১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর ।

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ (Causes)
১. জার সরকারের রক্ষণশীলতা ও স্বৈরতন্ত্র
১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত ছিল। ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে পরিবর্তনের স্রোত বইতে আরম্ভ করে। কিন্তু জার সরকার যুগের গতি অগ্রাহ্য করে স্রোতের বিরুদ্ধে চলতে থাকে। ইউরোপে জুলাই ও ফেব্রুয়ারি বিপ্লব, ইতালি ও জার্মানির জাতীয়তাবাদী যুদ্ধের ফলে পশ্চিম ইউরোপে পুরাতনতন্ত্রের কাঠামো ভেঙে উদারতন্ত্র, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের অগ্রগতি ঘটে। কিন্তু জার সরকার এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে স্বৈরশাসনকে অব্যাহত রাখেন। সর্বশেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসও তাঁর পিতার ন্যায় দমননীতিতে বিশ্বাস করতেন। তাঁর মন্ত্রী পিভি ছিলেন ভয়ানক স্বৈরাচারী। তিনি যে কোনো গণতান্ত্রিক দাবিকে কঠোর হাতে দমন করতেন। গুপ্তচর ও পুলিশ দ্বারা তিনি জনসাধারণের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার দমন করেন। বহু ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী নির্বাসিত অথবা কারারুদ্ধ হন। এই ব্যাপক দমননীতির ফলে রাশিয়ায় বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। যদি জার সরকার ধাপে ধাপে যুগের উপযোগী কিছু পরিবর্তন স্বীকার করত তবে সংস্কারপন্থিরা বিপ্লবের দ্বারা জার সরকারকে ধ্বংস করার কথা ভাবত না। তারা বিশ্বাস করতে পারত যে, সংস্কারের দ্বারা কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা যাবে। কিন্তু জার সরকারের সংস্কার-বিরোধী স্বৈরনীতি এই আশা নির্মূল করে। জার সরকারের পতন ছাড়া আর অন্য কোনো উপায়ে রাশিয়ায় পরিবর্তন আনা যাবে না-একথা সকলে বুঝে ফেলে।
জারের স্বৈরশাসনের তলায় নবজাত বিপ্লবী ভাবধারার ফল্গুস্রোত রাশিয়ায় প্রবেশ করতে থাকে। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে বহু সামরিক অফিসার পশ্চিম ইউরোপের মুক্ত সমাজ ও উদারপন্থি শাসনে মুগ্ধ হন। ফরাসি বিপ্লবের গণতন্ত্রী ভাবধারা তাঁদের অনুপ্রাণিত করে। রুশ চিন্তাবিদ হার্জেন তাঁর উপন্যাসে সর্বপ্রথম এই তত্ত্ব প্রচার করেন যে, রাশিয়ার মুক্তির জন্য 'স্বাধীনতা' বা গণতন্ত্র এবং কৃষকদের হাতে “ভূমি” এনে দেওয়া দরকার। ক্যার্নিশেভস্কি নামক চিন্তাবিদ ও সমাজতান্ত্রিক কৃষক শ্রেণির অভ্যুত্থানের দ্বারা রাশিয়ার শোষণমূলক সমাজব্যবস্থাকে ভাঙবার কথা বলেন। কৃষকদের মধ্যে কমিউন বা স্বয়ংশাসিত সংস্থা গঠনের জন্য নারোদনিক বা সমাজতান্ত্রিক দল প্রচেষ্টা চালায়। বলশেভিক বা কমিউনিস্ট বিপ্লবীরাও আপাতত জারের স্বৈরতন্ত্র ধ্বংসের উদ্দেশ্যে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে যোগ দেন। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ায় বিদ্রোহের সম্ভাবনা দেখা দেয় ।
১৯০৫ সালে রুশ-জাপান যুদ্ধে জার সরকারের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এর ফলে জার সরকারের দুর্বলতা প্রকটিত হয়। রাশিয়ার সর্বত্র গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং কৃষকের হাতে ভূমি দেওয়ার দাবিতে বিদ্রোহ আরম্ভ হয়। কলকারখানায় শ্রমিকরা ধর্মঘট আরম্ভ করে। ভূমিদাসরা জমিদারদের ম্যানর বা খামার পুড়িয়ে দেয় । জমিদারের ম্যানেজার বা বেলিফদের হত্যা করে। সরকারি খাজনা দেওয়া বন্ধ করা হয়। ১৯০৫ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গের শ্রমিকরা সম্রাটের নিকট এক স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য ফাদার গ্যাপন নামে এক ধর্মযাজকের নেতৃত্বে শোভাযাত্রা করে। এই শোভাযাত্রার উপর জারের সেনাদল গুলি বর্ষণ করে বহু শ্রমিককে হত্যা করে। জারের সেনাদল প্রচুর রক্ত স্নানের দ্বারা ১৯০৫ সালের- বিপ্লবকে দমন করে ৷
৩. ১৯১৭ সালে ভূমি ও স্বাধীনতা আন্দোলন
১৯০৫ সালের আন্দোলনকে রুশ বিপ্লবের ‘প্রভাতী তারা' বলা যায়। ১৯০৫ সালের বিপ্লবে জারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিক ও কৃষকেরা একযোগে লড়াই করে ৷ এই শিক্ষা ১৯১৭ সালে কাজে লাগে। ঐতিহাসিক রদেনস্টিনের মতে, এই বিপ্লব ছিল ১৯১৭ সাল-এর বিপ্লবের মহড়া। ১৯০৫ সালে এই বিপ্লবের গুরুত্ব অনুভব করে ট্রটস্কি মন্তব্য করেন যে, “বিপ্লব মৃত হয়েছে : বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক” (The Revolution is dead : Long live the Revolution)। ১৯০৫ সালের বিপ্লবের ফলে জারতন্ত্রের ভিত্তি ধসে যায়। এই ধসে পড়া স্বৈরতন্ত্রের সৌধ ১৯১৭ সালে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। সুতরাং ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবকে একটি হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিপ্লব বলা যায় না ।
এভাবে জার সরকারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী ভাবধারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। জার দ্বিতীয় নিকোলাসের কুশাসন জারতন্ত্রের পতন দ্রুত ডেকে আনে। বিপ্লবের প্রাক্কালে জারতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে স্বৈরাচারী ছিল কি না এ সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। একটি মত হলো যে, ১৯০৭ সালের নির্বাচনি আইন উদার করা হয়। ডুমা বা পার্লামেন্টের ক্ষমতা বাড়ে। শিক্ষাবিস্তারের ফলে জনসাধারণ অধিকার সচেতন হয়। সুতরাং বিপ্লবের প্রাক্কালে জারতন্ত্র আগের মতো কঠিন স্বৈরতন্ত্র ছিল না। দ্বিতীয় এই যে, ডুমার কোনো প্রকৃত ক্ষমতা ছিল না। জারের মন্ত্রীরা ডুমার কাছে দায়িত্ববন্ধ ছিল না। জার নিজে ছিলেন ঘোর স্বৈরাচারী ও প্রতিক্রিয়াশীল শাসক। তিনি প্রধানত সন্ত্রাস ও দমনপীড়নের দ্বারাই শাসন চালাতেন। তাঁর হাতে বিশেষ ক্ষমতা থাকায় তিনি ডুমা বা পার্লামেন্টকে গ্রাহ্য করতেন না। তিনি জনমত উপেক্ষা করে রাশিয়াকে যুদ্ধে < জড়িয়ে দেন।
৪. দ্বিতীয় নিকোলাসের দমননীতি : রাসপুটিনের ঘটনা
জার দ্বিতীয় নিকোলাসের রানি আলেকজান্দ্রোভা, রাসপুটিন নামে এক ভ সন্ন্যাসীর প্রভাবে পড়েন। রানির সমর্থন পেয়ে রাসপুটিন উচ্চ রাজ কর্মচারী সেনাপতিদের অপদস্থ করে। জার নিকোলাস, রাসপুটিন এবং রানিকে নিয়ন্ত্রণ করতে অসমর্থ হওয়ায় লোকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা হারায়। অবশেষে প্রিন্স ইউসুপড নামে এক অভিজাত রাসপুটিনকে গুলি করে হত্যা করেন। জার দ্বিতীয় নিকোলাস ছিলেন সংকীর্ণ চিত্ত, অর্ধশিক্ষিত ও গোঁড়া লোক । তিনি বুঝতে পারেননি যে, তিনি ইতিহাসের স্রোতের বিরুদ্ধে চলার চেষ্টা করছেন। তাঁর প্রতিক্রিয়াশীল নীতির ফলে জারতন্ত্রের প্রতি রুশ জাতির ঘৃণা তীব্র হয়ে ওঠে।
৫. প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার সরকারের যোগদানের পরিণাম
জার সরকারের বৈদেশিক নীতির ব্যর্থতা জারতন্ত্রের পতনকে ত্বরান্বিত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান ছিল জার সরকারের গভীর অদূরদর্শিতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়ার মতো প্রস্তুতি রাশিয়ার ছিল না। রুশ জনমত ছিল এই যুদ্ধে যোগদানের ঘোর বিরোধী। রাশিয়ার শিল্প এমন মজবুত ছিল না, যা দীর্ঘ যুদ্ধের ভার বইতে পারত। রুশ কৃষি ছিল অনগ্রসর। রুশ জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছিল। দেশের মধ্যবিত্ত, কৃষক, শ্রমিকের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ছিল। এই অবস্থায় জার সরকারের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ছিল ঘোর অদূরদর্শিতা। দুই বছর যুদ্ধ চলবার পর, রাশিয়ার সর্বস্তরে বিরাট সংকট দেখা দেয়। জার সরকার এই যুদ্ধে রুশ জাতির সহযোগিতা পাননি। জার সরকারের প্রতি ঘৃণা
অবিশ্বাস তীব্র হয়। প্রথমত, রুশ সেনাদলের মাত্র
অংশের হাতে পৃথক ধরনের রাইফেল ছিল। বাকিদের হাতে অস্ত্র ছিল না। দ্বিতীয়ত, দুই বছরের মধ্যে জার্মানির হাতে রুশ সেনাদলের বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় এক মিলিয়ন রুশ সেনা নিহত হয়। বাকি রুশ সেনা জার্মান আক্রমণের সম্মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ইউক্রেন ও ক্রিমিয়া জার্মানদের দখলে চলে যায়। রুশ সেনার মনোবল এমন ভেঙে যায় যে, তারা যুদ্ধ ত্যাগ করে শান্তিস্থাপনের জন্য অস্থির হয়। কিন্তু জার সরকার যুদ্ধ ত্যাগ করতে রাজি ছিল না। এই সময় বলশেভিকরা সেনাদলের মধ্যে গোপন প্রচার চালায় যে, এই যুদ্ধ হলো সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধ। বলশেভিকরা শাসন ক্ষমতা পেলে তৎক্ষণাৎ যুদ্ধ ত্যাগ করবে। এজন্য সৈন্যদলে হতাশা দেখা দেয়। বহু সেনা বলশেভিকদের প্রতি আনুগত্য
জানায়। তৃতীয়ত, যুদ্ধের ফলে রাশিয়ায় দারুণ অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। রাশিয়ার ১০ মিলিয়ন সেনার খাদ্য ও রসদপত্র যোগাতে জার সরকারের রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। বৈদেশিক সরকারের নিকট জার সরকারকে খুব কম করে ৩০০ মিলিয়ন রুবল ঋণ নিতে হয়। বড় বড় খামারগুলোতে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়। খাদ্যের দাম দারুণভাবে বাড়ে। ফলে শিল্প শ্রমিক ও শহরবাসী মধ্যবিত্তের মধ্যে বৈপ্লবিক মনোভাব দেখা দেয়। এদিকে রেলগাড়িগুলোকে রণাঙ্গনে ও কারখানায় যুদ্ধের মাল পরিবহণের কাজে লাগানো হলে কয়লা পরিবহণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বড় বড় কারখানায় চুল্লিগুলো কয়লার অভাবে নিভিয়ে ফেলা হয়। সাধারণ লোকে দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য কয়লা না থাকায়, জ্বালানির কষ্টে দিশাহারা হয়ে পড়ে। এই সঙ্গে যুদ্ধের খরচার দরুন জনসাধারণের উপর করের হার বাড়তে থাকে। শহরগুলোতে খাদ্যসংকট, গ্রাম ও শহরে জ্বালানি সংকট, যুদ্ধ করের চাপ, কারখানায় অতিরিক্ত কাজ ও কম মজুরি প্রভৃতি কারণে শ্রমিক এবং কৃষকের মধ্যে দারুণ অসন্তোষ দেখা দেয় ।
৬. রুশ বিপ্লবের অনিবার্যতা
কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন যে, যদি জার সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ না দিত তবে জার সরকারের দুর্বলতা দেখা দিত না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ না দিলে রুশ বিপ্লব ঘটত না। এই অভিমত গ্রহণীয় নয়। কারণ অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার জন্য জার সরকারের পতন ঘটতে বাধ্য ছিল। ১৮২৫ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার জার সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৯০৫ সালের বিপ্লবের পর থেকে জার সরকার পতনোন্মুখ হয়ে পড়ে। বিশ্বযুদ্ধে জার সরকারের পরাজয়, যুদ্ধজনিত অর্থনৈতিক সংকট এই সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
৭. কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির অসন্তোষ
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের প্রধান কারণ ছিল কৃষক ও শ্রমিকের দারিদ্র্য ও অনগ্রসরতা। তার সঙ্গে যুক্ত হয় সংখ্যালঘু জাতিগুলোর বিক্ষোভ, মধ্যবিত্ত জাতীয়তাবাদীদের অসন্তোষ এবং বিপ্লবী গোষ্ঠী বিশেষত সোস্যাল ডেমোক্র্যাট তথা বলশেভিক দলের বিপ্লবী কর্মপন্থা এই বিপ্লবের বারুদের গাদায় অগ্নিশলাকার কাজ করে। রুশ কৃষকদের দুরবস্থার সীমা ছিল না। ১৮৬১ সালে ভূমিদাস উচ্ছেদ আইন এবং এর পরে স্টোলিপিন ভূমিসংস্কার চালু হলেও, রুশ কৃষকের দুঃখ-দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। স্টোলিপিন সংস্কারের ফলে রাশিয়ায় কুলাক বা জোতদার বা জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয় । জমির দাম বহুগুণ বাড়ে। এজন্য সাধারণ কৃষকের জমি খরিদ করার উপায় ছিল না। অপরদিকে প্রান্তিক কৃষকরা ভালো দাম পেয়ে জমি বিক্রি করে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয় । স্টোলিপিন মির বা গ্রামসভার জমির উপর অধিকার লোপ করেন। কৃষকদের জমির মালিকানা দেন। অপরদিকে তিনি কুলাক বা জোতদার শ্রেণিকে কৃষকের জমি খরিদের জন্য ঋণদানের ব্যবস্থা করেন। দরিদ্র কৃষকরা জোতদারের কাছে জমি বিক্রি করে দিলে ভূমিহীন কৃষকের সমস্যা অমীমাংসিত থেকে যায়। বলশেভিক দল কৃষকদের বুঝায় যে, তারা বিনা ক্ষতিপূরণে কৃষকদের হাতে জমি এনে দেবে।
৮. শ্রমিক শ্রেণির দুরবস্থা ও শ্রমিক বিদ্রোহ
রাশিয়ায় ২৪ লক্ষ শিল্প শ্রমিক ছিল। এদের দুঃখদুর্দশার অন্ত ছিল না। কম বেতন, বেশি খাটুনি এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ শ্রমিকের জীবনকে বিষময় করে। যুদ্ধের দরুন খাদ্যের দাম বাড়ার ফলে কম মজুরিতে খাদ্য কেনা তাদের পক্ষে দুষ্কর হয়। জার সরকার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার স্বীকার করতো না। এজন্য শ্রমিকদের দাবি আদায় করা ছিল কষ্টসাধ্য। বলশেভিক দল শ্রমিকদের মধ্যে গোপন প্রচার চালিয়ে তাদের সংঘবদ্ধ করে। বলশেভিক দল শ্রমিকদের বিপ্লবমুখী করে তোলে। তারা শ্রমিককে ৮ ঘণ্টা কাজ ও ন্যায্য বেতন এবং কম দামে খাদ্য দিতে প্রতিশ্রুতি দেয়। লায়োনেল কোচানের ( Lionel Kochan) মতে, ১৯১০ সালে রাশিয়ার মোট ২২২টি শিল্পে ধর্মঘট হয়। ১৯১৪ সালে শিল্প ধর্মঘটের সংখ্যা ছিল ৪,০৯৮। ১৯১৪ সালে যে সকল শ্রমিক ধর্মঘটে যোগ দেয় তাদের সংখ্যা ছিল ১২,৫০,০০০। ধর্মঘটের ফলে রাশিয়ার অর্থনৈতিক জীবন ঝাঁঝরা হয়ে যায়। জার ওঠে 1 সরকার পুলিশ দ্বারা ধর্মঘট দমনের চেষ্টা করলে শ্রমিকেরা জঙ্গি হয়ে
৯. রুশীকরণ নীতি
রাশিয়ার বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতি গোষ্ঠীগুলো জারের রুশীকরণ নীতির জন্য বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । জার সরকার পোল, ফিন প্রভৃতি সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে নিজ নিজ ভাষা ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিত না। রুশীকরণ নীতি অনুসারে সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে রুশ ভাষা শিক্ষা করতে বাধ্য করা হয়। রুশ শাসনকর্তারা দমননীতির দ্বারা সংখ্যালঘু জাতির অধিকার হরণ করে। এজন্য সংখ্যালঘু জাতিগুলো বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
১০. সোস্যাল ডেমোক্র্যাট দল
রুশ বিপ্লবী দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিভিন্ন মতাদর্শ ছিল। ১৮৯৮ সালে রুশ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক দল গঠিত হয়। এই দলের সদস্যরা দীর্ঘকাল জারের দমনপীড়নের ফলে নির্বাসনে কাটান। এই দলের অধিকাংশ সদস্য মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং রুশ শিল্প শ্রমিকের সাহায্যে জারতন্ত্রের পতন ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা তারা প্রচার করতেন। সোস্যাল ডেমোক্র্যাট দল শেষ পর্যন্ত দুটি উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়। প্লেখানভ ও ট্রটস্কি প্রভৃতি এই বিপ্লবীদলের সঙ্গে জনতাকে যুক্ত করে গণবিদ্রোহের কথা বলেন। লেনিন চান যে দলের আদর্শ ও কাজে নিবেদিত প্রাণ লোকদের নিয়েই দল গঠিত হোক। বাইরে থেকে শ্রমিক শ্রেণির সমর্থন আনার চেষ্টা করা হোক। লেনিন চান যে বিপ্লবের জন্য আর দেরি করা উচিত হবে না। অপর গোষ্ঠী চান যে, আগে বুর্জোয়া বিপ্লব হলে তারপর প্রলেতারীয় বিপ্লবের কথা ভাবা যাবে লেনিনের মতবাদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। এজন্য তাঁদের বলা হয় বলশেভিক। অপর গোষ্ঠীরা সংখ্যালঘু বলে মেনশেভিক নামে পরিচিত হয়। অবশ্য এই দুই গোষ্ঠী জার সরকারের পতন তীব্রভাবে কামনা করতো। এজন্য তারা জারের শাসনের বিরুদ্ধে কলকারখানায় শ্রমিক ও সেনাদলে, সেনাদের মধ্যে মজবুত সংগঠন গড়ে তোলে। জারের পক্ষে সমাজতন্ত্রীদের গোপন পাঠচক্র, শ্রমিক সংগঠনের খোঁজ পাওয়া সম্ভব
ডেমোক্র্যাটদের সংগঠন তাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৭ সালের বিপ্লবে এরাই হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া যোগ দিলে, শ্রমিক প্রশাসনিক শিথিলতা বশত সোস্যাল প্রধান বর্ষাফলকের কাজ করে।
অবশেষে ১৯১৭ সালে মার্চ মাসে বলশেভিকদের ডাকে পেত্রোগ্রাদ শহরের কারখানাগুলোতে ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। ধর্মঘটী শ্রমিকরা জার সরকারের ধ্বংস কামনা করে পেত্রোগ্রাদ শহরের রাস্তায় রাস্তায় ধ্বনি দিতে থাকে। ৮ মার্চ থেকে শ্রমিক ধর্মঘটের সঙ্গে পেত্রোগ্রাদ শহরের জনতা শামিল হয়। জনতা গম, ময়দা প্রভৃতি | খাদ্যের মজুতদারের গৃহ আক্রমণ করে। জার সরকার ধর্মঘটী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সেনাদল পাঠালে সেনারা শ্রমিকদের পক্ষ নেয়। এর ফলে পেত্রোগ্রাদ শহরের উপর জার সরকারের নিয়ন্ত্রণ বিনষ্ট হয়। কারণ পুলিশ ও সেনা জারের আদেশ মানতে রাজি | হয়নি। এমতাবস্থায় বলশেভিকরা পেত্রোগ্রাদ শহরের সংগঠিত শ্রমিকদের সহায়তায় | একটি সোভিয়েত বা স্বশাসিত পরিষদ গঠন করে কলকারখানাগুলো এই সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। শ্রমিক ও সেনাদলের প্রতিনিধিদের নিয়ে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত গঠন করা হয়। জারের সেনাদল পেত্রোগ্রাদ দখল করতে ব্যর্থ হলে জার নিরুপায় হয়ে চতুর্থ ডুমা বা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন। ডুমার নির্দেশে ১৪ মার্চ ১০ সদস্যের অস্থায়ী কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি ও ডুমার নির্দেশে জার দ্বিতীয় নিকোলাস পদত্যাগ করেন। চতুর্থ ডুমার নির্দেশে দশ সদস্যের কমিটি নিয়ে রাশিয়ায় একটি অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রী সরকার স্থাপিত হয়। লুভভ হন এই সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং কেরেনেস্কি হন প্রধানমন্ত্রী। এভাবে জারতন্ত্রের অবসান ঘটে ।
৪.৫ ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ (Wheel)
সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব বহু ঘটনাবহুল। এ বিপ্লবের সূচনা থেকে জারতন্ত্রের পতন পর্যন্ত বহু ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনাপ্রবাহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. বিপ্লবের সূচনা
১৯১৭ সালের বর্ষারম্ভে খাদ্যাভাব, জ্বালানির সংকট ও মূল্যবৃদ্ধিতে রুশ জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। রক্তাক্ত রবিবারের দ্বাদশ স্মরণ দিবসে পেত্রোগ্রাদে ১,৫০,০০০ (দেড় লক্ষ) শ্রমিক ধর্মঘট করে। ৩ মার্চ পুটিলভ কারখানায় শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করে। ৮ মার্চ পেত্রোগ্রাদে আবার ধর্মঘট হয়। দুদিন পর তা জনগণের সাধারণ ধর্মঘটে রূপ লাভ করে। এর নেতৃত্বে ছিল বলশেভিক দলের পেত্রোগ্রাদ সমিতি। ১১ মার্চ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পথযুদ্ধ শুরু হয়। পরদিন ভলিনস্কি সৈন্যদল বিদ্রোহী হয় এবং সেনাধ্যক্ষকে হত্যা করে শ্রমিকদের পক্ষ অবলম্বন করে। অন্যান্য সৈন্যদল বিদ্রোহী হয়ে বিপ্লবীদের সংখ্যা স্ফীত করে তোলে। অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, বিচারালয় ও থানায় অগ্নিসংযোগ, বন্দিশালা ভাঙা ইত্যাদি বৈপ্লবিক কার্যকলাপ শুরু হয়। জারের মন্ত্রী ও সেনাপতিদের বন্দী করা হয়। এ সমস্ত ঘটনার প্রত্যুত্তরে অদূরদর্শী স্বৈরাচারপ্রিয় জার নিকোলাস ডুমাকে স্থগিত রাখেন ।
২. সামরিক সরকার ও সোভিয়েত গঠন
সৈন্যবাহিনীর
১২ মার্চের সন্ধ্যার মধ্যে রাজধানী বিপ্লবীদের দখলে চলে যায়। ডুমার ভীতসন্ত্রস্ত বুর্জোয়া নেতৃবর্গ দ্রুত সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে। ঐ দিনই শ্রমিক ও সদস্যদের পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত গঠিত হয়। এই সোভিয়েত অধিকাংশ শ্রমিক সৈন্যের সমর্থনপুষ্ট ছিল। সুতরাং এটি ক্ষমতা দখল করে সরকার গঠন করতে পারত। কিন্তু সোভিয়েতগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাতি বুর্জোয়া মেনশেভিক ও সোস্যাল রেভলিউশনারিরা ঐ পথে এগোতে পারেনি। সুতরাং কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্র্যাটিকরাও অন্যান্য সতেরোটি দলের সমবায়ে সাময়িক সরকার গঠিত হয়। এর শীর্ষে থাকলেন লুভভ নামে এক ধনী ভূস্বামী। স্থির হয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করবে সামরিক সরকার কিন্তু এর কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের ভার থাকবে সোভিয়েতগুলোর উপর। এইভাবে শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে এক দ্বৈত-ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
৩. জারতন্ত্রের পতন
এদিকে পেত্রোগ্রাদগামী জারের ট্রেনটিকে পথিমধ্যে আটক করে রেল শ্রমিকরা। রেলকামরাতেই তারা জার নিকোলাসকে তাঁর পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে (১৫ মার্চ)। এইভাবে রোমানভ বংশীয়দের তিন শতাব্দীর শাসনের অবসান হলো। রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হলো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। পুরনো বর্ষপঞ্জি অনুসারে এই বিপ্লব ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত হয়েছিল বলে একে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবও বলা হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]