মার্কসবাদ/সমাজতন্ত্রবাদের পটভূমি লিখ । কার্ল মার্কসের মতবাদ ও এর গুরুত্ব আলোচনা কর ।

মার্কসবাদের প্রসার ও ভি. আই. লেনিনের উত্থান বিশ্বের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। মার্কসবাদের আধুনিক প্রয়োগ দেখা যায় লেনিন ও বলশেভিক দলের জারতন্ত্র দমনে। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব মার্কসবাদের সর্বাধিক সফল প্রয়োগ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ এক ও অভিন্ন। উল্লেখ্য উনিশ শতকের আশির দশকে রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের আগমন স্বাভাবিক ছিল না। কেননা কাল মার্কস ভেবেছিলেন তার মতাদর্শ কেবল উন্নত শিল্পায়িত দেশেই প্রয়োগ করা যেতে পারে। রাশিয়া তৎকালে একটি কৃষিপ্রধান দেশ ছিল এবং তখন সবেমাত্র আধুনিক শিল্পায়নের যুগে প্রবেশ করেছিল। রাশিয়ানরা কার্ল মার্কস ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দার্শনিকদের দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিল। বিশেষ করে ফরাসি সমাজবাদীদের প্রভাব ছিল ব্যাপক । রাশিয়ানরা ইউটোপিয়ান পরিকল্পনাও প্রয়োগ করার প্রয়াস চালায়। কিন্তু তারা খুব হতাশ হয় এবং নয়া বৈপ্লবিক মতাদর্শের সন্ধান করে। মার্কসবাদে তারা এরূপ বৈপ্লবিক মতাদর্শ খুঁজে পায়। লোকবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতার পর রাশিয়ায় নয়া মতবাদ হিসেবে মার্কসবাদের প্রচার ও প্রসার লক্ষ্য করা যায়। তবে এ সময় দ্রুত মার্কসবাদের বিস্তার ঘটে। শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব গ্রহণ করে মস্কো, কিয়েভ, পিটার্সবার্গ প্রভৃতি শহরের কৃষকেরা সচেতনভাবে বিভিন্ন আন্দোলনে যোগ দেয়। বহু রুশ বুদ্ধিজীবী যেমন প্লেখানভ, এক্সেলরড, জাসুলিচ প্রমুখ রাশিয়ায় মার্কসবাদ প্রচারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। পশ্চিম ইউরোপের মডেলে এরা রাশিয়াতেও সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি গঠনের উদ্যোগ নেন। তবে রাশিয়ায় মার্কসবাদের প্রসারে লেনিন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ প্রসঙ্গে জে. এন. ওয়েস্টউড (J. N. Westwood) তাঁর রাশিয়ার ইতিহাসে বলেছেন যে, “প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞানের সাহায্যে, লেনিন মার্কসীয় তত্ত্বকে প্রয়োগ করেন। তাঁর নির্মম ও দৃঢ় ইচ্ছার প্রয়োগে তিনি কমিউনিস্ট রাশিয়া নামক রাষ্ট্রকে গঠন করেন। বলশেভিক নেতাদের মধ্যে লেনিনই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি তাঁর ভুল স্বীকার করার সততা ও সাহস দেখাতেন এবং ভুল স্বীকারের পর নীতি পরিবর্তন করার সাহস দেখাতেন।” ব্যক্তিগত জীবনে লেনিনের চরিত্র ছিল বৈচিত্র্যহীন, আনন্দময়, হাস্য পরিহাসহীন, নিঃসঙ্গ কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত ।
৩.১ মার্কসবাদ/সমাজতন্ত্রবাদের পটভূমি
আধুনিক পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম হলো সমাজতন্ত্রবাদের জনপ্রিয়তা। শিল্পবিপ্লব প্রসূত কারখানা প্রথার দোষত্রুটি দূরীকরণের প্রয়োজনেই সমাজতন্ত্রবাদের উৎপত্তি হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন ও প্রজাহিতৈষী আন্দোলন ফ্যাক্টরি-প্রথা প্রসূত সমস্যার সমাধান করতে সমর্থ হয়নি। শিল্পবিপ্লবের ফলে প্রত্যেক দেশেরই জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু এর বণ্টন ব্যবস্থার ত্রুটির ফলে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতেই অর্থ সঞ্চিত হচ্ছিল। এভাবে অর্থবলে বলীয়ান এক মূলধনি বা মালিক শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণির যুগ্ম চেষ্টায় যে অর্থ আয় হতো তা একাংশ শ্রমিকগণ পারিশ্রমিক
হিসেবে পেত বটে, কিন্তু মুনাফার অঙ্কে তাদের কোনো দাবি বা অংশ ছিল না। ফলে, দিন দিনই মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির আর্থিক ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়ে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এক অভাবনীয় পার্থক্যের সৃষ্টি হলো। এই অন্যায়মূলক পার্থক্য এবং মালিক শ্রেণি কর্তৃক শ্রমিক শ্রেণির শোষণের ফলে 'সমাজতন্ত্রবাদ' নামক চিন্তাধারার উদ্ভব হলো। মূলত সমাজতন্ত্রবাদ অন্যায়মূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দরিদ্র ও শোষিত সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ হিসেবেই শুরু হয়েছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার লাভ করাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
শ্রমিকদের উপকারার্থে এবং তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য জমি, শ্রম ও মূলধন প্রভৃতি উৎপাদনের উপাদান মাত্রই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখা প্রয়োজন এবং এই সকল উপাদান কোনো ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে বা নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবে না, এটা হলো সমাজতন্ত্রবাদের মূল কথা। শ্রম, জমি, মূলধন প্রভৃতি উৎপাদনের সামগ্রী কাজে লাগিয়ে কেউ লাভবান হতে চাইলেই শোষণ ও অন্যান্য সম্পদের অন্যায্য ব্যবহারের সুযোগ হয়ে থাকে। এজন্য সমাজতান্ত্রিকগণ এই সকল উপাদানের উপর ব্যক্তিগত অধিকার স্বীকার করেন না ৷
সমাজতান্ত্রিকদের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ রয়েছে এবং এই সকল শ্রেণির বা দলের মতবাদে অনেক অনেক পার্থক্যও আছে। কিন্তু (১) ব্যক্তিগত মূলধন ও মূলধনি সম্প্রদায়ের বিলোপসাধন, (২) শ্রমিক সম্প্রদায়ের উন্নয়ন এবং (৩) উৎপাদনের উপাদানগুলোর উপর রাষ্ট্রের অধিকার স্থাপন—এই তিনটি মূলনীতি সকল শ্রেণির সমাজতান্ত্রিকগণ মেনে থাকেন। সমাজতন্ত্রবাদের সংজ্ঞা সম্পর্কে সমাজতান্ত্রিকদের মধ্যেও মতানৈক্য রয়েছে। রাষ্ট্র কর্তৃক গণতান্ত্রিক উপায়ে উৎপাদন ও জাতীয় আয় 5. বণ্টনের ব্যবস্থাকে সমাজতন্ত্রবাদ বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। সমাজতন্ত্রবাদ ব্যক্তিগত মূলধন বা ভূসম্পত্তির মাধ্যমে মানুষের পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্য হরণ বন্ধ করতে চায় বটে, কিন্তু সর্বপ্রকার সম্পত্তির বিলোপসাধন এই মতবাদের উদ্দেশ্য নয়।
ইংল্যান্ডের রবার্ট আওয়েন (Robert Owen) সর্বপ্রথম ‘সমাজতন্ত্রবাদ’ (Socialism) কথাটির ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এরূপ নামকরণের বহু পূর্ব হতেই অর্থনৈতিক শোষণমুক্ত সমাজের কল্পনা একাধিক মনীষী করেছিলেন। অতি প্রাচীনকাল হতেই সমষ্টিগতভাবে সম্পত্তি ভোগদখল করবার মতবাদ বহু চিন্তাশীল ব্যক্তি প্রচার করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বেই মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির অর্থনৈতিক অসাম্য, মালিক শ্রেণি কর্তৃক শ্রমিকদের শোষণ ইংরেজ মনীষী জেরেমি বেনথাম (Jeremy Bentham), জেমস মিল (James Mill) ও জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill) এবং অন্যান্য দেশের অনেকেরই আলোচনা এড়ায়নি। তাঁরা অবশ্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ অথবা রাষ্ট্র কর্তৃক উৎপাদনের উপাদানগুলোর নিয়ন্ত্রণের কথা উল্লেখ করেননি। শ্রমিক শ্রেণির প্রতি ন্যায্য ব্যবহার করা হোক এবং তাঁরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য হতে বঞ্চিত না হোক, এজন্য তাঁরা প্রয়োজনীয় সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন। ১৭৯৬ সালে ফরাসি কৃষিজীবী সম্প্রদায় উদ্ভূত ফ্রাঁসোয়া বেবিউফ (Francois Baibeuf) সরকারের
কর্তৃত্বাধীনে সমগ্র জাতীয় আয় বণ্টনের পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। ষড়যন্ত্রের সাহায্যে শাসনতন্ত্র হস্তগত করে এই পরিকল্পনা কার্যকরী করবার চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি পড়েন এবং প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। উপর্যুক্ত আলোচনা হতে অন্তত এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পূর্ব হতেই অর্থনৈতিক দূরীকরণের চেষ্টা চলে আসছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে একশ্রেণির সমাজতান্ত্রিকের আবির্ভাব হয়। এদের ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন (Robert Owen), টমাস হজস্কিন (Thomas Hodgskin), উইলিয়াম টমসন (William Thompson) এবং ফ্রান্সের চার্জস ফুরিয়ার (Charles Fourier) ও সেন্ট সাইমন (Saint Simon) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সকল সমাজতান্ত্রিকের আদর্শ ছিল এমন সমাজ স্থাপন করা, যে সমাজে সকলেই যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং সকলের শ্রম দ্বারা লব্ধ আর সকলের মধ্যে ন্যায্যভাবে বণ্টন করা হবে। এরা ইউটোপিয়ানস' বা অবাস্ত আদর্শবাদী নামে পরিচিত। কার্ল মার্কস তাঁদের এরূপ নামকরণ করেছেন। ‘ইউটোপিয়ান’গণ নিজেরা সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মানুষের মনে সমাজতন্ত্রের ধারণা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। জনসাধারণের নিকট প্রচারকার্যের প্রয়োজনীয়তা তাঁর উপলব্ধি করেননি। রবার্ট ওয়েন প্রথম জীবনে মানচেস্টার এর এক কাপড়ের কলের ম্যানেজার ছিলেন। ফ্যাক্টরি প্রথার যাবতীয় কুফল ও দুঃখদুর্দশা তিনি স্বচক্ষে দেখে শ্রমিক শ্রেণির উন্নতি বিধানের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। নিউ ল্যানার্ক (New Lanark) নামক স্থানে তিনি একটি আদর্শ কাপড়ের কল স্থাপন করেন। শ্রমিকদের সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধা দান করে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থত্যাগ করে নিউ ল্যানার্ককে তিনি শ্রমিকদের এক তীর্থক্ষেত্রে পরিণত করেন। তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের সমাজতন্ত্রবাদের প্ৰকৃত স্থপতি ।
ফরাসি সমাজতন্ত্রবাদী সেন্ট সাইমন ছিলেন রবার্ট ওয়েন-এর সমসাময়িক। তিনিও সমবায়ের মাধ্যমে উৎপাদন এবং মোট আয় বণ্টনের কথা প্রচার করেছিলেন। তিনি শিল্পভিত্তিক রাষ্ট্র (Industrial State) গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন। পরস্পর প্রতিযোগিতাবিহীন, ব্যক্তিগত স্বার্থজ্ঞানশূন্য এবং অর্থনৈতিক দুর্দশামুক্ত সমাজ গঠন করে জনসাধারণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর বলিষ্ঠ চিন্তাধারা বহু ফরাসি যুবককে প্রভাবিত করেছিল। ওয়েন যেমন ছিলেন ইংল্যান্ডে সমাজতন্ত্রবাদের প্রকৃত পথপ্রদর্শক, সেরূপ ফ্রান্সে সমাজতান্ত্রিকতার প্রকৃত প্রভাব বিস্তার করেছিলেন সেন্ট সাইমন; ফরাসি সমাজতান্ত্রিক চার্লস ফুরিয়ার পনেরো শত জনসংখ্যা নিয়ে এক একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ‘কমিউন' (Commune) বা 'ফ্যালানস্টারি' (Phalanstary) গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এরূপ প্রত্যেকটি কমিউন একত্রে কাজ করবে এবং সকলের শ্রমে উৎপন্ন সম্পদ নিজেরা ভোগ করবে। সামাজিক উন্নতির মূলসূত্রই হলো পরস্পর সমতা স্থাপন এবং সকলের মধ্যে একতার ভাব জাগিয়ে তোলা এই ছিল তাঁর বিশ্বাস।
‘ইউটোপিয়ান’ সমাজতান্ত্রিকগণ ও আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদের জনক কার্ল মার্কস
(Karl Marx) এর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেন ফরাসি সমাজতান্ত্রিক Louis Blanc তিনি বাস্তববাদী সমাজতান্ত্রিক ছিলেন। সেন্ট সাইমন এর ন্যায় তিনিও “প্রত্যেকেই নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং এর বিনিময়ে প্রয়োজন মিটাবার মতো যথেষ্ট পরিমাণ পারিশ্রমিক পাবে”-এই মূলনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু ইউটোপিয়ানদের ন্যায় তিনি অবাস্তব আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অধিকতর গণতান্ত্রিক করে এর মাধ্যমে সমাজতন্ত্রবাদ কার্যকরী করতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। এজন্য তিনি জাতীয় কারখানা স্থাপন করে ব্যক্তিগত মালিকানার অবসানের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা এবং সুপরিকল্পিত কার্যপন্থার অভাবহেতু তাঁর এর চেষ্টা ফলবতী হয়নি। Louis Blance সমাজতন্ত্রবাদকে অবাস্তব কল্পনার জগৎ হতে বাস্তব জগতে নামিয়ে এনেছিলেন। তাঁর সময় হতেই এটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হিসেবে রাজনীতিতে স্থান লাভ করে ।
Louis Blance যখন ফ্রান্সে সমাজতান্ত্রিক পরীক্ষা চালাতে থাকেন ঐ সময়ে ইংল্যান্ডে চার্টিস্ট আন্দোলন (Chartist Movement) নামে এক শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয় (১৮৪৮)। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংস্কার আদায় করা। চার্টিস্টগণ ভোটাধিকারের দাবি করেছিল, কারণ তাঁরা বুঝতে পেরেছিল যে, ভোটাধিকারের সাহায্যে পার্লামেন্টে প্রতিনিধি প্রেরণ করেই নিজেদের অবস্থার উন্নতি সাধন সম্ভব। চার্টিস্ট আন্দোলন বলপূর্বক দমন করা হলেও এর প্রভাব পরবর্তীকালে সরকারি নীতির উপর প্রতিফলিত হয়েছিল এবং তাদের প্রত্যেকটি দাবিই স্বীকৃত হয়েছিল ।
শ্রমিক শ্রেণির দুঃখ-দুর্দশা ইংরেজ সাহিত্যসেবী টমাস কার্লাইল (Thomas Carlyle) এর রচনায় প্রকাশ পেয়েছিল। তাঁর ‘চার্টিজম' (Chartism), 'পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট' (Past and Present) এবং 'লেটার-ডে প্যামফলেটস' (Letter-day Pamphlets) নামক পুস্তকগুলোতে কার্লাইল শ্রমিক সম্প্রদায়ের প্রতি যে অবিচার চলতে থাকে, এর তীব্র নিন্দা করেছিলেন। তাঁর রচনা সমাজতান্ত্রিক প্রভাব বিস্তারে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।
প্রাথমিক সমাজতান্ত্রিকগণ তাঁদের আদর্শকে সাফল্যমণ্ডিত করতে সক্ষম না হলেও তাঁদের প্রচারকার্য এবং সমাজতান্ত্রিক কার্যাদি শ্রমিক সম্প্রদায়ের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতির উপরও এই নয়া ভাবধারার প্রভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হতে এডাম স্মিথ প্রমুখ মনীষীদের প্রচারিত স্বাতন্ত্র্যবাদ (Individual theory) ক্রমে পরিত্যক্ত হলো। সমাজতন্ত্রের উপর মানুষের আস্থা ক্রমেই বৃদ্ধি পেল। কিন্তু সমাজতন্ত্রবাদকে প্রকৃতপক্ষে কার্যকরী করে তুলবার উপায় তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কার্ল মার্কস তাঁর মানসিক ক্ষমতা ও ঐতিহাসিক জ্ঞানের সাহায্যে সমাজতন্ত্রবাদকে বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগের পন্থা প্রদর্শন করলেন। তিনি সমাজতন্ত্রবাদকে এক নয়া রূপ দান করলেন।
মার্কস আজন্মই একজন বিপ্লববাদী ছিলেন। নানা বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জনের পর তিনি ক্রমে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন এবং শ্রমিক সমাজের উন্নয়নের জন্য আত্মনিয়োগ করলেন। ঐ সময়ে তিনি 'রেনিশ গেজেট' (Rhenish Gazette) নামে | একটি চরমপন্থি গণতান্ত্রিক সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন। তাঁর প্রগতিশীল মতবাদ অল্পকালের মধ্যেই প্রাশিয়ার সরকারের কোপানল প্রজ্বলিত করল। মার্কস'এর পত্রিকা সরকারি আদেশে বন্ধ হলো। তাকে দেশ হতে নির্বাসিত করা হলো। মার্কস ফ্রান্সে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। সেখানে তিনি প্রাওধন, হাইনরিক, পিয়েরি লেরক্স (Proudhon, Heinrick Heine, Pierre Leroux) নামক ফরাসি সমাজতান্ত্রিকদের সংস্পর্শে আসলেন। সেই সময়কার সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্টগণ প্রায়ই পারি, ব্রুসেলস, লন্ডন এবং সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি স্থানে নির্বাসিত অবস্থায় তাদের কার্যকলাপ চালাতেন। ফ্রান্সে ফ্রেডারিক এঙ্গেলস (Frederick Engels) নামে একজন জার্মান সমাজতান্ত্রিকের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। এই পরিচয় শীঘ্রই বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। প্রাশিয়ার সরকারের ইঙ্গিতে ফ্রান্স হতেও মার্কসকে বহিষ্কৃত করা হলো। তিনি ব্রুসেলস'এ আশ্রয় গ্রহণ করলেন। সেখানে অবস্থানকালে এঙ্গেলস'এর সহায়তায় কার্ল মার্কস ‘কমিউনিস্ট লীগ' (Communist League) নামে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বস্তুত এটি ১৮৩০ সালের কয়েকজন নির্বাসিত জার্মান সমাজতান্ত্রিক ফ্রান্সে ‘লিগ অব দি জাস্ট' (League of the Just) নামে যে সংস্থা স্থাপন করেছিলেন ১৮৪৭ সালে কার্ল মার্কস এতে যোগদান করেন। এর নয়া নাম হয় ‘কমিউনিস্ট লিগ' (Communist League)। ক্রমে এই লিগে বহু ইংরেজ সমাজতান্ত্রিকও যোগদান করলেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, বক্তৃতা এবং রচনার সাহায্যে কার্ল মার্কস মূলধন ও ধনতান্ত্রিকতার অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হলেন।
৩. কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো
ব্রুসেলসে কয়েক বৎসর বাস করবার পর মার্কস ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে অবস্থানকালে ১৮৪৮ সালে তিনি ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো' (Communist Manifesto) নামে তাঁর বিখ্যাত প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। রবার্ট ওয়েন, সেন্ট সাইমন, ফুরিয়ার প্রমুখ আদর্শবাদী অবাস্তব সমাজতান্ত্রিক (Utopian and visionary socialism) চিন্তাধারার স্থলে আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এই ম্যানিফেস্টোতে দিলেন। এতে তিনি বললেন, “সকল মানুষই ভাই ভাই। এবং একমাত্র উদ্দেশ্য হলো বলপ্রয়োগ দ্বারা প্রচলিত সমাজব্যবস্থার মূল উৎপাটন।” এই ‘ম্যানিফেস্টো' আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদের ‘প্রথম ধ্বনি' (Birth-cry) বলে বিবেচিত হয়। এই প্রচারপত্রের জ্বালাময়ী আবেদনের মাধ্যমে মার্কস তাঁর মতবাদ ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং পৃথিবীর সকল শ্রমিককে সমাজতান্ত্রিক প্রচেষ্টাকে সফল করে তুলতে
১০২ তাঁর সাথে যোগদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কার্ল মার্কস 'সমাজতন্ত্রবাদ' (Socialism)'এর পরিবর্তে কমিউনিজম (Communism) নামটি ব্যবহার করা সমীচীন মনে করেছিলেন। কারণ, প্রাথমিক সমাজতান্ত্রিকগণ 'সমাজতন্ত্রবাদ' (Socialism) কথাটি ব্যবহার করতেন। তাঁর মতবাদ প্রাথমিক সমাজতান্ত্রিকদের মতবাদ হতে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল বলে তিনি 'কমিউনিজম' - এই নয়া নাম ব্যবহার করেছিলেন।
৪. 'ড্যাস ক্যাপিটাল' এর প্রভাব
১৮৬৭ সালে তিনি তাঁর অপর বিখ্যাত গ্রন্থ 'ড্যাস ক্যাপিট্যাল' (Das Capital) প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে তিনি সমসাময়িক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এক তীব্র সমালোচনা করেন। এ সময় হতে রুশোর ‘সামাজিক চুক্তির মতবাদ' (Social Contract Theory) 'এর ন্যায় মার্কস’এর ‘ড্যাস ক্যাপিটাল' সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধর্মগ্রন্থস্বরূপ-অর্থাৎ মূলনীতি হয়ে উঠে। রুশোর সামাজিক চুক্তির মতবাদ যেমন ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণা দান করেছিল, সেইরূপ ড্যাস ক্যাপিট্যালও রুশ বিপ্লবের (১৯১৭) প্রেরণা যুগিয়েছিল। ১৮৮৩ সালে মার্কস-এর মৃত্যু হয়।
৩.৩ কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে মার্কস হেগেল'-এর মতবাদ হতে ইতিহাসের অগ্রগতি এক অবশ্যম্ভাবী দ্বন্দ্বমূলক (dialectic) বিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে, এই যুক্তি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু হেগেল যেখানে এই অগ্রগতিকে সর্বব্যাপী আত্মার প্রকাশ বলে মনে করেন, মার্কস সেখানে ইহা একমাত্র অর্থনৈতিক তাগিদের ফল বলে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ ইতিহাস কেবল বঞ্চিত এবং বঞ্চনাকারীর পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হতে থাকে। ইতিহাস সেই কারণে শ্রেণিসংগ্রামের কাহিনি। আধুনিক সমাজে শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি বুর্জোয়াদের হাতেই অথনৈতিক শক্তি সঞ্চিত হবার পথ প্রশস্ত করে দিয়ে থাকে এবং এই অর্থনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে তাঁরা উৎপাদনের উপাদান নিজেদের মালিকানাধীনে আনতে পারে। ফলে পৃথিবীর উৎপাদনের উপাদান এবং শ্রমিক যারা নিজেরা উৎপাদনের উপাদানের মালিক নয় তাদের শোষণ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই বুর্জোয়া শ্রেণি সমাজের উদ্যোগী এবং প্রতিপত্তিশালী অংশ হবার ফলে যারা শ্রম বিক্রয় করে, অর্থাৎ যারা শ্রমিক তাদের শোষণ এবং পীড়ন সমানভাবে চলে। কিন্তু মার্কস তাঁর ম্যানিফেস্টোতে এই কথাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বুর্জোয়ারা যা উৎপাদন করে তার সর্বোপরি উৎপন্ন হয় সেই সব লোক যারা তাদের কবর খনন করবে। বুর্জোয়াদের পতন এবং প্রলেতারিয়েতদের জয়লাভ সমভাবে অবশ্যম্ভাবী।
মার্কস এর মতে সে কারণে গণতন্ত্র এবং সংসদীয় শাসনব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক শাসন চালাবার কেবলমাত্র মুখোশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। শ্রমিকদের কোনো জাতীয়তাবোধ অর্থাৎ নিজ দেশের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য থাকা সমীচীন নয়। কারণ পৃথিবীর অপরাপর দেশের শোষিত শ্রমিকদের স্বার্থের প্রত্যেক দেশের শ্রমিকের স্বার্থ এক এবং অভিন্ন। এই একই কারণে প্রলেতারিয়েত বিপ্লবের মাধমে প্রলেতারিয়েত | ডিক্টেটরশিপ স্থাপিত হবে এবং ক্রমে শ্রেণিহীন সমাজের সৃষ্টি হবে। মার্কস এবং এঙ্গেলস এই ম্যানিফেস্টোতে সেই বিখ্যাত আশ্বাস সকল শ্রমিককে শুনিয়েছিলেন : “শ্রমিকদের কেবল শৃঙ্খল ভিন্ন আর কিছুই হারাবার নেই, তাদের পাবার আছে অনেক কিছু। পৃথিবীর সকল দেশের শ্রমিকগণ এক হও।” কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম লন্ডন শহর হতে প্রকাশিত হয়। ঐ মাসেই ফ্রান্সে যে বিপ্লব ঘটেছিল তার উপর এই ম্যানিফেস্টো বা প্রচারপত্রের কোনো প্রভাব পড়েনি । কিন্তু পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে এটি সমগ্র ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন ভাষায় অসংখ্য সংস্করণ বাহির হয়। এটি পৃথিবীর আধুনিক সমাজতান্ত্রিকদের নিকট বাইবেল গ্রন্থস্বরূপ ৷
ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা হতে প্রলেতারিয়েত শাসিত সমাজ স্থাপনের উদ্দেশ্যে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এইগুলো হলো : (১) জমির মালিকানা বাতিল করা এবং জমির খাজনা সমাজের কাজে ব্যবহার করা। (২) উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি ভোগদখল রোধ করা। (৩) ক্রমপর্যায়ে বর্ধিত পরিমাণে আয়কর ধার্য করা। (৪) দেশত্যাগী ও রাষ্ট্রদ্রোহীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। (৫) পরিবহণ ব্যবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত করা। (৬) ব্যাংক এর মালিকানা বাতিল করা এবং রাষ্ট্র কর্তৃক নিজ মূলধনে ব্যাংক পরিচালনা করা। (৭) রাষ্ট্র কর্তৃক অধিগৃহীত শিল্পের ক্রমবিস্তার এবং পতিত জমি রাষ্ট্রের উদ্যোগে চাষের উপযোগী করা। (৮) শ্রমিকের প্রতি সমান দায়িত্ব পালন করা এবং তাদেরকে শোষণমুক্ত রাখা (৯) কৃষি ও শিল্পের সামঞ্জস্য সাধন করা এবং ক্রমে গ্রাম ও শহরের কৃত্রিম পার্থক্য দূর করা। (১০) প্রচলিত পদ্ধতিতে কারখানায় শিশু-শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করা। (১১) সকল শিশুকে অবৈতনিকভাবে সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করা। (১২) শিক্ষা ও শিল্পোন্নয়নের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রাখা।
৩.৪ ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, ১৮২০-৯৫
ফ্রেডারিক এঙ্গেলস কার্ল মার্কস-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং সহযোগী ছিলেন। মার্কস পারিতে আশ্রয় গ্রহণ করলে ১৮৪৪ সালে এঙ্গেলস তাঁর সাথে পরিচিত হন। পারী হতে মার্কসকে বহিষ্কার করা হলে এঙ্গেলসও তাঁর সাথে ব্রুসেলস-এ চলে যান। ১৮৪৪ হতে ১৮৮৩ সালে মার্কস-এর মৃত্যু পর্যন্ত এঙ্গেলস মার্কস-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। ১৮৪৪
সালে এঙ্গেলস তার The Condition of Working Classes in England প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে ধনতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা তিনি করেছিলেন। এঙ্গেলস কার্ল মার্কস-এর সাথে একযোগে শ্রমিক সংঘ স্থাপন করেছিলেন এবং ১৮৪৭ সালে লন্ডনে এর সর্বপ্রথম কংগ্রেসের অধিবেশন আহ্বান করেছিলেন। এ বছরই এই সংঘের নাম হয় কমিউনিস্ট লিগ। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো
মার্কস ও এঙ্গেলস-উভয়ে রচনা করেছিলেন।
এঙ্গেলস মার্কস-এর অন্যান্য গ্রন্থ রচনায়ও সাহায্য করেছিলেন। তাঁর নিজস্ব গ্রন্থের মধ্যে Socialism, Anti Duhring Utopian and Scientific, Private Property and the State প্রভৃতির নাম উল্লেখ্য। কার্ল মার্কস-এর মৃত্যুর পর ডাস ক্যাপিটাল (Das Capital) এর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনা এঙ্গেলস করেছিলেন।
৩.৫ মার্কস-এর মতবাদ ও এর গুরুত্ব
কার্ল মার্কস আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদের জনক হিসেবে জগদ্বিখ্যাত। তিনি তাঁর পূর্বগামী সমাজতান্ত্রিকদের অপেক্ষা বহুগুণে বেশি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সমাজতন্ত্রবাদের ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর সমাজতন্ত্রবাদের চারটি মূলসূত্র :
প্রথমত, হেগেল’এর ন্যায় তিনিও পরস্পর বিরোধী, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও শক্তির সংঘাতের ফলস্বরূপ ঐতিহাসিক বিবর্তন ঘটতে থাকে-এই কথা বিশ্বাস করতেন। মার্কস ঐতিহাসিক ধারাকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে অত্যাচারিতের সংঘর্ষের কাহিনি মনে করতেন। তাঁর মতে মানুষের জীবনের মূল প্রভাবই হলো অর্থনৈতিক প্রভাব। সুতরাং প্রাচীন, মধ্য বা আধুনিক যুগের ইতিহাস মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের ঘাতপ্রতিঘাত এবং পরস্পর সংঘর্ষ ভিন্ন অপর কিছুই নয়। প্রাচীন যুগের ক্রীতদাস ও স্বাধীন শ্রমিকদের দ্বন্দ্ব মধ্যযুগের সামন্ত শ্রেণি ও সার্ফদের দ্বন্দ্ব এবং আধুনিক যুগের মালিক ও মজুর শ্রেণির দ্বন্দ্ব একই অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের বিভিন্ন পর্যায় বিশেষ। এইভাবে মার্কস ইতিহাসকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি হতে বিচার করেছেন।
দ্বিতীয়ত, মার্কস মানবসমাজকে দুইটি পরস্পর বিরোধী শ্রেণিতে ভাগ করেছেন, যথা : মূলধনি বা মালিক শ্রেণি এবং শ্রমজীবী শ্রেণি। মালিক বা মূলধনি শ্রেণির উচ্ছেদের মধ্যেই শ্রমজীবী শ্রেণির অর্থনৈতিক মুক্তি নিহিত রয়েছে বলে তিনি মনে করতেন। তিনি সমগ্র পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণিকে সংঘবদ্ধভাবে মালিক শ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হতে আহ্বান করেছেন। শ্রমজীবীদের নিকট আবেদনে তিনি এই কথাই বলেছেন : “শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী আঘাতে মালিক শ্রেণি কম্পমান হোক। এই বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণির কোনো কিছু হারাবার ভয় নাই। মালিক শ্রেণির শোষণ ভিন্ন অপর
রা হারাবে না।” প্রচলিত ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বলপূর্বক উচ্ছেদ সাধনের পোতী ছিলেন। এজন্য তিনি পৃথিবীর শ্রমিকগণকে সংঘবদ্ধ হতে আহ্বান লেন। মালিক শ্রেণির অবসান অন্য দিক দিয়ে বিচার করাও তিনি প্রয়োজন তেন ৷ মালিক বা মূলধনি ভিত্তিক সমাজের প্রধান ত্রুটিই হলো উৎপন্ন সম্পদের বণ্টনব্যবস্থা। এরূপ সমাজে অর্থ মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে সঞ্চিত হয়। ফলে, । তাঁরা অধিকতর ধনবান হতে থাকে, অপরপক্ষে দরিদ্ররা অধিকতর দরিদ্র কে। এই অর্থনৈতিক অসাম্য রোধ করবার একমাত্র পন্থা হলো ব্যক্তিগত তার অবসান ।
তীয়ত, মার্কস ইংরেজ অর্থনীতিক রিকার্ডো এবং ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিকদের cal Economists) Labour theory of value' এর উপর ভিত্তি করে এই উপনীত হয়েছেন যে, কোনো সামগ্রীর মূল্যের সর্বপ্রথম উপাদান হলো শ্রম । । বা মূলধন অর্থাৎ উৎপাদনের উৎপাদিত উপাদান (Produced means of ction) এবং জমি ইত্যাদি সবই মূলত প্রকৃতির দান। মানুষের শ্রম ভিন্ন কে সামগ্রীতে রূপান্তরিত করা সম্ভব নয়। এইজন্য কার্ল মার্কস'এর মতে । শ্রমের মাপকাঠিতেই মুনাফা বণ্টিত হওয়া উচিত। শ্রমিকদের শ্রমের ফলে সামগ্রী হতে লব্ধ আয় একমাত্র শ্রমিকদেরই প্রাপ্য-অপর কারো এতে অংশ বৈধ এবং অযৌক্তিক।
তুর্থত, মার্কস এর সমাজতন্ত্রবাদের একটি আন্তর্জাতিক আবেদন রয়েছে। এই
১৮৬৪ সালে তিনি ‘আন্তর্জাাতিক শ্রমজীবী সংঘ' (International ingmen's Association) নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এটা গত First International নামে পরিচিত। পরে ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় এবং সালে তৃতীয় International এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চতুর্থ International হয়।
মার্কসবাদের সমালোচনা
মার্কসবাদের নানাপ্রকার বিরুদ্ধ সমালোচনা করা হয়েছে। এই সকল গাচনার মূল কথাগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. মার্কসবাদ ভ্রান্ত ইতিহাসের সাক্ষ্য
অনেকে মার্কসবাদ ভ্রান্ত বলে মনে করেন, কারণ যে সকল প্রভাব এবং প্রবণতা ন্ত্রিক সমাজের (Capitalistic Society) বিলোপসাধন করবে বলে মার্কস মনে চন, বিগত দীর্ঘকালের ইতিহাসে ঐ সকল প্রভাব সেরূপ কিছু সম্পন্ন করতে নি। এটা হতেই মার্কসবাদ যে অভ্রান্ত নয়, তা প্রমাণিত হয়। বিগত অর্ধ দীরও দীর্ঘকালের ইতিহাস মার্কসবাদের অসারতাই প্রমাণ করেছে বলে কেউ কেউ করেন।
২. মার্কস প্রদত্ত ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার ত্রুটি
মার্কসবাদের সমালোচনায় মার্কস প্রদত্ত ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার তীব্র প্রতিবাদ করা হয়েছে। মানবজাতির ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ধারার বা প্রয়োজনের উপরই নির্ভরশীল নয়। অর্থনৈতিক তাগিদ ভিন্ন অপরাপর বহু প্রকার প্রয়োজনের চাপে এবং বহুবিধ প্রভাবের ফলে ঐতিহাসিক বিবর্তন ঘটেছে এবং ঘটে থাকে। ধর্মভাব, দেশাত্মবোধ, দৈহিক শক্তি, বিভিন্ন কালে বিভিন্ন ব্যক্তিবিশেষের প্রগতিশীল প্রেরণা, রীতিনীতি, ঐতিহ্য প্রভৃতি নানাপ্রকার শক্তি ও প্রভাবের সমষ্টিগত ফলই হলো ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তন। সুতরাং ইতিহাসকে একমাত্র অর্থনৈতিক সংঘর্ষের কাহিনি বা অর্থনৈতিক অসাম্য দূরীকরণের আন্দোলনের বর্ণনা বলে ব্যাখ্যা করা অনেকেই ভুল মনে করেন। মানুষের সমস্যার মূলে অর্থনৈতিক কারণ প্রধান হতে পারে, কিন্তু একমাত্র অর্থনৈতিক সাম্য স্থাপনের মাধ্যমেই সকল সমস্যার সমাধান আশা করা অযৌক্তিক।
৩. মালিকশ্রেণি ও শ্রমজীবীদের বিভেদের ক্রমহ্রাস
ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রমিক সম্প্রদায়ের বিদ্বেষভাব ক্রমে এক বিরাট সামাজিক বিপ্লবের সৃষ্টি করবে বলে মার্কস আশা করেছিলেন। কিন্তু প্রত্যেক প্রভাব এবং প্রবণতার বিরুদ্ধেই যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, সেই কথা মার্কস বিবেচনা করেননি। মানবসমাজের ধর্মই হলো সমাজের স্বার্থবিরোধী বা অমঙ্গলজনক সব কিছুই ক্ৰমে নাশ করে সমাজের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করা। এই দিক দিয়ে বিচার করলে মার্কস এর সামাজিক বিপ্লবের (Social revolution) ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। বস্তুত, শ্রমজীবীদের সংখ্যাবৃদ্ধি রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত শ্রমিক উন্নয়ন আইন কানুন, শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কার্যকলাপ প্রভৃতির ফলে মূলধনি ও শ্রমিকের মধ্যে পার্থক্য ও ব্যবধান ক্রমেই হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে আসতেছে। শ্রমজীবী ও মালিক সম্প্রদায়ের মধ্যে খাদ্য-খাদক সম্পর্ক বৃদ্ধি না পেয়ে বরং হ্রাস পেয়েছে ।
৪. ভ্রান্ত আশঙ্কা
অধ্যাপক সিমখোভিচ (Prof. Simkhovitch) প্রমুখ সমালোচকগণ মনে করেন যে সম্পদ ক্রমে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে সঞ্চিত হবে এবং দরিদ্র ব্যক্তিরা ক্রমে দরিদ্রতর হবে মার্কস এর এই ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে শ্রমিকদের অবস্থা শোচনীয় না হয়ে ক্রমে উন্নতির পথেই চলেছে। ধনতান্ত্রিক সমাজে জাতীয় সম্পদ ও শিল্প মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে পুঞ্জীভূত না হয়ে বরঞ্চ সমাজের সর্বস্তরে বণ্টিত হচ্ছে। এটি ভিন্ন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শিল্প প্রধান ধনতান্ত্রিক দেশে সংঘটিত না হয়ে কৃষিপ্রধান রাশিয়ায় ঘটছে। এটি হতে মার্কসবাদের মালিক ও শ্রমিকের পরস্পর বিদ্বেষের ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
কিন্তু মার্কসবাদের বিরুদ্ধ সমালোচনা সত্ত্বেও এটি অনস্বীকার্য যে, মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির পরস্পর সম্বন্ধজনিত জটিল সমস্যার সমাধানে মার্কসবাদ তথা সমাজতন্ত্রবাদ সার্থক ইঙ্গিত দিতে সক্ষম হয়েছে। আধুনিক শিল্প পদ্ধতির সহজাত দোষত্রুটির নির্ভীক সমালোচনা দ্বারা শ্রমিক শ্রেণির প্রতি ন্যায্য ও মনুষ্যোচিত ব্যবহার করবার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা মার্কসবাদ সকলের দৃষ্টিগোচর করেছে। মার্কস-এর সময় হতে প্রত্যেক দেশেই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে প্রত্যেক দেশেই সমাজবাদী রাষ্ট্রকর্তব্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গৃহীত হয়েছে, জনসাধারণের নিকট সমাজতন্ত্রবাদের আবেদন সর্বাপেক্ষা অধিক প্রভাবশালী। হয়ে উঠেছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]