ্গ সমাজ এবং শহরতলীতে বসবাস করবে অশ্বেতাঙ্গ।
৩. শহরাঞ্চলে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নাগরিক সুযোগ সুবিধা পৃথক হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার এ বর্ণবাদ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন দক্ষিণ আফ্রিকারই প্রেসিডেন্ট হিনড্রিক ভারউড। তিনি ১৯৬৩ সালের এক বক্তৃতায় বলেন যে, "We want to keep South African white keeping it white can only mean one thing, namely white domination, not leadership but supremacy, we say that it can be achieved by separate development."
অতএব দেখা যাচ্ছে যে, দক্ষিণ আফ্রিকার আদিবাসীদের উপর শ্বেতাঙ্গদের উপর চাপিয়ে দেয়া আধিপত্যের বিভিন্ন নিয়মনীতিই হচ্ছে বর্ণবাদ এবং এ বর্ণবাদ দক্ষিণ আফ্রিকায় বহু বছর ধরে চলে আসছে।
বর্ণবাদের উদ্ভব : আফ্রিকায় প্রথম বসতি স্থাপন করে ওলন্দাজগণ এবং ওলন্দাজ ঔপনিবেশিকদের বংশধররা নিজেদের 'বোয়ার' বলে অভিহিত করতো। তাদের ভাষায় এ বোয়ার শব্দের অর্থ ছিল ভিন্নতা। এ ভিন্নতা থেকেই উত্তর হয়েছে বর্ণবৈষম্যের ধারণার। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে শ্বেতাঙ্গদেরকে উন্নত ধরনের কাজে নিয়োগ করা হতো এবং কৃষ্ণাঙ্গদের নিম্নস্তরের কাজে নিয়োগ করা হতো। এ শ্রম বিভাজনমূলক ব্যবস্থা থেকেই বর্ণবাদের উৎপত্তি হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন এলাকা। দুটি ব্রিটিশ উপনিবেশ 'নাটাল' ও 'কেপ অফ গুড হোপ উপনিবেশ এবং ১৮৯৯-১৯০২ সালে বোয়ার যুদ্ধে জেতা অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট এবং রিপাবলিক অফ সাউথ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত হয় নতুন ব্রিটিশ উপনিবেশ। পরবর্তীতে চারটি স্বতন্ত্র এলাকা নিয়ে গঠিত হয় ইউনিয়ন অফ সাউথ আফ্রিকা। ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শাসনক্ষমতায় আসে ন্যাশনাল পার্টি এবং তখন থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকায় শুরু হয় বর্ণবাদের নির্মম ব্যবহার এ সময় ন্যাশনালিস্ট পার্টি প্রস্তাব করে যে, সর্বক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ ও কারণ তারা বর্ণবাদকে আইনের ভিত্তিতে বৈধ করে কৃষ্ণাঙ্গদের স্বতন্ত্র বা বিভেদের। সুতরাং ১৯৪৮ সাল থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকায় আধুনিক বর্ণবাদের সূচনা তথা উদ্ভব । বর্ণবাদের ক্রমবিকাশ : দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাসের উদ্ভব ঘটে ওলন্দাজ শাসনামলে কিন্তু আধুনিক বর্ণবাদের উদ্ভব ঘটে ব্রিটিশ শাসনামলে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে। ফলে শুরু হয় বর্ণবাদের ক্রমবিকাশ। দক্ষিণ আফ্রিকায় এ বর্ণবাদের বিকাশ ঘটে বিভিন্ন মাধ্যমে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. জমি সংক্রান্ত : বিংশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় মোট ৮৫ লক্ষ লোক বসবাস করত। এদের মধ্যে মোটামুটি হিসাবে ২০ লক্ষ লোক শহরাঞ্চলে থাকে, ৩০ লক্ষ লোক ইউরোপীয়দের খামারের বাসিন্দা এবং ৩৫ লক্ষ লোক থাকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট সংরক্ষিত এলাকায়। এ ধরনের সংরক্ষিত এলাকাগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে জুলুল্যান্ড, ট্রান্সকী, পন্ডোল্যান্ড এবং ডেন্ডল্যান্ড। এ ধরনের সংরক্ষিত এলাকাসমূহের সমষ্টিগত পরিমাণ হবে দেশের মোট জায়গার শতকরা মাত্র ৯.৬%। অপর কথায় বলা যায় ৮৫ লক্ষ লোকের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে শতকরা ১০ ভাগেরও কম জায়গা, আর ২৬ লক্ষ শ্বেতাঙ্গ ভোগ করছে শতকরা ৯০.৪ ভাগ জায়গাজমি। আফ্রিকানদের 'সংরক্ষিত' এলাকায় যে ফসল জনে তাতে তাদের প্রয়োজনের অর্ধেকও মেটে না। ফলে দেখা যায় যে, বর্ণবাদের প্রথম বিস্তার ঘটে জমিতে এবং এখানে আফ্রিকানদের বঞ্চিত করা হয়।
২. খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংক্রান্ত : এর পরবর্তীতে শ্বেতাঙ্গ সমাজ আফ্রিকান প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে বর্ণবাদ চালু করে। শ্বেতাঙ্গরা বড় বড় খামার ও বাগান গড়ে তোলে এবং সেখানে শ্রমিক ও দাস হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়োগ দেয়া হয়। শ্বেতাঙ্গরা রপ্তানিযোগ্য কাঁচামাল উৎপাদনের দিকে নজর দেয়। উল ও মদ চালান হতো বেশি। কাঁচামাল পরিশোধন শিল্প গড়ে উঠতে থাকে। এরপর শ্বেতাঙ্গরা আফ্রিকান স্বর্ণ, হীরা, রুপা, তামাসহ খনিজ সম্পদ দখল করে নেয় এবং সেখানেও চালু করে বর্ণবাদ। এ সময় আফ্রিকায় ৭টি সুবৃহৎ স্বর্ণ খনি সংস্থা গড়ে তোলে। খনি এবং উৎপাদনশীল শিল্পক্ষেত্রটি সম্পূর্ণ চলে যায় শ্বেতাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে
রাজনীতি সংক্রান্ত : রাজনীতিতে শ্বেতাঙ্গদের প্রাধান্য ছিল। এখানে কোন কৃষ্ণাঙ্গদের স্থান ছিল না। ক্ষমতাসীন শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী দলের বক্তব্য যে, কোনরূপ রাজনৈতিক অধিকারই আফ্রিকানদের দেয়া না। এ সময় জনবিরোধী বর্ণদ্বেষী নীতি আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ২৬ মে
নির্বাচনে জিতে মালান সরকার গঠনের পর প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন তিনি পূর্বসূরিদের অনুসৃত জাতি বিদ্বেষী নীতি
সরে
দাঁড়াবেন না। এ জাতি বিদ্বেষী নীতির উদ্দেশ্য হলো আফ্রিকানদের পৃথিকীকরণ, নিঃসঙ্গ করে রাখা,
শোষণ ও শ্বেতাঙ্গ স্বার্থরক্ষা। ন্যাশনালিস্টরা দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে, তাদের
বিভেদের বীজ বপন করে আঞ্চলিকভাবেও তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এভাবে রাজনীতিতে কঠোরভাবে বর্ণবাদী নীতি বিস্তার লাভ করে।

এরিয়া অ্যাক্ট, ১৯৬০ : ক্ষমতায় আসার পর শ্বেতাঙ্গ সরকার একে একে বর্ণদ্বেষী নীতি কার্যকরী করতে থাকে।
এরই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পাস করা হয় গ্রুপ এ্যাক্ট ১৯৬০। এ আইন অনুসারে সরকার নির্দিষ্ট স্থানে কোন বিশেষ জাতি। বা সম্প্রদায়ের বসবাসের জন্য স্থির করে দেয়। সেখানে অন্য কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের লোক বাস করতে পারবে না। বড় বড় শহর থেকে আফ্রিকানদের সরিয়ে দেয়া হয়। প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের বৃহত্তম শহর জোহানেসবার্গে একটি পুনর্বাসন দপ্তর। খোলা হয়। ঘোষণা করা হয় শহরের পশ্চিম শহরতলীতে বাস করতে পারবে একমাত্র শ্বেতাঙ্গরা। সেখানকার ৬০ হাজার আফ্রিকানকে শহরের বাইরে নতুন বসতিতে সরে যেতে বলা হয়। ফলে বর্ণবাদের বিস্তার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
৫. শিক্ষা সংক্রান্ত : শিক্ষা ক্ষেত্রেও বর্ণবাদের বিস্তার ঘটে। ১৯৫৩ সালে পাস করা হয় বান্টু এডুকেশন অ্যাক্ট এবং এর দ্বারা আফ্রিকানদের শিক্ষা সংকোচ করা হয়। এ সময় নেভিট অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী ভেরউরড় বলেছিলেন, বান্টু ছেলেমেয়েদের অঙ্ক শিখিয়ে কোন লাভ নেই। কারণ তারা তা কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে অপারগ। ১৯৫৯ সালে পার্লামেন্টে পাস করা হয় ইউনিভার্সিটি এডুকেশন অ্যাক্ট। বলা হয় বিভিন্ন বর্ণের ছাত্ররা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারবে না। চালু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একমাত্র শ্বেতাঙ্গরাই লেখাপড়া শিখতে পারবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, শিক্ষাক্ষেত্রে বর্ণবাদের বিস্তার ঘটে।
৬. নির্যাতনমূলক বর্ণবিদ্বেষ : শ্বেতাঙ্গ সরকার আফ্রিকানদের উপর শিবা মূলক কিছু বিধি করে আফ্রিকানদের অত্যাচার ও নির্যাতন করতে থাকে। যে কোন আফ্রিকানদের দিবারাত্রি যে কোন সময়ে এবং যে কোন স্থানে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে এবং গ্রেপ্তারের পর তিন মাস কাল তাদের বিনা বিচারে আটক রাখাও চলে। কোন আফ্রিকানকে গ্রেপ্তার করার ব্যাপারে পুলিশকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোন প্রকার অনুমতি গ্রহণ করতে হয় না। এভাবে আফ্রিকানদের পুলিশি নির্যাতন করা হতো।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় ইউরোপীয় শক্তিবর্গের আগমনের পর এখানে বর্ণবাদী প্রথা চালু করা হয় এবং এ বর্ণবাদী প্রথার জনক ওলন্দাজগণ । কিন্তু আধুনিক বর্ণবাদের জনক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গরা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে চালু করে বর্ণবাদের। এ বর্ণবাদী প্রথা দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বত্র বিস্তার লাভ করে এবং আফ্রিকানদের সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। যদিও বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের কোন কার্যকলাপ নেই। তথাপিও তারা সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে এবং এটা বর্ণবাদেরই পরোক্ষ ফল।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]