১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লব কীভাবে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি ও অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রোডম্যাপ তৈরি করে? আলোচনা কর ।


১৯০৫ সালের বিপ্লব : কারণ, প্রকৃতি ও ফলাফল
২.৪ ১৯০৫ সালের বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ (Causes of Failure)
প্রথমত বিভিন্ন দলের উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির বিভিন্নতা
রুশ সরকারের নিষ্ঠুর ও নির্বিচার দমননীতি ও প্রতিবিপ্লবীদের দ্বারা সংগঠিত ‘প্রোগোন' অভিযানের জন্য ১৯০৫ সালে প্রথম রুশ বিপ্লবের যবনিকাপাত ঘটে। কিন্তু এই বিপর্যয়ের মূলে ছিল এই বিপ্লবের অন্তর্নিহিত দুবর্লতা। প্রথমত, এই বিপ্লবের নেতৃত্বে কোনো সুসংগঠিত দল ছিল না। স্বৈরশাসনের প্রতি সকলেই সমভাবে বিতৃষ্ণ ছিল, তাই এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনটিকে আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃত গণ-সংমিশ্রণে গঠিত ছিল এবং রাজনৈতিক দলগুলো একযোগে কাজ করলেও তাদের উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা অনেকক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী ছিল। নারোদনিকিরা সন্ত্রাসবাদী পন্থায় কৃষকদের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পক্ষপাতী ছিল। বলশেভিকদের আকাঙ্ক্ষা ছিল গ্রামের মানুষদের সমর্থন লাভ। কিন্তু তাদের সে আশা অপূর্ণ থেকে যায়। তাদের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কর্মসূচি প্রধানত শিল্প প্রধান শহরের উগ্রপন্থিদেরই আকৃষ্ট করেছিল। সরকারি শাসনব্যবস্থার বিপর্যয়ের সুযোগে মেনশেভিকরা ট্রেড ইউনিয়নগুলো ও অন্যান্য অধিকারগুলো দখলের জন্য সচেষ্ট হয়। উদারনৈতিকদের সংগঠন ‘লিগ অব্ এমানসিপেশান' নতুনভাবে কনস্টিটিউশন্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি' (সংক্ষেপে 'ক্যাডেট’) নামে আত্মপ্রকাশ করে। এর কর্মসূচি হয় সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত সংবিধান পরিষদ গঠন, সামাজিক সংস্কার ও জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি। এই লক্ষ্যে পৌঁছোনোর উপায় হিসেবে হিংসাত্মক পদ্ধতির প্রতি তাদের ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা। তাই জার কর্তৃক আহূত প্রথম ডুমা বা জাতীয় পরিষদে এদের সঙ্গে অক্টোবরিস্টদের মত পার্থক্য চরমে ওঠে। এর পরে দ্বিতীয় ডুমাতেও ক্যাডেট (এরা ডুমাকে সাংবিধানিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখার পক্ষপাতী ছিল) এবং বামপন্থিদের (এরা বৈপ্লবিক কর্মসূচির পক্ষপাতী ছিল) অনৈক্যের সুযোগে তা প্রধানমন্ত্রী স্টোলিপিন ভেঙে দেন।
দ্বিতীয়ত কৃষক-শ্রমিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি
কৃষক-শ্রমিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই আন্দোলন সুসংহত হতে পারেনি। একথা সত্যি, বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের দেয় ক্ষতিপূরণ অর্থ প্রদান বাতিল ঘোষণা করতে বাধ্য করেছিল জারকে। কিন্তু এই আন্দোলনগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত । আর জারের মহানুভবতায় তখনও কৃষকদের আস্থা ছিল । তারা মনে করেছিল জারের ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। তাদের এই মোহ তাদের রাজনৈতিক অসচেতনতারই সাক্ষ্য দেয়।
তৃতীয়ত স্থল ও নৌবাহিনী সহযোগী নয়
স্থলবাহিনী ও নৌবাহিনীর কিছু কিছু অংশ বিদ্রোহে যোগদান করেছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তারা বিদ্রোহে অংশ নেয়নি। তাই জার এদের সাহায্যেই বিপ্লব দমন করেছেন।
১৯০৫ সালের বিপ্লব : কারণ, প্রকৃতি ও ফলাফল
এম্পায়ারে'র গঠনের পরিবর্তন দাবি করেছিল। এছাড়া সামরিক আইন উচ্ছেদ ও রাষ্ট্রীয় জমিজমাগুলোর কৃষকদের দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দান তাদের অন্যতম দাবি ছিল। সদস্যরা শাসনব্যবস্থার ত্রুটিগুলোর নির্ভীকভাবে সমালোচনা করেন। কনস্টিটিউশন্যাল ডেমোক্র্যাটরা জাতীয় সভার কাছে দায়িত্বশীল মন্ত্রিসভা নীতি কার্যকর করার দাবি করলে জার তার প্রবল বিরোধিতা করেন। একটি সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয়। জার “জনগণের প্রতিনিধিরা নিজ অধিকার বহির্ভূত বিষয়ে বিপথগামী” হওয়ার অজুহাতে প্রথম ডুমা ভেঙে দিলেন (২২ জুলাই, ১৯০৬ সাল)।
১৯০৭ সালের ৫ মার্চ দ্বিতীয় ডুমার অধিবেশন আরম্ভ হবে ঘোষিত হয়। স্টোলিপিন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। প্রথম ডুমার বহু সদস্য ফিনল্যান্ডে আশ্রয় নেয়। তারা ভাইবর্গ থেকে ২৩০ জন সদস্য স্বাক্ষরিত একটি ঘোষণাপত্র জারি করে। এতে প্রথম ডুমা ভেঙে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়। করদান বা সৈন্যবাহিনীতে যোগদান না করতে জনগণকে আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এই ‘ভাইবর্গ ঘোষণাপত্র’ জনগণের মধ্যে আশানুরূপ সাড়া জাগাল না। রুশ সরকার ততদিনে বিপ্লবের ধাক্কা সামলে উঠেছে। সরকার নির্বাচনে কারচুপি করায় ‘কনস্টিটিউশন্যাল ডেমোক্র্যাটদের’ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যা অভাবনীয়ভাবে হ্রাস পেল ।
৪. দ্বিতীয় ডুমা
নির্ধারিত দিনে দ্বিতীয় ডুমার অধিবেশনে শুরু হলো। প্রথম থেকেই মন্ত্রিসভার সঙ্গে ডুমার বিরোধ শুরু হয়। অবশেষে রুশ সরকার বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য ষোলো জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। সাংবিধানিক স্বাধীনতার হস্তক্ষেপে ডুমা উত্তাল হয়ে ওঠে। জার দ্বিতীয় ডুমা ভেঙে দিলেন (১৬ জুন, ১৯০৭ সালে)। এর পর প্রধানমন্ত্রী স্টোলিপিন নির্বাচন আইন এমনভাবে পরিবর্তিত করে দেন যে, কৃষক-শ্রমিকদের ভোটাধিকার সংকুচিত হয়ে যায়, ডুমা পরিণত হয় উচ্চশ্রেণির এক নির্বাচিত সংসদে ।
৫. তৃতীয় ডুমা (১৯০৭ – ১৯১২)
নবনির্বাচিত তৃতীয় ডুমার অধিবেশন শুরু হলো ১৯০৭ সালের নভেম্বরে। জারের আজ্ঞাবহ প্রধানত ভূস্বামীদের এই পরিষদ পাঁচ বৎসর স্থায়ী হয়েছিল। এর একমাত্র উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল ‘মিরে’র কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে কৃষকদের জমির স্বত্ব-স্বামিত্ব দান (স্টোলিপিন প্রতিক্রিয়া দ্রষ্টব্য)।
৬. চতুর্থ ডুমা
চতুর্থ ডুমার নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল প্রতিক্রিয়াশীলরাই। অবশ্য ‘অক্টোবরের ঘোষণা' অনুযায়ী শাসনতন্ত্র রচিত হয়নি—এই অজুহাতে অক্টোবরিস্টরা জার সরকারের বিরোধিতা শুরু করে। ক্রমে সংস্কার আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯১৬ সালে ‘প্রোগ্রেসিভ ব্লক' নামে এক সংস্কারবাদী দল গড়ে ওঠে। জারের স্বৈরশাসন- বিরোধী মনোবৃত্তি সমস্ত শ্রেণির মধ্যে সংক্রামিত হয়। এর অনিবার্য পরিণতি হয় ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবে। এর ফলে জারতন্ত্রের চিরতরে বিলুপ্তি ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের প্রথম সাম্যবাদী সরকার।
১৯০৫ সালের বিপ্লবে স্টোলিপিন প্রতিক্রিয়া (Reacts)
দ্বিতীয় নিকোলাসের মন্ত্রীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্টোলিপিন ১৯০৬ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অন্তরে রক্ষণশীল হলেও প্রয়োজনবোধে উদার নীতির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে তিনি কুণ্ঠিত ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের পরই তিনি নির্বিচার দমননীতির সাহায্যে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লববাদীদের স্তব্ধ করে দেন।
13
১৯০৫ ও ১৯০৭ সালের শস্যহানি, ১৯০৬ সালে স্থানে স্থানে দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব কৃষকদের বৈপ্লবিক মনোভাবকে বর্ধিত করেছিল। ১৯০৫-০৬ সাল পর্যন্ত বহু কৃষক অভ্যুত্থান ঘটেছিল-সারা দেশে অগ্নিকাণ্ড, লুটতরাজ ইত্যাদির তাণ্ডব চলেছিল । অগণিত কৃষক ও বিপ্লবীদের রক্তস্নানে সরকার বিপ্লব দমন করে। অন্তত কিছু সংখ্যক কৃষকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল-১৯০৫ সালে গঠিত হয়েছিল 'কৃষক ইউনিয়ন' নামে একটি দল। প্রথম ডুমাতেই এক কৃষক প্রতিনিধি ভূস্বামীদের উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে বলেছিল যে, তারা তাদের জমি চুরি করেছে। সুতরাং তারা জমি ক্রয় করে নয়, ছিনিয়ে নেবে। উক্তিটি শুধু কৃষকদের প্রবল ভূমিক্ষুধা নয়, তাদের সচেতনতারও সাক্ষ্য বহন করে ।
১. মিরের নিয়ন্ত্রণ লোপ
স্টোলিপিন তাই বুঝেছিলেন ভূমি সমস্যার সমাধান কত জরুরি। তাঁর দৃষ্টিতে কৃষকদের অসন্তোষের মূলে হলো মির বা গ্রাম্যসমিতিগুলোর কৃষক ও কৃষি উৎপাদনের উপর নিয়ন্ত্রণ। সুতরাং স্টোলিপিনের আইন সংস্কারের প্রথম উদ্দেশ্য হলো এই নিয়ন্ত্রণ বিলুপ্ত করা। সমষ্টিগতভাবে কৃষকদের জমি ভোগদখলের পরিবর্তে কৃষকদের জমির ব্যক্তিগত মালিকানাত্ব দান। এ ব্যাপারে কৃষকদের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত জমির মালিকানা না দিয়ে জমির ছকবন্দীকরণ এবং তা বংশানুক্রমিক করার দিকে লক্ষ রাখা হয়েছিল।
২. কৃষকদের ভূসম্পত্তি বৃদ্ধির সুযোগ
স্টোলিপিন সংস্কারের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল কৃষকরা যাতে সহজে ভূস্বামীর বা সরকারি জমি ক্রয় বা খাজনার পরিবর্তে ভোগদখলের অধিকার পায় তার ব্যবস্থা করা। এই অনুসারে কৃষকদের জমিজমা সংক্রান্ত ব্যাংকগুলোর কর্মপদ্ধতির সংস্কার সাধন করা হলো যাতে তারা সহজে ঋণ পায় । গ্রাম্য ঋণদানকারী সমিতিও গড়ে তোলা হয় ।
৩. অনাবাদি অঞ্চলে কৃষকদের বসতিস্থাপন
স্টোলিপিন সংস্কারের তৃতীয় উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের ভূমিক্ষুধা নিবারণের জন্য পর্যাপ্ত ভূমিযুক্ত অনাবাদি অঞ্চল (যেমন- সাইবেরিয়া) কৃষকদের বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করা। কৃষকদের গমনাগমনের উপর মিরগুলোর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করা হয়। করধার্য ও কর সংগ্রহের দায়িত্ব থেকে মিরগুলোকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
৪. গুরুত্ব :
স্টোলিপিন সংস্কারের ফলে মধ্যযুগীয় কৃষি-উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটে। কৃষিযন্ত্র ও কৃত্রিম সার প্রয়োগ করা হতে থাকে। কিন্তু কৃষির এই উন্নতি কয়েকটি স্থানে এবং বড় বড় জোতদারের খামারে সীমাবদ্ধ ছিল। আর 'কুলাক' যা বড় বড় জোতদারের কাছেই ভূসম্পত্তি বৃদ্ধির সুযোগ সম্প্রসারিত হয়েছিল। সাধারণ কৃষকদের সিংহভাগেরই জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটেনি। তবু ঐতিহাসিক ক্রেগের মতের প্রতিধ্বনি করে বলা যায় যে, ভূমিদাসদের মুক্তির ঘোষণার পর স্টোলিপিনের সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
৫. সংস্কারের ত্রুটি
স্টোলিপিনের সবচেয়ে বড় ত্রুটি এই যে, তাঁর প্রবর্তিত সংস্কারের যুক্তিসংগত সীমানায় পৌঁছুতে তাঁর অনিচ্ছা ছিল। কেননা অন্তরে তিনি উদারনৈতিক ছিলেন না। অথচ প্রতিক্রিয়াশীলরা তাঁকে উদারপন্থি বলে নিন্দা করেছে। অবশেষে এক আততায়ীর হাতে তাঁর জীবনদীপ নিভে যায় (১৯১১ সালে)।
১৯০৫ সালের বিপ্লবের প্রকৃতি (Nature)
প্রকৃতি এবং করণীয় কাজগুলোর দিক থেকে বিচার করে বলা যায় রাশিয়ায় ১৯০৫ সালের বিপ্লব ছিল 'বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব'। কেননা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা লোপ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এর সরাসরি লক্ষ্য ছিল না। বিষয়গত উপাদানের (Content) দিক থেকে এটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল। জারতন্ত্রের উচ্ছেদ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রবর্তন, আট ঘণ্টা কাজের দিন ধার্য, কৃষকদের মধ্যে ভূমি বণ্টন প্রভৃতি কর্মসূচি প্রকৃতপক্ষে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নামান্তর ছিল। এখানে সমাজের আমূল পরিবর্তনের জন্য ‘সমাজতন্ত্রের' মতো কোনো বৈপ্লবিক কর্মসূচি ছিল না ।
তবে কতকগুলো বিশেষ নির্দিষ্ট উপাদানের জন্য এটা পশ্চিম ইউরোপের পূর্বেকার বুর্জোয়া বিপ্লবগুলো থেকে পৃথক ছিল। এসব উপাদানের জন্যই এই বিপ্লবের পরবর্তীতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণত হওয়া সম্ভব হয়েছিল। এটা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হলেও সংগ্রামের বা প্রণালির দিক দিয়ে (যাতে ধর্মঘট পরিণত হয় সশস্ত্র অভ্যুত্থানে) প্রলেতারীয় বিপ্লব ছিল এবং এর মধ্যে ব্যাপক শ্রমিক এবং আধা-প্রলেতারীয় উপাদান জড়িত ছিল। ১৯০৫ সালে প্রায় ৩ মিলিয়ন শ্রমিক ধর্মঘটে অংশ নেয় এবং ঐ সময় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবির সমন্বয়ে প্রথমত, যে ধর্মঘট শুরু হয় তাতে সবচেয়ে অগ্রগামী থেকে সবচেয়ে পশ্চাৎপদ সকল শ্রেণির প্রলেতারিয়েত অংশ নেয়। দ্বিতীয়ত, এ ধর্মঘট শেষ পর্যন্ত জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। এ বিপ্লবের প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিক Rothstein বলেন, “১৯০৫ সালের ঘোষিত বিপ্লব জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে ১ম বিপ্লব এবং এ বিপ্লবের ফলে জারতন্ত্রের পতন ত্বরান্বিত হয়।” ১৯০৫ সালের বিপ্লবের ফলাফল ( Results)
ক. বিপ্লবের শিক্ষা
১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লব রাশিয়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক চিহ্ন। এই বিপ্লব ব্যর্থ হলেও একেবারে নিষ্ফল হয়নি। জারতন্ত্র রক্ষা পেয়েছিল বটে কিন্তু এর ভিত্তিমূল কেঁপে উঠেছিল। ১৯০৭ সালের পর ডুমা দুর্বল ও রক্ষণশীল হয়ে পড়লেও এর মধ্য থেকেই একটি অর্ধ-সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতাগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠলেও এই শাসনব্যবস্থাকে সমূলে বিনাশ করতে পারেনি। এছাড়া, এই বিপ্লব জনগণের মধ্যে বিপ্লবী চেতনার উদ্দীপকের কাজ করে ছিল। এর মাধ্যমে জনগণ যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও শিক্ষালাভ করেছিল তা তাদের ভবিষ্যৎ মুক্তি আন্দোলনে প্রভূত সাহায্য করেছিল। বিপ্লব চলাকালে সৈনিকরা ছোট ছোট ‘বিপ্লবী কাউন্সিল' ও শ্রমিকরা বিভিন্ন অঞ্চলে ‘সোভিয়েত’ নামে বহু সংগঠন গড়ে তুলেছিল। ১৯১৭ সালের সফল অক্টোবর বিপ্লবের সময় এই ধরনের সংগঠনগুলো কার্যকর ভূমিকা নিয়েছিল। লেনিন যথার্থই বলেছেন, “১৯০৫ সালের বিপ্লবের ড্রেস রিহার্সাল ব্যতীত ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্য সম্ভব ছিল না।”
খ. কৃষক শ্রেণির উপর প্রতিক্রিয়া
শহরের শ্রমিকশ্রেণি অবশ্য বিপ্লব থেকে প্রত্যক্ষ সুফল লাভ করেনি। তাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটেনি। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার স্বীকৃত হলেও বিপ্লব চলাকালে সংগঠিত শ্রমিক সংগঠনগুলো রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ হয়। রাশিয়ায় পশ্চিমি ধাঁচের শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। নির্বিচার দমননীতিতে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী উৎসাহে ভাটা পড়েছিল, কিন্তু বিপ্লবী চেতনার প্রবাহ শুষ্ক হয়ে যায়নি।
গ. শ্রমিক শ্রেণির উপর প্রতিক্রিয়া
কিন্তু কৃষকরা বিশেষত তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক- বিপ্লবের দ্বারা নিজেদের পুরস্কৃত করতে পেরেছিল। ১৯১৭-পূর্ব দশ বৎসরে কৃষি ও কৃষকদের সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়। মিরের অধীনে কৃষকদের সমষ্টিগত ভূসম্পত্তির মালিকানার পরিবর্তে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত হয়েছিল। কৃষকদের উপর মিরের নিয়ন্ত্রণ উচ্ছেদ করা হয়। কৃষকরা জমির সুযোগ পেয়েছিল, এমনকি এগুলোর উপর বংশানুক্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে। যাতে তারা জার বা জমিদারের কাছ থেকে জমি কিনতে বা ইজারা নিতে পারে তার জন্য কৃষক ভূমি ব্যাংকগুলোর কর্মপদ্ধতি সংস্কার করা হয়। তাদের ভূমিক্ষুধা নিবারণের জন্য সাইবেরিয়া বা অন্যত্র বসতি স্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়। উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতি ও কৃত্রিম সারের ব্যবহার, কোনো কোনো অঞ্চলে বহু অনাবাদি জমিকে আবাদযোগ্য জমিতে পরিণত করা ইত্যাদির ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু সুফল ভোগ করেছিল মুষ্টিমেয়রাই, কৃষকদের অধিকাংশের জীবনযাত্রার মান খুব নিচে ছিল। তবু স্টোলিপিনের সংস্কারের ফলে কৃষকদের দীর্ঘ-সঞ্চিত অভিযোগগুলো কিছু পরিমাণে দূর হয়েছিল।
১৯০৫ সালের বিপ্লব : কারণ, প্রকৃতি ও ফলাফল ঘ. রুশীকরণের তীব্রতা বৃদ্ধি
११
সংখ্যালঘু জাতিগুলোর পক্ষে এই বিপ্লবের ফলাফল আদৌ সন্তোষজনক ছিল না। তাদের অভিযোগগুলো দূর করার জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফিনল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়া হয়, সেখানে রুশীকরণ নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। কুখ্যাত 'ব্ল্যাক হানড্রেডস' নামে এক উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদী দল ইহুদিদের উপরে অকথ্য নির্যাতন চালায়। পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া ইত্যাদি স্থানে রুশীকরণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
ঙ. আমলাতন্ত্রের উপর প্রতিক্রিয়া
১৯০৫ সালে দুটি আনুষঙ্গিক ফল উল্লেখযোগ্য। নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য চার্চ-বিদ্যালয়ের প্রবল বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার পরিকল্পনা রচিত হয়। শিক্ষাখাতে এই প্রথম রুশ সরকার বহু অর্থ মঞ্জুর করেছিল। অবশ্য ১৯১৭ সালের পূর্বে রাশিয়ার নিরক্ষরদের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি ছিল। দ্বিতীয়ত, এই বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার আমলাতন্ত্র মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। বিপ্লব চলাকালের মর্যাদানাশের প্রলম্বিত ছায়া এর উপর পড়েছিল। এছাড়া, পুনরায় বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় আমলারা স্বেচ্ছাচারী হতে পারত না। অবশ্য জনগণের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সীমা আমলাদের খেয়ালখুশির উপর নির্ভরশীল ছিল। সুতরাং এই বিপ্লবের ফলে বিপ্লবীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি । সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার সার্থকতার জন্য রাশিয়া ১৯১৭ সালে এক বৃহত্তর বিপ্লবের পথে এগিয়ে যায় ৷
চ. বৈদেশিক বা আন্তর্জাতিক প্রভাব
১৯০৫ সালের বিপ্লব বৈদেশিক বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে পেছনে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, জার তৃতীয় আলেকজান্ডারের রাজত্বকালের পররাষ্ট্রক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো রুশ-ফরাসি মৈত্রী (১৮৯৩ সাল)। ঐক্যবদ্ধ জার্মানি গঠিত হওয়ার পর বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল ফ্রান্সকে ইউরোপে নির্বান্ধব রাখা। বিসর্মাক যতদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন ততদিন তাঁর এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল। তাঁর কূটনৈতিক মোহজালে আবদ্ধ রাষ্ট্রগুলো ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলতে পারেনি বা চায়নি। অবশ্য নিকট-প্রাচ্যে রুশ-অস্ট্রিয়া দ্বন্দ্বে তিনি অস্ট্রিয়ার পক্ষ সমর্থন করেন। ফলে রাশিয়া জার্মানির উপর অসন্তুষ্ট হয়। কূটকৌশলী বিসমার্ক রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী অক্ষুণ্ণ রাখেন। কিন্তু কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের উগ্র সাম্রাজ্যবাদী নীতি এবং অস্ট্রিয়ার প্রতি পক্ষপাতিত্ব রাশিয়াকে শঙ্কিত করে তোলে। এছাড়া, রুশ মৈত্রীর উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেননি। তাই তিনি রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ গঠনমূলক কাজে প্রয়োজনীয় অর্থ ঋণ হিসেবে দিতে অস্বীকৃত হন। রাশিয়া তখন ক্রমশ ফ্রান্সের দিকে ঝুঁকতে থাকে। এর ফলে রাশিয়া তার স্থলবাহিনী, নৌবহর ও রেলপথ সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর ফরাসি ঋণ লাভ করে। সে কারণে জার তৃতীয় আলেকজান্ডার ফ্রান্সের তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের
৭৮
বিরোধী হলেও ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রী-বন্ধনে আবদ্ধ হন। এর ফলে ফ্রান্স তাঁর নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে ওঠে, আর জার্মানি-অস্ট্রিয়া চক্রান্তে রাশিয়া কোণঠাসা অবস্থা থেকে
মুক্তিলাভ করে।
পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে জার দ্বিতীয় নিকোলাস শান্তিবাদী ছিলেন। জার্মান রাজপরিবারে তিনি বিয়ে করেছিলেন, জার্মানির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাও ছিল। তবু ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রী তিনি অক্ষুণ্ণ রাখেন। তিনি ও জারিনা প্যারিস সফরে গেলে বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। তিনি বলেছিলেন যে, রুশ সাম্রাজ্য ও ফরাসি তৃতীয় প্রজাতন্ত্র এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ।
চীনে মাঞ্চুরিয়ার উপর রাশিয়ার দৃষ্টি পড়েছিল। কিন্তু ১৮৯৪-৯৫ সালে সংঘটিত চীন-জাপান যুদ্ধে জাপান জয়লাভ করে মাঞ্চুরিয়া অধিকার করে। চীনের উপর জাপানের এই প্রভাব বিস্তৃত হওয়ায় সেখানে রুশ-স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। অবশেষে রাশিয়ার উদ্যোগে সিমনোশেকির সন্ধিতে প্রাপ্ত পোর্ট আথার ও লিয়াওটং জাপান ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে চীনকে প্রত্যর্পণ করে।
মঞ্চুরিয়ায় প্রত্যাশিত রুশ আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ এনেছিল বক্সার বিদ্রোহ (১৯০০ সাল)।
কিন্তু ইউরোপীয় শক্তিবর্গের বিরোধিতা ও ইঙ্গ-জাপান মৈত্রীর (১৯০২ সাল) ফলে রাশিয়া ধাপে ধাপে মাঞ্চুরিয়া থেকে সৈন্য অপসারণের পর রাশিয়া পুনরায় মাঞ্চুরিয়ায় নিজ আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। এতে নিজ স্বার্থ বিপন্ন হওয়ায় জাপান রাশিয়াকে চরমপত্র প্রেরণ করে। রাশিয়া চরমপত্র গ্রহণে অস্বীকার করলে রুশ-জাপান যুদ্ধ (১৯০৪-০৫) শুরু হয়। এই যুদ্ধে ‘বামন’ জাপান রুশ ‘দৈত্যকে পরাস্ত করে। উভয়ের মধ্যে পোর্টসমাউথের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে সুদূরপ্রাচ্যে রুশ অগ্রগতি সামরীকভাবে রুদ্ধ হয়। আর এই যুদ্ধের বিপর্যয়ের ফলে জারতন্ত্রের প্রতি জনরোষ বৃদ্ধি পায় ।
পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে রুশ-ফরাসি মৈত্রীর পর রাশিয়ার উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো ইঙ্গ-রুশ কনভেনশন (১৯০৭ সাল)। পারস্য, আফগানিস্তান ও দূরপ্রাচ্যে ইংল্যান্ড ও রাশিয়ার মধ্যে স্বার্থসংঘাত বাঁধে। অভিন্ন শত্রু জার্মানির বিরোধিতার জন্য উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধের তীব্রতা কমতে থাকে। অবশেষে ১৯০৭ সালে উভয়ের মধ্যে ইঙ্গ-রুশ কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়। এর দ্বারা পারস্যকে রুশ ও ব্রিটিশ দুটি প্রভাব বলয়ে বিভক্ত করা হয়; রাশিয়া আফগানিস্তান ও তিব্বতে হস্তক্ষেপ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। ফলে ইংরেজদের ভারতবর্ষে রুশ অগ্রগতির ভীতি বিদূরিত হয়। এইভাবে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া সম্মিলিত হয়ে একটি কূটনৈতিক গোষ্ঠী গড়ে তোলে। এটি ত্রিপল আঁতাত নামে অভিহিত। ত্রিপল অ্যালায়েন্সের প্রত্যুত্তর হিসেবে এটি গড়ে উঠেছিল। অবশেষে এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে রাশিয়ার কাছে চরমপত্র প্রেরণ করলে রাশিয়া সার্বিয়াকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দান করে। ফলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া মিত্রপক্ষে যোগদান করে। কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবের (১৯১৭) জন্য রাশিয়া জার্মানির সঙ্গে সন্ধি স্বাক্ষর করে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে। ১৯০৫ সালের বিপ্লব ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি এবং অক্টোবর
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রোডম্যাপ (Roadmap)
জ্ঞার দ্বিতীয় নিকোলাসের রাজত্বকালে ১৯০৫-এর বিপ্লব ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই বিপ্লবের ক্ষেত্র অনেক দিন ধরেই তৈরি হচ্ছিল। নিহিলিস্ট, নারোদনিকি আন্দোলনকে দমন করা হলেও বিপ্লবীদের অসন্তোষ প্রশামিত হয়নি। ইতোমধ্যে বিপ্লবীরা কৃষকদের কাছে ভালো সাড়া না পেয়ে শ্রমিক সংগঠনের উপরেই জোর দেয়। ১৯০৫-এর বিপ্লবে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরাও অংশ নেয়। ১৯০৪-০৫ সালে রুশ-জাপান যুদ্ধে জার সরকারের শোচনীয় পরাজয়ের ফলে জারতন্ত্রের জনপ্রিয়তা দারুণভাবে হ্রাস পায়। শ্রমিকদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ফলে শ্রমিকদের জঙ্গি চেতনা বাড়ে। জার নিকোলাসের আমলে পুঁজিবাদী শিল্পের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। এজন্য শ্রমিকদের উপর শোষণ তীব্র হয়। শ্রমিকরা তাদের দাবি জ্ঞাপনের জন্য ১৯০৫ সালের ৫ জানুয়ারি এক বিশাল মিছিল জারের উইন্টার প্যালেসের অভিমুখে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। ফাদার গ্যাপন নামে এক ভণ্ড শ্রমিক দরদি যাজক, যে ছিল আসলে পুলিশের গোয়েন্দা, তারই পরামর্শে এই মিছিল আইন ভেঙে জারের প্রাসাদের দিকে আগালে রক্ষীরা গুলি চালিয়ে ১৩০ জন শ্রমিককে নিহত করে এবং বহু লোক আহত হয়। এই নির্মম হত্যার ফলে গোটা দেশে উত্তেজনা দেখা দেয় এবং জনসাধারণ ক্রোধে ফেটে পড়ে। সারা দেশের কলকারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট, সংখ্যালঘু জাতিগুলোর বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ একসঙ্গে দেখা দিলে জার সরকার ধসে পড়ার উপক্রম হয়। সবচেয়ে মারাত্মক ছিল সেনাদলের একাংশের মধ্যেও এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। রুশ শ্রমিকদের উপর বলশেভিকদের প্রভাব ছিল সর্বাধিক। তাদের ডাকে অক্টোবর মাসে রাশিয়ায় কারখানাগুলোতে ১০ দিন লাগাতার ধর্মঘট চলে। কৃষকরাও পিছিয়ে থাকেনি । শেষ পর্যন্ত জার নিকোলাস কৌশলগত পশ্চাদপসরণ করেন। তিনি ৩০ অক্টোবর মন্ত্রী কাউন্ট উইটির পরামর্শে ‘অক্টোবরের ঘোষণাপত্র' দ্বারা রুশ জাতীয় সভা বা ডুমার (Duma) অধিবেশন ডাকার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি সমগ্র রাশিয়ায় অর্থাৎ রুশ সাম্রাজ্যের সকল অঞ্চলের লোকেদের ডুমায় প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দেন । জারের প্রস্তাবিত আইনকে ডুমার গ্রহণ অথবা বর্জনের অধিকার দেওয়া হয়। অক্টোবর ঘোষণার ফলে বিপ্লবীদের মধ্যে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। বিপ্লবীদের মধ্যে যারা নরমপন্থি ছিল তারা আপাতত জারের ঘোষণা অনুযায়ী সংবিধান চালু করতে চায়। চরমপন্থিরা জারতন্ত্রের উচ্ছেদ চায়। বলশেভিক বিপ্লবীরা ইতিমধ্যে রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি সোভিয়েত বা শ্রমিকদের বিপ্লবী কমিউন গঠন করেছিল। বিপ্লবীদের মধ্যে মতভেদের ফলে তাদের আন্দোলন স্তিমিত হলে জার তার সুযোগে সেন্ট পিটার্সবার্গের সোভিয়েত ভেঙে দেন ও বিপ্লবী সদস্যদের গ্রেফতার করেন। অন্যান্য স্থানেও সেনাদল বিপ্লবীদের দমিত করে। সেন্ট পিটার্সবার্গের সোভিয়েতের সমর্থনে মস্কোতে দাঙ্গা শুরু হলে পুলিশ তা দমিত করে। সরকার সামরিক আইন প্রয়োগ করে বিদ্রোহী এলাকায় শান্তিস্থাপন করেন। বহু বিপ্লবী ও সংখ্যালঘু শ্রেণিকে হত্যা করা হয়
অথবা নির্বাসনে পাঠান হয়। মন্ত্রী কাউন্ট উইটি বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল নীতি প্রয়োগের পরামর্শ দিলে ক্রুদ্ধ জার তাঁকে পদচ্যুত করেন। নতুন মন্ত্রী স্টোলিপিন বিদ্রোহীদের কড়া হাতে দমন করেন। ১৯০৬ সালে ৮ মাসের মধ্যে ৬৮৩ জন ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। সাহিত্যিক টলস্টয়ের মতে, “জার দ্বিতীয় নিকোলাসের রাজ্যে টেলিগ্রাফের মতো আধুনিক ব্যবস্থা চালু থাকলেও শাসননীতির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন 'চেঙ্গিস খাঁর মতোই স্বৈরাচারী” (He was a Changiz Khan with telegraph)।
১৯০৫ সালে বিপ্লব ব্যর্থ হলেও, এই বিপ্লবের পরোক্ষ ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ট্রটস্কির মতে, ১৯০৫ সালে বিপ্লবকে ১৯১৭ সালে বিপ্লবের অভিনয়ের পোশাকি মহড়া (Dress rehearsal) বা পূর্বাভিনয় বলা যায়। ঐতিহাসিক রদেনস্টিনের মতে, যে তিনটি বিপ্লবের আঘাতে রাশিয়ায় জারতন্ত্রের চূড়ান্ত পতন ঘটে, ১৯০৫-এর বিপ্লব ছিল তার প্রথম ধাপ। জার তাঁর অনুগত সেনাদের দ্বারা ১৯০৫-এর বিপ্লব আপাতত দমন করেন। কিন্তু এই বিপ্লব প্রমাণ করে যে : (ক) জারতন্ত্রের প্রতি রুশ শ্রমিক সমাজে আর আনুগত্য নেই। ৫ জানুয়ারি গুলিচালনা বা রক্তাক্ত রবিবারের ঘটনা (Bloody Sunday) শ্রমিক সম্প্রদায় ও জার সরকারের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীর তুলে দেয়। রুশ কৃষকরা জানিয়ে দেয় যে, আমূল ভূমিসংস্কার না হলে তারা কোনো জোড়াতালি সংস্কারে সন্তুষ্ট হবে না। অক্টোবরে যে সংবিধান জার ঘোষণা করেন তাতে বুদ্ধিজীবীরা সন্তুষ্ট হয়নি। কারণ গণনির্বাচনের মাধ্যমে একটি সার্বভৌম পার্লামেন্টের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে জার একজন নিয়মতান্ত্রিক রাজা হিসেবে থাকতে রাজি ছিলেন না। ১৯০৫-এর পর বিপ্লবের উড়ন্ত স্ফুলিঙ্গ নিভে গেলেও, ছাইচাপা আগুনের মতোই বিপ্লবের আগুন ধিক ধিক করে জ্বলতে থাকে। অক্টোবরের ঘোষণা অনুযায়ী জার দুটি ডুমার নির্বাচন পর পর করেন। ডুমা আমূল ভূমিসংস্কার চাইলে জার দুটি ডুমাই ভেঙে দেন। এর ফলে বিপ্লবীরা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন যে, জারতন্ত্রের পতন না ঘটলে রাশিয়ায় কোনো সংস্কার সফল হবে না। ১৯০৫-এর বিপ্লবের সাময়িক সাফল্য বিপ্লবীদের কাছে কয়েকটি সত্য উদঘাটন করে : (ক) শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিপ্লবী চেতনা জেগে উঠছে। উপযুক্ত প্রস্তুতি, নেতৃত্ব ও সংগঠন করলে পরবর্তী বিপ্লব ব্যর্থ হবে না। ১৯০৫-এর বিপ্লবের চোখ খুলে দেয়। (খ) কৃষক শ্রেণিও ভবিষ্যৎ বিপ্লবে সহযোগিতা করবে তা ১৯০৫-এর বিপ্লবের থেকে শিক্ষা বিপ্লবীরা নেয়। (গ) শ্রমিকের দ্বারা লাগাতার ধর্মঘট যে সরকারকে অচল করতে সক্ষম ১৯০৫-এর বিপ্লব তা প্রমাণ করে। কাজেই ১৯০৫- এর বিপ্লব পরবর্তী বিপ্লবের পূর্বাভিনয় ছিল। ১৯১৭ সালে এই পথ ধরেই বিপ্লবকে সফল করা হয়।
১. স্টোলিপিন আইনে ভূমিব্যবস্থা সংস্কার
জার নিকোলাসের শাসনব্যবস্থায় স্বৈরতন্ত্র বহাল থাকলেও, এতে জারের একাধিপত্য ছিল না। অভিজাত ভূস্বামী, বুর্জোয়া বণিকশ্রেণি এবং কুলাক বা জোতদার শ্রেণির সঙ্গে জারকে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে হয়। ১৯০৫-এর বিপ্লবের পর দুটি ডুমার অধিবেশন জার নিকোলাস ভেঙে দেন। তৃতীয় ডুমায় সম্পত্তির অধিকারের ভিত্তিতে
নির্বাচনের ফলে জমিদার, কুলাক বা জোতদার, আমলা ও গির্জার প্রতিনিধিরা বেশি। শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেন। স্টোলিপিন কৃষকদের সমর্থন লাভের জজন্য চেষ্টা করেন। তিনি একটি ভূমি আইন পাস করেন (Stolypon's reforms ) এই আইন দ্বারা জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের ভূমিসংস্কার আইন সংশোধন করে কৃষকদের জমির বিক্রয়ের ও খরিদের অধিকার দেওয়া হয়। স্টোলিপিন চেয়েছিলেন গ্রামীণ কমিউনগুলির অধিকার খর্ব করে, নিজ জমির মালিক গৃহস্থ কৃষক শ্রেণি সৃষ্টি করতে। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, এর ফলে গ্রামাঞ্চলে সুস্থিতি ফিরে আসবে। কৃষকদের উপর গ্রাম। কমিউন যে নিয়ন্ত্রণ চাপায়, এজন্য স্টোলিপিন কৃষকদের তা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন। জমির শর্তহীন মালিকানা প্রদান ছিল সেই প্রচেষ্টার অঙ্গ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছড়ানো ভূমিখণ্ডগুলোকে তিনি এজন্য একত্র করে কৃষকদের দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এই ব্যবস্থার ফলে ইউরোপীয় রাশিয়ার
ভাগ জমি বড় বড় প্লটে পরিণত হয়। প্রায়
মিলিয়ন কৃষক পরিবার কমিউন প্রথা থেকে মুক্ত হয়ে নিজ জমির মালিকানা পায় । স্টোলিপিনের ১৯১০ সালে দ্বিতীয় ভূমিসংস্কার আইন দ্বারা প্রায় সকল কৃষক জমির মালিকানা পায়। স্টোলিপিনের ভূমিসংস্কার আইনকে এজন্য জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের ভূমিদাস উচ্ছেদ আইনের পর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ভূমিসংস্কার আইন বলা হয়। ওর্গানস্কি (Organsky) প্রভৃতি বিখ্যাত ঐতিহাসিকেরা এজন্য স্টোলিপিনের প্রশংসা করেন। ট্রেডগোল্ডের মতে, স্টোলিপিন প্রকৃতপক্ষে জারের ভেঙে অনেক অর্থনীতিক পড়া সাম্রাজ্যকে রক্ষার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করেন। ঐতিহাসিকেরাও বলেন যে, স্টোলিপিন জীবিত থাকলে রাশিয়ার কৃষি ও শিল্পের চেহারা বদলে যেত। কিন্তু মার্কসবাদী সমালোচকদের মতে, স্টোলিপিন জমি মালিকদের স্বার্থই দেখার চেষ্টা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কমিউনের অধিকার খর্ব করা। তিনি জমির পুনর্বণ্টন দ্বারা কৃষির আসল সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেননি। অধিকন্তু কৃষকরা জমির মালিকানা পেয়ে দ্রুত জমিগুলো বিক্রি করে ফেলে। গরিব কৃষকদের জমি কুলাক বা জোতদাররা কিনে নেয় এবং এই জমির সাহায্যে বড় খামার তৈরি করে। স্টোলিপিনের সংস্কারের ফলে রাশিয়ায় জোতদার প্রথা জোরদার হয় ।
২. স্টোলিপিনের হত্যা
স্টোলিপিনের জনপ্রিয়তায় জার দ্বিতীয় নিকোলাস ঈর্ষা বোধ করেন। তিনি এই আশঙ্কা করেন যে, স্টোলিপিন ডুমা বা জাতীয় সভার সাহায্যে জারের ক্ষমতা হরণ করবেন এবং জারকে সাংবিধানিক রাজায় পরিণত করবেন। এই আশঙ্কা বশত জার নিকোলাস স্টোলিপিনকে মন্ত্রীপদ থেকে সরাতে মনস্থ করেন। ১৯১১ সালে স্টোলিপিন, বোগরভ (Bogrov) নামে এক গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। স্টোলিপিনের মৃত্যুর ফলে জারের মন্ত্রিসভা থেকে শেষ যোগ্য ব্যক্তির তিরোধন ঘটে।
৩. রুশ শিল্প ব্যবস্থার অগ্রগতি
জার দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনকালে রাশিয়ায় শিল্পের বিস্তার ঘটে। যোগাড় গ্রসম্যানের মতে, জারের আমলে শিল্প বিস্তার ও শ্রমিক অসন্তোষ এই দুই বিষয়ে উপেক্ষা করা যায় না। কাউন্ট উইটির অর্থনীতির ফলে রুশ শিল্প, রুশ-জাপান যুদ্ধে মন্দা কাটিয়ে তেজি হয়ে ওঠে। রাশিয়ার ডোনেৎস উপত্যকায় কয়লা শিল্পের এ উন্নতি ঘটে যে, ১৯১৩ সালে সমগ্র দেশের প্রয়োজনীয় কয়লার ৫৫% এই স্থানে উৎপাদিত হতো। উরাল, সাইবেরিয়া, তুর্কিস্তান প্রভৃতি অঞ্চলে কয়লার উৎপাদনের হার দাঁড়ায় ১৯০৫ সালে যে ক্ষেত্রে ১০৩ মিলিয়ন পুড ১৯১৩ সালে তা হয় ১৮৯৭ মিলিয়ন পুড। রাশিয়ার বস্ত্র শিল্পে যেক্ষেত্রে ১৯০৫ সালে ২৪৬ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের বহু উৎপাদিত হতো; ১৯১০ সালে সেক্ষেত্রে ৪০৫ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের বস্ত্র উৎপাদিত হয়। ১৮৯৮ সালে রাশিয়ায় ২৮,৮৮৬ মাইল রেলপথ চালু ছিল। আরও ৬,৯৭৩ মাইল নির্মীয়মাণ অবস্থায় ছিল। শহরাঞ্চলে লোকের সংখ্যা ৪৫% বাড়ে। বিভিন্ন কলকারখানায় ১,৭২,০০০ শ্রমিক কাজ করতো। রাশিয়ায় শিল্প বিস্তারের জন্য বৈদেশিক মূলধন নিয়োজিত হয়। ১৯১৪ সালে রাশিয়ায় বৈদেশিক লগ্নি ছিল ১২,০০০ মিলিয়ন রুবল। এই মূলধনের শতকরা ৩২ ভাগ ফ্রান্স এবং ২২.৫% ভাগ ইংল্যান্ড এবং ১৬% জার্মানি থেকে আসে।
৪. শ্রমিক অসন্তোষ : দমননীতি
শিল্প বিস্তারের ফলে কলকারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা দারুণভাবে বাড়ে। রাশিয়ার প্রকৃত শ্রমজীবী শ্রেণি বা প্রলৈতারিয়েত শ্রেণির উদ্ভব হয়। কিন্তু জার নিকোলাস এই বিরাট উৎপাদক শ্রেণির উন্নতি সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। শ্রমিকদের কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। কারখানায় আলো-বাতাসের সুবন্দোবস্ত না থাকায় শ্রমিকরা অধিক পরিশ্রম ও অস্বাস্থকর পরিবেশে কাজ করে শীঘ্র মারা যেত। শ্রমিকদের বাসস্থানের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। তাদের মজুরি ছিল নিম্নতম। জার নিকোলাস শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজ ও উন্নত মজুরির দাবিতে কর্ণপাত করেননি। এজন্য তাঁর শাসনকালে দারুণ শ্রমিক অসন্তোষ ও ধর্মঘট চলতে থাকে। এই সুযোগে বলশেভিক দল শ্রমিকদের মধ্যে তাদের প্রভাব বিস্তার করে। ১৯১২ সালে একটি স্বর্ণখনিতে ধর্মঘটী শ্রমিকদের উপর সেনারা গুলি চালালে প্রায় ২০০ শ্রমিক নিহত হয়। জার সরকারের দমননীতির চাপে সোস্যালিস্ট ও কমিউনিস্ট কর্মীরা দেশত্যাগে বাধ্য হন। বলশেভিক নেতা লেনিন ও এই সময় দেশত্যাগ করেন। কাজেই মার্কসবাদী সমালোচকরা বলেন যে, জার দ্বিতীয় নিকোলাসের আমলে শিল্প বিস্তারের আসল চেহারা ছিল হতাশাজনক। প্রথমত, ১৮৯০ সালের পর থেকে রুশ শিল্পে পুঁজিবাদ ভয়ানক বৃদ্ধি পায়। মালিকরা মুনাফার পাহাড় জমাতে চেষ্টা করে। রুশ শিল্পের প্রায়
ভাগ ছিল বিদেশি মূলধন ও বিদেশি মালিকানায় গঠিত। তৈল শিল্পে ব্রিটিশ, রসায়ন ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে জার্মান এবং রেল ও কয়লা শিল্পে ফরাসি মূলধন খাটত। এদিকে দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য জার সরকারের কোনোই মাথাব্যথা ছিল না। জার রুশ সংখ্যালঘু শ্রেণির উপর নির্মম রুশীকরণ নীতি চাপাবার ফলে সংখ্যালঘু শ্রেণি ভয়ানক অসন্তুষ্ট ছিল।
জারের উপর রাসপুটিন নামক এক ভণ্ড সন্ন্যাসীর অশুভ প্রভাব পড়লে ব্যক্তিত্বহীন জার তাঁর কথায় চলতে আরম্ভ করেন। গ্রেগরি রাসপুটিন ছিল জনৈক জর্জিয়ান খ্রিষ্টীয় সন্ন্যাসী। রাসপুটিন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল বলে দাবি করতো। এই ভণ্ড সাধু তার তন্ত্রমন্ত্রের জোরে জারিনা আলেকজান্দ্রার একমাত্র বালক পুত্রের দুরারোগ্য রক্তপাত রোগ নিরাময় করে। এর ফলে রাসপুটিন রানি আলেকজান্দ্রার উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। রাসপুটিনের প্রভাবে রাজপরিবার চালিত হলে রোমানভ রাজবংশের সম্মান বিনষ্ট হয়। রাসপুটিনকে দমনে ব্যর্থ হওয়ায় জনসাধারণ নিকোলাসের প্রতি বিরক্ত হয়। রাসপুটিন রানিকে হাত করে মন্ত্রী ও সেনাপতিদের তার কথামতো চলতে বাধ্য করে। এজন্য সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে দারুণ ক্ষোভ দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত কয়েকজন সেনাপতি রাসপুটিনকে হত্যা করেন।
৬. ডুমার অধিবেশন আহ্বান : কুলাক শ্রেণির ক্ষমতা বৃদ্ধি
জার দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনকালে দূরপ্রাচ্যে মাঞ্চুরিয়ার উপর অধিকার নিয়ে রুশ-জাপান বিরোধ বাঁধে। ১৯০৪-০৫ সালে রুশ-জাপান যুদ্ধে ক্ষুদ্র জাপানের নিকট দৈত্যাকৃতি রাশিয়ার পরাজয় ঘটলে জার সরকারের বিরুদ্ধে ধিক্কার ওঠে। জার সরকারের এই দুরবস্থার সুযোগে রুশ সোস্যাল ডেমোক্র্যাট, নারোদনিক এবং বলশেভিকরা ১৯০৫ সালে বিপ্লব ঘোষণা করে। কিন্তু জার দৃঢ় হাতে তা দমন করেন। (১৯০৫-এর বিপ্লবের বিশদ বিবরণ আগে দ্রষ্টব্য)। এই বিপ্লবের ফলে জার দ্বিতীয় নিকোলাস বাধ্য হয়ে ১৯০৬ সালে প্রথম ডুমা বা জাতীয় পরিষদ আহ্বান করেন। কিন্তু ডুমার সভায় রাশিয়ার সংবিধান প্রবর্তনের দাবি উঠলে জার প্রথম ডুমা ভেঙে দেন। পরের বছর (১৯০৭ সালে) তিনি দ্বিতীয় ডুমা আহ্বান করেন। কিন্তু মন্ত্রিসভায় সঙ্গে ডুমার সদস্যদের বিরোধ দেখা দিলে, ৪ মাসের মধ্যে জার এই ডুমাও বাতিল করেন। ১৯০৭ সালে জার তৃতীয় ডুমার অধিবেশন ডাকেন। তিনি ভোটাধিকার সংকোচন করে তৃতীয় ডুমার নির্বাচন করেন। ফলে এই ডুমায় মডারেটরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। অনেকের মতে, ডুমার নির্বাচনে জার সরকার দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বামপন্থি ও বিরোধীদের পরাস্ত করেন। তৃতীয় ডুমার পাস করা আইন দ্বারা রুশ কুলাক বা জোতদার শ্রেণি, দরিদ্র কৃষকদের জমি ক্রয় করার অধিকার পায়। ১৯১২ সালে তৃতীয় ডুমার কার্যকাল শেষ হয় ।
৭. রাশিয়ার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান : রাশিয়ার পরাজয়
১৯১২ সালে চতুর্থ ডুমা বা জাতীয় পরিষদ আহূত হয়। এই ডুমার অধিবেশন কালে ১৯১৪ সালে জার সরকার প্রথম মহাযুদ্ধে যোগ দেয়। রাশিয়ার শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির অসন্তোষ, বুদ্ধিজীবী শ্রেণির হতাশা, বামপন্থি দলগুলোর বিদ্রোহী মনোভাব উপেক্ষা করে জার সরকার যুদ্ধে যোগ দিয়ে মহা ভুল করেন। এই যুদ্ধে যোগদানের

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]