রাশিয়ায় ১৯০৫ সালের বিপ্লব : কারণ, প্রকৃতি ও ফলাফল

সৈন্যবাহিনীতে লোক ভর্তির ফলে গ্রামের কৃষকদের মধ্যে উত্তেজনা ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ বাঁধিয়ে জার বৈপ্লবিক আন্দোলন স্তব্ধ করতে চাইলেও সেটাই তাঁর জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। রুশ-জাপান যুদ্ধের ফলে জারতন্ত্রের পচনশীলতা ও জনবিরোধী চরিত্র জনগণের কাছে উন্মোচিত হয়ে পড়ে। অসন্তোষ সারা রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ ছিল যেন শেষ বিন্দুটা, যার দরুন মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। রাশিয়া এসে পড়ে বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে। ১৯০৫ সালের ৯ জানুয়ারির ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে।
২.৩ ১৯০৫ সালের বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ (Usual Course of Events)
রুশ শাসনব্যবস্থার উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে সরকারি নির্দেশে ১৯০৫ সালের নভেম্বর মাসে সমস্ত জেমস্টভোর প্রতিনিধিরা সেন্ট পিটার্সবার্গে সমবেত হয়। মতানৈক্য সত্ত্বেও কতকগুলো সাধারণ দাবি উত্থাপিত হয়েছিল, যেমন- বিবেক, বাক, মুদ্রণ, জনসভা ও সংঘ স্থাপনের স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে অধিকতর ক্ষমতা এবং শক্তিশালী পার্লামেন্ট গঠন। স্বৈরাচারী জার দ্বিতীয় নিকোলাস দাবিগুলোকে উপেক্ষা করলেন। এরপর রুশ-জাপান যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ে গণবিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করল।
i. রক্তমাখা রবিবার/রক্তাক্ত রবিবার/রক্তরাঙ্গা রবিবার
অবশেষে পুঞ্জীভূত গণবিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল ১৯০৫ সালের জানুয়ারি মাসে। সেন্ট পিটার্সবার্গের বহু কলকারখানার শ্রমিকরা ঐ সময় ধর্মঘট করে। ৯ জানুয়ারি রবিবার গ্রেগরি গ্যাপন নামে জনৈক পাদ্রির নেতৃত্বে প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিক তাদের দস্তখত সংবলিত আবেদনপত্র জারের কাছে পেশ করার জন্য তাঁর শীতকালীন প্রাসাদের অভিমুখে শোভাযাত্রা করে অগ্রসর হয়। কেননা এদের অনেকেরই ধারণা ছিল তিনি সহৃদয় হলেও তাদের দুরবস্থার কথা তাঁর অজানা। কিন্তু “জনগণের জনক” জার তাদের দর্শন না দিয়ে সেই প্রাসাদ ত্যাগ করে গেলেন। জারের সৈন্যবাহিনী শোভাযাত্রার পথরোধ করে তার উপর গুলিবর্ষণ করল। এক হাজারেরও অধিক শোভাযাত্রাকারী শ্রমিক নিহত হলো, আহত হলো আরও অনেক বেশি। ঘটনাটি ইতিহাসে ‘রক্তমাখা রবিবার' (Bloody Sunday) নামে স্মরণীয় হয়ে আছে।
ii. ১৯০৫ সালের বিপ্লবের সূচনা
ঘটনাটির তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো। সেন্ট পিটার্সবার্গে সাধারণ ধর্মঘট দেখা দিল এবং তা দ্রুত সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। শুরু হলো কৃষি হাঙ্গামা। কৃষকরা বহু অভিজাতদের আবাসস্থলে অগ্নিসংযোগ করে। মে মাসে ইভানোভো-ভজনেসন্ কস্- এর কাপড়ের কলের ধর্মঘটী শ্রমিকরা একটি সোভিয়েত বা বিশেষ কাউন্সিল নির্বাচিত করে ধর্মঘটের নেতৃত্ব দান করে। এর সূত্র ধরে রাশিয়ায় বিভিন্ন স্থানে
সোভিয়েত গঠিত হতে থাকে পরবর্তীকালে শ্রমিকদের সোভিয়েতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবী সংস্থায় পরিণত হয়। সৈন্যবাি ছড়িয়ে পড়ে। জুন মাসে 'পোটেমকিন' নামক রণতরির সৈনিকরা বিরুদ্ধে প্রেরিত সৈনিকরাও উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারদের আে অসম্মত হয়। বিদ্রোহীদের হাতে জারের প্রতিক্রিয়াশীল খুল্লতাত নিহত হন ।
iii. ১৯০৫ সালে বিপ্লবের সূত্রপাত
৯ জুনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সারা রাশিয়ায় এবে ধর্মঘটের ঢেউ বইতে থাকে। পিটার্সবার্গে এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে তিফলিস, বাকু এবং অন্যান্য শহরের শ্রমিকেরা ধর্মঘটের ডাক শুধু জানুয়ারি মাসেই ধর্মঘট করে ৪ লক্ষ ৪০ হাজার শ্রমিক, বছরের সংখ্যার চেয়ে বেশি। পিটার্সবার্গের শ্রমিকদের স্লোগান ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হলো দেশময়। এভাবেই রাশিয়ায় প্র শুরু হয়। এই বিপ্লব আন্দোলনই রাশিয়ার ইতিহাসে ‘১৯০৫ পরিচিতি লাভ করেছে।
১৯০৫ সালে সারা শীতকাল ও বসন্তকাল ধরে দেশে ধ যায়। উরাল এলাকায়, ইউক্রেনে, ট্রান্স ককেশিয়ায় এবং লাটি শ্রমিকদের পাশাপাশি কৃষক আন্দোলনও সক্রিয় হয়ে ওঠে। কৃষক আক্রমণ শুরু করে, জমিদার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়, শস্য লুট করে, ভূসম্পত্তি জনগণের হাতে তুলে দেবার দাবি করতে থাকে।
iv. বিপ্লবী শ্রমিকদের সোভিয়েত গঠন ও বিপ্লবের নয়া মোড় চলমান বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে রাশিয়ার রাজধানী পিটার্স করে শ্রমিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত' (Soviets of Worke শ্রমিকদের বিপ্লবী কমিউন যা জনগণের ক্ষমতার এক নতুন ধর আধা (Prototype) রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। এই সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার মূল স্তম্ভ ছিল।
বলশেভিক নেতা মিখাইল ফ্রুঞ্জে এবং আফানাসিয়েভের নে প্রতিনিধিদের সোভিয়েত' গঠন করে পিটার্সবার্গের ইভানোভো-ভো টেক্সটাইল শ্রমিকরা। ১৯০৫ সালের শেষ নাগাদ সারা রাশিয়ায় ‘সোভিয়েত’ কর্মরত ছিল। এসব সোভিয়েত প্রথমে ধর্মঘট কমিটি ি কিন্তু পরবর্তীতে এগুলো সশস্ত্র বিদ্রোহ পরিচালনা করে ।
রাশিয়ায় প্রথম বিপ্লবের ফলে শ্রমিক শ্রেণি এবং রাশিয়ার শক্তিসমূহ, বিশেষত কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে মৈত্রী গড়ে ওঠে শক্তি সৈন্যবাহিনীর মধ্যেও বিপ্লবের ঢেউ লাগে ।
V.
১৯০৫ সালের বিপ্লব : কারণ, প্রকৃতি ও ফলাফল
. পতেমকিন যুদ্ধ জাহাজের নাবিকদের সক্রিয় বিদ্রোহ
৬৭
১৯০৫ সালের ১৪ জুন কৃষ্ণসাগরে রুশ নৌবহরের যুদ্ধ জাহাজ 'পতেমকিন'
| ক্রুরে বিদ্রোহ ঘটে। এটিই ছিল সৈন্যবাহিনী ও নৌবাহিনীর মধ্যে প্রথম বিদ্রোহের
ইঙ্গিত। ১৯০৫ সালের নভেম্বরে সেবাস্তপোলের নাবিক ও সৈনিকরাও বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ ওদেসাতেও দেখা দেয়। বিদ্রোহী সৈনিকরা অফিসারদের খারাপ ব্যবহার সহ্য | করতে রাজি ছিল না। 'পতেমকিন' জাহাজের বিদ্রোহী নাবিকরা জাহাজ দখল করে
তাতে লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে দেয়। অনেক অফিসারকে হত্যা করে। শ্রমিক, নাবিক এবং সৈনিকদের সোভিয়েত সৈন্যবাহিনীর বিদ্রোহ পরিচালনা করে। জার সরকার তার অনুগত বাহিনী দ্বারা নাবিকদের বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়। তবে এতে প্রমাণ হয় যে, জারতন্ত্রের প্রধান অবলম্বন সশস্ত্র শক্তিও ভেঙে পড়েছিল।
vi. অক্টোবর শ্রমিক হরতাল
এ সময় রুশ শ্রমিকদের ও বলশেভিকদের প্রভাবও বৃদ্ধি পায়। তাদের নেতৃত্বে ১৯০৫ সালের অক্টোবরের প্রথমে মস্কোর রেলওয়ে টার্মিনাল হরতাল শুরু করে এবং ১২ অক্টোবর পিটার্সবার্গ রেল টার্মিনালের শ্রমিকরাও হরতালে যায়। শুধু তাই নয়, অক্টোবর মাসে দেশজোড়া সাধারণ ধর্মঘট হয়, এতে শামিল হয় কলকারখানা, রেলওয়ে, ডাক, তার ব্যবস্থা। ধর্মঘটের সঙ্গে আরো যোগ দিয়েছিল অফিসের জুনিয়র কর্মচারীরা, দোকান কর্মচারী, শহরের পরিবহণ শ্রমিক, ছাত্র, আইনজীবী, ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়াররা। প্রায় দেড় মিলিয়ন শ্রমিক এবং দুই লক্ষ চাকরিজীবী ধর্মঘটে অংশ নেয়। স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদ করে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ছিল তাদের দাবি। তারা একটি সাংবিধানিক সভা প্রতিষ্ঠারও দাবি করে। অন্যান্য কারখানার ধর্মঘট জার সরকার সবলে দমন করতে পারলেও সম্মিলিত সাধারণ ধর্মঘট সৈন্যবাহিনী দিয়েও দমন করতে ব্যর্থ হয়। জার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং মন্ত্রী কাউন্ট উইটির পরামর্শ মতো কৌশলগত পশ্চাদপসরণের মাধ্যমে কিছু কিছু সুযোগ সুবিধা ঘোষণা করে বিপ্লবের বিকাশ রোধের জন্য সচেষ্ট হয়।
vii. ২য় নিকোলাসের ‘অক্টোবর ইশতাহার' ঘোষণা
জার দ্বিতীয় নিকোলাস ১৯০৫ সালের ১৭ অক্টোবর বিভিন্ন নাগরিক অধিকার সংবলিত একটি ইশতাহার (Manifesto) ঘোষণা করেন যা ‘অক্টোবর ইশতাহার' নামে পরিচিত ।
এতে মত প্রকাশের তথা বাকবিবেকের ও সভা সমাবেশের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় । ভবিষ্যতে বিনা বিচারে কাউকে বন্দি ও জেল দেওয়া হবে না।

সবশেষে রুশ সভা ‘ডুমা' (Parliament) নামক নির্বাচিত সংস্থা গঠন হবে এবং এর অনুমোদন ছাড়া কোনো আইন কার্যকরী হবে না ঘোষণা করেন।
এ ডুমাকে অনেকে একটি পরামর্শ সভা ছাড়া কিছু মনে করেনি। সোস্যা ডেমোক্র্যাটদের অনেকে এ সংস্কারকে ভুয়া বলে প্রত্যাখ্যান করে।
viii. ডুমার অধিবেশনসমূহ
১৯০৬ সালের মে মাসে ডুমার প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অক্টোবর ইস্তেহা প্রকাশের পর থেকে ডুমার গঠনে কতকগুলো পরিবর্তন আনা হয়। জার দ্বিতীয় নিকোলাস একটি উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট রাষ্ট্রীয় পরিষদ (State Council) সৃষ্টি করেন যায় অন অর্ধেক সদস্য নিজে মনোনীত করবেন। এছাড়া তিনি স্বয়ং যুদ্ধ ঘোষণার অধিকার তা অর্থোডক্স চার্চ নিয়ন্ত্রণ এবং ডুমা ভেঙে দেবার অধিকার নিজ হাতে রাখেন। বি অধিকন্তু জার মন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করার ক্ষমতাও নিজ হাতে রাখেন ।
প্রথম সভায় ডুমার সদস্যরা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দান, আট ঘণ্টা কাজের সময় ধার্য, ভূমিসংস্কার এবং রাশিয়ায় সংবিধান প্রবর্তনসহ এক গুচ্ছ দাবি উত্থাপন করে। জার দ্বিতীয় নিকোলাস এই সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং ডুমার অধিবেশন বাতিল করেন।
মন্ত্রী কাউন্ট উইটি বিপ্লবীদের এবং রাজবন্দিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে জার দ্বিতীয় নিকোলাস ১৯০৬ সালের এপ্রিলে তাঁকে পদচ্যুত করে অধিক রক্ষণশীল ও কঠোর প্রকৃতির পিটার স্টোলিপিনকে মন্ত্রী নিয়োগ করেন। স্টোলিপিন প্রয়োজনীয় ভূমিসংস্কারের পাশাপাশি বিপ্লবীদের কঠোর হস্তে দমনের পথে অগ্রসর হন। জার ১৯০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডুমার দ্বিতীয় অধিবেশন ডাকেন কিন্তু মন্ত্রীদের সাথে ডুমার সদস্যদের বিরোধ দেখা দিলে ৪ মাসের মধ্যে জার ২য় নিকোলাস এ ডুমার অধিবেশন বাতিল করেন।
১৯০৭ সালে জার আবার তৃতীয় ডুমার সভা আহ্বান করেন। তিনি ভোটাধিকার সংকোচন করে তৃতীয় ডুমার নির্বাচন করেন। ফলে বুর্জোয়াও ভূস্বামী প্রতিনিধিরাও ডুমায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। অনেকের মতে, ডুমার নির্বাচনে জার সরকার দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বামপন্থি ও বিরোধীদের পরাস্ত করেন। তৃতীয় ডুমার পাস করা আইন দ্বারা রুশ কুলাক বা জোতদার শ্রেণি দরিদ্র কৃষকের জমি ক্রয়ের অধিকার পায়। ১৯১২ সালে তৃতীয় ডুমার কার্যকাল শেষ হয়। ১৯১২ সালে চতুর্থ ডুমা আহুত হয় । এই ডুমার কার্যকালে ১৯১৪ সালে রাশিয়া মিত্রপক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয় এবং এ ডুমার . দ্বারাই জার দ্বিতীয় নিকোলাস ১৯১৭ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়।
১৯০৫ সালের বিপ্লব : কারণ, প্রকৃতি ও ফলাফল
যাহোক, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডুমার কার্যকালে অর্থাৎ ১৯০৫-১৯০৭ সাল পর্যন্ত রাশিয়ায় প্রথম বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব চলে। জার ডুমার অধিবেশন ডেকে বিপ্লবকে প্রশমিত করা ও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। প্রথমদিকে এ কাজে সফল হলেও পরবর্তীতে এ ডুমায় তার জন্য বুমেরাং হয়ে যায়।
ix. কৃষ্ণশতক
অক্টোবর ইশতাহার ঘোষণার পর লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা জারের এ ইশতাহারকে ভুয়া বলে আখ্যায়িত করে জারতন্ত্র উচ্ছেদের জন্য সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনের আহ্বান জানায়। অপরপক্ষে মেনশেভিকসহ উদারনৈতিক বুর্জোয়া দলসমূহ বুর্জোয়া ভূসামন্তদের পার্টি যেমন- 'সাংবিধানিক ডেমোক্র্যাটস পার্টি (কাদেতস), ১৭ অক্টোবর লিগ (অক্টোবরিস্ট) প্রভৃতি পার্টি দ্বিতীয় নিকোলাসের পক্ষ অবলম্বন করে প্রতিবিপ্লব শুরু করে দেয়। দ্বিতীয় নিকোলোসের সমর্থক গোষ্ঠী তথাকথিত 'কৃষ্ণশতক' বা 'ব্ল্যাক হানড্রেড' (Black Hundreds) গঠন করে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। জেল থেকে খালাস পাওয়া দস্যু, কিছু দোকানদার, আমলাদের নিয়ে পুলিশ পরিচালিত রাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন গঠন করে ‘কৃষ্ণশতক' । লোকেরা এ দস্যুদের ‘কৃষ্ণশতক' আখ্যা দেয়। এই কৃষ্ণশতকের সদস্যরা দুই অথবা তিন সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়ার একশত নগর ও শহরের ১০ হাজারের অধিক ব্যক্তিকে হত্যা বা আহত করে । নতুনভাবে প্রদত্ত স্বাধীনতা ‘মুক্ত’ নাগরিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়।
x. মস্কো সশস্ত্র বিপ্লব ও তা দমন
জার সরকার দেশে গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি করে। শ্রমিকরাও সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেয়। জারের বিরুদ্ধে ১৯০৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথম সশস্ত্র লড়াই শুরু করে মস্কোর শ্রমিকরা। ১৯০৫ সালের ৭ ডিসেম্বরে বলশেভিকদের পরিচালিত মস্কো সোভিয়েতের নির্দেশে শ্রমিকরা রাস্তায় লাল ঝাণ্ডা হাতে মিছিল করে এবং রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে তোলে । এসব ব্যারিকেডের পিছন থেকে শ্রমিকরা জারের সৈন্য ও পুলিশের প্রতি গুলি চালায়। মস্কোর প্রেসনিয়া মহল্লায় লড়াইগুলো খুবই দুর্ধর্ষ হয়েছিল। জারের অনেক সৈন্য শ্রমিকদের প্রতি গুলি চালাতে অস্বীকার করলে শেষ পর্যন্ত রাজভক্ত গোলন্দাজ বাহিনী কামানের গোলা নিক্ষেপের মাধ্যমে বহু হতাহতের পর শ্রমিকদের পিছু হটিয়ে দেয়। ৯ দিন ধরে শ্রমিকরা মস্কোয় সশস্ত্র লড়াই চালায়। ১৯ ডিসেম্বর মস্কো সোভিয়েত শ্রমিকদের সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধ করে। মস্কো অভ্যুত্থান ছিল প্রথম বিপ্লবের চূড়ান্ত পর্যায়। প্রেসনিয়ার লড়াইয়ের ঘটনা সারা দেশে শ্রমিকদের মধ্যে দৃঢ়তা এনে দেয়। মস্কো শ্রমিকদের অনুকরণে দোনেৎস অববাহিকায়, ডন অববাহিকায়, সরমোভোর, উরালের, ইউক্রেনের, এস্তোনিয়ার আর ট্রান্স-ককেশাসের শ্রমিকরা সশস্ত্র লড়াই শুরু করেছিল। তবে জারের বাহিনী অত্যন্ত পাশবিক উপায়ে এসব বিদ্রোহ দমন করে। কিন্তু রাশিয়ার শ্রমিকরা তৎক্ষণাৎ অস্ত্র সমর্পণ করেনি। এ সংগ্রাম ১৯০৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ১৯০৬ সালে বহু কৃষক বিদ্রোহ ঘটেছিল। কৃষকরা ভূস্বামীদের বাড়িতে হানা দিয়ে তাদের অনেকের ভূমি ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছিল।
শ্রমিক বিদ্রোহের মতো কৃষক বিদ্রোহ দমন করা হয়। বিপ্লবীদের মধ্যে মতভেদের ফলে তাদের আন্দোলনে ভাটা পড়লে জার এই সুযোগে সেন্ট পিটার্সবার্গের সোভিয়েত ভেঙে দেন এবং বিপ্লবী সদস্যদের গ্রেফতার করে। অন্যান্য স্থানেও সেনাদল বিপ্লবীদের দমন করে। বহু বিপ্লবী ও সংখ্যালঘু শ্রেণিকে হত্যা করা হয় অথবা নির্বাসনে পাঠানো হয়। মন্ত্রী কাউন্ট উইটি বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতির নীতি প্রয়োগের পরামর্শ দিলে ক্রুদ্ধ জার তাকে পদচ্যুত করেন। নয়া মন্ত্রী স্টোলিপিন কৃষক বিদ্রোহীদের কঠোর হস্তে দমন করেন। ১৯০৬ সালে ৬৮৩ জন ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ফলে শেষ পর্যন্ত বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এই পরিস্থিতিতে ঘোর স্বৈরাচারী জার নরমপন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হলেন। ১৯০৫ সালের আগস্ট মাসে এক রাষ্ট্রীয় কাউন্সিল বা ডুমা আহ্বান করবেন। কিন্তু এটির শুধুমাত্র পরামর্শ দানের ক্ষমতা থাকায় এবং শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখায় এই ঘোষণা জনগণের সন্তোষ বিধান করতে পারেনি। সুতরাং পর পর সংঘটিত কয়েকটি ধর্মঘট ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য। রেলপথ, বিদ্যুৎ, কলকারখানা, চিকিৎসক ও আইনজীবী এমনকি স্থল ও নৌবাহিনী এই ধর্মঘটের এক্তিয়ারভুক্ত ছিল। এগুলোর উপর শুধুমাত্র জনতা উৎপীড়নের নীতির অসরতা জার নিকোলাসও বুঝতে পারলেন। সেজন্য ১৭ অক্টোবর তারিখে এক ঘোষণাপত্রের দ্বারা সংস্কার ও সাংবিধানিক সরকারের প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হলেন তিনি। কৃষকদের দাঙ্গাহাঙ্গামার তীব্রতায় প্রধানমন্ত্রী উইটি শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য ভূস্বামীদের সম্পত্তির অধিকার খর্ব করার চিন্তাও করেন ।
এদিকে ১৯০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে বৈপ্লবিক কার্যকলাপ তুঙ্গে ওঠে। মস্কোর শ্রমিকরা বহু শিল্প কেন্দ্রের (যেমন রস্টভ্-অন-ডন, সরমোভো) শ্রমিকদের সংগঠিত করে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটায়। জারের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ঘটে। বলশেভিক দল বিদ্রোহীদের নানাভাবে উৎসাহিত করেছিল। কিন্তু এই বিক্ষিপ্ত ও বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত অভ্যুত্থান গুলি একটি সুসংহত বিপ্লবের রূপ ধারণ করেনি। সুপরিকল্পিত দমননীতির দ্বারা জার সরকার এগুলির কণ্ঠরোধ করে। ১৯০৬ সালে হিসেব করে দেখা গেছে যে, জার সরকারের এই নৃশংস দমন উৎপীড়নে নিহত হয়েছিল পনেরো হাজার এবং কারারুদ্ধ হয়েছিল সত্তর হাজার ব্যক্তি। এছাড়াও, অসংখ্য প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী (যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ‘রাশিয়ান পিপলস লিগ') পুলিশ প্রশাসন এমনকি সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের সাহায্যে ‘প্রোগোম' সংগঠিত করেছিল অর্থাৎ বিপ্লবীদের উপর প্রতিশোধ নিয়েছিল। ১৯০৭ সালের মধ্যেই বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যায়। অবশ্য জার ডুমা বা জাতীয় পরিষদ আহ্বান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর আহত চারটি ডুমার মধ্যে শেষ দুটি ছিল তাঁর একান্ত আজ্ঞাবহ। প্রথম দুটি (১৯০৬ ও ১৯০৭ সাল) ডুমা বিপ্লবী দলগুলোর মতবিরোধের জন্য ভেঙে দেওয়া হয়। বস্তুত এর পরই রাশিয়ার প্রথম বিপ্লবের পরিসমাপ্তি ঘটে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]