সোভিয়েত সরকার নয়া অর্থনৈতিক নীতির অধীনে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে? নয়া অর্থনৈতিক নীতির প্রবক্তা হিসেবে লেনিনের কৃতিত্ব নিরূপণ কর।

নয়া অর্থনৈতিক নীতির প্রবক্তা লেনিনের কৃতিত্ব (The
Achievements of Lenin)
রুশ বিপ্লবের প্রধান নায়ক লেনিনের আসল নাম ছিল ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। কাজান প্রদেশের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৮৭০ সালে লেনিনের জন্ম হয়। লেনিনের পরিবারের একটি বিপ্লবী ঐতিহ্য ছিল। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য ফাঁসিতে প্রাণ দেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যু লেনিনের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তিনি জারতন্ত্রের পতন ঘটাতে প্রতিজ্ঞা নেন। লেনিন ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। তিনি কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ডিগ্রি পান। কিন্তু চাকরি বা ওকালতি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ছাত্রজীবন থেকে তিনি মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সোস্যাল ডেমোক্র্যাট দলে যোগ দেন। বিপ্লবী কাজের জন্য তিনি পুলিশের নজরে পড়ে ও স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হন। তিনি সুইজারল্যান্ডে নির্বাসনে দিন কাটাতে থাকেন। সুইজারল্যান্ড থেকে তিনি গোপনে স্বদেশের সোস্যাল ডেমোক্র্যাট দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। দেশ পুনর্গঠনে একটি নয়া অর্থনৈতিক নীতি তার ভাবনা জুড়ে ছিল।
বিদেশে নির্বাসনে থাকার সময় রাশিয়ায় কীভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়, এজন্য লেনিন নিরন্তর চিন্তা করতেন। তিনি ইস্কারা পত্রিকায় বহু প্রবন্ধের দ্বারা রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের সঠিক পথ সম্পর্কে আলোচনা করেন। লেনিন বিশ্বাস করতেন যে, রাশিয়ায় পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের ফলে তাঁর এই ধারণা জন্মায়। পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অপেক্ষা রাশিয়ার সমাজ পিছিয়ে ছিল। বহুদলীয় গণতন্ত্র রাশিয়ার পক্ষে উপযোগী নয় বলে তিনি মনে করতেন। তাছাড়া রুশ শ্রমিকদের শ্রেণিসংগ্রামের পথে মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী অধিকার আদায়ের কথা তিনি ভাবতেন। এজন্য রুশি শ্রমিকদের মধ্যে মার্কসীয় তত্ত্ব প্রচার দ্বারা তাদের শ্রেণিচেতনা জাগরণের উপর তিনি জোর দেন। শ্রমিকরাই বিপ্লবের হাতিয়ার। একমাত্র সর্বহারা শ্রমিকরাই বিপ্লব আনতে সক্ষম, একথা তিনি বিশ্বাস করতেন।
লেনিন অলস চিন্তাবিদ ছিলেন না। আদর্শকে কাজে রূপায়ণের ক্ষমতা তাঁর ছিল। তাঁর বাস্তবজ্ঞান ছিল প্রখর। তিনি কঠোর পরিশ্রম করতে পারতেন। নিজের বক্তব্যকে তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে বোঝাতে পারতেন। রাশিয়ায় বিপ্লব সফল হবে এবং শেষ পর্যন্ত শ্রমিকের জয় হবে ও নয়া অর্থনীতি প্রবর্তিত হবে বলে তিনি দৃঢ় বিশ্বাস করতেন ।
১৯১৭ সালে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর সোস্যাল ডেমোক্র্যাট দল যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে অনিশ্চিত ছিল, সেই সংকট সময়ে লেনিন নির্বাসন থেকে স্বদেশে ফিরে কেরেনস্কি সরকারের বিরোধিতা করবেন। তার ফলে জার্মানির বিরুদ্ধে কেরেনস্কি প্রজাতন্ত্রের যুদ্ধ প্রচেষ্টা বিড়ম্বিত হবে। এজন্য কাইজার সরকার তাঁকে স্বদেশে ফিরতে সাহায্য করে ।
লেনিন রাশিয়ায় ফিরে এসে এপ্রিল থিসিস ঘোষণা করেন। তিনি সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের পরামর্শ দেন যে, অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে যেন কোনো সহযোগিতা না করা হয়। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে, রাশিয়ায় বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পূর্ণ হয়নি বলে বসে থাকলে চলবে না। বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে শ্রমিকদের দ্বারা, শ্রমিকের স্বার্থে সরকারি ক্ষমতা দখল করতে হবে। ইতিহাস যে সুযোগ এনে দিয়েছে, তার সদ্ব্যবহার না করলে এই সুযোগ আর আসবে না। বুর্জোয়া সরকার এখনো তার শিকড় বিস্তার করতে পারেনি। একে ধ্বংস করার এটাই উপযুক্ত সময় আর দেরি করা উচিত নয়। লেনিনের ডাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ কমিউনিস্টরা সাড়া দেয়। তিনি ইস্কারা পত্রিকায়- “কি করতে হবে” শিরোনামে এক প্রবন্ধে বিপ্লবের পন্থা সম্পর্কে জানিয়ে দেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, এই যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থরক্ষার জন্য চলছে। বলশেভিক দল এই যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে না। লেনিন বলেন, ১৯১৭ সালে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে জারতন্ত্রের পতন বুর্জোয়ারা ঘটায়নি। কমিউনিস্ট শ্রমিক সংগঠনের লাগাতার ধর্মঘটের ফলে জার সরকারের পতন ঘটে। সুতরাং ন্যায্যভাবে জারের পতনের পর বলশেভিকদেরই ক্ষমতা পাওয়া উচিত। মাঝখান থেকে বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্র ক্ষমতা গ্রহণ করে শ্রমিক ও বলশেভিকদের প্রতারণা করেছে। তিনি মেনশেভিকদের “এখনই শ্রমিক বিপ্লবের সময় নয়” এই আপত্তিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিন। তিনি তাঁদের পুঁথিপড়া কমিউনিস্ট বলে বিদ্রুপ করেন।
“রুটি, জমি ও শান্তি” এই তিন ধ্বনি নিয়ে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা অক্টোবর বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিকড়হীন অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে। বিপ্লব জয়যুক্ত হয়। লেনিন বিপ্লবী সরকারের প্রধান হন। নব গঠিত সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের সম্মুখে যে অসংখ্য সমস্যা দেখা দেয়, নবগঠিত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য যে বিদেশি আক্রমণ আরম্ভ হয়, লেনিন তা পরাস্ত করে রুশ সমাজতন্ত্রকে মহাবিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন।
রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস ১৯৪৫ খ্রি. পর্যন্ত চরমপন্থি কমিউনিস্টদের কাজের ফলে রাশিয়ায় খাদ্য, শিল্প ও
অর্থনীতিতে
সংকট দেখা দিলে লেনিন পুঁথিগত কমিউনিজম ছেড়ে নতুন অর্থনীতি বা নয়া NEP
গ্রহণ করেন। এই নিপ বা নয়া অর্থনীতি ছিল তাঁর বাস্তবজ্ঞান ও
দূরদর্শিতার
পরিচায়ক। NEP প্রবর্তনের ফলে ছোট চাষি ও ছোট ব্যবসায়ীরা বিপ্লবী সরকারকে আনুগত্য জানায়। লেনিন তাঁর নব অর্থনীতি দ্বারা মূলত মার্কসবাদকে অক্ষুণ্ণ রাখেন। রাশিয়ার বাস্তব অবস্থা বুঝে তাঁকে সামান্য কিছু আপস করতে হয়। এজন্য লেনিনের নীতিকে মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ বলা হয়।
ইউরোপের ধনতন্ত্রী দেশগুলোর সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে শত্রুতার কথা লেনিন ভালো রকম জানতেন। এজন্য তিনি তাদের সঙ্গে যে কোনো মূল্যে আপসের চেষ্টা না করে বিদেশি শক্তিগুলির বিরুদ্ধে রাশিয়ার নিজ মর্যাদা অব্যাহত রাখেন। এর আগে তিনি জার্মানির সঙ্গে শান্তিস্থাপন করে ব্রেস্টলিটভস্কের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধি বহু ক্ষতি স্বীকার করে রাশিয়া স্বাক্ষর করে। কিন্তু ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি তাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে জার্মানির সঙ্গে একতরফা সন্ধি স্থাপনের জন্য অসন্তুষ্ট হয়। প্যারিসের শান্তি বৈঠকে রাশিয়াকে আহ্বান না করে ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরের ফলে পূর্ব ইউরোপে রুশ সীমান্ত রাশিয়ার মতামত ছাড়াই গঠন করা হয়। এজন্য লেনিন ভার্সাই সন্ধিকে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত বলে অভিহিত করেন। পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো নবগঠিত সোভিয়েত সরকারকে স্বীকৃতি না দিলে, লেনিন হতাশ হননি। তিনি এই বয়কটের প্রতিবাদে জার্মানির সঙ্গে র‍্যাপালোর সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধি পশ্চিমি
দেশগুলোকে হতবুদ্ধি করে। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯২৪ সালে এই মহানায়কের যখন জীবনপ্রদীপ নিভে যায় তখন সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পিতৃভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
লেনিনের রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিভা, সাংগঠনিক শক্তি, লক্ষ্য স্থির করার পর তা কার্যে পরিণত করার ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। পশ্চিম ইউরোপের আরাম কেদারাময়ী বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ তিনি ছিলেন না। বহু ঝড় ঝাপটার মধ্য দিয়ে তিনি সমাজতান্ত্রিক রুশ রাষ্ট্রের পত্তন করেন। যদিও সাম্যবাদীরা ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকে তাঁদের মতবাদ অনুযায়ী গুরুত্ব দেন না; লেনিনের ক্ষেত্রে তাঁরাও শ্রদ্ধাবনত শিরে তাঁর কৃতিত্ব স্বীকার করেন। মার্কসীয় বিমূর্ত তত্ত্বকে রাশিয়ার জীবনধারার উপযোগী করে তার Pragmative বা বাস্তব এবং সুযোগমতো প্রয়োগের দ্বারা তিনি ফলিত সাম্যবাদের নয়া পথ বিশ্বকে দেখান। জে. এন. ওয়েস্টউড (J. N. Westwood) তাঁর রাশিয়ার ইতিহাসে বলেছেন যে, “প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞানের সাহায্যে লেনিন মার্কসীয় তত্ত্বকে রাশিয়ার উপযোগী করে প্রয়োগ করেন। তাঁর নির্মম ও দৃঢ় ইচ্ছার প্রয়োগে তিনি কমিউনিস্ট নামক রাষ্ট্রকে গঠন করেন। বলশেভিক নেতাদের মধ্যে লেনিনই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি তাঁর ভুল স্বীকার করার সত্যতা ও সাহস দেখাতেন এবং ভুল স্বীকারের পর নীতি পরিবর্তন করার সাহস দেখাতেন।” ব্যক্তিগত জীবনে লেনিনের চরিত্র ছিল বৈচিত্র্যহীন, আনন্দময় হাস্য-পরিহাসহীন, নিঃসঙ্গ কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত ।
লেনিনের চিন্তাধারার সফলতা স্বীকার করেও বলা যায় যে, ট্রটস্কি, স্টালিন প্রমুখ নিবেদিতপ্রাণ যোগ্য সহকর্মীর সহায়তা ছাড়া তিনি এতটা সফল হতেন কি না তা অনেকে সন্দেহ করেন। গৃহযুদ্ধের সময় স্টালিনের চেকা ও ট্রটস্কির লাল ফৌজ গঠিত। না হলে তাঁর আদর্শের বাস্তবায়নের সুযোগ কমে যেত। দ্বিতীয়ত, ১৯১৭ সালে জুলাই। বিদ্রোহে বলশেভিকরা হঠকারিতা দেখায়। তার ফলে স্বয়ং লেনিনকে রাশিয়া ছেড়ে ফিনল্যান্ডে আশ্রয় নিতে হয়। প্রজাতন্ত্রী সরকারের বাস্তব জ্ঞানের অভাব, যুদ্ধ পরিচালনার জন্য জেদ তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস করে। লেনিন তার সুযোগ নেন। উদারতন্ত্রী সমালোচকদের মতে, লেনিন পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না এটা দুঃখের। তিনি ১৯১৭ সালে সাধারণ নির্বাচন দ্বারা যে সংবিধান সভা গঠন করেন তাতে। বলশেভিকরা সংখ্যালঘু হলে তিনি সেই সংবিধান সভা ভেঙে দেন। তিনি একদলীয় শাসনে বিশ্বাস করতেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে অন্য দলের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে তিনি রাজি ছিলেন না। এপ্রিল থিসিস সম্পর্কে ট্রটস্কির প্রতিবাদ তিনি অগ্রাহ্য করেন। মেনশেভিকদের মতামতকে তিনি গ্রাহ্য করেননি। তাঁর মধ্যে এদিক থেকে ডিক্টেটরি প্রবণতা কোনো কোনো সমালোচক দেখেন। লেনিন অবশ্য বলেন যে, তিনি যদি ডিক্টেটরিতে বিশ্বাস করেন তা হবে সর্ববাদী বা প্রলেতারীয়দের ডিক্টেটরি প্রথা। তিনি রাশিয়াকে সমাজতন্ত্রের ছাঁচে ঢালাই করতে চান এবং তাতে সফল হন। আর এ সফলতার পেছনে তার নয়া অর্থনৈতিক নীতি খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল ।
নয়া অর্থনৈতিক নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অর্থনৈতিক পদক্ষেপ। ১৯২১ সালের মার্চ মাসে বলশেভিক দলের দশম অধিবেশনে লেনিনের প্রস্তাবিত নয়া অর্থনৈতিক (নেপ) গৃহীত হয়। এটি ছিল অভিনব অর্থনৈতিক নীতি যার উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা। বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্যের জন্য নয়া অর্থনৈতিক নীতি ফলপ্রসূ হয়েছিল। কেননা ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্বে রাশিয়া প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। বলশেভিক তথা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধ ও বৈদেশিক আক্রমণের ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয় এবং দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করে শিশু সমাজতন্ত্রকে রক্ষার জন্য সমগ্র উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা এবং সকল প্রকার ভূসম্পত্তি, শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রণের নীতি গৃহীত হয়। এ নীতির নাম 'Wartime Communism' বা যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ। লেনিনের মতে, এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা ছিল। ১৯১৮ সালে রাশিয়ায় ‘যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ' নীতি গৃহীত হয়। এসময় একদিকে যুদ্ধ ও ধ্বংস অন্যদিকে অনাবৃষ্টি এবং বড় ও মাঝারি কৃষকদের ফসল উৎপাদনে অসহযোগিতার দরুন রাশিয়ায় ১৯২০ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অর্থনৈতিক অভাব অনটনে জনগণের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। উদ্ভূত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে যুদ্ধকালীন সাম্যবাদী ব্যবস্থার উদ্দেশ্যাবলি প্রাথমিকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ফলে যুদ্ধকালীন সাম্যবাদী ব্যবস্থার
বিকল্প হিসেবে ১৯২১ সালে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ১০ম কংগ্রেসে 'নয়া অর্থনৈতিক নীতি' (New Economic Policy) আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এ ব্যবস্থাকে লেনিন রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ বলে উঠে।
করেছিলেন। উগ্রপন্থি মার্কসবাদীরা প্রথমদিকে এই নীতির বিরোধী ছিল। লেনিন তাদের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে সীমিতভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্ষুদ্র জমির মালিকদের জমির মালিকানা ফেরত দিয়ে ১৯২১ সালের ১০ মার্চ একটি ডিক্রি জারি এবং এ 'নয়া অর্থনৈতিক নীতি' কার্যকরী করেন। এই নীতিতে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় খাতের সহাবস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯২৮ সালে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দ্বারা স্টালিন নয়া অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তন সাধন করেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়ে ইউনিয়ন প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯২১ সালের মার্চ মাসে
বলশেভিক দলের দশম অধিবেশনে লেনিনের প্রস্তাবিত নয়া অর্থনৈতিক নীতি বা নেপ (New Economic Policy) গৃহীত হয়। এটা ছিল একটি অভিনব অর্থনৈতিক নীতি যার উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার অর্থনীতিকে আসন্ন ধ্বংস থেকে রক্ষা করা। আসলে নয়া অর্থনৈতিক নীতি ছিল রাশিয়ার সাম্যবাদী নেতাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কৌশলগত পশ্চাদপসরণ। ডেভিড টমসনের মতে, এটি ছিল ভবিষ্যতে দু কদম এগোবার জন্য এক কদম পিছু হটা। সিডনি হারকেড লিখেছেন, "It was rather a calculated relaxation of policy in the economic field, designed to saveguard internal political stability and to encaurage economic recovery so that a new drive for the attainment of Communist economic goals might be safely undertaken later. " রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ নয়া অর্থনৈতিক নীতি অন্তর্ভুক্ত ছিল যা পরস্পর বিরোধী। নয়া অর্থনৈতিক নীতিকে প্রাগমেটিক সাম্যবাদ বা প্রয়োজনভিত্তিক সাম্যবাদ বলা হয়। এর অর্থ হলো এই যে, রাশিয়ার প্রয়োজন বুঝে সাম্যবাদী নীতি প্রয়োগ করা হয়। এতে মার্কসবাদকে অক্ষরে অক্ষরে প্রয়োগ করা হয়নি। নয়া অর্থনৈতিক নীতিতে খুবই অল্প সময়েই সুফল দেখা দিয়েছিল। কৃষি উৎপাদন ৩০%, তেলে ৪২% এবং শিল্পে ৪০% উৎপাদন বাড়ে, রাশিয়া দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগোয়। এই নীতি ছিল বিশুদ্ধ মার্কসীয় চিন্তা থেকে কিছুটা ভিন্ন। ১৯২১ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত নয়া অর্থনৈতিক নীতি রাশিয়ায় বলবৎ ছিল এবং এটি দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করেছিল । কার্লটন হেজ ও পার্কার মুনের মতে, NEP সমাজতন্ত্র এবং ধনতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করার চেষ্টা করে এবং সাময়িকভাবে সোভিয়েত অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তোলে । বলা যেতে পারে লেনিন নয়া অর্থনৈতিক নীতি দ্বারা বলশেভিক বিপ্লবকে সুসংহত করেন। তাই নয়া অর্থনৈতিক নীতির প্রবক্তা হিসেবে লেনিন অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]