১৯১৭ সালের মহান অক্টোবর (বলশেভিক) বিপ্লবে লেনিনের ভূমিকা নিরূপণ কর । তাঁকে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার নির্মাতা বলা হয় কেন?

> মার্চ বিপ্লবের ফলে জারতন্ত্রের অবসান ঘটলেও ‘প্রলেতারিয়েত' অর্থাৎ সাধারণ সম্প্রদায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘটিত হয় নভেম্বর বিপ্লব। প্রথম দিকে সামরিক সরকার জনসমর্থন লাভ করেছিল। মেনশেভিকদের তথাকথিত সাম্যবাদী নীতি শ্রমিকদের আর সোশ্যাল রেভলিউশনারিদের ভূমির সমবণ্টন নীতি কৃষকদের আকৃষ্ট করেছিল। এই সামরিক সরকারের কাছে রুশ জনগণের পক্ষে লেনিনের স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল- (১) যুদ্ধের অবসান, (২) কৃষকদের মধ্যে ভূমি বণ্টন, (৩) আট ঘণ্টা কাজের সময়সীমা নির্ধারণ, (৪) দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক থেকে সংকট মুক্তি এবং (৫) জাতীয় অত্যাচার ও উৎপীড়নের অবসান।
১. লেনিনের এপ্রিল থিসিস
কিন্তু বুর্জোয়া স্বার্থরক্ষী সামরিক সরকার জনগণের সেই আদি প্রত্যাশা পূর্ণ করতে ব্যর্থ হলো। জনবিরোধী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হলো। এই সময় সুইজারল্যান্ডে নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন বলশেভিক দলের নেতা লেনিন (এপ্রিল ১৯১৭)। লেনিন তাঁর পরিকল্পিত সমাজ বিপ্লব শুরু করলে রাশিয়া বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এই আশায়
জার্মান কর্তৃপক্ষ লেনিন ও অন্যান্যদের একটি ঢাকা রেলগাড়িতে সুইজারল্যান্ড থেকে রুশ সীমান্তে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে। পেত্রোগ্রাদ পৌঁছে তিনি বলশেভিকদের কাছে ঘোষণা করলেন তাঁর বিখ্যাত 'এপ্রিল থিসিস'। এর উপরে ভিত্তি করে কমিউনিস্ট পার্টির নিখিল রুশ সম্মেলনে সামজ বিপ্লবে উত্তরণের একটি কর্মসূচি রচিত হলো। এর প্রধান নীতি ছিল : সোভিয়েতগুলোকে সমস্ত ক্ষমতা দিতে হবে। এই ক্ষমতার হস্তান্তর হবে শান্তিপূর্ণভাবে। ক্ষমতালাভ করেই সোভিয়েতগুলোর কর্মসূচি হবে : রাষ্ট্রগুলোর কাছে গণতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে শান্তিস্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া; উৎপাদন, বণ্টন ও ব্যাংকগুলোর উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ স্থাপন; গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের জাতীয়করণ: শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের সময়সীমা নির্ধারণ; জোতদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন; জাতিবিদ্বেষ প্রসূত সুযোগ বা বাধাগুলোর অপসারণ ইত্যাদি। লেনিন বলেছিলেন যে, বুর্জোয়া শাসনের অনিবার্য সংকটের জন্য অপেক্ষা না করে বুর্জোয়া বিপ্লবের সঙ্গেই শ্রমিক বিপ্লব ঘটাতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত শ্রমিকরাই জয়ী হবে অর্থাৎ ধনতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ধাপ বাদ দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও সাধারণ সম্প্রদায়ের (প্রলেতারিয়েত) একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ এসেছে। সুতরাং বলশেভিকদের ক্ষমতা দখল করতেই হবে। তিনি এই আসন্ন বিপ্লবে রুশ সৈন্যবাহিনী ও শ্রমিকদের শামিল হওয়ার জন্য আহ্বান জানান ।
২. এপ্রিল থিসিসের বিষয়বস্তু এপ্রিল থিসিসে লেনিন বলেন যে,
ক. ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিপ্লবের প্রথম স্তর প্রলেতারিয়েতের (সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণি) শ্রেণিচেতনা ও সংগঠন যথেষ্ট না থাকায় দেশের ক্ষমতা বুর্জোয়াদের হাতে পড়েছে, বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তরে গরিব কৃষকের সঙ্গে মৈত্রীবদ্ধ প্রলেতারিয়েত রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে। এ স্তরে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব অবশ্যম্ভাবীরূপে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণত হবে। খ. তিনি উল্লেখ করেন যে, সংসদীয় ধরনের প্রজাতন্ত্র মানি না । .... শ্রমিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত থেকে পার্লামেন্টারি বা সংসদীয় প্রজাতন্ত্রে ফিরে যাওয়া পশ্চাৎগামী পদক্ষেপ হবে। সংসদীয় অস্থায়ী সরকার থেকে সোভিয়েত কর্তৃক ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হবে। তাই পার্টি অস্থায়ী সরকারকে বিশ্বাস বা সমর্থন করতে পারে না । গ. তাঁর মতে, সামরিক সরকারের পক্ষে জনগণকে শান্তি, খাদ্য, ভূমি কিংবা মুক্তি দেওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র শ্রমিক ও সৈনিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত ক্ষমতায় আসলে যুদ্ধ বন্ধ হবে। কৃষক ভূমি পাবে এবং জাতিগত নিপীড়ন লোপ পাবে। এজন্য সারা দেশে সর্বোচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত শ্রমিক, কৃষক ও খেতমজুরদের সম্মিলিত সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র গড়তে হবে। এসব অর্জনের জন্য 'সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতা চাই' বলে লেনিন স্লোগান তোলেন ।
লেনিনের মতে, সামরিক সরকারের উপর জনগণের যথেষ্ট আস্থা থাকায় সোভিয়েতগুলো এ সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং বলশেভিক প্রতিনিধিরা সোভিয়েতগুলোতে সংখ্যালঘু হওয়ায় এ মুহূর্তে অস্থায়ী বুর্জোয়া সরকারকে উচ্ছেদ করা যাবে না। ... সুতরাং যতদিন এ সরকারের উপর বুর্জোয়াদের প্রভাব থাকবে ততদিন বলশেভিকরা ধৈর্য সহকারে অবিচল
• চিত্তে সুস্পষ্টভাবে অস্থায়ী সরকারের কর্মকৌশলের ভুলভ্রান্তিগুলো সমালোচনার মাধ্যমে জনগণকে তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝিয়ে দিবে যে, সোভিয়েতগুলোর হাতে সমগ্র রাষ্ট্রক্ষমতা না আসলে জনগণের বিপ্লবী শাসন কায়েম করা যাবে না।
সোভিয়েতগুলোর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা আসলে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বন্ধ করে সার্বজনীন গণতন্ত্রসম্মত শান্তিচুক্তি সম্পাদন করা হবে। এ যুদ্ধে রুশ জনগণ বর্তমান বুর্জোয়া সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে না।
চ. ভবিষ্যতে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে তিনি বলেন যে, রাশিয়ার সকল ব্যাংক জাতীয়করণ করাসহ একটি জাতীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে, সকল বড় বড় একচেটিয়া শিল্প কারখানাগুলোর জাতীয়করণসহ উৎপাদন ও উৎপন্ন পণ্যের বণ্টনের উপর সোভিয়েতগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হবে । ছ. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে সকল ভূমি জাতীয়করণ করে
কৃষকদের মধ্যে ভূমি বিতরণ করা হবে।
জ. লেনিন বলেন যে, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকারসহ রাশিয়ায় বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসমূহের পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার স্বীকার করা হবে এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে কোনো বৈষম্য করা হবে না। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বার্থে সমগ্র জাতির শ্রমিকদের মধ্যে একক রাজনৈতিক পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন, সমবায় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক ।
এপ্রিল থিসিসে লেনিন শান্তিপূর্ণভাবে সোভিয়েতগুলোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেছিলেন।
এপ্রিল থিসিসে অবিলম্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি ছিল না। তবে এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে সমাজতন্ত্রের দিকে একটা পদক্ষেপ হতো ।
লেনিন যখন রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির (RSDLP বা আর এস ডি এল পি) যৌথ সভায় এপ্রিল থিসিস উত্থাপন করেন তখন মেনশেভিকরা তাঁকে টিটকারী করে। বরিস বগদানভ নামে জনৈক মেনশেভিক নেতা এপ্রিল থিসিসকে 'পাগলের প্রলাপ' (The ravings of a madman) বলে আখ্যায়িত করে। বলশেভিকদের মধ্যে দুই একজন এর বিরোধিতা করেছিল। এরা সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থাভাজন ছিল না। বলশেভিকদের মধ্যে সর্বপ্রথম একমাত্র কলোনতাই (Kollontai ) এপ্রিল থিসিস সমর্থন করে। ১৯১৭ সালে ২৪ এপ্রিল সারা রাশিয়ার বলশেভিক পার্টির সপ্তম সম্মেলনে ব্যাপক আলোচনার পর লেনিনের এপ্রিল থিসিস অনুমোদন করা হয়। এ সম্মেলনের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সমগ্র পার্টি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়। পার্টি এ কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে হাজির হয়।
৩. এপ্রিল থিসিসের গুরুত্ব
বলশেভিকরা এপ্রিল থিসিসের কর্মসূচি জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচারে নেমে পড়ে। তারা শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকদের সম্মুখে পার্টির কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। এ সময় বলশেভিক পার্টি অস্থায়ী বুর্জোয়া সরকারের জনবিরোধী চেহারা জনগণের সামনে উন্মোচন করে। আর এস এল পি-এর সদস্য হিসেবে সোভিয়েতগুলোকে বলশেভিকদের পাশাপাশি মেনশেভিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদেরও প্রতিনিধি ছিল। বরং ১৯১৭-এর জুনের প্রথম ভাগ পর্যন্ত সোভিয়েতগুলোতে মেনশেভিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের প্রভাব বেশি ছিল। লেনিনের এপ্রিল থিসিসের পর বলশেভিকদের জনসংযোগমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে শ্রমিক ও সৈনিকদের সোভিয়েতগুলোতে বলশেভিক তথা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। নানা কারণে অস্থায়ী সরকারের জনসমর্থন হারাতে থাকে। কারণগুলো হলো— (১) অস্থায়ী সরকার সৈন্যবাহিনী ও সর্বসাধারণের দাবি অগ্রাহ্য করে যতদিন না রুশ—ভূমি শত্রু জার্মানদের হাত থেকে উদ্ধার হয় ততদিন যুদ্ধ চালিয় যাবার সংকল্প নেয়। যুদ্ধের দরুন দেশবাসীর দুঃখ-দুর্দশাকে সরকার আমল দেয়নি। এতে তাদের জনসমর্থন নষ্ট হয়। (২) কৃষকরা জমিদারি উচ্ছেদ করে ভূমি বণ্টনের দাবি জানালে সামরিক বুর্জোয়া সরকার এ বিষয়ে গড়িমসি করে এবং বলে যে, যুদ্ধে জয়ী হলে সাধারণ নির্বাচনের পর এ বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। (৩) শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের সময় ধার্য করে আইন প্রণয়ন ও ন্যায্য মজুরি দাবি করলে অস্থায়ী সরকার যুদ্ধের শেষে এ দাবি পূরণ করা হবে বলে ঘোষণা করে। শ্রমিক ও কৃষক সরকারের এ বিলম্বিত প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করেনি। আবার সেনাদল এই হেরে যাওয়া যুদ্ধ অনর্থক চালাতে চায়নি। তারা শান্তিস্থাপনের জন্য ব্যাকুল ছিল। অস্থায়ী সরকার এ দাবির উল্টো দিকে চলার নীতি নিয়ে সাধারণ সৈনিকদের সমর্থন হারায়। উল্লেখ্য, বলশেভিক পার্টি পূর্বেই এ সকল বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে। এসব কারণে অস্থায়ী সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় আর বলশেভিকদের প্রভাব বৃদ্ধি পায় ৷
১৯১৭ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত সারা রুশ সোভিয়েত কংগ্রেসে বলশেভিকরা ‘সোভিয়েতের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা চাই' এবং 'যুদ্ধ বন্ধ করো' দাবি জানালে কংগ্রেস তা গ্রহণ না করে সামরিক সরকারের যুদ্ধ চালিয়ে যাবার দাবি সমর্থন করে।
অস্থায়ী বুর্জোয়া সরকার ক্রমান্বয়ে বলশেভিকদের প্রভাবে ভীত হয়ে পড়তে থাকে। সরকার বলশেভিক পার্টি ও লেনিনের বিরুদ্ধে হিংস্র প্রচারণা শুরু করে এবং পাশাপাশি জার্মানির বিরুদ্ধে ১৯১৭ সালের ১৮ জুন দক্ষিণ রাশিয়ার এ অভিযান ব্যর্থ হয় এবং প্রায় ৬০,০০০ সাধারণ সৈনিক এতে হতাহত হয়। এর ফলে এ সরকারের প্রতি সকলের আস্থা নষ্ট হয়। তবে সরকার এ ব্যর্থতার দায় লেনিন ও বলশেভিকদের কাঁধে চাপাতে চায়। তারা বলে যে, বলশেভিকরা যুদ্ধ বিরোধিতা করে সৈনিকদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে। এ প্রচারণা লোকে বিশ্বাস করেনি।
৪. শান্তি রুটি ও জমির স্লোগান
লেনিন আরো বলেন যে, বলশেভিকদের নেতৃত্বে সোভিয়েতগুলো ক্ষমতা লাভ করলে রণক্লান্ত সৈনিকরা পাবে শান্তি অর্থাৎ যুদ্ধের অবসান ঘটবে, শ্রমিকরা পাবে 'রুটি' আর ভূমিহীন অর্থাৎ কৃষকরা পাবে ‘জমি'। সংক্ষেপে, “শান্তি রুটি ও জমির” স্লোগান বলশেভিকদের জনপ্রিয়তা বর্ধিত করলো ।
৫. জুলাই এর ব্যর্থ অভ্যুত্থান
১৯১৭ সালের জুলাই মাসে সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতগুলোকে দিতে হবে- এই | দাবিতে পেত্রোগ্রাদের রাস্তায় সমবেত হলো অসংখ্য শ্রমিক ও সৈন্য। সামরিক সরকারের আদেশে এই শান্তিপূর্ণ জমায়েতের উপর গুলিবর্ষণ করা হলো। কেরেনস্কি প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করলেন। শুরু হলো বলশেভিকদের উপর পরিকল্পিত দমনপীড়ন । | প্রাণভয়ে লেনিন ফিনল্যান্ডে আশ্রয় নেন ৷
৬. কর্নিলভের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান
তবু বিপ্লব পূর্ণোদমে এগিয়ে চলল। সামরিক সরকার বিপ্লব দমনে অপারগ হওয়ায় বুর্জোয়াদের সমর্থনপুষ্ট প্রধান সেনাধ্যক্ষ কর্নিলভ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু শ্রমিকরা এবং পেত্রোগ্রাদের ও অন্যান্য শহরের সৈন্য ও বাল্টিক নৌবহরের নাবিকরা সেই অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেয় ।
বিপ্লবী শ্রমিকদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিল্পপতিরা কলকারখানা বন্ধ করে দেয়। ফলে উৎপাদন প্রচণ্ড হ্রাস পায়। মজুরি হ্রাস, বেকার, চোরাকারবারিতে দেশ ভরে যায় ।
৭. অর্থনৈতিক সংকট
সাধারণ মানুষের দুর্দশা চরমে ওঠে। এর উপর সাময়িক সরকারের নির্বিচার দমন চলতে থাকে । এই সংকটকালে বলশেভিকদের জনপ্রিয়তা অসাধারণ বৃদ্ধি পায়। শ্রমিকরা কলকারখানা দখল করে নিয়ে মালিকদের বিতাড়িত করে, অনেকক্ষেত্রে উৎপাদন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে। বিভিন্ন স্থানে সোভিয়েত গঠিত হতে থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রে বিপর্যস্ত সৈনিকরা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করে বলশেভিকদের অনুগামী হয় ।
৮. বলশেভিকদের ক্ষমতা দখল
শান্তিপূর্ণ উপায়ে সোভিয়েতগুলোর হাতে ক্ষমতা যখন ন্যস্ত করা গেল না এবং জানা গেল যে, সাময়িক সরকার বিপ্লব দমনের জন্য জার্মান সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে পেত্রোগ্রাদ তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে তখন বলশেভিকরা শ্রমিক ও সৈন্যদের আহ্বান করল কৃষকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শক্তি প্রয়োগে সাময়িক সরকারকে উৎখাত করে সোভিয়েত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। তদনুসারে সোভিয়েতগুলো গ্রাম ও শহরের স্থানীয় শাসন অধিকার করতে লাগল। এগুলোতে ছিল বলশেভিকদেরই প্রাধান্য। অন্যদিকে, লেনিনের দক্ষিণহস্ত সরকারি ট্রটস্কি বলশেভিক স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে গঠিত সুযোগ্য লাল ফৌজের সাহায্যে কেরেনস্কি সরকারকে উচ্ছেদ করলেন ৭ নভেম্বর (পুরনো বর্ষপঞ্জি/দিনপঞ্জি অনুসারে ২৫ অক্টোবর)। এইভাবে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে নভেম্বর (বা অক্টোবর) বিপ্লব সংগঠিত হয়।
৫.৮ ১৯১৭ সালের অক্টোবর বা বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্যের কারণ
মার্চ বিপ্লবের সাফল্যের মূলে যে সমস্ত উপাদানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
সেগুলো হলো :
১. দুর্বল জারতন্ত্র সৈন্যবাহিনীর সমর্থন বঞ্চিত
রাশিয়ার জারতন্ত্র ছিল স্বৈরাচারী কিন্তু অযোগ্য ও দুর্বল। এই জারতন্ত্রের প্রতি জনসমর্থন তিরোহিত হয়েছিল। জারশাসনের পশ্চাতে সৈন্যবাহিনীর সমর্থন পর্যন্ত ছিল না। বস্তুত সর্বদেশে সর্বকালে স্বৈরতন্ত্রের শক্তির প্রধান স্তম্ভ হলো সামরিক বাহিনী। এর সমর্থন বঞ্চিত হলেই স্বৈরতন্ত্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের পশ্চাতে সৈন্যবাহিনীর সমর্থন থাকলেও পরে বিপ্লবীরা সেই সমর্থন লাভ করেনি।
২. ১৯০৫ সালের বিপ্লবের শিক্ষা
মার্চ বিপ্লবের সাফল্যের জন্য ১৯০৫ সালের বিপ্লবের শিক্ষা কম সাহায্য করেনি। এই বিপ্লব ব্যর্থ হলেও বিপ্লবীরা সেই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করেছে এবং তাদের দোষত্রুটিগুলো দূর করার চেষ্টা করেছে। এই বিপ্লব চলাকালীন তারা যে সমস্ত বিপ্লবী কাউন্সিল ও সোভিয়েত গঠন করেছিল তারই অনুকরণে ঐ সমস্ত সংস্থা গড়ে তুলে
বি ১৯১৭ সালের উভয় বিপ্লবই (মার্চ ও নভেম্বর বিপ্লব) সাফল্য লাভ করেছে। এ কারণে নে লেনিন যথার্থই বলেছেন যে, “১৯০৫ সালের বিপ্লবের ড্রেস রিহার্সাল ভিন্ন ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্য সম্ভব হতো না ।”
৩. নেতৃত্ব ও বিপ্লবীদের লক্ষ্যের অভিন্নতা
মার্চ বিপ্লবের বুর্জোয়া নেতৃত্ব ও বিপ্লবীদের স্বার্থের আপাত-অভিন্নতা তার অ সাফল্যের জন্য দায়ী ছিল। মেনশেভিকদের তথাকথিত সাম্যবাদী নীতি রুশ শ্রমিকদের এবং সোশ্যাল রেভলিউশনারিদের ভূমির সমবণ্টন নীতি কৃষকদের মোহগ্রস্ত করেছিল। সুতরাং বুর্জোয়া-শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী বিপ্লবকে শক্তিশালী করে তোলে। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের ব্যর্থতার একটি কারণ হলো নেতৃত্ব ও বিপ্লবীদের মধ্যে লক্ষ্যের পার্থক্য। বুর্জোয়া নেতৃত্বের লক্ষ্য ছিল সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক' ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা যাতে জনগণ রাজনৈতিক অধিকার লাভ করে। অন্যদিকে, সাধারণ সম্প্রদায় বা প্রলেতারিয়েতের লক্ষ্য ছিল বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা। অবশ্য শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া নেতৃত্ব সম্বন্ধে শ্রমিক ও কৃষকদের মোহভঙ্গ হয় এবং তারা নভেম্বর বিপ্লবের দিকে ঝুঁকতে থাকে ।
৪. সামরিক সরকারের দুর্বলতা
অন্যদিকে, নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যের মূলে ছিল প্রিন্স লুভভ ও পরে কেরেনস্কি পরিচালিত শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা। সামরিক সরকার প্রকৃতপক্ষে পুরানো শাসনের অথর্ব অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছিল। শ্রমিক-কৃষক-সৈন্যবাহিনী কিছুদিনের মধ্যেই বুঝেছিল বুর্জোয়া স্বার্থরক্ষী এই শাসনব্যবস্থা তাদের কোনো আশাই পূর্ণ করতে পারবে না। তাই তারা এর ধ্বংস সাধনে তৎপর হয়ে ওঠে।
৫. উপযুক্ত পরিবেশ ও যোগ্য নেতৃত্ব
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার ধারাবাহিক বিপর্যয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দুষ্প্রাপ্যতা, খাদ্যাভাব ইত্যাদি বিপ্লবের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। এর সঙ্গে লেনিনের উপযুক্ত নেতৃত্ব। এই মণিকাঞ্চনযোগ নভেম্বর বিপ্লবকে দ্রুত সাফল্যের পথে নিয়ে যায়। সাময়িক সরকার যখন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে তখন লেনিনের আবোস নেতৃত্ব বিপ্লবী শ্রমিক ও কৃষকদের ঐক্য দৃঢ় ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এর
অসাধারণ বাস্তববোধসম্পন্ন লেনিন ‘শান্তি, জমি ও রুটির' ধ্বনি তুলে জনগণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সৈন্যবাহিনীর এক বিরাট অংশের সক্রিয়া সাगान
মর্মমূলে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাই জনগণ জীবনমরণ পণ করে বিপ্লবে শামিল হয়েছিল আর এদের সঠিক পথে পরিচালিত করেছিলেন লেনিনের ও তাঁর সুগঠিত বলশেভিক দলের নেতৃত্ব ।
৬. অনুকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি
তদানীন্তন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যের জন্য কিছু পরিমাণে দায়ী ছিল। বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো পরস্পরবিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধরত ছিল। তারা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে রাশিয়ায় হস্তক্ষেপ করে সমাজতন্ত্রবাদী নভেম্বর বিপ্লবকে ধ্বংস করতে পারেনি।
৭. প্রতিবিপ্লবী শক্তিসমূহের দুর্বলতা
রাশিয়ার অভ্যন্তরে প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলোর দুর্বলতাও নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যের পথ মসৃণ করেছিল। নভেম্বর বিপ্লবের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানগুলো সংহত ছিল না। অন্যদিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পরই রাশিয়ার সাম্যবাদের ভিত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো যথা : ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান প্রভৃতি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সমরাভিযান করে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। অভ্যন্তরীণ প্রতিবিপ্লবী শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির আক্রমণের মোকাবিলার জন্য ট্রটস্কির নেতৃত্বে বিখ্যাত লাল ফৌজ গঠিত হয়। সুগঠিত ও সুযোগ্য লাল ফৌজ এই আক্রমণ সাফল্যের সঙ্গে হটিয়ে দিয়েছিল।
৮. কৃষক/শ্রমিকের সমর্থন
সর্বশেষে, বলশেভিক বিপ্লবের পর কৃষকদের ভূমিক্ষুধা নিবারণের জন্য তাদের মধ্যে ভূমি বণ্টন করা হয়েছিল। এই সমস্ত ভূমিতে কৃষকদের স্থিত স্বার্থ গড়ে ওঠে। বিপ্লব ব্যর্থ হলে এগুলো তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় কৃষকশ্রেণি বিপ্লবীদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। বস্তুত দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের পূর্ণ সমর্থন নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্য নিশ্চিত করেছিল।
৯. লেনিনের সুযোগ্য নেতৃত্ব
রুশ বিপ্লবের প্রধান নায়ক লেনিনের আসল নাম ছিল ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ । কাজান প্রদেশের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৮৭০ সালে লেনিনের জন্ম হয়। লেনিনের
রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস ১৯৪৫ খ্রি. পর্যন্ত
পরিবারের একটি বিপ্লবী ঐতিহ্য ছিল। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য ফাঁসিতে প্রাণ দেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যু, লেনিনের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তিনি জারতন্ত্রের পতন ঘটাতে প্রতিজ্ঞা নেন। লেনিন ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র তিনি কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ডিগ্রি পান কিন্তু চাকরি বা ওকালতি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ছাত্রজীবন থেকে তিনি মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলে যোগ দেন। বিপ্লবী কাজের জন্য তিনি পুলিশের নজরে পড়েন ও স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হন। তিনি সুইজারল্যান্ডে নির্বাসনে দিন কাটাতে থাকেন। সুইজারল্যান্ড থেকে তিনি গোপনে স্বদেশের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
বিদেশে নির্বাসনে থাকার সময়, রাশিয়ায় কীভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়, এজন্য লেনিন নিরন্তর চিন্তা করতেন। তিনি ‘ইকারা' পত্রিকায় বহু প্রবন্ধের দ্বারা রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের সঠিক পথ সম্পর্কে আলোচনা করেন। লেনিন বিশ্বাস করতেন যে, রাশিয়ায় পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের ফলে তাঁর এই ধারণা জন্মায়। পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অপেক্ষা রাশিয়ার সমাজ পিছিয়ে ছিল। বহুদলীয় গণতন্ত্র রাশিয়ার পক্ষে উপযোগী নয় বলে তিনি মনে করতেন। তাছাড়া রুশ শ্রমিকদের শ্রেণিসংগ্রামের পথে মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী অধিকার আদায়ের কথা তিনি ভাবতেন । এজন্য রুশি শ্রমিকদের মধ্যে মার্কসীয় তত্ত্ব প্রচার দ্বারা তাদের শ্রেণিচেতনা জাগরণের উপর তিনি জোর দেন শ্রমিকরাই হলো বিপ্লবের হাতিয়ার। একমাত্র সর্বহারা শ্রমিকরাই বিপ্লব আনতে সক্ষম, একথা তিনি বিশ্বাস করতেন।
লেনিন অলস চিন্তাবিদ ছিলেন না। আদর্শকে কাজে রূপায়ণের ক্ষমতা তাঁর ছিল তাঁর বাস্তব জ্ঞান ছিল খুবই প্রখর। তিনি কঠোর পরিশ্রম করতে পারতেন। নিজের বক্তব্যকে তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে বোঝাতে পারতেন। রাশিয়ায় বিপ্লব সফল হবে এবং শেষ পর্যন্ত শ্রমিকের জয় হবে বলে তিনি দৃঢ় বিশ্বাস করতেন।
১৯১৭ সালের মার্চে বিপ্লবের পর, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে অনিশ্চিত ছিল, সেই সংকট মুহূর্তে লেনিন নির্বাসন থেকে স্বদেশে ফিরে কেরেনস্কি সরকারের বিরোধিতা করবেন। তার ফলে জার্মানির বিরুদ্ধে কেরেনস্কি প্রজাতন্ত্রের যুদ্ধ প্রচেষ্টা বিড়ম্বিত হবে। এজন্য কাইজার সরকার তাঁকে স্বদেশে ফিরতে সাহায্য করে।
লেনিন রাশিয়ায় ফিরে এসে ‘এপ্রিল থিসিস' ঘোষণা করেন। তিনি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটকে পরামর্শ দেন যে, অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে যেন কোনো সহযোগিতা না করা হয়। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে, রাশিয়ায় বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পূর্ণ হয়নি বলে বসে থাকলে চলবে না। বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে শ্রমিকদের দ্বারা, শ্রমিকের স্বার্থে সরকারি ক্ষমতা দখল করতে হবে। ইতিহাস যে সুযোগ এনে দিয়েছে, তার সদ্ব্যবহার না করলে এই সুযোগ আর আসবে না। বুর্জোয়া সরকার এখনও তার শিকড়
বিস্তার করতে পারেনি। একে ধ্বংস করার এটাই উপযুক্ত সময় আর দেরি করা উচিত নয়। লেনিনের ডাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ কমিউনিস্টরা সাড়া দেয়। তিনি ইসকারা পত্রিকায়- “কি করতে হবে” শিরোনামায় এক প্রবন্ধে বিপ্লবের পন্থা সম্পর্কে জানিয়ে দেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, এই যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থরক্ষার জন্য চলছে। বলশেভিক দল এই যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে না। লেনিন বলেন যে, ১৯১৭ সালের মার্চ বিপ্লবে জারতন্ত্রের পতন বুজোয়ারা ঘটায়নি। কমিউনিস্ট শ্রমিক সংগঠনের লাগাতার ধর্মঘটের ফলে জার সরকারের পতন ঘটে। সুতরাং ন্যায্যভাবে জারের পতনের পর বলশেভিকদেরই ক্ষমতা পাওয়া উচিত। মাঝখান থেকে বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্র ক্ষমতা গ্রহণ করে শ্রমিক ও বলশেভিকদের প্রতারণা করেছে। তিনি মেনশেভিকদের “এখনই শ্রমিক বিপ্লবের সময় নয়” এই আপত্তিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেন। তিনি তাঁদের পুঁথিপড়া কমিউনিস্ট বলে বিদ্রূপ করেন।
“রুটি, জমি ও শান্তি" এই তিন ধ্বনি নিয়ে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা নভেম্বর বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিকড়বিহীন অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে। বিপ্লব জয়যুক্ত হয় । লেনিন বিপ্লবী সরকারের প্রধান হন। নব গঠিত সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের সম্মুখে যে অসংখ্য সমস্যা দেখা দেয়, নবগঠিত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য যে বিদেশি আক্রমণ আরম্ভ হয়, লেনিন তা পরাস্ত করে রুশ সমাজতন্ত্রকে জয়যুক্ত করেন। তাঁর কূটনীতি জ্ঞান এবং সঠিক পরিচালনার ফলে রুশ প্রজাতন্ত্র মহাবিপদের হাত থেকে রক্ষা পায় ।
চরমপন্থি কমিউনিস্টদের কাজের ফলে রাশিয়ায় খাদ্য, শিল্প ও অর্থনীতিতে সংকট দেখা দিলে লেনিন পুঁথিগত কমিউনিজম ছেড়ে নব অর্থনীতি বা NEP গ্রহণ করেন। এই নিপ বা নব অর্থনীতি ছিল তাঁর বাস্তবজ্ঞান ও দূরদর্শিতার পরিচায়ক। NEP প্রবর্তনের ফলে ছোট চাষি ও ছোট ব্যবসায়ীরা বিপ্লবী সরকারকে আনুগত্য জানায়। লেনিন তাঁর নব অর্থনীতি দ্বারা মূলত মার্কসবাদকে অক্ষুণ্ণ রাখেন। রাশিয়ার বাস্তব অবস্থা বুঝে তাঁকে সামান্য কিছু আপস করতে হয়। এজন্য লেনিনের নীতিকে মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ বলা হয় ।
ইউরোপের ধনতন্ত্রী দেশগুলোর সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে শত্রুতার কথা লেনিন ভালো রকম জানতেন। এজন্য তিনি তাদের সঙ্গে যে কোনো মূল্যে আপসের চেষ্টা না করে বিদেশি শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে রাশিয়ায় নিজ মর্যাদা অব্যাহত রাখেন । এর আগে তিনি জার্মানির সঙ্গে শান্তিস্থাপন করে ব্রেস্টলিটভস্কের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সান্ধ বহু ক্ষতি স্বীকার করে রাশিয়া গ্রহণ করে। কিন্তু ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি তাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে জার্মানির সঙ্গে একতরফা সন্ধি স্বাক্ষরের জন্য কূপিত হয়। প্যারিসের শান্তি বৈঠকে রাশিয়াকে আহ্বান না করে ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরের ফলে পূর্ব ইউরোপে রুশ সীমান্ত রাশিয়ার মতামত ছাড়াই গঠন করা হয়। এজন্য লেনিন ভার্সাই সন্ধিকে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত বলে অভিহিত করেন। পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো নবগঠিত সোভিয়েত সরকারকে স্বীকৃতি না দিলে, লেনিন হতাশ হননি। তিনি এই বয়কটের প্রতিবাদে জার্মানির সঙ্গে র‍্যাপালোর সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধি পশ্চিমি
রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস ১৯৪৫ খ্রি. পর্যন্ত দেশগুলোকে হতবুদ্ধি করে। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯২৪ সালে এই মহানায়কের যখন জীবনপ্রদীপ নিভে যায় রাশিয়া বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পিতৃভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
লেনিনের রাজনৈতিক প্রতিভা, সংগঠন শক্তি, লক্ষ্য স্থির করার পর তা কা পরিণত করার ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। পশ্চিম ইউরোপের আরাম কেদারাশায়ী বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ তিনি ছিলেন না। বহু ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে তিনি সমাজতান্ত্রিক রুশরাষ্ট্রের পত্তন করেন। যদিও সাম্যবাদীরা ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকে তাঁদের মতবাদ অনুযায়ী গুরুত্ব দেন না; লেনিনের ক্ষেত্রে তারাও শিরে তাঁর কৃতিত্ব স্বীকার করেন। মার্কসীয় বিমূর্ত তত্ত্বকে রাশিয়ার জীবন উপযোগী করে তার Pragmative বা বাস্তব এবং সুযোগমতো প্রয়োগের দ্বারা তিি ফলিত সাম্যবাদের নয়া পথ বিশ্বকে দেখান। জে, এন, ওয়েস্টউ (IN. Westwood) তাঁর 'রাশিয়ার ইতিহাসে' বলেছেন যে, “প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞানের সাহায্যে, লেনিন মার্কসীয় তত্ত্বকে রাশিয়ার উপযোগী করে প্রয়োগ করেন। তাঁর নির্ব ও দৃঢ় ইচ্ছার প্রয়োগে তিনি কমিউনিস্ট রাশিয়া নামক রাষ্ট্রকে গঠন করেন। বলশেভিক নেতাদের মধ্যে লেনিনই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি তাঁর ভুল স্বীকার করার সততা ও সাহস দেখাতেন এবং ভুল স্বীকারের পর নীতি পরিবর্তন করার সাহস দেখাতেন ব্যক্তিগত জীবনে লেনিনের চরিত্র ছিল বৈচিত্র্যহীন, আনন্দময় হাস্য-পরিহাসহীন, নিঃসঙ্গ কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত ।
লেনিনের চিন্তাধারার সফলতা স্বীকার করেও বলা যায় যে, ট্রটস্কি, স্টালিন প্রমুখ নিবেদিতপ্রাণ যোগ্য সহকর্মীর সহায়তা ছাড়া তিনি এতটা সফল হতেন কি না ত অনেকে সন্দেহ করেন। গৃহযুদ্ধের সময় স্টালিনের চেকা ও ট্রটস্কির লাল ফৌজ গঠিত না হলে তাঁর আদর্শের বাস্তবায়নের সুযোগ কমে যেত। দ্বিতীয়ত, ১৯১৭ সালের জুলাই বিদ্রোহে বলশেভিকরা হঠকারিতা দেখায়। তার ফলে স্বয়ং লেনিনকে রাশিয়া ছেড়ে ফিনল্যান্ডে আশ্রয় নিতে হয়। প্রজাতন্ত্রী সরকারের বাস্তব জ্ঞানের অভাব, পরিচালনার জন্য জেদ তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস করে। লেনিন তার সুযোগ নেন। উদারতন্ত্রী সমালোচকদের মতে, লেনিন পার্লামেন্টরি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না এটা দুঃখের । তিনি ১৯১৭ সালে সাধারণ নির্বাচন দ্বারা সে সংবিধান সভা গঠন করেন তাতে বলশেভিকরা সংখ্যালঘু হলে তিনি সেই সংবিধান সভা ভেঙে দেন। তিনি একদলীয় শাসনে বিশ্বাস করতেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে অন্য দলের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে তিনি রাজি ছিলেন না। এপ্রিল থিসিস সম্পর্কে ট্রটস্কির প্রতিবাদ তিনি অগ্রাহ্য করেন। মেনশেভিকদের মতামতকে তিনি গ্রাহ্য করেননি। তাঁর মধ্যে এদিক থেকে ডিরেটরি প্রবণতা কোনো কোনো সমালোচক দেখেন। লেনিন অবশ্য বলেন যে, তিনি যদি ডিক্টেটরিতে বিশ্বাস করেন তা হবে সর্ববাদী বা প্রলিতারিয়েতদের ডিক্টেটরি প্রথা। তিনি রাশিয়াকে সমাজতন্ত্রের ছাঁচে ঢালাই করতে চান এবং তাতে সফল হন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]