১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লবের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনা। এই বিপ্লব শুধু রাশিয়াতেই নয়, সারা পৃথিবীর রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই বিপ্লব সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। বিশ শতকে সারা পৃথিবীর নির্যাতিত, অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তিসংগ্রামে বলশেভিক বিপ্লব নিরন্তর প্রেরণার উৎস। বলশেভিক বিপ্লবের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিল নিম্নরূপ :
বলশেভিক বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লবের ফলে রাশিয়াতে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাশিয়াতে দীর্ঘদিনের সামন্ত ও ভূস্বামীদের শোষণ, অত্যাচার এবং পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণের অবসান ঘটে। উনিশ শতক থেকে চলে আসা ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক চিন্তা, দর্শন ও রাষ্ট্রচিন্তার বাস্তব রূপায়ণ ঘটে এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।
এই বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার পুরানো সামাজিক সম্পর্ক, পুরানো প্রশাসনিক কাঠামো বাতিল হয়ে যায়। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় নয়া সামাজিক সম্পর্ক এবং নয়া প্রশাসনিক কাঠামো। বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ার প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীভূত। একনায়কতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় এবং প্রশাসনে শ্রমিক কৃষকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় আঞ্চলিক সোভিয়েতের উপর।
বলশেভিক বিপ্লব পশ্চিম ইউরোপের পুঁজিবাদী সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর চরম আঘাত করে। পশ্চিমি সভ্যতার মূল শক্তির বিরুদ্ধে বলশেভিক বিপ্লব ছিল এক সংগ্রামের প্রেরণা। পুঁজিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এই বিপ্লব এক নয়া,
বিকল্প এবং সামগ্রিক মানব কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা করে। একই সঙ্গে পুঁজিবান সমাজ ভেঙে নয়া সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ প্রদর্শন করে। ফলে উন্নত ধনবাদী দেশগুলোতে নিয়োগ করে পুঁজিবাদী দেশগুলো। সমাজতন্ত্রের চরম বিরোধিতা থেকে পশ্চি ইউরোপের পুঁজিপতিদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে। মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির হুমকি এই ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে দ্বিতীয়
এক ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য সর্বাত্মক
বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
বলশেভিক বিপ্লব এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার পরাধীন দেশগুলোে . ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বলশেভিক বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত
উপনিবেশের জনগণ স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই শুরু করে। ক্রমে সার পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম। বলা যেতে পারে বিশ শতকের সার পৃথিবীর স্বাধীনতার লড়াই আর জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে বলশেভিক বিপ্লব ছিল অফুরন্ত প্রেরণার উৎস।
বলশেভিক বিপ্লব সারা পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণি ও কৃষক সমাজকে শোষ বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকে উৎসাহিত করে, অনুপ্রেরণা যোগায়। বলশেভিক বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালে সংঘটিত হয় চীনা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সার পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন একটি প্রধান রাজনৈতিক স্রোতে পরিণত হয় পৃথিবীব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কাজে মডেল হিসেবে বিবেচিত ছিল বলশেভিক বিপ্লব এবং বিপ্লবের নায়ক লেনিন। লেনিনের লেখা গ্রন্থাবলি ছিল ে বিপ্লবীদের অধ্যয়ন অনুশীলনের প্রধান বিষয় অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিম্নোক্ত শিরোনামে উপস্থাপন চ করা যায় ।
১. আদর্শিক বিবর্তনের সূচনা
নির্বাসিত জীবনে থাকার সময়ে লেনিন রাশিয়ায় কীভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকেন। তিনি ইসকারা পত্রিকায় প্রকাশিত ব প্রবন্ধে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাশিয়ায় কখনোই পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র দ্বারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাঁর এই ধারণার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দো পরিভ্রমণ। এসময় তিনি মনে করেন যে, যেহেতু রাশিয়া ইউরোপের অন্যান্য দেশে তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে, তাই এদেশে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বারাব মানুষের মুক্তি সম্ভব। এ লক্ষ্যে তিনি শ্রমিক ঐক্যের উপর জোর দেন। কারণ সর্বহার এই শ্রেণির দ্বারাই দেশের প্রকৃত বিপ্লব আনা সম্ভব হবে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা এবং জমি কৃষকদের কাছে হস্তান্তর করা। রাশিয়ার সমাজে দীর্ঘকাল ধরে এই ভূমির ইস্যুটি ছিল অমীমাংসিত। এছাড়া লেনিন রাশিয়াতে চলে আসা এককেন্দ্রিক ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীভূত করে স্থানীয় ক্ষমতা আঞ্চলিক সোভিয়েতের হাতে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।
১৯১৭ সালের এপ্রিল মে মাসের দিকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে ব্যাপক অরাজকতা দেখা দেয়। বুর্জোয়া সরকার যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। দেশের অভ্যন্তরে দেখা দেয় ভোগ্য পণ্যের প্রচণ্ড অভাব। খাদ্যসংকট তীব্র আকার ধারণ করে। জার্মান বাহিনী রাশিয়ার অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চল দখল করতে থাকে। ক্রমে পেত্রোগ্রাদের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ে। দেশের চরম সংকটের মুখে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে বলশেভিকরা বিভিন্ন অঞ্চলের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে থাকে । এই সময়ে লেনিনের নেতৃত্বে পার্টির দুই নেতা ট্রটস্কি ও স্টালিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বলশেভিক পার্টির হাজার হাজার সদস্য লেনিনের নেতৃত্বে জনগণকে সাথে নিয়ে সমগ্র রাশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং পেত্রোগ্রাদের দিকে অগ্রসর হয়। ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর বলশেভিকরা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন, রাষ্ট্রীয় ব্যাংক, টেলিফোন একচেঞ্জসহ সকল সরকারি স্থাপনা দখল করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। অতঃপর লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। এভাবে সম্পন্ন হয় বলশেভিক বিপ্লব ।
৫.৬ ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লবের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনা। এই বিপ্লব শুধু রাশিয়াতেই নয়, সারা পৃথিবীর রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই বিপ্লব সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। বিশ শতকে সারা পৃথিবীর নির্যাতিত, অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তিসংগ্রামে বলশেভিক বিপ্লব নিরন্তর প্রেরণার উৎস। বলশেভিক বিপ্লবের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিল নিম্নরূপ :
বলশেভিক বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লবের ফলে রাশিয়াতে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাশিয়াতে দীর্ঘদিনের সামন্ত ও ভূস্বামীদের শোষণ, অত্যাচার এবং পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণের অবসান ঘটে। উনিশ শতক থেকে চলে আসা ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক চিন্তা, দর্শন ও রাষ্ট্রচিন্তার বাস্তব রূপায়ণ ঘটে এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।
এই বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার পুরানো সামাজিক সম্পর্ক, পুরানো প্রশাসনিক কাঠামো বাতিল হয়ে যায়। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় নয়া সামাজিক সম্পর্ক এবং নয়া প্রশাসনিক কাঠামো। বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ার প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীভূত। একনায়কতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় এবং প্রশাসনে শ্রমিক কৃষকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় আঞ্চলিক সোভিয়েতের উপর।
বলশেভিক বিপ্লব পশ্চিম ইউরোপের পুঁজিবাদী সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর চরম আঘাত করে। পশ্চিমি সভ্যতার মূল শক্তির বিরুদ্ধে বলশেভিক বিপ্লব ছিল এক সংগ্রামের প্রেরণা। পুঁজিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এই বিপ্লব এক নয়া,
বিকল্প এবং সামগ্রিক মানব কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা করে। একই সঙ্গে পুঁজিবান সমাজ ভেঙে নয়া সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ প্রদর্শন করে। ফলে উন্নত ধনবাদী দেশগুলোতে নিয়োগ করে পুঁজিবাদী দেশগুলো। সমাজতন্ত্রের চরম বিরোধিতা থেকে পশ্চি ইউরোপের পুঁজিপতিদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে। মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির হুমকি এই ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে দ্বিতীয় এক ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য সর্বাত্মক
বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
বলশেভিক বিপ্লব এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার পরাধীন দেশগুলোে . ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বলশেভিক বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত
উপনিবেশের জনগণ স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই শুরু করে। ক্রমে সার পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম। বলা যেতে পারে বিশ শতকের সার পৃথিবীর স্বাধীনতার লড়াই আর জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে বলশেভিক বিপ্লব ছিল অফুরন্ত প্রেরণার উৎস।
বলশেভিক বিপ্লব সারা পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণি ও কৃষক সমাজকে শোষ বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকে উৎসাহিত করে, অনুপ্রেরণা যোগায়। বলশেভিক বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালে সংঘটিত হয় চীনা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সার পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন একটি প্রধান রাজনৈতিক স্রোতে পরিণত হয় পৃথিবীব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কাজে মডেল হিসেবে বিবেচিত ছিল বলশেভিক বিপ্লব এবং বিপ্লবের নায়ক লেনিন। লেনিনের লেখা গ্রন্থাবলি ছিল ে বিপ্লবীদের অধ্যয়ন অনুশীলনের প্রধান বিষয়
অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিম্নোক্ত শিরোনামে উপস্থাপন চ করা যায় ।
১. আদর্শিক বিবর্তনের সূচনা
নির্বাসিত জীবনে থাকার সময়ে লেনিন রাশিয়ায় কীভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকেন। তিনি ইসকারা পত্রিকায় প্রকাশিত ব প্রবন্ধে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাশিয়ায় কখনোই পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র দ্বারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাঁর এই ধারণার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দো পরিভ্রমণ। এসময় তিনি মনে করেন যে, যেহেতু রাশিয়া ইউরোপের অন্যান্য দেশে তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে, তাই এদেশে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বারাব মানুষের মুক্তি সম্ভব। এ লক্ষ্যে তিনি শ্রমিক ঐক্যের উপর জোর দেন। কারণ সর্বহার
. লেনিনের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও এপ্রিল থিসিস ঘোষণা ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরও লেনিন সুইজারল্যান্ডে নির্বাসিত অবস্থায় ছিলেন। এখান থেকেই তিনি আন্দোলন পরিচালনা করে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর বলশেভিক পার্টির কর্মীদের ভেতর নানা বিষয়ে মতান্তর দেখে লেনিনও রাশিয়ায় ফিরে আসতে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, লেনিনের যুদ্ধ বিরোধী অবস্থান | সকলের কাছেই স্পষ্ট ছিল। তাই ব্রিটিশ ও ফরাসিদের পক্ষ থেকে লেনিন যাতে রাশিয়ায় ফিরে আসতে না পারেন, সেজন্য নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জার্মানি, পোল্যান্ড, সুইডেন এবং ফ্রান্সের বিপ্লবীদের সহযোগিতায় | লেনিন এবং অন্যান্য প্রবাসী বিপ্লবীদের জার্মানির ভেতর দিয়ে রাশিয়ায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জার্মান কর্তৃপক্ষের ধারণা ছিল যে, লেনিন তার পরিকল্পিত সমাজ বিপ্লব শুরু করলে রাশিয়ার সমাজ এক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তখন সেখানে জার্মানি তার অবস্থানকে পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। এই রকম একটি চিন্তাধারা থেকে জার্মান কর্তৃপক্ষ লেনিন ও অন্যান্যদের একটি ঢাকা রেলগাড়িতে করে সুইজারল্যান্ড থেকে রুশ সীমান্তে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকে তিনি পেত্রোগ্রাদ স্টেশনে পৌছালে হাজার হাজার শ্রমিক, সৈনিক ও নাবিকের একটি দল তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক' – এই বলে লেনিন তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন।
১৯১৭ সালের ৪ এপ্রিল বলশেভিকদের এক সভায় লেনিন তাঁর সুবিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস' ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়েই মূলত তিনি তৎকালীন বলশেভিক পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান ও পরবর্তীতে করণীয় নিয়ে বিশদভাবে তুলে ধরেন। লেনিন দেখান যে, বিপ্লবের প্রথম ধাপে সর্বহারাদের সংগঠন থাকে দুর্বল অবস্থায় এবং শ্রেণি সচেতনতার অভাবের জন্য বুর্জোয়াদের হাতে ক্ষমতা চলে গেছে। কিন্তু বিপ্লবের চাপে নিশ্চয়ই সর্বহারা এবং গরিব কৃষকদের হাতে ক্ষমতা আসবে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, সামরিক সরকারকে সমর্থন করা যাবে না এবং একথাও মনে রাখতে হবে যে এখনও এই সরকারের উপর জনসাধারণের গভীর আস্থা রয়েছে। আর শ্রমিক কৃষকদের নির্বাচিত সোভিয়েতগুলো এই সরকারকে সমর্থন করে যাচ্ছে। এই অবস্থায় জনসাধারণের মধ্যে বলশেভিকদের সুসংগঠিতভাবে এবং ধৈর্যের সাথে ব্যাপকভাবে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যেতে হবে। সরকারও সোভিয়েতগুলোর ভুলভ্রান্তিগুলোকে সমালোচনা করে জনসাধারণের সামনে তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বোঝাতে হবে যে, সোভিয়েতগুলোর হাতে সমস্ত ক্ষমতা না আসা পর্যন্ত বিপ্লবী শাসন কায়েম করা যাবে না।
লেনিন আরও উল্লেখ করেন যে, ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জনসাধারণের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে বটে— জনগণ আজ সশস্ত্র— এই অবস্থার শান্তিপূর্ণভাবে বিপ্লব সফল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই অর্থ এই যে, বুর্জোয়া শ্রেণি চরিত্র বদলে গেছে অথবা সে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চায় তা নয়; বরং এর অর্থ হচ্ছে, বিপ্লবী
জনতার শক্তি এত বেশি যে, তাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা সামরিক সরকারের নেই। বুর্জোয়াদের সামরিক সরকার সোভিয়েত নেতাদের (যারা বেশির ভাগই ছিল
মেনশেভিক এবং সোশ্যালিস্ট রেভ্যুলিউশনারি) সঙ্গে যোগসাজশ করে তাদের সহযোগিতা নিয়েই দেশ শাসন করছে। অতএব, বিপ্লবীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে সোভিয়েতগুলোকে ঐ সকল ভণ্ড নেতাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করে সোভিয়েতগুলোর
হাতে সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে আসার চেষ্টা করা ।
শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিলোপসাধন করা, জমিদারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং দেশের সকল জমি জাতীয়করণ করা, সকল ব্যাংককে একত্রিত করে সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ন্যাশনাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব ছিল। উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে শ্রমিক সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য লেনিন তাঁর সুবিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিসের মধ্য দিয়ে দাবি জানান ৷
৩. এপ্রিল থিসিস প্রদানের পরবর্তী কর্মসূচি
লেনিনের এপ্রিল থিসিস প্রদানের পর পরই বুর্জোয়া, মেনশেভিক, সোশ্যালিস্ট রেভ্যুলিউশনারিসহ অন্যান্য পার্টিগুলো এর তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। এমনকি তারা প্রচার করতে লাগলেন যে, ‘লেনিন দেশের শত্রু এবং জার্মানির চর'। সামরিক সরকারও জনসাধারণের আন্দোলন দমন করতে পুরানো রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু সমাজের আপামর জনসাধারণ লেনিনের 'এপ্রিল থিসিসে'র মাঝে তাঁদের মুক্তির সন্ধান পেতে চান ৷
অবশ্য এ কথাও ঠিক যে, বলশেভিক পার্টির অনেক নেতাও লেনিনের এপ্রিল থিসিসের বিরোধিতা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কামেনেভ, রিকভ প্রমুখ। এই সমস্ত নেতাদের প্রধান যুক্তি ছিল, যে কোনো সমাজের সমাজতন্ত্রের মতো আদর্শিক অবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যে ধরনের পরিপক্বতা উক্ত দেশের বা সমাজের মানুষের থাকা প্রয়োজন, সে অবস্থায় রাশিয়ার সমাজ তখন পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। অতএব সর্বহারাদের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে, দেশে যাতে বুর্জোয়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখা। অন্যদিকে, ট্রটস্কি সরাসরি শ্রমিকদের রাষ্ট্র কায়েম করার কথা বলেন। এর ফলে সর্বহারা শ্রেণির বিশাল কৃষক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয় । এমনকি আন্দোলনের গতি কমে আসার সম্ভাবনা দেখা দেয় ৷
এপ্রিল মাসের শেষ দিকে বলশেভিক পার্টি কেন্দ্রীয় সম্মেলন আহ্বান করে। সেখানে রাশিয়ার সকল স্থান থেকে নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হন। সম্মেলনে লেনিনের প্রস্তাব অনুযায়ী পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। স্টালিন জাতিসংক্রান্ত প্রশ্নে রিপোর্ট পেশ করেন। সম্মেলনের প্রস্তাব অনুযায়ী রাশিয়ার অন্তর্গত সকল জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। পাশাপাশি যে কোনো জাতি ইচ্ছে করলে স্বাধীন হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার অধিকারকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বলশেভিক পার্টি মনে করতো যে, ন্যায্য অধিকারের এই স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমেই বিভিন্ন জাতির শ্রমিকদের
মাঝে ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সম্মেলন থেকে দাবি জানানো হয় যে, যে সকল জাতি রাশিয়ার সাথে থাকার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তাদেরকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিতে হবে। তাদের উপর অন্য কোনো অঞ্চলের ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। এমনকি জাতিগুলোর উপর কোনো প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণও করা যাবে না। বলশেভিক পার্টি মনে করতো যে, এভাবে যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে, তার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর ভেতর বিরাজমান | সংকট দূর করে শাসক-শাসিতের সহযোগিতার ভিত্তিতে জাতীয় সংহতি শক্তিশালী। করা সম্ভব হবে।
৪. সামরিক সরকারের প্রতি লেনিনের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও লেনিন দেখলেন যে, এর মধ্য দিয়ে সরকার পুঁজিপতি ও জমিদারদের স্বার্থরক্ষা করে চলেছেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, “সামরিক সরকারকে কোনো প্রকার সমর্থন দেওয়া যাবে না এবং সোভিয়েতের হাতে সকল ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে।” তিনি জনসাধারণের মাঝে এই চেতনা সৃষ্টি করলেন যে, এসমস্ত সোভিয়েতই মানুষের কাছে তার ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারে। তবে তিনি এপ্রিল মাসের পর পরই কোনো প্রকার বিপ্লবী ঘোষণা দেননি। কারণ তারপর থেকেই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রূপ দেওয়ার জন্য মানুষকে সচেতন করতে থাকেন।
৫. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লেনিনের কর্মসূচি
তিনি দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তিনি বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ব্যবস্থার উচ্ছেদ চেয়েছিলেন। দেশের সকল ভূমির জাতীয়করণ করা, এর ফলে ভূমির ব্যক্তি মালিকানা লোপ পেয়ে খেতমজুর ও কৃষক প্রতিনিধিদের সোভিয়েতগুলোর হাতে তা বন্দোবস্ত করা হবে। কলকারখানা ও সকল সামাজিক উৎপাদন কাঠামোর উপর শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি জানান। তিনি দাবি করেন যে, দেশের ব্যাংকগুলোকে জাতীয়করণ এবং এগুলোর নিয়ন্ত্রণের ভার সোভিয়েতের হাতে অর্পণ করতে হবে।
৬. কৃষক ও শ্রমিকদের সংঘটিত করার উদ্যোগ
লেনিন কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করার নীতি গ্রহণ করেন। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল- তিনি মনে করতেন যে, বিপ্লবের জন্য এ শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ। এই শ্রেণি নিপীড়িত হওয়ায় তাদের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থাকে প্রবল।
৭. আন্দোলনের সূত্রপাত ও লেনিনের নির্দেশনা
সামরিক সরকার বলশেভিক পার্টিকে অত্যন্ত কঠোর হস্তে দমন করে। এ সময়ে অনেক বলশেভিক নেতৃবৃন্দকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। বিশেষ করে ১৯১৭ সালের ৫ জুলাই বলশেভিকদের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত প্রভেদা অফিস তছনছ করে সামরিক সরকারের বাহিনী। এর মধ্যে দিয়ে বিপ্লবের শান্তিপূর্ণ পর্বের অবসান ঘটে ।
৮. লেনিনকে আটক অথবা হত্যার হুমকি
এর পর থেকেই সামরিক সরকার লেনিন ও বলশেভিক পার্টি সম্পর্কে কুৎসিত প্রচারণা চালাতে থাকেন। আইন বহির্ভূতভাবে লেনিন প্রসঙ্গে ঘোষণা করে, যে ব্যাধি লেনিনকে সরকারের হাতে তুলে দিতে সাহায্য করবে অথবা তুলে দিবে তাকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ পুরস্কার প্রদান করা হবে। এসময়ের বুর্জোয়া সংবাদপত্রগুলো বলশেভিকদের দমন পীড়নের যৌক্তিকতা তুলে ধরে। অন্যদিকে, সরকার কর্তৃক আরোপিত সেন্সরশিপের ফলে সংবাদপত্র থেকে মানুষের উপর সরকারি দমন পীড়নের
সংবাদ পাওয়া যেত না ।
৯. লেনিনের আত্মগোপন
কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তক্রমে ভ্লাদিমির লেনিন প্রায় সাড়ে তিন মাস আত্মগোপনে থাকেন। আত্মগোপনে থেকেই তিনি পার্টির সকল কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিতে থাকেন, এসময়ে তিনি কিছুদিন লুকিয়ে থাকেন পেত্রোগ্রাদে শ্রমিকদের বাড়িতে। পরে থাকেন রাজলিভ হ্রদের তীরে একটি কুঁড়েঘরে, ফিনদেশীয় ঘেসুড় হিসেবে। এসময়েই তিনি সুবিখ্যাত গ্রন্থ State and Revolution প্রণয়ন করেন ।
১০. গুপ্ত অবস্থায় পার্টির কর্মকাণ্ড তদারকি
গুপ্ত অবস্থায় থেকেও লেনিন পার্টি ও শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এ সময়ে তাঁর সঙ্গে কয়েকজন কমরেড নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- অর্জনিকিজে, জফ, শমান, রাখিয়া প্রমুখ। তিনি পেত্রোগ্রাদের খুঁটিনাটি সংবাদ জানতেন এবং সেই আলোকেই পরবর্তী করণীয় নিয়ে পার্টিকে দিকনির্দেশনা প্রদান করতেন। জুলাই মাসের দিকে বলশেভিক পার্টি অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। কিন্তু তারপরেও লেনিন বিপ্লবে বিজয়ী হওয়ার প্রশ্নে নিশ্চিত ছিলেন। তিনি কমরেডদের কাছে মন্তব্য করেন যে, অভ্যুত্থান হবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের পরে নয় বরং এই মাসের মধ্যে। তাঁর প্রস্তাব অনুসারে বলশেভিক পার্টি আপাতত তাদের স্লোগান- “সোভিয়েতের হাতে সকল ক্ষমতা চাই”-পরিত্যাগ করে। এর পেছনে কারণ ছিল-সোশ্যালিস্ট রেভ্যুলিউশনারি ও মেনশোভিক প্রভাবিত সোভিয়েতগুলো মূলত সামরিক সরকারের লেজুড়ে পরিণত হয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে লেনিন মত প্রকাশ করেন যে, ক্ষমতার পালা বদলের জন্য আশু কর্তব্য হচ্ছে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি ।
১৯১৭ সালের জুলাই মাসের শেষ নাগাদ বলশেভিক পার্টির গোপনে ষষ্ঠ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এটি গোপনে অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রধান কারণ ছিল সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে হামলার সম্ভাবনা ছিল। কংগ্রেসের শুরুতেই সদস্যরা প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, সামরিক সরকারের আদালতে লেনিন উপস্থিত হবেন কি না? এর জবাবে কংগ্রেস সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, লেনিন আদালতে উপস্থিত হবেন না। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সামরিক সরকারের তীব্র দমননীতির প্রতিবাদ জানানো হয়। এছাড়া কংগ্রেস লেনিনকে সভাপতি হিসেবে গ্রহণ করেন।
লেনিন রাশিয়ার সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অনুধাবন করেন। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি পটভূমি তৈরি হচ্ছে। এ লক্ষ্যে তিনি পার্টিকে প্রস্তুতও করেন। কংগ্রেসের পর থেকেই বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে কলকারখানা, ফৌজ, গ্রামাঞ্চলে, শ্রমিক, সৈনিক, নাবিক ও কৃষকদের মাঝে সাংগঠনিক কার্যক্রম চলতে থাকে। পুরো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড লেনিনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে। এসময়ই গড়ে তোলা হয় লাল ফৌজ। শ্রমিকরা অস্ত্র সংগ্রহ করে এবং তা ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণও গ্রহণ করে।
১১. বিপ্লব প্রসঙ্গে লেনিনের দিকনির্দেশনা
রাশিয়ায় বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বলশেভিক পার্টি যখন সংগ্রামে লিপ্ত, তখন বিভিন্ন মহল থেকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে এর স্বরূপ কী হবে তা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছিল। লেনিন অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্তভাবে এ প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন তাঁর সুবিখ্যাত রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থের মধ্য দিয়ে। গ্রন্থটি তিনি আত্মগোপন অবস্থায় ১৯১৭ সালে গ্রীষ্ম ও শরৎকালে লিখেন। গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্র ও প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রসঙ্গে মার্কস ও এঙ্গেলসের প্রচলিত মতবাদকে নয়াভাবে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় ব্যাখ্যা করেন। কারণ বিপ্লবের প্রাক্কালে প্রতিবিপ্লবীরা মার্কস ও এঙ্গেলস এর বক্তব্যকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করেন ।
লেনিন বিপ্লব প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা প্রদান করেন যে, রাষ্ট্র দেখতে যতই গণতান্ত্রিক হোক না কেন, বস্তুত সকল বুর্জোয়া রাষ্ট্রই প্রকৃতপক্ষে বুর্জোয়া একনায়কত্বের বা প্রভুত্বের একটা রূপ। তাঁর মতে, প্রলেতারিয়েতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, বুর্জোয়া ক্ষমতার উচ্ছেদ করতে হবে এবং প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাঁর মতে, এই ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে, সেটাই হবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কারণ সেখানে জনগণের স্বার্থকেই প্রতিনিধিত্ব করবে। তিনি এর মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্রে কীভাবে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে তাঁর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রচার করেন। লেনিনের ভাষায় বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, “রাষ্ট্র ক্ষমতা, শক্তির কেন্দ্রীভূত সংগঠন, বলপ্রয়োগের সংগঠন প্রলেতারিয়েতের দরকার শোষকদের প্রতিরোধ দমন এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ‘সুব্যবস্থার’ ব্যাপারে কৃষক, পেটি বুর্জোয়া, আধা-প্রলেতারিয়ানদের বিপুল জনসংখ্যাকে নেতৃত্ব দান, এই উভয়ের জন্যই।”
লেনিন বলশেভিক পার্টির কমরেডদের নিকট নির্দেশ প্রদান করেন যে, প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বই হচ্ছে মার্কসবাদের শিক্ষার প্রধান বক্তব্য। বস্তুত প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব নির্মাণের মধ্য দিয়েই প্রকৃত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে লেনিন মনে করতেন।
রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থে লেনিন 'সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমকে' কমিউনিস্ট সমাজ বিকাশের জন্য দুটি পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। মূলত মার্কস ও এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্ধিত করে তিনি নয়া যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তা অনিবার্যভাবেই বিকশিত হয়ে কমিউনিজমের স্তরে
গিয়ে পৌঁছবে। এ প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি কী ধরনের ভূমিকা পালন করবে তাও লেনিন অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তিনি তাঁর রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থে পার্টিকে চিহ্নিত করেছেন প্রলেতারিয়েত শ্রেণির অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে। এদের কাজ হবে জনগণকে সমাজতন্ত্রের পথে পরিচালিত করা। যার মধ্য দিয়ে পার্টি নয়া সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং সকল মেহনতি মানুষের স্বপক্ষে নেতৃত্ব প্রদান করতে সক্ষম হবে। তাঁর মতে, বুর্জোয়াদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে নবজীবন প্রদান করতে পারে কেবল কমিউনিস্ট পার্টি।
১২. লেনিনের ফিনল্যান্ড গমন ও রাশিয়ার রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় পার্টির কর্মসূচি নির্ধারণ
১৯১৭ সালের আগস্ট মাসে লেনিন ইঞ্জিনের ফায়ারম্যান হিসেবে ফিনল্যান্ড চলে যান। সেখানে পৌঁছে প্রথমদিকে তিনি হেলসিংফোর্সের কাছে একটি গ্রামে ফিন শ্রমিকদের সাথে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি হেলসিং ফোর্সে (বর্তমানে হেলসিঙ্কি নামে পরিচিত) চলে আসেন।
এই সময়ে রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। জ্বালানির অভাবে পুরো দেশের পরিবহণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এর ফলে শহরের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও খাদ্যের আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। চোরাকারবারি ও মজুতদারদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়। খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়ে তা সাধারণ মানুষের আওতার বাইরে চলে যায়। দেশের সামগ্রিক অবস্থা সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই কাজগুলো সামরিক সরকারের নেতৃত্বে থাকা বুর্জোয়ারা ইচ্ছাকৃতভাবেই করে। তাঁদের ধারণা ছিল, এর ফলে সাধারণ কৃষক শ্রমিকদের ভেতর যে বিপ্লবের অনুভূতি দানা বেঁধে উঠছিল তাকে দমন করা যাবে। কারণ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায় এবং শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ে। সুতরাং এ অবস্থায় শ্রমিকদের পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না এবং আসন্ন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবেরও গতিরোধ করা যাবে বলে বুর্জোয়ারা মনে করে।
আন্দোলনের এরকমই একটি পর্যায়ে লেনিন রচনা করেন আসন্ন বিপর্যয় ও তা প্রতিহত করার উপায় শীর্ষক গ্রন্থ। তিনি প্রমাণ করেন যে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে পুঁজিপতি, বুর্জোয়া ও জমিদাররা কীভাবে দেশকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এই অরাজক অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে বুর্জোয়ারা ক্ষমতাকে আবার নিরঙ্কুশ করতে চাচ্ছে। লেনিন মনে করেন যে, যদি দেশকে রক্ষা করতে হয় তবে একটি মাত্র পথ খোলা রয়েছে, সেটি হলো—সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে- ভূমি ও ব্যাংকগুলোর জাতীয়করণ করা। এককভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক গঠন এবং উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এসব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা যাবে এবং মানুষের কাজকর্মে সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি রাশিয়াকে অনৈতিক যুদ্ধের অবসান করতে হবে বলেও লেনিন মত প্রকাশ করেন।
১৩. জেনারেল কর্নিলভের প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা ও শ্রমিক শ্রেণিকে এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে লেনিনের ভূমিকা
রাশিয়ার বিপ্লব যখন সুনির্দিষ্ট পথ ধরে এগুচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে রাশিয়ার বুর্জোয়া শ্রেণি ও বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের মদদে ২৫ আগস্ট, ১৯১৭ সালে জেনারেল কার্নিলভ প্রতি বিপ্লবী বিদ্রোহ শুরু করেন। তাঁর প্রতিবিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বিপ্লবকে নস্যাৎ করে দেওয়া এবং সামরিক একনায়ক হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি রাজধানী পেত্রোগ্রাদ অভিমুখে তাঁর অধীনে থাকা সৈন্যদের প্রেরণ করেন। কিন্তু কার্নিলভের প্রতিবিপ্লবের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলশেভিক পার্টিকে নস্যাৎ করে দেয়। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণি এক নয়া অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। তাঁরা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অনুধাবন করেন যে, লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টিই কেবল তাদের স্বার্থকে রক্ষা করতে পারে। এর ফলে জনগণের চেতনায় এক নয়া ধরনের পরিবর্তন ঘটে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের পরে সোভিয়েতগুলোর নির্বাচনে বলশেভিক পার্টির আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। বলশেভিক পার্টির ও সোশ্যালিস্ট সামরিক সরকার মেনশেভিক হঠাৎ ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে
বৃদ্ধির ফলে সামরিক রেভ্যুলিউশনারিরা অপপ্রচার চালাতে থাকেন যে, বলশেভিকরা কখনই নিজেদের হাতে ক্ষমতা নিতে পারবে না। যদিও তারা ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে তবে তারা সপ্তাহ দুয়েকের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। কারণ দেশে সুশাসন দেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নেই। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে লেনিন ‘বলশেভিকরা কি রাষ্ট্র ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধে তিনি সকল সমালোচনার জবাব দেন। তিনি লিখেন-
বলশেভিকরা যে ক্ষমতা দখল করে, প্রতিবিপ্লবকে প্রত্যাঘাত হেনে সে ক্ষমতা ধরে রেখে দেশের অর্থনীতিকে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে পারবে, তার প্রয়োজনীয় সবকটি পূর্বশর্তই বর্তমান। এ ব্যাপারে শ্রমিক ও কৃষকদের নয়া রাষ্ট্র যন্ত্র হিসেবে বিরাট ভূমিকা পালন করতে হবে সোভিয়েতগুলোকে। গরিব কৃষকদের উপর নির্ভর করে বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতায় এলে নিগড়মুক্ত অসংখ্য জনগণের উদ্যোগ ও উদ্যম অবারিত হবার সুযোগ মিলবে এবং এগিয়ে যাওয়া যাবে নয়া জীবন নির্মাণে ।
১৪. সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা প্রণয়ন
দেশের ভেতরে রাজনৈতিক অবস্থা খুব দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকলেও লেনিন গুপ্ত অবস্থায় ফিনল্যান্ডে অবস্থান করেন। সেখানে অবস্থান করেও পার্টির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে পরবর্তী করণীয় ঠিক করে দিতেন। এসময়ে এসে বৃহৎ শিল্প কেন্দ্রগুলোর ‘সোভিয়েতসমূহে' বলশেভিক পার্টি সামনে নিয়ে আসে। সেটি হলো- 'সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে।' এ শ্লোগানকে সামনে আনার মধ্য দিয়ে মূলত লেনিন বুর্জোয়া সাময়িক সরকারের বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আহ্বান জানান। বলশেভিক পার্টির এই স্লোগানকে তখন রাশিয়ার ২৫০টিরও বেশি সোভিয়েত সমর্থন জানিয়েছে।
১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাঝামাঝি সময়ে লেনিন ফিনল্যান্ডে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পেত্রোগ্রাদ এবং মস্কো কমিটির কাছে দুটি গোপন চিঠি লিখেন। এই ঐতিহাসিক চিঠির শিরোনাম ছিল যথাক্রমে ‘ক্ষমতা দখল করতে হবে বলশেভিকদের' এবং ‘মার্কসবাদ ও অভ্যুত্থান'। এই চিঠিগুলোর মাধ্যমে লেনিন সশস্ত্র অভ্যুত্থানের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।
লেনিন সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা অত্যন্ত সচেতনভাবে গ্রহণ করে। তাঁর পরিকল্পনার ভেতর একদিকে যেমন দেশীয় শক্তি, প্রতিবিপ্লবী শক্তির অবস্থান ছিল, ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক পরিসরে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও বিবেচনায় আনেন। তিনি পার্টির কাছে প্রস্তাব করেন যে, অনতিবিলম্বে অভ্যুত্থানের জন্য বাহিনীগুলোর হেডকোয়ার্টাস গঠন করা হোক, শক্তির বণ্টনের মাধ্যমে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ইউনিটগুলোকে সবচেয়ে জরুরি কেন্দ্রগুলোতে রাখা হোক। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন যে, সরকারি ভবনগুলো পরিবেষ্টন করে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ কেন্দ্র দখল করা জরুরি। তিনি সুপারিশ করেন যে, শক্তিশালী সংগ্রামী বাহিনী গঠন করা, যাদের কাজ হবে পেত্রোগ্রাদ অভিমুখী বাহিনীর গতি রোধ করা ও নগরের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা। লেনিন এভাবেই একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থান সফল করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি পার্টির কাছে দাবি উত্থাপন করেন যে, কমিউনিস্টদের জনগণের সাথে আরো বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে। এজন্য তিনি কমিউনিস্টদের কলকারখানা, ব্যারাক থেকে সর্বত্র থাকার উপদেশ দেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘যেখানেই জীবনের স্নায়ুমণ্ডলি, সেখানেই বিপ্লবকে বাঁচাবার উৎস।'
১৫. পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কর্মসূচি
লেনিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী সশস্ত্র বিপ্লবকে বাস্তবায়নের জন্য লালরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলা হয় । সামরিক শিক্ষকরা পাঠচক্রের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিতে লাগলেন। এটি গঠিত হয়েছিল পেত্রোগ্রাদে । বাল্টিক সাগরের নৌবহরের বলশেভিকরা নাবিকদেরকে বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। ফ্রন্টের বলশেভিক পার্টির অনুগামী সৈনিকরা শ্রমিকদের সাহায্যে লালফৌজের সংগ্রামী বাহিনী গড়ে তোলেন ।
১৬. লেনিনের পুনরায় রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন ও বিপ্লবী কর্মসূচি গ্রহণ
১৯১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের পর লেনিন পেত্রোগ্রাদের কাছাকাছি থাকার জন্য হেলসিংফোর্স থেকে ভিবর্গে চলে আসেন। বলশেভিক পার্টির মুখপত্র হিসেবে বাবোচি পুৎ (শ্রমিক পথ) পত্রিকায় লেনিনের বিভিন্ন প্রবন্ধ এ সময়ে প্রকাশিত হতে থাকে। সেখানে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কীভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা যায়, এর নিপুণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি এসময়ে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেন যে, “সংকটের গভীরতা অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। রুশ বিপ্লবের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাজি ধরা হয়েছে।” তাঁর মতে, অনুকূল মুহূর্তে ছাড় দেওয়ার অর্থ হচ্ছে পুরো ব্যাপারটিকে পশু করে দেওয়া। লেনিন ১৯১৭ সালের ১ অক্টোবর এক পত্রের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটি, মস্কো ও পেত্রোগ্রাদ কমিটির কাছে বিপ্লবের বিষয়ে আশু পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রস্তাব প্রদান করেন।
অক্টোবরের গোড়ার দিকে, লেনিন সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি ও তাঁর নেতৃত্ব প্রদানের জন্য অবৈধভাবে ভিবর্গ থেকে পেত্রোগ্রাদে চলে আসেন। তিনি ৭ অক্টোবর বলশেভিক পার্টির নগর সম্মেলনে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। ৮ অক্টোবর তিনি উত্তরাঞ্চলের সোভিয়েতে অংশগ্রহণকারীদের নিকট এক পত্র লিখেন। সেখানে অভ্যুত্থানের জন্য চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান এবং সতর্কতা উচ্চারণ করেন। যে, 'বিলম্ব মৃত্যুতুল্য'। সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বলশেভিক পার্টির বিজয়ের ব্যাপারে তাঁর আস্থা ছিল ।
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রশ্নে বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় অধিবেশনে ১৯১৭ সালের ১০ অক্টোবর আলোচিত হয়। লেনিন উক্ত অধিবেশনে রিপোর্ট পেশ এবং বক্তৃতা প্রদান করেন। বক্তৃতায় তিনি যুক্তি দেখান যে, প্রলেতারিয়েত ও গরিব কৃষকের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সময় চলে এসেছে। সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য বলশেভিক পার্টি লেনিনের নীতিকে কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রহণ করে। এ সময়ে বলশেভিক পার্টির দুইজন কমরেড ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেন। তারা হলেন-কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ। তবে শেষ পর্যন্ত পার্টি লেনিনের নীতি অনুসরণ এবং কাজের ভিত্তি হিসেবে লেনিনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় কমিটি অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানের জন্য একই অধিবেশনে পলিটব্যুরো নির্বাচন করে। এখানে নেতা হিসেবে লেনিনকে নির্বাচিত করা হয় ।
১৯১৭ সালের ১৬ অক্টোবর শ্রমিক সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত অধিবেশনে লেনিন পুনরায় রিপোর্ট পেশ করেন। সেখানেও তিনি অবিলম্বে অভ্যুত্থানের জন্য আবেদন জানান। উপস্থিত অধিকাংশ সদস্যই লেনিনকে সমর্থন জানান। রুদ্ধদ্বার অধিবেশন বিপ্লবী অভ্যুত্থান পরিচালনার জন্য সামরিক বিপ্লবী কমিটি গঠন করা হয়। যার নেতৃত্বে ছিলেন- আ.স.বুবনভ, ফ.এ.জের্জিনস্কি, ইয়া.ম. সভেদলভ, ই.ভ.স্টালিন, এবং ম.স. উরিৎস্কি ।
অভ্যুত্থান বন্ধ রাখবার জন্য যে সকল যুক্তি বিভিন্নভাবে আসত লেনিন তা দৃঢ়ভাবে খণ্ডন করতেন। তিনি বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে তুলে ধরেন যে, বুর্জোয়া ও সামরিক সরকার বিপ্লবের শক্তিকে ভাঙতে বিভিন্ন চেষ্টা চালাবে। লেনিন অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে পার্টির নেতা-কর্মী ও সামরিক বাহিনীর নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রাখতেন, যাতে আসন্ন লড়াইয়ের প্রস্তুতি যথাযথভাবে গ্রহণ করা যায়।
১৭. দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবের বাণী প্রচার
লেনিন ও বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অভ্যুত্থানের জন্য দেশের সকল প্রান্তে পরিকল্পনা অনুসারে প্রস্তুতি চলতে থাকে। কেন্দ্রীয় কমিটির চিঠিও নির্দেশনামা দলের কমরেডদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। পেত্রোগ্রাদ ও মস্কোর সম্মেলনেও লেনিনের প্রস্তাবের পক্ষেই দলের সদস্যরা ভোট দেন। অক্টোবর বিপ্লবের প্রাক্কালে একই সিদ্ধান্ত দেশের ১০০টি প্রদেশ, জেলা, গুবের্নিয়া, আঞ্চলিক ও সামরিক পার্টি সম্মেলনে গ্রহণ করা হয়। সশস্ত্র অভ্যুত্থানে সহযোগিতার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দল প্রতিটি এলাকায় প্রেরণ করা হয়।
. লেনিনের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও এপ্রিল থিসিস ঘোষণা ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরও লেনিন সুইজারল্যান্ডে নির্বাসিত অবস্থায় ছিলেন। এখান থেকেই তিনি আন্দোলন পরিচালনা করে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর বলশেভিক পার্টির কর্মীদের ভেতর নানা বিষয়ে মতান্তর দেখে লেনিনও রাশিয়ায় ফিরে আসতে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, লেনিনের যুদ্ধ বিরোধী অবস্থান | সকলের কাছেই স্পষ্ট ছিল। তাই ব্রিটিশ ও ফরাসিদের পক্ষ থেকে লেনিন যাতে রাশিয়ায় ফিরে আসতে না পারেন, সেজন্য নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জার্মানি, পোল্যান্ড, সুইডেন এবং ফ্রান্সের বিপ্লবীদের সহযোগিতায় | লেনিন এবং অন্যান্য প্রবাসী বিপ্লবীদের জার্মানির ভেতর দিয়ে রাশিয়ায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জার্মান কর্তৃপক্ষের ধারণা ছিল যে, লেনিন তার পরিকল্পিত সমাজ বিপ্লব শুরু করলে রাশিয়ার সমাজ এক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তখন সেখানে জার্মানি তার অবস্থানকে পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। এই রকম একটি চিন্তাধারা থেকে জার্মান কর্তৃপক্ষ লেনিন ও অন্যান্যদের একটি ঢাকা রেলগাড়িতে করে সুইজারল্যান্ড থেকে রুশ সীমান্তে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকে তিনি পেত্রোগ্রাদ স্টেশনে পৌছালে হাজার হাজার শ্রমিক, সৈনিক ও নাবিকের একটি দল তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক' – এই বলে লেনিন তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন।
১৯১৭ সালের ৪ এপ্রিল বলশেভিকদের এক সভায় লেনিন তাঁর সুবিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস' ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়েই মূলত তিনি তৎকালীন বলশেভিক পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান ও পরবর্তীতে করণীয় নিয়ে বিশদভাবে তুলে ধরেন। লেনিন দেখান যে, বিপ্লবের প্রথম ধাপে সর্বহারাদের সংগঠন থাকে দুর্বল অবস্থায় এবং শ্রেণি সচেতনতার অভাবের জন্য বুর্জোয়াদের হাতে ক্ষমতা চলে গেছে। কিন্তু বিপ্লবের চাপে নিশ্চয়ই সর্বহারা এবং গরিব কৃষকদের হাতে ক্ষমতা আসবে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, সামরিক সরকারকে সমর্থন করা যাবে না এবং একথাও মনে রাখতে হবে যে এখনও এই সরকারের উপর জনসাধারণের গভীর আস্থা রয়েছে। আর শ্রমিক কৃষকদের নির্বাচিত সোভিয়েতগুলো এই সরকারকে সমর্থন করে যাচ্ছে। এই অবস্থায় জনসাধারণের মধ্যে বলশেভিকদের সুসংগঠিতভাবে এবং ধৈর্যের সাথে ব্যাপকভাবে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যেতে হবে। সরকারও সোভিয়েতগুলোর ভুলভ্রান্তিগুলোকে সমালোচনা করে জনসাধারণের সামনে তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বোঝাতে হবে যে, সোভিয়েতগুলোর হাতে সমস্ত ক্ষমতা না আসা পর্যন্ত বিপ্লবী শাসন কায়েম করা যাবে না।
লেনিন আরও উল্লেখ করেন যে, ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জনসাধারণের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে বটে— জনগণ আজ সশস্ত্র— এই অবস্থার শান্তিপূর্ণভাবে বিপ্লব সফল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই অর্থ এই যে, বুর্জোয়া শ্রেণি চরিত্র বদলে গেছে অথবা সে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চায় তা নয়; বরং এর অর্থ হচ্ছে, বিপ্লবী
জনতার শক্তি এত বেশি যে, তাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা সামরিক সরকারের নেই। বুর্জোয়াদের সামরিক সরকার সোভিয়েত নেতাদের (যারা বেশির ভাগই ছিল
মেনশেভিক এবং সোশ্যালিস্ট রেভ্যুলিউশনারি) সঙ্গে যোগসাজশ করে তাদের সহযোগিতা নিয়েই দেশ শাসন করছে। অতএব, বিপ্লবীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে সোভিয়েতগুলোকে ঐ সকল ভণ্ড নেতাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করে সোভিয়েতগুলোর
হাতে সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে আসার চেষ্টা করা ।
শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিলোপসাধন করা, জমিদারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং দেশের সকল জমি জাতীয়করণ করা, সকল ব্যাংককে একত্রিত করে সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ন্যাশনাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব ছিল। উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে শ্রমিক সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য লেনিন তাঁর সুবিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিসের মধ্য দিয়ে দাবি জানান ৷

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]