. রাশিয়া নয়া/নতুন অর্থনৈতিক নীতি (নেপ) প্রবর্তনের পটভূমি এবং এ নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যা কর ।

নয়া অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, ব্যাংকিং, মুদ্রা ও বাজেট ব্যবস্থা এবং হিসাব ব্যবস্থা বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়। যুদ্ধকালীন অকৃষি অর্থনীতি যেখানে শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। যুদ্ধকালীন সাম্যবাদে কৃষি ও শিল্প সমন্বয় করা হয়। নয়া অর্থনৈতিক নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা। ব্যক্তিগত উদ্যোগকে সরকারিভাবে উৎসাহিত করা হয়। রাষ্ট্র কর্তৃক বাধ্যতামূলক কৃষি উৎপাদন সংগ্রহের নীতি বাতিল করা হয়। কৃষিজ উৎপাদনের উপর কর প্রদানের নীতি প্রবর্তন করা হয়। কৃষি কর প্রদানের পর কৃষকদের তার কৃষিজ পণ্য খোলাবাজারে বিক্রয় করার অধিকার দেওয়া হয়। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষকদের অতিরিক্ত উৎপাদনে আগ্রহী করা হয়। কৃষক যাতে তার অতিরিক্ত কৃষিজ উৎপাদন খোলাবাজারে বিক্রয় করতে পারে সে জন্য খোলাবাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেসব কৃষক নিজেদের উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াবে তাদের জন্য সরকারকে দেওয়া করের পরিমাণ কম হবে। প্রথম দিকে এ কর আদায় করা হত শস্যের বিনিময়ে, কিন্তু ১৯২৪ সালের পরে নগদ অর্থে তা করা হয়। যুদ্ধকালীন সাম্যবাদের সময় পণ্য সামগ্রী ক্রয়, সংগ্রহ ও বণ্টনের উপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রাপ্ত Commisarate of supplies নামক প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত করা হয় এবং সমবায় সমিতিগুলোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯২৫ সালের মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ায় একটি ধনী কৃষক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। নিপম্যান নামে অতিরিক্ত উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল একদল কৃষকের উদ্ভব ঘটে। সরকার মুক্তবাজার ব্যবসায় উৎসাহিত করে। নয়া অর্থনৈতিক নীতিতে কৃষকের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। খাদ্য উৎপাদন ৩৮ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৫১ মিলিয়ন হয়। ক্ষুদ্র জমির মালিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থার পশ্চাতে যুক্তি দেখানো হয় যে, এই ধরনের কৃষক বা ব্যবসায়ীরা কাউকে শোষণ করে না।
যুদ্ধকালীন সাম্যবাদের সময় শিল্পের জাতীয়করণের যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়। শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রশাসন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। শিল্প পরিচালনা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করা হয়। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যকলাপে সরকারি হস্তক্ষেপ সীমিত করা হয়। বাজেট ঘাটতি মোকাবিলা করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সরকারি ব্যয় হ্রাস করার জন্য সরকারি ভর্তুকি দ্বারা পরিচালিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয় এবং অনুৎপাদনশীল শিল্পপ্রতিষ্ঠান তুলে দেওয়া হয়। লেনিন বলেছিলেন যে, বড় বড় শিল্পকারখানা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং ছোট ছোট শিল্পকারখানা ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত হবে। ১০% বড় বড় শিল্প ও মূল শিল্প কারখানাগুলো রাষ্ট্রের অধীনে থাকে। ৯০% শিল্পকারখানা বেসরকারীকরণ করা হয়। সরকারি
মালিকানাধীন ১০% শিল্প কারখানায় মোট শ্রমিকের ৮০% কাজ করতো। বাকি ২০%, বেসরকারি মালিকাধীন শিল্পকারখানায় কাজ করতো। যেসব কারখানায় কুড়িজনের কম শ্রমিক কাজ করে সেসব কারখানা পুরানো মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। নয়া অর্থনৈতিক নীতিতে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের সমন্বয় করা হয়। বৃহৎ শিল্পকারখানা পরিচালনার জন্য আমেরিকা ও জার্মানির মতো ট্রাস্ট গঠন করা হয়। সরকার মনোনীত ব্যক্তিরা এসব ট্রাস্ট পরিচালনা করতো। এতে ট্রাস্ট উৎপাদন ও বিক্রিতে স্বাধীন ছিল। কিন্তু তাদেরকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করতে হতো। শিল্পায়নের জন্য বিদেশি মূলধন আমন্ত্রণ করা হয়। আমেরিকা, ব্রিটিশ ও জার্মান বিনিয়োগ রাশিয়ার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। সাইমন লিবারম্যান নামে একজন মার্কিন রাশিয়ায় একটি বড় কাঠ ব্যবসায় পরিচালনা করতেন। এর ফলে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি লক্ষ করা যায়। শিল্প উৎপাদন দ্বিগুণ হয়। বাধ্যতামূলকভাবে শ্রমদানের বিষয়টি বাতিল এবং কিছুটা নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক বাণিজ্য চালু করা হয় । শ্রমিকরা তাদের শ্রমের পরিবর্তে বেতন পেতে শুরু করে।
বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার বজায় থাকে। দেশীয় বাণিজ্য পরিচালনার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ১৯২৮ সালের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু বিধিবিধান জারি করা হয়। এসব বিধিবিধানে নিপম্যানরাই প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্নীতির জন্য কিছু লিপম্যানের বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত বণিকরা দেশের মোট খুচরা বাণিজ্যের তিন-চতুর্থাংশ বাণিজ্য পরিচালনার অধিকার অর্জন করে, তবে দেশের মোট বাণিজ্যের কুড়ি শতাংশের উপর ব্যক্তিগত বণিকদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পাইকারি বাণিজ্যের উপর সমবায়গুলোর প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি যথেষ্ট পরিমাণে বজায় থাকে ।
অবনতিশীল অর্থনীতি দেখার জন্য ১৯২৯ সালের কিছু কৃষি ও সমবায় ব্যাংক বেসরকারি খাতে স্থাপন করা হয়। এসব ব্যাংক সঞ্চয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগের জন্য মূলধন সৃষ্টি করে। এর ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হয়। ১৯২১ সালের রাশিয়ার ইতিহাসে সর্বপ্রথম ব্যক্তিগত সম্পত্তির জন্য বিমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা ছিল সম্পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিপরীত ।
১৯২৪ সালে কাগজি মুদ্রার নকল প্রতিরোধের জন্য Chervonetz নামে একটি ধাতব মুদ্রা জারি করা হয়। এক Chervonetz ৫ ডলারের সমান ছিল। ১৯২৪ সালে সর্বপ্রথম বাজেট প্রথা চালু করা হয় ।
হিসাব ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। প্রতিটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে Balance Sheet প্রকাশ করতে হতো। প্রথমবারের মতো এটা ছিল একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন
সার্বিকভাবে নয়া অর্থনৈতিক নীতির তাৎপর্য হলো মিশ্র অর্থনীতির প্রবর্তন। এই মিশ্র অর্থনীতির মাধ্যমে রাশিয়া আর্থসামাজিক কাঠামোর সম্পূর্ণ পতন থেকে নিজেকে রক্ষা করে। ল্যাংসামের মতে, নয়া অর্থনৈতিক নীতি উৎপাদন ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে যুদ্ধ অবস্থায় ফিরিয়ে আনে এবং প্রাথমিক সাম্যবাদী অভিজ্ঞতার শর্তগুলো নিরাময়
শস্যের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ১৯২৬ সালে শিল্পের উৎপাদন যুদ্ধ পূর্ব সময়ের উৎপাদনের কাছাকাছি যায়। J. J. Hampded বলেন, "The country recovered from the famine of the civil war years, the peasants lived well and in towns there was food for all who had money to buy. The export trade of Russia rose in volume, rising from 1.4 million roubles in 1920 to 20.2 million in 1921, 81.6 million in 1922, 205.8 million in 1923. Economic recovery had been achieved. "
৭.৩ নয়া অর্থনৈতিক নীতির কারণ (Causes)
ক. অর্থনৈতিক কারণ
নয়া অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের অব্যবহিত পূর্বে রাশিয়ায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নৈরাজ্য, হতাশা এবং বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল। যুদ্ধকালীন সাম্যবাদের আওতায় কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, মুদ্রা ও ব্যাংক ব্যবস্থায় যেসব পদক্ষেপ গৃহীত হয় সেগুলো প্রতিবিপ্লবী শক্তি ও অসচেতন মেহনতি মানুষের অসহযোগিতার ফলে প্রায় সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থতার সম্মুখীন হয় । অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিরাজমান পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ :
:
১. যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ নীতির আওতায় কৃষকদের নিকট থেকে বাধ্যতামূলক খাদ্যশস্য আদায়ের নীতি গৃহীত হয়। এতে কৃষকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক । কারণ কৃষকরা চাচ্ছিল তাদের খেতের উদ্বৃত্ত ফসল বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে তাদের নিজ নিজ আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি করতে। কিন্তু বলশেভিক সরকার লক্ষ করে যে, খাদ্যশস্য বেশি দামে বিক্রি হলে কারখানার শ্রমিক ও শহরের মধ্যবিত্তরা চড়া দামে খাদ্যশস্য কিনতে পারবে না। এজন্য সরকার আইন করে যে, কৃষকদের নগদ টাকায় করের বদলে উদ্বৃত্ত ফসল সরকারকে দিতে হবে। ফসল আদায়ে কৃষকদের উপর জবরদস্তি করা হয় এবং জোর করে বাড়তি ফসল আদায়ের চেষ্টা করা হয়। কৃষকরা এই ব্যবস্থার প্রতিবাদে খোরাকির মতো জমি চাষ করে বাকি জমি অনাবাদি রাখে। আবার অনেকে শস্যের গোলা, গৃহপালিত পশু লুকিয়ে রেখে কৃষি ব্যবস্থার ক্ষতিসাধনে
কতিপয় বিশেষ সংস্থার উপর ন্যস্ত করা হয়। ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রচলিত ব্যবসা-বাণিজ্যের সরবরাহ কাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু দ্রব্যসামগ্রী বণ্টনে নিয়োজিত সংস্থাসমূহের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অদক্ষতার দরুন শহর ও গ্রামের মধ্যে ৪ শিল্পজাত দ্রব্যের সুষ্ঠু বণ্টনের নিশ্চয়তা বিধান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এছাড়া পরিবহণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। রেল ইঞ্জিনের এবং মালগাড়ির ওয়াগণের অভাবে কাঁচামাল ও খাদ্য পরিবহণে সংকট দেখা দেয়।
৪. যুদ্ধকালীন সাম্যবাদের আওতায় দেশীয় সংস্থা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং গৃহীত নীতি উৎপাদন বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎপাদনের ক্রমাবনতি এবং পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ বণ্টন ব্যবস্থার দরুন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে। এর ফলশ্রুতিতে অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির উদ্ভব ঘটে ।
খ. সামাজিক কারণ
সরকার যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ সময়ে গ্রামের বিত্তশালী কৃষক অর্থাৎ কুলাকদের নিকট থেকে বাধ্যতামূলক উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য সংগ্রহের প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। কিন্তু রাষ্ট্রের নিকট খাদ্য প্রদানে কৃষকরা রাজি ছিল না। ফলে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য সংগ্রহে সরকার গ্রামে সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য সংগ্রহের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি : (১) শিল্প শ্রমিকদের খাদ্য দ্রব্যের যোগান নিশ্চিত করা এবং (২) গ্রামাঞ্চলে বিপ্লব বিরোধী কুলাকদের আধিপত্য হ্রাস করা। এ উদ্দেশ্য সম্পর্কে অসচেতন থাকায় গ্রামে সেনাবাহিনী দ্বারা খাদ্যশস্য সংগ্রহ সাধারণ ও মধ্যবিত্ত কৃষকগণও সুনজরে দেখেনি। সেনাবাহিনীর প্রতি বৈরী মনোভাবের দরুন গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সমন্বয়ে পরবর্তী সময়ে কমিটি গঠন করে বাধ্যতামূলক উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য সংগ্রহ নীতি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা নেওয়া হয় । কিন্তু এই কমিটিও খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে গেলে কুলাকদের সাথে দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়। কৃষকদের মধ্যে এরূপ অবস্থা থাকায় সামাজিক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা প্রকট আকার ধারণ করে।
গ. রাজনৈতিক কারণ
বিপ্লবের অব্যবহিত পরে রাশিয়ায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভয়াবহ সংকটের সৃষ্টি হয়। বিপ্লবের বিরুদ্ধবাদীরা বিশেষত কুলাকশ্রেণি দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, উৎপাদন ধ্বংস ও অন্যান্য উপায়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিরোধিতা করতে শুরু করে। আবার অন্যদিকে শিল্পক্ষেত্রে নৈরাজ্য ও হতাশার জন্য শ্রমিক অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। অধিকন্তু একই সময়ে রাশিয়ায় ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ কয়েকটি বৈদেশিক রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ফলে দেশের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়। এভাবে একদিকে বিপ্লবের বিরুদ্ধবাদী ও প্রতিবিপ্লবী শক্তির বিরুদ্ধাচরণ এবং অন্যদিকে শ্রমিক অসন্তোষ ও বৈদেশিক শক্তির হস্তক্ষেপ বলশেভিক সরকারকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সন্দিহান করে তোলে । তাই সরকার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে রক্ষার জন্য নয়া ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
নয়া অর্থনৈতিক নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ (Main features) রাশিয়ার জনগণের দুঃখদুর্দশা ও সীমাহীন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে লেনিন বুঝছে। পারলেন যে, তাঁর বিশুদ্ধ সাম্যবাদের পরীক্ষা আশানুরূপ সাফল্যলাভ করেনি। তাই ত সহকর্মীদের নিষেধ সত্ত্বেও লেনিন তা থেকে কৌশলগত পশ্চাদপসরণের নীতি গ্রহ করলেন। তাঁর দৃষ্টিতে এই বিপর্যয়ের কারণ সাম্যবাদের অতি দ্রুত রূপায়ণ। তার পুরানো ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছু নীতি পুনরায় গৃহীত হলো। ধনতন্ত্র সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে 'নয়া অর্থনৈতিক নীতি' (New Economic Policy বা সংক্ষেপে NEP) প্রবর্তন করলেন লেনিন। যুদ্ধভিত্তিক সাম্যবাদ থেকে ঐ
বি পশ্চাদপসরণ ১৯২১ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। নয়া অর্থনৈতিক নীতিজ প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. নয়া অর্থনৈতিক নীতির প্রথম পদক্ষেপ হলো : কৃষকদের উদ্বৃত্ত শস্য গ্রহণের নীতি পরিত্যক্ত হলো। এর পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর গ্রহণের নীতি গৃহীত হল। ভূসম্পত্তির মালিকানার ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে এই কর ন্যস্ত হয়-প্রকৃত কৃষকরা অব্যাহতি পায়, মধ্যবিত্ত কৃষকদের সামান্য কর দিতে হতো কিন্তু এদের তুলনায় কুলাকদের করভার বেশি ছিল। এই কর মেটানোর পর কৃষক তার উদ্বৃত্ত শস্য খোলাবাজারে বিক্রয়ের সুবিধা পায় ।
২. কৃষকদের খামারের যাতে বিকাশ ঘটে সেজন্য গ্রামাঞ্চলে সমবায় প্রবা উৎসাহিত করা হয়। বিভিন্ন ধরনের সমবায় সমিতিতে কৃষকরা স্বেচ্ছায় যোগদান করতে পারত। সরকারি ঋণ ও করদান থেকে অব্যাহতি ইত্যাদি বহু সুবিধা এই সমবায় সমিতিগুলি লাভ করতো।
৩. যে সমস্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কুড়ি জনের কম সংখ্যক শ্রমিক নিযুক্ত থাকত সেগুলি মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি শিল্পপতিদের ছোট ফ্যাক্টরি নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয় ।
৪. শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয় এবং দেশের
বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে সংযোগ ও সমন্বয়ের পরিকল্পনা রচিত হয়।
৫. জোরজবরদস্তিভাবে শিল্পে শ্রমিক নিয়োগের নীতি ও শ্রমিক মাত্রেই ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার নীতি পরিত্যক্ত হয়। কর্মসংস্থান কেন্দ্রের মাধ্যমে নথিভুক্ত শ্রমিকদের শিল্পে নিয়োগের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। কাজের পরিমাণ ও গুণগত উৎকর্ষের ভিত্তিতে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করার ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ফলে তাদের মধ্যে কর্মদক্ষতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দেয় ।
অর্থনেতিক অবস্থাকে স্থিতিশীল করার জন্য স্বর্ণের ভিত্তিতে দশ রুবলের এক নয়া কাগজি মুদ্রা প্রচলিত হয় ।
বিদেশি মূলধন ৭. বিদেশি
মূলধন আকর্ষণ করার জন্য অনেক কলকারখানা বিদেশি মূলধানদের সহজ শর্তে ইজারা দেওয়া হয় এবং তাদের মূলধনে গঠিত শিল্প নির্দিষ্টকালের মধ্যে জাতীয়করণ করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। লেনিন-প্রবর্তিত নয়া অর্থনৈতিক নীতি অবলম্বনের ফলে রাশিয়ায় কৃষি ও শিল্পের অভাবনীয় উন্নতি ঘটে এবং বলশেভিক শাসনের প্রাথমিক পর্বের অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রাশিয়া পরিত্রাণ পায়। পশ্চিমি সমালোচকরা এটিকে সাম্যবাদ থেকে বিচ্যুতি ও ধনতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের প্রাথমিক পদক্ষেপ বলে চিহ্নিত করলেও প্রকৃতপক্ষে সাম্যবাদ থেকে এই পশ্চাদপদসরণ ছিল সাময়িক এবং এটি ছিল ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে একটি ফলপ্রসূ সমন্বয় । জাতীয় অর্থনীতির মূল বিষয়গুলো-ব্যাংকিং, যানবাহন, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য-সমস্তই ছিল সোভিয়েত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। এগুলোর বিকাশ ও বিবর্ধনেই সোভিয়েত রাষ্ট্র আত্মনিয়োগ করেছিল, সেই সঙ্গে ধনতান্ত্রিক প্রবণতাগুলো ক্রমশ দুর্বল করার নীতি গ্রহণ করেছিল। নয়া অর্থনৈতিক নীতি সোভিয়েত রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে তোলে এবং ধীরে ধীরে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বিকাশের পথ মসৃণ করে। এছাড়া, রাশিয়ায় বিদেশি পরিচালিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত রুশ প্রযুক্তিবিদরা প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা লাভ করে দক্ষতা অর্জন করে। যখন বিদেশিরা অপসারিত হয়েছিল তখন রাশিয়ার শিল্পোন্নতিতে এই অভিজ্ঞতা ছিল অত্যন্ত মূল্যবান । আবার, নয়া অর্থনৈতিক নীতির স্থিতিকালে সরকারি ব্যুরোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবস্থার সংগৃহীত পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে বিখ্যাত প্রথম রুশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা রচিত হতে থাকে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]