বার ভূঁইয়াদের পরিচয়
আফগানদের শাসনামলে বাংলায় বার ভূঁইয়াদের উত্থান ঘটে। তারা জমির খাজনা বা ইজারা লাভের সুযোগে জমিদার হয়ে
উঠেন। হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্য থেকেই এসব জমিদার বংশ সৃষ্টি হয়। যদিও এদের বার ভূঁইয়া বলা হয়, কিন্তু তাদের
প্রকৃত সংখ্যা ১২-এর অধিক ছিল। আকবরের বাহিনী বাংলায় প্রবেশ করলে জমিদারগণ শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
তাদের নিজস্ব সৈন্য ও নৌবাহিনী ছিল। উল্লেখযোগ্য বার ভূঁইয়াদের মধ্যে ছিলেন সোনারগাঁয়ের জমিদার ঈসা খান,
ভাওয়ালের গাজী পরিবার, বাকুড়ার বীর হামির, চন্দ্রদ্বীপের পরমানন্দ রায়, ভুলুয়ার লক্ষণ মাণিক্য, যশোরের প্রতাপাদিত্য,
বিক্রমপুরের কেদার রায়, পাবনার রাজা রায়, মানিকগঞ্জের বিনোদ রায় প্রমুখ।
ঘ. আকবরের শাসনামলে বার ভূঁইয়াদের প্রতিরোধ (১৫৮৪-১৬১২ খ্রি.)
সম্রাট আকবর বার ভূঁইয়াদের প্রতিরোধ দমনের জন্য কয়েকজন সুবাদারকে বাংলায় প্রেরণ করেন। এরা হলেন ১৫৮৩
খ্রিস্টাব্দে শাহবাজ খান, ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে সাদিক খান, ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে উজির খান এবং ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা মানসিংহ।
বেশ কিছু যুদ্ধ ও প্রতিরোধের পরও সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলার বার ভূঁইয়াদের বিদ্রোহ দমন করা যায়নি।
ঙ. সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বার ভূঁইয়াদের দমন
দিল্লির মসনদে জাহাঙ্গীর সম্রাট নিযুক্ত হওয়ার পর বাংলার বার ভূঁইয়াদের বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়। তিনি ইসলাম
খানকে (১৬০৮-১৬১৩) বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করে বাংলায় প্রেরণ করেন। ইসলাম খান বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে
ঢাকায় স্থানান্তর করেন। তখন বার ভূঁইয়াদের মূল নেতা ছিলেন সোনারগাঁওয়ের জমিদার মুসা খান। ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে
করতোয়া নদীর পূর্বতীর যাত্রাপুরে মুসা খানের সৈন্যদের সঙ্গে ইসলাম খানের বাহিনীর যুদ্ধ হয়। মুসা খান শেষ পর্যন্ত
আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। সেই সময় বাহাদুর গাজীসহ আরো কয়েকজন জমিদার আত্মসমর্পণ করেন। তবে ভুলুয়ার
অনন্ত মাণিক্য মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেননি, তিনি আরাকানে চলে যান। সিলেট অঞ্চলে জমিদার উসমান লোহানী
মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারান। ইসলাম খান কোনো কোনো জমিদারকে বশীভূত করেন। এভাবে ইসলাম খান
১৬১০ সালে ঢাকায় প্রবেশ করেন। তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে ঢাকার নাম জাহাঙ্গীরনগর রাখেন। তার আনুগত্য
প্রকাশ করায় তিনি সোনারগাঁয়ের জমিদার মুসা খানকে জমিদারি ফিরিয়ে দেন। মুসা খানের পর অন্য অনেকেই হতাশ হয়ে
মুঘল শাসনের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। এর ফলে বাংলায় বার ভূঁইয়াদের বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং মুঘলদের শাসন
প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলায় সুবাদারী শাসন
ক. মুঘল সম্রাট আকবর ভারতবর্ষকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করেন। প্রদেশকে ‘সুবা’ বলা হতো। সুবার শাসনকর্তাকে
সুবাদার বলা হতো। তারা মুঘল সম্রাটদের ইচ্ছানুযায়ী নিযুক্ত হতেন। সুবাদারগণ সামরিক, বেসামরিক, আইন-শৃঙ্খলা,
প্রশাসনিক, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বৈদেশিক আক্রমণ দমনের ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তারা দিলি র সম্রাটদের উপদেশ, -
নির্দেশ ও মতামত নিয়ে সুবা প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। কোনো সুবাদার মুঘল সম্রাটের আদেশ পালনে ব্যর্থ
হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হতো। বাংলায় সুবাদারী ব্যবস্থা বার ভূঁইয়াদের প্রতিরোধের কারণে সাথে সাথে চালু
করা যায়নি, এটি সুবাদার ইসলাম খানের (১৬০৮-১৬১৩) আমল থেকে বাংলায় কার্যকর হয়।
খ. বাংলার সুবাদারগণের পরিচয় ও কার্যক্রম
সুবা-বাংলার ইতিহাসে ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩ খ্রি.) অত্যন্ত গৌরবময় ভূমিকা পালন করেন। তিনি বার ভূঁইয়াদের
বিদ্রোহ দমন, তাদের বশীভূত করা, বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় আনা এবং ঢাকাকে জাহাঙ্গীরনগর নামে
পরিচিত করার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। ইসলাম খানের মৃত্যুর (১৬১৩ খ্রি.) পর ১৬৬০ সালে মীর জুমলা সুবাদার
হওয়ার আগ পর্যন্ত যারা সুবাদার নিযুক্ত হন তাদের অনেকেই তেমন অবদান রাখতে পারেননি। এ সময়ে সম্রাজ্ঞী নূর
জাহানের ভাই ইব্রাহিম খান ফতেহ জঙ্গ (১৬১৭ খ্রি.), কাশিম খান জুয়িনী (১৬২৮-১৬৩২ খ্রি.), ইসলাম খান মাসহাদী
(১৬৩৫-১৬৩৯ খ্রি.), মুহম্মদ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯ খ্রি.) কয়েকজন সুবাদারের নাম উল্লেখ করা যায়। তবে আওরঙ্গজেবের
অন্যতম সেনাপতি মীর জুমলা (১৬৬০-১৬৬৩ খ্রি.) সুবাদার হিসেবে নানাভাবেই কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি আসাম ও
কুচবিহার পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। তবে মীর জুমলা ও মুজাফফর জঙ্গ সুবাদার নিযুক্ত হয়েও বাংলায়
আসেননি। মীর জুমলার পর অস্থায়ীভাবে দিলির খান ও দাউদ খান বাংলার সুবাদারের দায়িত্ব পালন করেন। সম্রাট
আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খান দুই পর্বে (১৬৬৪-৭৮, ১৬৭৯-৮৮ খ্রি.) বাংলার সুবাদারের দায়িত্ব পালন করেন।
শায়েস্তা খান বাংলার প্রথম সুবাদার যিনি চট্টগ্রামের মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুদের কঠোর হস্তে দমন করেন। এ ছাড়া ইংরেজ
কোম্পানির সঙ্গে মুঘলদের প্রথম সংঘর্ষ তাঁর আমলেই ঘটে। শায়েস্তা খানের পর অনেকে বাংলার সুবাদার হন। তিনি রাজস্ব
সংস্কারে বড় ধরনের অবদান রাখেন। তিনিও স্বাধীন সুবাদরের মতো বাংলা শাসন করেন।
গ. সুবা-বাংলার শাসন ব্যবস্থা
বাংলাকে মুঘল সাম্রাজ্যের সুবা-বাংলা বলা হতো। সুবা-বাংলাকে ‘সরকার’ এবং সরকারকে কয়েকটি ‘পরগণায়’ ভাগ করা
হয়। সরকার ছিল জেলার মতো। এ সব জেলার শাসকদের ‘ফৌজদার’, পরগণার শাসকদের ‘শিকদার’ বলা হতো।
ফৌজদাররা সামরিক ও শাসন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ছিলেন। এ ছাড়া ভূমি রাজস্বই ছিল সুবার প্রধান আয়ের উৎস।
বিভিন্ন নিয়মে তা আদায়ের ব্যবস্থা ছিল। মুঘল আমলে বঙ্গদেশে এভাবে প্রশাসন, রাজস্ব ও অন্যান্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে
ভিত্তি চালু করা হয় তা পরবর্তীকালে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
বাংলার নবাবি শাসন (১৭১৭-১৭৫৭ খ্রি.)
ক. মুর্শিদকুলী খানের শাসনামল (১৭১৭ খ্রি.) থেকে সুবা-বাংলার চরিত্রে কিছু শব্দ ও চরিত্রগত পরিবর্তন আসে। সুবাকে
তখন ‘নিজামত’ (নবাবি) এবং সুবাদারকে ‘নাজিম’ (নবাব) বলা হতো। আগে মুঘলরা সুবেদার নিয়োগ করতেন। এই
সময় (১৭১৭ খ্রি.) থেকে নবাবি প্রাপ্তির বিষয়টি বংশগতভাবে অব্যাহত থাকার নিয়ম করা হয়। প্রথা হিসেবে মুঘল
সম্রাটদের কাছে একটি আবেদন করা হতো। নবাবগণ প্রদেশের স্বাধীন শাসকের মর্যাদা লাভ করেন। এর ফলে দিলি র -
শাসন ব্যবস্থায় প্রদেশের শাসন ক্ষমতায় পারিবারিক উত্তরাধিকারদের আইনগত বৈধতা লাভ ঘটে বা সুবাদারী শাসনে ছিল
না। মুর্শিদকুলী খানের কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। নবাবি ব্যবস্থার প্রথম সুযোগ গ্রহণ করেন মুর্শিদকুলী খানের উত্তরাধিকার
হিসেবে তাঁর কন্যার স্বামী। তাঁর কন্যা জিনাত-উন-নেসার স্বামী সুজাউদ্দীন খান (১৭২৭-১৭৩৯ খ্রি.) বাংলা, বিহার ও
উড়িষ্যার মতো তিন প্রদেশের স্বাধীন নবাব-এর মর্যাদা নিয়ে সিংহাসনে বসেন। সুজাউদ্দীন খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র
সরফরাজ খান উক্ত নবাবির নবাব নিযুক্ত হন। কিন্তু সরফরাজ খানের বিরুদ্ধে বিহারের নায়েব ই নাজিম আলীবর্দী খান
বিদ্রোহ করেন। সরফরাজ খান এতে পরাজিত ও নিহত হন। মুঘলদের অনুমোদন ব্যাতিরেকেই আলীবর্দী খান (১৭৪০-
১৭৫৬ খ্রি.) বাংলার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। নিজের নবাবির উত্তরাধিকার নিয়ে তাঁর আপন কন্যাই তাঁর মনোনীত
নবাব সিরাজকে গ্রহণ করেনি। নবাব পরিবারের ক্ষমতার দ্ব›দ্ব শেষ পর্যন্ত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাই শুধু নয় গোটা ভারতবর্ষেরই
স্বাধীনতা হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে সব নিয়ম-নীতিতে বাংলার মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তার অভ্যন্তরীণ
নানান দুর্বলতা এসব ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠে।
খ. পলাশির যুদ্ধ ও নবাবি শাসনের অবসান
আলিবর্দী খান ১৭৫৬ সালে তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে পরবর্তী উত্তরাধিকার নিযুক্ত করেন। এতে আলিবর্দী খানের
পরিবারের মধ্যে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ইংরেজরা তা কাজে লাগায়। ইংরেজরা সিরাজের আদেশ অমান্য করে কাশিম
বাজার কুঠি ও ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে। এ নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ক্রমে সিরাজের সভাসদ মীর জাফর, জগৎ
শেঠ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে গড়ে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননের যুদ্ধে মীর জাফরের
চক্রান্তের ফলে সেনাবাহিনী নীরব ভূমিকা পালন করে। সিরাজ যুদ্ধে পরাজিত এবং পরে নিহত হন। বাংলার স্বাধীনতা
ইংরেজদের হাতে চলে যায়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন: ২.১
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্নঃ
১. বাংলা তুলনামূলক শাসন আলোচনা করুন।
২. বাংলার হাবসী শাসন কী?
৩. বাংলায় হুসেনশাহী বংশের শাসন কেমন ছিল?
৪. মুঘলামলে বাংলার শাসন কেমন ছিল?
৫. বাংলায় সুবাদারী শাসন মূল্যায়ন করুন।
৬. বাংলায় নবাবী শাসন কেমন ছিল?
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১. বাংলায় তুর্কি শাসনের বিবরণ দিন।
২. বাংলার স্বাধীন সুলতান যুগের বর্ণনা দিন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত