১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর । ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ লিখ। এ বিপ্লবেই কি জারতন্ত্রের পতন ঘটে?

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলাফল ( Results)
১. ২য় বিপ্লবের সূচনা
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণগুলোই ছিল ১৯১৭ সালের নভেম্বরের বিপ্লবের কারণ। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে জারতন্ত্রের পতন ঘটে। জার সরকারের পতন ঘটলে লুভভ ও কেরেনস্কির নেতৃত্বে রাশিয়ায় প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়। রুশ বিপ্লবের প্রথম পর্যায় সমাপ্ত হয়। কিন্তু রুশ বিপ্লব কেবলমাত্র প্রজাতন্ত্র ঘোষণার দ্বারা সম্পূর্ণ হয়নি। এই বিপ্লবকে পূর্ণ পরিণতিতে আনার জন্য একটি দ্বিতীয় বিপ্লবের দরকার হয়। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে জার সরকারের পতন হলে পেত্রোগ্রাদ শহরে একই সঙ্গে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকার স্থাপিত হয়। চতুর্থ ডুমা কর্তৃক নিযুক্ত অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রী সরকার দাবি করে যে, তারাই হলো প্রকৃত বৈধ সরকার। জারের পতনের পর সংবিধান অনুযায়ী তারাই হলো বৈধ ক্ষমতার অধিকারী। কারণ যে চতুর্থ ডুমা সীমাবদ্ধ ভোটাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়, এই অস্থায়ী প্রজাতন্ত্র তারই নির্দেশে ঘোষিত হয়। জারের পদত্যাগের পর Law of Devolution অনুযায়ী এই প্রজাতন্ত্রই ছিল বৈধ সাংবিধানিক সরকার। অপরদিকে ৮ মার্চ পেত্রোগ্রাদে শ্রমিক ধর্মঘটের ফলে সবকিছু অচল হয়। এই ধর্মঘট রুশ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের দ্বারা এবং তাদের প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠন দ্বারাই অনুষ্ঠিত হয়। জারের সেনাদল এই ধর্মঘটী শ্রমিকদের সঙ্গে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের প্রভাবেই যোগ দেয়। বলশেভিকদের “শ্রমিককে রুটি, সেনাদের যুদ্ধের বদলে শান্তি এবং কৃষককে জমি” দানের প্রতিশ্রুতিই সকল শ্রেণির জনতাকে এই ধর্মঘটের শামিল করে। এই পটভূমিকার সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের বিশেষ সক্রিয় সংগঠন বলশেভিক গোষ্ঠী পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত গঠন করে। বলশেভিকদের দ্বারা গঠিত পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত ছিল দৃঢ় মূল। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের অনুকরণে রাশিয়ার অন্যান্য শহরগুলোতেও স্থানীয় সোভিয়েত স্থাপিত হয়। কাজেই ১৯১৭ সালের মার্চ থেকেই দুটি পরস্পর বিরোধী সংগঠন রাশিয়া শাসনের বৈধ অধিকার দাবি করে। অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রের এই দাবির কোনো ভিত্তি ছিল না। কারণ যে চতুর্থ ডুমা এই প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে তা সর্বসাধারণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি। তুলনামূলকভাবে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত ছিল শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধি । এটি ছিল শ্রমিকদের সরকার গঠনের সংগঠন।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি বলশেভিকদের বিরোধিতা
রুশ সোস্যাল ডেমোক্র্যাট দল বিশেষত বলশেভিক গোষ্ঠীর মতে কেন্দ্রের প্রজাতন্ত্র ছিল রুশ বুর্জোয়া শ্রেণির দ্বারা গঠিত। সুতরাং এই প্রজাতন্ত্র বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করতো। এই প্রজাতন্ত্রের দ্বারা শ্রমিক শ্রেণির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে না। বলশেভিক দল মনে করতো যে, মেহনতি শ্রমিকদের দ্বারা সরকার গঠিত না হলে রাশিয়ায় প্রকৃত সমাজতন্ত্র স্থাপিত হবে না। সুতরাং বলশেভিক দল কেন্দ্ৰীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য দেয়নি। তারা পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতকে নিয়ে সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয় ৷
এক্ষেত্রে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, গণভোট দ্বারা রাশিয়ার প্রজা সাধারণের মতামত জানা যেত। যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করত তারাই বৈধ অধিকার পেত । কিন্তু রাশিয়া তখনও বিশ্বযুদ্ধে জড়িত ছিল। প্রায় ১০ মিলিয়ন নাগরিক বিভিন্ন রণাঙ্গনে নিযুক্ত ছিল। যুদ্ধের জন্য দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিদ্যমান ছিল না। কাজেই প্রজাতন্ত্রী নেতারা বলেন যে, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা দেখা না দিলে সাধারণ নির্বাচন সম্ভব নয় । ততদিনে চতুর্থ ডুমার দ্বারা নিযুক্ত এই অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রই ছিল বৈধ সরকার। বলশেভিকরা অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রের বৈধতা মানত না। তাদের আশঙ্কা ছিল যে, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে হয়ত ভূমিস্বত্বলোভী কৃষকরা এবং ক্ষমতালোভী বুর্জোয়ারা তাদের ভোটের জোরে হটিয়ে দিবে। সুতরাং এই শক্তি শূন্যতার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা দখল করা উচিত।
৩. সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের দ্বিধা
কিন্তু সোস্যাল ডেমোক্র্যাট দল এখনই রাষ্ট্রক্ষমতা অধিগ্রহণ করা উচিত কি না, এ বিষয়ে একমত ছিল না। সোস্যাল ডেমোক্র্যাট দলের একটি গোষ্ঠী বিশেষত মেনশেভিকগণ (আগে মেনশেভিক ও বলশেভিক মতবাদে দ্রষ্টব্য) মার্কসবাদের তাত্ত্বিক নীতিতে গভীর আস্থাশীল ছিল । মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী তারা ত্রিস্তর বিপ্লব অর্থাৎ প্রথমে সামন্ততান্ত্রিক, তারপর বুর্জোয়া এবং সর্বশেষে প্রলেতারীয় বিপ্লবের তত্ত্বে আস্থাশীল ছিল। মেনশেভিকরা মনে করতো যে, রাশিয়ায় শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠার সঠিক সময় উপস্থিত হয়নি। এদের মতে, রাশিয়ায় সবেমাত্র বুর্জোয়া বিপ্লবের দ্বারা বুর্জোয়াশ্রেণি
ক্ষমতা পেয়েছিল। বুর্জোয়া শাসনের অবক্ষয় দেখা দিলে তবেই শ্রমিক বিপ্লবের উপযুক্ত সুযোগ আসবে। তার যথেষ্ট দেরি ছিল। শ্রমিক বিপ্লবের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই ধারণা হেতু মেনশেভিকরা কয়েকটি শহরে সোভিয়েত গঠন। করলেও তারা কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে নিরুৎসাহ থাকে। বলশেভিকরাও ইতিকর্তব্য স্থির করতে পারেনি।
৪. লেনিনের এপ্রিল থিসিস
এই সময়ে বলশেভিক নেতা লেনিন সুইজারল্যান্ডে নির্বাসন থেকে স্বদেশে ফিরে আসেন। তিনি ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর বিখ্যাত 'এপ্রিল থিসিস' ঘোষণা করেন। এই থিসিসে লেনিন বলেন যে- (১) ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণির জয় হয়েছে। এতে শ্রমিকদের সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। (২) বুর্জোয়া শাসনের তথাকথিত আই সংকটের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। বুর্জোয়া বিপ্লব ও শ্রমিক বিপ্লব এক সঙ্গে চলবে এবং শেষ পর্যন্ত শ্রমিকরা ক্ষমতা দখল করবে। লেনিন “ধারাবাহিক ও অবিচ্ছিন্ন বিশ্ব বিপ্লবের” (Continued revolution) কথা বলেন। তাঁর মতে, জারতন্ত্র ছিল সামন্ত শাসনের প্রতিনিধি। তার হাত থেকে মার্চ বিপ্লবে অস্থায়ী প্রজাতন্ত্র ক্ষমতা নিলে বুর্জোয়া নিব বিপ্লব ঘটে গেছে। কিন্তু মার্কসীয় তত্ত্বের আক্ষরিক অর্থ নিয়ে “বুর্জোয়া সরকারের সংকট দেখা দিলে তবে প্রলেতারীয় বিপ্লব হবে” এই মতকে লেনিন খারিজ করেন তিনি বলেন, রাশিয়ার যা অবস্থা তাতে প্রলেতারীয় বিপ্লবের জন্য অপেক্ষা করার প্রশ্ন নেই। এখনই অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রের কাঁপা হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে হবে। বুর্জোয়ারা প্রজাতান্ত্রিক গোষ্ঠী কোনোক্রমে জয়লাভ করে, তবে তারা বৈধতা ও পায়ের তলায় মাটি পেয়ে যাবে। এখন তাদের শিকড় ছড়ায়নি। তাদের উৎপাটিত করার এটাই উপযুক্ত সময়। সুতরাং লেনিন এপ্রিল থিসিসে ঘোষণা করেন যে, “সোভিয়েতগুলিকে এখন সকল ক্ষমতা দিতে হবে” (All power to the Soviets)। (৩) শ্রমিকের স্বার্থে ক্ষমতা এখনই দখল করতে হবে। আর দেরি নয়। শ্রমিক সোভিয়েতগুলো শহর ও গ্রামে অবিলম্বে শাসন ক্ষমতা অধিকার করবে। এরা কেন্দ্রীয় হ প্রজাতন্ত্রকে আনুগত্য দিবে না। (৪) বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রী সরকার জার্মানির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। এতে রুশ জনগণ সহযোগিতা করবে না। (৫) তিনি রুশ সেনাদল ও শ্রমিকদের এই বিপ্লবে শামিল হওয়ার জন্য আহ্বান ম জানান। সৈন্যদলকে সতর্ক করে লেনিন বলেন যে, সোভিয়েত সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা না করলে তার ফল ভোগ করতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রকে টিকে থাকতে হলে যে দৃঢ় নীতি নেওয়ার দরকার ছিল, তারা তা নিতে পারেনি। বলশেভিক দল লেনিনের এপ্রিল থিসিস গ্রহণ স করে লেনিনের নেতৃত্বে যে সকল ব্যবস্থা নেয় তার মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা ব কেন্দ্রীয় প্রজাতন্ত্রের ছিল না। অস্থায়ী প্রজাতন্ত্র কতকগুলো ভুল নীতির জন্য জনসাধারণের অপ্রিয় হয়। (১) প্রজাতন্ত্র সেনাদল ও সর্বসাধারণের দাবি অগ্রাহ্য করে, যতদিন না রুশভূমি শত্রু জার্মানদের হাত থেকে মুক্ত হয়, ততদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সংকল্প নেয়। যুদ্ধের দরুন দেশবাসীর দুঃখদুর্দশাকে তারা আমল দেয়নি। দেশপ্রেম নিয়ে তারা জাতিকে স্বার্থত্যাগ করতে ডাক দেয়। এতে তাদের গণসমর্থন নষ্ট হয়।
গ্যালিশিয়া উদ্ধারের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে একটি অভিযান পাঠালে জার্মান | সেনাপতি লুডেকডর্ফ তা চূর্ণ করে দেন। গ্যালিশিয়া অভিযান ব্যর্থ হলে, এই সরকারের | কীভাবে ভূমিবণ্টন করা হবে তার একটি সুন্দর খসড়া রচনা করে। কিন্তু তা কার্যকরী। না করে জানানো হয় যে, যুদ্ধে জয় হলে, সাধারণ নির্বাচনের পর এই খসড়া কার্যকরী জমি বণ্টনের আগাম ঘোষণা দেয়। লেনিন বলেন যে, ভূমিহীন কৃষকদের বা গ্রামীণ করা হবে। এতে তারা কৃষকদের সমর্থন হারায়। বলশেভিকরা ক্ষমতা পেলে কৃষকদের | এলেতারিয়েতকে জমি দিয়ে তাদের কুলাক বা জোতদারদের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করা | দরকার। (৩) শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের সময় ধার্য করে আইন রচনা ও ন্যায্য মজুরি আইন দাবি করলে, অস্থায়ী প্রজাতন্ত্র একই উত্তর দেয় যে, যুদ্ধ শেষ হলে এই দাবি কি সকলের আস্থা নষ্ট হয়। তোর কৃষকরা ভূমিবণ্টনের দাবি জানালে প্রজাতন্ত্রী সরকার
| পুরণ করা হবে। শ্রমিক ও কৃষকরা অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রের এই বিলম্বিত প্রতিশ্রুতিতে | বিশ্বাস করেনি। সেনাদল এই হেরে যাওয়া যুদ্ধ অনর্থক চালাতে চায়নি। তারা শান্তিস্থাপনের জন্য ব্যাকুল হয়। প্রজাতন্ত্রী সরকার এই দাবির উল্টো দিকে চলার নীতি নিলে সাধারণ সেনাদের সমর্থন এই সরকার হারায়। (৪) প্রজাতন্ত্রী সরকারের নেতাদের মধ্যেও মতবিরোধ ছিল। বলশেভিকরা দাবি করে যে, “ক্ষতিপূরণ ও রাজ্য গ্রাসের কথা না ভেবে এখনই জার্মানির কাছে শান্তি প্রস্তাব দেওয়া দরকার।” এ বিষয়ে প্রজাতন্ত্রীদের মধ্যে মতভেদ হয়। বিদেশমন্ত্রী সিলিকভ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। বলশেভিকরা তাঁকে দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল বলে চিহ্নিত করায় তিনি বিরক্ত হয়ে পদত্যাগ করেন। এরপর কেরেনস্কি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী ও যুদ্ধমন্ত্রীর দায়িত্ব হাতে নেন ।
৫. প্রজাতন্ত্রীদের ক্ষমতা লাভ
কেরেনস্কি ছিলেন একাধারে মধ্যপন্থি সমাজতন্ত্রবাদী দেশপ্রেমিক। তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান। গ্যালিশিয়া অভিযানে সরকারের পরাজয় হলে কেরেনস্কি ধিকৃত হন। তাছাড়া তিনি পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় দৃঢ়তা দেখাতে পারেননি। সমাজতান্ত্রিক বিকাশের জন্য তিনি মানসিক ও আদর্শগত দিক থেকে প্রেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের সঙ্গে সহযোগিতা রেখে চলার নীতি নেন। তিনি তাঁর মন্ত্রিসভায় চেরনভ প্রভৃতি মেনশেভিক সদস্যদেরও স্থান দেন। বলশেভিকদের দাবি মেনে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে দক্ষিণপন্থিদের প্রায় বহিষ্কার করেন। বলশেভিক সেনাদলে
| তাদের প্রভাব বিস্তার করে যে সকল সেনা কমিটি বা সেনা সোভিয়েত গঠন করে, তিনি । তাতে বাধা দেননি। তাঁর আশা ছিল তাঁর মধ্যপন্থি সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বলশেভিকদের | সমর্থন আদায় করতে পারবে। কেরেনস্কি এদিক থেকে ছিলেন অনেকটা ইউরোপীয়ান বা বাস্তবতাহীন আদর্শবাদী। কেরেনস্কি সরকার সম্পর্কে মেনশেভিকদের মোহ | রাজনৈতিক ও শাসন ক্ষমতা হাতে নিতে হবে। সুতরাং কেরেনস্কি সহযোগিতার হাত থাকলেও, লেনিনের তা ছিল না। লেনিন চান যেভাবেই হোক বলশেভিক দলকে বাড়ালেও লেনিন সেই হাত ধরেননি। উগ্রপন্থি বলশেভিকদের স্বভাবসিদ্ধ কটুভাষায় তিনি আপসপন্থি সমাজতান্ত্রিকদের ধিক্কার জানান। লেনিন বলেন যে “১৯১৭ সালের মার্চ মাসে বলশেভিকদের প্রতারণা করা হয়েছে।” ১৯১৭ মার্চ বিপ্লবে জার সরকারের
পতন প্রকৃতপক্ষে বলশেভিকরাই ঘটিয়েছিল। পেত্রোগ্রাদের শ্রমিক ধর্মঘট তারাই সফল করে। সুতরাং শাসন ক্ষমতা পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের প্রাপ্য ছিল। মাঝখান থেকে বিনা স্বার্থত্যাগে, বিনা আয়াসে বুর্জোয়া চতুর্থ ডুমার নির্দেশে প্রজাতন্ত্রীরা ক্ষমতা দখল করেছে। এই সরকারের কোনো গণভিত্তি নেই। ক্ষমতা পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতই নিবে।
এই পটভূমিকায় ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে (১৯১৭ সাল) লেনিন পেত্রোগ্রামে সর্ব রুশীয় সোভিয়েত কংগ্রেসের অধিবেশন ডাকেন। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের অনুকরণে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে ও গ্রামে যে সকল স্থানীয় সোভিয়েত স্থাপিত হয়, তাদের প্রতিনিধিরা এই কংগ্রেসে যোগ দেয়। এই প্রতিনিধিরা পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতকেই প্রকৃত বৈধ কেন্দ্রীয় সরকার এবং পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের লেনিনকেই সোভিয়েত রাষ্ট্রের বৈধ প্রদান রূপে ঘোষণা করে। লেনিন সর্ব রাশিয়া সোভিয়েতের কংগ্রেস ডেকে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের বৈধতা এবং কেন্দ্রীয় সরকার রূপে তার স্বীকৃতি আদায় করেন। এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বলশেভিকরা তাদের সমর্থক গোষ্ঠী শ্রমিক ও নৌ-সেনা জুলাই মাসের মাঝামাঝি পেত্রোগ্রাদে এর অভ্যুত্থান ঘটায়। কিন্তু পরিকল্পনার অভাবে অভ্যুত্থান বিফল হয়। প্রজাতন্ত্রী সরকারের অনুগত সেনাদল ও সেনাপতি কর্নিলোভ এই বিদ্রোহ দমন করেন। লেনিন আত্মরক্ষার জন্য রাশিয়া ছেড়ে ফিনল্যান্ড পালান। বলশেভিকদের মধ্যে দোষীদের শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রধানমন্ত্রী কেরেনস্কি, “তরমিদডীয় প্রতি বিপ্লব” বা দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীলতার ভয়ে বলশেভিকদের সংগঠনগুলো ভেঙে ফেলার চেষ্টা থেকে বিরত থাকেন।
কেরেনস্কির এই সমাজতন্ত্রী ঝোঁকের জন্য গোঁড়া প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থি গোষ্ঠী অসন্তুষ্ট হয়। তাদের মুখপাত্র হিসেবে সেনাপতি কর্নিলোভ অতর্কিত আক্রমণ দ্বারা একাধিক প্রজাতন্ত্রী সরকার ও পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতকে উচ্ছেদের চেষ্টা করেন কর্নিলোভ যুদ্ধ জানতেন অনুপ্রাণিত (Indoctrinate) না করার ফল ভোগ করেন। কর্নিলোভের আক্রমণের সম্মুখে কেরেনস্কি সরকার আত্মরক্ষার ব্যবস্থা না করলেও, বলশেভিক প্রচারযন্ত্র কর্নিলোভের সেনাদের অস্ত্রসহ তাদের পক্ষে যোগ দিতে প্ররোচনা দেয়। এই প্রচারে কাজ হয়। কর্নিলোভের সেনাদল প্রজাতন্ত্রী সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে ।
৬. বলশেভিকদের ক্ষমতা লাভ
কর্নিলোভের বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহ দমনে কেরেনস্কি সরকারের ব্যর্থতা, প্রজাতন্ত্রের পতনের ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। সেনাদল, শ্রমিক ও শহরের লোকেরা বুঝে যায় যে প্রজাতন্ত্রী সরকার নিষ্ক্রিয়, ক্ষমতাহীন ও লক্ষ্যহীন। বিপদের সময় এই সরকার নেতৃত্বদানে অক্ষম। সাধারণের জীবন ও সম্পত্তি এই সরকার রক্ষা করতে পারবে না। জুলাই বিদ্রোহের বিফলতার পর বলশেভিকদের ক্ষীয়মাণ জনপ্রিয়তা, কর্নিলোড বিদ্রোহের পর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। লেনিন স্থির করেন যে, আর বিলম্ব করলে প্রজাতন্ত্রী সরকার নির্বাচন ডেকে বৈধতা আদায় করে নেবে এবং ক্ষমতা সংগঠন করে ফেলবে। কর্নিলোভ বিদ্রোহের পর কেরেনস্কি প্রজাতন্ত্র অনেকাংশে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের সহায়তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
অক্টোবর মাসে বলশেভিক নেতা ট্রটস্কি পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের সভাপতি নির্বাচিত হলে, লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক দল আসন্ন ক্ষমতা দখলের জন্য প্রস্তুতি নেয়। পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের ৯নং আদেশনামা দ্বারা লেনিন, রুশ সেনাদলকে | প্রজাতন্ত্রী সরকারকে আনুগত্য না দিয়ে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতকে আনুগত্য দিতে আদেশ দেয়। নতুবা দেশদ্রোহী ঘোষণা করে কঠোর শাস্তিদানের হুমকি দেওয়া হয়। | পেত্রোগ্রাদ গ্যারিসন বা রাজধানীর সেনাদলে বলশেভিক কর্মীরা অনুপ্রবেশ করে এই | সেনাদলের আনুগত্যে ফাটল সৃষ্টি করে। সেনাদলের সহযোগিতায় অস্ত্র যোগাড় করে। জঙ্গি শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এভাবে প্রস্তুতির পর নভেম্বর ৬, ১৯১৭ সালে মধ্যরাত্রে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের জঙ্গি শ্রমিক নেতারা রাজধানী পেত্রোগ্রাদের সরকারি অফিসগুলো দখল করে নেয় ৷ এর ফলে রাজধানী বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কেরেনস্কি ও তাঁর সমর্থকরা রাজধানী থেকে পালান। নভেম্বরের ঘটনার ফলে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ঘটে এবং বলশেভিকদের হাতে ক্ষমতা চলে আসে। অবশ্য এর পর প্রতি বিপ্লবী বিদ্রোহ দমন করে ও বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করে বলশেভিকদের গৃহীত ক্ষমতা রক্ষা করতে হয়।
বলশেভিকদের সফলতার কারণগুলো আমরা প্রজাতন্ত্রী সরকারের নেতিবাচক নীতি, এই সরকারের সাধারণ নির্বাচন ভীতি, প্রজাতন্ত্রী সরকারের যুদ্ধনীতি, কৃষক ও শ্রমিকদের নিরপক্ষে আনার জন্য সংস্কার প্রবর্তনে ব্যর্থতা, খাদ্যসংকট ও শিল্প সামগ্রী সরবরাহে ব্যর্থতার মধ্যেই খুঁজে পাব। অপরদিকে বলশেভিকদের সফলতার মূলে ছিল তাদের সংগঠন ও প্রচারকার্য। সোস্যাল ডেমোক্র্যাট দল মার্কসবাদকে সারসত্য জ্ঞান করে ১৯০৫ সালের আগে থেকেই শ্রমিক সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে। এজন্য রুশ শ্রমিকদের তারা ছিল নিজের লোক। সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন দ্বারা তারা যেমন জার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তেমনই তারা প্রজাতন্ত্রীদেরও ক্ষমতাচ্যুত করে। দ্বিতীয়ত, নিরন্তর প্রচার দ্বারা শ্রমিক, নিম্নমধ্যবিত্ত ও কৃষকদের কাছে বলশেভিকরাজের মাধ্যমে এক স্বর্ণযুগ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখায়। আপাতত পরাজিত, হতাশাতাড়িত সেনাদলকে শান্তি এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, কৃষককে জমি ও শ্রমিককে রুটি দেওয়ার তারা প্রতিশ্রুতি দেয়। এই প্রতিশ্রুতির জন্য তারা এই সকল শ্রেণির আস্থা অর্জন করে। তৃতীয়ত, লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা বাস্তবমুখী, দূরদর্শী নীতি নিতে সক্ষম হয়। লেনিনের নেতৃত্ব, বাগ্মীতা, কূটনীতি ও যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এই দলের জয়লাভ ঘটায়। চতুর্থত, বলশেভিকদের প্রতি কেরেনেস্কি সরকারের দুর্বলতা এবং কর্নিলোভ বিদ্রোহের পর কেরেনস্কি সরকারের মধ্যপন্থি নীতির দেউলিয়াপনা বলশেভিকদের জয়লাভের পথ প্রশস্ত করে। শ্রমিক শ্রেণির সহায়তা ছাড়া রুশ সেনাদলের সহায়তা ছিল বলশেভিকদের জয়লাভের চাবিকাঠি।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]