সম্রাট আকবরের বাংলা জয়ের কারণ


সম্রাট আকবরের বাংলা জয়ের কারণ
শুধু দাউদ কররানীর অনুসৃত নীতির ফলেই যে আকবর বাংলা আক্রমণ করেছিলেন, তা নয়। তাঁর বাংলা
জয়ের পেছনে আরো কারণ ছিল। সমগ্র ভারতে একচ্ছত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর লক্ষ্য। সে উদ্দেশ্যে
তিনি একের পর এক রাজ্য জয়ে মনোনিবেশ করেন। গুজরাট অধিকারের পর আকবর কররানী রাজ্য
আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তাই এটা স্পষ্ট যে, বাংলা বিজয় ছিল তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই অংশ।
দ্বিতীয়ত, তাঁর পিতা হুমায়ুন এক সময় বাংলা অধিকার করেছিলেন। চৌসার যুদ্ধের পর শেরশাহ বাংলা
দখল করেন। তাই পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করা তিনি তাঁর কর্তব্য বলে মনে করতেন। তৃতীয়ত, মুঘলরা
আফগানদের পরাজিত করে ভারতের ক্ষমতা দখল করেছিল। তাই পূর্ব শত্রুতার জের ধরে সুযোগ পেলেই
যে আফগানরা মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হবে সে আশঙ্কা বিদ্যমান ছিল। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার
শক্তিধর আফগান রাজ্য হতে যে কোন সময় মুঘলদের বিপদ ঘটার সম্ভাবনা ছিল। এ কারণে কররানী রাজ্য
জয় করে আফগান শক্তি নির্মুল করা অতীব জরুরী কাজ বলে আকবর বিবেচনা করেছিলেন।
বাংলা বিজয়ের বিবরণ
সুলায়মান কররানীর জীবদ্দশায় সম্রাট আকবর কররানী রাজ্য আক্রমণের সুযোগ পাননি। ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে
গুজরাট অভিযানকালে সম্রাট আকবর সুলায়মান কররানীর মৃত্যু সংবাদ পান। সে সময় অনেকে সম্রাটকে
গুজরাট অভিযান স্থগিত রেখে বাংলা আক্রমণের পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। তিনি
জৌনপুরের মুঘল শাসনকর্তা মুনিম খানকে কররানী রাজ্য জয় করার নির্দেশ দেন।
মুনিম খানের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে বিহার আক্রমণ করে। দাউদ কররানী তাঁর বিশ্বস্ত
উজির লোদি খানকে মুঘল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পাঠান। লোদি খান নগদ তিন লক্ষ টাকা ও
মূল্যবান উপহার করস্বরূপ দিতে রাজি হওয়ায় মুঘল সেনাপতি এক সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হন এবং জৌনপুর
প্রত্যাবর্তন করেন। সম্রাট আকবর এতে মুনিম খানের ওপর অসন্তুষ্ট হন এবং তাঁকে পুনরায় কররানী রাজ্য
অধিকারের নির্দেশ দেন।
মুনিম খান ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় বিহার আক্রমণ করেন। ইতোমধ্যে দাউদ কররানী তাঁর সুযোগ্য উজির
লোদি খানকে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বন্দি ও হত্যা করেন। এর ফলে মুঘলদের প্রতিরোধে যোগ্য সামরিক
নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। মুনিম খান ও তাঁর বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে দাউদ কররানী ও তাঁর সেনাপতিরা
পিছু হটতে বাধ্য হয়। তাঁরা পাটনা দুর্গে আশ্রয় নেন এবং দুর্গ সুরক্ষিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ
করেন। মুনিম খান ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে পাটনা দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু প্রায় নয় মাস
অবরোধের পরও তিনি দুর্গ অধিকারে ব্যর্থ হন। তখন সম্রাট আকবর নিজেই বিহার অভিযানে অগ্রসর হন।
তিনি শক্তি প্রয়োগে পাটনার দুর্ভেদ্য দুর্গ জয়ের পরিবর্তে এক ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। যে হাজীপুর
শহর থেকে পাটনা দুর্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ আসতো তিনি সুকৌশলে তা দখল করে দুর্গের
সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেন। এতে দাউদ কররানী ও তাঁর সেনাপতিরা নিরাশ হয়ে পড়েন এবং
পাটনা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। আকবর পাটনা অধিকার করে কিছুদূর পর্যন্ত পলায়মান আফগানদের


অনুসরণ করেন। শেষে মুনিম খানের ওপর অভিযানের দায়িত্ব দিয়ে তিনি রাজধানী আগ্রায় প্রত্যাবর্তন
করেন।
মুনিম খান সম্রাটের নির্দেশ মোতাবেক দাউদ কররানীকে অনুসরণ করে একে একে সুরথগড়, মুঙ্গের ও
ভাগলপুর অধিকার করেন এবং শেষে কররানী রাজ্যের রাজধানী তান্ডায় প্রবেশ করেন। দাউদ এ সময়ে
সপ্তগ্রাম অর্থাৎ পশ্চিম বাংলার দিকে চলে যান। তাঁকে অনুসরণ করে মুঘল বাহিনী সপ্তগ্রামের দিকে অগ্রসর
হলে দাউদ কররানী উড়িষ্যায় আশ্রয় নেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। মুনিম খানের
অধীনে মুঘল বাহিনী উড়িষ্যায় দাউদের অনুসরণ করে এবং তুকারয় নামক স্থানে দুই পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ
হয় (মার্চ, ১৫৭৫ খ্রি:)। যুদ্ধে দাউদের পরাজয় ঘটে এবং তিনি কটক দুর্গে আশ্রয় নেন। শেষ পর্যন্ত নিরাশ
হয়ে তিনি মুনিম খানের সঙ্গে কটকের সন্ধি (১২ এপ্রিল, ১৫৭৫ খ্রি:) স্থাপন করেন। উক্ত সন্ধিতে স্থির হয়
যে বাংলা-বিহার মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হবে এবং দাউদ সম্রাটের সামন্তরূপে উড়িষ্যা শাসন করবেন।
আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ দাউদ সম্রাটের জন্য বহু মূল্যবান উপহার সামগ্রী পাঠান।
কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই দাউদ কররানী কটকে সম্পাদিত চুক্তির শর্তাবলী ভঙ্গ করেন। মুঘল সেনাপতি ও
শাসনকর্তা মুনিম খান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে রাজধানী তান্ডায় মৃত্যুবরণ করলে মুঘল সৈন্যদের মধ্যে নৈরাজ্য ও
বিশৃ´খলা দেখা দেয়। এ সুযোগে দাউদ কররানী পশ্চিম ও উত্তর বাংলা পুনরুদ্ধার করেন এবং রাজধানী
তান্ডায় স্বীয় অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠা করেন। মুঘল সৈন্যরা বাংলা ত্যাগ করে বিহারে আশ্রয় নেয়।
সম্রাট আকবর মুনিম খানের মৃত্যু এবং দাউদের সন্ধি ভঙ্গের সংবাদ পেয়ে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা খান জাহান
হোসেন কুলী খানকে বাংলার শাসনকর্তা ও সেনাপতি নিয়োগ করেন। রাজা টোডরমল তাঁর সহকারী নিযুক্ত
হন। তাঁরা উভয়ে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে আগ্রা হতে বিহার অভিমুখে রওনা হন। বিহারে আশ্রয়
গ্রহণকারী মুঘল সৈন্যদের সাথে তাঁদের সাক্ষাত ঘটে ভাগলপুরে। খান জাহানের নেতৃত্বে বিশাল মুঘল
বাহিনী বাংলার দিকে অগ্রসর হয়। তেলিয়াগর্হিতে একদল আফগান সৈন্য তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করে।
কিন্তু মুঘলদের প্রচন্ড আক্রমণে তারা পালাতে বাধ্য হয়। দাউদ কররানী রাজমহলের প্রবেশ পথে মুঘল
বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং তাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেন। তখন সম্রাটের নির্দেশে
বিহারের শাসনকর্তা মুজাফফর খান তুরবাতি আরো সৈন্য নিয়ে খান জাহানের সঙ্গে যোগ দেন। অবশেষে
১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে রাজমহলের নিকটে এক প্রচন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয় মুঘল ও আফগানদের
মধ্যে। এ যুদ্ধ রাজমহলের যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধে দাউদ কররানী সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও বন্দি হন।
পরে মুঘল সেনাপতিরা তাঁকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করে। এর ফলে বাংলায় কররানী আফগান বংশের রাজত্বের
অবসান ঘটে।
সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলায় মুঘল শাসনের সূত্রপাত হলেও তখন সমগ্র বাংলার ওপর মুঘল আধিপত্য
প্রতিষ্ঠিত হয়নি। খান জাহান রাজমহলের যুদ্ধের পর রাজধানী তান্ডায় প্রবেশ করেন। তিনি মুঘল প্রশাসন
প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি সপ্তগ্রাম অর্থাৎ পশ্চিম বাংলা ও ঘোড়াঘাট বা
উত্তরবঙ্গ অঞ্চল অধিকারে নেন। বিজয়ী মুঘল বাহিনী পূর্ব বাংলায়ও তাদের অভিযান পরিচালনা করে।
মুঘলদের উপস্থিতিতে ভাওয়াল অঞ্চলের জমিদাররা সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন। ভাটি এলাকার
জমিদাররাও প্রথমে মুঘল আধিপত্য মেনে নেন। কিন্তু খান জাহানের রাজধানীতে প্রত্যাবর্তনের পর বৃহৎ
জমিদাররা মুঘল শাসন মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এরফলে মুঘল শাসন কার্যত বাংলার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে। জমিদারদের দমন করার জন্য সম্রাট আকবর শাহবাজ খান, উজির খান ও
রাজা মানসিংহ-এর মতো সেনাপতিদের বাংলার সুবাদার করে পাঠান। কিন্তু আকবরের রাজত্বকালে বাংলার
এসব সামন্ত ভ‚স্বামীদের স্থায়ীভাবে পদানত করা সম্ভব হয়নি। এ কাজটি সম্পন্ন হয় তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীরের
শাসনকালে।


সারসংক্ষেপ
সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয়ের উদ্যোগ ছিল তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই অংশ। তাছাড়া যে
আফগানদের হাত থেকে মুঘলরা ভারতবর্ষের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় সে আফগান শক্তিকে নির্মূল করার
প্রয়োজনীয়তাও তিনি অনুভব করেন। সে উদ্দেশ্যে ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নির্দেশে মুঘল সেনাপতিরা
বাংলা আক্রমণ করেন। কররানী আফগান বংশের শেষ শাসক দাউদ খান কররানীর বিরুদ্ধে পরিচালিত
মুঘল অভিযানের সর্বশেষ ঘটনা ছিল ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের রাজমহলের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে বিজয়ী মুঘল
সেনাপতি খান জাহান বাংলায় মুঘল শাসনের সূচনা করেন। পশ্চিম এবং উত্তরবঙ্গ অধিকার করে মুঘল
বাহিনী পূর্ব বাংলায়ও সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু ভাটি এলাকার সামন্ত ভ‚স্বামীদের
সম্পূর্ণভাবে দমন করা সম্রাট আকবরের সেনাপতিদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সে কারণে সম্রাট আকবরের
সময়কালে বাংলা প্রদেশ বিজিত হলেও মুঘল শাসন কার্যত বাংলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শহর ও দুর্গ
এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে। সমগ্র বাংলার ওপর মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় আকবরের পুত্র ও
উত্তরাধিকারী জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী ঃ
১. আবদুলকরিম, বাংলার ইতিহাস (১২০০Ñ১৮৫৭ খ্রি.)।
২. ড. মুহম্মদ আবদুর রহিম ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস।
৩. গঁযধসসবফ গড়যধৎ অষর, ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব গঁংষরসং ড়ভ ইবহমধষ, ঠড়ষ. ১(অ)
৪. ঔ.ঘ. ঝধৎশধৎ, ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ, ঠড়ষ. ওও.


পাঠোত্তর মূল্যায়নÑ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ঃ
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। কররানী আফগান বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে?
(ক) দাউদ কররানী (খ) তাজ খান কররানী
(গ) সুলায়মান খান কররানী (ঘ) বায়েজিদ কররানী।
২। মুনিম খানের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী কত খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিহার আক্রমণ করে?
(ক) ১৫৬৮ খ্রি: (খ) ১৫৭০ খ্রি:
(গ) ১৫৭২ খ্রি: (ঘ) ১৫৭৪ খ্রি:।
৩। দাউদ কররানীর রাজধানী কোথায় ছিল?
(ক) রাজমহল (খ) গৌড়
(গ) সপ্তগ্রাম (ঘ) তান্ডা।
৪। কটক দুর্গ কোথায় অবস্থিত ছিল?
(ক) বিহার (খ) উড়িষ্যা
(গ) দাক্ষিণাত্য (ঘ) মুর্শিদাবাদ।
৫। রাজমহলের যুদ্ধ কখন অনুষ্ঠিত হয়?
(ক) ১৫৭৫ খ্রি: (খ) ১৫৭৬ খ্রি:
(গ) ১৫৭৭ খ্রি: (ঘ) ১৫৮৬ খ্রি:।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। সম্রাট আকবরের বাংলা জয়ের কারণ উল্লেখ করুন।
২। মুনিম খান সম্পর্কেযা জানেন লিখুন।
৩। দাউদ কররানী সম্পর্কেএকটি টীকা লিখুন।
রচনামূলক প্রশ্ন ঃ
১। সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয়ের পূর্বে বাংলার রাজনৈতিক অবস্থার বর্ণনা দিন।
২। সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয়ের বিবরণ দিন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]