জার শাসিত রাশিয়ায় বৈপ্লবিক ডিসেম্ব্রিস্ট আন্দোলনের বর্ণনা দাও ।

বৈপ্লবিক আন্দোলনসমূহ
Revolutionary Movements
উনিশ শতকের বৈপ্লবিক আন্দোলনসমূহের মধ্যে ডিসেম্ব্রিস্ট আন্দোলন ও বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ ও রুশ বিপ্লবীদের কার্যকলাপ, পোল্যান্ডের বিদ্রোহ, নিহিলিস্ট ও নৈরাজ্যবাদী আন্দোলন, নারোদনিকি বা পপুলিস্ট বা জনবাদী আন্দোলন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । নিম্নে এ বিপ্লবী আন্দোলনসমূহ পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো :

১. ডিসেম্ব্রিস্ট আন্দোলন ও বিদ্রোহ
জার প্রথম আলেকজান্ডারের অভ্যন্তরীণ শাসনের ব্যর্থতা ও হতাশা থেকে জনু হয় প্রথম রুশ বিপ্লবী গোষ্ঠীর। ১৮২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থান থেরে তারা পরিচিত হয় ডিসেম্ব্রিস্ট নামে। অধিকাংশ ডিসেম্ব্রিস্ট রুশ রেজিমেন্টের মুক্তপন্থি অফিসার যারা প্রগতির পথে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক ছিল। এদের অনেকেই অভিজাত, উচ্চশিক্ষিত, ফরাসিসহ বিদেশি ভাষায় ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন। জ্ঞানদীবি ও ফরাসি বিপ্লবী ঐতিহ্যের প্রতি অনুরক্ত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা ও কয়েকটি মৌলিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা, ভূমিদাসত্বের অবসান ডিসেম্ব্রিস্টদের মধ্যে নিকিতা মুরাভিয়েভ
একটি রক্ষণশীল কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র। কর্নেল পল পেস্টেল চেয়েছিলেন জ্যাকবিনপন্থি কেন্দ্রীয় প্রজাতন্ত্র। তাঁরা প্রথমদিকে ইউনিয়ন অব স্যালভেশন অথবা ইউনিয়ন অব ওয়েলফেয়ার নামে যে সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন যার লক্ষ্য ছিল মানবকল্যাণ,
সামরিক বিদ্রোহ নয় । কিন্তু রাশিয়ার মুক্তপন্থি রূপান্তরের সম্ভাবনা যখন সুদূরপরাহত হতে লাগল তখন মুক্তপন্থি এই সংস্কারকরা বলপ্রয়োগ বা বিদ্রোহের কথা ভাবতে লাগল। আন্দোলনের জন্য দুটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হলো। একটি উত্তরের সেন্ট পিটাসবার্গ অন্যটি দক্ষিণের তুলেচিন। ১৮২৫ সালের ডিসেম্বরে জার প্রথম আলেকজান্ডারের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর ফলে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে যে সংকটের সৃষ্টি হয় তার সুযোগ নেয় ডিসেম্ব্রিস্টরা। উত্তরের সমিতির অফিসাররা মনে করেন বিদ্রোহের এই ধরনের সুযোগ আর আসবে না। সুতরাং তারা বিভিন্ন সামরিক ইউনিটকে নিকোলাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্ররোচিত করে। প্রায় তিন হাজারের মতো বিদ্রোহী সৈন্য সুশৃঙ্খলভাবে সেন্ট পিটাসবার্গের কেন্দ্রে মার্চ করে। আকস্মিক এই বিদ্রোহের জন্য সরকারের কোনো প্রাথমিক প্রস্তুতি না থাকলেও সরকার বিদ্রোহীদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সৈন্য সমাবেশ করে। জার প্রথম নিকোলাস শান্তিপূর্ণভাবে বিদ্রোহের অবসান চাইলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে সশস্ত্রভাবে এই বিদ্রোহ মোকাবিলা করতে হয়। নিহত হয় প্রায় ষাট থেকে সত্তরজন ডিসেম্ব্রিস্ট, গ্রেফতার হন অনেকে। দক্ষিণে ডিসেম্ব্রিস্টদের বিদ্রোহ আরও সহজে দমন করা হয়। পরবর্তীতে কর্নেল পল পেস্টেলসহ পাঁচজন বিদ্রোহীকে মৃত্যুদণ্ড, অনেককে নির্বাসন ও অন্যান্য দণ্ড দিয়ে ডিসেম্ব্রিস্ট বিদ্রোহ দমন করা হয় ।
ডিসেম্ব্রিস্ট আন্দোলন ও বিদ্রোহের ঘটনাপ্রবাহ
আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আলেকজান্ডারের শাসনের ব্যর্থতার ফলে যে হতাশার সৃষ্টি হয়, প্রথম রুশ বিপ্লবী গোষ্ঠীর সংগঠনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ১৮২৫-এর ডিসেম্বরে এই গোষ্ঠীর ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ফলে এঁরা ডিসেম্ব্রিস্ট নামে আখ্যাত হয়। অধিকাংশ ডিসেম্ব্রিস্টই বাছাই করা রুশ রেজিমেন্টের অফিসার। এঁদের অনেকেই অভিজাত, উচ্চশিক্ষিত, ফরাসি ভাষা ও আরো কিছু ভাষায় এঁদের বিশেষ ব্যুৎপত্তি। নেপোলিয়নীয় যুদ্ধাভিযানে অংশগ্রহণ করায় এঁদের প্রত্যেকেরই পশ্চিম ইউরোপ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। ডিসেম্ব্রিস্টরা মুক্তপন্থি । বুদ্ধিবিভাসা ও ফরাসি বিপ্লবী
ঐতিহ্য এরা আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁরা সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা ও কয়েকটি মৌলিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ভূমিদাসত্বের অবসান চেয়েছিলেন। ডিসেম্ব্রিস্টদের মধ্যে নিকিতা মুরাভিয়েভ চেয়েছিলেন একটি রক্ষণশীল নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র; কর্নেল পল পেস্টেল চেয়েছিলেন জ্যাকোবিনপন্থি কেন্দ্রীভূত প্রজাতন্ত্র ও ভূমিসংস্কার। ডিসেম্ব্রিস্টদের প্রতি সহানুভূতি ছিল শিক্ষিত রুশিদের। পুশকিন ও গ্রিবেদেভের মতো বিখ্যাত লেখকও এঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু এঁদের পেছনে কোনো গণসমর্থন ছিল না। প্রথম আলেকজান্ডারের রাজত্বে মুক্তপন্থির পতাকা বহন করতে হয়েছিল রক্ষীবাহিনীর অভিজাত অফিসারদের। এ যুগে রুশ মধ্যবিত্ত শ্রেণির পশ্চাৎমুখীনতা ও দুর্বলতার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে! আন্দোলনের দুর্বলতাও সেই কারণেই। উনিশ শতকের প্রথম দিকে রুশ মুক্তপন্থার সাদৃশ্য ছিল স্পেনীয় মুক্তপন্থার সঙ্গে, ইংরেজ কিংবা ফরাসি মুক্তপন্থার সঙ্গে নয়। সুলভ মেজাজ প্রতিফলিত হয়েছিল একটি বিচিত্র দলিলে যা পবিত্র চুক্তি নামে খ্যাত। ১৮১৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া এবং ক্রমে ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্র এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির প্রধান কথা হলো খ্রিষ্টান শাসকদের প্রতি একটি আবেদন যে, তাঁরা যেন ভ্রাতৃসুলভ সৌহার্দবন্ধনে আবদ্ধ থাকেন এবং ইউরোপের শান্তিরক্ষা করেন। খ্রিষ্টধর্ম ও আন্তর্জাতিক আইন- এই দুটি প্রধান পশ্চিমি ঐতিহ্যের গভীরে পবিত্র চুক্তির শিকড় প্রোথিত থাকলেও সেই মুহূর্তের আন্তর্জাতিক সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে এর কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। খ্রিষ্টীয় সৌভ্রাতৃত্বের নীতির প্রয়োগের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বনের কথাও এই চুক্তিতে ছিল না। কাসেলরিয়ে এই চুক্তিকে গভীর অতীন্দ্রিয়বাদ ও অর্থহীন বলে বর্ণনা করে কিছু অত্যুক্তি করেননি।
পবিত্র চুক্তি তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবের উপর কোনো রেখাপাত করেনি। কিন্তু চতুরাষ্ট্রীয় মৈত্রী যা পরে পঞ্চরাষ্ট্রীয় মৈত্রীতে পরিণত হয় তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। চতুরাষ্ট্রীয় মৈত্রী গ্রেট ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধকালীন মিত্রতা হিসেবেই শুরু হয় (২০ নভেম্বর ১৮১৫)। উদ্দেশ্য ছিল নেপোলিয়ন অথবা তাঁর বংশধরের পুনরায় ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহণ ব্যর্থ করা এবং ভিয়েনা ব্যবস্থাকে রক্ষা করা। এই মৈত্রী বিশ বছর স্থায়ী হয়। এই মৈত্রীচুক্তির ষষ্ঠ ধারায় স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মাঝে মাঝে আলাপ-আলোচনার কথা বলা হয়। এই ধারারই ফলশ্রুতি কংগ্রেস ব্যবস্থা অথবা ইউরোপীয় কনফেডারেশন। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী পর পর কয়েকটি সম্মেলন হয় : ১৮১৮-তে আইলা শাপেলে, ১৮২০-২১ - এ ট্রোপাউ ও লাইবাখে এবং ১৮২২-এ ভেরোনায়। আইলা শাপেল সম্মেলনে ফ্রান্স মৈত্রী চুক্তিতে যোগ দেওয়ায় চতুরাষ্ট্রীয় মৈত্রী পঞ্চশক্তি মৈত্রীতে পরিণত হল। ট্রোপাউ ও লাইবাখে স্পেন ও ইতালীর বিপ্লব নিয়ে আলোচনা হয়। পরিশেষে ভেরোনায় স্পেনের বিপ্লব সম্পর্কে ব্যবস্থা অবলম্বিত হয় এবং তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রিসের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা হয় ।
১৮২৫-এর ডিসেম্বরে প্রথম আলেকজান্ডারের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর ফলে রুশ সিংহাসনে উত্তরাধিকার নিয়ে সংকট দেখা দেয়। আলেকজান্ডারের কোনো পুত্র অথবা দৌহিত্র ছিল না। সুতরাং আলেকজান্ডারের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গ্র্যান্ড ডিউক কনস্টানটাইনের সিংহাসনে বৈধ অধিকার স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি এক অভিজাত পোল কন্যাকে বিবাহ করেন যাঁর দেহে রাজরক্ত ছিল না। সুতরাং আলেকজান্ডার স্বাক্ষরিত একটি বিশেষ ঘোষণার দ্বারা (১৮২২) তাঁর তৃতীয় ভ্রাতা নিকোলাসের সিংহাসনে অধিকার স্বীকৃত হয়। কিন্তু এই ঘোষণা প্রচারিত হয়নি। অল্প কয়েকজন লোকই এই ঘোষণা সম্পর্কে জানতেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর কনস্টানটাইন ও পোল্যান্ড রাজ্য নিকোলাসের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা করে। অন্যদিকে নিকোলাস, সেন্ট পিটার্সবার্গ ও রুশ সৈন্যবাহিনী কনস্টানটাইনের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। কনস্টানটাইনের সিংহাসনের অনমনীয় প্রত্যাখ্যানের ফলেই নিকোলাস রাশিয়ার সম্রাট হন।
সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে এই সংকটের সুযোগ নেয় ডিসেম্ব্রিস্ট গোষ্ঠী। ১৮২২-এর ২৬ ডিসেম্বর (পুরানো ক্যালেন্ডারের ১৪ ডিসেম্বর) ডিসেম্ব্রিস্টদের উত্তরের সমিতির অফিসাররা বুঝতে পেরেছিলেন যে, বিদ্রোহের এই ধরনের সুযোগ আর আসবে না। সুতরাং তারা বিভিন্ন সামরিক ইউনিটকে নিকোলাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্ররোচিত করে। প্রায় ৩ হাজারের মতো বিদ্রোহী সৈন্য সুশৃঙ্খলভাবে সেন্ট পিটারসবার্গের কেন্দ্রে মার্চ করে আসে। আকস্মিক এই বিদ্রোহের জন্য সরকার একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষে বিদ্রোহীদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি সৈন্যসমাবেশ করা সম্ভব হয়েছিল। এই দুই বাহিনী কয়েক ঘণ্টা পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ডিসেম্ব্রিস্টদের নেতৃত্বের অভাব এই বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা নিয়ে আসে; নয়া সম্রাটেরও কিছুটা দ্বিধা ছিল। তিনি একটি রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড দিয়ে তাঁর রাজত্ব শুরু করতে চাননি; ভেবেছিলেন কথাবার্তা বলে তাদের বশ্যতা স্বীকার করানো সম্ভব হবে। কিন্তু কথাবার্তায় বিশেষ ফল হল না, শীতের অপরাহ্ণ গড়িয়ে গেল। অন্ধকার জমতে লাগল। সরকার এবার কামান নিয়ে এলেন। বেশি গুলিগোলা ছুঁড়তে হলো না। বিদ্রোহীরা বিশৃঙ্খলভাবে পালাল। মৃতের সংখ্যা বেশি হয়নি। মাত্র ৬০ থেকে ৭০। কিন্তু গ্রেফতার হলো অনেক বিদ্রোহী। দক্ষিণি ডিসেম্ব্রিস্টদের অভ্যুত্থানও অনায়াসে দমন করা হলো। পেস্টেল ও কবি কনরাড রাইলিভ সহ পাঁচজন ডিসেম্ব্রিস্টকে মৃত্যুদণ্ড এবং প্রায় আরো তিনশজনকে অন্যান্য দণ্ড দেওয়া হলো । প্রথম নিকোলাস নিষ্কণ্টক হয়ে সিংহাসনে বসলেন।
২. কৃষক বিদ্রোহ ও রুশ বিপ্লবীদের কার্যকলাপ
দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের উদারনৈতিক সংস্কার রাশিয়ার কৃষককুলকে মোটেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সার্ফ প্রথার বিলুপ্তির পর সেই বৎসরেই রাশিয়ায় এক ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। নিজেদের তথাকথিত 'মুক্তির' প্রত্যুত্তরে তারা বিদ্রোহী হয়। এক বৎসরের মধ্যে প্রায় এক হাজার কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এই বিদ্রোহগুলো দমন করার জন্য সেনাবাহিনীর এবং এমনকি গোলা ও বারুদেরও সাহায্য নিতে হয় ।
১৮৬১ সালের বহু পূর্বেই বিপ্লবী গণতান্ত্রিগণ জারের শাসন ও সার্ফ প্রথার বিরুদ্ধে এক জোর প্রচারকার্য শুরু করেছিল। ‘কলোকল' (Kalokol) নামে এক বিপ্লবী পত্রিকা এই প্রচারকার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এই পত্রিকা সংবাদপত্রের উপর বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও কৃষকদের বিপ্লবের নামে নির্ভীকতার সঙ্গে প্রচারকার্যে ব্রতী হয়। রাশিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলনের অপর কেন্দ্র ছিল 'সোভ্রেমেনিক' (Sovremenike) নামে অপর এক বিপ্লবী সংবাদপত্রের প্রধান কার্যালয়।
রুশ বিপ্লবিগণ রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবী সংস্থা গড়ে তোলে। ১৮৬১ সালে ‘দেশ ও মুক্তি' (Zemlyaivolva) নামে একটি শক্তিশালী গোপন বিপ্লবী সংস্থা স্থাপিত হয়। সমগ্র রাশিয়ায় এই সংস্থার বহু গুপ্তসমিতি ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র দেশব্যাপী কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত করা। বিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিল ১৮৬১ সালের সংস্কার প্রবর্তিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষক বিপ্লব সংঘটিত করা। যাহোক, খণ্ডখণ্ডভাবে বিপ্লব ঘটায় ও বিপ্লবীদের মধ্যে আদর্শগত মতপার্থক্য থাকায় সমগ্র দেশব্যাপী কৃষি অভ্যুত্থান সংঘটিত করবার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। সেই সঙ্গে বিপ্লবীদের উপর সরকারি দমননীতি কঠোর হয়। তথাপি অর্থনৈতিক অগ্রগতি, কৃষকদের ও বিপ্লবীদের আন্দোলনের প্রসারতাহেতু জার সরকারের নিকট হতে একাধিক সংস্কার আদায় করা হয় । ১৮৬৩ হতে ১৮৭৪ সালের মধ্যে এই সংস্কারগুলো প্রবর্তিত হয় ৷
৩. গোল্যান্ডের বিদ্রোহ
পোল্যান্ডের প্রতি রাশিয়ার উদারনীতি
১৮৬৩ সালে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কারমুখী উৎসাহ স্তব্ধ হয়ে যায়। সেই বৎসর রাশিয়ার বিরুদ্ধে পোল্যান্ডে এক ব্যাপক অভ্যুত্থান ঘটে। রাশিয়ার ন্যায় পোল্যান্ডের ক্ষেত্রেও দ্বিতীয় আলেকজান্ডার উদারনীতি অনুসরণ করেছিল। জার প্রথম নিকোলাসের প্রবর্তিত দমনমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ও পোল্যান্ডের দেশত্যাগী রাজনীতিকদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেওয়া হয়। পোল্যান্ডের রাষ্ট্রপরিষদ পুনঃস্থাপন করা হয় যা ১৮৩৯ সালে বিলোপ করা হয়েছিল। কিছু পরিমাণে স্বায়ত্তশাসনের অধিকারও পোল্যান্ডকে দেওয়া হয়েছিল। ওয়ারম-র বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় চালু করা হয়েছিল। স্কুল পর্যায়ে পোলিশ ভাষার ব্যবহার মঞ্জুর করা হয়েছিল। সুতরাং দেখা যায় যে পোলদের জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে রুশ সরকারের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।
পোল্যান্ডের দাবি ও বিদ্রোহ
কিন্তু রাশিয়ার এই উদারতা পোলদের সন্তুষ্ট করিতে পারেনি। পোল্যান্ডকে প্রদত্ত এই সকল সুযোগ সুবিধা পোলরা রুশ সরকারের দুর্বলতার প্রকাশ বলে মনে করে। ইতোমধ্যে রাশিয়ায় ভূমিদাসদের মুক্তি দেওয়া হলে তা পোল-চরমপন্থিদের উৎসাহ জোগায় ও তারা নানা দাবিতে জোর আন্দোলন শুরু করে দেয়। তারা শুধু নানা দাবিতে জোর আন্দোলন শুরু করে দেয়। তারা শুধু নব-প্রতিষ্ঠিত পোল-প্রজাতন্ত্রের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেই ক্ষান্ত থাকল না তাদের দাবি হলো 'বৃহত্তর পোল্যান্ডের'
পুনঃপ্রতিষ্ঠা অর্থাৎ ১৭৭২ সালের প্রথম ব্যবচ্ছেদের পূর্বে পোল্যান্ডের যে রাষ্ট্রীয় সীমানা ছিল তা পোল্যান্ডকে প্রত্যর্পণ করা। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার পোলদের এই দাবি অগ্রাহ্য করলে পোল্যান্ডের সর্বত্র গুপ্তসমিতিগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ষড়যন্ত্র ও হিংসাত্মক কার্যকলাপে প্রবৃত্ত হয়। রুশ সরকারের কঠোর দমননীতি উপেক্ষা করেই চরমপন্থি পোলরা বিপ্লবের পথে অবিচল থাকে। কিন্তু প্রথমদিকে নরমপন্থি পোলরা ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। অবশ্য পোল-বিদ্রোহীদের অনুকূলে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের সমর্থনের আশ্বাস পেলে নরমপন্থিরা বিদ্রোহীদের দলে যোগ দেয়।
বিদেশি শক্তিবর্গের ভূমিকা
রাশিয়ার ন্যায় এক প্রবল শক্তির সঙ্গে সংগ্রামে পোলদের সাফল্য লাভের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। পোলরা নানা দলে ও উপদলে বিভক্ত ছিল। এই কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পোল-বিদ্রোহীদের দলে ছিল অভিজাত, শহরবাসী ও ধর্মীয় যাজকশ্রেণি। অভিজাতদের বিরুদ্ধে কৃষকদের অভিযোগ থাকায়, তারা বিদ্রোহে যোগদান করা হতে বিরত থাকে। এই অবস্থায় একমাত্র বিদেশি সমর্থনই পোলদের সহায়ক হতে পারত। রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রীস্থাপনের আগ্রহ থাকায় প্রাশিয়া বিদ্রোহীরা পোলদের আবেদন অগ্রাহ্য করে। বিসমার্ক পোলদের বিদ্রোহকে জার্মানির জীবনমরণের সমস্যা বলে অভিহিত করেন। তাঁর কথায়— "It is a matter of life and death to us." বিসমার্ক পোলিশ সীমান্তে সেনা সমাবেশ করে পোলদের বিদ্রোহ দমনে রাশিয়াকে সাহায্য করেন। ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন পোলদের সাহায্য করার পক্ষপাতী ছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের এক বৈঠকের প্রস্তাব দেন। কিন্তু নেপোলিয়নের এই প্রস্তাব দূরভিসন্ধিমূলক মনে করে তা অগ্রাহ্য করা হয়। অস্ট্রিয়াও পোল্যান্ডকে সাহায্য করতে অসম্মত হয়। সুতারাং বিদেশি শক্তির সাহায্য না পাওয়ায় পোল-বিদ্রোহীরা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ১৮৬৪ সালের মার্চ মাসে রাশিয়া কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করে।
পোল-কৃষকদের প্রতি রাশিয়ার উদারনীতি
বিদ্রোহের ব্যর্থতার ফলে পোল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করা হয় এবং পোল্যান্ডকে সরাসরি রুশ-সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত করা হয়। (২) পোল-অভিজাতদের সম্মান ও প্রতিপত্তির বিপর্যয় ঘটে এবং রুশ সরকার পোল—কৃষকদের সন্তুষ্টিবিধানে প্রয়াসী হয়। এই নীতি অনুসরণ করে পোল্যান্ডে কৃষি সংস্কারের এক ব্যাপক কর্মসূচি রুশ সরকার গ্রহণ করে; (৩) পোল-কৃষকদের জমির মালিকানাস্বত্ব স্বীকার করা হয় এবং এর জন্য জমিদারদের ক্ষতিপূরণ মঞ্জুর করা হয়; (৪) আইন করে পোল কৃষকদের পোল্যান্ডের অন্যান্য সম্প্রদায়ের নিকট হতে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় এবং নিজস্ব সংগঠন গড়ে তোলার অধিকার এদের দেওয়া হয় ।
রুশীকরণ নীতি
পোল্যান্ডে রুশীকরণনীতিও অনুসরণ করা হয়। পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদ দমন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয় এবং সর্বোতভাবে পোল্যান্ডকে রুশ ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করে তোলার প্রয়াস হয়। পোল্যান্ডের রোমান ক্যাথলিক গির্জা ছিল পোল-জাতীয়তাবাদের মেরুদণ্ড। সুতরাং এই গির্জার সব রকমের সুযোগ সুবিধাগুলো বাতিল করা হয় ও এর ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। পোল্যান্ডে রুশভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং শিক্ষায়তনগুলোতে এই ভাষায় পঠনপাঠন আবশ্যিক করা হয় ৷ ক্রমে সরকারের উচ্চপদগুলোতে পোলদের স্থলে রুশদের নিয়োগ করা হয়। বিদ্রোহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পোলদের নির্বাসন দেওয়া হয় এবং সব রকমের রাজনৈতিক আন্দোলন নিষিদ্ধ করা হয়। অবশ্য সেই সঙ্গে পোল্যান্ডের সামাজিক জীবন নয়া করে গড়ে তোলা হয়। সামাজিক আমোদ-প্রমোদে উৎসাহ দেওয়া হয় এবং বহু অপেরা ও নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা করা হয়। ফলে রাজধানী ওয়ারশ আনন্দমুখর শহর হয়ে ওঠে। ওয়ারশ পূর্ব ইউরোপের প্যারিস হয়ে ওঠে

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]