১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লবের প্রকৃতি ও ফলাফল

যে কোনো দেশে বিপ্লব হলে এর মূল লক্ষ্য থাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা। এই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়েই দেশে আপন মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যায়। এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়ারা রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী হয়। এদের সাহায্যে এগিয়ে আসে সোশ্যালিস্ট রেভ্যুলিউশনারী ও মেনশেভিক পার্টি। এমনকি এ সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এই সামরিক সরকারকে সমর্থন করে। এ বিপ্লবে যুদ্ধের অবসান, কৃষকের মাঝে ভূমি বণ্টন, আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ, দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও নিপীড়ন থেকে সকল মানুষের মুক্তি ঘটে।
সুতরাং প্রকৃতিগত দিক থেকে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। এ বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলে। রাশিয়া থেকে সামন্তবাদের অবশেষ ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উৎখাত করা হয়। ভূসম্পত্তি ও শিল্প কলকারখানা ও পুঁজি রাষ্ট্রীয়করণ তথা জাতীয়করণ করা হয়। অর্থাৎ উৎপাদনের উপায় ও উপকরণ জাতীয়করণ করা হয়। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তবে এরপর প্রতিবিপ্লবী বিদ্রোহ দমন করে এবং বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করে
বলশেভিক পার্টিকে তাদের গৃহীত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হয়। এই বিপ্লবে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। যার পুরো কৃতিত্ব ছিল শ্রমিক শ্রেণির। মূলত তাদের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাশিয়ান বুর্জোয়া শাসনের সমাপ্তি ঘটে। এই বিপ্লবে সারা দুনিয়ায় সমাজতন্ত্র বাঁধভাঙা জোয়ারের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে।
১. ব্রেস্ট লিটভস্কের সন্ধি
লেনিন বিশ্বাস করতেন যে, অক্টোবর বিপ্লবকে যদি সমাজতান্ত্রিক রূপ দিতে হয়, তাহলে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। এটি বাস্তবায়নের তিনি তাঁর সহকারী লিও ট্রটস্কিকে দায়িত্ব প্রদান করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় জার্মানির কাইজারের সঙ্গে ব্রেস্টলিটভস্কের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে রাশিয়াকে অনেক বেশি ছাড় দিতে হয়। এই কঠিন চুক্তির শর্তাবলির আওতায় রাশিয়াকে পোল্যান্ড, তিন বাল্টিক রাজ্য, ফিনল্যান্ড, বাইলো রাশিয়া, ইউক্রেন এবং ট্রান্সককেশিয়ার একাংশ হতে তাঁর রাষ্ট্রীয় দাবি পরিত্যাগ করতে হয়। রাশিয়াকে অনেক আর্থিক ক্ষতিপূরণের মুখোমুখি হতে হয়। সর্বোপরি, এই সন্ধির আওতায় রাশিয়াকে তার ইউরোপীয় অংশের চার ভাগের এক ভাগ অংশ এবং রুশ কয়লা ও লৌহ সম্পদের চার ভাগের ৩ ভাগ অংশের উপর থেকে দাবি ত্যাগ করতে হয়। এত ধরনের ছাড় দেওয়া সত্ত্বেও জার্মানির সাথে সন্ধির ফলে রাশিয়ায় বলশেভিক পার্টি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কারণ এ চুক্তির মাধ্যমে বলশেভিক সরকার একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শান্তিস্থাপনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মূলত এটি ছিল লেনিনের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে একটি Turning point.
২. পুরাতন শাসনব্যবস্থার ধ্বংস ও নতুন শাসন কাঠামোর সূচনা
অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক সাফল্যের মধ্য দিয়ে পুরানো প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- ক. ডুমা বা সংবিধান সভাকে বাতিল করা হয়। প্রজাতন্ত্রী সরকারের অনেক সদস্যকে নির্বাসিত করা হয়। খ. মস্কো ও পেত্রোগ্রাদের মিউনিসিপ্যালিটিগুলো বিপ্লবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তা ভেঙে দেওয়া হয়। গ. জার শাসনামলে গঠিত সিনেট ভেঙে দেওয়া হয়। ঘ. জেমেস্টভো বা জেলা পরিষদগুলো জার শাসনের সমর্থক হওয়ায় তা ভেঙে দেওয়া হয়। ঙ. সেনা অফিসার নিয়োগের মানদণ্ড হিসেবে বিচার্য হয়ে দাঁড়ায় যারা বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন তাদেরকে অফিসার পদে নিয়োগ দেওয়া। চ. সেনাদলের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পুরানো অনেক নিয়মের রদবদল করা হয়। শুধু তাই-ই নয়, শীর্ষ পদগুলোতে বলশেভিকদের প্রতি বিশ্বস্তদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে এক নয়া ধারার সূচনা হয় ।
৩. ধর্মীয় সংস্কার
বলশেভিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ধর্মক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার করা হয়। এর ফলে রাশিয়ার জাতীয় গির্জাকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করা হয়। গির্জার অন্তর্ভুক্ত ভূ-সম্পত্তি রাষ্ট্রের অধিকার নিয়ে নেয়। এমনকি রাশিয়ান নাগরিকের বিবাহ দান ও বিবাহবিচ্ছেদের সকল অধিকার গির্জার হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। এর পরিবর্তে রাষ্ট্রকে এই ক্ষমতার অধিকার দেওয়া হয়। ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এটা এ আন্দোলনের একটি বিরাট সাফল্য।
৪. সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আশু ফল ছিল রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। তবে ১৯১৮-২১ সাল পর্যন্ত পুরোপুরি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। কারণ এ সময় প্রথম মহাযুদ্ধ চলছিল। তাই এই সময়ের গৃহীত নীতিকে ‘যুদ্ধকালীন জরুরি সমাজতন্ত্র' নামে অভিহিত করা হয়। বিপ্লবের পরে একমাত্র লেনিন ও তাঁর কয়েকজন কাছের সঙ্গী ছাড়া বাকি কারো রাষ্ট্র পরিচালনা কিংবা আমলাতন্ত্র সম্পর্কে কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই লেনিন একেবারে হঠাৎ সবকিছু পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন না। বাস্তবতাকে বিবেচনা করে লেনিন সিদ্ধান্ত নেন যে, দেশের সকল শিল্পকারখানা এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও কৃষি খামারগুলোকে রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করবে। আর তা বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ আইনও প্রণয়ন করেন। এতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫. শ্বেতসন্ত্রাস ও প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ড
বলশেভিকরা নভেম্বর মাসে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করলেও প্রতিবিপ্লবীরা তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেননি। সামরিক সরকারের অন্যতম নেতা কেরেনেস্কি ও তাঁর সমর্থকগণ বলশেভিকদের উৎখাত করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে তাঁদেরকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলো। কারণ তাদের ধারণা ছিল, সমাজতন্ত্রের এই প্রবহমাণ ধারা 'Dom-inno Effect' -এর মতো তাঁদের দেশে গিয়ে পড়তে পারে। তাই তারা প্রতিবিপ্লবীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। মূলত জার আমলের সেনাপতি যেমন- ডেনিকিন, কোলচাক, য়ুডেনিখ প্রমুখ প্রতিবিপ্লবী সরকারের পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
৬. প্রতিবিপ্লবীদের দমন
লেনিনের নেতৃত্ব এবং তাঁর দুই সহকর্মী ট্রটস্কি ও স্টালিনের দক্ষতায় বলশেভিক সরকার রাশিয়ায় টিকে যায়। কারণ স্টালিন প্রতিবিপ্লবীদের দমন করতে চেকা নামক এক গোপন পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলেন। এর সাহায্যে তিনি প্রতিবিপ্লবী ও কুলাখ বিদ্রোহীদের ধ্বংস করতে সমর্থ হন। বস্তুত স্টালিন শ্বেতসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লাল সন্ত্রাস চালান। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, উভয় পক্ষের এই লড়াইয়ের ফলে প্রায়
3 মিলিয়ন লোক নিহত হয়। ২ মিলিয়ন লোক দেশ ছেড়ে চলে যান। এমনকি দুই পক্ষের হাতেই সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অনেক নিরীহ লোক মারা যান। এমতাবস্থায় বিদেশি শক্তির ধারণা ছিল যে, দেশের এরকম একটি সঙ্গীন অবস্থায় রাশিয়ার জনগণ তাদেরকে স্বাগত জানাবে। কিন্তু দেশপ্রেমিক রুশদের বিরোধিতার মুখে বিদেশি অন্যরা ফেরত যায়। অন্যদিকে, ১৯১১ সালে প্রতিবিপ্লবী সেনারা পেত্রোগ্রাদের কাছাকাছি চলে আসে। কিন্তু লালফৌজের চরম প্রতিরোধ ও জনসমর্থনের অভাবে তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কারণ দরিদ্র ও শ্রমিকরা বলশেভিকদের কাছ থেকে নয়া কিছু পাবার স্বপ্ন দেখছিল। শেষ পর্যন্ত প্রতিবিপ্লবীরা সাধারণ মানুষের সমর্থনের অভাবে পিছু হটতে বাধ্য হন। এর মধ্য দিয়ে বলশেভিকরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেন। বিপ্লবী রুশ সরকার প্রতিবিপ্লবীদের অত্যন্ত নিষ্ঠুর শাস্তি প্রদান করে। এভাবে প্রতিবিপ্লবীদের দমন করা হয় ।
৭. পোল যুদ্ধের সূত্রপাত
রুশ বিপ্লবের অব্যবহিত পরে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হলেও পোল্যান্ডের সাথে তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এর পেছনে কারণ ছিল পোল্যান্ড দীর্ঘদিন ধরে রুশদের দ্বারা নিপীড়িত ছিল। সুতরাং এরকম একটি টালমাতাল অবস্থায় তারা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সুবর্ণ সুযোগ বলে মনে করে। এ সময় তাদের লড়াইয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় রাশিয়ার শস্যাগার বলে খ্যাত ইউক্রেনের বৃহৎ অংশ দখলে নিয়ে আসা। ইউক্রেনের অধিবাসীরা রুশ জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তাদের মাঝে স্বাতন্ত্র্যের বীজ বপন করা হয়। পোলরা প্রতিবিপ্লবী জেনারেল র‍্যাঙ্গেলের (Wrangle) সামরিক সহযোগিতার ফলে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। তাঁদের সহযোগিতায় ফরাসি সরকারও এগিয়ে আসেন। এভাবে পোল যুদ্ধের পথ তৈরি হয়। ৮. রুশ সীমান্তে কার্জন লাইন গঠন ও প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা পোল্যান্ডের সাথে যুদ্ধে রাশিয়ার লালফৌজ অত্যন্ত সফলতা দেখায়। এক্ষেত্রে জেনারেল তুখাচেভস্কি অসাধারণ রণকৌশলের কাছে পোলিশরা পরাভূত হয় এবং লালফৌজ পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ এর কাছাকাছি চলে আসে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এর মধ্য দিয়ে পোলদের নতি স্বীকারে বাধ্য করা। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের মিত্র শক্তি পোল্যান্ডের অখণ্ডতা রক্ষার্থে এগিয়ে আসেন এবং কার্জন লাইন বরাবর যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দেন। রুশ কর্তৃপক্ষ তা মেনে নিতে বাধ্য হন। রুশ-পোল যুদ্ধের অবসান রিগার সন্ধি দ্বারা হয় । এর ফলে ইউক্রেনের বেশ কিছু অংশ পোল্যান্ডের অধীনে চলে আসে। এ সময় রুশ বিপ্লবী সরকার রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁর সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো যেমন- পারস্য, বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ, রুমানিয়া ও তুরস্কের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এতে একটি স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
৯. বিপ্লবী সরকারের সংবিধান প্রণয়ন
দেশের অভ্যন্তরীণ শাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য লেনিন ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে সংবিধান সভা গঠন করার লক্ষ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। নির্বাচনে মোট ৪২ মিলিয়ন ভোট পায় মধ্যপন্থি বিপ্লবীরা। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনমত সুস্পষ্টভাবে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ সংবিধানের আলোকে দেশকে একটি মধ্যপন্থি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ সংবিধান সভার কার্যক্রম ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই লেনিনের নির্দেশে তা ভেঙে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, লেনিন ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে একমাত্র বলশেভিকদের দ্বারা সোভিয়েত শাসনের আদেশ জারি করেন। যদিও তিনি পুরো বিষয়টিকে সাময়িক বলে উল্লেখ করেছিলেন। পাশাপাশি স্থায়ী সংবিধান পরে প্রণীত হবে বলে ঘোষণা করেন। ১৯১৮ সালের সংবিধান ১৯২৪ সালে বাতিল করে রাশিয়ার জন্য স্থায়ী সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। এই সংবিধানের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল-
ক. রাশিয়াকে সংযুক্ত সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র (United Soviet Socialist
Republic or U.S.S.R) বলে ঘোষণা করা। সেই আলোকে এর অঙ্গরাজ্যগুলো ছিল- ইউক্রেন, শ্বেত রাশিয়া, ট্রান্সককেশিয়া, তুর্কমেন, উজবেক ও তাজিক । ১৯৩৬ সাল নাগাদ এর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ তে ।
খ. দেশের প্রশাসনিক ক্ষমতা চারটি সংস্থার মাঝে বিভাজিত করা হয়। সেগুলো হলো— (১) সোভিয়েতগুলো, (২) সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি, (৩) গোপন পুলিশ বাহিনী ও (৪) সেনাবাহিনী
গ. দেশের শাসন ক্ষমতা সোভিয়েতগুলোর হাতে প্রদান করা হয় । এরা সরকার ও জনসাধারণের মাঝে সেতুবন্ধনের মতো কাজ করবে বলে সংবিধানে মত প্রকাশ করা হয় ।
১০. সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা বৃদ্ধি
রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করায় পার্টির একচ্ছত্র ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পার্টিকে সোভিয়েত গঠনের অনুসরণে গড়ে তোলা হয়। এর মধ্য দিয়ে গ্রাম থেকে একেবারে সরকারের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাই প্রতিনিধিত্ব করতেন। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ৩,০০০ এবং এরাই দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী প্ল্যাটফরম পলিটব্যুরোর সদস্যদের নির্বাচিত করতেন। বস্তুত এরাই ছিলেন রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতার মালিক। অধিকাংশ সময়ই লক্ষ করা গিয়েছে যে, সোভিয়েতগুলোর সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রেসিডিয়াম এবং পলিটব্যুরোর সদস্যরা একই ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৩৬ সালে সংবিধানকে সংশোধন করে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের বদলে প্রলেতারিয়েত একনায়কতান্ত্রিক দেশ বলে ঘোষণা করা হয়। সোভিয়েত পার্টির ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি পায় ।
১১. লেনিনের একচ্ছত্র ক্ষমতা বৃদ্ধি
রাশিয়ার সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হওয়ায় সেখানে একনায়কতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েতের হাতে সকল ক্ষমতা দেওয়া হয় বটে, কিন্তু সুপ্রিম সোভিয়েত সদস্যরা ৩০০ জন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সমিতির সদস্যদের নির্বাচিত করতেন। তারা আবার ১০ সদস্যের প্রেসিডিয়াম মন্ত্রিসভা গঠন করতেন। এই মন্ত্রিসভা বা কাউন্সিল অব পিপলস কমিশনার প্রত্যক্ষভাবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন। এই মন্ত্রিসভার প্রধান হিসেবে এককভাবে ক্ষমতা লাভ করেন লেনিন। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত একই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
১২. দেশে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের ফলে বিশুদ্ধবাদী বা উগ্র মার্কসবাদীরা রাশিয়ার সকল প্রকার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এর ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। কারণ, পুরো বিষয়টির সাথে শ্রেণিগত চৈতন্যও জড়িত। যেমন- কৃষকরা চাইতেন যে তাদের উদ্বৃত্ত ফসল বাজারে উচ্চদরে বিক্রি করে তারা জীবনে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনবেন। কিন্তু বলশেভিক সরকার লক্ষ করলেন যে, এর ফলে শহরে বসবাসরত মধ্যবিত্ত শ্রমিক শ্রেণির উক্ত ফসল ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। এজন্য সরকার আইন করেন যে, উদ্বৃত্ত সকল ফসলের বিক্রিত নগদ টাকা কর হিসেবে দিতে হবে। এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের উপর নিপীড়ন করা হয় এবং জোর করে বাড়তি ফসলের টাকা আদায়ের চেষ্টা করা হয়। এরকম জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে কৃষক উৎপাদন কমিয়ে দেয়। তার নিজের জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন ছাড়া বাকি ভূমি অনাবাদি রাখেন। ফলে ১৯২০-২১ সাল নাগাদ রাশিয়ায় ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দেয় । উপরন্তু ১৯২০ সাল ভলগা ও ডন উপত্যকায় অনাবৃষ্টি ঘটে। এর ফলে শস্যহানি ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ অবস্থায় প্রখ্যাত লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে গম পাঠাবার জন্য আবেদন করলে মার্কিন সরকার তাতে সাড়া দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো গম দিয়ে পরিস্থিতির আপাতত সমাধান করা হয়। লেনিন অনুধাবন করেন যে দেশের ভূমি নীতির সংস্কার প্রয়োজন। কারণ এরই মধ্যে ১৯১৩ সালের চেয়ে ১৯২০ সালে নাগাদ খাদ্য উৎপাদন ব্যয় ৫০ ভাগ নিচে নেমে গিয়েছিল। কলকারখানাগুলো ব্যাপকভাবে অধিগ্রহণের ফলে তার কুফলও দেখা যাচ্ছিল। পরিবহণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি এক মহাসংকটের মুখোমুখি হয় যা ছিল রুশ বিপ্লবের আশু ফলাফল ।
১৩. নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যখন পুরোপুরি পর্যদুস্ত তখন এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে পার্টির ভেতরে থাকা কট্টরপন্থি মার্কসবাদীদের অগ্রাহ্য করে লেনিন তাঁর বিখ্যাত ‘নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা' নঅব্য ঘোষণা করেন। এই নীতি প্রাগমেটিক সাম্যবাদ বা প্রয়োজনভিত্তিক সাম্যবাদ নামেও অভিহিত করা হয়। এর মানে দাঁড়ায় যে,
রাশিয়া তার প্রয়োজন অনুসারে সাম্যবাদী নীতি প্রয়োগ করবে। এই নীতির আলোকে হুবহু মার্কসবাদকে অনুসরণের নীতি অগ্রাহ্য করে একটি সমন্বয়বাদী নীতি গ্রহণ করা হয়।
এই নীতি ১৯২১-২৪ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল-
ক. বাধ্যতামূলকভাবে কৃষকের কাছ থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহের নীতি বন্ধ করা
হয়। এর পরিবর্তে কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
খ. গরিব কৃষকদের কর মওকুফ করে মধ্য ও ধনী শ্রেণির কৃষকের উপর বেশি
কর আরোপ করা হয়।
গ. কৃষকদের খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়।
ঘ. ক্ষুদ্র জমির মালিক ও ব্যবসায়ীদের সম্পত্তি ফেরত দেওয়া হয়।
ঙ. শিল্প কলকারখানার উপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের আইন শিথিল করা হয়। চ. শিল্প কলকারখানার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত ছিল। যদিও কার্যক্ষেত্রে প্রায় ৯০% কলকারখানাকে বেসরকারীকরণ করা হয়েছিল। ছ. বিদেশি মূলধন এনে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নীতি গ্রহণ করা হয়। জ. বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঝ. চাকরিজীবী শ্রমিকদের বেতনের ব্যবস্থা করা হয়।
এর মধ্য দিয়ে লেনিন সমাজতন্ত্র থেকে খানিকটা পিছু হটেছিলেন বটে কিন্তু বলশেভিকদের শাসনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
১৪. বলশেভিক সরকারের স্বীকৃতি লাভ
লেনিনের সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল নিঃসন্দেহে বলশেভিক বিপ্লব। কিন্তু এর যে বৈশ্বিক পরিসরে স্বীকৃতির প্রয়োজন ছিল তাও অর্জন করতে সমর্থ হন। বিশেষ করে তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিকেরিনের কূটনীতির ফলে ইংল্যান্ড সর্বপ্রথম ১৯২৪ সালে বলশেভিক সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর একে একে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ফ্রান্স, ইতালি ও অন্যান্য দেশ স্বীকৃতি প্রদান করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য অনেক পরে রুশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় ।
১৫. বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন
রুশ বিপ্লবের ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে ইতিহাসে এক নয়া বাঁক বদলের সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এরপর থেকে কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হতে থাকে। নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ রাশিয়ার অনুকরণে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালে চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়। পাশাপাশি সমগ্ৰ বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয় ও স্নায়ুযুদ্ধের প্রাথমিক সূত্রপাত রুশ বিপ্লবের পর পরই শুরু হয়েছিল একথা বলা যেতে পারে যা পরবর্তীতে পুরো বিশ শতক জুড়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এভাবে বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে ।
রুশ বিপ্লবের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, উদ্দেশ্য ছিল একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এর প্রচণ্ড তরঙ্গাঘাত বিশ্বের এই বিপ্লব ছিল পৃথিবীর নির্যাতিত-নিপীড়িত-মেহনতি মানুষের প্রথম বিপ্লব। যার পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। রুশ বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় পূর্ব ইউরোপ ও চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এমনকি পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক প্রভাবাধীন এলাকায় পরিণত হয়েছিল। তবে রুশ বিপ্লবের | সবচেয়ে বড় সুফল ছিল এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে নির্যাতিত-নিপীড়িত শ্রেণি রাষ্ট্র
মমতায় অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়। নিপীড়িত মানুষের চোখে এক নয়া পৃথিবী গড়ে
| তোলার স্বপ্নে উদ্ভাসিত হয়। বিশ শতকের ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী লড়াই, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে ‘রুশ বিপ্লব' মানুষের কাছে বিপ্লবের এপিটাফে পরিণত হয়। এখানেই রুশ বিপ্লবের কৃতিত্ব ও সাফল্য নিহিত ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]